#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ৪০
অফিসঘরে নিঃস্তব্ধতা। জাহানারা চোখ গরম করে তাকিয়ে আছেন ইউভানের দিকে। ইউভান শান্ত, তবে তার চোখে সেই চাপা দম্ভ। সে যে একটু আগে শাশুড়ি বলে আখ্যায়িত করলো তা নিয়ে জাহানারার রাগের পরিমাণ মাপার কথা যেন ইউভানের মাথাতেই এলো না।
জাহানারা দাঁড়িয়ে বলেন
“এই কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজটার ব্যাখ্যা চাই আমি। তুমি কীভাবে এমন নাটক করতে পারো?”
ইউভান ঠোঁটে এক চিলতে হাসি নিয়ে বলল,
“কাণ্ডজ্ঞানহীন? আমি তো কেবল নিয়ম মেনেছি, আন্টি। আপনি নিজেই সই করেছেন বিয়ের অনুমতিপত্রে। আপনার সিল আছে, সাক্ষরও আছে। কেবল কাগজের এক কোণায় আমার আর জারার নামটা লুকিয়ে ছিল, আপনি খেয়াল করেননি।”
জাহানারা গর্জে উঠলেন
“তুমি প্রতারণা করেছো! এটা ভুলভাবে সই করিয়েছো।”
ইউভান এবার টেবিলের ওপর আঙুল টোকা দিতে দিতে ঠান্ডা গলায় বলে
“একজন জেলা শিক্ষা অফিসার যদি লিগ্যাল ফাইল না পড়ে সই করেন, সেটা কি আমি ভুল করলাম নাকি আপনি দায়িত্বহীন ছিলেন? এখন যদি আপনি বলেন, ‘আমি জানতাম না’, তাহলে প্রশ্ন উঠবে এই পদে আপনি কীভাবে বসে আছেন?”
জাহানারা স্তব্ধ। তিনি এমন কথা আশা করেননি। ইউভান টেবিলের দিকে ঈষৎ ঝুঁকে এল। গলার স্বর আরও নিচু, কিন্তু আগুনে মোড়া।
“আপনি চাইলে কোর্টে যান, চাকরির ফাইল খুলে ফেলুন, মিডিয়া ডেকে বলুন—‘আমি আমার মেয়ের বিয়ে অনুমোদন করেছি, পরে বুঝলাম ছেলেটা পছন্দ নয়।’ দেখবেন, সমাজ আপনার দিকে তাকিয়ে বলবে—‘এই জন্যই দেশের প্রশাসনে অনিয়ম।’ আপনি কি সেটা চান?”
জাহানারার কণ্ঠ আটকে গেল। মুখে কথা নেই। ইউভান এবার পিঠ সোজা করে দাঁড়াল। চোখে সেই অদ্ভুত দৃঢ়তা, ঠোঁটে নিঃশব্দ বিজয়ের ছাপ।
“আন্টি, আমি কিন্তু জারাকে জোর করে নিতে পারি। করিনি কারণ আমি আপনার সম্মান রাখতে চেয়েছি। এখন আপনি যদি আবার বাধা দেন, তাহলে এই ‘পাগল’ ছেলেটা আর সংযম দেখাবে না। আপনার মেয়ে আমার হয়ে গেছে। আপনি সেটা মেনে নিন। আপনি একজন মা। মুখে না বললেও অন্তর বুঝে যাবে, কে আসলে আপনার মেয়েকে মর্যাদা দিচ্ছে।”
জাহানারা ধীরে ধীরে বসে পড়েন চেয়ারে। তার চোখে অপার বিস্ময়, হতাশা আর পরাজয়ের ছায়া। মন যেন ক্রমশ মেনে নিচ্ছে
“এই ছেলেকে ঠেকানো যাবে না। একেই বলে প্রেমে পাগল, হিসেবি পাগল। আর এই হিসেবি পাগলের সামনে দাঁড়ানো মানে নিজের গর্তে নিজে ঝাঁপ দেওয়া।”
ইউভান কাগজটা তুলে নিল টেবিল থেকে ধীরে। যেন এই কাগজটাই তার বিজয়ের মুকুট। চোখে একরোখা দৃঢ়তা। সে আর কিছু বলে না। হেঁটে বেরিয়ে যেতে থাকে রুম থেকে। তার পা চালনায় একধরনের সুনিয়ন্ত্রিত অহংকার।
মাথা উঁচু করে চলে যাওয়া একজন বিজয়ীর মতো,
যার শরীর জুড়ে অভিজাত সৌন্দর্য আর দুর্ধর্ষ দাপট মিশে গেছে নিখুঁত ছন্দে। জাহানারা কপালে হাত রেখে ঠাঁই বসে রইলেন কিছুসময়। একটা পদক্ষেপের পর চাকরি না হয় গেলো। কিন্তু তারপরও কি ইউভান জারার পিছু ছাড়বে?
.
বাড়িতে এসে প্রথমেই স্বামী জাবেদ সাহেবের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন জাহানারা। স্বামী স্ত্রী দু’জনেই চিন্তিত। জারার বাবার তেমন কোন অপছন্দের কারণ জানা ছিল না। তার বরং ইউভানকে খারাপ লাগে না কিন্তু জামাই হিসেবে? কখনে ভাবা হয়নি। উপরন্তু এমন কাহিনি শোনার পর তিনিও বেশ ঘাবড়ে যান। কখন না জানি আবার আরেকটা কাগজে সই করিয়ে নিয়ে বলবে
“আমার মৃত্যু পত্র। আমি সুইসাইড করবো জারাকে না পেলে। আর এরজন্য দায়ী থাকবেন শুধুমাত্র আপনারা।”
বিষয়টা! খুবই খারাপ। কিন্তু পরিশেষে মেয়েটার ডিভোর্সের সাড়ে তিনমাস পেরিয়ে গেছে। রমনীদের বাবার বাড়িতে চিরকাল রাখা যায় না। সেদিক দিয়ে ভাবলে একদিন তো জারাকে কারো হাতে তুলে দিতে হবে। আজীবন বাবা হয়ে আগলে রাখতে পারবেন না। আবার নেই কোন পুত্র সন্তান। কিন্তু জারা কি চায় এতো সবের মাঝে? মাঝে মাঝেই ইউভানের সঙ্গে তাকে দেখা যায়। এরমানে কি জারাও চায় ইউভানকে? শুধু লজ্জা, ভয় আর সংকোচে বলেনি?
.
সারা রাত ধরে বাড়িতে যেন একটা অদ্ভুত ব্যস্ততা।
জাহানারা একে একে আলমারি খুলছেন, জামাকাপড় গুছিয়ে নিচ্ছেন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, ওষুধ, ছোট মেয়েটার বইখাতা সবকিছু নীরবে গুছিয়ে নিচ্ছেন।
জারা চুপ করে দেখে যাচ্ছে, কিছু বলতে পারছে না। মায়ের মুখে এক ধরনের চাপা রাগ, চোখে চিন্তার ছায়া, আর মাঝে মাঝে ক্লান্ত নিঃশ্বাস। মায়ের এই ব্যাস্ততার মাঝে জারা এগিয়ে যায় নিকটে। রয়ে সয়ে প্রশ্ন করে
” আমরা সবাই কি কোথাও যাচ্ছি মা?”
জাহানারা তখন বিছানার ওপর একটা ওড়না ভাঁজ করছিলেন। থেমে গিয়ে বললেন
” হুম।”
“কোথায়?”
প্রশ্নের বিপরীতে ওনার রাগের পাত্র থেকে উপচে এলো রাগ। বলতে শুরু করলেন বিরবির করে
“আমি ভেবেছিলাম তোর কপালে রাজপুত্র আছে। কিন্তু কে জানতো এই রাজপুত্রের ঘোড়া না থাকলেও একটা পাগলামি ভরা প্ল্যানবুক আছে।”
এরপর ওড়নাটা ঠাস করে রাখেন লাগেজের মধ্যে। আবারও বলেন আঙ্গুল উঁচিয়ে
” একজন মেয়ে মায়ের দোয়ায় ভালো ঘরে যায়। কিন্তু তুই গেলি এমন একজনের ঘরে মা, যাকে দেখলেই আমার প্রেশার ওঠে।”
জারার পুরো বিষয়টা বুঝে উঠতে পারে না। তবে আবছা বোঝে। মনে হয় তার ইউভানের সঙ্গে মায়ের একটা কিছু হয়েছে। জারা গুটি গুটি পায়ে ঘর ছাড়ে। অতিরিক্ত প্রশ্ন মানেই এই মুহূর্তে দুমদাম কথার বাড়ি।
জাহানারার চোখে রাগ মিশে একরকম পরাজয়ের ছায়া।
তিনি বুঝেছেন, সবকিছু গুছিয়ে নেওয়ার পরেও মনটা গুছিয়ে নেওয়া যায় না, যদি জামাই হয় ইউভানের মতো।
রাত গভীর। সব ঘুমের সঙ্গে চুক্তি করেছে । ছাদ-বারান্দার চারপাশে যেন নীরবতা চুপ করে বসে আছে। হঠাৎ হালকা আওয়াজে জারা চমকে তাকায়। ইউভান বারান্দায় দাঁড়িয়ে, গ্রে রঙের শার্টের বোতাম খোলা, ভেতরে কাল টিশার্ট। চুলগুলো এলোমেলো, চোখে ক্লান্তি।তবুও সেই দাপট, সেই অপার মোহ এখনও ঠিক জেগে আছে তার ভঙ্গিতে।
ইউভান হালকা গলায় বলে,
“সরি এটাই শেষ। আজ থেকে ভালো হয়ে যাবো। এভাবে আর আসা ঠিক না। পাপ হয়। এখন তুমি আমার হবু বউ… এভাবে লুকিয়ে দেখা করতে আসা… মানায় না।”
জারার চোখ কুঁচকে যায়। সে কোমরে এক হাত রেখে রাগী স্বরে বলে
” মাঝে মাঝে হাদিস কিন্তু ভালোই দেন আপনি।”
ইউভান মৃদু শব্দে হাসে। মাথা হেলে পরে তার হাসির দাপটে।
“শুধু একটা কথা বলতে এসেছি। আমাদের বিয়ে আগামী শুক্রবার। তোমার মা রাজি হয়েছেন। কথা হয়েছে আমার সঙ্গে। তো শোনো হবু বউ ভালোভাবে থাকবে এই কয়টা দিন। কোনো ছেলের দিকে তাকাবে না। দুইদিনের মধ্যে আসছি, নিতে যাবো। সব আয়োজন হয়ে গেছে প্রায়।”
জারা হঅদম্য অবাক ভাব নিয়ে বলে
—”ওওও এই কারণে মা… কিন্তু কিভাবে কি হলো? কিভাবে রাজি হলো মা?”
ইউভান শার্টের গুটানো হাতা নামিয়ে দেয়। হালকা ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। ঠান্ডার আমেজ। আপন কাজ সম্পাদন করে সে বলে
” সব কথা জানতে হয় না জারা। কিছু কথা অজানা থাকলে কোন ক্ষতি হয় না। ”
এরপর জারা জিজ্ঞেস করে না। ইউভান রেলিঙে হাত ঠেকিয়ে আকাশের বুকে তাকায়। জারা জানে তার সঙ্গে তর্ক করা মানায় না।
” আজকের চাঁদটা সুন্দর তাই না?”
জারার মনে হঠাৎ জড়তা ছড়িয়ে পড়ে। আচমকাই। হয়তো ভাবতেও আড়ষ্টতা কাছে টেনে নিচ্ছে যে ইউভান এখন তার হবু বর।
“আম্মুর সঙ্গে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত আমার মনে আছে জারা। মানে তখন আমি ছোট ছিলাম কিন্তু তবুও বুঝতে শেখার পর আমার সব স্মৃতি কেমন আঁটকে গেছে মাথার মধ্যে। আই থিঙ্ক আম্মু চলে যাবে বলে তাই না?”
জারা মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। কেবল তার চোখ ঘোলাটে হয়। চাঁদের রূপালী আলো আর ঘরের সাদা আলোয় স্পষ্ট দেখা যায় ইউভানের চিকচিক করা চোখ। সে হঠাৎ ফিরে চায় জারার দিকে। অনড়ভাবে বলে
“জারা, আমাকে শুধু ভালোবাসা দিও।
আমার মা নেই, যেটুকু ছিল তা স্মৃতির ভেতর হারিয়ে গেছে। বাবা থেকেও আমার নেই। এখন শুধু আমার নিজের বলতে তুমি আছো। এখন তুমিই আমার সব। ছেড়ে যেও না কখনো।”
জারা চুপচাপ শোনে। তার চোখের কোল বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে নীরব, কিন্তু স্পষ্ট।
তার বুকের ভেতরটা যেন হঠাৎ চুপসে যায়, আর সেই মুহূর্তে তার ভেতর জন্ম নেয় এক গোপন প্রতিজ্ঞা। এই মানুষটাকে কেউ যেন আর কষ্ট না দেয়।
এভাবেই, এক চিলতে চাঁদের আলোয় দু’জন মানুষের মাঝে এক নীরব বন্ধন গড়ে ওঠে। যেখানে শব্দ কম, কিন্তু অনুভবের গভীরতা অসীম। তবে একটা আফসোস জারাকে ভেতর থেকে একটু নাড়িয়ে দেয়। যদি সেই আলভি নামের অধ্যায়টা জীবনে না থাকতো?
.
বিকেল নামলেই শহরের ব্যস্ততা যেন একটু স্তব্ধ হয়ে যায়। আর তার মধ্যেই জারার পরিবার ব্যাগপত্র গুছিয়ে ফিরে যায় নিজ বাড়িতে। জাহানারা মুখ শক্ত করে রেখেছেন, কিন্তু চোখে-মুখে ক্লান্তি আর একরাশ অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতির ছাপ। উপমা? সে নিরপেক্ষ হয়ে হেঁটে গাড়িতে বসে।
.
ইউভানের বিয়ের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় পরদিন থেকেই। আর মাত্র তিনদিন বাকি আছে। ইউভান তার প্রিয় বড় ফুফুকে এনেছে। ইকরা-আদৃত এসেছে। এসেছে এমন হাতে গোনা কয়েকজন আত্মীয়। যারা ইউভানের হবু বউয়ের নামে কিছু বলার কথা ভাববে না তারাই কেবল আমন্ত্রিত। ইউভানের ফুফু স্বামী ও মেয়েকে সাবধান করে দিলেন
” কেউ টু শব্দ করবে না জারাকে নিয়ে। ইউভান কিন্তু নিশ্বাস থামিয়ে দেবে। ও কিন্তু আরমানের সঙ্গে এটা নিয়ে অনেক বিরোধ করেছে। বাবাকেই ছাড় দেয় না আর আমরা তো…..”
কথা বলতে বলতে হেঁটে চলে গেলেন ডেকোরেশন এর কা করা লোকদের নিকট।
ইউভানের বাড়ি সেদিন যেন এক কবিতার প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা রাজপ্রাসাদ। সাজসজ্জায় ছিল না কোলাহলের আড়ম্বর, ছিল নিঃশব্দ সৌন্দর্যের ব্যঞ্জনা। যেন কোনো শিল্পী রঙ তুলির বদলে অনুভব দিয়ে সাজিয়েছেন প্রিয়জনের আগমনের মঞ্চ।
বাড়ির মূল গেট থেকে শুরু হয়েছিল এক লাল-মেরুন কার্পেটের যাত্রা, যা বয়ে গেছে এপার্টমেন্টের দরজার চৌকাঠ পর্যন্ত। প্রতিটি ধাপে, প্রতিটি ভাঁজে যেন ইউভানের নিখুঁত পরিকল্পনার ছায়া। কার্পেটের পাশে সাজানো ছিল মোমবাতির মতো আলো বহন করা ছোট ছোট ল্যাম্প।
যার আলো হেঁটে চলার পথকেই করে তুলেছে গল্পময়।
গেটের ওপরে। সাদা গোলাপ, অর্কিড আর জারবেরায় গাঁথা এক পরিপাটি ফুলের ধাঁচা। তাতে ঝুলছিল কাঠের হ্যান্ডক্র্যাফট বোর্ড।
“Her Forever Begins”
জানাজানি নয়, বরং ঘোষণা। পৃথিবীকে জানিয়ে দেওয়া।
সে আসছে। তার ভালোবাসা এসে পৌঁছাবে ঠিক এই চৌকাঠে।লিফট থেকে নামতেই সাজানো পড়ল ছোট্ট ইনসেন্স স্ট্যান্ড। আর পাশে LED স্ক্রিনে চলছিল ইউভানের কিছু মুহূর্ত। যেখানে তার চোখের গভীরতা। ঠোঁটের চিলতে হাসি আর ভেতরের গোপন যন্ত্রণার ছাপ একসাথে বসবাস করছে।
ঘরে পা রেখেই মনে হয় এ যেন কোনো আধ্যাত্মিক নিস্তব্ধতা।
সাদা-সোনালি থিমে সাজানো রাজসভা। দেয়ালে ঝুলছে নরম আলোয় ভেজা চ্যান্ডেলিয়ার। নিচে বসানো দুটি মখমলি সাদা সোফা। একটি ইউভানের জন্য আরেকটি তার ‘হবু রাণী’র অপেক্ষায়।
একপাশে টেবিলে রাখা জারার প্রিয় মিষ্টি আর একটি লাল গোলাপের সঙ্গে মোড়ানো সাদা খাম।
তাতে হস্তাক্ষরে লেখা “To My Queen”
চলবে……