#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ৩৬
আঁধার কাঁপছে আমাদ এর তপ্ত নিঃশ্বাসে। যেন পরিবেশ ঠাহর করে নিয়েছে আজ নিয়তি ঘটাতে চলেছে এক ভয়ঙ্কর কিছু। তবে তা কি? হয়তোবা কারো নিষ্ঠুর সমাপ্তি।
আমাদ কালো জ্যাকেটের নিচে লুকিয়ে রাখে তার কাঙ্ক্ষিত অস্ত্র। গান, ছুড়ি ইত্যাদি আধুনিক পন্থার গন্ডি পেরিয়ে সে আপন করেছে একটামাত্র ধারালো তলোয়ার। যেন সেই পাতলা অস্ত্র সহজেই লুকিয়ে রাখা পিঠে। আর চাইলেই যে কেন সময়ে তা বের করে ছিন্ন করা যায় যে কারো গলা। পুলিশের নজর থেকে লুকিয়ে রাখা কিছুটা সহজ হয়।
এই তলোয়ারের ইতিহাসটাও ফেলনা নয়। প্রতিশোধের অনলে নিজেকে পুড়িয়ে টানা ছ’মাস সে নিখুঁত ভাবে অর্জন করেছে এর ব্যাবহার। এক নিষিদ্ধ অস্ত্রপাচার কারখানায়। প্রথম বার হাতে ক্ষত সৃষ্টি হয়। যে ক্ষতটা আজও তার হাতে অমলিন হয়ে টিকে আছে।
মাথায় হেলমেট, হাতে মোজা আর ঢেকে যাওয়া চোখে অগ্নিশিখার অনল নিয়ে সে যখন পেছন ফেরে। দম্ভভরে একা পা এগিয়ে যায় ঠিক তখনই বেজে ওঠে টেবিলে পড়ে থাকা ফোনটা। তার চিৎকার একটু বিরক্ত করল আমাদকে। তবুও হাতে নিয়ে রিসিভ করে। ওপাশ থেকে ভেসে আসে কেয়ার ভয়ার্ত কন্ঠ
” কেউ একজন উপমাকে আটক করেছে। শহরের পরিস্থিতি ভালো না। উপমার মা-বাবা, ইউভান পুরো শহর চুষে বেড়াচ্ছে। ওরা যদি আপনাকে সন্দেহ করে থাকে? আপনি এখন বাইরে বের হবেন না ভাইয়া। এটা সেইভ সময় নয়। রাস্তায়, রাস্তায় পুলিশ। ”
আমাদ এর বুকে কিছু একটা ছড়িয়ে পড়ে। যার অনুভূতি বিষের যন্ত্রণার মতো। প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেই যন্ত্রণা ছড়িয়ে পরার পূর্বেই সে ফোন ঘেঁটে উত্তাল নেটের বার্তায় চোখ বুলিয়ে নেয়। কিন্তু সেখানে মিডিয়া কভার করেনি উপমার বিষয়৷ সে কোন সেলিব্রিটি নয় বলেই হয়তো! কিন্তু আমাদ কি হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? জারার কথা ভুলে সে কম্পিউটারে বসে পড়ে। হ্যাকিং বিষয়টি তার আয়ত্তে ছিল বেশ করে। পড়ালেখা করা হয়েছে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারে। তার নিষিদ্ধ ভালো কাজের জগতে এমন স্কিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
উপমার মায়ের ফোন হ্যাক করে সে। সেখানে মেলে একটা ভিডিও। যে ভিডিওর ধার, ধরণ দেখেই সে বুঝে নেয় উপমা কোথায় আছে। তবে মাথায় রক্ত ওঠে উপমার বাঁধা হাত পা দেখে। সে তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে পরে। সে জানে উপমা তার নয়, সে জানে উপমা কাব্যর। তবুও… তবুও তার ভালোবাসা তো উপমার নামে গড়া। এই অদ্ভুত শব্দটা যখন কেউ বুকে পুষতে শুরু করে তখন সে যেন হিসাব ভুলে যায়। ভুলে যায় কে কাকে পাবে, কে কাকে হারাবে। শুধু জানে তাকে আমার বাঁচাতে হবে। তার চোখের জল আমাকে পুড়িয়ে ফেলে।
.
আমাদ অবশেষে পৌঁছে যায় সেই আস্তানায়। একটা পুরোনো গ্যারেজ। চারিপাশে বিধ্বস্ত গাড়ি। মাঝে হেঁটে যাওয়ার জন্য রাখা একটা প্রশস্ত রাস্তা। মাথার হেলমেট ছুড়ে ফেলে উন্মাদ আমাদ। তার হাঁটার চলে যেন কম্পন ওঠে। দূর থেকেও সে শব্দ কানে বাজে অনিকের। সে প্রস্তত হয়। ছদ্মবেশ ছিল প্রতিটি পুলিশের পোশাকে। নেই ডিফেন্সের কোন সাজসজ্জা। ওরা কোমরের বন্দুক নিয়ে প্রস্তুত হয়। উপমা ছিল সহজ, স্বাভাবিক। যখন কানে বাজে ধারালো ছুরি আর দেহের সংঘর্ষের অদ্ভুত গা শিউরে দেওয়া শব্দ তখন সে কেঁপে ওঠে। এমন ভয়াবহ পদক্ষেপ সে অনিকের সঙ্গে নিয়েছে কেবলই, শুধুমাত্র জারার প্রাণের নিরাপত্তার কথা ভেবে। তবে সে এটা জেনে অবাক হয়েছে আমাদ তার জন্য আসবে এখানে। সে সত্যিই অবাক। নারী মন, নারীর হৃদয়ের চোখের দৃষ্টি হয় শক্তিশালী। সে চোখ জানে পুরুষের হৃদয়ের রূপ৷ সে দৃষ্টি প্রেমিক বক্ষ ভেদ করে পৌঁছে যায় হৃদয়ের কাছাকাছি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে আসে, উঠিয়ে নিয়ে আসে এক টুকরো অনুভূতি। উপমা আমাদ এর সেই অনুভূতি উদ্ধার করেছিল। কিন্তু কথায় আছে না? যার শান্তি যেখানে মেলে। তার শান্তি মিলেছিল কাব্যর নিকট। সে-ই কাব্যও উপমা আর পুলিশের এই চুক্তির চুলপরিমাণ জানে না। তবে জানে জারা ও ইউভান। তারা একটু আগেই ছুটে এসেছে। জারা এই পরিকল্পনায় খুশি হতে পারছে না। একইভাবে ইউভানও অসন্তোষ। তার বুক ঢিপঢিপ করছে। কিন্তু কেন? অজানা সে কথা।
কিছু জনের অন্ত চিৎকার ভেসে আসছে বাহির থেকে। হৃদয় কাপে ভেতরে অনিশ্চয়তা নিয়ে হাশফাশ করা প্রতিটি মানুষের। জারার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। উপমার শরীর কাঁপছে থরথর করে। তাকে কেন্দ্র করে! হ্যা সবই তাকে কেন্দ্র করে। বাহিরে আমাদ যেন উন্মাদ হয়ে গেছে। অনিকের প্রতিটি কনস্টেবল রক্তের মাঝে শুয়ে পড়ছে। আর আমাদ? সে তো এগিয়ে আসছে সিংহের হিংস্রতা নিয়ে। অনড় চোখের দৃষ্টিতে জ্বলে যেন আগুন। থামে না পা। কেবল চলে হাতের ধারালো তলোয়ারের আন্দোলিত মুহূর্ত। সঙ্গে ছ্যত ছ্যাত শব্দ।
ভেজা বুটজোড়া কংক্রিটের মেঝেতে পায়ের শব্দ তুলে এগিয়ে যায় আমাদ। ভিতরে ঢোকার আগেই হঠাৎ একটা ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে কাঁটা ধরিয়ে দেয়। দরজা খোলা ছিল—অস্বাভাবিকভাবে। এক পা ভেতরে ফেলার পর তার চোখ আটকে যায়। নেমে আসে ঘুটঘুটে কালো আইরিশে শূন্যতা।
পিনপতন নীরবতা সেখানে।
না, চিৎকার নেই, কান্না নেই, সহানুভূতির এক বিন্দুও নেই।
শুধু শূন্যতা। তার সামনে উপমা। একদম ঠিকঠাক। অক্ষত।
অস্পষ্ট আলোয় দাঁড়িয়ে, চোখে কোনো চমক নেই।
কোনো বিস্ময় নেই। আমাদ থেমে যায়। বরফের ন্যায় শীতল, গোপনে পদক্ষেপ নেওয়া মস্তিষ্ক বুঝে যায় সব। তার হাত থেকে তলোয়ারটা নিচে পড়ে যায়।
তার ঠোঁট ফাঁকা ফিসফিস করে
“তুমি….”
বাকি শব্দগুলো আঁটকে যায়। যেন জিহবা হয়ে যায় অসম্ভব ভাড়ি। উপমার চোখ নামিয়ে নেয়।
ঠিক তখনই—
চারপাশ থেকে বেরিয়ে আসে নির্দিষ্ট পেশাকের সজ্জায় সজ্জিত পুলিশ বাহিনী। আমাদ এর পিঠে লেগে থাকা রক্তের ওপর পড়ে যায় রাইফেলের ছায়া।
অনিক সামনে আসে। চোখে ঠাণ্ডা হাসি।উপমার দিকে তাকিয়ে থাকে না আমাদ। সে তাকিয়ে থাকে কেবল উপমার চোখে—যেখানে কোনো প্রেম নেই,কোনো ভয় নেই। শুধু একটা দ্বিধার ছায়া আছে।
ইউভান দাঁড়িয়ে থাকে নির্লিপ্তভাবে। একটুও এগিয়ে আসে না। একটুও বাঁধা দেয় না।
আর দূরে, এক কোণায় দাঁড়িয়ে জারা অনুভব করে আমাদ এর বুকের ক্ষতকে। সে যেন দেখতে পায় একজন পরাজিত যোদ্ধাকে। যে রাজ্য জয় করতে এসে শুনেছে রাজ্যের রাজা নিজেই চায় পরাজয়।
আমাদ এর মুখে ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে এক টুকরো হাসি। কঠিন সেই হাসির রেখা। বিষাদে ভরা। সে তার স্পষ্ট কন্ট নিয়ে উচ্চারিত করে
“তুমি ছিলি এই ষড়যন্ত্রের ভেতর?”
উত্তর জেনেও আকাঙ্খা। উপমা নিশ্চুপ থাকে। আমাদ ওপরের দিকে মাথা দিয়ে কিছুসময় নিশ্চুপ থাকে। কেউ পর্যবেক্ষণ করেনি তার চোখের কোণের জল। সে এই গুটিকয়েক পুলিশের নিকট হেরে যায়নি। সে হেরে গেছে সেই চোখের দৃষ্টিতে। যে দৃষ্টি আজ সত্যিই তাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। হ্যা, প্রেমিকার চোখের দৃষ্টিতে সত্যিই প্রেমিক ফেঁসে যায় মৃত্যুর ফাঁদে আর একথাটা কঠিনভাবে সত্যি প্রমাণ না করলে কি হতো না উপমার? আমাদ সোজা হয়ে দাঁড়ায়। কখন যে কেটে গিয়েছিল তার হাতের বাহু, ঠোঁটের কেণে তা এখন যন্ত্রণা করতে শুরু করেছে। সঙ্গে হৃদপিণ্ডও। ঠোঁটের কোনে রক্ত আর , বুকের মাঝে ক্ষত নিয়ে আমাদ তার সুন্দর মুখশ্রীতে ফুটিয়ে তুলেছে এক ঝলক লুকানো বেদনা। বলে সে হিম কন্ঠে
” প্রেম চাইনি কিন্তু একটু প্রত্যাশা চেয়েছিলাম তোমার থেকে উপমা।”
উপামর বুকটা কেঁপে ওঠে। আমাদ শেষ বারের মতো বলে
” ভেবেছিলাম তোমার চোখে আমার ঠাঁই আছে
আজ বুঝলাম, সেই চোখ আমার কবর খুঁড়েছে। ”
কথাটা বলা শেষ করেই আমাদ পায়ের সাহায্যে একটা কনস্টেবলকে লাথি দেয়। ছিনিয়ে নেয় তার রাইফেল এবং তাক করে জারার পানে। বিষয়টা এতো দ্রুত ঘটলো যেন কেউ চোখের পলক ফেলার মধ্যেই সম্পন্ন হলো এটা।
চলবে…..
#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ৩৭
লয় তুলে এক পা বারিয়ে এক কদম দূরত্বে সামনে যেতেই রাইফেলের লম্বা সরু নলে শক্ত এক হাত এসে বাঁধা হলো। আধখোলা কালো শার্ট পরা ইউভানের উঁচু দেহ পাহাড়ের ন্যায় ঢাল হয় জারার সম্মুখে। চোখ তার রক্তলাল। হাতের শিরা জেগে উঠেছে। কপালে চিকচিক করছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ইউভান স্থির চেয়ে স্পষ্ট কন্ঠে ব্যাক্ত করলো
” তুমি কি ভুলে গেছো এখানে ইউভান দাড়িয়ে আছি?”
“আহ! আপনি ভোলার মানুষটাই নন স্যার। অল টাইম আপনি আমাকে খুঁচিয়ে মারেন। ”
কথায় রসিকতার সুর থাকলেও চোখে ছিল আমাদ এর এক রাশ ঘৃণা। সে আরো এক পা এগিয়ে যেতে চায়। রাইফেলের নল তীক্ষ্ণ হয়ে গেঁথে যেতে শুরু করে ইউভানের হাতের তালুতে। সাদা হাতের তালুতে তৎক্ষনাৎ রক্ত জমে। মনে হয় চামরাও কিছুটা বিদীর্ণ হলো। তবে ইউভান দৃঢ়, অটুট তখনও। ঘাড় ঘুরিয়ে অবহেলার ছলে চারিপাশ বেখেয়ালিতে দেখতে দেখতে বলল
“শপথ আমাদ, তুমি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ না করলে আমার হাতে গান উঠবে আর তোমার নিশ্বাস থেমে যাবে।”
“আচ্ছা? ফাইরুজ আমাদকে তুমি চেনো? তার সঙ্গে লড়ার নূন্যতম যোগ্যতা তোমার নেই ইউভান৷ তুমি তোমার বাবার পুতুল। তোমাকে শুধু ঘরে বসে পাগলামি, আর ভাংচুর করতেই মানায়৷”
একটা কটাক্ষ! ইউভানের রাগ পাতাল কাপিয়ে আকাশ ছোঁয়। কাঁপতে থাকে তার হাত। জারা তখন পা বাড়িয়ে ইউভানের পাশে দাঁড়ায়। ইউভানের হাত চেপে ধরে শক্ত করে। ভয় হচ্ছে তার। আমাদ এর সঙ্গে বিশ্বাস শব্দের যেন বিচ্ছেদ হয়েছে অনেক আগেই। আমাদ মুচকি হাসে জারাকে দেখে। যখন সে রাইফেল ঘুরিয়ে জারার দিকে রাখতে চায় তখনই ইউভান শক্ত করে তা চেপে ধরে হুংকার দিয়ে বলে
“আমাদ, শুধু আইন জানি বলে হাতে দস্তানা পড়েছি, গ্লাভস না৷ তুমি একচুল নড়লে আদালত নয় ইউভান রায় দেবে।”
আমাদ এর পাল্টা হুংকার ফিরে আসে তিরস্কার আর অজানা এক ব্যাথার সন্ধিতে
“আরে ভাই তুই ব্যারিস্টার তাই জিহ্বায় নিয়মের তালা লাগানো। আমি রাস্তায় বড় হয়েছি, আমার গুলি আগে চলে বাক্য পরে।”
কথাটা বলেই আমাদ সজোরে একটা লাথি দেয় ইউভানের বুক বরাবর। সঙ্গে রাইফেলের নল দিয়ে আঘাত করে দূরে সরিয়ে দেয়। ইউভান যেন এটা আশা করেনি। সে ছিটকে দূরে পড়ে। ভাঙা, বিধ্বস্ত গাড়ির কাঁচে গিয়ে ধাক্কা খায়। কপাল কেটে যায় তৎক্ষনাৎ। জারার প্রাণ যেন ইউভানের পিছু দৌড়ে গেছে। মনে হলো ইউভানের কিছু হলে সেই অদৃশ্য প্রাণপাখিও পালিয়ে যাবে। জারা দৌড়ে চলে যায় ইউভানের নিকট। এক ঝটকায় গিয়ে আড়াল করে হালকা জড়িয়ে ধরে ইউভানের দেহ। ইউভানের উঠে দাঁড়াতে যেন কষ্ট হয়। আনিক আমাদ এর পিছু এসে মাথায় বন্দুক তাক করে বলে
“তোমার বিশৃঙ্খলা বন্ধ করো আর রাইফেল নিচে রাখো।”
আমাদ শক্ত হয়ে দাড়িয়ে থাকে। তখন তার বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা হাওয়া বইছিল। সম্ভবত জারার আকুলতা ইউভানের নামে, এই ব্যাপারটা তাকে লক্ষ ভ্রষ্ট করছে। এরইমাঝে উপমা চিৎকার দিয়ে বলে
” আপনার এই রূপ আমি কখনো আশা করিনি। ছিহ! আপনি এতোটা লুজার, যে কিনা ভাইয়ের বুকে লাথি বসায়।”
আমাদ রাইফেল ফেলে নিচে পরে থাকা তলোয়ার তুলে নিয়ে এক পলকে উপমার নিকট দাঁড়ায়। তার গলায় রাগ সমেত ধারালো রক্তমাখা অস্ত্রটা ধরে স্থির তাকিয়ে বলে
“Just shut up! You had no right to play with my love, and you have absolutely no right to judge me.”
কথাটা বলতে বলতেই তার চোখ থেকে টুপ করে গড়িয়ে পরলো এক ফোঁটা অশ্রু। যেন মনে হলো শত বছরের পুরোনো কঠিন এক পাথরের বুক চিড়ে ঝাড়না তৈরি হয়েছে। উপমা কুঁকড়ে গেছে। দেয়ালে তার পিঠ। আর সামনে রণমুর্তির আমাদ। যার মুখাবয়ব লাল। মৃদু কম্পমান ঠোট৷ তপ্ত শ্বাস যেন অভিযোগ করে আঁচড়ে পরছে উপমার নাকে মুখে আর খোলা চুলে। আমাদ এর ঠিক পেছনেই দাড়িয়ে আছে অনিক বন্দুক তাক করে। আমাদ ক্রমশ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ভেতরে লুকোনো সুপ্ত ব্যাথা জাগ্রত হচ্ছে। অনিক চাইলে এখনই তার হাত থেকে তলোয়ার ছিনিয়ে নিতে পারে। তাকে বন্দী করতে পারে। কেননা আমাদ এর হাত কাঁপছে। এতটুকু শক্তি পাচ্ছে না সে। মোচড়াচ্ছে ভেতরটা। রাজার যেমন সবচাইতে বড় অপমান আর ঘৃণার জায়গা কারাগার। তেমনই আমাদ মানতে পারছে না সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে তার বন্দি হওয়ার। তার মন মানতে পারছে না এটাও যে কেউ তার ভালোবাসা নিয়ে কটাক্ষ করেছে। কেউ সেটা নিয়ে খেলেছে খুবই ফেলনা ভেবে। আমাদ আবারও, বরাবরের মতোই হীম কেন্ঠে বলল
“আমি তোমাকে হৃদয়ের এমন একটা অংশ দিয়েছিলাম উপমা যেটা ছিল সবচাইতে পবিত্র। যেটা ছিল আমার নীল বিষাদের নদীর মাঝের একটা ফুলের দ্বীপ। আমি শুধু হাঁপিয়ে গিয়েছিলাম এই জীবন নিয়ে। শুধু চেয়েছিলাম তোমার কোলে মাথা রেখে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সব কষ্ট ভুলে যেতে। কিন্তু তুমি…..”
কন্ঠ থাকে। থামিয়ে দেয় হৃদয়। উপমা কি বুঝবে তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ের করুন কথা? চোখ যেন অশ্রু গড়িয়ে উন্মুক্ত করে বাকি কথাগুলো। আমাদ শুধু ছোট করে বলে
” তোমাকে ভালোবাসাটা আমার অপরাধ ছিল? তোমার সুখ চেয়ে নীরবে দূরে সরে যাওয়াও আমার অপরাধ ছিল তাই না?”
কথাটা বলেই সে দু’পা পিছিয়ে যায়। অতঃপর তার মাথায় থাকা জারাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া ভাবনা তড়বড় করে জেগে ওঠে । সে বলে চিৎকার দিয়ে
” তুমি সেই ভাইয়ের কথা বলছো যার কারণে আমার বাবাকে আমি বাবা ডাকতে পরিনি? তুমি তার কথা বলছো যার মুখের দিকে তাকিয়ে আমাকে আর আমার মা’কে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল আমার জন্মদাতা পিতা? তুমি তার কথা বলছো যার জন্য আমার মায়ের জানাজায় পর্যন্ত উপস্থিত ছিল না আরমান শাহ?”
বুক ফাটা আর্তনাদ ছিল আমাদ এর। গলার প্রতিটি শিরা উপশিরা জেগে ওঠে। আর উপমা কেঁপে ওঠে আমাদ এর একেকটা বাক্যে ৷ ইউভান হা হয়ে তাকিয়ে থাকে শেষ কথাটা শুনে। আমাদের চোখ কাঁদছে। হ্যা তারা আজ জনসম্মুখে কাঁদছে। কিন্তু মন ভাবছে তার সামনে শুধুই আছে উপমা। এই ঘরটা ফাঁকা। শুধু দাড়িয়ে আছে এই মুহূর্তে উপমা আর আমাদ। অনিক থ হয়ে গেছে। আমাদ হাতের উল্টো পিঠের আলতো ছোঁয়ায় হালকা করে চোখের অশ্রু ধীর গতিতে মুছে নেয়। অতঃপর ন্যানো সেকেন্ডের মাথায় তলোয়ার উঁচু করে চিৎকারের সঙ্গে এগিয়ে যায় জারার দিকে। ইউভান ভয় পায়। সে জাপ্টে ধরে। হয়তোবা তারা দু’জনেই আজ ছিন্ন হয়ে যাবে আমাদ এর এক আঘাতে। চোখে অশ্রু আসে জারার আর তখনই একটা বিকট শব্দ ঘরজুড়ে আঘাত আনে। আমাদকে থামতে হয়। সঙ্গে থেমে যায়, গতিহারা হয় যেন চারিপাশ। দেহটা কম্পন তুলে শক্তি হারায়। হাতের তলোয়ার ঝাঁকুনি নিয়ে পরে যায় জারা আর ইউভানের পায়ের নিকট। আমাদ অবিশ্বাস্য চোখে তাকায় নিজের বুকের দিকে। শুকিয়ে থাকা ঠোঁটের কোণের রক্ত তাজা হয় আরো রক্তসঙ্গীর দেখা পেয়ে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে বুকের পা পাশ থেকে। যেখানে লেগেছে গুলিটা। কেউ যদি জানতো সেখানে আমাদ এর নীল আংটির বাক্সটা এখনো আছে বা কেউ যদি সেখানটা আমাদ এর মতো করে দেখতে পেতো তবে সে দেখতো একটা আংটি পড়া হাত। যা আলতো করে ছুঁয়ে আছে বুকের ওপরে। আমাদ হাঁটু গেরে পড়ে যায় মেঝেতে। বুকে হাত চলে যায়। শব্দ বেরিয়ে আসে মুখ থেকে জড়িমা পাকিয়ে
” ম ম ম মা…”
অনুভূতির পারদ শূন্যে নামছে ক্রমশ। শুধু মনে হচ্ছে বুকের ভেতরে একটা লোহার হাত ঢুকেছে যা টেনে বের করে আনছে হৃদপিণ্ড। উপমা নিজের জায়গা থেকে নড়তে পারছে না। সে ঠাহর করতেও পারছে না আপন অশ্রুতে ভিজে উঠতে তার গাল, গলা, বুক। হুঁশ ফিরতেই সে হাত পায়ের শক্তি হারিয়ে বসে পড়ে থপ করে। অতিরিক্ত কাঁপা হাতে চোখ আর মুখ আড়াল করে ফিসফিস করে বলে
” আমি এটা চাইনি….. না না এটা চাইনি আমি।”
আমাদ ততক্ষণে লুটিয়ে পরে মাটির বুকে। চোখ জোরা লুকিয়ে যেন তাকিয়ে থাকে উপমারই দিকে। যেমন করে তাকিয়ে থেকেছে সবসময়। আচ্ছা এমনটা কি হতো? উপমা একবার এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলতো
” প্লিজ মারবেন না আমার আপুকে।”
তাহলে কি সেই জড়িয়ে ধরা আর চোখের পানি উপেক্ষা করতে পারতো আমাদ? জানে না সে কথা কেউ!এমনকি আমাদ নিজেও না। ইউভান ছুটে আসে আমাদ এর কাছে। একটু আগেও যে বলেছিল, ভেবেছিল আমাদকে শেষ করে দেবে সে এখন আমাদ এর মাথা কম্পমান হাতের তালুতে ঠাঁই দিয়ে বলতে শুরু করে
” আমাদ, না আমাদ, তোমার কিছু হতে পারে না। তোমার সঙ্গে আমার অনেক হিসাব বাকি। তুমি চলে যেতে পারো না। তোমার থেকে আমি গুণে গুণে হিসাব নেবো। তোমাকে মারার অধিকার যদি কারো থাকে তাহলে সেটা একমাত্র আমার।”
আমাদ এর কান পর্যন্ত সে কথা পৌঁছায়। কিন্তু প্রতিক্রিয়া হিসেবে এক চিলতে হাসি ছাড়া কিছুই ব্যাক্ত হয় না। আর ইউভানের চোখের পাতা কাঁপতে কাঁপতে ঘৃণার সঙ্গে লুকিয়ে থাকা পাঁচ মাসের স্মৃতিও ঝড়িয়ে দেয়। যেন তার ঘৃণাও কাঁদছে। কিন্তু কেন? অসংখ্য বার অসুস্থ বেহুঁশ ইউভানকে বার থেকে বাসায় নিয়ে আসার খাতিরে? নাকি সেই সময়গুলো যখন মিডিয়া বা কেউ আঙ্গুল ওঠাতে চাইতো কেইস এর বিষয় নিয়ে ইউভানের ওপর আর তখন আমাদ শান্ত থেকে পরিস্থিতি সামলানোর কৃতজ্ঞতায়? আবার কি সেই দুষ্কর মুহূর্তগুলো? একসঙ্গে হাসি আর ঠাট্টা করা অফিসে কাজের ফাঁকে। গাড়িতে বসে শত আলাপ। আবার কখনো ইউভান জ্বরে বা বার থেকে ফিরে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পরলে ইউভানের ঘরে রাত পার করে দেওয়া। ইউভান জানে না কোন কারণটা তাঁকে ভেতর থেকে তীব্র যন্ত্রণা দিচ্ছে। হৃদয়ের কোন অংশটা মানতে চাইছে না আমাদের চিরবিচ্ছেদ। ইউভানের একই সঙ্গে অজানা আমাদ এর মনে ইউভানের জন্য আদৌও কোন জায়গা আছে কিনা। সবটাই কি শুধু বিশ্বাস অর্জনের জন্য করেছিল আমাদ? ধোঁয়াসা সেই অনুসন্ধান।
কিন্তু কখনো পরিবারের ছায়াতলে ঠাঁই না পাওয়া ইউভান দেশে ফেরার পর পাঁচ মাসে এক টুকরো পারিবারিক অনুভূতি বা হতে পারে বন্ধুত্বের অনুভূতি অনুভব করেছে আমাদ এর কারণে। ইউভান শক্ত করে হাত ধরে আমাদ এর। তার ক্ষীণ গলা নিয়ে সে বলে
” আমাদ আমার হিসাব না চুকিয়ে তুমি চলে যেতো পারো না। তুমি আমার কষ্টের কথা না শুনে যেতে পারো না। তুমি আমার মায়ের আর মেড এর মৃত্যুর কারণে আফসোস না করে পৃথিবী ছাড়তে পারো না। নেভার।”
কিন্তু আমাদ শুনলো না ইউভানের কথা। শেষ বারের মতো উপমার মুখটা দর্শন করে হাত পা ছেড়ে দিতে চাইলো। দেহটা শেষ বারের মতো ঝাঁকুনি দিল। রক্তলাল পাতলা ঠোঁট জোরা কিছু বলতে চাইলো। আর তার দৃষ্টিনন্দন চোখের পাতা বুঁজে এলো। পরিশেষে থপ করে ইউভানের হাতের মুঠো ভেদ করে নিচে পরে গেলো আমাদ এর হাত। সমাপ্ত ঘটলো একটা মুকুটহীন রাজার। হয়তোবা পুরো পৃথিবী জানে না কেন সে মুকুটহীন রাজ! কেন সে শ্যাডো জাস্টিস! কিন্তু জানে সেই রক্তমাখা নিঝুম নিশি, জানে কেয়ার মতো গোপনে ধ র্ষ ণ হওয়া যুবতীরা, জানে হয়তোবা অন্তরীক্ষ আর পবন৷ সে ছিল সমাজের নিষিদ্ধ সুবাস। সে ভগ্নহৃদয়ের পুত্র যে মায়ের নিষ্ঠুর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়েছে যখন সবাই মুখ ফিরিয়ে থেকেছে। আজ তার জীবনের অন্তিম মুহূর্তে যেন ভারী হলো ঘরের বাতাসও। নিষ্পাপ মুখশ্রী ঘুমিয়ে গেছে চিরতরে। ফিরবে না আর সে।
ইউভানের গলা চেপে আসে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা। জারার চুবক বেয়ে পরছে অঝোরে আঁখি জল। আমাদ যেন জীবনের ইতি টানলো খুব নীরবে। একটা কথাও রাখলো না কারো জন্য। এমনকি উপমার জন্যও নয়। সেই সুপ্ত অভিমান হয়তোবা এমন ছিল
” ধোঁয়াশার শেষে তুমি অন্য গ্রহের নক্ষত্র, আর আমি ভিন্ন দিগন্তের সূর্যাস্ত।”
তার আলোহীন অন্ধকার জীবনের প্রতিটি অধ্যায় ছিল অপ্রাপ্তিতে ভরা। সে চেয়েছিল সর্বদাই একটা পরিবার। যা তার বিধিলিপিতে অদৃশ্য ছিল বরাবরই। সে চেয়েছিল একটা কণ্যাকে। সেই কণ্যা… যে কণ্যার বর্ণনা আমাদ করতে পারলে হয়তোবা বলতো
” কণ্যা তোমায় ভালোবেসেছিলাম
তুমি দিলে ধোঁকা।
কণ্যা একটু ছোঁয়া চেয়েছিলাম
তুমি দিলে দংশন।
কণ্যা তোমার স্বীকারোক্তি চেয়েছিলাম
তুমি দিলে মৃত্যুদন্ড। ”
যে কণ্যা তার ভাগ্যে মৃত্যুদণ্ড লিখে দিল,
তাকেই তো হৃদয়ের অলিখিত প্রণয়পত্রে শেষ নিঃশ্বাসেও মুছে ফেলতে পারেনি আমাদ।
আমাদ এর নিকট থেকে উঠে গিয়ে ইউভান কলার চেপে ধরে অনিকের। তার বন্দুক থেকে কেন গুলি বের হয়েছে? সে চিৎকার দিয়ে জিজ্ঞেস করে
” কে বলেছে তোমাকে গুলি চালাতে? কোন অধিকারে তুমি গুলি চালিয়েছো?”
অনিকের কিছু বলার থাকে না। সে জারা ও ইউভানকে বাঁচাতে এমনটা করেছে। কিন্তু বুঝে উঠতে পারেনি গুলি বিদ্ধ হবে আমাদ এর বুকে। ইউভানের মনে হচ্ছে অনিক একটা উপন্যাসের শেষ পাতা ছিড়ে ফেলেছে। যেখানে ছিল আবেগ, ঘৃণা আর গুটিকয়েক প্রশ্নের জবাব।
চলবে……
#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ৩৮
আকাশে মেঘের গর্জন। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা কাঁপন ধরিয়ে দেয় গাছের পাতায়। অন্তরীক্ষের এই আবহাওয়ার সঙ্গে জুড়ে থাকা একটা শোকের ছায়া গূঢ় হয়ে পরেছে কিছু মানুষের মনে। আমাদ কে রাখা হয় মাটির বুকের সাড়ে তিন হাত ঘরে। আরমান শাহ আসতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যেন জানাজা শুরু না করা হয়। তবে ইউভান? সে এমন কথা কানেই নেয়নি। প্রশ্নই আসে না।
কেয়া কাঁদছে ভয়ঙ্কর চিৎকার দিয়ে। দু’টো পুলিশ মহিলা তার দু বাহু ধরে আছে। আমাদ এর মায়ের কবরের নিকটই তাকে দাফন করা হলো। ইউভান ঠাই দাড়িয়ে আছে সেখানে। শত্রুতার বাহিরে সে আমাদ এর ভাই। এটুকু অনুভূতি মেনে নিয়ে সে কাক ভেজা হয়ে দাড়িয়ে আছে কবরের সামনে। চোখ মুখ রক্তিম। কালো পাঞ্জাবি ভিজে লেপ্টে গেছে শরীরে।
আমাদ এর সেই মা। যে ছিল তার পালক। অর্থাৎ আমাদ যে পরিবারের দত্তক নেওয়া সন্তান ছিল সেই পরিবারের মা’টা। উনি আজ সব ভুলে কেঁদে চলেছেন অঝোরে। বলছেন
“বাবা, ফিরে আসো তুমি। তোমাকে এতোটা অবহেলা তো করিনি বাবা যে তোমার চলে যেতে হবে। আমাকে যদি মা বলে ডেকে থাকো তাহলে ফিরে আসো। ফিরবে না আর একবার রহমান গ্রুপে?”
চোখের জল মুছে দেয় ঝুম বৃষ্টি। হয়তোবা আমাদ বলছে তখন নীরবে
” ফিরবো না আপনাদের কাছে। আমি বরং এই স্বার্থপর পৃথিবী ছেড়ে এসে শান্তি পাচ্ছি।”
ইউভান যখন ঘুমিয়ে থাকতো। তখনই আমাদ ইউভানের মাকে একদিন রান্নাঘরে ছুরির আঘাত দিয়ে মেরে ফেলে। আর ঘুমন্ত ইউভাননে এনে বসিয়ে দেয় তার মায়ের নিকট। তার মস্তিষ্ক ছিল তখন অস্বাভাবিক। আপন মায়ের মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি। ভেবেছিল যখন আমার মা নেই তখন ইউভনেরও মা থাকার কোন যুক্তি নেই। একইভাবে ইউভানের মেডকেও। আমাদ সে বাড়িতে ঢুকেছিল তার বস্তিতে বসবাস করা এক খালার মাধ্যমে। সে ইউভান রেসিডেন্সে কাজ করতো। আমাদ যেহেতু তার মায়ের মাধ্যমে চিনেছিল ইউভানের পরিবার তাই তার সবাইকে মনে ছিল।
সেই ঘটনার পর পাঁচ মাস পেরিয়ে যায়। আমদ বোতল টুকিয়ে, না খেয়ে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে দিনাতিপাত করতো। কিন্তু একদিন হঠাৎ তাদের বস্তির কর্তা অর্থাৎ যাকে সবাই মান্য করতো সে আমাদ কে তুলে দেন রহমান গ্রুপের এক ছেলের নিকট। তারা ছিল নিসন্তান। আমাদ এর মায়াভরা মুখ আর সৌন্দর্য তাদের আকর্ষণ করে। হয়তোবা তখন আমাদ এর জীবনটা হতে পারতো একটুখানি সুখের। কিন্তু তবুও হলো না। তাকে দত্তক নেওয়া হয়েছিল শুধুমাত্র কোম্পানির অংশ পাওয়ার লোভে। সন্তান না থাকলে আমাদ এর বাবাকে সম্পদ কম দেওয়া হবে।
মাঝখানে ঘটলো আরেক ঘটনা। আমাদ এর মা অন্তঃসত্ত্বা হলেন। তখন আবারও শুরু হলো অবহেলা। আমাদ কে পাঠানো হলো পনেরো বছর বয়সে হোস্টেলে। তারপর থেকে সে সেখানেই থাকা শুরু করল। তার জীবনে টাকার অভাব ছিল না। কিন্তু সে যা চাইতো সেটাই কেউ দিলো না৷ একটা সুন্দর পরিবার। দামি হোস্টেল, দামি কাপড়, দামি স্কুল, কলেজ এমনকি দামি এক প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে সে শেষ করলো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া। তার জীবনে বন্ধুর সংখ্যাটাও সীমিত ছিল। কিন্তু যা ছিল সেসবও স্বার্থের জন্য। পরীক্ষার আগে বন্ধু জুটতো।
.
ঝুম বৃষ্টি ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ইউভান সেখানেই দাড়িয়ে থাকে কিছু বলার জন্য। কিন্তু মুখে আনতে পারে না বাক্য। তার বুকের অগণিত ব্যাথাও কখনো আমাদ গুনলো না। সে নিজের পথটাই সঠিক ধরে এগিয়ে গেলো। ইউভান সব শেষে মুখ ফিরিয়ে নিলো। উল্টোদিকে হাঁটতে হাঁটতে সে ফিরতে লাগলো গাড়ির নিকট। কিছু বলার নেই তার। শুধু প্রার্থনা এমন পরিস্থিতি যেন তার শত্রুরও না হয়। একই পাশে বন্ধুতুল্য ভাই, অন্যপাশে তার মায়ের মৃত্যুর কারণ। এ এক নিষ্ঠুর অনুভূতির জন্ম দেয়।
.
থেমে থেমে গর্জে ওঠা মেঘ পন্ডের চিৎকারে কুঁকড়ে যাচ্ছে উপমা। গায়ে তার জ্বর। মাথায় জলপট্টি রাখা। পাশে বসা কাব্য। একটু আগে সে এখানে এসেছে। এসেই উপমার নিস্তেজ, কম্পমান দেহের দর্শন তাকে ভাবাচ্ছে গভীরভাবে। আবার যেন নির্লিপ্ত করে দিচ্ছে। উপমার মা ও বাবা সব কিছু জেনে গেছেন। মূলত পুলিশের থেকে জানা হয়েছে। উপমা শুধু আধ ঘন্টা পর পরই শিউরে উঠে বলছে
” আমি এমনটা চাইনি….আমি সত্যিই খারাপ? আমি তার মৃত্যুর জন্য দায়ী।”
উপমার এই কথা গুলো পাশের ঘর থেকে শুনতে পায় জারা। সে জানালায় ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছে। মাথায় ঘোমটা টানা। চোখ ভেজা। মনে হয় এইমাত্র সে আমাদ কে দেখবে এই বাড়িতেই, এই বুঝি বাগানের মধ্য দিয়ে হেঁটে ঘরে যাচ্ছে। নয়তোবা তলোয়ার উঁচু করে ধরে আছে জারার গলার নিকট। তর্ক করছে ইউভানের সঙ্গে। ভাবনার মাঝে জারা ফিরে চায় সামনের দিকে। ইকরার এপার্টমেন্টে আলো জ্বলছে। বৃষ্টির ফোঁটার ওপাশে দেখা যায় বারান্দায় দাড়িয়ে আছে কেউ মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে। দৃষ্টি স্থির ইউভানের মায়ের কবরের নিকট।
.
আরমান শাহ! নামটাই যেন পুরো তিনটে ছেলেমেয়ে আর দু’জন নারীর জীবনের সংকটের মতো আবির্ভাব হওয়া এক ঝড় ছিল। সে এমন একজন পিতা যে যার বড় ছেলেরা বা প্রথম সন্তানের চেহারাই মনে করতে পারেনি। চেনেনি বারংবার কোল ঘেঁষে থাকলেও। ইউভানের সঙ্গে মোট প্রায় সাত থেকে আট মাস ছিল আমাদ। জারা আগমনের পূর্বের পাঁচ মাস। আর শেষে তিন মাসের মতো।
.
কেয়াকে বন্দি করা হলো জেলে। যেহেতু জারা তাকে দেখেছিল ও চিনেছিল তাই কেয়ার সম্পর্কে তথ্য ছিল পুলিশের নিকট অনেক আগেই। শুধু যখন সে ছুটে এলো আমাদ এর মৃত্যুর কথা শুনে তখন আটক করা বাকি ছিল।
.
মাঝখানে পেরিয়ে গেলো একটা দিন। ইউভান যেন ভিন্ন এক মানুষে পরিণত হয়ে গেছে। তার কোন নিঃশ্বাসের অস্তিত্বও টের পাওয়া দ্বায় হলো। উপমা মন্থরে বেরিয়ে আসছে ট্রমা থেকে। তার মাথায় শুধু ঘুরপাক খায় আমাদ এর শেষ চাহনি। চোখের সামনে ভাসে যখন সে এগিয়ে গিয়েছিল আমাদ এর নিথর দেহের নিকট তখনকার এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরার দৃশ্য। কাব্য এখানেই থেকে গেলো। উপমার সঙ্গে এখনো তার কথা হয়নি এবিষয়ে। কিন্তু কথা হলেই বা কি? কি বলবে সে?
.
ছাদ বারান্দায় উঁকি দিয়েছে ভোরের প্রথম আলো। বর্ষাকালের বৃষ্টি গত দুদিন ধাবমান রইলো। শুকনো পাতা ভিজে একপ্রকার গেঁথে রয়েছিলো বারান্দায়। মেহগনি গাছের ফুল পরে মরে শুকিয়ে কাঠ রাঙা হয়ে গেছে। জারা সেগুলোই দেখছিল আনমনে। এমন সময়ই হঠাৎ কানে বাজে দু তিন জোরা পায়ের শব্দ। চোখ যায় গেইটের দিকে। দেখা মেলে গাম্ভীর্যের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে হেটে যাওয়া ইউভানের। পেছনে তার দু’জন বলিষ্ঠ দেহের পুরুষ। গায়ে কালল স্যুট, বুট। ইউভানের পোশাকে কেমন কাঠিন্য ভাব। মনে হয় যেন সে যাচ্ছে এক আনুষ্ঠানিক কাজে। মুখে কাল মাস্ক। হাঁটার ভঙ্গিতে মনে হলো দুশ্চিন্তা গ্রস্ত রাজা। নিখুঁত ভাবে আঁচড়ে রাখা চুলগুলো নড়লো। কিন্তু নড়লো না ইউভানের দৃষ্টি। এমনকি সে ফিরে চাইলো না জারার ঘরের পানেও। কেউ একজন কালো গাড়ির দরজা খুলে দিতেই সে ভেতরে প্রবেশ করল। দুমিনিট পরই ইঞ্জিন গর্জে উঠলো। ধা করে মেড় নিয়ে গাড়ি ছুটল কোথাও। জারার বুকটা ঢিপঢিপ করে উঠলো। মনের কোথাও কিছু একটা হলো। যা তাকে তলিয়ে নিয়ে গেলো মন খারাপের সমুদ্রে।
.
নিউ ইয়র্কের বিলাসবহুল হোটেলে জমজমাট ভীর। প্রেস, মিডিয়া যোগাযোগ মাধ্যমে চলবে লাইভ। মাইক্রোফোনের সামনে বসে আছে ইউভান। মুখে এঁটে রাখা কালো মাস্ক। চোখের পাতায় হালকা কাঁপুনি। ফ্লাশের অত্যধিক আলোয় চোখ খুলে রাখা বড্ড অকুলান লাগছে। তবুও ইউভান যেন স্থির বসে আছে। ভেতরের জেদ তাকে আঁটকে রেখেছে এখানে। ফোনটা বারংবার ভাইব্রেট হচ্ছে। পাশ থেকে তার গার্ড বলে উঠলো
“স্যার, আপনার বড় ফুফু।”
ইউভান ইশারায় বন্ধ করার নির্দেশ দিলো ফোন। সকল সাংবাদিক মুখিয়ে আছে ইউভানের বক্তব্য শোনার জন্য। বাংলাদেশের এক নাগরিক। নিউ ইয়র্কে জায়গা করে নিয়েছে নিউরোসার্জন হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রের দশজন নিউরোসার্জনের নাম বললে আরমান শাহর নামও উঠে আসে। তার আছে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সম্মানীয় কিছু সম্মাননাও। কি এমন হতে পারে যে ডাক্তার আরমান শাহর ছেলে হঠাৎ আয়োজন করেছে তার নামে কনফারেন্স?
চলবে…..