#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_২৮
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন
গাড়িতে চুপ করে বসে থাকাটা প্রজ্ঞা,এনজামের জন্য এক দমবন্ধকর ব্যাপার। শুধু গাড়িতে নয়, যেকোনো স্থানেই। পৃথিবীর যত ধরণের ফালতু কথা আছে সব বলবে তারা। আর কিছু না পেলে পাশের বাসার আন্টি হয়ে যায় প্রজ্ঞা। কার বাসায় কী হয়েছে তাই নিয়ে আলোচনা শুরু করে দেয়। আর নাহলে ঘুমিয়েই পড়ে।
সে এখন জেগেই আছে। মাথা নিচু করে আঙুল বরাবর দৃষ্টি রেখেছে। এনজাম গাড়ি চালাচ্ছে কম গতিতে। এর অর্থ,সে কিছু বলতে চায়। প্রজ্ঞার নিকট হতে কোনোপ্রকার প্রতিক্রিয়া পেলেই মুখ খুলতো। কিন্তু সে কথা বললোনা। একবার ঘুরেও তাকালো না। এনজাম খেয়াল করলো, সে আজকাল খুব চুপচাপ হয়ে গেছে। আজ থেকে নয়, আরো কিছুদিন আগে থেকেই। তার এমন করা উচিৎ নয়। বাচাল প্রকৃতির মানুষকে নির্বাক রূপে মানায় না। অনেক মানুষ তাদের অতিরিক্ত কথায় বিরক্ত হয়। আবার যারা তাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন থাকে, তারা সেই কথার ই মায়ায় পড়ে যায়। একপ্রকার অভ্যাস তৈরি হয়। এনজামের প্রথম তাকে ভালোলেগেছিলো তার কথা শুনে। ঠোঁটদুটো স্থির থাকার সময় ই পায়না। একপর্যায়ে গিয়ে মনে হলো, মেয়েটির বকবকানি সে সারাজীবন শুনে যেতে চায়। এতে তার কান নষ্ট হলেও সমস্যা নেই।
চোখ বুজে ব্রেক কষলো সে। প্রজ্ঞা তবুও নিশ্চুপ, প্রতিক্রিয়াহীন। এনজাম একটু রাগী স্বরেই বললো,
– “এমন বোবার মতো বসে আছো যেন আমি তোমার ড্রাইভার?”
প্রজ্ঞা ফিরেও তাকায়না। এনজাম ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
– “অভিনয়শিল্পী হিসেবে কাজ করতে চাও? অডিশন দেবে? ইচ্ছে থাকলে বলো, খুব ভালো কাজ করতে পারবে।”
প্রজ্ঞা চোখের একটা পলক ফেলে শুধু। এনজাম গম্ভীর গলায় বলে তখন,
– “দেখো, সবকিছুর উপরে গিয়ে আমি একটা কথা বলবো, কেবল প্রণয়ের কারণে যদি সংসার করতে চাও তাহলে সেই চিন্তা ঝেড়ে ফেলো মাথা থেকে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছুই হয়না।”
কয়েক সেকেন্ড থেমে বললো সে,
– “ভালোবাসতে ভুলে গেলে তা ফিরিয়ে আনা এতো সহজ নয়।”
প্রজ্ঞার চোখের পাতা কেঁপে উঠলো। এনজাম আরো বলে,
– “হয়তো আমাদের মাঝের ভালোবাসাও…”
– “প্লিজ! স্টপ ইট… আর না।”
চোখ খিঁচে বললো প্রজ্ঞা। পরক্ষণেই হু হু করে কেঁদে উঠলো। এতই আকস্মিকতার সঙ্গে যে এনজাম থতমত খেয়ে যায়। প্রজ্ঞা দুহাতে মুখ লুকিয়ে বলে,
– “একটু থামো, দোহাই লাগে। এটা বোলোনা অ্যাটলিস্ট।”
হাতটা সরিয়ে সে তাকালো এনজামের দিকে,
– “ভালোবাসা এত সহজ না। আমার ভালোবাসা মিথ্যে না এনজাম! আমি ভুলে যাইনা কিছু। কখনো ভোলার কথা ভাবতেও পারিনা। তাও কেন বলছো? আমি..আমি এগুলো সহ্য করতে পারিনা, ডোন্ট ইউ নো দ্যাট?”
ঠোঁটদুটো থরথর করে কাঁপছিলো তার। কথা আটকে আসছিলো বারবার। এনজাম হাতটা ধরতে নিলেই সে নিজে থেকে খামচে ধরে সেই হাত। চোখের দিকে চেয়ে উদভ্রান্তের ন্যায় বলে ওঠে,
– “বিয়ে হলেই ভালোবাসা কমে যায়, এটা একটা ভুল কথা না বলো? একদম মিথ্যে কথা। সবকিছু বদলাতে পারে কিন্তু ভালোবাসা বদলায় না। আমি মানি না সেটা। তাহলে তুমি কী করে বলছো? এই তুমিই না বলতে যতদিন বেঁচে আছো শুধু আমাকেই ভালোবাসবে। তবুও কেন! বলতে তো, তুমি হাজারটা ভুল করলেও বকবোনা কখনো। তাও কেন বকো?
এনজাম… আই ফিল সো হেল্পলেস, ডোন্ট ডু দ্যাট প্লিজ! আই রিকুয়েস্ট ইউ।”
পাথরের মতো তার দিকে তাকিয়ে রইলো এনজাম। এমন অনুরোধ সে আজ অবধি কখনো করেনি, একবারও না। মনে হলো তার গলাটা কেউ চেপে ধরে আছে, নিঃশ্বাস ফেলা দায়। প্রজ্ঞা নিজেকে সামলে উঠতে ব্যার্থ হলো। কাপাকাপা গলায় বললো,
– “আমি তো খারাপ মা নই। ওকে পেটে ধরেছি তো, জন্ম দিয়েছি। ওর জন্য কত কিছু করেছি! আমি তো ওর খারাপ চাইনি। ওকে কষ্ট দিতে চাইনি। কেন চাইবো বলো? ওর চোখে একফোঁটা জল দেখলেও আমার বুকটা ছিঁড়ে যায়।
আর আমি তোমাকে বুঝতে চাইনা? কী করে বলতে পারো এটা? তোমাকে বুঝতে চেয়েছি বলেই তো এই হাতটা ধরেছিলাম। তুমি সব কী করে ভুলে যেতে পারো? আমিতো একটা সুন্দর সংসার চেয়েছি। এমন কিছু তো চাইনি! আমি কেন চাইবো? তুমি কেন বুঝতে পারছোনা…আমি…”
শক্ত এক ঢোক গিললো প্রজ্ঞা। এনজামের তাকে দেখে স্বাভাবিক মনে হলোনা। সে দ্রুতবেগে দু’হাতে তুলে ধরে তার মুখখানা। বারকয়েক গাল চাপড়ে বলে,
– “প্রজ্ঞা? কিচ্ছু হয়নি। তাকাও,লুক অ্যাট মি। আছি আমি, এখানেই আছি। ডোন্ট প্যানিক… বুঝতে পারছি আমি। টেইক আ ডিপ ব্রিথ।”
প্রজ্ঞা তার মাথাটা রাখলো এনজামের কাধের পাশে। লম্বা দম টানলো কয়েকবার, চোখদুটো খুলে রেখেছে পিটপিট করে। এনজাম সামনে রাখা পানির বোতলটা এনে তার মুখের সামনে ধরে বললো,
– “মুখ খোলো। শান্ত হও, শুনছি তো আমি। সব কথা শুনছি। এত উত্তেজিত হলে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে তো।”
তার কথা শুনে আবারো কেঁদে উঠলো প্রজ্ঞা। মাথাটা তুলে বললো,
– “বিশ্বাস করো, আমি ভাবি তোমাকে নিয়ে, প্রণয়কে নিয়ে। ওর দিকে তাকাই না আমি, এটা কী করে বলতে পারো? তোমায় বোঝার একটুও চেষ্টা করিনা,এটা কেন বলো? আমিতো এমন নই, তুমি ভুল বুঝো আমাকে।”
বুকের উপর হাত রেখে বলে সে,
– “ইট হার্টস মি হিয়ার… কষ্ট হয় আমার! তোমার বলা একটা খারাপ কথাও আমি নিতে পারিনা। কী করবো? আমার সেই ধৈর্য নেই। অন্তত তোমার ক্ষেত্রে নেই। তোমার বেলায় আমি আহ্লাদীই হয়ে যাই এনজাম। শুধু আদর পেতে চাই,ভালোবাসাই পেতে চাই। তুমি কিছু বললে আমি ঠিক থাকতে পারিনা, এটা আমার দোষ। কিন্তু পারিনা… চাইলেও না। আমি কী করবো!”
অস্থির হয়ে ওঠে প্রজ্ঞা। এনজাম তার গালদুটো শক্তভাবে চেপে ধরে বলে,
– “বুঝতে পেরেছি তো, আর বলতে হবেনা। তোমার কিচ্ছু করতে হবেনা, জাস্ট একটু শান্ত হও। আমি বকবোনা তোমাকে, কক্ষনো বকবোনা প্রমিস।”
প্রজ্ঞা দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলে,
– “নাহ, কেন বকবেনা? আমি কীসব বোকার মতো কাজ করি! জানো, আমি এ কদিনে কতবার ভেবেছি একটা কল করবো, ঝগড়া করবো। কিন্তু করতে পারিনি। বিশ্বাস করো, আমি কালকেও ওভাবে চলে যেতে চাইনি। আমিতো কথাই বলতে চেয়েছিলাম। ফিরে আসার পরও তোমার কাছে সরিই বলতে চেয়েছিলাম। তোমার সঙ্গে ফিরে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তখনই তুমি কিসব কথা বললে! কেন বললে? একটু কেন বুঝলেনা আমাকে?
তুমি যাওয়ার পর আম্মু এসে আমায় কতগুলো কথা শোনালো। কত খোঁটা দিলো। ভালোবাসা এভাবেই কমে যায় বললো। আমার কানটা জ্বলে যাচ্ছিলো, এতসব নিতে পারছিলাম না। তাও বড় গলায় বলেছি, তোমার ভালোবাসা এ জীবনে কখনো কমবেনা। একটু ঝগড়া হতে পারে, ভুল হতে পারে। কিন্তু ভালোবাসায় এর কোনো প্রভাব পড়েনা। আর তুমি এখন কী বললে? ভালোবাসতে ভুল গেলে কী যেন? না… ইউ লাভ মি অ্যান্ড আই লাভ ইউ, এটা মিথ্যে না এনজাম! এসব ভাবলেও আমার দম আটকে আসে। বলবেনা কখনো, ভুলেও না প্লিজ!”
দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছিলো প্রজ্ঞা। এনজাম তার চোখটা মুছিয়ে দিয়ে আহত স্বরে বললো,
– “আমায় কী পাগল মনে হয়? ও কথা স্বপ্নেও ভাববো আমি? যাকে ভালোবাসার জন্য এত ত্যাগ স্বিকার করেছি, তাকে ভালোবাসতে ভুলে যাবো?
আমি… আমি বুঝতে পারিনি সোনা। ভেবেছিলাম তুমি এসব কানেই তোলোনা। এতটা কষ্ট পাবে জানলে আমি কখনো বলতাম না বিশ্বাস করো। তোমাকে কষ্ট দিতে ভালোলাগে আমার? এইযে কাঁদছো, ইচ্ছে করছে নিজের মাথা টাকাই দেওয়ালে গিয়ে। প্রজ্ঞা, কেন বোঝোনা? কষ্টটা তুমি পেলেও ওটার আঁচ এসে আমার মনেই লাগে। সেদিন তোমাকে ঐ কথাগুলো বলার পর থেকে দুটো ঘণ্টা টানা শান্তিতে ঘুমোতে পেরেছি বলে মনে পড়েনা। তুমি কাল ফোন না করলেও আমি থাকতে না পেরে ছুটে যেতাম। আর তোমাকে না নিয়ে তো ফিরতাম ই না। কিন্তু বাড়িতে গিয়ে দেখলাম প্রণয় ওভাবে বাসায় ফেরার আবদার করছে, তুমি বাড়িতে নেই। তাই ওভাবে… ভুল হয়ে গেছে,আর হবেনা এমন। কান্না থামাও, শান্ত হও।”
প্রজ্ঞা ঠোঁট উল্টে একহাত রাখলো তার গালে। দুবার ফুঁপিয়ে উঠে বললো,
– “থামছেনা তো। আমার কষ্ট হচ্ছে। তুমি না… বুঝিয়ে বলবে আমাকে। আমি এরপর থেকে বুঝবো কিছু বললে, সত্যি। একদম ঝগড়া করবোনা। একেবারে শান্ত হয়ে যাবো।”
এনজাম কপালে কপাল ঠেকায় তার। নিচুস্বরে বলে,
– “তোমার আর কিছু করতে হবেনা। শুধু আমাকে একটু সামলাবে,কোনো ভুল চিন্তা মাথায় আসতেই দেবেনা। ভুল করে কিছু বললেও এভাবে চুপ করে না থেকে মুখের উপর বলবে সব। না বললে সবকিছু বোঝা যায়না রে! যেমন তুমি ভুল বুঝে ফেলো, আমিও ভুল বুঝে ফেলি।”
– “কিন্তু আমি ঠিকটাই বুঝতে চাই!”
– “আমিও চাই। এসব ভালো লাগেনা আমার। কখনো চাইনি এমন কিছু। শুধুমাত্র তুমি কষ্ট পাবে বলে এ জীবনে কম কথা লুকিয়ে রাখিনি আমি।”
প্রজ্ঞা তার চোখের দিকে চেয়ে বললো,
– “আমি লুকোইনি? শুধু চেষ্টা করে গেছি, আমার কারণে যেন তোমার খারাপ না লাগে। তুমি তারপরও বকো আমায়। শুধু ভুলই খুঁজে বেড়াও।”
পুনরায় কেঁদে উঠলো প্রজ্ঞা। এনজামের হাতে নখ বসিয়ে বললো,
– “বাসায় যাবো আমি। এখনি, প্রণয়কে নিয়ে সোজা মোহাম্মদপুর। মিরপুরের হাওয়া বাতাস সহ্য হচ্ছেনা আর।”
এনজাম তার ঘাড়ের পিছনে হাত রেখে বুঝিয়ে বললো,
– “তিনদিন পরেই তো চলে যাচ্ছি আমি। এখন আর গিয়ে কী করবে? ফিরে আসি আগে, তারপর একেবারে নিয়ে যাবো।”
প্রজ্ঞা ভ্রু কুঁচকালো। ক্ষুব্ধ স্বরে বললো,
– “একা থেকে খুব মজা পেয়ে গেছো তাইনা? এখন আমাকে নিয়ে যেতেও সমস্যা, বউয়ের কোনো দরকার ই নেই!”
গাল ফুলিয়ে সোজা হয়ে বসলো সে। কান্নার ফলে ফুলে যাওয়া চোখমুখ, সঙ্গে অভিমানী মুখখানা কী যে মিষ্টি লাগছিলো! এনজাম এগিয়ে এলো তার মুখের কাছে। বেশ জোরে গাল টেনে দিয়ে বললো,
– “যেহেতু আমরা গাড়িতে আছি, ডোন্ট গিভ দিস টু মাচ কিউট লুক প্লিজ!”
‘আউচ’ বলে গালে হাত ঘষলো প্রজ্ঞা। আঙুল উঁচিয়ে বললো,
– “ডোন্ট ওয়ান্ট টু বি টু মাচ রোম্যান্টিক, বিকজ ইউ আর নট।”
এনজাম নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকায় তার পানে। অমনি হতাশ হয় প্রজ্ঞা। এগিয়ে এসে তার গাল ছুঁয়ে তড়িঘড়ি করে বলে,
– “না না না। সরি সরি… ভুলে বলে ফেলেছি। তুমি…তুমি হচ্ছো…মানে তুমি…”
কথা গুলিয়ে ফেললো প্রজ্ঞা। এনজাম ভ্রু কুঁচকে শুধায়,
– “আমি কী?”
– “তুমি…তুমি তুমি…উফফ, পারবোনা আমি এসব। আমার দ্বারা তেল মাজা হয়না অতো।”
সরে এসে বললো প্রজ্ঞা। পরমুহূর্তে পাশ ফিরে বলে,
– “আচ্ছা তুমি একটা কাজ করবে। ভালো বউ হওয়ার কোনো কোর্স থাকলে সেটাতে ভর্তি করিয়ে দেবে আমাকে। সেই কোর্স করে একদম বউ নাম্বার ওয়ান হয়ে দেখাবো।”
এনজাম কিছুক্ষন ঠোঁট চেপে থেকেই ফিঁক করে হেসে ফেললো। প্রজ্ঞা তা দেখে অকস্মাৎ গালে একটা আলতো চ’ড় মেরে বললো,
– “ভ্যাটকাস কেন তুই? সমস্যা কী?”
আবারো জিভ কামড়ালো প্রজ্ঞা। সেই গালেই আদর করে বললো,
– “সরি সরি…আর মা’রবোনা।”
নিজের গালে থাকা প্রজ্ঞার হাতের উপর হাত ছোঁয়ালো এনজাম। মুচকি হেসে বললো,
– “একটা জিনিস আছে তোমার জন্য।”
প্রজ্ঞা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইতেই গাড়ির সামনে থেকে একটা নেতিয়ে যাওয়া ফুল বের করলো এনজাম। প্রায় শুকিয়েই গেছে,পাপড়ি ঝড়ে পড়েছে অনেকটাই। এনজাম সেটা হাতে তুলে কোনোভাবে কানের পাশে গুঁজে দেয় তার। প্রজ্ঞা ভ্রু কুঁচকে বলে,
– “তাজা ফুল দেওয়া যায়না?”
এনজাম তার কানেকানে ফিসফিসিয়ে বললো,
– “তাজা ফুলের সৌন্দর্য তোমার চেয়ে বেশি হয়ে গেলে সমস্যা না?”
হেসে ফেললো প্রজ্ঞা। একটু অভিমানী সুরে বললো,
– “গতবছর ফুল দাওনি।”
– “আর তুমিতো তারিখটাই মনে রাখোনি। পরেরদিন নিউজফিড দেখে মনে পড়েছে।”
– “তো রাতে মনে করিয়ে দিলে কী জাত যেত?”
– “ফুল আনার কথা মুখে বললেও কী জাত যেত?”
দুজনেই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলো। ধীরেধীরে তা শিথিল হয়ে আসে। একটু ভেবে একসঙ্গেই বলে ওঠে,
– “আচ্ছা পরেরবার থেকে বলবো।”
পুনরায় হেসে ফেললো তারা। প্রজ্ঞার বামগালে হাত রেখে অপর গালে নিজের দাড়িযুক্ত গাল ঘষলো এনজাম। মৃদুস্বরে বললো,
– “চিরন্তন সত্য মানে কী বলতো?”
– “কী?”
দূরত্ব মিটিয়ে তার কাঁপতে থাকা ঠোঁটের কিনারে ঠোঁট ছোঁয়ালো এনজাম। একই সঙ্গে বললো,
– “আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
অমনি নিচের ঠোঁট ভেঙে এলো প্রজ্ঞার। এনজাম ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইতেই আহ্লাদী স্বরে বললো,
– “কতদিন পর!”
– “কোনটা?”
পুরুষটির প্রশস্ত বুকে মাথা রাখে প্রজ্ঞা। দুহাতে জাপটে ধরে চোখ বুজে বলে,
– “দুটোই।”
#চলবে?
#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_২৯
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন
প্রীতি সেই সন্ধ্যা থেকে সোফায় বসে বসে নাটক দেখছে। উঁহু, এই নাটক টিভিতে কিংবা মোবাইলে দেখার প্রয়োজন পড়েনা। নাটকের লাইভ টেলিকাস্ট চলছে তার চোখের সামনে।
পাপিয়া আক্তারকে বুঝিয়ে শুনিয়ে প্রজ্ঞা এক নতুন মিষ্টি বানাতে রান্নাঘরে ঢুকেছে। গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে চিনির বদলে লবণ দিতে নিয়েছিলো, শেষ মুহূর্তে গিয়ে খেয়াল এসেছে বলে রক্ষা। প্রণয় পাশে বসে মায়ের কাজ দেখছে। প্রীতি গালে হাত ঠেকিয়ে ভাবে, এই ছেলের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। রান্নাবান্না তার এতটা প্রিয় থাকলে ভবিষ্যৎ এ শেফ হয়ে যাওয়ার বিস্তর সম্ভাবনা রয়েছে। বউকে রেঁধে খাওয়াবে, ঘরের কাজও করতে পারবে।
ভাগ্নের এই সুখের সংসার দেখে সে পায়ের উপর পা তুলে পান চিবোতে চিবোতে এনজামের উদ্দেশ্যে বলবে, “দেখেন দেখেন, সংসার সুখের হয় পুরুষের গুণে!”
একা একাই হেসে উঠলো সে। পাপিয়া আক্তার অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চলে গেলেন নিজের ঘরে। প্রজ্ঞার মিষ্টি বানানো শেষ,এখন ঠান্ডা হওয়ার অপেক্ষা। প্রণয়কে নিয়ে সে-ও গেল ঘরের দিকে। প্রীতি একাই ড্রইং রুমে পপকর্ন নিয়ে বসে রইলো, ফোন স্ক্রোল করে রিলস দেখছে সঙ্গে। হুট করে হোয়াটস অ্যাপ এ একটা মেসেজ এলো তার। শাফায়াত চোখে চশমা পরা ইমোজি দিয়ে লিখেছে,
– “ইহজগতে কি আপনার উপস্থিতি রয়েছে?”
বেশ ভালো মেজাজেই ছিলো প্রীতি। শাফায়াতের সঙ্গে কদিনে আর যোগাযোগ করা হয়নি। তাদের মধ্যে খুব বেশি কথা হয়, তেমনটাও নয়। তবে মাঝেমধ্যে হাসি তামাসা করেই থাকে। মেসেজের উত্তর না পেয়ে কলই করে বসলো শাফায়াত। অস্বস্তি কাটিয়ে তা রিসিভ করলো প্রীতি। হাসিখুশি থেকেই বললো,
– “কী অবস্থা ভাইসাব?”
– “এটাতো তোমাকে জিজ্ঞেস করা উচিৎ। থাকো কোন দুনিয়ায়? খুঁজেই পাওয়া যায়না।”
– “ওমা, খুঁজছিলেন নাকি? ফিলস লাইক সেলিব্রিটি!”
শাফায়াত হাসলো তার কথা শুনে। পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
– “হয়েছে কী? অসুস্থ? নাকি দাওয়াত দেওয়ার প্লানিং চলছে?”
– “আহহা… ধরে ফেললেন? ভাবলাম একেবারে সামনে গিয়ে বলবো, মিট মাই বিলাভড হাব্বি, মিস্টার ড্যাশ ড্যাশ”
– “ড্যাশ ড্যাশ?”
– “ঐতো,নামটা বসিয়ে দিতাম।”
শাফায়াত জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বললো,
– “আসলেই?”
হো হো করে হেসে উঠলো প্রীতি,
– “শুনেন ভাই, আম্মু আমারে কাল রাতে ডেকে জিজ্ঞেস করে, ‘বড় হয়েছো যেহেতু,বিয়ে দেওয়ার একটা দায়িত্ব আছে আমার। একজন তো দায়িত্ব পূরণের সুযোগ ই দেয়নি। সেই পরিকল্পনা থাকলে আগে থেকেই বলে দাও। তোমাদের উপর আর ভরসা নেই আমার।’ ভাবতে পারেন,উনি এতদিন পরে এসেছে জিজ্ঞেস করতে! আমি যে আরো পাঁচ ছয় বছর আগে থেকে পাত্রপক্ষের সামনে যাওয়ার জন্য এক্সাইটেড হয়ে বসে আছি, এইটা বলি কেমনে? তার উপর লজ্জার ল ও আসেনা ভিতরে। কী এক জ্বালা!”
– “বিয়েশাদির প্ল্যান থাকলে বলতে পারো। এক কলেজ ফ্রেন্ড আছে আমার। বিজয় নাম, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। দেখতে শুনতেও ভালো।”
– “হাহ… এই নামের ছেলে চলবেনা।”
– “কেন?”
– “আপনার কী মনে হয়, পিঁপড়ার মতো ছোট থেকে হাতির মতো বড় দ্বন্দ্বেও আমি জামাইকে জিততে দেবো কখনো? এইজন্য চলবেনা। তার উপর আপনার ক্লাসমেট মানে বয়স হবে উনত্রিশ কী ত্রিশ, এত কম ডিফারেন্স! আমার তো ইচ্ছে ছিলো অন্তত এক যুগের বড় কাউকে বিয়ে করার। তারপর ফেইসবুকে পোস্ট দিতাম, ‘এইজ ডাজ’ন্ট ম্যাটার’। কিন্তু নিজেই যখন আধবুড়ো হয়ে বিয়ে করছি, সেখানে একযুগের বড় খুঁজতে গেলে ভুঁড়িওয়ালা সুগার ড্যাডি ব্যতীত কিছু পাওয়ার চান্স নেই। তাই অ্যাটলিস্ট থার্টি টু অর থ্রি হওয়া চাই।”
মাথায় হাত চলে যায় শাফায়াতের। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
– “ম্যাগনিফাইং গ্লাস নিয়ে ছেলে খুঁজতে হবে তোমার জন্য।”
– – –
কম্বলের নিচে পা ঠুকিয়ে হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসেছে দুই মা-ছেলে। প্রণয় দেখছে তার অতি প্রিয় গোপাল ভাঁড়। প্রজ্ঞার একহাতে ফোন, কানে ধরে কথা বলছে এনজামের সঙ্গে। অন্য হাতটা প্রণয়ের মাথার উপর। আঙুলে চুল প্যাঁচাচ্ছে একটু একটু করে। এনজাম কানের ব্লুটুথ হেডফোনটা একটু ঠিকঠাক করে বললো,
– “এখন তুমি ঠিকই শিফট বদলে নিতে পারছো। আমি বললে তখনই যত অজুহাত!”
– “উঁহু, এবার শিফট আর বদলাবো না ভাবছি।”
এনজাম মিটিমিটি হেসে বলে,
– “আচ্ছা? ওয়ানা স্পেন্ড মোর কোয়ালিটি টাইম উইথ মি?”
প্রজ্ঞা ভেঙচি কেটে বললো,
– “হাহ… সরো তো!”
– “আহ মাম্মা…আমার চুল!”
প্রণয়ের কণ্ঠ শুনে পাশে তাকালো প্রজ্ঞা। চুল থেকে হাতটা সরিয়ে নিলো সঙ্গেসঙ্গে। জিভ কামড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
– “সরি বাবা, খেয়াল করিনি।”
এনজাম অপর প্রান্ত থেকে ভ্রু কুঁচকে শুধায়,
– “এই এই…কী করেছো তুমি?”
প্রজ্ঞা প্রণয়ের চুলের দিকে নজর রেখেই রাগী স্বরে বললো,
– “তুমি এত ব্যস্ত যে ছেলের চুল কাটানোর সময়ও পাওনি? এত বড় হয়ে গেছে চুল!”
এনজাম সাফাই গেয়ে বললো,
– “আমি ব্যস্ত না, ও-ই ব্যস্ত। গতবার সেলুনে নিয়ে গিয়েছিলাম, চুল কাটানোর বদলে তিন ঘণ্টা ধরে আয়নায় নিজের হেয়ারস্টাইল দেখছিল!”
প্রজ্ঞা অবাক কণ্ঠে শুধায়,
– “তিন ঘণ্টা? ও ছোট মানুষ, তুমি কী করছিলে তখন?”
– “আমি? বসে বসে ভাবছিলাম, এর চেয়ে একটা সিনেমা দেখে নিলেই ভালো হতো!”
– “ইশ! একটা কাজও ঠিক করে করতে পারেনা। ছোট একটা বাচ্চা, তার চুল কাটাতে আবার কীসের সমস্যা?”
– “নেক্সট টাইম তুমিই যেও। তারপর এসে বলবে, ‘মাফ চাই,দোয়াও চাই’।
আচ্ছা, রাখো ফোন। বাসায় গিয়ে ব্যাক করবো।”
কলটা কেটে দেয় এনজাম। প্রজ্ঞা আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে উঠতে গেলেই কোমড়ে চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হলো। ঠোঁট কামড়ে একহাতে কোমড় চেপে ধরে পুনরায় বসে পড়লো সে। প্রণয়ের জন্মের পর থেকে তার এই কোমড়ে ব্যাথার সমস্যা। বেশ তো ঠিকই ছিলো কয়েক মাস যাবৎ। আবার সেই আগের মতো… এই ব্যাথা যার হয় সে ব্যতীত অন্য কেউ বোধহয় ধারণাও করতে পারবেনা।
প্রণয় মা-কে বসে পড়তে দেখেই রিমোটটা ফেলে কাছে গেলো তার। হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো,
– “কী হয়েছে মাম্মা? তোমার কষ্ট হচ্ছে?”
মৃদু হেসে মাথা উপরনিচ করলো প্রজ্ঞা। প্রণয়ের মুখে হাত বুলিয়ে বললো,
– “একটু।”
– “আচ্ছা, তুমি শুয়ে থাকো।”
– “কেন?”
– “শোও না!”
একপ্রকার টেনে ধরেই তাকে বিছানায় শোয়ালো প্রণয়। একটু কাত হয়ে শুতে বলে তার ছোটছোট হাতের দ্বারা কোমড়ের দিকটাতে ধীরেধীরে মাসাজ করে দিলো। বাবাকে কয়েকবার এমন করতে দেখেছে, খাম্মিকেও দেখেছে। সে জানে, মায়ের কষ্ট হয়। আর এভাবে মাসাজ করে দিলে মায়ের ভালো লাগে।
প্রজ্ঞা ঘাড় ঘুরিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকায় বাচ্চাটার দিকে। হৃদয়ে এক শীতল বাতাস বয়ে যায় তার। শাফায়াতের কথাগুলো মনে পড়তেই চোখদুটো ভিজে ওঠে। অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে তার স্থানে নিজের ছেলেকে কল্পনা করলে। অসম্ভব… এমনটা কখনোই হতে দেবেনা তারা। ভুলবশত ও না।
– “ব্যাথা কমেছে মাম্মা?”
প্রজ্ঞা একহাত রাখলো তার গালে। মৃদুস্বরে বললো,
– “হুম… একদম ঠিক হয়ে গেছে সোনা।”
— — —
আনুমানিক রাত এগারোটা বেজেছে তখন। পাপিয়া আক্তার স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ। তার বাড়িতে দশটার মধ্যে খেয়ে দেয়ে ডাইনিং টেবিল গোছানো ও সম্পন্ন হয়ে যায়। দেরিতে ঘুমালেও খাওয়াটা তাড়াতাড়িই শেষ করেন তিনি।
প্রীতি ঘরে থাকা সিঙ্গেল সোফায় বসে কিছু একটা পড়ছে, প্রজ্ঞা তখনো শুয়ে আছে বিছানায়। প্রণয় শুয়েছে নানুর সঙ্গে। প্রজ্ঞার ঘুমও পেয়েছিলো খুব, তবে চোখ খুলে রেখেছে এনজামের ফোনের অপেক্ষায়। সে বাসায় গিয়ে কল করবে বলেও এখন অবধি করেনি। ভালো হলোনা আর! প্রজ্ঞা ভাবলো, আর পাঁচমিনিট অপেক্ষা করে তারপর নিজে থেকেই কল করবে। কিন্তু তার আর প্রয়োজন পড়লোনা। এনজামই কল করলো তাকে। এক লাফে উঠে বসে সে রিসিভ করলো কলটা। প্রীতি ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার পানে। এমন একটা ভাব করছে যেন নয়া নয়া প্রেম শুরু করেছে। এই প্রেম যে দুদিন ও টিকবে না তা তো জানাই আছে।
প্রজ্ঞা কিছু বলার পূর্বেই এনজাম বলে উঠলো,
– “নিচে আসো তো।”
– “কেন?”
বিস্মিত কণ্ঠে বলে প্রজ্ঞা। এনজাম বিরক্তিসূচক ‘চ’ উচ্চারণ করে বলে,
– “মঙ্গল গ্রহে যেতে। বলদি একটা… দশমিনিট এর মধ্যে নিচে আসবে।”
কানে হর্নের আওয়াজ আসতেই চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যায় প্রজ্ঞার। হা করে বলে,
– “তুমি কী বাইকে?”
উত্তর দিলোনা সে। প্রজ্ঞা খানিকটা রেগে বলে,
– “বাইকে বসে কল দিয়েছো কোন দুঃখে? অ্যাক্সিডেন্ট করে হাত-পা ভাঙলে আমি সেবা করতে পারবোনা।
আর এখন নিচে নামবো মানে? আম্মু দেখে ফেললে কী বলবো?”
– “যা বলার বলবে। বর ডেকেছে তাই যাচ্ছো,শেষ।”
টুট টুট করে কেটে গেলো কলটা। প্রীতি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলো তখনো। প্রজ্ঞা মেকি হেসে বলে,
– “সোনা পাখি আমার, একটামাত্র বোন আমার!”
তার কথায় হেসে উঠলো প্রীতি। আঙুল দ্বারা দরজার দিকে নির্দেশ করে বললো,
– “যাহ ভাগ। বিয়াইত্তা মানুষের আবার কত্ত ঢং! নাটক দেখে বাঁচিনা আর… দুদিন বাদে আর চুলোচুলি করলে তোদের খবর আছে।”
প্রীতির গালদুটো টেনে দিয়ে ঘর থেকে বেরোলো প্রজ্ঞা। একেবারে পা টিপেটিপে রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রিজ থেকে সন্ধ্যার বানানো মিষ্টি কয়েকটা বের করে বাটিতে তুলে নিলো। একইভাবে টু শব্দটি না করে সদর দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। পাপিয়া আক্তারের চোখে পড়লেই ঝামেলা। কিছু বলতে পারবেন না ঠিকই, তবে একটা লজ্জার ব্যাপার।
ওড়নাটা মাথায় পেঁচিয়ে গিয়ে সে দাড়ালো সেই সরু গলিতে, এখানে মানুষ আসেনা। তাদের বাড়ির একটা বারান্দা থেকেই দেখা যায় কেবল, সেখানে পাপিয়া আক্তার আসেন না খুব একটা।
দশ মিনিটের কথা বলে এনজাম এলো ঠিক পনেরো মিনিট পর। গলির মধ্যে ঢুকে প্রজ্ঞার সামনে এসেই বাইক থামালো। হেলমেটটা খুলতেই প্রজ্ঞা মুখ বাঁকিয়ে শুধায়,
– “কতদিন পরে গ্যারেজ থেকে বের করলেন এটা? চালানো মনে আছে আদেও?”
– “বোসো, একটা রাইড দিয়ে আসি। তাহলেই না বুঝবে!”
নেমে দাঁড়িয়ে বললো এনজাম। প্রজ্ঞা হাতের বাটিটা বাইকের উপর রেখে বলে,
– “হ্যা… তারপর বাসায় একটা কেস খেয়ে যাই তাইতো?”
এনজাম বিরক্তির স্বরে বললো,
– “কীসের কেস? মনে হচ্ছে আগে কখনো লুকিয়ে বের হওনি?”
– “আগের কথা আর এখনের কথা আলাদা। আগের ব্যাপার আম্মু জানতো, কিন্তু কখনো জিজ্ঞেস করেনি। এখন তো করতেই পারে।
সেটা বাদই দিলাম। কিন্তু তুমি কী মনে করে, এই সময়? দরকার কিছু?”
দুপাশ থেকে তার গলায় হাত ঝুলিয়ে কিছুটা এগিয়ে এলো এনজাম। মুচকি হেসে বললো,
– “মিসড ইউ!”
চোখ বড়বড় করে কেশে উঠলো প্রজ্ঞা। বিস্ময় ভঙ্গিতে বললো,
– “আচ্ছা?”
– “জি ম্যাডাম।”
– “তা কাকে মিস করলে? বউ নাকি প্রেমিকা?”
নিচু হয়ে আসে এনজাম। কানেকানে ফিসফিসিয়ে বলে,
– “দুটোই।”
– “আর এতদিন একটাকেও মিস করা হয়নি?”
পিছু ঘুরিয়ে তার হাতদুটো আঁকড়ে ধরলো এনজাম। কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে বললো,
– “তফাৎ আছে ডিয়ার। বুঝবেনা।”
চোখমুখ কুঁচকে ঘুরে দাঁড়ালেন পাপিয়া আক্তার। মুখখানা তার ঠিক প্যাঁচার ন্যায় হয়ে আছে। বারন্দায় তার কম্বলটা রাখা ছিলো। ওটা নিতে এসে এসব কী দেখতে হচ্ছে!
প্রীতি কানে হেডফোন লাগিয়ে ঘুরছিলো আসেপাশে। মা-কে বারান্দার সামনে দেখেই দাঁড়িয়ে পড়লো। এখানে কী করছে সে? শুকনো ঢোক গিলতেই পাপিয়া এগিয়ে এলেন তার কাছে। গম্ভীর গলায় বললেন,
– “তোমার বোনকে বলে দেবে, এখানে ভদ্রলোকেরা থাকেন। আর তার বরকে বোলো একেবারে বাড়ি নিয়ে যেতে। রাস্তাঘাটে এসব… ছিহঃ!”
প্রীতি একটু এগিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো তাদের। ভ্রু কুঁচকে মায়ের সামনে এসে বললো,
– “আম্মু, ওরা গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড না! আর এখানে কে-ই বা আসে?”
– “আসুক আর না আসুক সেটা আমার দেখার বিষয় নয়। কিন্তু এখানে এসব চলবেনা।”
– “কীসব চলবেনা? আরে জাস্ট জড়িয়েই তো ধরেছে! হাজবেন্ড ওয়াইফ ওরা, তুমি খামোখা রেগে যাচ্ছো।”
পাপিয়া আক্তার স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে কাটকাট গলায় বললেন,
– “অভদ্র মেয়ে একটা… তোমাকে আগে তাড়ানোর ব্যবস্থা করছি আমি। তারপর দুই বোন যা খুশি করো গিয়ে।”
.
– “আমি কিন্তু তিনদিন থেকে আবার আসতে পারতাম। তুমি ইচ্ছে করেই নিলেনা। ভাবসাব ভালো ঠেকছেনা।”
এনজাম ঠোঁট কামড়ে বললো,
– “সত্যিটা বলি, ভালো বর হবার একটা কোর্স এ ভর্তি হয়েছিলাম বুঝলে? সেখানে ট্রেইনার হলেন দুজন মেয়ে।”
প্রজ্ঞা হাতটা ছাড়িয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। বুকে হাত গুঁজে বললো,
– “তাদের কাছেই থাকতে। মাঝরাতে আর আমাকে দেখতে এসে ঢং করার কী দরকার?”
এনজাম কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে কাছে টেনে নিলো তাকে। দুহাতে কোমড় চেপে ধরে গালে নাক ঘষে বললো,
– “কী দরকার?”
ধীরেধীরে আরো খানিকটা নিকটে আসে সে। প্রজ্ঞার বুজে থাকা চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে মধ্যকার দূরত্ব একেবারেই কমিয়ে আনে। দুজনের মাঝে চুলপরিমাণ ব্যবধান শুধু।
ঠিক তখনি পকেটে থাকা ফোনটা বেজে উঠলো এনজামের। অকস্মাৎ শব্দে ঘোর ভঙ্গ হলো দুজনেরই। চোখে মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করলো এনজাম। না দেখে রিসিভ করে কানে ধরতেই প্রীতি কড়া গলায় বললো,
– “আপনার বউকে বলেন এক্ষুনি বাসায় ঢুকতে। আর নাহলে নিজের সাথেই নিয়ে যান। উপরে বারান্দার দিকে একটু তাকাতে হয় মাঝেমধ্যে! পরে আম্মু কিছু বললে আমার কোনো দোষ নেই।”
কথাটুকু কানে যেতেই তড়িৎবেগে সরে দাঁড়ালো প্রজ্ঞা। বড়বড় চোখ করে বারান্দার দিকে তাকালো। নাহ, কেউ নেই তো।
এনজাম সেদিকে দৃষ্টিপাত না করে আহত কণ্ঠে শুধায়,
– “শালীকা,তোমার কী আমার সঙ্গে কোনো জনমের শত্রুতা আছে? টাইমিং সেন্স এত ভালো কেন হতে হবে!”
– “রাখেন আপনার টাইমিং সেন্স। প্রেম করবে তারা আর বাঁশ খাবো আমি। হোয়াই! দিন আমারো আসবে,হুহ…”
কলটা কেটে দিলো সে। এনজামকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই প্রজ্ঞা মিষ্টির বাটিটা ধরিয়ে দিলো তার হাতে। গালে হাত রেখে বললো,
– “সন্ধ্যায় বানিয়েছিলাম মিষ্টি, খেয়ে নিও। আমি যাই।”
– “আরে আরে… যাই মানে কী?”
প্রজ্ঞার আর কানে গেলোনা কথা। বড়বড় পা ফেলে চলে গেলো বাড়ির ভিতর। রাগে,দুঃখে ফুঁসে উঠলো এনজাম। হাতে ধরে রাখা বাটিটার দিকে চেয়ে পুনরায় সামনে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
– “এই মিষ্টি খেতে হলেতো মিষ্টান্ন ভাণ্ডার এই যেতাম! তেল খরচ করে এ অবধি এলাম কেন? ধ্যাৎ…”
বাচ্চাদের মতো নাক কুঁচকে বাইকে উঠে বসলো সে। পরমুহূর্তে আরো একবার তাকালো বাটিটার দিকে। খুলে একটা মিষ্টি মুখে দিয়ে উদাস মনেই খেতে লাগলো। সময়ের সাথে সাথে সেই মুখভঙ্গি ও বদলে যায় তার! আরো একটা মিষ্টি মুখে তুলে একাই বলে,
– “নাহ…খারাপ না। চলে…”
— — —
রাতের বেলা লাইট জ্বালিয়ে বসেই ফোন স্ক্রোল করছিলো দুই বোন। প্রীতির কানে হেডফোন লাগানো। হোয়াটস অ্যাপ এর একটা মেসেজ দেখে প্রজ্ঞা চেঁচিয়ে উঠলো হুট করেই,
– “এই! দেখ, খালামনি একটা ছেলের বায়োডাটা পাঠিয়েছে।”
প্রীতি আনমনে বলে উঠলো,
– “কীসের জন্য?”
প্রজ্ঞা আড়চোখে চেয়ে বলে,
– “আমার জন্য। জানিস না, দ্বিতীয় বিয়ে করে বহুপতী পরিবার গঠনের প্ল্যান করছি?”
প্রীতি অবাক হয়ে তাকাতেই বললো সে,
– “বলদ কোথাকার, তোর জন্য পাঠিয়েছে নিশ্চই। দাঁড়া দেখি।”
অতি উৎসাহ নিয়ে বায়োডাটা জুম করে দেখলো প্রজ্ঞা। আবারো চেঁচিয়ে উঠলো,
– “এই দেখ দেখ, ছেলের একটা ভাইও আছে!”
চোখদুটো চিকচিক করে উঠলো তার, দাঁত বের করে তাকালো প্রীতির দিকে। পরমুহূর্তেই কপাল চাপড়ালো। মেকি হেসে হতাশ কণ্ঠে বললো,
– “তাতে আমার কী? আমি তো বিয়াইত্তা!”
ছবির দিকে মনোযোগ দিলো সে আবারো। বললো,
– “এইজ থার্টি টু। ঢাকা মেডিকেল থেকে এম বি বি এস কমপ্লিট করেছে। আবার বিদেশের কয়েক জায়গা থেকেও পড়ে এসেছে, পি এইচ ডি ও করেছে! বাহ!”
– “থার্টি টু? হুম…চলে। হাইট কত?”
– “হাইট… ফাইভ নাইন। হে হে, আমার জামাইয়ের চেয়ে এক ইঞ্চি কম।”
বেশ ভাব নিয়ে বললো প্রজ্ঞা। প্রীতি কিছুটা ভেবে বলে,
– “ফাইভ নাইন এন্ড ফাইভ ফোর… হুম চলে। ওয়েট?”
– “সেভেন্টি ফাইভ। হাহ, আমার জামাইয়ের চেয়ে তিন চার কেজি বেশি।”
প্রীতি মুখ বাকিয়ে বলে,
– “তুই কী তুলনা করতে বসেছিস এখানে? বাট, এটাও ঠিকঠাক। স্কিন টোন?”
প্রজ্ঞা ছবিটা দেখে ভ্রু কুঁচকে বলে,
– “স্কিন টোন তো দেওয়া নেই। সেটা আবার কে দেয় বায়োডাটায়?”
– “অবশ্যই দেওয়া উচিৎ। ছবি দেখে তো বিশ্বাস করা যায়না। ফোন দিয়া জিগাইতাম, আপনি ধলা না কালা? দেখ, আমার চেয়ে অন্তত টু শেড ডার্ক হতেই হবে। পুরোপুরি ডার্ক চকলেট হলেও সমস্যা নেই। ভাব নিতে পারবো।”
আবারো হেডফোন কানে লাগিয়ে বসলো সে। প্রজ্ঞা মনোযোগ সহকারে দেখছে বায়োডাটা। কয়েক সেকেন্ড বাদে প্রীতি পাশ ফিরে বললো,
– “চৌদ্দ গুষ্টি দেখে ফেললি, নামটা দেখবে কে? নাম কী তার?”
প্রজ্ঞা নামের অংশটা জুম করে ধীরেধীরে পড়লো,
– “নাম হলো… স্বজন হায়দার বেলাল।”
হতবাক দৃষ্টিতে চাইলো প্রীতি। কান থেকে হেডফোন সরিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
– “স্বজন হারানোর বেদনা?”
#চলবে?
#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_৩০
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন
প্রজ্ঞা কয়েক সেকেন্ড বড়বড় চোখে চেয়ে থেকে ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো। প্রীতির মাথায় একটা গাট্টা মে’রে বললো,
– “কানের ডাক্তার দেখা বলদি। স্বজন হারানোর বেদনা নয়, পাত্রের নাম স্বজন হায়দার বেলাল।”
প্রীতি ভ্রু কুঁচকে শুধায়,
– “স্বজন? আচ্ছা, নামটা কেমন চেনাচেনা লাগছে না?”
– “চেনা চেনা…”
একটু ভাবতেই চকিত দৃষ্টিতে তাকালো প্রজ্ঞা। প্রীতিও তাকিয়েছে একইভাবে। আরো কয়েকবার বায়োডাটা দেখে প্রজ্ঞা বিস্মিত কণ্ঠে শুধায়,
– “আমি যার কথা ভাবছি, তুইও কি…”
– “ওয়েট ওয়েট, ঐ লোক বিবাহিত না?”
– “আমি কী করে জানবো? আমার সাথে তো আর অত যোগাযোগ নেই।”
প্রীতি কিছুক্ষন ভেবে বলে,
– “আরে নাহ। উনি তো ভার্সিটির ছাত্র তাইনা? আর এই স্বজন তো ডাক্তার।”
প্রজ্ঞা অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে শুধায়,
– “প্রীতি, উনিও কিন্তু ডাক্তার ই। এনজামের এলাকার ভাই বলা চলে। সেদিন কোনো কাজে, বা ছোট ভাইয়ের সঙ্গে প্রোগ্রাম দেখতে এসেছিলেন। অ্যান্ড দ্যা ফ্যাক্ট ইজ… ভাইয়াও ঢাকা মেডিকেল এর ছাত্র ছিলেন।”
প্রীতি তৎক্ষণাৎ মুখ বেঁকিয়ে বলে,
– “তাহলে এই স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে থাকা যাবেনা… রিজেক্টেড।”
– “ওমা! কেন?”
প্রীতি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে ওঠে,
– “বেডায় তো ভালোই ফর্সা। আমার মতোই…না না আমার চেয়েও এক দু শেড উপরে। কেমন ধলা বিলাই লাগে! ডার্ক চকলেট ছাড়া আমি বিয়ে করবো না মানে করবোই না।”
প্রজ্ঞা গাল ফুলিয়ে বললো,
– “তুই কিন্তু ইন্ডিরেক্টলি অপমান করছিস!”
– “কাকে?”
– “কাকে আবার? আমার ভ্যানিলা আইসক্রিম কে!”
– “আরে ছাগল! তোরটা ভ্যানিলা নয়, বাটারস্কচ আইসক্রিম হবে। কিন্তু এইটা তো পুরাই ভ্যানিলা!”
প্রজ্ঞা একটু ভেবে জানায়,
– “কিন্তু এই স্বজন ই ঐ স্বজন কিনা তার ই তো নিশ্চয়তা নেই। খালায় ছেলের ছবি দেয়নাই কেন?”
– “তুই ফুল নাম জানিস না ওনার?”
– “নাহ তো। বললাম না আমার সাথে ওনার তেমন যোগাযোগ নেই। এফবি তেও অ্যাড নেই।”
– “তো তোর জামাই রে কল কর। ও তো জানবে অ্যাটলিস্ট।”
প্রজ্ঞা তৎক্ষণাৎ এনজামের নম্বরে কল করতে গিয়েও প্রীতির দিকে চেয়ে বললো,
– “বেচারাকে এই রাতের বেলা জাগাবো?”
প্রীতি দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
– “এই বেচারার নামেই আবার গা’লি’গা’লাজ করিস আমার কাছে এসে, থাপড়ায় দাঁত ভেঙে ফেলবো।”
শুকনো ঢোক গিলে কলটা করেই ফেললো প্রজ্ঞা। এনজাম সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। চোখ না খুলেই ফোনটা রিসিভ করে ঘুমঘুম কণ্ঠে বললো,
– “হ্যালো?”
– “হ্যালো… শুনো,একটা ইনফরমেশন লাগবে।”
এনজাম পিটপিট করে চোখ খুললো। ফোনটা সামনে এনে প্রজ্ঞার নম্বর দেখেই কানে ধরে বললো,
– “এই রাতে কিসের ইনফরমেশন? দেখো,আমি ঘুমোবো। যা বলার কাল সকালে বলবে। গুড নাইট।”
– “এই না না!”
– “হোয়াট! কে তোমার নানা?”
প্রজ্ঞা ভ্রু কুঁচকে বলে,
– “আজব! নানা কেন হতে যাবে? যাই হোক, তুমি আমার কথা শুনো। স্বজন ভাইয়ের ফুল নেইম কী?”
– “কোন স্বজন?”
– “আরে স্বজন ভাইয়া! আমাদের বিয়েতে যে সাক্ষী হিসেবে ছিলো, কদিন আগেও দেখা হলো, সে।”
এনজাম ভারী বিরক্ত হলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে বসে বললো,
– “তার নাম দিয়ে তুমি কী করবে?”
– “আরে তুমি বলোই না…প্লিজ!”
এনজাম কয়েক সেকেন্ড ভেবে বলে,
– “বাড়িতে কয়েকজন শুনেছিলাম বেলাল বলে ডাকে। পুরো নাম মনে নেই।”
ফোনটা স্পিকার এ থাকায় প্রীতিও শুনলো কথাটা। মুখ ঘুরিয়ে নিলো সঙ্গেসঙ্গেই। প্রজ্ঞা তার দিকে চেয়ে বলে,
– “আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি ঘুমাও এখন, গুড নাইট।”
এনজাম শুয়ে পড়লো বিছানায়। চোখ বুজে ফোনটা মুখের সামনে এনে বললো,
– “ওকে, গুড নাইট। লাভ ইউ… উম্মাহ…”
প্রজ্ঞা প্রশস্ত হেসে ফোনটা মুখের সামনে নিলো। ঠোঁট চোখা করে একটা চুমু দিতে যাবে এমন সময় প্রীতির বিরক্তিসূচক দৃষ্টি দেখে ফোনটা সরিয়ে নেয় আবারো। মেকি হেসে কেটেই দেয়।
প্রীতি আবারো এগিয়ে এসে বললো,
– “ওনার আইডি সার্চ কর তো। তোর ফোনে জলদি খুঁজে পাওয়া যাবে। মিউচুয়াল থাকবে অবশ্যই।”
– “হ্যা! ভালো আইডিয়া।”
প্রজ্ঞা পুরো নাম লিখে সার্চ করতেই সবার উপরে স্বজনের আইডি চলে এলো। বিশ্বজয়ের হাসি হেসে প্রোফাইলে ঢোকা মাত্রই বড়সড় এক ধাক্কা খেলো তারা। প্রীতি ভ্রুযুগল এক করে বিরক্তির কণ্ঠে বললো,
– “বেডা মানুষের আবার আইডি লক করা লাগে কীসের জন্য? এদের এত প্রাইভেসি কীসের?”
প্রজ্ঞা এবারেও প্রতিবাদ জানিয়ে বলে,
– “আবারো অপমান করছিস তুই! এনজামের ও একটা আইডি লক করা।”
প্রীতি আর কথাই বললোনা। লাইটটা নিভিয়ে ঢুকে পড়লো কম্বলের নিচে। প্রজ্ঞাও হাই তুলে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। অমনি তার ফোনে কল এলো এনজামের। রিসিভ করতেই বললো, একবার ঘুম ছুটে গেছে বলে আর ঘুম আসছেনা। প্রজ্ঞাও মুচকি হেসে, ‘এই জানো কী হয়েছে?’ থেকে কথা শুরু করলো। সেকেন্ড যায়,মিনিট যায়… এদের কথাই শেষ হয়না! ফিসফিসিয়ে কথা বলছে, হুটহাট হেসে উঠছে, বারবার এপাশ ওপাশ ফিরছে। প্রায় বিশমিনিট যেতেই ধৈর্যহারা হলো প্রীতি। তড়িৎবেগে উঠে বসে প্রজ্ঞার কান থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে কানে ধরে বললো,
– “এই আপনার কী চোখে ঘুম নাই? সকালে অফিস নাই? এত কীসের কথা! চুপচাপ ঘুমান। আর একবার কল করলে আপনার বউকে কিন্তু বাসা থেকেই বের করে দেবো আমি।”
এনজামকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কলটা কেটে দিলো সে। প্রজ্ঞার হতবাক মুখের দিকে চেয়ে আঙুল উঁচিয়ে বললো,
– “তোর ভাতার এখনো কাতার যায়নি। এত পিরিত উপচে পড়লে তার কাছেই চলে যা। আর একবার এদিক ওদিক মোড়ামুড়ি করতে দেখলে লা’থি মে’রে খাট থেকে নিচে ফেলবো বলে দিচ্ছি।
মাবুদ! এই আ’কা’ইম্মা বেডা বেডি আমার ভাগ্যেই জুটলো কেন?”
— — —
পরদিন রাত এগারোটা নাগাদ আবারো হাজির হলো এনজাম। তবে কেবল দেখা করতে নয়। প্রজ্ঞাকে বলেই রেখেছে, আসপাশ থেকে একটু চক্কর দিয়ে আসবে। বহুদিন এভাবে বেরোনো হয়না তাদের।
প্রজ্ঞা আজ আর আপত্তি জানায়নি। প্রণয়কে প্রীতির পাশে ঘুম পাড়িয়ে ফোনটা নিয়ে বেরোলো সে। এনজাম দেরি করলোনা। ঠিক সময়ে এসেই হেলমেটটা খুলে বললো,
– “উঠে বোসো।”
প্রজ্ঞা বাইকে উঠে একহাত রাখলো তার কাঁধে। এনজাম তা দেখে পিছু ঘুরে ভ্রু কুঁচকে বললো,
– “আমাকে কী তোমার পাঠাও ড্রাইভার মনে হচ্ছে? এভাবে হাত রেখেছো কেন?”
প্রজ্ঞা মুখ বেঁকিয়ে বললো,
– “তুমি কি চাচ্ছো, আমি হেলমেট এর সঙ্গে সিটবেল্ট ও পরি?”
– “বাইকে যে সিটবেল্ট থাকেনা, এটা কি তুমি জানো না?”
– “আল্লাহ তাই! তাহলে এক কাজ কোরো, ব্রেক কষার আগে সতর্ক করে দিও যেন আকাশে উড়তে না হয়।”
এনজাম কপাল চাপড়ে বললো,
– “তুমি কী জানো, তোমার মধ্যকার রোম্যান্টিক প্রেমিকা বর্তমানে গাছের ডালে বসে নৃত্য করছে? একটু সুন্দরকরে ধরে বসতে বলেছি, ইডিয়ট!”
প্রজ্ঞা ভ্রু কুঁচকে শুধায়,
– “তো এটা নিয়ে এত রঙ্গ করার কী আছে? সোজাসুজি বললেই তো হতো। তুমি ইচ্ছে করেই রাগাও আমাকে!”
একেবারে কাছে এগিয়ে পিছন থেকে তার পেট জড়িয়ে ধরে বসলো প্রজ্ঞা। মুচকি হেসে পিঠের সঙ্গে নাক ঘষতেই পেট মুচড়ে উঠলো তার। তৎক্ষণাৎ সরে গিয়ে মুখে হাত চেপে বললো,
– “এটা কোন পারফিউম? কী বিশ্রি স্মেল!”
এনজাম অবাক চোখে চেয়ে বললো,
– “কেন? এটাতো আগেও ইউজ করেছি। তোমার পছন্দ!”
– “পছন্দ না ছাই… মাথা ঘুরছে আমার এই স্মেল এ।”
এনজাম পাত্তা দিলোনা। পেটের কাছে থাকা একটা হাত শক্ত করে ধরে সামান্য টান দিতেই পুনরায় পিঠের সঙ্গে লেপ্টে গেলো প্রজ্ঞা। বাইক স্টার্ট দিতে দিতে বলে এনজাম,
– “নাটক না করে শক্ত করে ধরে বোসো।”
হেলমেট আর পরলোনা তারা। পারফিউমের গন্ধটা ধীরেধীরে সয়ে এলো প্রজ্ঞার। পূর্বের চেয়েও শক্ত হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে পিঠে নাক ঘষলো বারকয়েক। প্রায় বছরখানেক পর এই বাইক নিয়ে বেরোনো হলো তাদের। রাতের শান্ত শহর, মৃদু হাওয়া, সঙ্গে প্রীয় মানুষ… নিজের মাঝে এক অসম্ভব সুখ অনুভূত হলো তার। এইতো তার ব্যক্তিগত পুরুষ, তারই প্রেমিক পুরুষ! আগের চেয়ে অনেকটা সুদর্শন হয়েছে, লম্বায় হয়তো একটুখানি বেড়েছে, বয়সের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কিছুটা দাম্ভিকতা এসেছে। তবে মানুষটা এক, শুধুই তার এনজাইম।
মুচকি হেসে একটা হাত উঁচু করে এনজামের চুলের মাঝে রাখে প্রজ্ঞা। আলতো হাতে টেনে দেয় কয়েকবার। যুবক মৃদু হেসে শুধায়,
– “কিছুই চাইনা? সত্যি তো?”
প্রজ্ঞা হাতটা সরিয়ে নিয়ে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে,
– “না না, তেমন কিছুই চাইনা। যদি পারো তো সামান্য কিছু…”
– “সামান্য কিছু? কী কী?”
প্রজ্ঞা মেকি হেসে বলা শুরু করলো,
– “শুনো, প্রথমত আমি একটা পারফিউমের নাম লিখে দেবো। ওটা খুঁজবে। যদি পাও তো আনবে। কিন্তু কম দামের দেখে।”
– “কম দামের কেন?”
– “কারণ আমি নব্বই শতাংশ নিশ্চিত, তুমি ভুল টাই আনবে। তবুও দাম কম হলে স্বান্ত্বনা দিতে পারবো নিজেকে।”
এনজাম ঘাড় কাত করে বলে,
– “তারপর?”
– “আর তেমন কিছুই না। কিছু মেকআপ আইটেম এর ছবি পাঠাবো, ওগুলো দেখবে। তারপর আমি চারটে ড্রেস এর ছবি পাঠাবো, পেয়ে গেলে সেখান থেকে পছন্দ করে তিনটে আনলেই চলবে। আর এক ধরণের ব্রেসলেট আছে, ওগুলো পেলে আনবে। এত বাহিরে…”
এনজাম ঠোঁট চেপে হেসে বললো,
– “এগুলো তোমার সামান্য কিছু?”
– “হ্যা, তো কি বেশি বললাম? একটামাত্র বউ! আচ্ছা আমরা এদিকে যাচ্ছি কেন? ব্যাক করো, বাড়ি ফিরতে হবে তো।”
– “চুপ করে বসে থাকো। বাসায় গিয়ে আগে আমার লাগেজ গুছিয়ে দেবে, তারপর পৌঁছে দিয়ে আসবো।”
প্রজ্ঞা হতভম্ব হয়ে বললো,
– “এই রাতে তুমি আমাকে বাসায় নিয়ে যাচ্ছো লাগেজ গোছানোর জন্য? এনজাম, মাথা খারাপ হয়েছে তোমার? আম্মু বুঝতে পারলে…”
– “বুঝতে পারলে পারুক। আমি বলি,তাকে তার বরের কাছে পাঠিয়ে দাও। নিজে সারাজীবন একা থেকেছে বলে কী নিজের মেয়ের উপর রাগ ঝাড়বে?”
– “মুখ সামলাও! কীসব কথা বলছো?”
এনজামের বাইক থামলো তাদের গ্যারেজে এসে। প্রজ্ঞা আর আপত্তি জানায় না। কতদিন বাসায় পা রাখা হয়না! এটাই তো তার নিজের বাসা, যেখানে তার সম্পূর্ন অধিকার রয়েছে।
ফ্ল্যাটে প্রবেশ করতেই প্রজ্ঞা প্রথম শু র্যাকের দিকে চাইলো। নাহ, এনজাম ব্যাগটা রাখেনি এখানে। ঠিকঠাক পরিষ্কার না করায় ধুলো জমে গেছে উপরে। তবে ফুলদানি এবং ফুলগুলো একদম চকচকে। অজান্তেই মুচকি হাসে প্রজ্ঞা। ঘর পরিষ্কার করেনি এই ছেলে, তবে তার পছন্দের জিনিসগুলো ঠিকই যত্নে রেখেছে।
বেডরুমে প্রবেশ করামাত্র মাথায় হাত চলে যায় প্রজ্ঞার। বিছানার একপাশে এখনো ঝুলছে মশারি। সেখান থেকে চোখ সরিয়ে এনজামের দিকে চেয়ে বলে সে,
– “এ কদিনে কী তুমি মশারি খোলোনি?”
এনজাম হাই টেনে বিছানায় আরাম করে বসে বলে,
– “তিনদিন আপা এসে খুলেছিলো। শুধুশুধু খুলে কী করবো? সেই তো রাতে আবার টাঙাতেই হবে। এত মশা!”
– “আরে গাঁধা! দু তিন ঘণ্টা আগে একটা কয়েল জ্বালিয়ে রাখলেই তো আর মশা পড়তো না। বুদ্ধিশুদ্ধি সব গেছে একদম। লাগেজটাও বের করোনি এখনো?”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গলার ওড়নাটা একপাশ থেকে এনে কোমড়ের কাছে বেঁধে নিলো প্রজ্ঞা। লাগেজ বের করে আলমারি থেকে সব জামাকাপড় বের করলো এনজামের। কোনটা কোনটা নেবে তা দেখিয়ে এক এক করে লাগেজ গুছিয়ে দিলো। এনজাম বিছানায় কনুই ঠেকিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে পুরোটা সময় দেখলো তাকে। চুল বাঁধা তার নিকট এক বিশাল মেহনতের ব্যাপার। তেল তো ভুলেও দেবেনা। সবসময় পেঁচিয়ে খোঁপা করে রাখবে অথবা ব্যান্ড লাগিয়ে রাখবে। তারই মাঝে এনজামের চোখ যায় তার গলার দিকে। ফাঁকা গলাটা দেখে কিছুটা অসম্পূর্ণ মনে হলো।
প্রজ্ঞা ব্যাগটা গুছিয়ে কোমড়ে হাত রেখে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বলে,
– “মোটামোটি সবই ঠিকঠাক। এখন জাস্ট চার্জার আর ব্রাশ টা…”
ওয়ারড্রবের উপর চোখ যেতেই কথা থেমে যায় প্রজ্ঞার। হতভম্ব চিত্তে চারকোণা প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বলে,
– “তুমি সিগারেট খেয়েছো?”
এনজাম অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে উঠে বসে। প্রজ্ঞা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে তাকায় তার পানে। নাক ফুলিয়ে বলে,
– “সত্য কথা বলবি, খেয়েছিস এগুলো?”
এনজাম উঠে এসে সামনে দাঁড়ায় তার। স্মিত হেসে বলে,
– “এনেছিলাম… কিন্তু খাওয়া হয়নি।”
ভ্রু কুঁচকালো প্রজ্ঞা,
– “কেন?”
এনজাম উত্তর না দিয়ে উপরের ড্রয়ার থেকে কিছু একটা বের করে হাতে নিলো। প্রজ্ঞার পিছনে এসে ধীর হস্তে সেই লকেটসহ চিকন চেইনটা গলায় পরিয়ে দিলো। পরক্ষনেই চুলের ব্যান্ডটা খুলে খোলা চুলে মুখ ডুবিয়ে বলে,
– “বউয়ের চুমুর স্বাদ পেয়ে গেলে আর সিগারেট এর স্বাদ ভালো লাগেনা রে!”
– “মিথ্যে কথা বলবে না। খেয়ে থাকলে সত্যিটা বলো, আমি বকবোনা। জাস্ট ঠোঁটে একবার গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দেবো।”
এনজাম এক ঝটকায় নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয় তাকে। কানের পাশে হাত গলিয়ে তার কোমল ঔষ্ঠ্যদ্বয়ের উপর বৃদ্ধাঙ্গুল ঘষে বলে,
– “আপাতত আপনার পার্সোনাল ছ্যাকা প্রয়োজন ম্যাডাম। সেটুকুই দিন।”
প্রজ্ঞা হেসে মাথা নুইয়ে ফেলতেই তার থুঁতনিতে তর্জনী রেখে পুনরায় মুখটা উপরে তোলে এনজাম। ঘাড়ের পিছন থেকে চুলের মাঝে হাত গলিয়ে এক গাঢ় চুমু খায় তার ঠোঁটের পাশে। পরমুহূর্তেই গভীর চুম্বনে লিপ্ত হয়ে বসে। অনেকদিন বাদে প্রজ্ঞার সাড়া পেয়ে একপ্রকার মাতাল হয়ে ওঠে এনজাম। দীর্ঘক্ষণ বাদে তার অধরযুগল মুক্ত করেই অকস্মাৎ কোলে তুলে নেয় তাকে। চোখ খুলে মৃদু আওয়াজে চেঁচিয়ে তার গলা পেঁচিয়ে ধরে প্রজ্ঞা। চোখ বড়বড় করে বলে,
– “কী করছো? নামাও আমাকে।”
এনজাম শুনলোনা তার কথা। পা থামালো ঠিক বিছানার কাছে এসে। ধপ করে বিছানায় শুইয়ে দিলো প্রজ্ঞাকে। সে উঠে বসতে চাইলেই কাঁধ চেপে ধরে বিরক্তির স্বরে শুধায়,
– “সমস্যা কী?”
বলামাত্র তার গলায় মুখ ডুবিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস টানলো সে। প্রজ্ঞা কাপাকাপা গলায় বলে,
– “ব বাড়ি যেতে হবে আমাকে।”
– “হ্যা, যাবে তো।”
– “তাহলে ছাড়ো আমাকে। পৌঁছে দিয়ে এসো।”
– “উঁহু,এখন না।”
প্রজ্ঞা অবাক চোখে চেয়ে শুধায়,
– “কখন?”
এনজাম মিটিমিটি হেসে তার চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
– “হোপ সো,সূর্যদ্বয়ের আগে। ইন-শা-আল্লাহ…”
ভেজা ঢোক গিলে বললো প্রজ্ঞা,
– “পাগলামো কোরোনা!”
এনজাম বোধ হয় কানেই তুললোনা তার কথা। একহাতের সাহায্যে কোমড়ে বাঁধা ওড়নাটা খুলে পাশে সরিয়ে রাখলো। ধীরেধীরে তার উন্মুক্ত গলায় ঠোঁট ছোঁয়াতেই প্রজ্ঞা কিছু বলার জন্য মুখ খোলে। তবে তা বলা আর সম্ভব হলোনা। এর পূর্বেই তার ঠোঁটে আঙুল চেপে ঘোরলাগা কণ্ঠে বললো এনজাম,
– “ডোন্ট টক অ্যাট দিস টাইম, প্লিজ!”
চুপ করে যায় প্রজ্ঞা। বাঁধা দেওয়ার শক্তি,ইচ্ছে দুটোই হারিয়ে শক্ত হাতের মুঠোয় চেপে ধরে তার চুলগুলো। বড্ড বেসামাল হয়ে উঠলো এনজাম। সময়ের ব্যবধানে যখন মেয়েটির সর্বাঙ্গে তার হাতের বিচরণ, ঠিক তখনি বিছানায় অবহেলায় পড়ে থাকা ফোনটা বিশ্রি আওয়াজে বেজে উঠলো। এনজামের মাঝে কোনো ভ্রুক্ষেপ না দেখা গেলেও ঘোর কাটে প্রজ্ঞার। মৃদু ধাক্কায় এনজামকে সরানোর মিছে প্রচেষ্টা চালিয়ে বলে,
– “সরো, আমার ফোনটা দাও।”
এনজাম তবুও শুনলো না। আশাহত হয়ে প্রজ্ঞা হাত বাড়িয়ে কোনোভাবে ফোনটা আনলো নিজের কাছে। প্রীতির কল দেখে তড়িঘড়ি করে রিভিস করলো। কানে ধরতেই সে কর্কশ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো,
– “ছাগলের বাচ্চা কই তুই? বিশমিনিট এর কথা বলে কোন গ্রহে গেছোস? এদিকে তোর বাচ্চা ঘুম থেকে উঠে ম্যা ম্যা করতেছে। আমার কাছে থাকতেই চাইছে না। হয়তো কোনো স্বপ্ন টপ্ন দেখেছে। আম্মু শুনতে পেয়ে ঘরে চলে এলে কী বলবো আমি? তুই কোথায় আগে সেটা বল।”
প্রজ্ঞা আমতা আমতা করে বলে শুধু,
– “হ হ্যা, আমি…এইতো রাস্তায় আছি। দশমিনিট একটু সামলা ওকে। আসছি আমি।”
– “জলদি আয়।”
ফোনটা কেটে ওঠার চেষ্টা করতেই এনজামের হাতের দৃঢ় বাঁধনে আটকা পড়লো সে। কাঁধ থেকে মুখ সরিয়ে গালে একবার ঠোঁট ছোঁয়াতেই প্রজ্ঞা অকস্মাৎ এক চড় বসালো তার গালে। এনজাম ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই বললো,
– “ছাড়ো আমাকে। ছেলে কাঁদছে।”
– “কার ছেলে?”
– “আরে তোর ছেলে!”
– “আমার ছেলে কে?”
– “ওরে হাদারাম! প্রণয় কাঁদছে,আমাকে যেতে হবে।”
বলেই এনজামকে সরিয়ে উঠে বসলো প্রজ্ঞা। এনজাম আহাম্মকের মতো কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে চট করে উঠে বসে বললো,
– “কাঁদছে কেন? আর তুমি যাবে মানে?”
– “এই তোমার মাথার ঘিলু কি গরুর খাবার হিসেবে দান করেছো? বোকার মতো কথা না বলে ওঠো, আমাকে দিয়ে এসো।”
উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ওড়নাটা টেনে গায়ে জড়ালো প্রজ্ঞা। এনজাম তৎক্ষণাৎ তার হাত ধরে আটকে দিয়ে বলে,
– “আরে কাঁদছে তো কী হয়েছে? আমি ফোন করে বুঝিয়ে বলছি না!”
– “কী বলবে? লজ্জা সরম গুলিয়ে খেয়েছো সব? প্রীতি জিজ্ঞেস করে যদি কোথায় আছো,তখন কী বলবে?”
– “বলতে হবে কেন? ফোনটা অফ করে রাখো। আর প্রণয় তো কাঁদেনা তোমার জন্য, প্রীতি আছে তো। ও থেমে যাবে। আধঘণ্টা পরে গেলে কিচ্ছু হবেনা সোনা।”
প্রজ্ঞা হতবাক চোখে তাকিয়ে নিজের হাতটা ঝামটা মেরে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
– “এক মিনিট দেরি করাও রিস্কি, সেখানে তুমি বলছো আধঘণ্টা? ফাজলামো কোরোনা এনজাম। ওখানে আমার ছেলে মা-কে না পেয়ে কাঁদছে!”
এনজাম বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে বলে,
– “ওখানে ছেলে কাঁদছে… আর এখানে যে আমি কাঁদছি,তার কোনো কদর নেই?”
প্রজ্ঞা করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে দু-গালে হাত রাখে তার। বামগালে ঠোঁট চেপে বলে,
– “রাগ করেনা সোনা! আচ্ছা,আমি কাল আসবো হ্যা?”
এনজাম নাক ফুলিয়ে বললো,
– “কাল কী তোমার অপেক্ষায় আমার ফ্লাইট দাঁড়িয়ে থাকবে?”
প্রজ্ঞা আর বোঝালোই না তাকে। উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে বললো,
– “না দাঁড়ালে চলে যাবে। আমি কী পালিয়ে যাচ্ছি নাকি? এখন আর কোনো কথা নয়। চুপচাপ দিয়ে এসো আমায়,জলদি!”
প্রজ্ঞা পিছু ঘুরে হাঁটা ধরতেই এনজাম পিছন পিছন এসে আহাজারি শুরু করলো,
– “এমন কোরোনা প্লিজ! প্রজ্ঞা, জান আমার! আরে কথাটা তো শোনো। আমি কথা বলছি তো প্রণয়ের সাথে। এই মেয়ে, দাঁড়াও! যেওনা!”
সে কিছুই শুনলো না। নিচে এসে লিফট থেকে বেরোতেই এনজাম বুকে হাত গুঁজে বললো,
– “পারবোনা আমি দিয়ে আসতে, একা একা যাও গিয়ে। আর নাহয় আমার কথা শোনো। তাহলে ঠিকই পৌঁছে দিয়ে আসবো।”
প্রজ্ঞা কড়া চোখে তাকালো তার দিকে। ফুঁসে উঠে বললো,
– “অনেক হয়েছে। আর একবার উল্টোপাল্টা কথা বললে এক মাসেও বাসায় আসবোনা আমি… এই বলে রাখলাম।”
কথাটা বলেই সে হনহনিয়ে হেঁটে বাইকের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। রাগে,দুঃখে জর্জরিত এনজাম অসহায়ের ন্যায় উপরে তাকিয়ে দুহাত তুলে কাঁদোকাঁদো গলায় বললো,
– “হে মাবুদ! এমন স্বাধীনতা কি আমরা চেয়েছিলাম?”
#চলবে?