ধ্রুবতারা পর্ব-৩৪

0
877

#ধ্রুবতারা
#পর্ব_৩৪
#পুষ্পিতা_প্রিমা

চাঁদের গাড়ি করে ফিরে সাজেক ভ্যালি থেকে সবাই যাত্রা করলো রাঙামাটির উদ্দেশ্যে। তখন খুব সকাল সকাল।
রাঙ্গামাটি জেলার সেনানিবাস এলাকায় মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে নির্মিত পারিবারিক বিনোদন কেন্দ্রে আরণ্যক হলিডে রিসোর্টে উঠবে তারা । রিসোর্ট ছাড়া ও এটি একটি বিনোদন কেন্দ্র। থাকা ছাড়া অনেকে ঘুরতে আসে এখানে। প্রবেশ টিকেট মূল্য ৫০ টাকা করে নেয়। থাকা খাওয়া খরচ তুলনামূলক একটু বেশি অন্য রিসোর্টগুলো থেকে। কাপ্তাই হ্রদে ঘেরা শান্ত ও ছিমছাম পরিবেশের আরণ্যক রিসোর্টটি সুনিপুণ ভাবে ছবির মত সাজানো গোছানো। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত আকর্ষনীয় এই রিসোর্টে রয়েছে ছোটদের জন্য বিভিন্ন রাইড, হ্যাপি আইল্যান্ড, ওয়াটার ওয়ার্ল্ড, পেডেল বোট, সুইমিং পুল, রেস্টুরেন্ট এবং খেলাধুলার ব্যবস্থা।
তাননার জন্য বেশ সুবিধা হলো। জিশান খেলতে পারবে এখানে। রুইলুই পাড়ার রিসোর্টগুলোতে পানি সংকট ও ছিল যা এখানে নেই।

কাপ্তাই হৃদের পাড়ে সবুজ ঘাসে মোড়ানো আরণ্যক রিসোর্টের প্রথম অংশে আছে নান্দ্যনিক ফুলের বাগান, নানা রকম ভাস্কর্য, রিসোর্ট, স্পিডবোট ও প্যাডেল বোটে চড়ার সুবিধা এবং কফি শপ। আরণ্যক হলিডে রিসোর্টের দ্বিতীয় অংশের হ্যাপি আইল্যান্ডে আছে ওয়াটার ওয়ার্ল্ড, পার্ক, রাইডার, বোট রাইডিং এবং লেকভিউ সুইমিং পুল। হ্যাপি আইল্যান্ডের ওয়াটার ওয়ার্ল্ডে প্রবেশ টিকেটের মূল্য ১৫০ টাকা। প্রতি সোমবার শুধুমাত্র দর্শনার্থীদের জন্যে প্রবেশ বন্ধ থাকে।
নান্দ্যনিক ফুলের বাগানের সৌরভে মাতোয়ারা রাহা আর নোহা। এত এত সুন্দর দৃশ্যর তুলনা হয় না কোনোকিছুর। পবিত্র ফুলের সৌরভে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারপাশে। ছবির মতো জায়গাগুলো শুধু কল্পনায় নয় এইবার চোখের সামনে। রোয়েন ব্যস্ত বাগানের ভেতর ঘুরে ঘুরে ফুলগাছগুলোর ছবি তোলায়। সোয়েভ ভাস্কার্যের সেখানে। আর ঈশান ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদের সাথে৷

তারা সবাই ব্রেকফার্স্ট বাঘাইহাটে সেড়েছে। রিসোর্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাননা রোয়েনকে ডেকে বলল
‘ এই ভাই কিছু খাবো তো। কিছু আন৷
রোয়েন বলল
‘ কি খাবি?
তাননা বলল
‘ জানিনা৷
ঈশান তা শুনে একপর্যায়ে দৌড়ে এল৷ তাননাকে চাপা রাগ দেখিয়ে বলল
‘ আমাকে বলেননি কেন খিদে লেগেছে?
তাননা বলল
‘ না খিদে লাগেনি তো৷ এমনি এমনি।
ঈশানের চেহারা দেখে হেসে ফেলল রোয়েন। তাননাকে বলল
‘ তুননু খিদে লাগলে তোর বরকে বলবি। দেখ বলিসনি তাই চেহারার কি হাল?
তাননা ঈশানের দিকে তাকালো। কপাল ভাঁজ করে তাকালো। ঈশান ভারী গলায় বলল
‘ আইসক্রিম খাবেন?
রোয়েন হেসে চলে গেল। তাননা ভেংচি কেটে বলল
‘ নাহ। আপনাকে খাব।
ঈশান তাকালো না। বলল
‘ কি খাবেন সেটা বলুন। এনে দেই।
তাননা ঈশানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বলল
‘ আনা লাগবে কেন? সামনেই তো আছেন৷ এদিকে আসুন। খাই ৷
ঈশান চোখ তুলে তাকালো। বলল
‘ আপনি শুধু ইয়ার্কি করেন। তাননা হেসে ফেলল। বলল
‘ আপনার সাথেই তো করি। আর কার সাথে করব?
ঈশান জবাব দিল না।
তাননা আরেকটু দূরত্ব কমিয়ে দাঁড়ালো। ঈশানের শার্টের কলার ঠিক করে দিতে দিতে বলল
‘ যা আনবেন তাই খাব। যান নিয়ে আসুন।
ঈশান মাথা নাড়িয়ে বলল
‘ আচ্ছা।
তাননা হাসলো। ঈশানের গলা জড়িয়ে ধরে বলল
‘ এক প্যাকেট রাগ ভাঙার ঔষধ কিনে আনিয়েন তো। রাহা, নোহা আর আমার খুবই দরকার ওই ঔষধটা।
ঈশান মাথা নাড়িয়ে বলল
‘ আচ্ছা। রাহা আর নোহার জন্য আনব। আপনার জন্য না।
তাননা বলল
‘ কেন? আমি কি দোষ করেছি?
ঈশান বলল
‘ ঔষধ পেলে তো ঔষধ আপনার জায়গাটা নিয়ে নেবে।
তাননা ঠোঁট গোল করে মাথা উপর-নীচ নাড়িয়ে বলল
‘ ওহহ আচ্ছা। কি বুদ্ধি। অবশ্য বুদ্ধি না থাকলে কি গোয়েন্দাগিরি করতেন?
ঈশান বলল
‘ বুদ্ধি না থাকলে কি আপনাকে পেতাম?
তাননা বলল
‘ কেন? আমাকে তো সোজাসাপ্টা পেলেন৷ আমি কি প্যারা দিয়েছি নাকি?
ঈশান বলল
‘ দুই বছর অপেক্ষা করালেন৷ ওইগুলো প্যারা ছিল না? আমার কাছে আসলে কি পড়ালেখা করতে দিতাম না? শুধু শুধু জেদ৷
তাননা হাসলো। বলল
‘ রাগ করছেন কেন? পড়ালেখা ও কমপ্লিট করলাম৷ সাথে আপনার ধৈর্যের পরীক্ষা ও নিলাম৷ এক ঢিলে দুই পাখি মরলো। ভালো নাহ?
ঈশান বলল
‘ ভালো।
তাননা হাসলো। বলল
‘ যান আইসক্রিম নিয়ে আসেন।
ঈশান এক পা বাড়ালো। আবার ফিরে এসে হাতের মুঠোয় থাকা তাননা হাতটার একপাশে শক্ত চুমু বসালো।
তারপর পরই চলে গেল৷ তাননা হেসে আওড়ালো, পাগল।

রোয়েন এল কিছুক্ষণের মধ্যে। এক বক্স চকলেট কেক দিয়ে বলল
‘ বেশি খাবি না। লান্চ করতে পারবি না।
তাননা হেসে ভাইয়ের মুখে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল
‘ মুননু আদোল আদোল।
রোয়েন নাক তুলে বলল
‘ সর। যাহ।
তাননা হাসলো। বলল
‘ তোর বউ কোথায়?
রোয়েন বলল
‘ আমি কি জানি? আমি কি তোর বরের মতো সারাক্ষণ বউয়ের পেছনে লেগে থাকি নাকি?
তাননা কোমরে হাত দিয়ে বলল
‘ কি বললি? আমি ও কি তোর বউয়ের মতো বরের পেছনে সারাক্ষণ লেগে থাকি নাকি?
রোয়েন যেতে যেতে তাননার দিকে আবার পেছনে ফিরে তাকালো। বলল
‘ যেখানে সেখানে রাহাকে টানিস কেন?
তাননা বলল
‘ যেখানে সেখানে ঈশান ভাই ঈশান ভাই করিস কেন? হুহ।
রোয়েন গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেল। তাননা ও গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেল। দুজন দুদিকে যেতে যেতে হাসলো। আহ কি সুন্দর ঝগড়া!
দুষ্টুমিষ্টি হাসিখুশিতে ভরে থাকুক ভাইবোনের প্রতিটা মুহূর্ত। পেটের ভাত হজম করার জন্য হলেও ঝগড়া করা দরকার পড়ে ভাইবোনের। ভাইবোন মানেই খুনসুটি, ঝগড়া, আদর। ভাইবোন শব্দটাই আস্ত একটা ভালোবাসা। বেঁচে থাকুক, ভালো থাকুক প্রত্যেকটা ভাইবোন। কোনোকিছুই সেই পবিত্র সম্পর্কে ফাটল না ধরাক। না ছুঁক। না ভাঙুক।

এগারোটার দিকে সবাই রেডি হয়ে রওনা দিল কাপ্তাই লেক ঘোরার জন্য।
রাঙ্গামাটির প্রধান আকর্ষণ হল কাপ্তাই লেকে বোটে চড়ে শুভলং ঝর্ণা, পেদা টিং টিং, ঝুলন্ত ব্রিজ দেখতে যাওয়া, পাহাড়ে অনেক উচুতে ওটে ঘাম ঝরানো এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা ও উপজাতিদের জীবন স্টাইল দেখা।
এখানকার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে কাপ্তাই হ্রদ ভ্রমন অন্যতম ও অসাধারণ। । কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মানের ফলে সৃষ্টি হয় সুবিশাল কাপ্তাই হ্রদ। মূলত পানি বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য এই বাঁধ নির্মিত হয়। অসংখ্য পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে চলা আঁকাবাঁকা বিশাল কাপ্তাই হ্রদে নৌবিহারে অনুভূতি এক অনন্য অভিজ্ঞতা। এতে করে অনুভূত হয় রোমাঞ্চকর অনুভূতির । যদি প্রিয় মানুষ গুলো সাথে থাকে তাহলে তো কথায় নেই ।
দেশীয় ইঞ্জিন নৌকা,লঞ্চ, স্পিডবোটে দিনভর নৌবিহার করা যায়। তবে রোয়েন জেনেশুনে কেয়ারী সিন্দবাদ ভাড়া করেছে। সারাদিন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আড়াই হাজার টাকা নেবে বললো৷

সবাই বুটে চড়ে যেতে লাগলো শুভলং জলপ্রপাত। প্রায় আড়াই ঘন্টার পথ। লেকের মধ্যে পানি আর পানি, চারিদিকে পাহাড়ে ঘেরা আর লেকের মাঝে মাঝে ছোট ছোট দ্বীপের মত পাহাড়, এরকম কিছু কিছু পাহাড়ে ঘর বাড়িও আছে, যারা নৌকা নিয়ে চলাফেরা করে। লেকের পাশ ঘিরেও অনেক জনবসতি আছে। নীল রং এর পানির এই লেকটি মানুষেরই তৈরি, প্রাকৃতিক নয়। চলতে চলতে এক সময় পৌঁছলো কাঙ্খিত সেই শুভলং। এখানকার অনেকে বলে সুবলঙ।

এই ঝর্ণায় চারিদিকে উঁচু উঁচু পাহাড় আর পাহাড়। একটা পাথরের পাহাড়ের গাঁ বেয়ে নেমে এসেছে সেই জলপ্রপাত। দুই-তিন ভাগ হয়ে পানি পড়ছে, কোন ভাগে বেশি আবার কোন ভাগে কম। পানির গতিও কখনো বেশি বা কখনো কম। ঝর্ণার কাছে যেতে হলে কিছু হালকা কাঁদা পানি দিয়ে যেতে হয়। তারপর আস্তে আস্তে করে খুব সাবধানে পাথরের পাহাড় বেয়ে ঝর্ণার পানি ছুঁতে হয়।
রোয়েন সবাইকে বারণ করলো যাতে কেউ না ভিজে। রাহার মন খারাপ হলো। রোয়েন তা খেয়াল করলো। বলল
‘ রিসোর্টে ফিরে সুইমিংপুলে ইচ্ছেমত ভিজো। এখন না। অনেক পথ যেতে হবে।
রাহা তখনি খুশি হয়ে গেল। মাথা দুলিয়ে বলল
‘ আচ্ছা মুননু।
রোয়েন অগ্নিচোখে চেয়ে রইলো। রাহা বুকে থু থু ছিটালো। ঈশানের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। বলল
‘ ঈশান ভাই বাঁচান।
ঈশান হাসলো। সোয়েভ ও হাসলো। রোয়েন ফুলে থাকলো।

বোট উঠে পড়লো সবাই শুভলং ঝর্ণা দেখে। এবার যাত্রা হল, বরকল উপজেলা ও পেদা টিং টিং হয়ে সেই কাংখিত ঝুলন্ত ব্রিজ। বরকল উপজেলায় তেমন কিছু নেই, আছে শুধু উঁচু পাহাড়, চাইলে ওঠা যায়।

কাপ্তাই হ্রদের চারিদিকে কেবল পাহাড় আর হ্রদ, যেন প্রকৃতির মাঝে আপিন এক আগন্তুক মাত্র। বুনো প্রকৃতি ছাড়া আর কিছুই আশা করা যায় না এখানে। বোট চলতে লাগলো। রাহা মিনমিন করে গাইলো
‘ এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলোতো।
সবাই রাহার দিকে ফিরলো। রোয়েন ভ্রু কুঁচকে চাইলো। নোহা বলল
‘ রোয়েন ভাইয়া আপনাকে জিজ্ঞেস করেছে বোধহয়।
রাহা জিভে কামড় খেল। জিশান বলল
‘ খালামুণির গান নাইস। বিটিফুল৷
রাহা বলল
‘ যাহ পাজি ছেলে মামি ডাকবে।
রোয়েন বলল
‘ নাহ।
রাহা বলল
‘ হ্যা।
সোয়েভ বলল
‘ আরেহ কি শুরু করলি?
রোয়েন বলল
‘ রাহা ধাক্কা দিয়ে লেকে ফেলে দেব এখন।
রাহা বলল
‘ দিন তো সাহস থাকলে। পরে বউ বউ করলে সমস্যা আছে। রোয়েন পিঠ করে বসলো। তাকালো না কারো দিকে। নাহ রাহাকে ফেলা যাবে না। সে আবার বউ কোথায় পাবে? তার রাহা রাহা গন্ধমাখা ঘর পরিষ্কার করবে কে? তাকে বাচ্চাকাচ্চার বাপ বানাবে কে? নাহ একদম ফেলা যাবেনা। কখনোই না। নো নেভার।

বোট থেমে গেল হঠাৎ রাঙ্গামাটি শহর থেকে ৪-৫ কিলোমিটার দূরে কাপ্তাই হ্রদের ভাসমান একটি পাহাড়ে অবস্থিত একটি পর্যটন সংস্থার কাছে।

সবাই নেমে গেল৷ সবার চোখেমুখে কৌতূহল। সোয়েভ,ঈশান রোয়েন ছাড়া। রাহা বলল
‘ এটা কোথায়?
জুনিত বলল
‘ আপু এটা পেদা টিং টিং। ওই দেখো সাইনবোর্ডে লেখা আছে। রাহা দেখলো। জিশান হেসে হাত তালি দিয়ে বলল
‘ পেতা টিংটাং টিংটাং।
তাননা বলল
‘ পেদা বলে আব্বা। পেতা কি?
জিশান বলল
‘ পিদা টিংটাং, টিংটাং।
সবাই হাসলো। রিহান বলল
‘ মামা আইসক্রিম খাওয়া শেষ?
জিশান বলল
‘ খাওয়া শেষ। মজা বেশ৷ টিংটংয়ের দেশ।
রিহান আর জুনিত হাত তালি দিয়ে বলল
‘ জিও জিশু । জিও জিও।
তাননা ঈশান রোয়েন হাসলো। তাননা জুনিত আর রিহানকে বলল
‘ ওকে তোদের সাথে রাখ তো ভাই।
জিশান নিজেই চলে গেল তাদের কাছে। অলরেডি দুপুরের খাবারের সময় চলে যাচ্ছে পেদা টিং টিং-য়ে লান্চ সাড়বে সবাই ।

সামনে এগোতে এগোতে তাননা ঈশানকে বলল
‘ পেদা টিং টিং এটার মানে কি গোয়েন্দা সাহেব?
ঈশান বলল,
পেদা টিং টিং একটা চাকমা শব্দগুচ্ছ, যার অর্থ হচ্ছে পেট টান টান। অর্থাৎ মারাত্মকভাবে খাওয়ার পর পেটের যে টান টান অবস্থা থাকে, সেটাকেই বলা হয় পেদা টিং টিং।
তাননা বলল
‘ ওহ। থাকার জায়গা নেই এখানে?
ঈশান বলল,
‘ আছে। রেস্তোরা, কটেজ, নৌবিহার ব্যবস্থা, সেগুন বাগান ও অসংখ্য বানর রয়েছে। ইচ্ছে করলে মনোজ্ঞ কোন অনুষ্ঠানও আয়োজন করা যায়। শুধু তাই নয় আপনি চাইলে রাত্রিযাপনও করতে পারবেন। এখানে থাকার জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি কক্ষ সদৃশ ঘর। চাঁদনী রাতে এমন একটি পাহাড়ের উপর রাত্রিযাপন সত্যিই দুর্লভ। থাকেনা কেউ তেমন স্থানীয় লোকজন ছাড়া।
তাননা মাথা দুলালো। বলল
‘ বুঝেছি।

পেদা টিং টিংয়ে খাবার অর্ডার করলো সোয়েভ। আদিবাসীদের খাবার সার্ভ করা হলো পরে৷ সাজানো গোছানো হোটেলটা। রান্নার গন্ধে পরিবেশ সুগন্ধে মাখামাখি। খাবার এল। সাদা ঝরঝরে ভাত । এর একটা হলো মুরগির মাংসের চচ্চড়ি, আরেকটা ঝাল ভেজিটেবল। বিগল বিচি, বাঁশের তরকারি, রুই মাছ। সবগুলোই রাঙ্গামাটিতে খুবই পপুলার।
তাননা জানতে চাইলো মুরগির মাংসের চচ্চড়িটার বিশেষত্ব কি? কেন পপুলার?
তারা জানালো
‘ এটার বিশেষত্ব হলো, এটা রান্নার সময় তেল একেবারেই ব্যবহার করা হয় না। মুরগি টুকরো টুকরো করার পর সিদ্ধ করা হয়। সাথে বাঁটা কাঁচামরিচ ও আলাদা ভিজিয়ে রাখা কাঁচামরিচের পানি যোগ করা হয়। পাশাপাশি ধনে পাতা এবং এ ধরনের আর কী কী যেন দেওয়া হয়। খুবই ঝাল লাগে খেতে! ভেজিটেবলেরও একই অবস্থা। বরবটি সিদ্ধ করা হয় কাঁচকি মাছের সাথে। সেখানেও প্রচুর ঝাল! জিশান মাছ দিয়ে খেল। রোয়েন ও।

খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই বাইরে বের হয়ে এসেছে। বোটে উঠে পড়বে। ঝুলন্ত ব্রিজ দেখে ফিরে যাবে। কিন্তু রাহা এক বিরাট ভুল করে বসলো। সে হোটেলের টেবিলে বসে ফোন টিপছিল। হোটেলের একটি ছেলে পানির মতো কি একটা এনে তাকে জিজ্ঞেস করল
‘ ম্যাডাম স্যারেরা কি এটা খাবে?
রাহা বলল
‘ ওগুলো কি?
ছেলেটা বলল
‘ দোচুয়ানি।
রাহা বলল
‘ মজা?
ছেলেটা বলল
‘ যারা ঘুরতে আসে তারা প্রত্যেকে খেতে চায়। আপনারা ও যদি খান।
রাহা বলল
‘ আগে আমি খেয়ে দেখি৷ মজা লাগলে ওনাদের খেতে বলব।
ছেলেটা রাহাকে এনে দিল। রাহা ঢকঢক করে খেয়ে নিল। কিছুক্ষণ পর যখন নোহা এল। নোহা ও খেল একসাথে। ছেলেটা কপাল চাপড়ে বলল
‘ এতগুলো কেন খাচ্ছেন ম্যাডাম?
রাহা বলল
‘ কেন? কি হয়েছে?
ছেলেটা বাইরে বের হয়ে সোয়েভ আর রোয়েনকে ডেকে আনলো। তারা এসে দেখলো রাহা আর নোহা এখনো খেয়েই যাচ্ছে। সাথে চুপচাপ ফোন টিপছে। রোয়েন দৌড়ে এসে নোহা আর রাহার কাছ থেকে গ্লাস কেড়ে নিল। বলল
‘ এগুলো কিহ?
রাহা বলল
‘ দো…. দো চুয়ানি।
রোয়েন কপালে হাত দিয়ে বলল
‘ ও আল্লাহ?
সোয়েভ হতভম্ব। এগুলো তো পাহাড়ি মদ?

তাননা আর ঈশান দৌড়ে এল। জুনিত এসে বলল
‘ কি খেয়েছে?
ঈশান বলল,
‘ মদ। দোচুয়ানি- এখানকার স্থানীয় পদ্ধতিতে বানানো মদ বিশেষ। বিশেষ ধরনের চালের ভাত এবং পাহাড়ি লতাপাতার মিশ্রণে নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বানানো হয় দোচুয়ানি। তবে ভয়ের কিছু নেই, স্থানীয় ভাবে তৈরি হলেও এটি একেবারেই স্বাস্থ্যসম্মত।

তাননা বলল
‘ মদ আবার স্বাস্থ্যসম্মত?
ঈশান বলল
‘ ভাতকে বাসি করে। গলিয়ে। ভিজিয়ে। কতকিছু করে বানায়। তারপর পাহাড়ি গাছগাছালির পাতা দিয়ে রস বের করে বানায়। তাই স্বাস্থ্যসম্মত বলে। বাকিটা জানিনা। এখানে খারাপ কিছু দেওয়া হয় না।
আমি বন্ধুদের সাথে একবার খেয়েছি। কিন্তু শিক্ষা হয়ে গেছে। ভারী নেশা লাগে। বেশি খেলে তা ও৷ কম খেলে কিচ্ছু হয় না। এরা বেশি খেয়েছে। মধুভাত খেলে যেমন ঝিমুনি আসে এগুলো খেলে ও ঝিমুনি আসে। তবে নেশা নেশা লাগে।

তাননা নাক ফুলিয়ে তাকালো। ওদিকে রোয়েনের গর্জন শোনা গেল। রাহা চোখ পাকিয়ে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। নোহা সোয়েভের পেছনে গিয়ে শার্ট আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো। সোয়েভ কিছু বলার পেল না। রোয়েন সবাইকে নিয়ে বোটে উঠে বসে বলল
‘ রাহা থাকুক এখানে। ওকে কেউ নিয়ে যাবি না। থাকুক।
রাহা কাঁদোকাঁদো হয়ে চেয়ে রইলো। সে বুঝতে পারছেনা ডাক্তার কেন এমন করছে? এদিকে মাথা ঘুরছে। কোথায় তাকে একটু শক্ত করে ধরবে। তা না।
নোহা মাথা ফেলে পড়ে থাকলো সোয়েভের কাঁধে। সোয়েভ ডাকলো
‘ নোহা কষ্ট হচ্ছে?
নোহা বলল
‘ নাহ। ঘুম পাচ্ছে।
রোয়েন বলল
‘ নোহা উঠো। তোমাকে ও যেতে হবে না।
নোহা সোয়েভের হাত ধরে রাখলো। সোয়েভ বলল
‘ শান্ত হ রোয়েন। রাহাকে নিয়ে আয়। ও পড়ে যাবে। তাননা তুই নিয়ে আয় তো ।
তাননা গেল। রাহাকে নিয়ে এল। তাননা তার ঘাড়ে মাথা ফেলে রাখলো।
ঝুলন্ত ব্রিজ দেখার জন্য রোয়েন নামায় সবাই নামলো। তাননা আর সোয়েভ ছাড়া। রোয়েন রাগে ইচ্ছে করেই নামলো। মনটা পড়ে রইলো ওখানে।

রাঙ্গামাটি শহরের শেষ প্রান্তে কাপ্তাই হ্রদের তীর ঘেঁষে অবস্থিত সরকরি পর্যটন মোটেল। পর্যটকদের জন্য খুবই দৃষ্টিকাড়া ও আকর্ষনীয় স্থান এটি। পর্যটন মোটেলেই অবস্থিত ঝুলন্ত ব্রিজটি, যা পর্যটন এলাকাকে আরও বেশি সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দিত করেছে। সহজেই পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে এটি। পর্যটকদের প্রধান আকর্ষনের কারনে এবং এর নির্মানশৈলির কারনে ঝুলন্ত ব্রিজ আজ রাঙ্গামাটির নিদর্শন হয়ে দাড়িয়ে আছে। অতিরিক্ত মানুষ থাকায় ওদিকে গেল না কেউ। পাঁচ মিনিটের ভেতর চলে আসলো। তাননা বলল
‘ পরে দেখিস না। ওদের নিয়ে গিয়ে কি খাওয়াবো? ঢলে পড়ে রয়েছে দুজন।
রোয়েন বলল
‘ আমি কি জানি? দুজনকেই নর্দমায় ফেলে রাখবো।
সোয়েভ নোহাকে মিনমিন করে বলল
‘ নোহা তো শেষ।
নোহা তার শার্ট শক্ত করে ধরলো। নাকিসুরে কেঁদে বলল
‘ নাহ।
সোয়েভ হাসলো। রোয়েন রাহার দিকে আঁড়চোখে তাকালো। রাহা তাকে দেখে বলল
‘ ডাক্তার পান খাব। পান পান।
রোয়েন ধমকে বলল
‘ জাস্ট শাটআপ। চড় মেরে দাঁত ফেলে দেব একদম। বেয়াদব কোথাকার।
রাহা চোখ বন্ধ করতে করতে বলল
‘ পান, কাঁচা সুপারি, মিষ্টি জর্দা। তারপর চুনা। লাল লাল ঠোঁট,,
রোয়েন বলল
‘ আল্লার ওয়াস্তে চুপ করো। নাহলে সত্যি সত্যি ফেলে দেব। রাহার টলটলে চোখ দুটো টলমল করতে লাগলো। সে বিড়বিড় করলো
‘ বেয়াদব ডাক্তার।
সবাই মিটিমিটি হাসলো। জুনিত আর রিহান লুকিয়ে হাসলো। সবার দেখাদেখি জিশান ও গালে হাত দিয়ে চেপে হাসলো। রোয়েন তাকাতেই বলল
‘ মামা খালামুণিকে বকো কেন?
রোয়েন কিছু বলল না।

রিসোর্টে ফিরতেই নোহাকে কোলে তুলে হাঁটা ধরলো সোয়েভ। রোয়েন ব্যাটা তার বউকে বকে। নোহা সোয়েভের গলা শক্ত করে ধরে বলল
‘ ওই সিমেন্টওয়ালা, আমি কোথায়?
সোয়েভ বলল
‘ একদম চুপ। মদ খেয়ে এখন আবার কোথায় জানতে চাইছে।
নোহা ঠোঁট বাঁকালো। চোখ বন্ধ অবস্থায় বলল
‘ আমার আব্বাকে বলে দেব আপনি গুন্ডা। আমার আব্বা পুলিশ। আমার শ্বশুড় পুলিশ।
সোয়েভ তার বকবকানি শুনতে শুনতে ঘরে নিয়ে গেল। বিছানায় শুইয়ে দিতেই কাশতে শুরু করলো নোহা। পানি পানি করতে করতে সোয়েভ পানি খাওয়ালো। ঢলে পড়লো নোহা। সোয়েভ তার দিকে ঝুঁকে মুখ নাড়িয়ে ডাকলো
‘ নোহা শরীর খারাপ লাগছে? এই নোহা বেশি খারাপ লাগলে বলুন। নোহা? এই নোহা?
নোহা কথা বলল না। নেতিয়ে পড়লো বিছানায়।
সোয়েভ তোয়ালে ভিজিয়ে এনে মুখ,কপাল, গলা মুছে দিল। তারপর আবার শুকনো তোয়ালে দিয়ে মুছে দিয়ে আধশোয়া হয়ে পড়লো নোহার পাশে। গালে হাত দিয়ে নম্র গলায় ডাকলো
‘ নোহা?
নোহা হু বলে একটু আওয়াজ করলো। সোয়েভ নিজের কাছে টেনে নিল তাকে। বন্ধ চোখের পাতায় উষ্ম স্পর্শ আঁকলো। একটু একটু করে ব্যক্তিগত প্রলেপ লাগিয়ে দিল সারামুখে। তারপর মিশিয়ে নিল বক্ষমাঝে। নোহা উষ্ণ ভালোবাসার চাদর পেয়ে নিজেকে ঢেকে নিল সেই বক্ষতলে৷

রুমে নিয়ে আসতেই গলগল করে রোয়েনের গায়ের উপর বমি করে দিল রাহা। কান্নামাখা গলায় বলল
‘ আল্লাহ আমি মরে যাচ্ছি কেন?
রোয়েন বমি পরিষ্কার করলো। নিজের শার্ট খুলে নিল। ঘর পরিষ্কার করলো। রাহা বকবক করছে শুইয়ে শুইয়ে চোখ বন্ধ অবস্থায়। রোয়েন রাগে ফেটে পড়ার মতো অবস্থা। সব বরবাদ করে দিল রাহা। এখন চারপাশে বমি বমি গন্ধ। তাকে শাওয়ার নিতে হবে।
রাহার শাড়ি পাল্টে দেওয়া দরকার। সেটাতে ও বমি বমি গন্ধ। রাহার সবকিছুতে রোয়েন রোয়েন গন্ধ হওয়া উচিত।
রাহাকে শাড়ি পাল্টে দিতে গিয়ে মহাঝামেলায় পড়লো রোয়েন। রাহা উলটপালট বকবক করছে। সুর টেনে গাইলো
‘ একটা পান চাইলাম, পান দিলানা ৷ তোমার সাথে কিসের পিরিতি?
রোয়েন ধমক দিল। একদম চুপ রাহা। ঠাসস করে দেব একটা।
রাহা চুপ হয়ে গেল।
রোয়েন তার শাড়িটা পাল্টে দিয়ে কোনোমতো নীল রঙের শাড়িটা পড়িয়ে দিল ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে। কোনোমতো পেঁচিয়ে দেওয়া যাকে বলে৷ রাহা বকবক করলো আবারও।
‘ ডাক্তার বেয়াদ্দব। আমার শাড়ি ধরে।
রোয়েন কিচ্ছু বলল না। রাহা যা বলার বলুক, সে সময় আসলে সব উসুল করে নেবে।
ঘরের লাইট বন্ধ করে লাল রঙের বাল্বটি জ্বালিয়ে দিল সে। রাহার চোখে যদি অন্তত ঘুম আসে এবার।
তারপর সে শাওয়ার নিল।
শাওয়ার শেষে এসে মাথা মুছতে মুছতে খুঁজলো তার শার্ট। খুঁজে পেলনা ব্যাগটা। রাহা কোথায় রাখলো। সবকিছু আছে। ধোয়া হয়নি শার্টগুলো ও আছে। অন্য গুলো কোথায় হজম করেছে কে জানে? রাগে একদম ফেটে চৌচির হলো রোয়েন। রাহার কাছে গেল। রাহার দিকে ঝুঁকে ডাকল
‘ রাহা আমার শার্টগুলো কোথায় রেখেছ? এই রাহা ফাহা?
রাহা উত্তর দিল
‘ হুহ।
রোয়েন বলল
‘ আমার শার্ট।
রাহা বলল
‘ মেরে ফেলেছি।
রোয়েন সরে পড়লো। তন্নতন্ন করে খুঁজে বের করলো। তারপর শার্ট গায়ে দিয়ে রাহার কাছে আসতেই মৃদু মৃদু আলোয় দেখলো পেঁচানো শাড়িটার নাজেহাল অবস্থা। রোয়েন গিয়ে ঢেকে দিল। রাহার গালে হাত দিয়ে মৃদু মৃদু চাপড়ে বলল
‘ রাহা উঠো। শাড়িটা ঠিক করে পড়ে নাও।
রাহা চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলো। রোয়েন তার দিকে ঝুঁকে ডাকলো
‘ রাহা উঠো। তুমি ওসব খেয়েছ, আর আমাকে জ্বালাচ্ছ। আমি টায়ার্ড রাহা। উঠো প্লিজ।
রাহা উঠলো না । দুর্বল হাতে শক্ত করে ধরলো রোয়েনের শার্টের কলার। নিজের দিকে টেনে নিল ।

নুইয়ে যাওয়া রোয়েনের ওষ্ঠ অধর গিয়ে ঠেকলো রাহার গলদেশের কাছে। মদিরা-মত্ত রাহা নিজের অজান্তেই সংকুচিত হয়ে গেল গ্রীবাদেশে তপ্ত শ্বাসের উপস্থিতি টের পেয়ে।
যখন দেখলো সেই তপ্ত শ্বাসের প্রগাঢ়তা বাড়ছে। সঁচরণ বাড়ছে। বিচরণ বাড়ছে। নিবিড়তা বাড়ছে। তখন নিজেকে গুটিয়ে নিতে গিয়ে অসাবধানতায় আর ও উন্মুক্ত করে দিল সে৷

সেই ঢিলেঢালা শাড়ি নিজের অবস্থান থেকে নড়বড়ে হয়ে গেল । হিমশীতল কায়ার ভাঁজে ভাঁজে পরিক্রমণ ঘটলো উষ্ণ হস্তের প্রলেপণ।
অসংখ্য বার অধরের স্পর্শে কম্পন ধরল গলদেশ, গ্রীবাদেশে। উষ্ণ আলিঙ্গনে বাড়লো গাঢ়ত্ব,গভীরত্ব।
বিভোর হওয়া রাহা গলে গেল, নুইয়ে গেল, নেতিয়ে পড়লো প্রাণপুরুষের ভয়ানক অনুষঙ্গের সংস্পর্শে। তার মত্ত্বতার বিনিময় ঘটলো যেন। আর মাতোয়ারা হলো অপর মানুষটি।
তার গায়ে বমি বমি গন্ধ সরে গেল৷ অতঃপর রোয়েন রোয়েন গন্ধে সুবাসিত হলো সে।
তারপরেই সে বলে বসলো
‘ আপনার কালা কালা দাঁড়িগুলো বেশি ধার। মাছ ঢলা যাবে। মাছ একদম পরিষ্কার ঝকঝকা ফকফকা,,
রাহার অযথা বকবকানি বন্ধ হয়ে এল, নিঃশ্বাস থমকে গেল, শ্বাস নেওয়া কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে এল চঞ্চল চঞ্চুর উপর কোমল, নমনীয় আক্রমণে। সে যুদ্ধে পরাজিত রাহা, অবশেষে পরাজয় মেনে নিল।

চলবে।