#ধ্রুবতারা
#পর্ব_২৮
#পুষ্পিতা_প্রিমা
রোয়েনের কথা সে বিয়ে করবে কোনো প্রকার ধুমধাম ছাড়া। একদম চুপিসারে। অত রং ঢং তার পছন্দ না। ওসব করে শুধু শুধু টাকা খরচা ছাড়া বৈকি অন্য কিছু না। তার এ কথায় কেউ মত দিতে পারলো না। সবার আগে তাননা বলেছিল
‘ তোর বিয়ে তো একবার দিচ্ছি মুননা৷ নাকি আবার কাউকে বিয়ে করবি?
মুননা সেসময় কিছু বলেনি। মনে মনে শুধু বলেছে
‘ আরেকটা বিয়ে! কি করে সম্ভব? এক বউ সামলাতে তার কেয়ামত হয়ে যাবে আবার আরেকটা বিয়ে! যত্তসব ফালতু কথা তাননার মুখে। মাইর খেয়েছে দেরী হয়েছে।
নাহিল আর জায়িদ ও রাজী হলো না। জায়িদ বলল
‘ তোমার হসপিটালের ডাক্তারদের ইনভাইট করলে ভালো দেখাবে? বন্ধুবান্ধব না আসলে ভালো দেখাবে? উকিল, পুলিশ, ডাক্তার আর সিমেন্টেবাহিনী না আসলে কি ভালো দেখাবে? নোহার শ্বশুর বাড়ি, তাননার শ্বশুরবাড়ির লোকজন ওদের দাওয়াত না করলে কেমন দেখায়? আর কখন জুনিত আর রিহানের বিয়ে নামবে? তাছাড়া জুননু কি ভাববে আমায়? তার মুননুর বিয়ে আর আয়োজন হবে না? এটা কি মানা যায়?
রোয়েন তাদের মুখে কাছে টিকতে না পেরে পালালো। সব রাহার দোষ।
বাড়িভর্তি মানুষ। রাহাকে তালুকদার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেটি কনের বাড়ি। নোহা আফসোসর সুরে বলল
‘ রাহাপু তোমার বাপের বাড়ি যেটা শ্বশুর বাড়ি ও সেটা।
রাহাপু গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। পা নাড়াতে লাগলো আনমনা হয়ে। তাননা বলল
‘ ও-ই আমি তোর শ্বাশুড়ি, আমিই তোর শ্বশুর। আমার কথামতো চলবি। বুঝেছিস?
রাহা হ্যা না কিছুই বলল না। আনমনা হয়ে ভাবতে লাগলো ডাক্তারকে লুঙ্গি পড়লে ঠিক কেমন লাগবে? বেচারা লুঙ্গি খুলে পড়ে যাওয়ার ভয়ে ও তো পড়বে না। সোয়েভ ভাইয়া যা দুষ্টু। টান মেরে কেলেংকারী ঘটাতে ও পারে।
রাহাকে মুচকি হাসতে দেখে তাননা ডাকলো
‘ ওই?
রাহা হকচকিয়ে বলল
‘ বলো।
তাননা কিছুই বললো না। রাহাকে সাজানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আত্মীয় স্বজন এল দলে দলে। ডাক্তার, নার্স, উকিল, জর্জ, পুলিশ, গোয়েন্দা সবই আসলো। বাড়িভর্তি পিঁপড়ের মতো মানুষ দেখে গা রি রি করলো রোয়েনের। এত জমকটমক তার পছন্দ না। সে ঠান্ডা মানুষ। ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশ পছন্দ করে। ঠান্ডা বউ ও পছন্দ করে। কিন্তু যাকে বিয়ে করছে সে একটা আগুনের লাভা। রোয়েনের আফসোসের শেষ নেই। তার ঘরে আর ও একজন এসে রাজত্ব করবে। সব বিরক্তিকর। এত এত মানুষের কোলাহল হচ্ছে রাহার জন্য। তাকে এত ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে রাহার জন্য। ভারী শেরওয়ানি গায়ে দিতে হবে রাহার জন্য। সবই রাহার দোষ।
কিন্তু রাহা আসার আগে তার ফেসওয়াশ, চিরুনি, পারফিউম সব লুকিয়ে রাখতে হবে। বলা যায় না রাহা সব ইউজ করে ফেলে। চিরুনিতে লম্বা চুল লেগে থাকবে। তখনকার মতো চুল আঁচড়ে দিতে হবে। মাথায় ক্লিপ আটকে দিতে হবে। কাপড় চোপড় ধুঁয়ে দিতে হবে। আবার শুকিয়ে ভাঁজ করতে হবে। উফফ রাহা তাকে খুব জ্বালাবে। সেজন্য কাল সারারাত তার ঘুম হয়নি। রোয়েনের গিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে
‘ ওহহ রাহা ফাহা টাহা তোমাকে আমি বিয়ে করব কিন্তু আমার ঘরে জায়গা দেব না।
রাহা তখন উত্তরে কি বলবে রোয়েন সেটা ও ভেবে নিল। রাহা তার চিকনচাকন ঠোঁট জোড়া বিচ্ছিরি ভাবে নেড়ে বলবে
‘ মনে জায়গা পেলাম আর ঘরে পাব না? এটা কোনো কথা মুননুসাহেব ?
যাক বাবা রাহার আবার তাকে মুননু ডাকবে। তারপর সে রেগে রাহাকে ঘর থেকে বের করে দেবে। অবশ্য লাভ ও আছে। একদম ঘর থেকে বের করে দেবে। আর সে আরামে ঘুমোবে। নাক ডেকে ঘুমোবে। নাক ডাকতে না জানলে ও শিখে নেবে। রাহা তাকে শান্তি দেয় না। সে ও দেবে না।
মেহেদী সন্ধ্যায় খয়েরী রঙের একটা পাঞ্জাবি পড়লো মুননা। বসে রইলো যেখানে দর্শক বসেছে সেখানে । সবাই তাকে দেখে হেসে কুটিকুটি। সালেহা বেগম বলল
‘ ভাই তুই তো দুলা। তুই ওখানে কেন?
রোয়েন বলল
‘ অনুষ্ঠান শুরু হোক। আমি এখানে বসে দেখব। ওখানে ফুলের গন্ধে মাথা ঘুরছে।
সবাই আরেকদফা হেসে কুটিকুটি। রোয়েন রেগে গেল কিন্তু চাপা দিল। সবসময় রাগ করা ভালো, কিন্তু দেখানো ভালো না। রোয়েন ভালো ছেলে। স্কুল, কলেজ, মেডিকেলের স্যারেরা এটাই বলতো। আম্মা বলতো, আব্বা ও বলতো। জুননু আর গুড্ডুর ছেলে খারাপ হতেই পারে না।
মুননাকে টেনে টেনে স্টেজে তুললো তাননা। রোয়েন তাননা আর নোহাকে দেখে
‘ তোদের দেখতে লাগছে কেমন? ছিঃ জঘন্য।
তাননা বলল
‘ তোর বউ তো আর ও বেশি সেজেছে।
রোয়েন বলল
‘ শেষ করে দিল সব। হসপিটাল থেকে যারা এসেছে সবাই বলবে ডক্টর রোয়েনের বউ দেখতে বিচ্ছিরি। আগে যেমন ছিল তেমন থাকতো কি হতো? রাহার কোনো প্রেস্টিজ নেই।
তাননা আর নোহা ঠোঁট টিপে হাসলো। সোয়েভ এসে বলল
‘ দারুণ লাগছে জামাইবাবু।
রোয়েন বুক ফুলিয়ে বলল
‘ সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমি রাহার মতো কালো নই যে অত সাজবো।
অনুষ্ঠান শেষের একপর্যায়ে। রোয়েনকে রাহার কাছে টানতে টানতে নিয়ে এল ঈশান আর সোয়েভ। রোয়েন গায়ে হলুদের শাড়ি পড়া মেয়েটার দিকে তাকালো না । সে জানে রাহাকে বিচ্ছিরি লাগছে। ছিঃ তার বউ বিচ্ছিরি ব্যাপারটা মানা যাচ্ছে না। রাহা বলল
‘ অাম্মা কোথায়?
সোরা কোথাথেকে যেন দৌড়ে এল। বলল
‘ এই তো নিয়ে এসেছি। কাস্টার্ড খাবে নাকি ফালুদা?
রাহা নাকমুখ কুঁচকে বলল
‘ খিদে পেয়েছে আম্মা। ওসবে কি পেট ভরে? বিরিয়ানি খাব। শেষ?
সোরা হাসলো। বলল
‘ নাহ। অনেক আছে।
রাহা বলল
‘ আনো খাব। খিদে লেগেছে।
রোয়েন রাগসমেত রাহার দিকে তাকিয়ে থাকলো। রাহা বলল
‘ আমি জানি আমাকে সুন্দর লাগছে। ওভাবে তাকিয়ে থাকতে হবে না। আমার লজ্জা লাগে।
‘ ওহহ তোমার লজ্জা ও আছে? লজ্জা থাকলে কেউ এভাবে খাওয়ার কথা বলে? ডিজগাস্টিং রাহা।
রাহা মুখ মোচড়ালো। যেতে যেতে বলল
‘ মুননু হেব্বি লাগছে।
রোয়েন একমুহূর্ত ও দাঁড়ালো না। গটমট পায়ে হেঁটে আহম্মেদ বাড়ির দিকে পা বাড়িয়ে মনে মনে বলে গেল
‘ বিয়ে করব না আমি।
সেটা রাগের কথা রোয়েন জানে। সে আর ও ভালো করে জানে রাগের বশে মিথ্যে ও বলা যায়। সমস্যা না, কেউ শুনছে না৷
অতঃপর বিয়ের দিন। রাহার জন্য নিজে পছন্দ করে শাড়ি কিনেছিল রোয়েন। নিজের শেরওয়ানিটা নিজের পছন্দের। সে যাইহোক শাড়ি শেরওয়ানি মূল কথা না। মূল কথা হচ্ছে রোয়েনকে নিয়ে। বেচারা সেইরকম চিন্তায় আছে রাহা আজকে ও আবার ভূত পেত্নীর মতো সাজবে না তো? তাহলে তার ইজ্জত সম্মান যতটুকু আছে ততটুকু এক্কেবারেই চলে যাবে।
যখন বিয়ের সময় এসে উপস্থিত হলো রোয়েনকে রেডি করাতে আসলো সোয়েভ আর ঈশান। রোয়েন নিজে নিজে রেডি হয়েছে। ইয়াক তাকে এত কালো লাগছে কেন? বিয়ের দিন কি সুন্দর বর ও কালো হয়ে যায় নাকি? আর কালো বউ সুন্দর?
রোয়েন কয়েকবার মুখ ধুঁয়ে নিল। ভাবলো টেনশনে ফেনশনে বোধহয় কালো হয়ে গেছে। ভালো করে ঘুম দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
ফিতা কাটার সময় এক ঝামেলা বাঁধিয়ে বসলো ঈশান আর সোয়েভ। তারা বলল
‘ জুনিত আর রিহান তো বরবাবুকে ভয় পাচ্ছে তাই তারা আসছে না। তাদের বদলে আমরা। টাকা বের করুন বরবাবু।
রোয়েন তার আশপাশে বন্ধুদের দিকে তাকালো। তারপর গিয়ে বসে থাকলো একটা চেয়ারে। অনিক, অনির্বাণ, সোহেল আর বাকিদের সাথে তর্কবিতর্ক চললো ঈশান আর সোয়েভের সাথে । সোয়েভ তাদের বলল
‘ শালা আমি আজ এই দুইবাড়ির জামাই বলে নইলে এতক্ষণে!
রোয়েন হাঁক ছাড়লো। এই তোদের হলো?
তারা সবাই মাথা নাড়লো। রোয়েন হেঁটে হেঁটে এগিয়ে আসলো। পেছনে হাত দিয়ে গলা কাত করে দাঁড়িয়ে কান্ড দেখতে লাগলো। বেশকিছুক্ষণ পার হতে না হতেই ফিতা না কেটে মাথার উপর তুলে পার হয়ে হাঁটা ধরলো সোজা। সবাই তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভ্যাবাছ্যাঁকা খেল। রোয়েন যেতে যেতে বলল
‘ ফিতা না কাটলে বিয়ে হয় না এটা তোদের কে বলেছে?
ঈশান বলল
‘ ওররে যোদ্ধা। বউ জয় করতে যাচ্ছে ফিতা না কেটে।
রোয়েনকে একা একা বাড়িতে ঢুকে আসতে দেখে সবাই হা করে তাকিয়ে থাকলো। সোয়েভ দৌড়ে এল। তার হাতে রোয়েনের পাগড়ি। নোহা এসে বলল
‘ সমস্যা কি?
সোয়েভ বলল
‘ আপনার ভাই টাকা দিল না। ফিতা কাটলো না। চলে এল। যেন তার বউ কোথায় ও পালিয়ে যাচ্ছে।
নোহা বলল
‘ এজন্যই ওনার নাম মুননু ওরফে রোয়েন। আহা রাহাপু কত্ত লাকি!
সোয়েভ ভ্রু উঁচিয়ে থাকলো। নোহা হেসে বলল
‘ নোহা খুব লাকি৷
সোয়েভ অবশেষে হাসলো।
কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করলো। রাহাকে আনা হলো অনেক্ক্ষণ পর। বিয়ে পড়া শেষ হলো। কবুল বলতে বললো রাহাকে। রাহা কবুল বললো। রোয়েনকে বলতে বলল
‘ রোয়েন বলল, বলেছি।
‘ মুখে তিনবার বলুন।
রোয়েন বক
‘ বলেছি।
কাজী বলল
‘ উচ্চারণ করুন।
রোয়েন বিরক্ত হলো প্রচন্ড। তারপর কবুল বলল। বাপরে বাপ লজ্জা শরম ফালায় দিতে হয় বিয়ে করার সময়। অতগুলো মানুষের সামনে কবুল বলা কি চারটে খানি কথা! তাকে এত এত লজ্জায় পড়তে হলো। সব রাহার জন্য।
বিয়ে পড়ানো শেষে রোয়েন চলে গেল তার বাড়িতে। নিজের ঘরে গিয়ে দেয়াল থেকে নিয়ে নিল একটি ছবি। নিজের বুকের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করলো
‘ আম্মা আজকের দিনে তোমরা থাকলে খুব ক্ষতি হতো না। কেন আমাকে আর তাননাকে ছেড়ে চলে গেলে তুমি আর আব্বা? আমি তোমাদের কথা মনে না উঠার জন্য কতকিছু করলাম। কিন্তু পারলাম না। আমায় দোয়া করো। আমি যাতে এই বাড়ি আর বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষকে ভালো রাখতে পারি। তাদের মুখের হাসিটুকু যাতে কখনো না মুছে। তোমরা ও ভালো থেকো।
তাননা এসে কখন দাঁড়ালো খেয়াল করলো না রোয়েন। সে ফিরতেই তাননা দৌড়ে এল। ভাইকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। প্রায় অনেকটা সময় পর জোরে কেঁদে উঠে বলল
‘ মুননা আম্মা আব্বা আজ খুব খুশি হতো। তাদের হাসিটা কেন দেখতে দিল না আল্লাহ? আল্লাহ এ কেমন ভালোবাসলো আমাদের? আম্মা আব্বাকে কেন নিয়ে গেল?
রোয়েন শেষমেশ বোনের কান্না থামানোর জন্য বলল
‘ তোর সব সাজগোছ তো নষ্ট তুননু। তাননা মাথা তুললো। রোয়েন সযত্নে তার গাল মুছে দিয়ে বলল
‘ বোন আমার আম্মা আব্বা বেশিদূরে না তো। ওই ছাদের কোণায় সন্ধ্যার আকাশে তাদের প্রায়ই দেখা যায়। আমি দেখি। দেখি তারা টুনাটুনি খুব খুব ভালো আছে। অবশ্য তারা তো ভালো থাকার জন্যই একসাথে চলে গিয়েছে। ভালো থাকবে না কেন?
তাননা বলল
‘ তুই চলে এলি কেন? রাহাকে নিয়ে আয়।
রোয়েন বলল
‘ বিয়ে হয়ে গেছে। রাহা নিজে নিজে আসুক। রাহা কি হাঁটতে জানে না।
তাননা বলল
‘ পারে কিন্তু তোর হাতে তাকে তুলে দেওয়া দরকার।
হাসলো রোয়েন।
‘ ওসব তো আনুষ্ঠানিকতা।
তাননা তাকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল
‘ আনুষ্ঠানিকতা সেড়ে আয়।
রোয়েনকে দেখে নাহিল বলল
‘ এভাবে কেউ চলে যায় আব্বা?
রোয়েন বলল
‘ ওই আম্মা আব্বার কাছে গিয়েছিলাম।
নাহিলের হঠাৎ মনে পড়লো ভাইয়ের বিয়ের সেই দিনটা। যেদিন ভাই শেরওয়ানি পড়েছিল। আর পাগড়িটা নাহিল পড়ে বসেছিল। ভাইকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য কতকিছু করলো নাহিল। ভাই সেই নাহিল বলে ডাক দিয়ে আবার চুপ হয়ে যেত। শাসন ওই অতটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো। বকার পর পরে এসে আবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিত অগোচরে। এত ভালোবাসার ভাইটা নাহিলকে দায়িত্ববান পুরুষ হয়ে উঠার জন্য বোধহয় ফেলে চলে গেছে। ভাই কি দেখে তার ছোট ভাইয়ের এই রূপ?
ছলছল করে উঠলো নাহিলের দুচোখ। রোয়েন তাকিয়ে থাকলো নাহিলের সেই দুচোখের দিকে। রাহাকে নিয়ে এল নাহিল। সোরা ও এল পিছুপিছু। একই বাড়িতে থাকবে কিন্তু মনে হচ্ছে কিছু একটা খালি খালি হয়ে যাচ্ছে নাহিলের। রাহার হাত রোয়েনের হাতের উপরে তুলে দিল নাহিল। বলল
‘ জানিনা আমি রাহার আব্বা পুরোপুরি হতে পেরেছি কিনা। তবে একজন বাবার কাজ তার মেয়েসন্তানকে একজন যোগ্য ছেলের হাতে তুলে দেওয়া। আমি আমার ভাইয়ের রেখে যাওয়া সেই মানিকের হাতে তুলে দিলাম মেয়েকে। আমার দায়িত্বের মধ্যে কোনো ফাঁকফোকর থাকতো দিওনা মুননা। রাহাকে ভালো রেখো। তুমি ভালো থেকো৷ আর যাইহোক না কেন কখনো একে অপরের হাত ছেড়ো না। আমি জানি আমার ভাইয়ের ছেলে ঠিক তার আব্বার মতোই হবে। তার আব্বা যেমন তার আম্মাকে ভালোবেসেছিল সে ও ভালোবাসবে। ভালো রাখবে।
রোয়েন নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল
‘ বাবাই প্লিজ চোখ মুছো। আমার ভালো লাগেনা।
নাহিল হাতের কব্জি দিয়ে চোখ মুছলো। রাহার মাথা নিচে ঝুঁকানো। টপটপ পানি পড়লো পায়ের আঙুলের কাছে। নাহিল ডাকল
‘ রাহা?
রাহা চোখ তুলে চাইলো। চোখের পানিতে এবার গাল ভিজলো। নাহিল তা মুছে দিয়ে বলল
‘ আব্বা কি হতে পেরেছি?
রাহা হু হু করে কেঁদে দিল। ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো নাহিলকে। সোরা অন্যদিকে ফিরে তাকিয়ে রইলো। মনে হচ্ছে যেন বহুদিন পর শান্তি অনুভব হলো তার। কোথাও একটা পাথর চাপানো ছিল। শুরু থেকে শেষ, শেষ থেকে শুরু অব্ধি যে মানুষগুলো ভালোবেসে যায়, ভালোবাসে তাদের কি বলে সে জানেনা। তবে নাহিলের প্রতি তার ঋণের শেষ নেই। মানুষটা তাকে একমুহূর্তের জন্য ও ভালো না বেসে থাকেনি। থাকার চেষ্টা করেনি। সোরা সে অনুযায়ী কিচ্ছু দিতে পারেনি নাহিলকে। কিচ্ছু না।
রাহার হাতটা টেনে এনে রোয়েনের হাতের উপর শক্ত করে চেপে ধরলো তাননা। দুজনের মাথায় চাটি মেরে বলল
‘ মুননা রাহাকে এবার শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাহ। খবরদার আমাদের বাড়িতে নিবি না। ওয়ান, টু, ত্রি গো।
কি হলো যাহ।
মুননা রাহার হাতে চাপ দিল। রাহা ফিরলো তার দিকে। রোয়েন বলল
‘ রাহা একদম সোজা চলে যাও তোমাদের বাড়িতে। তোমাকে নিয়ে যাব না আমি। যাও যাও নিজের ঘরে যাও।
রাহা দোটানায় পড়লো।
নোহা এসে বলল
‘ ভাইয়া রাহাপুকে নিয়ে যেতে দেব না। ফুলের গাড়ি করে নিয়ে যাও, নয়তো কোলে করে।
সবাই সম্মতি দিল। ঠিক ঠিক।
রোয়েন পড়লো মহাঝামেলায়। অবশ্য রাহা আস্ত একটা ঝামেলা।
সে সিদ্ধান্ত নিল রাহাকে কোলে করে নিয়েই যাবে। অবশেষে রাহাকে কোলে তুলে নিল। যেতে যেতে বলল
‘ শান্তি দিলেনা রাহা।
রাহা হেসে বলল
‘ আপনার শান্তি নেই।
রোয়েন চোখ নামিয়ে তাকালো রাহার দিকে। পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে বলল
‘ শোনো রাহা , তোমাকে আমি ভালো টালো ওসব বাসিনা কিন্তু। একদম দামে উঠবে না।
বিয়ে করেছি মানে ভেবোনা তোমার প্রেমে আমি হাবুডুবু খাচ্ছি।
রাহা হাসলো। বলল
‘ আমি ও ভালো টালো বাসিনা আপনাকে। অতটা দামে উঠবেন না।
জাহেদা আর জায়িদ উঁকি দিয়ে তাকালো বাইরে। রোয়েনকে দেখে মনে পড়লো সেই আগের ঘটে যাওয়া একটি দৃশ্য। সাহিল ও বিয়ের দিন জিনিয়াকে এভাবেই কোলে করে নিয়ে গিয়েছিল তার বাড়িতে।
চলবে,
#ধ্রুবতারা
#পর্ব_২৯
#পুষ্পিতা_প্রিমা
তালুকদার বাড়ি থেকে বধূবিদায় শেষে সবাই আবার যাত্রা করলো বরের বাড়িতে। পাশাপাশি দুইবাড়ির মধ্যে কনে আদান-প্রদান বেশ দেখতে মজার। ঈশান আর সোয়েভের আফসোস তারা এত সুযোগ সুবিধা পায়নি। রোয়েনের শ্বশুরবাড়ি যেতে গাড়ি ভাড়া লাগবে না৷ ফলমূল, নাশতা পানি নিয়ে যেতে হবেনা। ফোন করে শ্বশুরবাড়ির মানুষের খোঁজ খবর নেওয়া লাগবে না। ফলে মোবাইলের খরচটা ও বেঁচে যাবে। আহা একটা মানুষকে আল্লাহ এতগুলো সুবিধা কি করে দেয়? তারা কি দোষ করলো? তারা একটা সুবিধা অন্তত পেত। কি দোষ হতো তাতে?
রাহাকে কোলে নিয়ে এসেছে এইজন্য হাত ব্যাথা করলো রোয়েনের। সোফায় রাহাকে এমনভাবে ছেড়ে দিল, সোফা ভাগ্যিস নইলে রাহা শেষ। এভাবে ধপাস করে ফেলার ইচ্ছে থাকলে কোলে নেওয়ার কি দরকার ছিল?
হাত ঝাড়তে ঝাড়তে রোয়েন বলল
‘ তুমি তো ভার আছ রাহা। দেখতে শুকনা হলে কি হবে, তোমার হাড্ডিগুলো ভার। উফফ আমার হাত গেল। উফফ।
এমন খাপছাড়া কথা শুনে রাহা থ মেরে তাকিয়ে থাকলো। কেমন বেয়াদব মানুষ? কোলে নিতে কে বলেছে? খোঁচা মেরে কথা বলতে কে বলেছে? রাহা কিছু বললো না। রোয়েন জানে কারো কথার জবাব না দেওয়া কথাটাকে পাত্তা না দেওয়া। তারমানে রাহা তার কথাকে পাত্তা দেয়নি। কেন? বিয়ে করেছে বলে দামে উঠেছে? ভাব নিচ্ছে? তা ও রোয়েনের সাথে? রোয়েন এতই সস্তা? বেশ! রাহা থাকুক তার মতো। রোয়েন রাহাকে তার ঘরে ঢুকতে দেবে না। তার ঘরের ভাগ দেবে না। কিছুতেই দেবে না। সবকিছু দখল করে নিচ্ছে রাহা। এ হতে পারে না। এখানে রাহার রাজত্ব চলবে না। রোয়েনের রাজত্ব চলবে। রাহা ভালো না। সুন্দর না। রাহাকে রোয়েনের একটু ও ভালো লাগেনা। সে একটু ও ভালোটালো বাসেনা৷ ওসবের ধারেকাছেও রোয়েন থাকেনা। জঘন্য বিচ্ছিরি ওসব শব্দ,কর্ম আর অনুভূতি। রোয়েনের ফালতু কাজ করার সময় কোথায়?
রোয়েন তার ঘরের দিকে যেতে যেতে ভাবলো সে আজকাল বেশি বেশি ভাবছে। মনের সাথে আজকাল বেশি ভাবসাব হয়েছে৷ মনে মনে সারাক্ষণ বকবক করতে শুরু করেছে। অবশ্য সেটা একপ্রকার ভালো ও হলো। সে আর রাহার সাথে ভাবসাব করবে না। মনের সাথে ভাবসাব করবে।
কিন্তু মনটা ও জঘন্যরকম বিচ্ছিরি। অসভ্য। বেয়াদব। সারাক্ষণ রাহা রাহা করে। বেয়াদব মন রোয়েনের। ডাক্তার যদি রোগীর মতো আচরণ করে তখন কি করতে হয়? উফফ সব রাহার দোষ। সব।
ঘরে গিয়ে শেরওয়ানি পাল্টাতে গিয়ে রোয়েন নিজেকে আয়নায় দেখলো। দেখেই ভাবলো বাহ রোয়েন দেখতে রাহার চাইতে ও সুন্দর।
এই দেখ আবার ও রাহার কথা। এখানে তাননার কথা মাথায় আসলে কি হতো? মানা যেত সে তাননার চাইতে ও সুন্দর। তার আম্মার মতো হয়েছে সে। আম্মাও সুন্দর। আম্মার ছেলে ও সুন্দর। কিন্তু রাহা কালো।
ধুরর আবার রাহা। রাহা টাহা এখন বাদ। রাহা নিয়ে কোনো কথা চলবে না৷ মাথা নষ্ট করে দিল।
মিষ্টিমুখ চললো অনেক সময় ধরে। রাহা বিরক্ত হয়ে চিল্লিয়ে সালমা বেগমকে বলল
‘ নানু মাফ করো আমায়। এটা আমার বাড়ি। অত মিষ্টিমুখ করা লাগবে না।
সালমা বেগম হেসে ফেললেন৷ বললেন
‘ বইন আজ থেকে এটাই তোর শ্বশুরবাড়ি।
রাহা বলল
‘ কচু।
এইবাড়িতে কোন জায়গায় তেলাপোকারা থাকে সেটা ও মুখস্থ আমার৷ আবার নাকি শ্বশুরবাড়ি? কচুরবাড়ি!
সোয়েভ বলল
‘ রাহা একদম ঠিক কথা বলেছ৷ তোমার বরকে বলবে যাতে আলাদা প্ল্যাটে রাখে তোমাকে। তোমার ও তো শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে হয়।
ঈশান সমর্থন জানালো সোয়েভকে৷
লাল সাদা রঙের টিশার্ট পড়ে নিচে আসার সময় রোয়েনের কানে আসলো কথাগুলো। তাকে আসতে দেখে সবাই তাকালো। রোয়েন বলল
‘ আরেহ এসব এবার শেষ করো। বিয়ে বিয়ে গন্ধ লেগে আছে গায়ে।
সোয়েভ বলল
‘ কখন লেগেছে? লাগার সময় তো আসেনি এখনো।
সবাই ঠোঁট চেপে হাসলো। নাহিল আর সোরা চলে গেল। রোয়েন শান্ত চোখে চেয়ে থাকলো সোয়েভের দিকে। কাছে গিয়ে এদিকওদিক তাকিয়ে বলল
‘ তুই এত বেয়াদব জানলে আমার বোন দিতাম না তোকে।
সোয়েভ হো হো করে হাসলো। বলল
‘ তোর বোনকে তুলে নিয়ে যেতাম মামা।
রোয়েন নাক সিটকালো।
‘ আমি শুধু জিশুর মামা। তোর মামা কেন হবো? তোর বাচ্চার মামা।
সোয়েভ আবার ও হাসলো। রোয়েন রাহাকে দেখলো। তাননা আর নোহা তার পাশে বসা। তিনজনই ঠোঁট টিপে টিপে হাসছে। রোয়েন বলল
‘ এই রাহা তাড়াতাড়ি এসব শাড়ি টাড়ি পাল্টে নাও। তোমাকে দেখতে অদ্ভুত লাগছে। যাও যাও।
রাহা সোফায় হেলান দিয়ে মজা করে বলল
‘ আমার পায়ে ব্যাথা করছে। উফফ।
তাননা বলল
‘ ভাই যা তো তোর বউকে কোলে করে নিয়ে যাহ। যাহ।
রোয়েন শক্ত চাহনি দিয়ে রাহার দিকে তাকালো। বলল
‘ আমি কি তোমার গাড়ি নাকি? একবার নিয়েছি বলে কি বারবার নেব? মামার বাড়ির আবদার। লিসেন রাহা উল্টাপাল্টা কথা বলবেনা আমার সাথে। পছন্দ না।
রাহা হাসলো। রোয়েন বলল
‘ মিনিমাম লজ্জা শরম নেই। বউমানুষ ঘোমটা টেনে বসে থাকবে, তা না করে ফালতু কাজকারবার।
রাহা রোয়েনের প্রতিক্রিয়া দেখে হাসলো। কিছু বলল না। রোয়েন কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালো। ঈশান রোয়েনকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল
‘ আরেহ ভাই চোখে চোখে কথা পরে বলো। অনেক সময় আছে। আমরা একটু ও ডিস্টার্ব করব না। এখন সময় আমাদের দাও৷ বিয়ে তো করেছ, বউ পালাবে না আর।
রোয়েন মহাবিরক্ত, মহাজ্বালাতনে আছে এদের নিয়ে। এসবের মূল কি রাহা নয়?
______________
বিয়ের শাড়ি পাল্টে দিয়ে রাহাকে অন্য একটা শাড়ি পড়িয়ে দিল তাননা আর নোহা। রাহা বলল
‘ ত্রিপিছ পড়ি না?
জাহেদা বেগম ছিলেন। তিনি ধমক দিয়ে বললেন
‘ ফালতু কথা বলবিনা রাহা । নতুন বউদের শাড়ি টাড়ি পড়ে সাজগোছ করে থাকতে হয়। চুলার ধারেকাছেও যাবিনা। হাতের মেহেদীর রঙ যেন তাড়াতাড়ি না মুছে।
রাহা বলল
‘ এগুলো তো কুসংস্কার দাদু।
জাহেদা বলল
‘ মারেম্মা তুই আমাকে সংস্কার শিখাবি?
রাহা চুপ করে গেল। থাক এরা পুরাতন আমলের। কাজ হবে না।
রোয়েনের বিছানার উপরে জিশান বসে রইলো রাহার পাশে। তাননা আর নোহা ও সাথে। কয়েকটা আত্মীয় স্বজন রাহাকে দেখতে আসলো আবার। একজন বলল
‘ কি বউ দেখব? এরে তো এখানে এলে রোজ দেখি।
জিশান বলল
‘ আমি ও দিখি। বউ দিখি৷ মামার বউ।
হাসাহাসি করলো সবাই।
তাননা বলল
‘ দেখিয়েন না আর। আপনারা এভাবে দেখতে থাকলে আমার ভাই কি দেখবে?
উফফ এমন কথায় কান গরম হয়ে উঠলো রাহার। এরা দুইভাইবোন কেউ কারো থেকে কম না। হেব্বি ডেঞ্জারাস।
জিশান হাই তুলতে তুলতে তাননাকে বলল
‘ আম্মা ঘুমাবো।
তাননা বলল
‘ আচ্ছা চলেন। খালামুণিকে টা টা দেন৷
জিশান টা টা দিল। নোহা বলল
‘ গায়ে হলুদের চাপে পড়ে আমার ও ঘুম হয়নি। রাহাপু তুমি থাকো। আমরা আসি।
রাহা গাল ফুলিয়ে বলল
‘ আমার ভয় করে তো।
তাননা বলল
‘ ঢং করিস না। তুই কি এই ঘরে নতুন নাকি? এর আগে ও তো থেকেছিস।
রাহা লজ্জা পেয়ে গেল। তাননা বলল
‘ তুই ও ঘুমিয়ে পড়। গুড নাইট।
রাহা গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। তাজা বেলীফুলের সুগন্ধি চারপাশে। বেলীফুল দিয়ে কেউ বাসরঘর সাজায়? বাসর ঘর হবে গোলাপে গোলাপে গোলাপি। তা না! ডাক্তারের আবার বেলীফুল পছন্দ। সবখানে সাদা সাদা। শুধু লাল টকটকে রাহা। ছাই!
এভাবে একা একা বসে থাকতে থাকতে কোমর ব্যাথা করে উঠলো রাহার। আরেহ তার বরবাবু কি বাসর রাতের ভয়ে কোথায় পালালো নাকি? আজব মানুষ আজব কাজ করতেই পারে।
ঘড়ির কাঁটা তখন বারোটার ঘর ছুঁই ছুঁই। দরজায় খটাখট আওয়াজের কারণে ঘুম ভেঙে গেল রাহার। ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুললো সে। ছোট ছোট চোখে চেয়ে রোয়েন ঠান্ডা চাহনি দিয়ে তাকিয়ে আছে। চোখের ভাষায় বলছে
রাহা তাড়াতাড়ি সরে পড়ো। আমি ঘরে ঢুকবো।
রাহা দাঁড়িয়েই থাকলো। সরার কথা মাথায় এলো না। রোয়েন রাহাকে ডিঙিয়ে চলে গেল। হাতের বাহুতে বাহুতে ঘষা লাগলো। রাহা হাতের বাহু ঢলতে ঢলতে বলল
‘ অসভ্য ডাক্তার।
রোয়েন কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। গায়ে এখনো বিয়ে বিয়ে গন্ধ লেগে আছে। শাওয়ার নিতে হবে।
রাহা রোয়েনের রুমে থাকা রিডিং টেবিলে মাথা রেখে চেয়ার টেনে বসলো। ঘুমঘুম চোখে সে বিড়বিড় করলো
‘ ডাক্তারের গায়ে কে। পায়খানা করে দিল আবার? এত সাবান ঢলাঢলি কেন?
পরে সে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুম যে বাঁধা মানেনা।
রোয়েন ভেজা চুল মুছতে মুছতে আসতেই রাহাকে দেখলো। ছিঃ রাহা গোসল করেনি? ইয়াক।
রাহা কি নোংরা। রাহার গায়ে ও বিয়ে বিয়ে গন্ধ। মাংসের গন্ধ। রাহা এভাবে থাকলে সে থাকতে পারবে না। রোয়েন রাহাকে টেনে তুললো।
বলল
‘ রাহা যাও গোসল করে ফেলো। তোমার গায়ে বিয়ে বিয়ে গন্ধ৷
রাহা ঘুম ঘুম গলায় বলল
‘ নাহহ। বিয়ে হয়েছে তাই বিয়ে বিয়ে গন্ধ। করব না।
রোয়েন ধমক দিল।
‘ যাও বলছি। নইলে এক্ষুণি এই ঘর থেকে চলে যাব আমি। সবাইকে ডেকে বলব তুমি ঘুমাতে দিচ্ছনা আমায়।
রাহা কাঁদোকাঁদো গলায় বলল
‘ আপনাকে দেখে নেব আমি। আপনার শার্টে সর্দি মুছে দেব।
রোয়েন দু পা পিছু হেঁটে বলল
‘ ছিঃ ছিঃ রাহা। আচ্ছা যাও যাও আগে গোসল করে আসো। বিয়ের গন্ধ সহ্য হচ্ছেনা আমার।
রাহা অন্য একটা শাড়ি নিয়ে নাকিসুরে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল।
শীতের ভাব চলে গেছে। গরম শীতের মাঝামাঝি অবস্থা। তারপর ও রাহার শীত লাগলো।
গোসল সেড়ে আসতেই রোয়েন আঁড়চোখে তাকালো। রাহা নরম পায়ে হেঁটে আসলো। মিনমিন করে বলল
‘ আপনাকে সালাম করতে বলেছে দাদু। দেখি পা টা দিন৷ আমার ঘুম পাচ্ছে। লম্বা ঘুম দেব। আপনার সাথে বাসর ঘর করার ইচ্ছা নাই।
রোয়েন বলল
‘ পা ছোঁয়ার দরকার নেই। এমনি সালাম দেওয়া যায়।
রাহা বলল
‘ দাদু তো,
রোয়েন চ কারান্ত শব্দ করল মুখ দিয়ে। রাহা নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সালাম দিল।
রোয়েন সালাম নিলে ও আওয়াজ করল না।
রাহা বলল
‘ দাদু নামাজ পড়তে বলেছে।
রোয়েন বলল
‘ জানি।
রাহা মাথা নাড়লো।
দুজনেই নামাজ পড়লো একসাথে।
নামাজ শেষে রাহা জায়নামাজ ভাঁজ করতে করতে বলল
‘ আপনার চুল দিয়ে পানি পড়ছে। শার্ট ভিজে যাচ্ছে।
রোয়েন মহাবিরক্ত। কড়া গলায় বলল
‘ তুমি তোমারটা দেখো। নিজের চুলের পানি মুছেছ? ঘরটা পুরো ভিজিয়ে ফেলছো। টোটালি ডিজগাস্টিং।
রাহা মুখ কালো করে ফেললো। দুচোখে পানি ছলছল করলো কিন্তু সে তা দেখালো না। কথাটা ওভাবে বলার কি ছিল? রাহার সাথে কি ভালোভাবে কথা বলা যায় না? হয়ত যায় না।
রোয়েন তার টেবিল গুছিয়ে রাখতেই ফোনে কল আসলো। ফোন কানে দিয়ে বাইরে বের হয়ে গেল রোয়েন। রাহা একগাদা রাগ, অভিমান নিয়ে আবার টেবিলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল।
রোয়েন ঘরে ফিরে এসে রাহাকে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমাতে দেখলো। ভাবলো রাহা তার ভালো চাইতে লাগলো কখন থেকে? ভালোই তো তার বিছানার ভাগ নিচ্ছে না। সে আরামে ঘুমাতে পারবে। রোয়েন রুমের লাইট বন্ধ করে দিল। শুয়ে পড়লো। রাহার ঘুম ছুটে গেল। দেখলো রুম ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাহার ভয় করলো। সাথেসাথে বুক ভারী হয়ে কান্না আসলো। সবাই তাকে কার গলায় ঝুলিয়ে দিল আবার? যে তার রাগ, অভিমান বুঝে না। হাসি কান্না টের পায় না। কি দরকার ছিল অত ঘটা করে বলার, আমি রাহাকে বিয়ে করব, অন্য কেউ না।
রাহা টেবিলে মাথা রাখলো। টেবিল ভিজে উঠলো নোনাজলে। পরক্ষণেই ভয় লাগলো। আর থাকতে না পেরে সে নিজের ফোনের লাইট জ্বালিয়ে দিল। বিছানার দিকে মারতেই দেখলো জ্বলজ্বল করে কি দুটো যেন জ্বলছে। তার দিকে তাকিয়ে আছে। এলোমেলো চুল। এলোমেলো চাহনি। রাহা লাইট সরিয়ে নিল। লাইট বন্ধ করে দিল। তারপর টেবিলে মাথা রেখে আবার শুয়ে পড়লো। ডাক্তার জেগে আছে। ভয়ের কিছু নেই। পরক্ষণেই ভারাক্রান্ত মনে ঘুমাতে হলো তাকে৷
রোয়েন নিজেই লাইট জ্বালালো। সবাই তাকে ঘাড়ত্যাড়া ডাকে। অথচ রাহা আস্ত একটা ঘাড়ত্যাড়া।
টেবিলে মাথা রেখে ঘুমানো রাহাকে পাঁজা খোলা করে তুলে নিল রোয়েন। সে অল্পতেই বুড়ো হয়ে যাবে রাহাকে কোলে নিতে নিতে। তার বলশক্তি এজন্যই ক্ষয় হয়ে যাবে। খাটে শুয়ে দিতেই রাহা পিটপিট করে তাকালো। বসে পড়লো। চোখদুটো ভারী ফোলা।
নেমে যেতেই রোয়েন শাড়ির উপর পায়ে হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে ফেললো। অন্তরআত্মা কেঁপে উঠলো রাহার। রোয়েন বলল
‘ নামবে না। তোমার পায়ে হাত দিতে চাই নি। তুমি বাধ্য করেছ।
রাহা পা গুটিয়ে নিল তাড়াতাড়ি। হাত দিয়ে পা দুটো জড়িয়ে ধরলো। মাথা নিচু করে রইলো।
রোয়েন কিছু একটা ভেবে ড্রয়ারের কাছে গেল। একজোড়া নূপুর নিয়ে এসে রাহার সামনাসামনি বসে বলল
‘ কালকে যখন সবাই জিজ্ঞেস করবে আমি তোমাকে কি দিয়েছি, তখন সবাইকে বলবে ধমক দিয়েছি। কান্না করিয়েছি। বুঝেছ?
রাহা মাথা তুললো না। রোয়েন বলল
‘ পা দাও। দেখতেই পাচ্ছি নিজের ভবিষ্যত, বাকিটা জীবন আমাকে তোমার সেবা করেই পার করতে হবে। কোলে নিয়ে নিয়ে যৌবন শেষ করতে হবে।
রাহা পা আর ও গুটিয়ে নিল। রোয়েন নিজেই পা টেনে আনলো। সোনালি রঙের নুপুর জোড়া পড়িয়ে দিতে দিতে বলল
‘ বিয়ে করা মানেই পুরুষত্ব ফলানো নয় রাহা। পুরুষত্ব ত্যাগ করা। নাহলে তুমিই বলো আমি কখনো এসব কাজ করেছি? এসব মেয়েদের কাজ। কি আশ্চর্য নুপুরটা লাগাতেই পারছিনা।
রাহা মাথা তুললো এতক্ষণে। নুপুর?
সাথেসাথে দুচোখ নোনাজলে ভর্তি হলো তার। টলটলে চোখদুটো রাহার অসাবধানতায় রোয়েন দেখে ফেললো। নুপুরের আংটা লাগানোর চেষ্টা করতে করতে বলল
‘ এই নুপুরগুলো সুন্দর নাহ? অবশ্যই সুন্দর। রোয়েনের পছন্দ বলে কথা। সুন্দর হলে কি হবে দোষ ও আছে রাহা । নুপুরগুলো হাঁটলে শব্দ করেনা। ধরতে পারো আমার মতো।
রাহা নাক টানলো। রোয়েন নুপুরে মনোযোগ দিল। রাহা তার দিকে তাকিয়ে বলল
‘ আপনি খারাপ।
তাতে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া করল না রোয়েন। হাসলো। রাহার চোখ থেকে টপটপ জল পড়লো এবার প্রকাশ্যে। রোয়েন নুপুরজোড়া পড়িয়ে দিয়ে চোখ তুলে তাকালো। গম্ভীর স্বরে বলল
‘ তোমার এবার ও পালানো উচিত ছিল রাহা। তাহলে তো আর আমাকে বিয়ে করতে হত না। এভাবে কাঁদতে ও হত না৷
রাহা চোখ তুললো না। হাতের কব্জি দিয়ে চোখ মুছে বলল
‘ আমি থাকব না আপনার সাথে। আপনার কাছে। খারাপ মানুষের সাথে থাকব না আমি।
রোয়েন হেসে ফেললো। বলল
‘ ইউ মে গো নাও। দরজা খুলে চলে যাও যেখানে ইচ্ছে। গো।
রাহা দেরী করলো না।
বিছানা থেকে নামলো। গটগট পায়ে হেঁটে চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বের হলো। যেই বের হলো সেই আরেক বিপদ। পুরো বাড়িটা অন্ধকার। বিয়ের ঝামেলা চুকিয়ে সবাই ঘুমোচ্ছে। কতদিন ঘুমায়নি মানুষগুলো? সবকিছুর মূলে কি রাহা রোয়েন ছিল না?
রাহা কান্না মাখা চোখজোড়া বা হাত দিয়ে মুছলো। আবার নিজের ওই ঘরটাতে তাকাতেই দরজার কাছে পেছনে হাত দিয়ে দাঁড়ানো ছেলেটাকে দেখতে পেল। ভেজা চুল আঙুল দিয়ে নাড়িয়ে আবার পেছনে হাত দিয়ে ছেলেটা রাহাকে বলল
‘ ততটা দূরে যাও। যতটা দূরে গেলে আবার ফিরে আসতে পারবে।
রাহা নাক টানলো। শাড়ির আঁচল দিয়ে নাকমুখ মুছে বলল
‘ তো আপনি আমাকে কষ্ট দেন কেন? সোয়েভ ভাই, আর ঈশান ভাইকে দেখেন না? বউকে কিভাবে ভালোবাসে।
রোয়েনের মেজাজ খারাপ হলো। রাহা অন্যদের সাথে তার তুলনা করবে কেন?
রাহা রোয়েনের রাগী চেহারা টের পেল। তাড়াতাড়ি দৌড়ে গেল৷ রোয়েন লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘরে ঢুকে গেল। দরজা বন্ধ করতে চেয়ে ও পারলো না রাহার জন্য। তারপর লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়লো। রাহা অন্ধকারে পা টিপে টিপে দরজা বন্ধ করলো। তারপর রোয়েনের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরতেই রোয়েন একছিঁটকে হাতটা ছুঁড়ে ফেললো৷ উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ চেপে বলল
‘ আমি ঘুমাচ্ছি রাহা। দূরে যাও।
রাহা বলল
‘ আমার শীত লাগছে। কাঁথা দেন৷
রোয়েন বলল
‘ দেব না। ওরকম বলেছ কেন? তোমার সাথে আমার কিসের কথা?
রাহা হাসলো মিটিমিটি। শাড়ির আঁচল টেনে গায়ে জড়ালো। তারপর আলো আঁধারিতে রোয়েনের আবছা মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসলো। রোয়েন মুখ ফিরিয়ে নিল। রাহা অন্য পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। ধুরর আজকে কি আর চোখে ঘুম নামবে। এই ব্যাটার ফসফস নিঃশ্বাসের শব্দে মরি যায় মরি যায় অবস্থা। রাহার সত্যি ঠান্ডা লাগতে শুরু করলো। পাতলা নকশাতোলা কাঁথাটা রোয়েন গায়ে দিল আষ্টেপৃষ্টে। রাহা গাল ফুলিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল। কিন্তু ঘুম আসলো না। কান্না আসলো। ডাক্তার তাকে শাস্তি দিচ্ছে। মায়া দরদ নেই একটু ও। ঢুসে ঢুসে ঘুমোচ্ছে। রাহার ও সময় আসবে।
রাহা শাড়িটা ভালো করে গায়ে জড়াতে না জড়াতেই রোয়েন বাঁধা দিল। টেনে রাহাকে কাঁথার নিচে ঢুকিয়ে শাড়ির আচঁল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজের বক্ষতলে পিষ্ট করে বলল
‘ তুমি ওটা দিয়ে নাক মুছেছ। আবার গায়ে জড়াচ্ছ? আমার সাথে থাকলে ওসব বদঅভ্যেস বাদ দিতে হবে। বুঝেছ।
রাহার কথা বলা বন্ধ হয়ে গেল। বক্ষতলে এমনভাবে পিষ্ট হলো মান,অভিমান, রাগ, অনুরাগ সব পিষে আমিষ হয়ে গেল। একটুখানি ভালোবাসামাখাময় ছোঁয়ার সান্নিধ্যে নেতিয়ে পড়লো রাহা।
আসলে ভালোবাসার কাঙালদের ওই একটুখানিটা এক আকাশ মনে হয়। চাতকদের কাছে একফোঁটা বৃষ্টিটা এক সাগর মনে হয়।
ভালোবাসাহীন, মায়াহীন, অনুভূতিহীন, মরুভূমির মতো খা খা করা রৌদ্দুরময় হৃদয়ের বুকে প্রেমের বৃষ্টি নামানো তাদের পক্ষেই সম্ভব।
আর যারা শতবার অবহেলা করে ও ভালোবাসা পায়, অবজ্ঞার পর যত্ন পায়, পাগলের মতো ভালোবাসার একটা ভালোবাসার মানুষ পায় তাদের কথা নাই বা বলি।
সময় নিয়ে কপাল ভিজলো রাহার। কান ছুঁয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কে যেন বলে গেল
‘ তোমার কাছে আমি অন্যরকম।
ভালোবাসি বেশি, প্রকাশ করি কম।
চলবে।