#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ৩৩
পুলিশ পিছু নেওয়ার জঙ্গলের ধারের নদীপথ ধরে আমাদ পালিয়ে যায়। ভাগ্যিস একটা ডিঙি নৌকা বাঁধা ছিল ঘাটে। পুলিশ শুধু পাহাড়ায় ছিল রাস্তায়। আর খুঁজেছে জঙ্গলে। তাদের ধারণা ছিল না কোন পথে কোন দিকে নদী আছে। অবশেষে যখন ছোট নদীর নিকট পৌঁছে যায় ওরা তখন আমাদ হাতের অসহ্য ব্যাথায় ঢলে পরেছে একটা নির্জন বাড়ির উঠোনে। মনে হয় তার গুলিবিদ্ধ জায়গায় লোহা উত্তপ্ত করে চেপে ধরা হয়েছে। রোদের কড়া উষ্মাতের সঙ্গে মৈত্রীবদ্ধ হয়ে গায়ের কোর্ট জ্বালা ধরায় শরীরে। এই কষ্ট অনুভব করার পূর্বেই মস্তিষ্ক যেন মায়া করে কাজ করা সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখে। অজ্ঞান হয় বুকে প্রায় দুই যুগ ধরে চেপে রাখা যন্ত্রণা আর প্রতিশোধের অনলে দগ্ধ হওয়া আমাদ নামের ছেলেটা।
.
ওপাশে আমাদ এর অপ্রিয় ভাইয়ের প্রিয় পাত্রী চোখ খোলে। নিজেকে আবিষ্কার করে নিজ ঘরের বিছানায় শয়ন দশায়। চমকে ওঠে সে। হাত পা নাড়ায়। সম্মুখে দেখে তার কক্ষের ড্রেসিং টেবিল। সেখানে তার প্রতিবিম্ব। গলায় লেপ্টে আছে চুল। চোখ মুখে এখনো আতঙ্কের রাজত্ব। সঙ্গে এবার যুক্ত হলো অবাক আর দ্বিধা ভাব। সে কি বেঁচে আছে?
” আপু….”
ভাঙা গলায় উপমা ডেকে ওঠে। চোখ তার ছলছল করছে। জারা পাশ ফিরে চায়। এবার সে নিশ্চিত সে ঠিকঠাক আছে। উপমার কন্ঠ পেয়ে দরজার ওপাশে দুই ঘন্টা জাবত দাড়িয়ে থাকা ইউভান চোখ খোলে। সে এক হাতে কপাল ঠেকিয়ে বুকে মৃদু ভাবে ঠোকাচ্ছিল মাঝে মাঝে। অতিরিক্ত মানষিক চাপ বা টেনশন হলে তার প্যানিক অ্যাটাক হয়। দম বন্ধ লাগে। বুকের মধ্যে যেন ভাংচুর হয়। আর এমনটা তো আরো বেশি হয় জারার বিষয় যুক্ত হলে। ইউভান উঁকি দেয় ঘরের মধ্যে। জারার মা-বাবা ঘরেই ছিল। ওনারা অপেক্ষায় ছিলেন জারার চেতনা আসার। ইউভান হাফ ছাড়ে। জারার সঙ্গে তার চোখাচোখি হয়। এতেই তার বুকে মেলে এক টুকরো শান্তি। সে মলিন একটা হাসি উপহার দিয়ে হাটতে থাকে নিজ এপার্টমেন্টের দিকে। এতোক্ষণ তার দাড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করাটা জাহানারা বাঁকা চোখে দেখেছেন। জাবেদ সাহেবও। অনেক বার তাকে চলে যাওয়ার কথা বলা হলেও সে যায়নি। এসব তার গায়েই লাগেনি। কিন্তু সে কি জানে? জারার মা বাবার নিকট তার সব পাগলামির রিপোর্টের ফলাফল কি দাড়িয়েছে?
ইউভান যখন জারার রুম ছেড়ে নিচে আসে তখন ড্রয়িং রুমে বসা দু’জন জুনিয়র পুলিশ অফিসারের সঙ্গে দেখা হয়। তারা অপেক্ষা করছে কিছু তথ্য জানার জন্য। ইউভান এখানে দু’মিনিট দাঁড়ায়। বলে রুক্ষ কন্ঠে
” কাল আসুন। জারা সুস্থ না হওয়ার আগে ওর সঙ্গে কথা বলবেন না।”
যেন একটা আদেশ। তবে এই আদেশের পর সে দু-হাত আড়াআড়ি ভাবে বুকে রেখে ওখানেই দাড়িয়ে রইলো অনিমেষ চাহনি নিয়ে। পুলিশ দু’জনের ইউভানের পূর্ব রিপোর্ট জানা আছে। জানা আছে এই ব্যারিস্টার অনেকটাই উগ্র। তারা বাকবিতন্ডায় না জড়িয়ে বেরিয়ে যায়। অবশ্য জারা মেয়েটা এখন নিশ্চয়ই ট্রমাটিক হয়ে আছে।
.
তীব্র একটা শব্দে আমাদ এর মস্তিষ্ক জেগে ওঠে। মাথা ভার। হাতে প্রচন্ড ব্যাথা। সে চোখ মিটমিট করে খোলে। নিজেকে দেখতে পায় একটা শক্ত বিছানার ওপর। পাশে বসা আছে এক বয়স্ক দম্পতি। আমাদ পূর্ণ দৃষ্টিতে চাইতেই চোখে শেষ বিকেলের অন্ত ঝিলিক আক্রমণ করলো। বুঁজে এলো চোখ। আমাদ উঠে বসার চেষ্টা করতেই বৃদ্ধা বলেন
” থাকো। তুমি অসুস্থ। ”
আমাদ খ্যান্ত হয় না। সে ঠোঁট দিয়ে শুষ্ষ ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। তখনই অনুভব করে হাতে স্যলাইন লাগানো। সে বানচাল করে উঠলো। অস্থির হয়ে সামনে তাকাতেই মহিলাটা বললেন
” তড়পাইও না বাপ। ডাক্তার জইছে তোমার আরাম দরকার। গুলি লাগছিল শুইয়া থাকো। কিন্তু কি হইছিল তোমার? ”
ওনাদের কন্ঠে আতঙ্ক। গুলি! শব্দটা যেই সাধারণ মানুষের জন্য বিড়াট ভয়ের কথা। আমাদ শান্ত হয়। নিজের স্বভাবে ফিরে মলিন ও ধীর কণ্ঠে বলে
” ওই আসলে…. আসলে একটা অপরাধীকে ধরতে গিয়ে… ”
” বুইঝছি বুইঝছি। তুমি পুলিশ তাই না?”
” তুমি না বেশি কতা কও। চুপ থাহো মালেকা।”
মালেকা বানু চুপ হয় স্বামীর ধমকে। অতঃপর দু’জনেই ঘর ছাড়েন। আমাদ ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়ে। অতিরিক্ত কিছু বলার প্রয়োজন নেই।
টিনের বেড়া আর টিনের চাল বাতাসের ঝাপটায় ঝনঝন করে। গাছের ডালের সংঘর্ষে এই শব্দ। ছোট একটা কক্ষের ছোট একটা বিছানার ওপর আমাদ পরে থাকে নিঃশব্দে। পা দুটো তুলে দেয় জানালার ফাঁকে। সাদা শার্টের ডান হাতায় রক্ত। মাথার চুল এলোমেলো। তার ধূসর রঙের লং কোর্ট মাথার একপাশে। ক্লান্ত তার চোখ। প্রশ্ন তার মাথায়। পুলিশ আসেনি এপাড়ে? এরপরই বন্ধ হয় আঁখি। ছিমছাম দেহটা নিথরের মতো মনে হয়। বুকে বাজে তীক্ষ্ণ ব্যাথা। সে ব্যাথা কিসের? নির্দিষ্ট কোন কারণ নেই। হয়তোবা প্রেমের বিরহে, বাবার ওপর থাকা ঘৃণার কারণে নয়তোবা অস্থির পরিস্থিতির কারণে।
মাত্রই স্কুল থেকে ফেরা সাত বছরের হাসি জুতো খুলে হাতে নিয়ে নিজ ঘরে প্রবেশ করে। তবে প্রবেশ করতেই তার পা থেকে যায়। তার বিছানায় রক্তমাখা হাত নিয়ে পরে থাকা এক সুন্দর মানুষকে দেখে সে হা হয়ে যায়। স্কুল থেকে পালিয়ে এসেছিল। ভেবেছিল ব্যাগটা রেখে দৌড়ে খেলতে চলে যাবে। যেন বুবু তাকে দেখে না ফেলে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে বিছানার এই মানুষটার থেকে পালাতে চাইছে। ব্যাগটা ঠাস করে টেবিলের ওপর ছুড়ে দিয়ে হাসি দৌড়ে চলে গেল। আমাদ এর মাত্রই লেগে আসা চোখ খুলে যায়। সে ফিরে চায় দরজার দিকে। দেখতে পায় না কাউকে। শুধু নজরে আসে হাসির টার্গেট মিস হওয়া মাটিতে পরে থাকা সিন্ডারেলার ছবি ধারণ করা ব্যাগটা৷
.
” তোমরা কি নদীর ওপাশে গিয়েছিলে?”
” উঁহু ”
” কেন? এতোটা দায়িত্ব এড়িয়ে চলার শখ কেন? পুলিশ হয়েছো অপরাধীকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য? ”
কনস্টেবল সাতজন চুপসে যায় অণিকের ধমকে। তাদের একজন মিনমিন করে জবাব দেয়
” আমরা সেখানে সময় নষ্ট না করে স্যাডো জাস্টিস এর খু ন করা অন্য একটা জায়গায় গিয়েছিলাম। বডি আনার জন্য। ”
একথা শুনলেও অনিক শান্ত হতে পারে না। সব অপরাধ সমান। আমাদ জারার প্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। এটা কম বড় অপরাধ?
তাদের এমন গুরুগম্ভীর মুহূর্তে থানায় আগমন ঘটে ইউভান আর জারার। ইউভান জারার ওড়নার সঙ্গে নিজের এক হাত বেঁধে রেখেছে। জারা টানাহেঁচড়ার করছে। ইউভান শাসিয়ে কিছু বলে। অনিক এদের নাটকে অবশ্য কিছুটা বিরক্ত হয়। ইউভান-জারা এলে ওদের বসতে দেওয়া হয়। জারাকে জিজ্ঞেস করা হয় আমাদ সম্পর্কে। জারা শুরুতে কিছু একটা ভাবে। যা ভাবতেই তার মুখটা শুকিয়ে ওঠে। অতঃপর চায় ইউভানের পানে। ইউভানের মুখের ভঙ্গি গম্ভীর। জারা এরপর খুলে বলে সব। সব মানে সবই। একটা কথাও সে লুকিয়ে রাখলো না। S.A অর্থাৎ স্যাডল আমাদ মানে শ্যাডো জাস্টিস এর লিডার ইউভানের এসিসট্যান্ট আমাদ-ই। আর সে ইউভানের সঙ্গে শত্রুতা করে জারাকে মা রা র চেষ্টা করেছে। এসব ইউভান শুনে হতভম্ব হয়। সে ভেবেছিল আমাদ হয়তোবা টাকার উদ্দেশ্যে নয়তোবা কোন একটা কারণে এমন করেছে। কিন্তু আমাদ যে তারই সৎ ভাই আর আরমান শাহ আরো একটা বিয়ে করেছিলেন এটা ইউভান কে ভেঙে ফেলে ভেতর থেকে। উপরন্তু সে হাত পায়ের শক্তি হারিয়ে ফেলে তার মায়ের মৃ ত্যাুর কারণ জেনে। অফিসার অনিক অশান্ত হয়েও থেমে যান। তার ইউভানের ওপর কিছুটা রাগ হয়। গতকাল যদি ইউভান জারার জবান জিজ্ঞাসার সুযোগ দিত তাহলে হয়তোবা আমাদ কে খুঁজে পাওয়া যেতো। আরো কতগুলো মানুষের যে প্রাণ যাবে তা একমাত্র ওপর ওয়ালাই জানেন।
.
ইউভানের এই ধাক্কা সামলাতে সময় লাগলো। ইকরাও জানতো। অতঃপর আরমান শাহ। কিন্তু তারপর কি আর আরমান শাহর মুখে কিছু বলার থাকে? ইকরা ইউভানের নিকট গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। ক্ষমা চায়। সে-ই মূলত দেখেছিল ইউভান মায়ের রক্তাক্ত দেহের পাশে ছুরি হাতে দাড়িয়ে আছে। সে চিৎকার করে সবাইকে ডেকে বলেছিল ইউভান খু নি। কিন্তু আসলেই কি তাই? ইউভানের ঘুমে ছিল। অতঃপর চোখ খুলে নিজেকে আবিষ্কার করেছিল মায়ের পাশে ছুরি হাতে ধরা অবস্থায়। ছোট ইউভান দ্বিধায় পড়েছিল। কিন্তু কেউ তার কোন কথা শোনেনি। একইরকম ঘটনা দিলরুবার সময়ও হয়েছিল।
.
পরদিন ভোরে পুলিশ জারা আর ইউভানকে নিয়ে উপস্থিত হয় সেই জায়গায়। যেখানে জারাকে আমাদ বন্দী করে রেখেছিল। জারা যেহেতু জানে এখানে অস্ত্র লুকানো আছে তাই তাকেও সঙ্গে আনা হয়েছে। আর ইউভান! সে তো আসবেই। আজও সে জারার ওড়নার আঁচলে নিজের হাতটা শক্ত করে গিট পাকিয়ে বাঁধলো। যেন সে হারিয়ে না যায়। অতঃপর গাড়ি থেকে নেমে জারা দেখিয়ে দেয় সেই কবরের মত দেখতে উঁচু জায়গাটা। বাশের বেড়া ছিল চারদিকে। কারে সন্দেহ করা মুশকিল এটা অস্ত্র লুকানোর জায়গা। মাটি খুঁড়ে সেখান থেকে উদ্ধার করে পুলিশ একটা বড় বাক্স। তার মুখ খুলতেই তার ভেতরে দেখা যায় অসংখ্য ছু রি, কা চি, চাপাতি, দা আরো অনেক রকমের অস্ত্র। যার নাম জারার অজানা। পুলিশ এবার এই ঘরের তালা ভাঙে। প্রবেশ করে তল্লাশি চালায়। এরমাঝে ইউভান কোমরে এক হাত রেখে দাড়িয়ে ছিল ক্লান্ত হয়ে। কড়া রোদে ঘেমে উঠেছে। তার পাশেই যতটুকু সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে দাড়িয়েছিল জারা। হঠাৎই তার চোখ যায় ইউভানের পিঠের মধ্যে। সেখানে এসে বসেছে একটা মৌমাছি। সে বসছে আবার উড়ছে। যেন ফাঁক ফোকর খুঁজছে কামড়ে দেওয়ার। জারা আড় চোখে দেখে। সে ভাবনায় পরে যায়। এটাকে কি তার তাড়িয়ে দেওয়া উচিত? কিভাবে? একটু পেছনে সরে জারা শব্দ না করে হাত দিয়ে মৌমাছিকে তাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বেচারা যায় না। জারার তখন হঠাৎই রাগ হয়। সে হাতের ঝাড়া দিয়ে ফেলে দেওয়া জন্য উদ্যত হতেই ইউভান তার মুখোমুখি ফেরে
সে বলতে চাইছিল
” আচ্ছা জারা, আমাদ…”
তার কথা সেখানেই সমাপ্ত হয় জারার থাপ্পড়ের দোহাইয়ে। একেবারে বুকের মধ্যে ঠাস করে হাত রেখেছে জারা। ইউভান ভ্রু কুঁচকে চোখ বন্ধ করে। মনে হলে বেশ জোরেই লেগেছে। জারার চোখ বড়বড় হয়ে যায়। এটা কি হলো? ইউভান চোখ খোলে ধীর গতিতে। ডান হাতে শার্টের ওপরের দু’টো বোতাম খুলতেই ভেতর থেকে উঁকি দেয় লাল হয়ে যাওয়া অংশটুকু। জারা হাত সরিয়ে নিয়েছে অনেক আগেই। ইউভান তীব্র হতাশার সঙ্গে বলে উঠলো
” যখন আমাকে চুৃমু দেওয়ার কথা তখন তুমি থাপ্পড় দিলে? এটাই বাকি ছিল? ”
চলবে…
#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ৩৪
ইউভানের আফসোসের সাগর দেখে জারা লজ্জা পেলো। তবে তা অপ্রকাশিত রাখতে সে মুখ ঘুরিয়ে দূরে সরতে চাইলে টান পড়ে হাতে। থামতে হয়। ইউভান বুক থেকে একটা দীর্ঘ শ্বাস মুক্ত করে বিনা বাক্যে ওড়না পেঁচিয়ে নেয় হাতের মুঠোয়। যেটুকু দূরত্বে দাড়াতে পারতো জারা তা এখন সুযোগ হারা।
.
মৃত্যুর হুমকি পাওয়ার পর দিনকাল ভয়ে কাটে জারার। জানালা দরজা বন্ধ করে রাখেন জাহানারা। ইউভান যথেষ্ট কড়া গার্ড দিয়ে বেষ্টিত করে রেখেছে তার বাসা। জারাদের বিল্ডিং এর চারপাশে কড়া গার্ড। পায়ে হাঁটার জন্য তৈরি করা প্রশস্ত রাস্তার চারপাশে দশ জোরা দেহরক্ষী। ভেতর থেকে হাসির শব্দ এলেও তারা তড়াক হড়বড়িয়ে দরজায় কড়া নাড়ে। এটাতে জারা হাসবে না কাঁদবে বোঝে না ঠিক। ইউভান কোথাও যাচ্ছে না। সে যেন আত্মা হাতে রেখে দিন পার করছে। জাহানারা সুযোগ পাননি এতসবের মাঝে ইউভান সম্পর্কে জারাকে কিছু জিজ্ঞেস করার।
সময়গুলো জারার নিকট খুবই তিক্ত হয়ে উঠেছে। বাবা বন্ধ করেছে কোচিং, ভার্সিটি। যতদিন না আমাদকে পুলিশ কব্জা করতে পারছে ততদিন জারাকে অতি সাবধানে থাকতে হবে। কিন্তু জাহানারার এই বিষয়টা মোটেও সুবিধার লাগছে না। রাগ হচ্ছে প্রচন্ড ইউভানের ওপর। অচেনা একটা ছেলের জন্য কিনা তার মেয়ের প্রাণ আজ সংশয়ে? অফিসের জন্য তৈরি হতে গিয়ে উনি জুতোটা ঠাস করে মেঝেতে রাখলেন। বিরবির করলেন কিছু। উপমা খাবার টেবিলে বসে টিভি দেখছিল। সামনে ছিল আধ খাওয়া নুডলস। মায়ের এমন ঝাড়িতে দ্রুত সে টিভি অফ করে। জাহানারা বেরিয়ে যান ঘর থেকে। যাওয়ার আগে জারাকে ঘরে ফেরার নির্দেশ দেন। তবে এই নির্দেশ অমান্য করে জারা ভালোলাগাকে ঠাঁই দিয়ে বসে থাকে ঘাসের ওপর। কড়া রোদের মাঝে বিড়াট জাম গাছ তাকে ছায়া দিয়েছে। ফুরফুরে বাতাস সঙ্গি হয়েছে। সুন্দর এই মুহূর্তে আরো একজন সঙ্গী হতে হেঁটে আসে। মুখটা তার ভাড়। বাবরি রূপ ধারণ করা চুলগুলো চোখের ওপর নির্দবাবে খেলছে। সে বুকের মাঝে আগলে রেখেছে কিছু। ঠিক আগলে নয়। লুকিয়ে রেখেছে শার্টের ভাঁজে বুক পাঁজরে। কালো শার্টের ভেতর থেকে এই প্রথম দেখা মিলল কালোর বাইরে ভিন্ন এক রঙ। গ্রে রঙ। যেন মনে হলো তার অজান্তেই এটা তার স্বাভাবিক স্বভাবের আহ্বান। আর সে আহ্বানে ক্রমেই সাড়া দিচ্ছে ইউভান।
নগ্ন পায়ে হেঁটে এসে জারার পাশে বসে পড়লো ইউভান। তার হঠাৎ আগমনে বাতাস ভারি হলো সুবাসে। শীতল এক অনুভূতির উৎপত্তি মস্তিষ্ক খুঁজে নিতে জারা চক্ষু ঘেরালো পাশে। ইউভানের মুখটা বড্ড শুকনো। এলোমেলো চুলে তাকে লাগছে ভীষণই বাচ্চা। জারা এতোদিনে যেটুকু উদ্ধার করেছে ইউভানের সাইকোলজি তাতে তার মন বলল একটা গড়বড় হয়েছে। যে গড়বড় ইউভানের মনের বিরুদ্ধে। ইউভান শার্টের খোলা অংশ দুটিকে উন্মুক্ত করতেই বেরিয়ে আসলো জারার ছোট সাদা বিড়াল। সব ভুলে তার চোখজোড়া বড় হয়ে গেলো। দ্রুত কোলে তুলে নিল সে। ভরপুর আনন্দে কাঁপা স্বরে শুধালো
” কোথায় পেলেন ওকে? ”
” আমার কাছেই ছিল। নিয়ে গিয়েছিলাম তুমি আমার চাইতে ওকে বেশি প্রেফার করতে। ”
জারা অবাক হলো। স্বভাব বেশে তার এক হাত চলে গেলো কোমরে। রেগে বলল
” এটা কেমন আচরণ আপনার? আমার প্রিয় জিনিস এটা। আপনি চুরি করেছিলেন? ছিহ! ইউভান। ”
ইউভান রেগে তাকায়। অবশ্যই মিসফিটের দিকে। তাকে খাইয়ে পড়িয়ে এতোদিন আদরে আগলে রেখেও অপবাদ মুছলো তার চরিত্র থেকে?
” শোন জারা, তুমি আমার চাইতে ওকে বেশি গুরুত্ব দিতে পারবে না। আমি তোমার প্রতিটি জিনিস দূরে সরাবো যদি তুমি…. ”
এটুকু বলতে গিয়েই তাকে থামতে হয়। মিসফিট লাফিয়ে তার কাঁধে উঠে গেছে। শুধুমাত্র এতেই তার শখ পূর্ণ হয়নি। সে রীতিমতো ইউভানের গালের সঙ্গে সন্ধি গড়লো। ফলস্বরূপ তার নরম তুলোর মত সাদা পশমগুলো ওড়নার মতো হালকা হাওয়ায় উড়ে এসে ইউভানের চোখের ওপর পড়ল। ইউভান তাই মাঝপথে কথা ভুলে চোখ মিটমিট করছে।
জারা একটু হাসলো। সেই হাসিতে অনেকদিনের জমে থাকা হিম গলে গেল। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে নিজের আঙুল দিয়ে ইউভানের চোখের উপর থেকে মিসফিটের নরম পশমগুলো সরিয়ে দিল। আঙুলের স্পর্শে ইউভান চুপ করে গেল। চোখ বন্ধ করে রাখলো, যেন সে মুহূর্তটুকু চিরদিনের মতো ধরে রাখতে চায়।
জারার আঙুল ছুঁয়ে থাকলো তার কপালে, চুলে।
” আপনি একটা বাচ্চা, যে কিনা সঙ্গীকে হারানোর জন্য একটা বিড়ালকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। একটা হাতিমার্কা বাচ্চা। ”
কথাটা বলেই জারা নিজের অজান্তেই হাসে। হাসতে হাসতে সে ইউভানের বুকের ঝড়কে কালবৈশাখী ঝড়ে রূপ দিতে তার পকেটে গুঁজে দেয় একটা ঘাসের ফুল। ইউভানের মাথায় হাত দিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করে। ইউভানের গলা শুকিয়ে যায়। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ঘন হয়ে বিছিয়ে থাকা ঘাসের বুকে। ঠোঁটে তার হালকা হাসি। যেন জয় করেছে অসম্ভব কিছু। তার কল্পনায় সে পৌঁছে যায় রঙিন এক দুনিয়ায়। তার রঙহীন পৃথিবী মুহূর্তে হয় রঙিন। সেই আকাশে ছিল বড়বড় অক্ষরে মেঘের কালিতে লেখা
“She is the colour in my colorless life”
জারার ভালোবাসা অজান্তেই উচ্চারণ না করে জন্ম নিচ্ছে। আর যন্ত্রণা ধুয়ে যাচ্ছে নীরবতার উষ্ণতায়।
.
আমাদ সে বাড়িতেই ঠাঁই নিল দুই দিন। হাসির সঙ্গে তার লুকোচুরির সম্পর্ক। মেয়েটাকে আমাদ কে দেখলেই লজ্জায় দৌড়ে পালায়। তবে আজ আমাদ হঠাৎ করে তার ছোট হাতের কব্জি ধরে। খোলা হাওয়ায় বারান্দায় বসে জিজ্ঞেস ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে
” ভয় পাও কেন আমাকে? নাকি লজ্জা পাও? এইটুকু মেয়ের লজ্জা! ও বাবা! কি লজ্জাবতী তুমি। ”
হাসি হাত মোচড়াচ্ছে। তার বুক ঢিপঢিপ করছে। অজানা আশঙ্কা যেন তাকে চেপে ধরলো। তবে আমাদ এর সরল মুখ তাকে বশ করল দ্রুত। ভরসা পেয়ে সে এবার প্রথম বারের মতো আমাদ এর জন্য একটা বাক্য ব্যায় করলো
” আপনি যাবেন কবে?”
লজ্জার বিষয়! আমাদ মাথা চুলকালো ঈষৎ লজ্জায়।
” আজ যাবো। ”
তাদের এই মিষ্টি মুহূর্তে হঠাৎ আগমন ঘটল একটা অচেনা ছেলের। লুঙ্গির একাংশ এক হাতে রেখে কলঙ্কের মাথার ছবি রূপী একটা টি শর্ট পড়ে ষাঁড়ের মতো চিৎকার দিয়ে ডাকলো
” হাসি, হাসি রে। কি হরোস?”
হাসি ছুটে পালালো মুখে ভয়ের ছাপ নিয়ে। ছেলেটা দৌড়ে গেলো ওর পিছু পিছু। চোখের দৃষ্টিতে কেমন নোংরা ভাব। হাসি লুকালো তার ঘরের বিছানার নিচে। আমাদ বারান্দায় জানালার ধারে বসে সবই পরখ করছে। অচেনা ছেলেটা হাসিকে বিছানার নিচ থেকে টেনে বের করে চোখ ঘুরায় চারিপাশে। বিভৎস রকমের মন নিয়ে ছোট হাসিকে সে ছুঁতে যাবে যখনই তখন আচমকা অশরীরির মতো আমাদ এর আগমন হয় ছেলেটার পেছনে। দু-হাত পকেটে গুঁজে চোখে দাবানল দাহ্য আপাদমস্তকে ঠাঁই দিয়ে সে অনঢ় হয়ে পেছন থেকে একটা লাথি বসিয়ে দিল ছেলেটার পিঠের মধ্যে। উবু হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় নাইম। আমাদ তখনও হীম। সে হাসিকে নিজের টিকে টেনে নেয়। একারণেই সম্ভবত ছোট মেয়েটা প্রথম প্রথম তার থেকে পালিয়ে বেড়াতো। এই ভয়ে! ভাবতেই বুকের এক পাশে যেমন ব্যাথা হয় আমাদ এর ঠিক তেমন আগুন জ্বলে ওঠে। নাইম পেছন ফিরে চায়। আমাদ এর দৃষ্টি প্রস্তুত ছিল তার কথা গ্রহণ করার জন্য। নাইম তেড়ে আসতে চাইলে আমাদ অকাতরে জানায়
” উমমম, দূরে দূরে।”
সে কন্ঠে কি যেন ছিল। নাইমের পা উঠলো না কিছুসময়ের জন্য। মিনিট তিনেক হবে। অতঃপর সে অকথ্য ভাষায় গালি দিতে দিতে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। আমাদ বাঁকা হাসল তিরস্কার সরূপ। অতঃপর বিরবির করে বলল
” ছা প ড়ি ”
.
অনিক সিদ্ধান্ত নিলো আমাদ এর ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার। নিউজে দেওয়ার। নয়তো তাকে ধরা অনেকটা অসম্ভব। নদীর ওপারে তারা খোজ নিল না। নিশ্চয়ই আমাদ বসে থাকবে না সেখানে। কিন্তু ধারণা এখানেই ভুল। এমন একটা চিন্তাভাবনা পুলিশ করবে বলেই আমাদ বসে আছে এখনো সে বাড়িতে।
বারো সালের কেইস যে গ্রামে সংঘটিত হয়েছিল সে গ্রামের স্থানীয় থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেলো তিন জন মানুষের প্রাণ গেছে। তাতে করে গ্রামের মানুষ বেশ খুশি ছিল। কারো অসুবিধা হয়নি বিধায় পুলিশও ক্লোজ করে দিয়েছিল কেইস। উপরন্তু তারা এসে হট্টগোল করতো থানায় মাঝে মাঝেই।
অনিক আরো ঘাটাঘাটি করে পৌঁছে যায় আমাদ এর বস্তির প্রতিবেশীদের নিকট। জানতে পারে আমাদ এর মা-ই করুনভাবে প্রাণ হারিয়েছে। অতঃপর বোঝার বাকি থাকে না প্রথম স্যাডো জাস্টিস কেন বারো সালে আত্মপ্রকাশ করেছিল। মায়ের মৃ ত্যু র প্রত্যক্ষ প্রতিশোধের দরুন। অতঃপর আমাদ হয়তোবা বয়সের সঙ্গে হয়ে উঠেছে অন্য মন মানুষিকতার ছেলে। মস্তিষ্কে গেঁথে যায় তাকে শেষ করতে হবে সমাজ থেকে ধর্ষকদেরকে। আমাদ এর খুঁটিনাটি উদ্ধার করতে গিয়ে একসময় বেরিয়ে এলো এক চাঞ্চল্যকর তথ্য।
টপ বিজনেসম্যান ম্যাম শাহিনুজ্জামান এর বাসায় পৌঁছে পুলিশ বাড়ির ড্রয়িং রুমের একটা দেয়ালে আবিষ্কার করল হা হয়ে যাওয়ার মতো তথ্য। দামি সুট, বুট, টাই পড়া একটা ছবি দেয়ালে ঝুলছে। যার উচ্চতা ছ ফুটের কাছাকাছি। এতো বড় ছবিতে দেখা যাচ্ছে আমাদ কে। যার কোটের পকেটে ব্যাজ ঝুলছে এ বংশের। অর্থাৎ জানা গেলো সে এই আলিশান পরিবারের দত্তক নেওয়া সন্তান। কিন্তু যখন আমাদ এর বিষয়ে আমাদ এর মা’কে জিজ্ঞেস করা হলে তখন ওনার উত্তর মিলল
” জানি না ফাইরুজ কোথায়। ওর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নেই আজ পাঁচ বছর হবে। নিজের মতো জীবনযাপন করে। বাসায়ও আসে না।”
চলবে….
#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ৩৫
দিন পাঁচ এভাবেই কাটলো। আমাদ ফিরলো সে গ্রাম থেকে রক্ত মাখা শরীরে এক নিশিতে। নাইম নামের ছেলেটার গলা কাটা লাশ উদ্ধার করলো পুলিশ। নিউজ, টিভি, সামাজিক মাধ্যমে এখন আতঙ্ক। এমন এক পরিস্থিতি বিরাজ করছে যেন মনে হয় রাস্তার প্রতিটি পুরুষের কলিজায় ভয়। তবে নারীরা নিজেকে আবিষ্কার করছে মুক্ত পাখির মতো। তারা আশ্চর্যজনক ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে সানন্দে। কারণ আমাদ রেখে গেছে নাইমের সঙ্গে একটা বার্তা। যা রক্ত দিয়ে লেখা ছিল ব্রিজের ওপরে অস্পষ্ট ভাবে
“আমাদ ধর্ষকদের জন্য সমাজে কোনো জায়গা রাখে না—সে তাদের অস্তিত্বই মুছে ফেলে।”
নিউজ দেখার পর মুহূর্তে ইউভান সিদ্ধান্ত নেয় জারাকে বিয়ে করার। আর কোন সময় গড়াতে দেওয়া যাবে না। একই ভাবে এমনই সংকল্প বুকে এঁটে বদ্ধ ঘরে ছক কষে আমাদ। তাকে পৌঁছাতে হবে জারার নিকট। আর ইউভানকে নিঃসঙ্গ করতে হবে। একেবারে ভেঙে দিতে হবে ভেতর থেকে।
এরই মাঝে দেশে আগমন ঘটে আরমান শাহর। তিনি তখনও ইউভানের বিয়ের বিপক্ষে। জারা বসে ছিল বাড়ির বাইরে। সন্ধ্যা নামার মুহূর্তে একটা সাদা গাড়ি গেইট দিয়ে প্রবেশ করে। রাগ সমেত নেমে আসে ইউভানের বাবা। তিনি একবার ক্ষিপ্ত রোমপূর্ণ দৃষ্টিতে জারার পানে তাকান। তখনই জারার হৃদয় কাপে। মনে পড়ে সেদিন রেস্টুরেন্টে বলা কথাগুলো। লজ্জা আর সংকোচে তার ইচ্ছে হয় মাটির নিচে ঢুকে যেতে। তবে পরক্ষণেই ভয়ের উদ্রেক ঘটল। বুকটা বিষিয়ে উঠছে। ধীরে ধীরে যাতনা গলা বেয়ে উঠছে। দপদপ করছে একটা ভাবনা। সে কি ভয় পাচ্ছে ইউভানের থেকে দূরে সরতে? আজ মন পুরোপুরি জানিয়ে দিল তার সুপ্ত অনুভূতি। কিন্তু সে অনুভূতি ছোঁয়া যে ভীষণ জটিল সেকথা মাথায় আনতেই বুক কাপে জারার।
.
ইউভানের সঙ্গে উত্তাল একটা কথা-কাটাকাটি হয় তার বাবার। পারিবারিক আলোচনা। ইউভান এমন কিছু বলে আরমান শাহকে যাতে করে উনি ভগ্ন হৃদয়ে বেরিয়ে যান বাসা থেকে। তবে তার আগেই ঘটে সবচাইতে ভয়ঙ্কর কাহিনি। আরমান শাহ যখন বললেন
“তোমার জন্য টাকার পাহাড় গড়েছি আমি তোমার নষ্ট জীবন দেখার জন্য? তুমি এখানে ওই মেয়ের জন্য পরে থাকবে আর আমাদ এসে তোমাকেও মে রে ফেলবে ইউভান।”
“আপনি ভাবছেন তাহলে আমাদ এর কথা? আপনি ভাবছেন? শুনুন আরমান শাহ, আপনি যদি সেই সময়ে আমাদ এর কথা আর আমাদের কথা ভবতেন তাহলে আমরা কেউই আজ এমন পরিস্থিতিতে থাকতাম না। না আমরা শত কষ্ট বুকে চেপে বড় হতাম। আমার মা’কে হারাতাম না আমি। আপনি জানেন না মা হারানোর কষ্ট। আপনি জানেন না একা থাকার কষ্ট। যে কষ্ট আমি আর আমাদ দু’জনেই বয়ে বেড়াচ্ছি। ”
“তুমি কি আমাদ এর পক্ষে কথা বলছো?”
“পক্ষ বিপক্ষ বুঝি না আমি। আমি শুধু বুঝি সবকিছুর জন্য আপনি দায়ী। প্লিজ আপনি বেরিয়ে যান আমার বাসা থেকে। আপনাকে দেখলে আমার খু নি শব্দটা মাথায় আসে। যে দু’টো ছোট বাচ্চার মায়ের মৃত্যুর কারণ।”
” ইউভান, সবই আমি তোমার জন্য করেছি। তুমি আমার আদরের ছেলে।”
ইউভান সে পর্যায়ে ভ্রু উঁচিয়ে বিদ্রুপ করে তাকায়। মাথা ঝাকিয়ে বলে
” আদরের… এতোটাই যখন আদরের তখন আমাকে সাত বছর বয়সে এই বাসাতে বন্দী করে একা রেখে গিয়েছিলেন কেন?”
” কারণ আমি ভেবেছিলাম তুমি তোমার মা’কে… ”
ইউভান তাকিয়ে থাকে অপলক। যেন সে স্পষ্ট ভাষী হয়েও আজ এই মুহূর্তে বাক হারা হয়ে গেছে।
” শোন, ইউ কে তে চলো। সারা জীবন বসে খাবে তুমি। ওখানে বিজনেস কোরো, নয়তো ওখানে কেইস সলভ কোরো। এখানে রাখবো না তোমাকে। জারাকে ভুলে যাও। সে তোমাকে দাবার গুটির মতো ব্যবহার করছে।”
ইউভানের চোখ দপ করে জ্বলে উঠেছিল। আরমান শাহ এরপর যখন বললেন
” জারার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক আমি হতে দেবো না। তুমি যত জেদই করো না কেন। তোমার সম্পত্তির ওপর ওর লোভ আছে ইউভান এটা তুমি বুঝতে পাছো না।”
ব্যাস, এটাই ছিল ইউভানের জন্য যথেষ্ট। বাড়ির বাহিরে দাড়িয়ে তারা কথা বলেছিল। ইউভান পকেটে হাত রেখে দাড়িয়ে ছিল। হঠাৎই সে আকাশ পানে চায়। অতঃপর হঠাৎই পকেট থেকে দিয়াশলাই বের করে ছুড়ে মারে একটু আগে আটৃান শাহ যে গাড়িতে এসেছে তার দিকে। মুহূর্তের মধ্যে আগুন জ্বলে। ইউভান সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে৷ আর মান শাহ পিছিয়ে যায়। ইউভান এগিয়ে যায় দু’পা বাবার নিকট। বলে
” জাস্ট একটা নমুনা দেখালাম। আপনি যদি আমার পথের কাটা হয় তাহলে আপনার সব সম্পত্তি জ্বালিয়ে দেবে আমি। তার নামে আপনি যে কলঙ্ক লেপ্টে দিলেন সেটা সরাতে যদি আমাকে নিঃস্বও হতে হয় তাহলে আমি তাই হবো। কিন্তু তার নামে কোন অপবাদ আমি সইব না। আর একটা কথা বাবা, আপনি বারবার বলছেন আপনি বিয়ে হতে দেবেন না কিন্তু আপনি হয়তো জানেন না আপনি দাওয়াতের লিস্টেই থাকবেন না।”
কথাগুলো বলে ইউভান ধীর গতিতে হেলতে দুলতে চলে যায় নিজ ঘরে। যেন তার উগ্রতা এবার আরো এক ধাপ বাড়িয়ে দিলেন আরমান শাহ। যে স্বাভাবিক ভাবটুকু জারার কারণে এসেছিল তা আবারও তলিয়ে গেলো গহীনে।
.
নিজের বিয়ের ঘটক কি কখনো নিজে হওয়া যায়? এমন ইতিহাস পৃথিবীতে আগে কখনো রটেছে বা ঘটেছে কিনা তা জারার জানা নেই। কিন্তু সে আজ জানলো। ড্রয়িং রুমে পানির বোতল হাতে রেখে আর এক ঢোক পানি মুখে রেখে যখন বসে ছিল সে সোফায় তখন আচমকা জাদুকরের মতোই আগমন ঘটে ইউভানের। সে ইন করা কালো শার্ট পড়ে কড়া পারফিউম লাগিয়ে উপস্থিত জারাদের ড্রয়িং রুমে। উপমা ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিল। ইউভান জুতো পরেই ঢুকে পরেছে। এ নিয়ে সে বেজার ক্ষেপে জারার দিকে তাকালে ইউভান টুপ করে উপমার দৃষ্টির সামনে দাড়িয়ে যায়। তীব্র অসন্তোষ তার চোখে মুখে। কন্ঠ হতে ধ্বনিত হয়
” চোখ নিচে।”
উপমা ভয় পায় না এই লম্বা বস্তুটাকে। উল্টে নিক্ষেপ করে সেই দৃষ্টি ইউভানের দিকে। ইউভান তখন ডেকে ওঠে জারার মা’কে
” আন্টি? আপনার ছোট মেয়ে পাত্রর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে।”
এই বাক্য শুনে জারার মুখের পানি মেঝেতে ছিটকে যায়। সে দৌড়ে এসে ইউভানের পাশে দেড়িয়ে বলে
” কে পাত্র, কিসের পাত্র?”
ইউভান তোয়াক্কা করে না। তবে জারার ভিজে যাওয়া গলা পকেট থেকে টিস্যু বের করে জারার হাতে দিয়ে মুছে ফেলার নির্দেশ দেয়।
” ঠান্ডা লাগবে। মুছে নাও। আর আমি আজ পাত্রির সঙ্গে কথা বলতে আসিনি। গুরুজনদের সঙ্গে কথা বলবো। ডাকো তোমার মা-বাবাকে।”
” কে এসেছে? ”
জাহানারার দৃষ্টিতে বিরক্তি আসে। ইউভান সোফায় বসে। সালাম জানায়। অতঃপর বলতে শুরু করে
” জানি আন্টি, আপনি আমার ওপর বিরক্ত। জারার ওপর আক্রমণ হওয়ার কারণে। কিন্তু আমি আপনাকে টেনশন ফ্রি করার জন্য এসেছি। পাত্র হিসেবে পারফেক্ট, বর হিসেবে যত্নশীল, সাতাশ বছরের জীবনে দ্বিতীয় কোন মেয়ের দিকে না তাকানো ছেলে ইউভান অর্থাৎ আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করবো আগামী দুদিনের মধ্যে। আপনার অনুমতির সাপেক্ষে না হলেও বিপক্ষে করবো।”
জাহানারা ইউভানের সামনে বসেন। শান্ত কন্ঠে জানান
” বিয়ে দেওয়া হবে না। পাত্র পছন্দ নয় আমার। ”
” তাতে পাত্রর কিছু যায় আসে না।”
জাহানারা হা হয়ে যান৷ রাগে ফেটে পড়েন। ইউভান তা উপেক্ষা করে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে। তার ভাব ভঙ্গি বলল সে খুবই সিরিয়াস। জারা ঘরে ফিরলো। ফোন করলো ইউভানকে।
” আমি অযু দিয়েছি কথা বলতে পারবো না। ”
এরপর ফোন কাটে। জারা আশ্চর্য হয়। মুহূর্তের মধ্যে আবার তার অযুও হয়ে গেছে? আবার সারাদিন পিছু ঘুরে এখন আবার লজিকও দিল? কি সাংঘাতিক সে। জারা চিন্তায় পরে যায়। ইউভানের কাছে সবকিছু সহজ মনে হলেও তার জন্য মোটেও কিছু সহজ নয়। ক্রমশ সে সব জটিলের মধ্যে দলাদলি হয়ে যাচ্ছে। ইউভানের যত্ন তাকে গভীরভাবে ভাবতে শেখালেও বাস্তবতা ভিন্ন কিছুই বলে। সমাজের চোখে এটা মোটেও সু দৃষ্টির কিছু নয়। আর না তার মা বাবার জন্য ভালো কিছু। একবার তাদের মান সম্মানে প্রশ্ন তুলে দ্বিতীয় বার সামনে হাঁটতে ইচ্ছে করছে কি লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। সে এক ইউভানের জন্য মনে জমা এক টুকরো অনুভূতি গিলে ফেলতে পারবে কিন্তু মা বাবার অপমান আর সহ্য করতে পারবে না।
.
একদিন ডেকে পাঠানো হলো উপমা কে পুলিশ স্টেশনে। অনিকের মাথায় ভিন্ন কিছু চলছিল। সে এখন মত্ত আমাদকে খুঁজে বের করতে। এখন উপমাই একটা পথ যে কিনা তাকে আমাদ পর্যন্ত পৌঁছে দিতে সমক্ষ হবে।
চলবে…..