ধোঁয়াশার শেষে পর্ব-৩০+৩১+৩২

0
19

#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ৩০

আমাদ বেড়ে উঠতে লাগলো মায়ের নিকট। এক রাশ অভিমান মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে সে সবসময়। তার মালিক শুধু ছিল বাবা নামের লোকটা। উনি আর ফিরে এলেন না। শুধু ফিরে এলো একদিন একটা ডিভোর্স লেটার। যা পেয়ে আরশি হতভম্ব হয়ে যায়। তার পড়ালেখা সব বন্ধ হয়েছিল আমাদ হওয়ার পরই। এরপর বাসা ভাড়া আর হাত খরচ চলতো আরমান শাহর টাকায়। উনি ততদিনে একজন ডক্টর হয়ে বেরিয়েছেন। আরশি যদিও জানতে পারে আমাদ এর পঞ্চম জন্মদিনে যে আরমান শাহ দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন কিন্তু ইউভানের মা ইরিন একথা জানতেন না। উনি এবিষয়ে অজানা থেকেই মৃত্যু গ্রহণ করেছেন।

আরশির সঙ্গে অনেক কথা কাটাকাটি হয় আরমান শাহর। কিন্তু এই লোকটা ছিল বড্ড স্বার্থপর। উনি বললেন তার সোনার সংসার ছেড়ে তিনি আরশিকে গ্রহণ করবেন না। কাবিনের পাঁচ লক্ষ টাকার সঙ্গে অতিরিক্ত পাঁচ লক্ষ টাকা আমাদ এর মায়ের হাতে দিয়ে উনি ডিভোর্স চান। রাগ হয়েছিল আরশির। উজ্জ্বল ভবিষ্যত ছেড়ে বিশ্বাস করে হাত ধরেছিল আরমানের। কিন্তু সে? এতোটা নিচু তার মানষিকতা? তার দেওয়া টাকা ছুয়েও দেখলেন না তিনি। ডিভোর্স পেপারে সই করে চলে এলেন আমাদ কে নিয়ে। একটা রেস্টুরেন্টে দেখা হয়েছিল তাদের। সেখান থেকে বাবার বাড়িতেও ফিরলেন না। একটা বস্তিতে উঠলেন। যেভাবেই হোক সে আমাদ এর ওপর এর কোন প্রভাব পড়তে দেবেন না। গলায় বাবার বানিয়ে দেওয়া একটা সোনার চেইন ছিল। হাতে একটা সোনার আংটি আর কানে ছিল সোনার দুল। এই সব বিক্রি করে একটা ছোট ফার্মেসি খুললেন তিনি। যেহেতু মেডিকেলে তার দুই বছর পড়া হয়েছিল। বেশ কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা জানতেন। দিন গুলো বেশ কাটছিলো। একদল ধনীর চাইতে বস্তির এক দল মানুষ তাকে খুবই সহায়তা করতো। তার নিরাপত্তা নিয়েও ভাবতে হতো না বেশি। ধীরে ধীরে নারীদের খুব আপন হয়ে ওঠলেন। আমাদ থপ থপ করে হাঁটা হাঁটি করা সমাপ্ত দিল। সে ধুপধাপ পা ফেলে হাঁটতে জানে। সে রাগ করতে জানে। সে মাকে বকা দিতে শিখেছে। ক, ব, ১, ২ শিখে গেছে মায়ের কোলে বসে বড় যত্নে বেড়ে উঠছিল। এভাবে পাঁচ বছর কাটলো। আমাদ স্কুলে যাওয়া শুরু করলো। ছোট ফার্মেসি দিয়ে আর খরচ জমানো হয়ে উঠছে না। আরশি তখন এনজিও থেকে ট্রেনিং নিয়ে গর্ভবতী মহিলাদের সম্পর্কে আরো ভালোভাবে জানাল। পাশের গ্রামে গঞ্জে নিম্নবিত্তদের এই ভয়াবহ বিপদে পাশে থাকা শুরু করলো। এর বিনিময়ে তাকে বেশ কিছু টাকা দেওয়া হত। মা ছেলের দিন বেশ ভালো কাটলেও আরশির পরিশ্রম করতে হতো বেহিসাবি ভাবে।

কিন্তু, আমরা একটা সমাজে সমাজে বসবাস করি। যে সমাজে কেবল আমরাই নেই। আমরা মানে মানুষ। এখানে থাকে কিছু মানুষ রূপের হায়েনা, শেয়ার, নারীক্ষেকো। এমন নিকৃষ্ট শিকারী বোধ হশ সারা জাহানে মিলবে না। যে শিকারীদের শিকার নারী হয়। ঝুম বৃষ্টি, নিঝুম রাত আর একটা মেয়ে। দেখলেই যেন জিভে লেলিয়ে পড়ে ওদের। ঠিক এমনই হয়েছিল। ঘরে একা কলিজার ছেলেকে রেখে গিয়েছিল আরশি পাশের এক গ্রামে। বড়ই গরিব এক পারিবার। অজপাড়া গাঁ। বাচ্চা হতে বেশ সমস্যা হলো। এরকারনে বেলা গড়িয়ে রজনী মিলল। আরশি দ্রত হাঁটছিল। আমাদও ছিল গাল ফুলিয়ে মায়ের অপেক্ষায়। মা ছাড়া ঘুম হয় না, খেতে ইচ্ছে হয় না।কিচ্ছু ভালো লাগে না তার। কিন্তু একথা কি নারীক্ষেকোদের মাথায় ঢুকে? ওরা এতো নিকৃষ্ট কেন? সেদিন ওদের শিকার বানিয়ে নেয় আরশিকে। নির্জন পথ, দুপাশে ধানক্ষেত। আকাশেও গর্জন! এক ভয়ঙ্কর পরিবেশ। বাঁচার চেষ্টায় চিৎকার, হাতাহাতি করেও আরশির ভাগ্য প্রসন্ন হয়নি। তিনজন ছিল ওরা।

এটুকু বলতে গিয়েই আমাদের গলা ধরে এলো। ঠিক যেৃন করে অভিমানে ঠোঁট উল্টে তোলে ইউভান ওমন করেই সে মায়ের নামে অভিমান পুষে ঠোঁট উল্টে তুলল। রক্ত জমে লালিমা ছড়িয়ে পড়েছে তার চোখে মুখে। জারা ভয়ে চেপে উঠেছে। এক লহমায় তার মনে হয়েছিল সে বন্দী হয়। বরং একজন দোষী। কোন এক অজ্ঞাত দোষে তাকে শুনতে হচ্ছে এমন কাহিনি। যদিও আমাদ খোলাখুলি বলছে না। তবে একজন মেয়ের কাছে এমন কাহিনির হালকা বর্ণনাই কলিজা কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। আমাদ ফিরে চায় জারার পানে। মুহুর্তের মাঝে যেন সব আবেগ দমিয়ে নিয়ে হেসে বলে জারার উদ্দেশ্যে

” জাস্ট এটুকু শুনেই তোমার মুখ শুকিয়ে গেছে? এটা মাত্র আট আনা দুঃখ আমার। বাকি আাট আনা শোন। যে চলে যায় তার থেকে কিছু প্রত্যাশা থাকে না। আর মনও খারাপ হয় না। কিন্তু যে বেঁচে থাকে সে যদি কাছে না টানে তাহলে বেঁচে থাকার ইচ্ছে হারিয়ে যায়। ”

জারা বুঝলো এটা আরমান শাহ।

” পুলিশে রিপোর্ট করেননি? ওদের শাস্তি হলো না?”

আমাদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।

” কে বিচার করবে?”
” কেন? পুলিশ? থানার রিপোর্ট করবেন আপনি। দেশে আইন আছে, নিয়ম আছে। ”
” কোন আয়িনের কথা বলছো তুমি? যে আইনের মুখ টাকা দিয়ে বন্ধ করা যায়? যে আইনকে পাওয়ার দিয়ে পাওয়ার অফ করে দেওয়া যায়? যে আইন গরিবের কথা মানে না?”

শেষেরটা ছিল একটা তীব্র চিৎকার সঙ্গে আমাদের ভয়ঙ্কর চাহনি। যার কবলে পরলে যেন কারো রক্ষা নেই।

জারা আর আমাদ এর মাঝে একটা টেবিলের দূরত্ব ছিল। তা ঘুচিয়ে আমাদ টেবিলে হাত রাখে শব্দ করে। কঠিন দৃষ্টিতে চায় জারার দিকে।

” আমার মায়ের নিথর দেহ যখন আমার সামনে আনা হয় তখন বস্তির সবাই মিলে থানায় গিয়েছিলাম। ওরা আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু দু’দিন খুঁজে বলল অপরাধী পাওয়া যায়নি। কিন্তু তাতে কি? ওরা না পেলেও পরে কিন্তু আমি ঠিকই খুঁজে পেয়েছিলাম। ”

টেবিল থেকে হাত উঠিয়ে পকেটে গুঁজে ঠান্ডা গলায় আওড়ালো আমাদ। জারার গলা শুকিয়ে যায়। তবুও প্রশ্ন করে

” পাওয়ার পর কি করলেন? ”

ভয়ার্ত কন্ঠ। আমাদ জবাব দেয় না। হাতটানিজ গলায় রাখে। অতঃপর কেটে দেওয়ার মতো ভঙ্গি করে চোখ উল্টিয়ে কাত করে মাথা পেছন দিকে।

” আপনি মে রে ছে ন?”

আমাদ বড্ড স্বাভাবিক ভাবে জবাব দেয়

” হুম”

জারার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। এখনো আমাদ এর মুখে নিষ্পাপ ছোঁয়া লেগে আছে। কি করে করতে পারে এটা আমাদ? তার কেবলই মনে হয় এটা একটা নাটকের অংশ। সত্যি কোন ভাবেই না। আমাদ স্ক্রিপ্ট আওড়াচ্ছে ক্রোমাগত।

” তোমার জন্য কিছু নিয়ে আসি। থাকো। আর আমার ভাইয়ের একটু খেয়াল রেখে আসি। আফটার অল বড় ভাই না আমি? একটু খেয়াল আর যত্ন তো রাখতেই হয় তাই না? সঙ্গে ঠিক করে আসি তোমার সোল ওপরে পাঠিয়ে দিয়ে তোমার বডি কোথায় রাখবো।”

” আমাদ ভাই? ইউভানের কোন ক্ষতি আপনি করবেন না। ”

জারা যেন শাসিয়ে বলে। আমাদ একটা ছোট চিরুনি দিয়ে মাথার চুল আঁচড়াচ্ছিল। সামনে ছিল তার খয়েরী রঙের দেয়াল আয়না। একটা লোহার ওপর তার অস্তিত্ব নির্ভর। এটা আমাদ এর পুরোনো ঘর। এখানেই তার থাকা হয়েছিল মায়ের সঙ্গে।

” তুমি ভুলে যেও না জারা, তুমি এখন আমার বাসায়। এটা তোমার বা ইউভানের ইউভান রেসিডেন্স নয়। দিস ইজ আমাদ রেসিডেন্স।”

ছোট টেবিলটায় বসে আমাদ জুতোর ফিতা বাঁধতে বাঁধতে শীতল কন্ঠে প্রকাশ করলো। অতঃপর উঠে দাঁড়ায় সে। জারা পেছন থেকে আরো একটা প্রশ্ন করে

” আমাকে আগে কেন মা র লে ন না? আপনি চাইলে তো আগেই মা র তে পারতেন বা এখনই মা র তে পারেন?”

“অবশেষে একটা বুদ্ধিমান প্রশ্ন করলে।”

একথা বলেই আমাদ কিছু সময় নীরিক্ষণ করে জারাকে। অতঃপর বন্দুক ঠেকায় জারার মাথায়। অনুত্তেজিত কন্ঠে বলে

” চালাকি নয় কেমন? এখানে রিয়ার মতো ইডিয়ট নেই। মাইন্ড ইট।”

জারা তার প্রশ্নের উত্তর পায় না। আমাদ হেঁটে চলে যায়। গুনগুন করে। গুমোট বাতাবরণে ছড়িয়ে পড়ে তার গুণগণ। চেয়ার থেকে উঠিয়ে নেওয়া জ্যাকেট, মাথার ক্যাপ আর হেলমেট সে সব খুবই সুক্ষভাবে তার চেহারা গোপন করে। হাত দু’টোও ঢেকে ফেলে সে শক্ত হাত মোজায়। শেষ বার দার খোলার কৃত্যে বাহির থেকে আসা সূর্যের ক্ষীণ আলোয় শুধু জারার চোখে পড়লো নির্ভয়ে হেঁটে যাওয়া আমাদ এর সাদা হাতের শেষ আঙ্গুলের নিচে লম্বা কাটা দাগ। আমাদ এর গলার স্বর ছিল নিখুঁত। যেন মনে হলো তার গাওয়া গান শিল্পীর চাইতে সে বেশি মাধুর্য দিয়ে গাইছে। তার অভিব্যাক্তি প্রকাশ করলো এই রক্তমাখা পৃথিবীতে সেই যেন একমাত্র শিল্পী।

“Am I a man or a monster?”
“Just a creature of habit in a world full of madness.”
“I was raised to be a killer, but the blood always stained my hands.”
“All these scars keep getting deeper, now they’re screaming out my name.”

জারার মনে হলো আমাদ সত্যিই মন্সটার। তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো। আমাদ এর গলার সুর তাকে ভাবনায় ফেলল। একটা বিশুদ্ধ চেহারার নিচে আছে একটা কালো অধ্যায়। আর এই অধ্যায়ের শেষ কোথায়? আরো কিছু অন্ধকার নিয়ে কি আমাদ বেঁচে আছে? লোকচক্ষুর আড়ালে সে আরো কিছু কি থাকতে পারে?

চলবে….

#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ৩১

রাতের শেষ প্রহর চলে এলো। তবুও মিলছে না প্রেয়সীর দেখা। ইউভান ক্রমেই দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। শহরের এমন কোন দল বা গ্যাং নেই যেখানে পুলিশ জারাকে খোজেনি। মাহাকেও জেড় করা হয়েছে জেলে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। নিজ বাসার সামনের নির্জন সেই শড়কে গাড়ি দাড় করিয়ে ইউভান অসহায়ত্বের মাত্রা নির্ধারণ করছে। অনেক জায়গায় খুঁজেছে সে। পায়নি কোথাও।

” স্যার আপনি এখানে? কোন খবর পেলেন? ”

আমাদ এর চিন্তিত কন্ঠস্বরে ইউভানের বুকটা মুচড়ে উঠলো। নিজের জেদ, দাপট সব মাটি করে দিয়ে তার বলতে কষ্ট হলো

” না”

ভরাট শশীর অপ্রখর আলোয় ইউভানের রক্তিম আভার বদন বেশ শান্তি জমালো আমাদ এর বুকে। তার চোখে মুখে তৃপ্তির দ্যুতি। চশমাটা অনাড়িভাবে ঠেলে দিয়ে গলায় মেকি দুঃখ টেনে বলল

” আপনি কি হাল ছেড়ে দিচ্ছেন? ”

” নাহ!”

ঠিকরে পড়লো আবারও জেদ। আমাদ দূরছাই করলো মনে মনে। ফাঁকা কলস হয়েও কেমন বাজছে দেখ? খোঁজ জানে না অথচ খুঁজে বের করবে। আহা! কি জটিল প্রেম! কতটা আপন জারা। আমাদ ঠিক এ কারণেই এখনো জারাকে জিবীত রেখেছে। ইউভান যখন পুরোপুরি অসহায় হয়ে যাবে। যখন হার মানবে আর বিষাদে বেদনায় কাতরাবে ঠিক তখনই আমাদ জারাকে শেষ করে দিয়ে তার বডি ফেলে রেখে যাবে ইউভানের এই প্রসাদ তুল্য বাড়ির গেইটের সামনে।

” আমি খোঁজ নিচ্ছি স্যার। আপনি টেনশন করবেন না। আপনার শরীর এমনিতেই ভালো না। আপনার কিছু হয়ে গেলে আপনার বাবার কি হবে স্যার?”

আমাদ মনের ক্ষোভ থেকে বলে। ইউভান জবাব দেয় না। ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে আমাদ রওনা হয় নিচ ঘরের দিকে। গেইটের নিকট এসে সে থমকে যায়। বাড়ির নেইম প্লেটের ওপর ধুলো জমেছিল। গেইটে লাগানো বিদ্যুতের আলোর ছটায় ইউভান তা ফু দিয়ে পরিষ্কার করে। বিরবির করে

” তোমাকে ঠিক থাকতে হবে ইউভান। আমার জন্য। আরমান শাহর জন্য। তার একমাত্র সুখ ও শাস্তি তুমি নিজেই।”

আমাদ এর বিরবিরে গেইটে দাঁড়ান গার্ডদের ঘুমঘুম ভাব ছুটে যায়। তার ভাবে আমাদ তাদের বোঝালো নরম সুরে। তার সটান হয়৷ তবে খুব একটা পাত্তা দেয় না। কেননা এই ছেলেটা একদমই সাদামাটা। সে জানে না তেজ, সে পারে না অন্যের বিরুদ্ধে রাগতে।

.
নিজ ঘরে প্রবেশ করে আচমকা আমাদ আলমারি থেকে বের করে আংটির বক্স। সে চাইছে এটা মাটিতে পুঁতে দিতে। ভালোবাসার করব দিতে। তার আগে শেষ বারের মতো এই যন্ত্রণা সে বুকপকেটে রাখে। অতঃপর ঘর তালাবদ্ধ করে বেরিয়ে যায়। জারাদের বিল্ডিং পেরিয়ে গেইট। সেখানে এসে তাকে থামতে হয় নিচে গালে হাত দিয়ে বসে থাকা উপমার কারণে। বুকটা তখনই হুহু করে আমাদ এর। উপমা মেইন দরজার পাশের ছোট বারান্দার মতো জায়গাতে বসে আছে। ফ্লোরে বসে আছে। ঝিমোচ্ছে সে। হয়তোবা বোনের অপেক্ষায় আছে। শুষ্ক দু’টো ঠোঁট। চোখের বড় বড় পল্লব একে অন্যর সঙ্গে লেপ্টে আছে। কেঁদেছে কি সে? আমাদ এগিয়ে যায় দ্রুত। উজ্জল আলোয় সে উপমার শ্যামলা মায়াভরা মুখটা দেখার সুযোগ সে হাতছাড়া করে না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ঘুমন্ত মায়াবতীর দিকে। তার কন্ঠস্বর হতে ধ্বনিত হয়

” কাব্যর কপালে রইলে, আর আমাদ এর হৃদয়ে।”

এরপর আমাদ আরো একটা উদ্যোগ নেয়। সে জানে সে কখনো বসতে পারবে না উপমার পাশে। কিন্তু আজ অবচেতন উপমার পাশে বসে একটা সুন্দর স্মৃতি রেখে দিতে চায় সে। ভাবনা মনে নিয়ে আমাদ উপমার পাশে বসে। মাঝে এক হাত দূরত্ব। কেমন অসহায়, কষ্টে ভরা চাহনি নিয়ে সে উপমাকে দেখে। এরপর… পর পাঁচ মিনিট পর উঠে দাঁড়ায়। মাফ চায়। সে জারার জন্য ক্ষতিকর বলে। আবারও হাটতে শুরু করে নিজ গন্তব্যের দিকে। উদাসী মন আকাশের দিকে নেশাগ্রস্ত হয়। পায়ের গতি হারিয়ে যেতে চায়। এমন দূর্বলতা সে কখনো অনুভব করেনি। তার কোন পিছুটান নেই এই একত্রিত বছরের জীবনে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে উপমা তার একটা পিছুটান। যে টান কথা বলার আগেই বোবা হয়ে রয়ে গেছে।

” আমার স্বপ্নগুলো একলা কাঁদে
তবুও তোমার নামটি ঠোঁটে রেখে
আমাদ তোমাকে দেখলে
দূর ভবিষ্যতেও থমকে দাঁড়াবে। ”

এমন একটা কথা আওড়ে আমাদ হেঁসে ওঠে। এতোটা ভালোবাসা? কখন, কিভাবে হলো? বুঝে আসে না তার।

.
বেরোনোর রাস্তা, আমাদ এর রহস্য আর নিজের প্রাণের সময়কাল নিয়ে ভাবতে ভাবতে জারার ঘাম ছুটে যাচ্ছে। মাথার ওপর একটা পুরোনো ফ্যান। আমাদ যাওয়ার আগে ড্রিম লাইট অন করে গেছে। সেই আলোয় বসে থাকতে থাকতে চোখে ব্যাথার সন্ধান হয়েছে। পিঠেও তীব্র ব্যাথা হচ্ছে। মেরুদণ্ড একটু বিশ্রাম চায়। রাত এখন কটা বাজে? পুরোটা রাত জারা বসে থেকেছে। খুবই বিষাক্ত লাগছে এই মুহূর্তে। কেন শেষ হচ্ছে না এই রজনী? এতোটা দীর্ঘ কেন? তার ভাবনার মাঝেই দরজা খুলে যায় খট করে। ভেতরে প্রবেশ করে দুটো অবয়ব। একটা মেয়ে মনে হলো। জারা মুখের স্কচটেপ এর জন্য চিৎকার করতে পারলো না। অস্পষ্ট গেংগানো শব্দ কেবল বেরোলো। ওরাও যেন অবাক। দ্রুত লাইট অন করে একজন আরেকজন দরজা বন্ধ করে। একটা অল্প বয়স্ক মেয়ে আর একটা অল্প বয়স্ক ছেলে। ওরা মুখ চাওয়া চায়ি করে। নিজেরা আলোচনা করে। কিন্তু কিছু উদ্ধার করতে না পেরে জারার মুখের টেপ সরিয়ে নিতেই জারা জোরে একটা হাফ ছাড়ে। যেন বহুবছর পর সে বুক ভরে শ্বাস নেয়নি।

” একটু পানি।”

মেয়েটা এক গ্লাস পানি দিল। জারাও তখন একটু চালাকি করে নিজের হাতের দিকে ইশারা করলো। কিন্তু মেয়েটা যেন তার চাইতে দু ধাপ ওপরে। হাত খোলার কথা চিন্তাও করল না। নিজে গ্লাস ধরলে জারার মুখের কাছে।

” কে তুমি? ভাইয়া তোমাকে বেঁধে রেখেছে কেন?”
” আমি…. আমি জানি না কেন? কিন্তু তোমরা কে? আমাদ ভাইয়ের সঙ্গে তোমাদের কি সম্পর্ক? ”

ছেলেটা মেয়েটাকে কিছু ইশারা করতেই ওরা দূরে সরে। জারা এতোক্ষণে খেয়াল করে ওদের কালো শার্ট প্যান্টে রক্তের দাগ। ঠিক দাগ নয়। মেয়েটা যেন রক্তের কোন নদী থেকে উঠে এসেছে। তার পুরো শরীর ভেজা। একটা চাপা গন্ধ। জারার হাত পা থরথর করে কাঁপতে লাগলো। বমির ভাব হলো। কিন্তু পেটে কিছু না থাকায় কিছু বের হলো না। দ্রুত চোখ বন্ধ করে জারা চিৎকার দিয়ে বলে

” তোমরা মানুষ হ ত ্য া করো? জঘন্য মানুষ তোমরা। তোমরা মনস্টার একেকটা।”
” মানুষ মানুষকে মনস্টার বানায় বুঝেছো? পরিস্থিতি বানায়।”

মেয়েটা তেড়ে আসে জারার দিকে। ছেলেটা কোনোভাবে আটকায়। জারার মুখে নতুন করে স্কচটেপ লাগিয়ে দিয়ে ওরা ওদের ব্যাগ থেকে ছু রি, কা চি, দ া বের করে। অতঃপর পেছনের একটা দরজা দিয়ে চলে যায় কোথায়। হয়তোবা অস্ত্র লুকিয়ে ফেলতে যাচ্ছে। কিছুসময় পর ফিরে আসে। এর মাঝে আমাদও উপস্থিত হয়। সে এসে কিছু নিয়ে আলোচনা শুরু করার আগে জারার পানে চায়। তারপর মুচকি হাসে।

” তুমি শুনতে আগ্রহী? ”

জারার চোখ দিয়ে ঠিকরে পড়ে ঘৃণা।

” ঠিক আছে শোন।”

জারা না চাইতে ওদের কথোপকথনে কান দেয়। যেটুকু বোঝা যায় তা হলো ছেলে-মেয়ে দুইটা এই মুহূর্তে কাউকে চির নিদ্রায় শায়িত করে দিয়ে এসেছে। আর একজনের হাত পা ভেঙে তার বাসার সামনে ফেলে রেখে এসেছে। মেয়েটা আমাদ কে ধন্যবাদ জানালো। জলযুক্ত নয়নে বলল

” ভাইয়া, আমার শত্রু শেষ। আমি আর বাঁচতে চাই না। ”

জারা কিছুটা চমকে উঠলো এমন কথা শুনে। ওদের মাঝে আরো কিছু কথা হচ্ছে। যা আর বোঝা যাচ্ছে না। র ক্তে র গন্ধ আ র এমন ভয়ঙ্কর সব কথা শুনে তার মাথা ঘুরে উঠছে। সে ধীরে ধীরে হাত ভায়ের ভারসাম্য হারিয়ে অজ্ঞান হলো।

.
ভোরের আলো ফুটতেই ইউভানের ফোন বেজে উঠলো। ব্যারিস্টার হওয়ার সুবাদে তার দু একজন নিজস্ব ইনফর্নার ছিল। ওরাও বাদ যায়নি জারাকে খোঁজার জন্য। এপার্টমেন্টে এসে দরজার সামনেই বসে ছিল ইউভান। হালকা ঝিমুনি অনুভব করতেই ফোনের শব্দে সে সজাগ হয়। রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে বলা হয়

” স্যার আমার মনে হয় এটা স্যাডো জাস্টিস এর কাজ। আপনার লাস্ট কেইস ছিল একটা ছোট মেয়ের রে প নিয়ে। স্যাডো জাস্টিস হয়তোবা আপনাকে হুমকি দিতে চায়। কারণ ওরা রে পি স্ট কে নিজেরা মা রে। নির্মমভাবে। আজ আমাদের পাশের গ্রামে একজ খু ন হয়েছে। সে একবার একটা কলেজ পড়ুয়া মেয়ের সঙ্গে…. মানে স্যার সব গ্যাং তে ঘেঁটে দেখেছেন এটাই বাকি আছে। আর আমার মনে হয় ম্যম থাকলে এখানেই থাকবে। ”

ইউভান অবাক হয়। এমনকি সে এই গ্যাং এর নাম প্রথম শুনলো।

” স্যডো জাস্টিস জিনিসটা কি? কে এর লিডার? ”

” লিডার S.A তাকে কেউ কখনো দেখেন। শুনেছি ওনারা তিনজন। কিন্তু কে বা কারা এটা সম্পর্কে একটা পিঁপড়াও বলতে পারবে না।….. ”

ছেলেটার কথা থেকে ইউভান জানলো অনেক কিছু।

“শ্যাডো জাস্টিস” অর্থাৎ ওরা ছায়ার মতো। ওদের নির্দিষ্ট কোন ঠিকানা নেই । ওরা নিজেদের ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করার একটা মাধ্যম মনে করে। যেখানে যেখানে নারীদের সম্মান, ইজ্জতের ওপর প্রশ্ন সেখানেই আছে ওরা। লোক কথায় কথিত আছে প্রথম শ্যাডো জাস্টিস আত্মপ্রকাশ করে ২০১২ সালে। তারপর হঠাৎ করে উধাও। এরপর আবারও তার উৎপাদ শুরু হয় উনিশ সালে। অতঃপর একাধারে খু ন। পুলিশ তাকে খুঁজেও পায়নি। বড্ড চতুড়তার সঙ্গে সে পা ফেলে। তার গায়ের রং পর্যন্ত জানা সম্ভব হয়নি। কালো না শুভ্র নাকি শ্যামলা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আপাদমস্তক কালো শার্ট, জ্যাকেট, হেলমেট দিয়ে ঢাকা থাকে। হাতে থাকে কালো হাতমোজা। তবে সে তাকে বরাবরই ধরতে গেলে সে বাইক নিয়ে পালিয়ে গেছে।

আরো একটা বিষয় জানা গেছে। সে যখন উনিশে আবারও ফিরে এলো তখন এক রেপিস্টের লা শ এর সঙ্গে একটা চিরকুট পাওয়া গেছে। যাতে লেখা ছিল তার জীবনের একাংশ। সে বলেছিল তার মনের আগুন নেভানো সম্ভব নয়। কেননা তার আপন জনকে কলঙ্কিত করে মে রে ফেলেছে এই জাত। সে দাবি করে সে অন্যায় করছে না। বরং সমাজ থেকে জাঞ্জল দূর করছে। পুলিশ তাকে বোঝাতে পারেনি এটা বিশৃঙ্খলা। এটা দূর করার জন্য আইন আছে।

কিন্তু প্রশ্ন একটাই, সে কেন ইউভানের পেছনে পড়বে? উত্তর মেলে না। ইউভান দ্রুত ফোন করে আমাদ এর নিকট।

ভোরের আলো ফুটছে মাত্রই। জারার মুখে পানি ছেটা দিয়ে তাকে জাগানো হয়েছে। আমাদ সামনে রেখেছে একটা পরোটা আর ডাল। জারাকে খাওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। কিন্তু সে খাচ্ছে না। আমাদ জোর করার মানুষটাই নয়। সে প্রস্তুতি নেয় ঘর ছাড়ার। রেখে যায় সেই তরুণী মেয়েটাকে। যাকে দেখেই যেন জারার বমি উঁকি দিচ্ছে।

” খেতে চাইলে খাওয়াবে। নয়তো না। সে ম র লে আমার ভালো। খুদা মানুষকে তিলে তিলে মা রে। ”
” ঠিক আছে ভাইয়া।”
” আপনার থেকে এমনটা সত্যিই আশা করিনি। ছিহ! আপনি এতো নিকৃষ্ট।”
” হাহ! নিকৃষ্টই।”

সহজ স্বীকারোক্তি। দিন হয়ে যাওয়ার নিজের চশমার রূপটা ধারণ করলো আমাদ। এরইমাঝে ফোন বাজে। পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে ইউভান। সে ইশারায় জারার পাশে থাকা মেয়েটাকে বলে জারার মুখটা চেপে ধরে রাখতে।

” জ্বি স্যার।”
” আমাদ, এস সুন এস পসিবল আমার স্যাডো জাস্টিস এর ঠিকানা লাগবে। কুইক।”

আমাদের অন্তরাত্মায় একটা ধ্বক করে শব্দ হয়। তবে তার কোন রূপ প্রভাব কন্ঠে না টেনে বলে

” কেন স্যার?”

ইউভান ব্যাখ্যা করার ছেলেটাই নয়। সে ফোন কাটতে যায় ঠিক তখনই জারা বুদ্ধি এঁটে মুখ দিয়ে শব্দ করে। কেবল অস্পষ্ট শব্দ হয়। মেয়েটার আঙ্গুলের ফাঁক থেকে এমন বেশ জোরে শব্দ বের হবে তা জারার কল্পনাতে ছিল না। সে তৎক্ষনাৎ চিৎকার করার চেষ্টা করে। দূর্বল হয়ে সেই শব্দ প্রকাশ পেলেও ফোনের ওপাশে হালকা পৌঁছে যায়। ইউভানের তীক্ষ্ণ মস্তিষ্কে সেটা খট করে ধরে যায়। বুক ধড়ফড় করে। আমাদ ফোন কাটে তৎক্ষনাৎ। রেগে তাকায় জারার দিকে। এক মিনিট না গড়াতেই ইউভান আবারও ফোন করে। আমাদ উত্তেজিত হয় না। সে রিসিভ করে। জারার থেকে অনেকটা দূরে সরে সে প্রশান্ত নদীর মতো করেই প্রবাহিত করে ওপাশে তার কন্ঠস্বর

” কোন সমস্যা হয়েছে স্যর?”
” উঁহু ”
” আপনি ঠিক আছেন? ”
” হুম। ”
” তুমি এখন কোথায়? ”
” রাস্তায়। ”

ইউভান খুবই ধীর গতিতে কথা এগিয়ে নিল। আর অপেক্ষা করলো আবার কোন শব্দ তার কানে আসে কিনা্ কিন্তু এলো না। জারা বেশ ফাঁকে ছিল। সে শব্দ করলেও তা এখানে পৌঁছে আবার ফোন দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার মতো ছিল না। ইউভানের বুকটা ধুকপুক করছে। ঠিক প্রথম দিনের মতো। এটা সেই তীক্ষ্ণ ব্যাথা যেটা জারার উপস্থিতিতে সে অনুভব করে। দ্রুত ফোন কাটে ইউভান। এক।প্রকার দৌড়ে গাড়ির নিকট যায়। হোক আন্দাজ। তবুও খুঁটিয়ে দেখবে সে।

ফোন কাটতেই এপাশে আমাদ দ্রুত জারার বাঁধন খোলে। ফোনটা অফ করে দেয় এবং ছুড়ে ফেলার আদেশ দেয় সেই অচেনা মেয়টাকে। বলে

” ফ্যাক্টরির ওপাশে জঙ্গলের মধ্যে ফেলে দাও এটা। দ্রুত কেয়া। ফাস্ট। ”

কেয়া অস্থির হয়ে শুধায়

” কিন্তু কেন ভাইয়া?”
” তুমি জানো না ইউভানের টেলিপ্যাথি কাজ করে। ও এখানে আসবে আমি জানি। ওর সিক্স সেন্স তুখোড়। ”

কেয়া বুঝতে পারে না সে কি করবে। আমাদ এর ওপর দিয়েও যে কেউ চালাক থাকতে পারে এটা যেন তার বিশ্বস করতে ইচ্ছে হয় না।

” ওইপাশে মাটির নিচের বাক্সে অস্ত্র আছে। যদি পুলিশ নিয়ে আসে?”

“কিচ্ছু হবে না। টের পাবে না ওটা।”

কেয়া হাফ ছাড়ে। ওটা একটা কবরের আকৃতি দিয়ে তৈরি করা। মাটির নিচে আছে একটা বক্স। তার মধ্যে অস্ত্র।

জারা কি করবে বুঝতে পারে না। আমাদ নিজের একটা লং কোর্ট গায়ে জড়িয়ে নেয়। দ্রুত হাতে জারার দু-হাত সামনে এনে বেঁধে ফেলে। হেলমেট নিতে ভোলে না সে। এরপর দরজা খুলে সকালের প্রথম আলোয় বেরিয়ে যায়। ছোট এই বাড়ির কাছে ফ্যাক্টরি। একসময়ের বস্তুি ভেঙে গড়ে তোলা। তার পেছন দিয়ে আমাদ জারাকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। কেয়া বাড়িতে থাকা আমাদ এর অপ্রয়োজনীয় আর প্রয়োজনীয় সব কিছু নিয়ে পালিয়ে গেল অন্য পথ দিয়ে। জঙ্গলের কাছে খুব কষ্টে জারা এলো। এক প্রকার টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাদ। জারার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। মুখে আবারও দিয়েছে ওরা পট্টি। যেন টু শব্দ করতে না পরে জারা। জঙ্গলের মাঝখানে গিয়ে আমাদ থামলো। জারা উমম, উমম শব্দ করছে। বোধ হয় বোঝাতে চাইছে সে আর হাঁটতে পারবে না।

আমাদ থামল। এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল যেন এক মুহূর্তের জন্য নিজের ভেতরের ধৈর্যটুকু জড়ো করছে। ধীরে ধীরে হেলমেট খুলে ফেলল। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কোর্টের এক পাশ সরিয়ে কোমরে হাত রাখল। তার চোখে এক ধরনের তিক্ততা, বিরক্তি মিশে আছে, বা চোখ সামান্য কুঁচকে গেছে, কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ—যেন পুরো দুনিয়ার ওপরেই এক ধরনের বিতৃষ্ণা কাজ করছে।

জারা কিছুটা কেঁপে উঠল। বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত আতঙ্কের অনুভূতি খেলে গেল। সে এক পা, দু’পা করে পিছু হটছে, কিন্তু আমাদ ফিরেও তাকাল না। যেন তার সমস্ত অস্তিত্বেই আত্মবিশ্বাস খোদাই করা। ধূসর রঙা লং কোর্টের গাঢ় ছায়া তাকে আরও রহস্যময় করে তুলছে। মুহূর্তের জন্য নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর হঠাৎই লং কোর্টের ভেতর থেকে ধাতব কিছু বের করল। ঠোঁট বাঁকিয়ে একরকম হাসতে চাইল, কিন্তু তা ভয়ঙ্কর না হয়ে হলো গভীর, সৌম্য—এক জঙ্গলের রাজার মতো অভিজাত, অথচ নির্মম।

সে বা হাতে চিবুকের ঘাম মোছে, একবার আশপাশে তাকিয়ে যেন চারপাশের পরিবেশটুকু শুষে নিচ্ছে। তারপর নিচু স্বরে বলল

“আমি বোকার মতো তোমাকে নিয়ে দৌড়াচ্ছি কেন? এখানেই এটা শেষ করা উচিত।”

তার কণ্ঠে এমন এক শীতল দৃঢ়তা, যেন সে যা বলে ফেলেছে, তা পেছনে নেওয়ার উপায় নেই। পুরো পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ তার হাতেই।

চলবে…..

#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ৩২

অশ্রু চোখের কোল বেয়ে পরছে অঝোরে। দাড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে জারার। তার বুক বরাবর তাক করা বন্দুকের নল। ঝাপসা হচ্ছে ক্রমশ সবকিছু। এই আমাদ? এই আমাদ কিভাবে পারবে তার দিকে বন্দুকের গুলি ছুড়ে দিতে? জারা ক্রমশ হাত মোচড়াচ্ছে। তার দূর্বল হলে যেন চলবে না। পুরোপুরি ম রে যাওয়ার হার শিকার করে ম র তে চায় না জারা। হাত ছিলে যায়। লাল হয়ে ওঠে। বোবা কান্নার সঙ্গে জারা জঙ্গলের শুকনো পাতার মাঝে থপ করে বসে যায়। বাঁধা হাত দিয়ে কোনোভাবে মুখের আঠাযুক্ত মোটা টেপ খুলে ফেলে। লাল গাউনের ওপর দুপাশ দিয়ে ঝুলে ছিল ওড়না। কাঠ গোলাপের মতো দেখতে কাকড়া নড়বড়ে হয়ে গেছে। কাটা চুল মুখের ওপর এসে জড়ো হয়েছে। আর্ধেক চুল কাকড়া থেকে বেরিয়ে পিঠে ছড়িয়ে আছে। জারা সামনে তাকায়। আমাদ এর চোখে প্রতিশোধের আগুন।

” আমার সঙ্গে আপনার কি শত্রুতা?”
” শত্রুর ভালোবাসা আমার শত্রু।”
” আপনি এটা নন আমাদ ভাই। হুঁশে আসুন। আপনি অনেক ভালো। আমি জানি।”
” তুমি ভুল জানো। আমি শুধুই একটা প্রতিশোধের পিন্ড ছাড়া কিছুই না। ফাইরুজ আমাদ শুধুই ইউভান আহসান আর আমাদ শাহর শত্রু।”
” ইউভান আপনার ভাই হয়।”
” আমিও একসময় খুব করে চেয়েছিলাম জারা, খুব করে চেয়েছিলাম আমরা দু’ভাই এক বোন হেসে খেলে দিন কাটাবো। আমি ওদের কেয়ার করব, ভালোবাসবো৷ কিন্তু আরমান শাহ? সে আমার খোঁজ নিল না। সে আমাকে ছেলে হিসেবে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো না।”
” বাবার কর্মফল ছেলে কেন ভোগ করবে?”
” এই তুমি কি আমার সময় নষ্ট করার চেষ্টা করছো? নিজেকে খুব চালাক ভাবো?”

জারা যেন ধরা পড়ে গেলো। তড়িঘড়ি করে উঠে দাড়ায়। আমাদ বন্দুকের ট্রিগারে হাত রাখে। জারা ঠাঁই দাড়িয়ে তখনও হাতের বাঁধনের সঙ্গে কঠিন ভাবে যুদ্ধ করছে। একটু ঢিলে হয়েছে। আর একটু হলেই এটা খুলে ফেলা সম্ভব। আমাদ একটা শ্বাস নেয়। আজ তার হাত কাপছে। যেন এটা তার প্রথম খু ন। জারার কান্নামাখা মুখের অভিব্যাক্তিতে সে যেন আবছা করে দেখতে পায় উপমার মুখটা। শুধু স্যাম আর শুভ্র। এটুকুই তাদের তফাত। চেহারা আর গড়নে মিল আছে অসম্ভব রকমের। আমাদ দূর্বল হয়ে আসতে চায় ভেতর থেকে। অনুভব করে ভালোবাসার উল্টোদিকটা। আচ্ছা ভালোবাসা কি এতোটাই শুদ্ধ? পাপ থেকে দূরে সরাতে সক্ষম? আমাদ মাথা ঝাকায়। সোজা হয়ে দাঁড়ায় সে। এগিয়ে যায় দু পা এক পা করে। জারা হাতের বাঁধন খুলে ফেলেছে। তিরতির করে ঠোঁট কাঁপছে তার মৃত্যুর মুখোমুখি দাড়িয়ে। হাত খুললেও তা আমাদ এর নজর থেকে লুকাতে একই ভঙ্গিতে রাখলো হাত। আমাদ কাছে আসতেই সে ধাক্কা দেবে। অতঃপর দৌড়াবে কোনো এক অজানা দিকে।

.
ইউভানের গাড়ি এসে থামে একটা দশ তাল ফ্যাক্টরির সামনে। গারির সামনে থেকে ফোনটা তুলে নিয়ে সে সিগনাল ফলো করে এগোতে থাকে সামনের দিকে। লাস্ট লোকেশন আশেপাশেই দেখিয়েছে। ইউভান এলোমেলো পা ফেলে পৌঁছে যায় একটা রঙচটা দেয়ালের এক কুঠারির ঘরের সামনে। দরজাটা কাঠের। আশপাশে শুধুই ময়লা আবর্জনা। ইউভান খুব কাছেই আছে লোকেশানের। পলক না ফেলে সে ফোন ধরে এগিয়ে গিয়ে উপস্থিত হয় বিল্ডিংটার পেছনে। অবাঞ্ছিত অপ্রয়োজনীয় কিছু গাছ। এখানেই লাস্ট লোকেশন। ইউভান হতাশ হয়। কিন্তু হাল ছাড়ে না। সে এই ছোট ঘন বন বিছুটীর মতো অংশের মাঝে খুঁজে চলে সেই ডিভাইস। কি এটা? ফোন নাকি সিম হবে? ফোন পেলেও একটা ক্লু আসবে হাতে । যেই ভাবা সেই কাজ। আপন ফোন পকেটে রেখে উন্মাদের মতো খুঁজে চলে সে। একসময় পেয়ে যায় একটা ফোন। হাতে নিতেই কাভারের পেছনে উঁচু নিচু কিছু অনুভব হয়। ইউভান উল্টে ধরে। যা চোখে ভাসে তাতে মনে হয় কোনো খনিজ পদার্থের ওপর আঁচড় কেটে কিছু লেখা হয়েছে। গভীর লালচে কালির মতো কিছু একটা ফোন কভারের গায়ে শুকিয়ে আছে, মনে হয় যেন তা রক্তের দাগ। অক্ষরগুলো কাঁপতে থাকা হাতের লেখার মতো—

“The Crownless Ruthless King”

শব্দগুলো টানটান, অদ্ভুতভাবে আঁকাবাঁকা, যেন কেউ তাড়াহুড়োয় খোদাই করেছে, কিংবা প্রচণ্ড রাগ আর কষ্টে লিখেছে। ছোট করে লেখা এই বাক্যটা কালো কাভারের গায়ে লাল হয়ে ভাসছে। ইউভানের ভ্রু জোরা কুঁচকে গেলো। কোথাও দেখেছে সে এটা। কিন্তু কোথায়? মনে পড়ে আমাদ এর ফোনের কভারে। ততক্ষাত তার মন পুরোপুরি সায় দেয় জারা আমাদ এর সঙ্গেেই আছে। কিন্তু আমাদ এর সঙ্গে? ইউভানের মনে যে এক সিকি বিশ্বাস ছিল তা কাঁচের মতোই টুকরো টুকরো হয়ে বিগঠিত হলো। সে এক ঝাঁক আফসোস, এক গাদা রাগ আর এক রাশ প্রশ্ন নিয়ে দূরে সরলো। আশপাশে তাকালো। আমাদ বা অন্যকেউ যে-ই জারাকে নিয়ে এখান থেকে পালানোর চেষ্টা করুক না কেন নিশ্চয়ই বেশি দূর সে এগোতে পারেনি। ইউভান বট বিছুটির পাশ দিয়ে সামনের দিকে এগোয়। পুলিশের নিকট ফোন করে জানিয়ে দেয় এ জায়গা ঘেরাও করতে। এই অঞ্চল থেকে একটা কিটও যেন বাহিরে বেরোতে না পারে।

ইউভান দৌড়াতে থাকে। চিৎকার দিয়ে ডাকে জারাকে। ঘন গাছপালার জঙ্গলের মতো অংশটুকু তাকে টানে। সে ওদিকেই পা বাড়ায়। তার একেকটা চিৎকারে পাখিরা পালক ঝাপটায়। নির্জন এই স্পটে তারা আশা করেনি কারো আগমন। ইউভান আর্তনাদ করে ডাকে। ঘামে ভেজা শার্ট লেপ্টে গেছে পিঠে। কালো শার্টের এক হাতা কনুই ছেড়ে কব্জিতে এসে গেছে। চোখের নিচে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মুখটা তার বড়ই অসহায়। যেন এখনই বুক ফেটে যায় যায় ভাব তার।

” জারা, একটু সাড়া দাও। আমি এসে গেছি।”

ইউভানের মনস্তাপ জুড়ে ঘুরে বেড়ানো কথা ফিসফিস করে বেরিয়ে এলো।

.
জারার কানে পৌঁছায় এই চিৎকার। সে ভেবেছিল আমাদ কে ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে পালাবে। কিন্তু ব্যাপারটা ততটা সহজ ছিল না। উল্টো সে ভালোভাবে জিম্মি হয় আমাদ এর হাতে। এখন সে বন্দুকের স্পর্শ অনুভব করে বন্ধ চোখে দাড়িয়ে থেকে জীবনের অন্তিম সময় গুনছে। দোয়া পাঠ করছে। আর এমন সময়ই ঘোর আঁধারে আশার আলোর মতো দপ করে জ্বলে ওঠে একটা বাতি। সেই বাতি, যা জারার নিজস্ব। সেই উজ্জ্বল আলো যেটা কেবল জারার জন্যই জ্বলজ্বল করে যে কোন মুহূর্তে। সে জীবন দিয়ে হলেও সদা প্রস্তুত তার জারাকে আগলে রাখতে।

আমাদ এর কানেও পৌঁছায় চিৎকার। বোঝা যায় ইউভান তাদের থেকে বেশ দূরেই আছে। তবে তা মুহূর্তের মাঝে ভুল প্রমাণিত হয়। পাতার মড়মড় ধ্বনি কানে বাজে। ধুপধাপ পা ফেলে কারো এগিয়ে আসার শব্দ। আমাদ অনেকটা সময় নষ্ট করেছে। এই মুহূর্তে সে আর চাইছে না আর এক মিনিটও অপচয় করতে। সে বন্দুকের ট্রিগারে হাত রাখে। জারার সাহস ও বুদ্ধি কোনোটাই অবশিষ্ট ছিল না। তার মন লত্তয়া করেছে এটাই তার অন্তিম মুহূর্ত। মানস্পটে ইউভান কে দাঁড় করিয়ে সে যখন বলছিল নীরবে

“আপনারর ভালোবাসা আমার কপালে ছিল না। হয়তো বেঁচে থাকলেও তা গ্রহণ করতে পারতাম না। তবে এক মুহূর্তের জন্যও আপনার ভালোবাসার গভীরতায় সন্দেহ করিনি। আমার দেখা সেরা প্রেমিক আপনি। যে ভালোবাসা কোনো স্বীকৃতি চায় না, যে ভালোবাসা নিজের সবকিছু উৎসর্গ করেও কিছু পাওয়ার আশা রাখে না—তুমি আপনি। ”

কথাটা বলেই চোখ বন্ধ করে অপেক্ষায় থাকে জারা গুলির শব্দের। সেকেন্ড না গড়াতেই কানে বাজে তা। বিকট শব্দ। মনে হলো তার কানের পর্দা ফেটগেলো। ব্যাথা অনুভব করার শক্তিটুকুও রইলো না। সে ঢলে পারল মাটির বুকে শুকনো পাতার মাঝে।

টুপ টুপ করে রক্ত পড়ছে। রঙ্গিন হচ্ছে ধূসর শুষ্ক পল্লব। সঙ্গে অবাক চাহনি ও নির্লিপ্ত চাহনির সন্ধি হয়েছে। আমাদ অভিব্যাক্তি আর অভিযোগ হীনভাবে তাকিয়ে দেখছে ইউভানকে। আর ইউভান দেখতে একটা কঠিন সত্য। হাতের গানটা সে পজিশনেই আছে, যে পজিশনে সে আমাদ কে এই মুহূর্তে গু লি করেছে। আমাদ এর ডান হাতের বাহু থেকে চুইয়ে পড়া রক্তের ধারা বেড়ে গেলো। ধাবত ব ন্দু ক ছিটকে পড়েছে তার থেকে দুই পা দূরে। সে তোলার কথা চিন্তা করার আগেই ইউভান হুঁশে ফেরে। অবাক চাহনি উবে দিয়ে কঠিন স্বরে বলে

” ডোন্ট মুভ আমাদ।”

আমাদ মাথা কাত করে আকাশ পানে তাকায় ক্ষণিকের জন্য। যেন ভুলে যায় হাতের ব্যাথা।

” জেদ দেখিও না ইউভান। আমি তোমার চার বছরের বড়। রক্ত আমাদের একই। এখন থেকে তোমার কোন রাইট নেই আমাকে আদেশ দেওয়ার।”

ইউভান আমাদ এর কোন কথাই যেন বুঝতে পারে না।

” তুমি আমার সবচাইতে মূল্যবান রত্নে হাত দিয়েছো, তুমি আমার জানে হাত দিয়েছো আমাদ। এটার জন্য তোমাকে দিতে হবে তোমার অমূল্য রক্ত। এটা এমন দাম যা তুমি চুকাতে বাধ্য থাকবে। ”

ইউভানের কন্ঠ ছিল চিৎকার সমতুল্য। ছিল মারাত্মক সতর্কতা। যেন বাজে এক ধ্বংসাত্মক শক্তির আহ্বান।

” তুমি চাইলে চেষ্টা করতে পারো। তবে ওপেন চ্যালেঞ্জ তোমার জানের জান কবচ আমার দ্বারাই হবে। ”

আমাদ এর শীতল কন্ঠ। পাল্টা সতর্কতা।
ইউভান সহ্য করতে পারে না একথা। আমাদ কে কিছু বলার জন্য মুখ খোলার পূর্বেই সাইরেন বাজে পুলিশের গাড়ির। একদল এগিয়ে আসছে এদিকে। তাদের পায়ের শব্দে আমাদ লং ইউভানের দিকে বাঁকা হাসি ছুড়ে দিয়ে বলে

” টাইম টু গো। তুমি প্রটেক্ট করার চেষ্টা কোরো তোমার জানকে। তুমি লুকিয়ে রেখো। আমি পাতাল থেকে হলেও খুঁজে বের করবো।”

একথা বলেই আমাদ রক্তমাখা হাতের বাহু চেপে ধরে দৌড়ে পালালো। গতির তীব্রতায় সে দ্রুত মিলিয়ে গেলো ঘন গাছপালার মাঝে। ইউভান কেবল ঠাঁই দাড়িয়ে দেখলো তার ধূসর কোর্টের হাওয়ায় সঙ্গে খেলা করা। পুলিশের দল হাজির হলো। ওরা কেউ ছুটল আমাদ এর পেছনে। এক ঝাঁক অনিশ্চয়তা নিয়ে।

উজ্জ্বল সূর্যের আলোতে জঙ্গলজুড়ে সোনালি আভা ছড়িয়ে পড়েছে। রাগে ফুঁসতে থাকা ইউভান দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে, কোলে নিস্তেজ জারা। তার অবচেতন শরীর ইউভানের শক্ত বাহুর মাঝে নরম পালকের মতো শুয়ে আছে। বাতাসে দুলছে জারার এলোমেলো চুল, সূর্যের আলো তাতে সোনার ঝিলিক তুলছে। বিবস হাত-পা যেন তার দুর্বলতার প্রমাণ।। ইউভানের চোখে তীব্র আগুন, প্রতিটি পদক্ষেপে যেন ঝরে পড়ছে এক অদৃশ্য শপথ—আমাদ এর থেকে এই হিসাব তাকে নিতেই হবে।

চলবে….