#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_২৫
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন
– “আমাদের মধ্যে কপাল ভালো এনজামের ই। যেখানে আমি একটা মেয়ে, অথচ আমার বাচ্চা এখনো ঠিকঠাক হাঁটাই শিখেনি। সেখানে ঐ শা’লার বাচ্চা স্কুলেও ভর্তি হয়ে গেল!”
গালে হাত রেখে বললো তোহা। তার কথার প্রেক্ষিতে রিয়ান আরো হতাশ কণ্ঠে বললো,
– “তোর তো বাচ্চা হামাগুড়ি দেয় তাও। আর আমার তো এখনো বউয়ের চাঁদমুখখানা দেখারই সৌভাগ্য হলোনা!”
সজীব একপেশে হেসে বললো তখন,
– “আধবুড়ো হয়ে বিয়ে করতে যাস কেন? তোর না কোন লন্ডনের প্রেমিকা ছিলো?”
– “এমন ভাব নিতাছোস যেন তুই চারটা বিয়ে করে উল্টায় ফালাইছিস?”
থতমত খেয়ে যায় সজীব। তাদের সবারই বয়স আটাশ উনত্রিশ চলে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ছেলেরা সাতাস এর আগে বিয়ে খুব কমই করে। আবার অনেকে ত্রিশ ছাড়িয়েও বিয়ে করে। এটা আহামরি বড় কিছুই না। বন্ধুমহলের সব ছেলেদের মাঝে এখন অবধি বিয়ে হয়েছে কেবল দুজনের। একজন এনজাম, আরেকজন বর্তমানে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছে।
এনজাম খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে ছিলো। মূলত তার মনটা ভালো লাগছেনা। এই স্থানটাতে এসে একাকীত্ব সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করছে তাকে। কী ভয়ানক খারাপ লাগা! বন্ধুদের কোনো কথা কান অবধি পৌঁছালোই না। তোহা সকলের কথা অগ্রাহ্য করে জানতে চাইলো,
– “প্রজ্ঞা কোথায়? তোর জান,পরান,কলিজা! তোদের মনে আছে ভাই, কী পাগলামি টাই না করতো এই ছেলে!
সকালে ভার্সিটি,বিকেলে অফিস,আবার রাতে গিয়ে টিউশন। এমনকি ভার্সিটি থেকে লুকিয়ে বের হতো ও। প্রজ্ঞা দেখলে ছাড়তে চাইবেনা, আর এই বান্দা ওকে সময় দিতে পারবেনা। তাই বলে মেয়েটার সামনেই আসতোনা। তোমারে সালাম ভাই!”
হাত উঁচিয়ে বললো তোহা। এনজাম ঘাসের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। সজীব হতবাক কণ্ঠে বলে তখন,
– “জাস্ট ভেবে দেখ, আমরা এখন কোথায় আর ও এখন কোথায়। লাইফে আর কী ই বা চাই? এইজন্যই মনে হয়, আরলি ম্যারেজ খুব ভালো একটা ব্যাপার।”
– “ভালো ব্যাপার, তার জন্য এনজাম হতে হয়। তুই পারতিস শখ আহ্লাদ বাদ দিয়ে কল সেন্টারে,কফি শপে কাজ করতে? তার মধ্যেও ওর সিজি আমাদের চেয়ে উপরে থেকেছে। কেমনে ভাই?”
এনজাম এবার মুখ খুললো। বিরক্তির স্বরে বললো,
– “তোরা কী আমাকে নিয়ে গবেষণায় নেমেছিস? আমার জায়গায় থাকলে তোরাও একই কাজ করতি।”
রিয়ান দুহাত তুলে বলে,
– “সারেন্ডার করছি ভাই। মেয়ে একটা গেলে দশটা পাবো। কিন্তু জীবন তো একটাই, সময় একবার গেলে দ্বিতীয়বার পাওয়ার চান্স নেই।”
– “মেয়ে দশটা পাওয়া গেলেও, ঐ একটা মেয়েকে দ্বিতীয়বার পাওয়া নাও যেতে পারে।”
তোহা বুকে হাত রেখে শুধায়,
– “উফফ! প্রজ্ঞা ইজ সো লাকি ম্যান। আর আমার জামাই… খালি সারাদিন খাচ্ছে আর ভুড়ি বানাচ্ছে। ওর পাশে এখন বাচ্চা লাগে আমারে। কিন্তু আমাকে খুব টেক-কেয়ার করে।”
এনজাম ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে,
– “যত্ন পেলেই সবদিক মাফ?”
– “অবশ্যই! কেয়ারিং এর উপরে কিচ্ছু নেই।”
সজীব আবারো প্রশ্ন করলো তাকে,
– “কিন্তু তোর সাধের বউ কই? সিঙ্গেল দের মতো আমাদের পাশে বসে আছিস কেন? তোরে তো মাসেও একবার পাইনা খুঁজে।”
– “বউ আপাতত বাপের বাড়ি। তাই পাচ্ছিস। থাকলে অভিয়াসলি পেতিস না।”
রিয়ান নাক কুঁচকে বলে ওঠে,
– “হালায় এক নাম্বার এর বউ পাগল ভাই। এই তুই প্রজ্ঞার মধ্যে কী এমন দেখেছিলি বল তো? প্রেম তো আমিও করেছি দশ বারোটা। এমন মাতাল তো হয়ে যাইনি।”
– “দশ বারোটা করেছিস বলেই ঠিক আছিস। একজনকে ভালোবাসলে, তখন বুঝতি।”
হুট করে সামনের দিকে চোখ যেতেই হেসে উঠলো তোহা। টিপ্পনি কেটে বললো,
– “এই সেরেছে, এখন আর এনজামকে খুঁজে পাওয়া যাবনা।”
রিয়ান,সজীব কিছু না বুঝলেও এনজাম তড়িৎবেগে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো। প্রজ্ঞাকে দেখে যেন বুকের উপর থেকে একটা পাথর সরলো তার। মনে হলো… নাহ, সে একা নয়। এইতো মেয়েটা আছে। খানিকটা দূরত্বেই। ক্যাম্পাসের এক সেরা প্রেমিকযুগল আজও উপস্থিত এখানে। হারিয়ে যায়নি তারা, হারিয়ে যায়নি তাদের ভালোবাসা।
তোহার কথাকে সত্য প্রমাণিত করে এনজাম তৎক্ষণাৎ উঠে গেলো। হাঁটা ধরলো প্রজ্ঞার দিকে। সজীব নাক শিটকে বললো,
– “ব্যাস…একবার বলেও গেলোনা দেখলি? বউ একদিকে,পুরো দুনিয়া আরেকদিকে।”
– “এমন বউপাগল ও সবাই হতে পারেনা। ওর পা ধোয়া পানি এনে খা তোরা।”
.
প্রজ্ঞার কাছাকাছি এসে দাঁড়াতেই থেমে যায় এনজাম। একজন বিশেষ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলছিলো সে। ব্যক্তিটা বিশেষ, তাদের জন্য সত্যিই বিশেষ। ব্যক্তিটি পাশ ফিরতেই এনজামকে চোখে পড়লো তার। প্রশস্ত হেসে বললো,
– “বাহ, বর-বউ দুজনের সঙ্গেই দেখা হয়ে গেলো।”
প্রজ্ঞাও এবার তাকালো এনজামের দিকে। এনজাম তাকে একনজর দেখেই সামনে এগিয়ে এলো। লোকটির সঙ্গে সৌজন্যমূলক আলিঙ্গন করে বললো,
– “আপনার কোনো খোঁজ ই তো পাইনা ভাই। নম্বরটাও বন্ধ। দেশে ছিলেন না নাকি?”
লোকটি হেসে জানায়,
– “নাহ ছোট ভাই। ছিলাম বাহিরেই। ফিরলাম এইতো মাস দুয়েক আগে। তোমাদের একসঙ্গে দেখে ভালো লাগলো খুব। আমার মাধ্যমে শুরু হওয়া একটা সম্পর্ক অন্তত জীবিত আছে এখনো।”
এনজাম-প্রজ্ঞা তাকালো একে অপরের দিকে। প্রীতি হাতের ব্রেসলেট টা ঠিক করতে করতে প্রজ্ঞার পাশে এসে বলতে নেয়,
– “তোরটা আমায় দে। এটা তুই পর তো।”
সামনে তাকিয়ে অপরিচিত লোকটিকে দেখে সালাম দিলো প্রীতি। কালো রঙের পাঞ্জাবী পরিহিত লোকটাকে একটু চেনাচেনা মনে হলো তার। অনেক আগে একবার দেখেছে হয়তো। লোকটি তার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি পরখ করে নিজে থেকেই বললো,
– “স্বজন… আপনি আমায় চিনবেন না। কিন্তু আপনার বোন আমাকে খুব ভালো করে চেনে। তাদের বিয়ের একজন সাক্ষী হিসেবে ছিলাম।”
প্রীতি এতক্ষনে চিনলো তাকে। উৎসাহিত কণ্ঠে বললো,
– “আরে ভাইয়া,আপনিতো নামের যথাযথ মূল্য রেখেছেন!”
– “কীভাবে?”
– “স্বজন, অসহায় বাচ্চাদের স্বজন হয়েই পাশে দাঁড়িয়েছেন। নামের মর্যাদা রইলো না?”
মৃদু হাসলো স্বজন। প্রীতি নিজেও হেসে বলে,
– “আর আমি প্রীতি, প্রজ্ঞার বোন আর ভাইয়ার একমাত্র শালীকা। আপনার সাহায্যে বাঁধা পড়া দুই পাগলকে এ অবধি টেনে নিয়ে আসছি।”
এনজাম,প্রজ্ঞা কড়া চোখে তাকালো তার দিকে। সে সবটা অগ্রাহ্য করে চলে যায় নিজের বন্ধুদের কাছে। সে যথেষ্ট মিশুক, তবে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হয়না। এইযে বছরখানেক পর দেখা হলো, জমিয়ে আড্ডা দেবে। তারপর পরবর্তী এক বছরের জন্য আবারো নিরুদ্দেশ।
এনজাম-প্রজ্ঞা স্বজনের সঙ্গে কথা বললো আরো কিছুক্ষন। মানুষটার প্রতি অনেকাংশে কৃতজ্ঞ তারা। কোনো দিকে না চেয়ে যখন দুজন বিয়ে করার জন্য কাজী অফিসে গিয়ে পৌঁছোলো, তখন বড় ভাইয়ের মতো এই মানুষটা তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এমনকি বিয়ের পর এনজামকে চাকরি জোগাড় করে দিয়েছেন। যেকোনো বিপদ-আপদে পাশে থেকেছেন।
প্রজ্ঞা,এনজামের মাঝে আলাদা কথা হয়ে উঠলোনা আর। নিজেদের মতো গিয়ে চেয়ারে বসলো তারা। এনজাম বসলো স্বজনের পাশে। আর প্রজ্ঞা তার থেকে তিন-চার চেয়ার পরে গিয়ে নিজের আরো কিছু বন্ধুদের সঙ্গে।
প্রায় দশিমিনিট বাদে এনজাম লক্ষ্য করলো, প্রজ্ঞা বারবার নিজের চোখে হাত দিচ্ছে। মুখভঙ্গি ভালো ঠেকছেনা তার। টিস্যু দিয়ে চোখ চেপে ধরে আছে। খানিক বাদে সে চেয়ার ছেড়ে উঠে অন্যদিকে চলে গেলো। এনজামও আর বসে রইলোনা। দ্রুত উঠে গিয়ে তার পথ ধরলো। প্রজ্ঞা ভিতরে গিয়ে ওয়াশরুম এর পাশে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। চোখ থেকে লাগাতার পানি ঝরছে। বাম চোখ মেলে তাকাতেও পারছেনা,জ্বলে যাচ্ছে একদম। কলটা ছেড়ে পানির ঝাপটা দিতেই জ্বলন আরো বেড়ে গেলো।
এনজাম দ্রুত এসে তাকে নিজের দিকে ঘোরায়। চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে জানতে চায়,
– “হয়েছে কী চোখে?”
– “জ্বলছে!”
এনজাম দু আঙুলের সাহায্যে চোখটা টেনে খুলতেই মেজাজ বিগড়ে গেলো তার। রাগত স্বরে বললো,
– “এই ছাতার মাথা চোখে দিতে বলছে কে? সাধারণ চোখ কী কম সুন্দর তোমার?”
– “আরে প্রীতি পরিয়ে দিয়েছিলো তো।”
– “তো তুমি বারণ করতে পারোনা? গর্দভ একটা! দেখি ঠিক করে তাকাও।”
এনজাম লেন্স খোলার জন্য হাত এগোতেই প্রজ্ঞা চেঁচিয়ে উঠলো,
– “এইইই আমার চোখ! তোমার ভরসা নেই,ছাড়ো। আমি দেখছি।”
– “এক চটকানা মা’রবো…চুপ করে থাকো।”
এনজামের ধমকে থেমে যায় প্রজ্ঞা। খুব সাবধানে তার চোখ থেকে লেন্সটা খুলে আনে এনজাম। একদম ফেলেই দেয়। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
– “আরেক চোখের টা খোলো। তারপর পানি দাও। নিজের ভালো পাগলেও বোঝে। জেনেবুঝে বোকার মতো কাজকাম করলে আর বলার কিছু থাকেনা।”
প্রজ্ঞা অপর লেন্সটাও খুলে পানি দিলো চোখে। এখনো জ্বলছে চোখ। বাম চোখ ফুলে কলাগাছ, সাদার মাঝে লাল শিরাগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এনজামের নিজের ই খারাপ লাগলো। এমন কিছু বাচ্চাদের মতো কাজ যে করে এই মেয়ে!
প্রজ্ঞাকে একটু ক্ষ্যাপাতে সে নিজে থেকেই বললো,
– “ইশ! এখন যে সব আটা ময়দা ধুয়ে গেলো, কী হবে এবার?”
প্রজ্ঞা কড়া চোখে চেয়ে শুধায়,
– “পাউডার ব্যতীত মুখে কিচ্ছু মাখিনি। সেজেগুজে কাউকে ইমপ্রেস করার প্রয়োজন নেই আমার।”
এনজাম ঠোঁট কামড়ে তার পিছনে এসে দাঁড়ায়। আয়নায় চেয়ে চুলগুলো ঠিকঠাক করে জিজ্ঞেস করে,
– “বাট…আ’ম লুকিং হ্যান্ডসাম না?”
প্রজ্ঞা বিরক্তিভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে যেতে নিলেই এনজাম হাত ধরে থামিয়ে দেয় তাকে। সরু চোখে চেয়ে বলে,
– “ওদিকে কই যাও?”
– “তো…কোথায় যাবো?”
এনজাম মুখে কিছু উচ্চারণ করলোনা। তার হাতটা চেপে ধরেই হাঁটা উল্টো উল্টোপথে। থামে ঠিক পুকুরপাড়ে এসে। চারনম্বর সিঁড়িটাতে বসে প্রজ্ঞাকেও বসার নির্দেশ জানায়। প্রজ্ঞা বিরোধ না জানিয়েই শুনলো তার কথা।
কিন্তু এনজাম বলবে টা কী? এমন শব্দসংকটে তার ভোগার কথা নয়। মনে কথা জমিয়ে রাখার অভ্যাস তাদের কখনোই ছিলোনা।
বেশ কয়েক মিনিট পেরোলো। এনজাম কথা বলেনা। প্রজ্ঞাও নিরবে হাটুতে মুখ লুকিয়ে বসে। এই স্থানটাতে বসে সে শেষ একবার কেঁদেছিল ছয় বছরের বেশি সময় পূর্বে। একরাশ জড়তা,ভয়ে আচ্ছন্ন ছিলো তার কিশোরী মন। এনজামের প্রতিক্রিয়া দেখার এক মিশ্র অনুভূতি হচ্ছিলো। “তুমি বাবা হতে চলেছো” এই চারটে শব্দ গলা থেকে বেরই হচ্ছিলো না। প্রায় আধাঘণ্টা যাবৎ কান্নাকাটির পর সে জানাতে সক্ষম হয়েছিলো।
এনজাম আড়চোখে তাকিয়ে বলে,
– “কিছু বলো।”
প্রজ্ঞা মুখ তুলে শুধায়,
– “কী?”
– “যা খুশি। কী বুঝলে ক’দিনে?”
প্রজ্ঞা চোখ সরিয়ে উত্তর দেয়,
– “কিছুই না। আ’ম ইমোশনলেস।”
এনজাম একটু হাসে তার কথায়,
– “আচ্ছা? তা কে জানি কাঁদছিলো বাড়িতে বসে?”
প্রজ্ঞা চকিতে তাকায় তার পানে। তার কান্না দেখবে কে? প্রীতির সামনে এ অবধি একবারো কাঁদেনি সে। এমনকি সে খুব একটা কান্নাকাটি তো করেই না। যা মাঝেসাঝে অতিরিক্ত আবেগী হয়ে যায়, সেটা ভিন্ন বিষয়।”
– “তোমায় কে বললো?”
– “মনে হলো।”
একদৃষ্টে চেয়ে বলে এনজাম। প্রজ্ঞা গম্ভীর গলায় বলে,
– “ভুল ভেবেছো। দরকার হলে আমার ব্যাপারে ভাবাই বাদ দিয়ে দাও।”
এনজাম কথা বললোনা। প্রজ্ঞা কোনো প্রতিত্তর না পেয়ে তাকালো তার দিকে,ঠিক চোখদুটোর দিকে। একপর্যায়ে এনজাম নরম স্বরে বললো,
– “আগেপিছের কথা সাইডে রেখে এই সময়টাকে উপভোগ করো। এমন মুহূর্ত বারবার পাওয়া যায়না। ঝগড়া করতে নিয়ে আসিনি তোমায়।”
প্রজ্ঞা মৃদু হেসে শুধায়,
– “অথচ এই মুহূর্তগুলো হাজারবার ফিরে পেতে চেয়েছিলাম আমরা।”
এক শক্ত ঢোক গিলে মুখ ঘুরিয়ে নেয় প্রজ্ঞা। এনজামও হাটুর উপর হাত ঠেকিয়ে বসে সময় নিয়ে বললো,
– “ডোন্ট ইউ থিংক দ্যাট উই লস্ট আওয়ারসেল্ফ?”
– “ইউ লস্ট ইয়োরসেল্ফ… আই ডোন্ট।”
– “এক হাতে তালি বাজেনা।”
– “কেউ কথা দিয়েছিলো, সে বদলে যাবেনা।”
এনজাম হেসে বললো,
– “কেউ আমাকেও কথা দিয়েছিলো, সে আমাকে বদলাতেই দেবেনা।”
একসঙ্গে ফিরে তাকায় দুজন। প্রজ্ঞা দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
– “সে বলেছিলো, থাকতে পারবেনা।”
– “সে-ও বলেছিলো, ছেড়েই যাবেনা।”
– “পাল্টা উত্তর দিচ্ছো কেন?”
খানিকটা রেগে বললো প্রজ্ঞা। এনজাম মুচকি হেসে জানায়,
– “উত্তর আছে তাই।”
– “না নেই। তোমার কথাগুলো যুক্তিহীন।”
– “তোমার গুলোই যুক্তিযুক্ত?”
– “অবশ্যই।”
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে এনজাম। পরক্ষনে আবারো চোখ তুলে চায়। প্রজ্ঞা তার চাহনি দেখে নিচু গলায় বলে,
– “একসময় কেউ আমাকে ছাড়া ঘুমোতে পারতোনা। অথচ এখন পাশের ঘরে রেখে দিব্যি ঘুমোতে পারে।”
– “একসময় কেউ জেগে থাকতো আমার অপেক্ষায়। ভরসা রাখতো, মাঝরাতে হলেও আমি আসবো। এই আশাটা এখন সে রাখেনা।”
– “রাখেনা…কারণ সে রাখার মতো কোনো কাজই করেনা। আগে তার ঘুম হতোনা বলে মাঝরাতে ছুটে যেতো। সেই নির্ভরতা এখন নেই।”
এনজাম পলকহীন চোখে চেয়ে শুধায়,
– “মাঝরাত অবধি জেগে ছিলে কি?”
প্রজ্ঞা এবারে উত্তর দিতে পারলোনা,চুপ করে রইলো। এনজাম হাসতে হাসতে বলে,
– “চিন্তা না রেখে ঘুমিয়ে পড়েছি, এটা যদি আমার বদলে যাওয়ার উদাহরণ হয়…তাহলে তুমি যে আশায় বসে থাকোনি, এটা তোমার বদলে যাওয়ার উদাহরণ। আবারো বললাম,এক হাতে কিন্তু তালি বাজেনা।”
একটুক্ষণ থেমে বললো সে,
– “এইযে এতদিন, একদিনও রাত জেগেছো? অপেক্ষায় থেকেছো? অথচ তুমি কিন্তু অপেক্ষায় রাত পার করে দিতে পারো।”
– “আশা করলেও তা পূরণ হতোনা।”
– “করেই দেখতে পারতে। কেউ আমার থেকে কিছু চাইলে, তবেই কিন্তু আমার তাড়া থাকবে তার প্রাপ্যটা পাইয়ে দেওয়ার। যখন সেই দৃঢ় বিশ্বাসটাই অবশিষ্ট নেই, তখন আর আমার থেকে কিছু আশা করো কী করে?”
– “বিশ্বাস তুমি ভেঙেছো।”
– “যদি ভেঙেও থাকি, তার শুরুটা কিন্তু তুমিই করেছো।”
প্রজ্ঞা মুখ ফিরিয়ে নিলো। দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলো। এনজাম খানিকটা সময় বাদে বলে,
– “আগের কথা বাদ দাও। জাস্ট থিংক আবাউট লাস্ট টু ইয়ারস। কতটুকু ইফোর্টস তুমি দিয়েছো আর কতটা আমি দিয়েছি?”
– “হাত পুড়িয়ে রান্না শেখার চেষ্টা করেছি আমি!”
– “হ্যা তো সেই হাতে মলমটা আমিই লাগিয়ে দিয়েছি।”
উচ্চস্বরে বললো এনজাম। অকস্মাৎ ধমকে প্রজ্ঞা কেঁপে উঠলে পুনরায় সোজা হয়ে বসে সে। এনজাম কপালটা টিপে ধরে নিরাশ কণ্ঠে বললো,
– “মাথায় যেকোনো ভুল চিন্তা এলে একশোবার শাসিয়েছি নিজেকে। আমি যে বদলে যাচ্ছি এটা তোমার চোখে পড়ে ঠিকই, কিন্তু বদলে যাওয়া থেকে যে নিজেকে টেনে হিচড়ে সরিয়ে রাখছি এটা কেন চোখে পড়েনা?
ঠিক আছে, মনে ভুলভাল চিন্তা এলে মুখে বলেই ফেলি, কিন্তু এরপর? এমন একটা সময় বলতে পারবে যেখানে নিজে থেকে ছুটে যাইনি আমি? মনে করে দেখো…খুঁজে পাবেনা। আমি নিজেই নিজেকে সামলাচ্ছি, তাহলে তুমি কী করছো? ট্রাই টু আন্ডার্সট্যান্ড প্রজ্ঞা, তুমি থাকতে যা আমি ভাবতে চাইনা এমন চিন্তা আমার মাথায় আসবে কেন? তুমি এটা একবারো কেন বুঝতে চাইবেনা?”
প্রজ্ঞার ঠোঁটজোড়া কাঁপলো বারকয়েক। এনজাম খানিকটা অভিযোগের স্বরে বললো,
– “দোষগুলো দেখো,ঠিক আছে। তাহলে শোধরানোর চেষ্টাটা কেন দেখবেনা? প্রতিবার যে আমি ব্যস্ত হয়ে ছুটে যাই, এটা কেন? লোক দেখানোর জন্য? কাকে দেখাবো? আমি ইগো ধরে রাখিনা, এর কারণটাও তুমি। নইলে এমন ঠ্যাকা পড়েনাই আমার।”
শেষ কথাটা আবারো ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললো সে। প্রজ্ঞা নাক ফুলিয়ে শুধায়,
– “এখন সব দোষ আমার?”
– “হ্যা… ধরেই নিলাম দোষ আমার। বাট ইউ নো দ্যাট, আমার যেকোনো দোষ ধুয়ে মুছে সাফ করার ক্ষমতা তোমার আছে। কিন্তু তুমি তার চেষ্টা করবেনা। কেন? কারণ তোমার একটা আত্মসম্মান আছে।
প্রজ্ঞা! আমি মাঝেসাঝে এক আধবার হলেও ভাবি। নিজেকে নিয়ে ভাবি। নিজের ভুলগুলো আইডেন্টিফাই করার চেষ্টা করি। তুমি তো সেটার চেষ্টাই করোনি কখনো। অ্যাটলিস্ট আমার সামান্য রিগ্রেটনেস টুকু বুঝতে পারলেও চলতো!”
– “দেখো, সাধু সাজার চেষ্টা করবেনা একদম।”
এনজাম একপেশে হেসে বললো,
– “আগের দিন হলে আননোন আইডির মেসেজেস দেখে একবারেই বুঝে যেতে এটা অন্য কেউ না। আর এখন তুমি এতই বড় হয়ে গেছো… এগুলো আর ভাবায় না,তাইনা?”
একটু অবাক হলো প্রজ্ঞা। এনজাম আবারো ক্ষুব্ধ স্বরে বলে,
– “অনুপস্থিতি মেনে ঘুমিয়ে পড়লেও ভোরবেলা গিয়ে যে পাশে কোলবালিস দিয়ে এসেছিলাম, এটা বোঝার ইচ্ছেটাই হারিয়ে ফেলেছো তুমি। হুটহাট এক দুবার রং নাম্বারের কল তোমার ফোনে কেন যায় এটাও বোঝার বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছো।
যাকে একবার ব্লক করেছো, তার দুটো আইডি যে নিজে থেকে এর আগে দুবার ব্লক করেছি সেটা জানার প্রয়োজনবোধ করোনি।”
– “এটা আমি জানতাম!”
– “জানতে তো অ্যাপ্রেশিয়েট করোনি কেন? খুঁত ধরার গুণ থাকলে প্রশংসা টুকুও করার গুণ রাখো। কিন্তু না… তুমি মেয়ে,দ্যাট মিনস তুমি কিছু করবেনা। সব আমার দায়িত্ব। ওকে ফাইন!”
একই সঙ্গে সে রেগেই গেলো। প্রজ্ঞা ঠোঁট কামড়ে কান্না নিয়ন্ত্রণ করলো নিজের। প্রায় পাঁচমিনিট বাদে এনজাম শান্ত গলায় বললো,
– “চাইলে কাঁদতে পারো।”
– “কেউ একজন কান্না দেখতে পারতোনা।”
– “তাইজন্যই বলছি। ইমোশনাল হয়ে কান্নাকাটি শুরু করো। আমিও সরি বলে মানিয়ে নেবো। এছাড়া না, কারণ এবারে নিজে থেকে সরি বলার কোনোপ্রকার ইচ্ছে আমার নেই।”
– “আমার কান্না এত সস্তা?”
– “একটা অ্যাসেট। ঠিকঠাক কাজে লাগালেই চলে।”
প্রজ্ঞা কাঁদলোনা। এনজাম দৃষ্টি স্থির রেখে বললো,
– “অনেক কিছু বলেছি। আমার কথা বোঝার ইচ্ছেটাও তোমার মধ্যে নেই। নাহলে এখন অবধি ভাব দেখাতেনা। বাট ইটস ওকে, এটুকু জেনে রাখো, আমার তরফ থেকে আর কোনো রিসপন্স পাবেনা তুমি। ইগো আমার ও থাকতে পারে, রাগ আমার ও থাকতে পারে। তোমায় মাথায় তুলে রাখতে পারি,বুকে আগলেও রাখতে পারি, কিন্তু পা ধরে ঝুলে থাকতে পারবোনা। আমার দোষের পাশাপাশি নিজের দিকটা যেদিন সামান্য উপলব্ধি করবে, সেদিন এসো। তার আগে আর কোনো দরকার নেই।”
#চলবে?
#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_২৬
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন
সে-বেলায় বাড়ি ফিরে এনজাম গম্ভীর চিত্তে বিছানায় বসে রইলো কতক্ষন। ঠিক-ভুলের এক বিশাল দ্বন্দ্বে পড়ে আছে সে। এই কঠিন কথাগুলো হয়তো বলা উচিৎ হয়নি। কিন্তু বলা প্রয়োজন ছিলো।
তার স্বামী সত্ত্বা ভাবছে, প্রজ্ঞা কথাগুলো শোনা ডিজার্ভ করে। আবার প্রেমিক সত্ত্বা মরিয়া হয়ে উঠছে এই ভেবে যে, সে মেয়েটাকে আঘাত করলো, কষ্ট পেলো তো সে! এই কথা মাথায় এলেই সে প্রতিবার তাকে কাছে টেনে নেয়। একটা সরি… মেয়টাকে বোঝানোর চেষ্টা, তার প্রেমিক এখনো ফুরিয়ে যায়নি। সে জীবিত, মাঝেসাঝে কেবল সম্পর্কের চাপে ঘুমিয়ে পড়ে। তবে এবারে তার ‘মেল ইগো’ ঐ প্রেমিককে অগ্রাহ্য করে যাচ্ছে। সে মাথা নোয়াতে রাজি নয়।
মাথাটা ভার হয়ে রইলো সারাটা রাত। না ঘুমিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে রইলো এনজাম। সিগারেট সে খায়না, একদমই অভ্যাস নেই। রাগের মাথায়, কষ্ট পেলে… কখনোই না। যেই বয়সটাতে ছেলেরা এসবের প্রতি পুরোপুরি আসক্ত হয়ে পড়ে, সেই বয়সে সে ভেবেছে ভবিষ্যৎ নিয়ে,পরিবার নিয়ে। মা-বাবাকে নিয়ে খুব বেশি ভাবতে হয়নি। তারা গ্রামে থাকে, নিজেদের মতো ভালোই আছে। সম্পূর্ন ধ্যান-ধারণা তার আবদ্ধ ছিলো প্রজ্ঞা,প্রণয়ের উপর। বিশেষ করে প্রণয়ের অস্তিত্ব জানার পর একটা অন্যরকম দায়িত্ব উপলব্ধি করলো সে। প্রজ্ঞা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলো তখন। তাকে স্বান্ত্বনা দেবার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়ে আশ্বাস দিয়েছিলো এনজাম, “বোকা মেয়ে, কাঁদছো কেন? হ্যা, আমরা এখনো অনেকটা ছোট, মা-বাবা হবার মতো ম্যাচিউরিটি এখনো নিজেদের মধ্যে আসেনি। কিন্তু আমরা তো বড় হবো। তাকে সঙ্গে নিয়ে আমরা বুদ্ধিদীপ্ত হয়ে উঠবো, দেখো। ওর খেয়াল রাখবো, ওকে ভালো রাখবো। যখন বড় হবে, তখন এই সময়গুলোর গল্প শোনাবো। আমার উপর বিশ্বাস রাখো, তোমাকে,তোমার মা-কে কোনো অভিযোগ জানানোর সুযোগ দেবোনা।”
ঐ পুরোটা রাত সে প্রজ্ঞার একটা ফোনকলের অপেক্ষায় রইলো। ভুল বলেনি এনজাম। আর কিছুর ই প্রয়োজন ছিলোনা। তার ক্ষমা চাইতে হতোনা, নিজের ভুলটুকো স্বিকার করতেও হতোনা। কেবল দু’ফোটা অশ্রু ঝড়িয়ে তার প্রশস্ত বুকটাতে জায়গা খুঁজে নিলেই চলতো। আগেপরের কথা ভুলে ঐ মুহূর্তে তাকে ফিরিয়ে আনতো এনজাম। দুদিন বাদে পুনরায় ঝগড়া হলে হতো… তবুও সে ফিরিয়ে আনতো।
রাগ,অভিমান,কষ্ট সবকিছুর সমন্বয়ে ক্লান্ত হয়ে একপর্যায়ে ফোন নিয়ে বসলো এনজাম। পিডিএফ খুলে কয়েকটা রান্নার রেসিপি দেখেই চোখ আটকে যায় তার। মাঝেমধ্যে এসব পড়তে নিলেই প্রজ্ঞা নাক শিটকে বলতো,
– ‘আর এগুলো দেখে হবে টা কী? বানাতে তো পারো শুধু টোস্ট আর অমলেট।”
এনজাম ভ্রু কুঁচকে বলতো,
– “আর তুমি কী দেখো ফোনে? ‘স্বামী নিয়ন্ত্রণে রাখার দশটি নিয়ম’ এসব ই তো।”
– “আ..হা..হা! আর নিজে যে তার বিপরীতে এগারোটা পদ্ধতি বানাও তার কী হবে?”
– “এগারোটা না, ত্রিশ টা বানাবো। আমার মতো মাসুম ছেলেদের বউয়ের হাত থেকে রক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ।”
ফোনটাও বিছানায় ছুড়ে ফেলে টিভি ছেড়ে বসলো এনজাম। কিন্তু এখানেও শান্তি নেই। মাস তিনেক আগে একদিন টিভিতে খেলা দেখছিলো সে। প্রজ্ঞা কোথা থেকে এসেই কোমড়ে হাত রেখে বলে,
– “তুমি কি জানো, আমি শেষবার কবে টিভি রিমোট ধরেছি?”
– “হ্যাঁ, যখন তুমি আমার অ্যাকশন মুভি বন্ধ করে ‘রান্নাঘর’ দেখছিলে।”
– “আর তুমি? রাতে ম্যাচ দেখার সময় ঘুমিয়ে পড়ো, আর সাউন্ডের কারণে আমাকে জাগিয়ে রাখো!”
– “হ্যাঁ, কারণ তোমার কুকিং শো-ও তো ঘুমানোর জন্য হরর মুভির মতো কাজ করে!”
শক্ত এক ঢোক গিলে টিভিটাও বন্ধ করে রাখে সে। অসহ্য লাগছে সবকিছু। অনেকটা পাগল হয়ে প্রজ্ঞার নম্বরে ডায়েল করতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে থেমে যায় সে।
আলাদা এক ফোল্ডার ভর্তি প্রজ্ঞা,প্রণয়ের সেলফি। সেগুলো দেখেই বাকি রাতটা তার পার করতে হলো… আর কিছুই করার নেই।
— — —
বাড়ি ফেরার পর চোখ মেলে তাকানোই দায় হয়ে গিয়েছিলো প্রজ্ঞার জন্য। পাপিয়া আক্তার শুরুতেই গম্ভীর গলায় ক’টা কথা শোনালেন, সেই এক লেন্স পরার জন্য। পরবর্তীতে নিজ হাতে খাবার খাইয়ে ঔষধ এনে দিলেন। প্রীতি প্রণয়ের সঙ্গে রইলো। দুটো ঔষধ খেয়ে রাত তিনটে অবধি ঘুমিয়েই থাকে প্রজ্ঞা। সন্ধ্যায় অল্প খেয়েছিলো বিধায় তাকে আর ডাকা হলোনা রাতে। যখন ঘুম ভাঙলো তখন প্রীতি,প্রণয় একে অপরকে জড়িয়ে ধরে গভীর ঘুমে মগ্ন।
বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এলো সে। বিছানায় না বসে পড়ার টেবিলের সামনে চেয়ার টেনে বসলো। মাথাটা টেবিলের উপর রেখে ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিলো।
তার নামে আজ কী সুন্দর যুক্তিগত অভিযোগ ছুড়লো এনজাম! তার সব ভুলগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। যার সারমর্ম স্বরূপ একটা কথাই মাথায় এলো প্রজ্ঞার, সে একজন ভালো বউ নয়। সংসার করতে জানেনা, স্বামীকে সামলাতে জানেনা, তাকে বুঝতে চায়না। অর্থাৎ একজন যোগ্য বউয়ের কোনো গুণ তার মধ্যে নেই।
প্রজ্ঞা একটু ভাবে, কী করে ভালো বউ হওয়া যায়? এইযে বেলা নয়টার আগে বিছানা না ছাড়া মেয়েটা সকাল সকাল উঠে নাস্তা বানায়, এটা কী ভালো কাজ নয়? খিটখিটে মেজাজে কথা বলেও খাওয়ার পর লাইটটা নিভিয়ে যে আলতোহাতে বরের চুলগুলো টেনে দেয়,মাথা টিপে দেয়, এটা ভালো কাজ নয়?
সব ধরণের রান্না না জানলেও প্রতিদিন যে কাজের মাঝে তাকে ফোন করে জ্বালায়, ‘কী খাবে আজ’ বলে, এটা কী ভালো বউয়ের গুণ নয়? অনেক সময় অতীতের সুন্দর স্মৃতিগুলো মনে করে রাতবিরেতে ঘুড়তে যেতে ইচ্ছে করলেও যে ভাবে, লোকটা অফিস করে এলো। থাক,এখন বিশ্রাম ই নিক। এটাও তার গুণ নয়?
ভুলভাল কিছু বলে ফেললে ছেলেটা প্রতিবার ছুটে আসে, আর সে যে প্রতিবার ঐ এক কথায় গলে যায়। যা-ই কষ্ট পাক, সবটা ভুলে যায়, এটাতো দেখলোনা সে!
অত:পর তার মনে হলো, যা করেছে সবটাই বোধ হয় ভুল করেছে। একজন পরিপূর্ণ নারী হয়ে সে যে সংসার করতে চেয়েছে, প্রেমিকা সত্ত্বাকে খানিকটা দূরে সরিয়ে স্ত্রী হতে চেয়েছে, এটাই হয়তো ভুল। কারণ পুরুষটি বউ চাইলেও, তার মাঝে প্রেমিকার অস্তিত্ব খুঁজেছে। দুটো একসঙ্গে পেতে চেয়েছে, যা সে দিতে সক্ষম হয়নি। এইতো ভুল…মস্ত বড় ভুল।
অথচ প্রজ্ঞা এবারেও নিজের দিকটা ভেবে দেখলোনা। এনজাম যে শুরুর দিকে স্বামী হয়ে ওঠার চেষ্টা করতো,সেটা তার মাথায় এলোনা। সে-ও যে স্বামী আর প্রেমিমকে একসঙ্গে চেয়েছে, এটাও ভেবে দেখলোনা। তবে বুঝলো নিজের ভুলটা। বুঝলো, সে যেমনভাবে নিজেকে সাজাতে চেয়েছে, তেমনটা এনজাম চায়নি। একটু আকটু চেষ্টা সে ঠিকই করেছে, তবে সঠিক দিকে নয়।
আজ সে বললো, প্রজ্ঞা তার জন্য রাত জেগে অপেক্ষা করেনি। হ্যা,অপেক্ষা করেনি। কিন্তু রাতে বারবার ঘুম ভাঙায় যে উঠে বসে থেকেছে, কই…সেটা তো ধরতে পারলোনা!
গাল বেয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তার। বামচোখ তখনো খানিকটা ফুলে আছে। মানুষ তাকালেই দেখতে পাবে, একটা মেয়ের জন্য ছেলেটা কতই না করেছে!
কিন্তু মেয়ের দিকটা দৃশ্যমান হবেনা, কেউ ভাববেনা।
উচ্চমাধ্যমিক পরিক্ষার সময় প্রণয় তার পেটে ছিলো। পাঁচ মাসের গর্ভবতী তখন সে, পেট অল্পস্বল্প উঁচু হয়েছে। বন্ধুরা খুব অবাক হয়ে এই সেই প্রশ্ন করতো। কবে বিয়ে হয়েছে,কতমাস চলছে,বর কী করে আরো কত কী! এমনকি ম্যাডাম রাও জানতে চাইতো। খুব লজ্জা লাগতো তখন কলেজে যেতে, পরীক্ষা দিতে যেতে। নিজের প্রিয় বিষয়, গণিত পরিক্ষার দিন শরীর এতটাই খারাপ হয়ে গেল যে তিন ঘণ্টার পরিক্ষায় দু ঘণ্টার পরপরই খাতা জমা দিয়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছিলো তাকে। ঐ এক বিষয়ের জন্য গোল্ডেন মিস গেল তার। তবুও মন খারাপ করেনি।
এরপর এলো অ্যাডমিশন পিরিয়ড। প্রণয়ের জন্মের আগের ক’টা মাস এই সেই সমস্যার কারণে তেমনভাবে পড়াও হয়ে ওঠেনি। জন্মের পর প্রণয় রাতে ঘুমোতে চাইতো না। কাঁদবে না,তবে তার সঙ্গে থাকতে হবে। প্রীতির ও একই সময়ে পরীক্ষা। রাত দুটো অবধি ছেলেকে নিয়ে বসে থেকে তারপর তাকে ঘুম পারিয়ে এক মগ কফি নিয়ে পড়তে বসতো সে। একেতো সি সেকশন এর কারণে শরীরে নানান সমস্যা, তার উপর বসে থাকতে গিয়ে কোমড় ব্যাথা হয়ে যেত। তবুও সে পেটে বেল্ট বেঁধে পড়তো, মেডিকেল এ পড়ার বিশেষ স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে।
এত কষ্টে বেশ ভালো একটা প্রস্তুতি নেবার পর যেদিন পরীক্ষা, তার আগের দিনই প্রণয় অসুস্থ হয়ে পড়লো। হাসপাতালে নিলে টাইফয়েড ধরা পড়লো। তার উপর রক্তশূন্যতা। ছেলেকে নিয়ে সবার কান্নাকাটি। তার মাঝে আর পরীক্ষা কীসের? পাপিয়া, এনজাম বারবার বললেও তার আর পরীক্ষাটা দেওয়া হলোনা। অসুস্থ দুধের বাচ্চাকে রেখে হাসপাতাল থেকে এক পা-ও নড়তে পারলোনা সে।
ছোটবেলার স্বপ্ন, কিচ্ছুটি না ভেবে বিসর্জন দিয়ে দিলো। এরপরের ডিপ্রেশন, মুড সুইং সবকিছুর কথা তো বাদ-ই। তার পরের দিনগুলোও খুব হেসেখেলে কাটিয়েছে,তেমনটা নয়।
এসব আর কী…কোনো ব্যাপার ই না। সত্যিই কী কিছু নয়? কোনো ত্যাগ নেই তার? একটু তো আছে! এগুলো কেন মনে নেই এনজামের? মনে থাকলে তো এই অভিযোগগুলো করতোনা। ও তো বলেছিলো, এ জীবনে কখনো কোনোপ্রকার অভিযোগ আমার আসবেনা তোমার প্রতি।
প্রজ্ঞা এবারেও ভুল করে বসলো। পরীক্ষার সময়ে গেইটের বাহিরে দাঁড়িয়ে হাতটা শক্ত করে ধরে যে আশ্বাস দিয়েছিলো এনজাম, সেটা ভাবনায় এলোনা। রাত জেগে কষ্ট করে পড়েছে সে। ঐ ছেলেটাও যে সারাদিন খেটে তার জন্য রাত জাগতো, বারবার ফোন করে খবর নিতো, এটা মনে পড়লোনা। পরীক্ষা না দিতে পারায় তার সমপরিমাণ কষ্ট যে সেই ছেলেটাও পেয়েছে… তা আর ভাবা হলোনা।
তবে প্রজ্ঞা বুঝলো, এনজামের অভিযোগ জায়েজ। কিন্তু এর বিপরীতে তার কী করা উচিৎ? ক্ষমা চাইবে? তাহলেই সব আগের মতো ঠিক হয়ে যাবে তো? ঠিক সেই পুরনো দিনের মতো!
— — —
দুদিন বাদে, সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ বাড়ি ফিরলো প্রজ্ঞা। শরীর,মন কোনোটাই ভালো লাগছেনা বলেই আগেআগে ছুটি নিয়ে এসেছে। এখন ছেলের সঙ্গে সময় কাটাবে, তাকে নিয়ে একটু ঘুম দেবে ভেবে হাতমুখ ধুয়ে বের হতেই দেখলো প্রণয় মুখ ভার করে বসে আছে। প্রজ্ঞা কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। জানতে চায়,
– “কী হয়েছে আমার বাবার? জানো,তোমার জন্য একটা নতুন চকলেট এনেছি। নেবে?”
প্রণয় দুদিকে মাথা নাড়লো। প্রজ্ঞা ভ্রু কুঁচকে বলে,
– “কী হয়েছে সোনা?”
প্রণয় চট করে তার বুকের সাথে মিশে যায়। কাঁদোকাঁদো গলায় বলে,
– “বাবার কাছে যাবো,মাম্মা। বাবাকে আসতে বলো।”
– “বা..বাবাকে..”
চুপ করে যায় প্রজ্ঞা। বুকটা ভার হয়ে আসে। একটা শক্ত ঢোক গিলে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। প্রণয় আবারো বলে,
– “বলোনা আসতে!”
প্রজ্ঞার কিছু একটা হলো। হুট করেই মনে হলো, সে কেবল খারাপ বউ নয়, সঙ্গে একজন খারাপ মা। এইযে ছেলেটা বাবা-মা’কে কাছে পাচ্ছেনা, মন খারাপ করছে, কষ্ট পাচ্ছে, এটা তো কাম্য নয়। কোনো ভালো মা নিশ্চই সন্তানকে কষ্ট দিতোনা। মানুষতো বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়েই কত কিছু সহ্য করে নেয়। আর সে কিনা সামান্য বিষয়টুকু মেনে নিতে পারছেনা। এইযে দুদিনে, কেন কল করলোনা এনজামকে? সে কী পারতোনা সবকিছু মিটমাট করে নিতে? কিন্তু তা করলোনা,কেন করলোনা? এরও উত্তর নেই।
আসলে কেন এতকিছু হচ্ছে? সময়টা এত বিষাদময় কেন? নির্দিষ্ট কারণটা খুঁজে পেলে এর সমাধান করা যেত। কিন্তু এর তো কোনো নির্দিষ্ট কারণই নেই! তার অনেকটা ভুল, এনজামের কিছুটা ভুলের প্রভাবটা গিয়ে পড়ছে এই বাচ্চাটার উপর। অথচ তার একটা সুন্দর পরিবেশে বড় হওয়ার কথা ছিলো। তাকে সঙ্গে নিয়ে তার বাবা-মায়ের বড় হবার কথা ছিলো, একেবারে শেষ নিঃশ্বাস অবধি ছোট্ট হাতটা ধরে রাখার কথা ছিলো।
প্রণয় একটু একটু ফুঁপিয়ে কাঁদলো। তার ভালো লাগছেনা। নানু বাসা আর ভালো লাগছেনা। সে নিজের বাসায় যেতে চায়। টুশির সাথে খেলবে, পিপির সাথে গল্প করবে, বাবার সাথে টিভি দেখবে,দুষ্টুমি করবে, স্কুলে যাবে। এতদিন তো সে নানুর বাসায় থাকেনা।
দুপুরে ঘুমায়নি প্রণয়। মায়ের শরীরের ওম পেয়ে তার ঘুম পেয়ে যায়। প্রজ্ঞা শুয়ে পড়ে তাকে নিয়ে। হাতে,পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেই মিনিট দশেকের মাঝে ঘুমিয়ে পড়ে সে। প্রজ্ঞা উঠে বসে তখন। তার মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে মুখে হাত চেপে কেঁদে ওঠে। প্রণয়ের ঘুম ভেঙে যেতে পারে বিধায় বাথরুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। প্রীতি থাকলে এখন বেশ কিছুক্ষন কাঁদতো তাকে জড়িয়ে ধরে। পরামর্শ চাইতো। কিন্তু সে বাড়িতে নেই। আর মায়ের কাছে সে কিছু বলবেনা। যার ফলে একা একাই সে কাঁদলো অনেকটা সময়। এনজামের কথায় নিজের দোষ খানিকটা খুঁজে পেলেও ছেলেকে দেখে তার নিজেকে বড্ড অপারগ মনে হলো। আসলেই তো… সে কোনো ইফোর্টস দেয়না।
কান্নার একপর্যায়ে গা গুলিয়ে উঠলো। বেশি কান্নাকাটি করলে বমি পায় তার, এটা নতুন নয়। চোখেমুখে পানি দিয়ে সে বেরোলো বাথরুম থেকে। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো সাতটার বেশি বাজে।
বিছানায় বসে ফোনটা নিয়ে কাপাকাপা হাতে এনজামকে একটা কল করলো। সে ফোন তুললো সঙ্গেসঙ্গেই। দু সেকেন্ড চুপ থেকে শান্ত গলায় শুধায়,
– “হ্যাঁ…বলো।”
প্রজ্ঞা মুখ চেপে ধরে কেঁদে উঠলো আবারো। ফোনটা সরিয়ে নিলো কান থেকে। এনজাম কিছুটা সময় অপেক্ষা করে। কোনো প্রতিত্তর না পেয়ে বলে,
– “কিছু বলতে চাইলে বলো। নাহলে ফোন রাখো।”
প্রজ্ঞা তবুও কথা বলেনা। এনজাম এবারে বিরক্তির স্বরেই বললো,
– “হয়েছে কী? নাটক দেখানোর জন্য কল করেছো? আদেও কিছু বলবে নাকি…”
– “প প্রণয় সন্ধ্যা থেকে কান্নাকাটি করছিলো। পারলে একটু দেখে যেও ওকে।”
এনজাম অবাক স্বরে বলে,
– “আগে বলবেনা? অফিস থেকে সোজা ওখানেই যেতাম। আচ্ছা, আসছি।”
কলটা কেটে আবার প্রণয়ের পাশে গিয়ে বসলো প্রজ্ঞা। চোখে থাকা চশমাটা খুলে কপালে একটা চুমু এঁকে উঠে গেলো তার পাশ থেকে।
– – –
এনজাম এসে পৌঁছোলো আটটার দিকে। পাপিয়া আক্তার এসে দরজা খুললেন। এনজাম সালাম দিলে তার উত্তর দিয়ে মৃদু হেসে সরে গেলেন। প্রণয় সোফায় বসে চিপস খাচ্ছিলো। এনজামকে দেখামাত্র ছুটে এসে বললো,
– “বাবা তুমি এসেছো!”
এনজাম তাকে কোলে তুলে একগাল হেসে বলে,
– “তুমি নাকি আসতে বলেছো, আর আমি আসবোনা?”
প্রণয়ের সমস্ত মন খারাপ একেবারেই উড়ে গেলো। এনজাম তাকে নিয়ে সোফায় বসতেই সে গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
– “বাবা, বাসায় যাবো। বাসায় চলো।”
এনজাম একটু ভেবে বলে,
– “উমম…যাওয়াই যায়। আমার সাথে যাবে?”
– “মাম্মা যাবেনা?”
অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে প্রণয়। এনজাম ঠোঁটে মিছে হাসি টেনে শুধায়,
– “মাম্মা তো তার মাম্মার কাছে এসেছে অনেকদিন পর। ওর একটু থাকতে ইচ্ছে করেনা বলো?”
– “নাহ! মাম্মাও যাবে।”
হাত পা ছুড়ে বলে প্রণয়। এনজাম তার গালে চুমু খেয়ে বলে,
– “তাহলে তুমি মাম্মার সাথে থাকো। আর কিছুদিন থেকে তারপর যেও।”
– “নাহ!”
আবারো এনজামের কাঁধে মাথা রেখে বলে প্রণয়। এনজাম তাকে শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরলো। ভেবে দেখলো, বাবার কাছে থাকলে সে মা’কে খোঁজে। আবার মায়ের সঙ্গে থাকলেও বাবার জন্য মন খারাপ করে।
তাদের দুজনের মধ্যকার দোষগুণ এই বাচ্চাটা বোঝেনা। তার কাছে তো দুজনই সমান। সে দুজনকেই চায়, একসঙ্গে চায়। অথচ এনজাম বলতে পারছেনা, ‘চলো, আজই বাসায় যাবো সবাই।’ তার আনন্দিত মনটাকে ছোট করে দিচ্ছে। এটা ঠিক হচ্ছেনা। একদমই ঠিক হচ্ছেনা।
কী প্রয়োজন তার রাগ ধরে রাখার? প্রজ্ঞা তো তারচেয়ে তিন চার বছরের ছোট, তার ই তো বউ। তার টুকটাক ভুলগুলো গোণায় না ধরলে এমন কিছুই হবেনা। অন্তত ছেলের জন্য এইটুকু করাই যায়। একটা সম্পর্কে শতবার মাথা নোয়ালেও কেউ ছোট হয়ে যায়না। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক এমন হয়ই না!
প্রণয়কে সামনে এনে জানতে চাইলো সে,
– “মাম্মা কোথায়?”
– “মাম্মা তো নেই।”
– “নেই মানে?”
– “মাম্মা তো বেরিয়েছে।”
– “কোথায় গেছে?”
– “জানিনা।”
নিজেকে যা যা বোঝালো,সবটা এক নিমেষেই বেরিয়ে যায় মাথা থেকে। প্রজ্ঞা চাইছে টা কী? সে আসবে বললো, আর অমনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো? এই সময়ে আর কীসের কাজ তার?
এভাবে, এমন অনিশ্চয়তার মাঝে একটা সম্পর্ক টিকে থাকতে পারে? নাহ, এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। নিজের বাচ্চার কথায় এভাবে চুপ করে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
।
প্রায় বিশমিনিট বাদে কোনো এক স্থানে এসে গাড়ি থামায় প্রজ্ঞা। হুট করেই মাথায় প্রশ্ন জাগে, সে এভাবে বেরিয়ে এলো কেন? অথচ তার বাড়িতে থাকা উচিৎ ছিলো। এনজামের সঙ্গে কথা বলার বিশেষ প্রয়োজন ছিলো। নিজের মাথায় নিজেই একটা চাটি মারলো সে। কী চলছে এই মাথায়? উচিৎ একটা,করছে আরেকটা। চোখ খিঁচে স্টেয়ারিং এ মাথা ঠেকিয়ে কিছুক্ষন বসে রইলো সে। পরমুহূর্তে গাড়ি ঘোরালো। বাড়ি যাওয়া উচিৎ। ভাগ্য ভালো থাকলে এনজামের সঙ্গে দেখা হয়েও যেতে পারে।
#চলবে?
#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_২৭
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন
রাস্তায় জ্যাম এর কারণে প্রজ্ঞার বাড়ি ফিরতে অনেকটাই দেরি হলো। নয়টার পরে গিয়ে তার দেখা পাওয়া যায়। তবে ভাগ্য ভালো থাকায় এনজাম তখনো ফিরে যায়নি। পাপিয়া আক্তার তাকে না খাইয়ে ছাড়বেন না। প্রজ্ঞা যখন এলো, এনজাম তখন প্রণয়কে নিয়ে টেবিলে খেতে বসেছে। ছেলেকে কোলে বসিয়ে খাইয়ে দিচ্ছে, সঙ্গে নিজেও অল্প কিছু খাচ্ছে।
এনজাম একবার চোখ তুলে তাকালো তার পানে, পরমুহূর্তেই খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। প্রজ্ঞা আর বিরক্ত করলোনা তাদের। নিজের ঘরে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিলো। সিদ্ধান্ত নিলো, এনজামের সঙ্গে সরাসরি কথা বলবে। প্রণয়ের জন্য হলেও, একটা বোঝাপড়ায় আসা প্রয়োজন।
প্রজ্ঞার ভাবনাকে সহজ করে এনজামই আগে চলে এলো ঘরে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে তাকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে প্রজ্ঞা। মুখটা মুছে এগিয়ে আসতে নিলেই এনজাম প্রশ্ন ছুড়লো,
– “কোথায় গিয়েছিলে?”
প্রজ্ঞা চোখ নামিয়ে নরম গলায় উত্তর দিলো,
– “কাজ ছিলো একটা।”
– “কীসের কাজ?”
দৃঢ় কণ্ঠে পুনরায় জানতে চায় এনজাম। প্রজ্ঞা এবারে চুপ করে থেকে পাশে বসলো তার। এনজাম একপেশে হেসে বলে,
– “মিথ্যে বলছো কেন? সোজাসুজি বলো, আমি আসবো বলে বেরিয়েছিলে।”
– “ভুল ভাবছো,তেমনটা নয়।”
এনজাম একটু তেঁতে উঠলো এবার,
– “তাহলে কোনটা? কথা প্যাঁচানোর স্বভাব যায়না তোমার?”
প্রজ্ঞার মাথা ঘুরছিলো। কর্কশ কন্ঠের কথাগুলো কানে লাগছিলো খুব। সে খানিকটা ঝুঁকে মাথা চেপে ধরে বলে,
– “ভালো লাগছেনা আমার। একটু শান্তভাবে কথা বলা যায়?”
– “তুমি! তুমি বলবে? হাহ… সিরিয়াসলি প্রজ্ঞা,আমি অবাক হচ্ছি তোমাকে দেখে। কোনো মা নিজের ছেলের দিকেও না তাকিয়ে থাকতে পারে?”
প্রজ্ঞা ভ্রু কুঁচকালো,
– “তাকাইনি মানে?”
– “ওহ রিয়েলি! তাকিয়েছো? তো ছেলেটা যে মন খারাপ করে আছে সেটা চোখে পড়লোনা?”
– “চোখে পড়েছে বলেই তোমাকে আসতে বলেছিলাম।”
এমজাম ফিরে তাকায় তার দিকে। একটু হেসে বলে,
– “ওর মন খারাপ যদি তোমার উপর বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতো তাহলে একেবারেই বলতে, এসে নিয়ে যাও আমাদের। কিংবা নিজেই চলে যেতে পারতে। কিন্তু না… তা করলে তোমার জাত যাবে তো!
আমার আরো এখন বিরক্ত লাগছে, হুদাই কথা খরচ করলাম সেদিন। আমার কোনো কথা তো তোমার মস্তিষ্ক অবধি পৌঁছায় ই নি।
ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে কতই না কষ্টে আছো আমার কাছে! তোমার দিকে তাকাই ই না, কোনো শখ-আহ্লাদ কিছুই বুঝিনা, কোনো প্রয়োজন ই মেটাই না!”
– “আমি সে কথা বলিনি।”
চোখ বুজে বললো প্রজ্ঞা। এনজাম বুকে হাত গুঁজে বলে,
– “তোমার কাজকর্মে আর কিছুতো প্রকাশ পাচ্ছেনা। কোনো কথাই বলবেনা,আমি ফোন করলে তা প্রণয় তুলবে প্রতিবার। আবার আমার সামনেও আসতে চাইছোনা… খুব ভালো।”
প্রজ্ঞা দরজার দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বললো,
– “আস্তে কথা বলো। আম্মু শুনে ফেলবে।”
এনজাম তাচ্ছিল্যের সুরে হাসলো তখন,
– “শুনুক না! শুনলে তো তোমার জন্য ভালোই, নিজ দায়িত্বে সরিয়ে আনবে তোমাকে।”
– “সে শুরু থেকেই চেষ্টা করেছে। আমি সরে আসিনি।”
– “অ্যান্ড নাও ইউ থিংক, দ্যাট ওয়াজ রং ফর ইউ?”
প্রজ্ঞা তার দিকে চেয়ে বললো,
– “সবকিছু যদি তুমি নিজে থেকেই বুঝে নাও তাহলে তো আর আমার কিছু বলার প্রয়োজন ই পড়েনা!”
– “এমনিতেও পড়ছেনা। তোমার কাজকর্মই সব বুঝিয়ে দিচ্ছে। নইলে কিছুটা হলেও মায়া মমতা তো অবশিষ্ট থাকতো। তোমার মধ্যে ঐ মা মা টাইপ বিষয়টাই নেই।”
প্রজ্ঞা বিস্মিত চোখে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
– “সবকিছু বলতে পারো আমাকে, শুনে নেবো। কিন্তু এই ধরণের কথা ভুলেও উচ্চারণ করবেনা। আটমাস ওকে পেটে আমি রেখেছি, আমার চেয়ে বেশি চিন্তা নিশ্চই তোমার থাকবেনা।”
– “জন্ম দিলেই ভালো মা হওয়া যায়? তার জন্য দায়িত্ববোধ,স্যাক্রিফাইস এর মনোভাব থাকতে হয়। আর তা তোমার মধ্যে নেই। বড় গলায় আবার কথা বলো কী করে?”
– “তুমি কিন্তু সীমা অতিক্রম করছো। যা নয় তাই বলছো!”
এনজাম বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো এবার। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো,
– “কদিন যাবৎ তোমার যা নাটক দেখছি, তারপর এখন তো খুব কমই বলছি। তুমি এর চেয়ে অনেক বেশি কিছু শোনা ডিজার্ভ করো।”
প্রজ্ঞাও উঠে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। কাটকাট গলায় বলে,
– “আজ তুমি অনেককিছু বললেও আমি চুপ করে থাকতাম,বিশ্বাস করো। কিন্তু প্রণয়কে মাঝে এনে ঠিক করলেনা। নাটক আমি করে থাকলে তো গতদিন তুমিও করছিলে। ভদ্র নরম ভাষায় অজুহাত দেখিয়ে দিলে না?”
– “অজুহাত?”
– “অবশ্যই। মাঝেসাঝে একটু ভালোমানুষি দেখিয়ে সেইফ জোন এ রাখো আরকি নিজেকে, যেন দিনশেষে সব দোষটুকু আমায় দেওয়া যায়। তা না হলে এই সামান্য বিষয়টা নিয়ে ওভাররিয়্যাক্ট করার কোনো মানেই ছিলোনা। যেখানে আমি ভদ্রভাবে কথা বলতে চেয়েছিলাম।”
এনজাম হাত উঁচিয়ে বাহবা জানায় তাকে,
– “বাহ! তোমার মাইন্ড এর তো জবাব ই নেই প্রজ্ঞা! কী সুন্দর ফন্দিটা ধরে ফেললে।
এত বেশি বোঝার কারণেই না আমরা আজকে এখানে দাঁড়িয়ে আছি। বাট ইট’স ইনাফ…”
প্রজ্ঞা সরু চোখে তাকাতেই সে সামান্য নিচু হয়ে বলে,
– “তোমার আমার মধ্যে ঐ বোঝাপড়া বিষয়টা আর হয়ে ওঠার নয়।”
শক্ত এক ঢোক গিলে বলে প্রজ্ঞা,
– “তাহলে?”
হুট করেই তখন ঘরে ঢুকলো প্রণয়। এনজামের পা জড়িয়ে ধরে বললো,
– “বাবা,কোলে নাও।”
এনজামের ভ্রুযুগল শিথিল হয়ে আসে। প্রজ্ঞার থেকে চোখ সরিয়ে কোলে তোলে ছেলেকে। মুখে এক মিছে হাসি টেনে বলে,
– “খাওয়া শেষ?”
– “হুম।”
এনজাম তার গালে দুটো চুমু খেয়ে বলে,
– “ভেরি গুড। এখন তো আমার যেতে হবে বাবা।”
প্রণয় ভ্রু কুঁচকে বললো,
– “কেন? তুমি যাবেনা,থাকবে। খাম্মি বলেছে তো!”
প্রজ্ঞার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে চেয়ে সে ক্ষীণ স্বরে বলে,
– “তোমার সাথে আমিই থাকবো।”
পরক্ষণেই মুচকি হেসে প্রণয়ের উদ্দেশ্যে বলে,
– “অনেক ইম্পর্টেন্ট কাজ আছে বাবা। আজ যেতে হবে। মন খারাপ করবেনা,ঠিক আছে?”
প্রণয় রাজি হয় বাবার কথায়। প্রীতি তখন কোক খেতে খেতে ঘরে ঢুকে বলে,
– “ওমা, এ কেমন কথা? এই রাত্তির বেলা বাসায় গিয়ে কোন ঘোড়ার ঘাসটা কাটবেন আপনি? ম্যালা দিন আড্ডা দেওয়া হয়না। থেকে যান আজকে। একেবারে বউ নিয়েই যাবেন, প্রচুর জ্বালাচ্ছে কদিন ধরে।”
এনজাম সহজ ভাষায় ‘না’ বলে প্রণয়কে নিয়েই নিচে চলে যায়। প্রীতি তখন ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে প্রজ্ঞার দিকে চেয়ে বলে,
– “ভাইয়াকে থাকতে বললিনা কেন তুই?”
প্রজ্ঞা ধপ করে বসে পড়ে বিছানায়। দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
– “যাক যেখানে খুশি, আমি বলতে যাবো কেন? ওকে ছাড়া কী থাকতে পারিনা আমি? ম’রে যাচ্ছি একদম?”
প্রীতি তেঁতে উঠে হাত উঁচু করে বলে,
– “কথাবার্তা ঠিক কর। কবে জানি তুই মা’র খেয়ে বসিস আমার হাতে।”
– “হ্যা তো আয়,মা’র। আমি না করেছি? খারাপ আমি, সবদিক থেকেই খারাপ। একজন বলে যায়…তুইও বল।”
– “বললে সেটা ঠিকই বলেছে।”
বড়বড় দম টেনে প্রজ্ঞা চোখ তুলে বললো,
– “ঠিক ই তো। আমার ক্ষেত্রে সবকিছুই ঠিক। বাকিদের কানা কড়িও দোষ নেই। যা খুশি,যখন খুশি তাই বলে যাবে, বিপরীতে দুটো মিষ্টি কথা বললেই সাত খু’ন মাফ।”
প্রীতি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রজ্ঞার সামনে এসে মাথায় হাত রাখলো তার। প্রজ্ঞা ছলছল চোখে তাকিয়ে শুধায়,
– “আজ একদিন না প্রীতি। দুটো বছরে যেসব কথা শুনিয়েছে তা আমার সহ্যের বাহিরে। যা আমি নিতে পারিনা, ও সেগুলোই করবে। হ্যা, মানতে পারিনা সবকিছু, ওর মতো খুব সহজেই সর্ট আউট করতে পারিনা সব, এটা আমার সমস্যা। আর যখনই একটু বোঝাই নিজেকে, একটু বোঝার চেষ্টা করি, তখনই ওর ব্যবহারে সবকিছু ভেঙে যায়। ও যদি বলতে পারে, আমি ওকে বুঝিনা। তাহলে তো আমিও বলতে পারি, ও আমাকে বোঝেনা। আমি কারো কটু কথা মেনে নিতে পারিনা, ও জানে খুব ভালো করেই। তারপরও কেন!”
প্রীতি মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় তার। কোকের বোতলটা পাশে রেখে বলে,
– “শান্ত হ আগে, রিল্যাক্স।”
– “না পারছিনা। কত বড় সাহস, ও আমার ছেলেকে নিয়ে প্রশ্ন তোলে! গিরগিটি একটা… সময়ে সময়ে শুধু গিরগিটির মতোই রঙ বদলায়।”
প্রীতি চোখ ছোট করে বলে,
– “সাফাই গাসনা। ও তো তবুও রঙ বদলায়, নিজে ঐটুকুও বদলাতে পারিস না।”
____
পরদিন ঠিক রাত আটটা বাজে শাফায়াতের চেম্বারে হাজির হলো তারা। এর আগে সময় হয়ে ওঠেনি। কলটা এনজামই করেছে, প্রজ্ঞাকে আসতে বলেছে। সে-ও টু শব্দটি না করে নির্দিধায় চলে এসেছে। বর্তমানে দুজনের মাথায় একপ্রকার আগুন জ্বলছে। কদিনের পাওয়া কষ্ট, অভিমানের উপরে জায়গা করে নিয়েছে এই বিশ্রি রাগ। শাফায়াত খানিকক্ষণ দুজনকে পরখ করে জানতে চায়,
– “হুট করে এত উতলা হয়ে উঠলেন কেন? থাকছিলেন তো বেশ।”
– “এটাকে থাকা বলেনা স্যার।”
উত্তর দিলো প্রজ্ঞা। এনজামও একই সঙ্গে বলে ওঠে,
– “যেমনভাবে থাকছি, এতে ওর ক্ষতি না হলেও আমার বাচ্চাটার ক্ষতি হচ্ছে।”
শাফায়াত ভ্রু কুঁচকে বলে,
– “তো এই তাড়াহুড়ো বাচ্চার জন্য?”
মাথা নাড়ে এনজাম। শাফায়াত অকস্মাৎ দাড়ি-মুখে হাত বোলানোর মাঝে হাসলো খানিকটা। প্রজ্ঞা তা দেখে বলে,
– “আপনি হাসছেন স্যার? ব্যাপারটা এত সোজা নয়। আমার ছেলে একটা আনহেলদি ফ্যামিলিতে বড় হবে এটা আমি কখনোই চাইবো না।”
– “আপনারা কী তাকে একটা সুস্থ জীবন দেওয়ার আশা করছেন?”
– “হ্যাঁ, তাই করছি। নাহলে আপনি ভেবে দেখুন স্যার, আমরা সবকিছু মেনে নিয়ে একসঙ্গে থাকতে শুরু করলাম। যেখানে আমাদের মধ্যে আন্ডার্সট্যান্ডিং নামক বিষয়টা একেবারে নেই বললেই চলে। দুদিন বাদে আবার সেই একইরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। যার প্রভাবটা গিয়ে পড়বে আমার ছেলের উপর। এর চেয়ে তো একেবারে আলাদা হয়ে যাওয়াটা ভালো।”
– “ভালো?”
এনজাম উত্তর দেয়,
– “চোখের সামনে এসব দেখার চেয়ে তো ভালো। কদিন বাদে নাহয় নিজের মা’কে দু চোখে দেখতে পারবে না ও।”
প্রজ্ঞাও সমান তালে বলে,
– “নিজে থেকেই এসে বলবে, বাবার সাথে থাকবেনা। যা ওর বাবার জন্যও অসম্মানের। এটা আমি চাইছিনা স্যার।”
শাফায়াত আবারো হাসে। আড়মোড়া ভেঙে সোজা হয়ে বসে বলে,
– “স্যার অ্যান্ড ম্যাম, আপনাদের ভাবনা দেখে আমার খুবই ভালো লাগছে, কারণ অবশেষে এতদিনে নিজেদের ছেলেটার দিকে চোখ পড়েছে আপনাদের। খুবই ভালো। জাস্ট এই ভাবের পরিণতি টা দেখে হাসি পাচ্ছে। এক্সট্রেমলি সরি ফর দ্যাট।”
– “মানে?”
– “ছেলেকে একটা সুস্থ পরিবেশে বড় করবেন তাই তো? যেখানে ও মা-বাবার ঝগড়া দেখবেনা, ব্রেইনে কোনোপ্রকার খারাপ ইফেক্ট পড়বেনা, এমন একটা জায়গা দেবেন থাকার তাইতো?”
– “জি।”
– “আপনাদের সে একসঙ্গে চাইলে?”
– “বোঝাবো তাকে। এখন ও ছোট, মেনে নেওয়াটা সহজ হবে। আরো পরে গিয়ে মেনে নেওয়াটা ওর জন্যই কঠিন হয়ে যাবে।”
– “স্যার, আপনি কি জানেন আমরা একটা সমাজে বসবাস করি?”
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলো এনজাম। শাফায়াত মৃদু হেসে বলে,
– “আমি কিন্তু একটা ডিভোর্সড কাপল এর ছেলে। জানলে খুশি হবেন, কমবেশি সাতবছর বয়সের পর থেকে মা-বাবাকে একসঙ্গে পাইনি।
তবে হ্যা, বিশাল সুস্থ পরিবার পেয়েছি।”
এনজাম,প্রজ্ঞা হতভম্ব হয়ে তাকায় তার পানে। শাফায়াত মাথা নুইয়ে বলে,
– “যেখানে বাবা আছে তো মা নেই, মা আছে তো বাবা নেই। বাবার কাছে থাকলে সে যথাসাধ্য যত্ন করেছে। জাস্ট সে বকলে মা এসে স্বান্ত্বনা দেবার সুযোগটা পায়নি। আর মায়ের কাছে থাকলে তো পারলে সে ঢুকিয়ে রাখে কলিজার ভিতর, কেবল সময়টা পায়নি। তার নতুন পরিবারে সবাই খুব ভালো চোখেই দেখেছে, শুধু একসঙ্গে খেতে বসলে একটু আকটু বিরক্ত হয়েছে। নতুন বাবাও ভালোই জানতো, শুধু সে ঘরে থাকলে আর মায়ের কাছে যাওয়ার সুযোগ টা হয়ে উঠতো না।
আব্বুর কাছে থাকলে চাচিরা এক বেলা খাইয়ে দিয়েছে আদর করেই, কেবল ঐ খেতে না চাইলে জোর করে খাওয়ায়নি আর।
খুব সুস্থ পরিবেশ, বেশ আনন্দময়। ঝগড়া নেই,কিচ্ছু নেই। মানসিক বিকাশ ঠিকঠাকভাবে হওয়ার জন্য একদম পারফেক্ট!”
একটু থামে শাফায়াত। তাদের দিকে না তাকিয়েই বলে আবারো,
– “চার দেওয়ালের মাঝে জীবন যতটা আনন্দময়, বাহিরে গেলে তো তারও দশগুণ সুখের, জাস্ট মাঝেসাঝে ছুটে ঘরে চলে আসতে মন চাইবে।
এ ধরণের বাচ্চাদের প্রতি কিন্তু সমাজের মানুষের ভীষন মায়া-মমতা! স্কুলে সব গার্জিয়ান থেকে শুরু করে টিচার রা পর্যন্ত মায়া দেখাবে। অবশ্য তাদের ও একটা লাভ হয়, অবসরে কথা বলার একটা উৎস পেয়ে যায়। সমাজের চিন্তা তো বাবা মায়ের চেয়েও বেশি! সামনে দেখলেই অধিকাংশের মুখে একটা হতাশার ভাব ফুটে উঠবে, আন্টিরা পেলেই মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দেবে। টিচার রাও ভালোই নজরে রাখবে। মজার বিষয় কী জানেন, পড়াশোনার চেয়েও বেশি আন্টিরা আমায় এই প্রসঙ্গে চিনতো। খুবই দুঃখ প্রকাশ করবে ‘আহারে’ বলে। তবে ঐ শব্দটা কানে খুব একটা শ্রুতিমধুর শোনায়না, এই যা… প্যারেন্টস মিটিং এ বাবা-মা কে একসঙ্গে পাওয়া যাবেনা। হাতেগোণা দু একবার পাওয়া গেলেও দুজন থাকবে দু-প্রান্তে। অর্থাৎ একসঙ্গে তাদের দুজনের হাতধরে হাঁটতে হাঁটতে বলা যায়না, এইযে আমার বাবা-মা।
তার চেয়েও তো সুন্দর হাই স্কুলের সময়টা। কেউ পরিবারের ব্যাপারে জানতে পারলেই হলো। শুরু তাদের হা-হুতাস। ইশ! এই ছেলে তো মানুষ হতে পারবেনা। আবার কিছু মানুষ আছেন, পরিবার দেখে বন্ধু বানাতে বলে। অর্থাৎ মা-বাবার একটা অতীত এর কারণে সবাই বন্ধু নাও হতে পারে। এটাও ভালো,ফ্রেন্ড সার্কেল সীমিত রাখতে হয়। পুরো স্কুললাইফ জুরে আন্টিদের গসিপিং এর একটা বিষয় হওয়া কিন্তু খুবই ভাগ্যের ব্যাপার!
ধরুন এইযে লোকে একটু অন্যভাবে তাকায়, এটাও একটা বড় বিষয়। শতবার শতজন জিজ্ঞেস করবে, থাকো কার কাছে? এর উত্তর দেওয়াও ভালো। কেবল একটু বিরক্তি এসে যায়,এই আরকি।”
প্রজ্ঞা মাথা নুইয়ে নেয়। শাফায়াত দম ছেড়ে তাকায় তাদের দিকে। একটু হেসে বলে,
– “আরেকটা মজার ঘটনা আছে। শুনবেন?
ভার্সিটি লাইফে একজন প্রেমিকা জুটেছিল। বেশ ভালো সম্পর্ক দুজনের। কয়েক বছর পর, আমিও ইস্টাবলিশড হলাম। ধীরে ধীরে গোটা কয়েক কেস হাতে পেতে শুরু করেছি। তারও বাড়ি থেকে বিয়ের কথা বলছে। তো যা সবাই করে,তাই করলাম। তার বাড়িতে গেলাম। আঙ্কেল আন্টি নাম,পড়াশোনা,কাজ সবকছুই জিজ্ঞেস করলো। কেমন ইনকাম করি তাও বললাম। ভাবসাব দেখে বোঝা গেল তাদের আমাকে পছন্দ হয়েছে।
এবার এলো আসল ঘটনা। জিজ্ঞেস করলো বাবা-মা কোথায় থাকেন। লুকোচুরি পছন্দ নয় আমার। সত্যটাই বলে দিলাম। এইযে এতক্ষণের ভালোলাগা, সবটা কেটে গিয়ে তাদের মুখ কালো হয়ে গেলো। ফিরে এলাম সেদিন। পরে জানলাম আমার সাথে তারা মেয়ের বিয়ে দেবেন না। কারণ কী? এইযে,আমার ফ্যামিলি। বাবা-মা খারাপ না হলে কী আর ডিভোর্স নিতো? নিশ্চই তারা খারাপ। যেহেতু আমার পরিবার ভালোনা, তাহলে আমি আর ভালো হবো কী করে? সূত্র অনুযায়ী আমিও খারাপ। সুন্দর যুক্তি না?”
শাফায়াত হেসে হেসে বলছিলো কথাগুলো। এবারে একটু জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে বলে,
– “জাস্ট এই একটাই প্রশ্ন থেকে যায় আমার, বাবা-মায়ের হিস্ট্রি কেন বাচ্চার লাইফে খাটাতে হবে? তারা কী করেছে না করেছে তার দায় সন্তান কেন নেবে? একই রক্ত বলে?”
দুজনের নিচু দৃষ্টি দেখে শাফায়াত হেসে উঠলো আবারো,
– “আরে আরে, আপনারা লজ্জা পাচ্ছেন নাকি? পাবেন না। আমিতো জাস্ট বললাম, সবার ক্ষেত্রে এমন না-ও হতে পারে। তবে… চার দেয়ালের মাঝের সুস্থতার বদলে জগৎটাই খানিকটা অসুস্থ মনে হয় মাঝেমধ্যে, এটা তো আর বড় বিষয় নয়।”
খানিকটা গম্ভীর হলো সে,
– “আসলে আপনাদের সমস্যা টা কী জানেন তো? ফুলের কাটা সরাতে গিয়ে ফুলটাকেই ছিড়ে সন্তানের হাতে ধরিয়ে দেন কেবল একটা ডাঁট। অথচ চাইলে ডাঁটটা ভেঙে ফেলে ফুলটা হাতে দিতে পারতেন।
ডিভোর্স শব্দটা মানুষের কাছে এত বেশি সাধারণ হয়ে গেছে যা দেখে মাঝেসাঝে অবাক হই আমি। কিছু একটা হলেই হলো…এই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা অসম্ভব। রাগের মাথায় মানুষ এমনভাবে ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেয় যেন এটা একটা সাধারণ বিষয়।
আপনাদের বলছিনা, এমনটা দেখে আসছি ক’বছর ধরে।
মানুষ আমার কাছে ডিভোর্সের সাজেশন চাইতেও আসে। এর বদলে যদি বিয়ের সাজেশন চাইতে আসতো তাহলে আমি একটা বুদ্ধি দিতাম, কয়েক বছর সংসার করুন আগে। যদি মনে হয়, নাহ,এই মানুষটার সঙ্গে সারাটা জীবন কাটানো সম্ভব, তাহলেই মাঝে নতুন সদস্য আনার কথা ভাবুন। শুধুশুধু একটা বাচ্চাকে এত সুখ দিয়ে আদেও কোনো লাভ আছে কী? এত সুখের ভার সইতে না পারায় অনেকে কিন্তু ভুল পথেও চলে যায়। একটা কথা আমি সবাইকে বলি, মোস্ট অফ দ্যা টাইম, ডিভোর্স ইজ বিকাম এ কার্জ টু এ চাইল্ড।”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে শাফায়াত। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বলে,
– “একসঙ্গে আমার কাছে এই বোধ হয় দ্বিতীয়বার এসেছেন তাইনা? অথচ আপনারা দুজনেই যে আলাদা আলাদাভাবে আরো এসেছেন, সেটা একজন অন্যজনকে জানান ই নি।”
প্রজ্ঞা,এনজাম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলো একে অপরের দিকে। শাফায়াত বলে,
– “যে কথাগুলো আমার সাথে বলেছেন, আলোচনা করেছেন, সেইটুকু নিজেদের মধ্যে করে নিলে হয়তো আপনাদের সিদ্ধান্ত বদলাতে পারতো।
এনিওয়ে, এসব বলে তো আর আমার কাজ নেই। বাচ্চাকে নিয়ে চিন্তা করেন, এটা দেখে ভালোলাগলো। অনেকে তো ভুলেই যায় মাঝে একজন সদস্য আছে। সেদিক থেকে আপনারা যথেষ্ট কেয়ারিং বাবা-মা, আই অ্যাপ্রেশিয়েট। তবে আপনাদের ডিভোর্সটা নব্বই দিন পরেই করাবো। বেশি তো আর সময় নেই। প্রায় দু-মাস কাটিয়েই ফেললেন। আরো একমাস কাটিয়ে দিন। ঠিক নব্বই দিনের দিন আসবেন। পেপার্স রেডি থাকবে, কোনো সমস্যা নেই।”
একটু থেমে বললো শাফায়াত,
– “আরো একটা কাজ করতে পারেন, ছেলেকে চাইলে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারেন। আফটার অল,একটা সময় সে-ও বুঝবে, তার জন্য তার বাবা-মা কত ভেবেছে! সঙ্গে তার ভবিষ্যৎ সুস্থ জীবনের জন্য একটা শুভকামনা জানিয়ে দেবো।”
দাঁত কামড়ে বসে ছিলো প্রজ্ঞা, নজর আবদ্ধ মেঝেতে। এনজামও নির্বাক রূপে বসেই রইলো। শাফায়াত দুজনকে দেখে বলে,
– “আপনারা এখন আসতে পারেন। আর তো কোনো প্রশ্ন রইলো না।”
তার কথা শেষ হবার পূর্বেই উঠে বেরিয়ে যায় প্রজ্ঞা। এনজাম সৌজন্যমূলকভাবে হাত মিলিয়ে ধীর পায়ে বের হলো। তারা চলে যেতেই দরজার আড়াল হতে ভিতরে এলো অ্যানি। শাফায়াতের সামনে এসে আহত স্বরে বললো,
– “এটা কী করলেন আপনি?”
– “কী করলাম?”
– “বোঝানোর বদলে ওদের পথ সহস করে দিলেন? ওরা যদি সত্যি সত্যি…. শাফায়াত সাহেব, দুজনের ফ্যামিলি কখনোই তাদের এই কাজে বাঁধা দেবেনা। কারণ দুই পরিবারের মধ্যে এখন অবধি বিন্দুমাত্র সখ্যতা নেই। আপনি এটা ঠিক করলেন না।”
শাফায়াত মৃদু হেসে বলে,
– “জোর করে কাউকে আটকে রাখা উচিৎ নয় ম্যাডাম। দোষগুণ এখানে ভ্যারি করছে না। মূলকথা এটাই, তারা যদি একসঙ্গে থাকতে না চায়, তাহলে আমি জোর করে এক করতে চাইবো কেন? কোনো কিছুই অতিরিক্ত ভালো নয়। আর আমার শেষ যতটুকু বলার ছিলো,তা বলেছি। তাদের জন্যও এটা শেষ সুযোগ,একটা মুখ্যম সুযোগ বলতে পারেন। এটাকে যদি কাজে লাগায় তো ভালো। তা না হলে… আলাদা হওয়াটাই বেটার বলে মনে করবো।”
অ্যানি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বসলো চেয়ারে। হুট করে চোখ তুলে বললো,
– “আপনি যা যা বললেন সবকিছু সত্যি? নাকি ওদের…”
– “মিথ্যে বলে আমার লাভ?”
– “না মানে ঐ সম্পর্কের ব্যাপারটাও…”
শাফায়াত হাসলো একটু। গালে হাত ঠেকিয়ে বলল,
– “কেন? বিশ্বাস হচ্ছেনা?”
– “উঁহু। আপনাকে তো খুব বুদ্ধিমান মানুষ বলে মনে হয়।”
হো হো করে হেসে উঠলো শাফায়াত। বললো,
– “তো? বুদ্ধিমান মানুষ কী প্রেম করতে পারেনা?”
অ্যানি থতমত খেয়ে বলে,
– “নাহ…সেটা নয়।”
শাফায়াত টেবিলে দুহাত রেখে বসলো। মুচকি হেসে বললো,
– “যখন একজন মানুষের পারিপার্শ্বিক কাউকেই আপন মনে হয়না, তখন সে খুব করে একজন আপন মানুষ চায়। যতই বুদ্ধিমান হোক না কেন, কারো সান্নিধ্যে সামান্যতম আত্মিক শান্তি পেলে সে ভুল পথেও পা রাখে। সেখানে প্রেম টাকে তো কেউ ভুল বলে গণ্য করেনা আজকাল।”
অ্যানি খুব ভাবুক স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
– “সে পরিবারের কথা মেনে নিয়েছিলো?”
– “হুম।”
– “কোনো চেষ্টাই করেনি?”
– “করেছিলো হয়তো। মানাতে পারেনি। আর আমিও জোর করিনি।”
অ্যানি চোখ নামিয়ে নিলো। নিজ হাতের দিকে দৃষ্টি রেখে বললো,
– “প্রেমের এই যে অপূর্ণতা, আবার পূর্ণতার পরও কারো মধ্যকার দ্বন্দ্ব, এসব দেখেই প্রেম জিনিসটার উপর থেকে মন উঠে গেছে একদম। ভয়ঙ্কর একটা বিষয়, ভয় হয় রীতিমতো।”
শাফায়াত কিঞ্চিৎ হেসে শুধায়,
– “এ জন্যই তো কবি বলেছিলেন,
প্রেম করছে যে জন জানে সে জন
পিরিতের কি বেদনা।
সখি তোরা প্রেম করিয়ো না
পিরিত ভালা না”
#চলবে?