#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_৩১
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন
পরদিন সকাল সকাল এনজাম একবার প্রজ্ঞাদের বাড়িতে এলো। তার ফ্লাইট দুপুরের পর। এইসময়ে আসার বড় একটা কারণ হলো প্রীতি। কাল রাতে প্রজ্ঞাকে নিয়ে আসার সময় স্বজনের খবরটা জানার পর খানিকটা অবাক হয়েছিলো সে। মূলত তার বিস্ময়তার কারণ প্রীতির নির্বিকার ভঙ্গিমা। সে বিয়ের ব্যাপারে নিজের কোনোপ্রকার আপত্তি জানাচ্ছেনা। অথচ তিন চারমাস আগেও এনজামকে বলেছে, সে নিজের পছন্দেই বিয়ে করবে। প্রেম করে নয়, তবে যাকে পছন্দ তাকেই সরাসরি বিয়ে করে নেবে। এনজাম অনেকটাই নিশ্চিত ছিলো, এই মেয়ে কাউকে পছন্দ করছে, কিংবা কারো সাথে তার সম্পর্ক রয়েছে। সেখানে হুট করে এককথায় বিয়ের জন্য রাজি হয়ে যাওয়াটা একটু ভাবাচ্ছে তাকে।
পাপিয়া আক্তার সকাল সকাল উঠে পড়েন ঘুম থেকে। প্রজ্ঞাকে এ বাড়িতে থাকাকালীন সাড়ে আটটা কী নয়টার আগে শত চেষ্টা করেও তোলা সম্ভব নয়। প্রীতি আবার পেয়েছে মায়ের ধাঁচ। ফজরের নামাজ শেষে ঘুমোলেও সাতটার আগেই উঠে পড়ে। এই যেমন ভরাভরা এককাপ কফি নিয়ে সোফায় বসেছিলো খবরের কাগজ সমেত। এনজামের আগমনে পাপিয়া আরো একমগ কফি বানিয়ে নিয়ে এলেন। প্রজ্ঞাকে ডাকার উদ্দেশ্যে উপরে যেতে নিলেই এনজাম বাধা দিয়ে বলে,
– “থাক মা, ডাকতে হবেনা। ঘুমাচ্ছে যখন ঘুমাক, যাওয়ার সময় দেখা করে যাবো।”
প্রীতি ঠোঁট চেপে হেসে কিছুটা নিচু স্বরে শুধায়,
– “কাল যে কত রাত অবধি টো টো করেছেন রাস্তায় তা বলে দেই?”
এনজাম কড়া চোখে চাইলো একবার। পাপিয়া আক্তার স্থান ত্যাগ করতেই পাশ ফিরে সোফার হাতলে কনুই ঠেকিয়ে বসলো। ভ্রু কুঁচকে বললো,
– “তুমি মিঙ্গা আগে নিজের কথা বলো। আম্মাজান যে সিরিয়াসলি বিয়ের বন্দবস্ত করছে তা কি জানো? আমার মনে হয়না তিনি কথার কথা বলছেন। ছেলে পছন্দ হলে কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ হয়েও যেতে পারে।”
প্রীতি হো হো করে হেসে উঠে বলে,
– “হোক না! আর কতকাল আপনাদের বাচ্চা পালবো বলেন তো? এবার নিজের বাচ্চা নিজেরাই পালেন। প্রেম বহুত করেছেন। এখন সময় আমার।”
– “সত্যিই মায়ের পছন্দে বিয়ে করবে?”
– “অ্যাহ! নিজের ও পছন্দ হতে হবে। অতো বাধ্য মেয়ে না আমি।”
– “আর ইউ ওকে?”
একটু গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন ছুড়লো এনজাম। প্রীতি হাসির রেশ কমিয়ে তার দিকে চেয়ে বলে,
– “অভিয়াসলি। আমি অল টাইম ভালোই থাকি।”
এনজামের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি লক্ষ্য করে সে কফির মগটা টি টেবিলের উপর রাখে। সোজা হয়ে বসে বলে,
– “আপনার কী মনে হচ্ছে আমি ছ্যাকা ট্যাকা খেয়ে বাঁকা হয়ে বসে আছি? কাম অন ব্রো, প্রীতি অমন মেয়েই না!”
এনজাম মৃদু হেসে শুধায়,
– “কিছু একটা ঘাপলা লাগছে আমার।”
– “হুদাই লাগছে। শুনেন ভাই,লাইফে অল টাইম চিল মুড এ থাকা উচিৎ। একটা কিছু না পাওয়ার আক্ষেপ মনে রেখে দিলে চলবে না। বরং ভাবতে হবে, উপরওয়ালা ভাগ্যে দ্বিগুণ ভালো কিছু লিখে রেখেছেন।”
এনজাম ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,
– “তোমাদের দুই বোনের এই এক মিল, মুখ ফসকে সত্য কথা বেরিয়েই যায়!”
– “মুখ ফসকে বেরোনোর কী আছে? আর লুকোনোর ই বা কী আছে? লাইফে যে কাউকে পছন্দ হতেই পারে, ইটস নরমাল। এটাকে কমপ্লিকেটেড করে তোলে মানুষ নিজেই। ওকে লাগবেই… এই মনোভাব রাখলে তো সে মা’রা খাবেই ভাই!”
এনজাম চোখ ছোটছোট করে বলে,
– “কাকে কী বলছো?”
প্রীতি তার দিকে চেয়ে ফিঁক করে হেসে ফেললো,
– “ওহহো! সেটাই তো। পাবনার পুরাতন পাগলকে কিনা আমি রিয়েলিটি বোঝাচ্ছি… হায়রে কপাল!”
এনজাম কফির মগটা হাতে নিয়ে দু-বার চুমুক দিলো। প্রীতির উদ্দেশ্যে বললো,
– “সময় নিতে পারো চাইলে। এখনই বিয়ে করতে হবে, এমন কিন্তু কোনো কথা নেই। মায়ের চিন্তা করতে হবেনা, সেটা আমি দেখে নেবো।”
প্রীতি ফোঁস করে দম ছেড়ে বললো,
– “উঁহু, মন থেকেই রাজি আমি। একদম হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে। এরও একটা কারণ আছে। নিজের মধ্যে ওয়ান পার্সেন্ট ও আফসোস থাকলে আমি সেটা মেনে নিতে পারিনা। আই নো হু আই অ্যাম অ্যান্ড হোয়াট আই ডিজার্ভ।
যদিও আমার লাইফে দুঃখ টুঃখ জায়গা করতে পারেনা, তবুও আনফরচুনেটলি একটু হলেও বাঁশ যে খেয়েছি, এটা স্বিকার করতে হবে। সেটুকু থেকে ফুল্লি মুভ অন করতে চাই, উইথ সামওয়ান এলস। সো…”
স্মিত হাসে প্রীতি। এনজাম কফিটুকু শেষ করে মগটা রাখে পাশে। প্রীতি তখনই রসিকতার ছলে বলে,
– “যান তো ভাই, বউয়ের কাছেই যান। সে আপনাকে চারটে তো দূর দুটো বিয়েও করতে দেবেনা, তাই প্রীতি খুবই প্রিটি হলেও তার দিকে তাকিয়ে লাভ নেই!”
বলামাত্র আলতো এক চাটি পড়লো তার মাথায়। এনজাম হাটুতে হাত রেখে ঝুঁকে বসে বলে,
– “কী আর করার! তবে যার কথা শুনেছেন, তার ব্যাপারে কিছুটা নিশ্চয়তা আমি দিতে পারি। তাকে আপনার পছন্দ হবেই, এবং আপনার জন্য পারফেক্ট বলা চলে।”
– “কেমনে পারফেক্ট হয়? আমার চাই ডার্ক চকলেট আর সে হলো প্রপার ভ্যানিলা আইসক্রিম। বাকি সবই ঠিক ছিলো, কিন্তু এই দিকটাতেই তো ঝামেলা! ধরুন তার সঙ্গে হাতে হাত রেখে ছবি তুললাম। তার হাত যদি আমার চেয়ে ফর্সা হয়, কোনো প্রেস্টিজ থাকবে?”
এনজাম প্রশস্ত হেসে উঠে দাঁড়ায়। প্রীতির সামনে এসে তার মাথায় হাত রেখে বলে,
– “এডিট করে পোস্ট দেবে, তাহলেই তো হলো।”
উল্টো ঘুরে সে চলে যায় উপরে, প্রজ্ঞার ঘরের দিকে। প্রীতি সোফার উপর পা তুলে বসলো। ফোনটা হাতে নিয়ে খালার সকালে পাঠানো দুটো ছবি নিরিখ করে দেখলো কয়েকবার। থুঁতনিতে হাত ঘষে মনেমনে বললো,
– “নট ব্যাড…”
.
ঘরে এসে আস্তে করে দরজাটা ভিড়িয়ে দিলো এনজাম। প্রজ্ঞার নাক অবধি কম্বল জড়ানো, আর প্রণয়কে দেখাই যাচ্ছেনা। ভ্রু কুঁচকে কাছে গিয়ে কম্বলটা একটু সরালো এনজাম। ছেলে মা-কে এমনভাবে জড়িয়ে ধরে ঘুমোচ্ছে যেন ছেড়ে দিলেই কোথাও পালিয়ে যাবে। প্রজ্ঞার ও একই অবস্থা। এনজাম বুকে হাত গুঁজে তাকিয়ে রয় কিছুক্ষন। এই ছেলে জীবনে মায়ের জন্য রাতে উঠে কাঁদেনা, কালই অমন করতে হলো? শাশুড়ি,শালীর পর এবার ছেলেও তার সঙ্গে শত্রুতামো করছে। একটু হিংসাই হলো বোধ হয় তার। খুবই সাবধানে প্রণয়কে কোলে তুলে প্রজ্ঞার অন্যপাশে শুইয়ে গায়ে কম্বল টেনে দিলো। ঘড়িতে সময় দেখলো একবার। সাড়ে সাতটা বাজে। নাহ, বেশি বাজেনি। নিজেও তাই শুয়ে পড়লো প্রজ্ঞার পাশে। ঠিক প্রণয়ের জায়গায়। মেয়েটির বুকে মাথা রেখে তার পেট জড়িয়ে ধরে চোখ বুজলো সে। প্রজ্ঞাও ঘুমের মাঝে তার পায়ের উপর পা তুলে গাঢ় ঘুমে তলিয়ে যায়। এনজাম এখন ঘুমোবেনা। তাই প্রজ্ঞাকেও এভাবে শান্তিতে ঘুমোতে দিতে মন চাইলোনা। ধীরেধীরে হাত বাড়িয়ে কানের পাশে সুরসুরি দিলো কয়েকবার। চোখ কুঁচকে ঘুমের মাঝে হাতটা সরিয়ে দিলো প্রজ্ঞা। তবে এনজাম থেমে যায়না। আলতো স্পর্ষে হাত বুলিয়ে দেয় সমগ্র মুখে। প্রজ্ঞা এবার রেগেই গেলো খুব। চোখ খুলে এনজামকে না দেখেই এক চড় বসালো তার গালে। পরমুহূর্তেই তাকে দেখতে পেয়ে জিভ কামড়ে গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
– “এমা! তুমি কখন এলে? সরি সরি, বুঝতে পারিনি আমি।”
এনজাম নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
– “আমার গাল টা কী তোমার জন্য সরকারি সম্পদ হয়ে গেছে? এমনিতেই তোমার নাক ডাকার শব্দ শুনে আমি ঘুমের মধ্যে ভেবেছি কেউ কানের সামনে হাতুড়ি পেটাচ্ছে।”
প্রজ্ঞা বড়বড় চোখে চেয়ে বললো,
– “তাহলে তুমি কেন পাশে শুয়ে ঢোল বাজানোর মতো শব্দ করছো? বুঝি না!”
– “আমার কি কোনো স্বাধীনতা নেই? অন্তত নাক ডাকার স্বাধীনতা!”
– “নাক ডাকার জন্য স্বাধীনতা লাগে না, দরকার সাইলেন্সার লাগানো।”
এনজাম মুখ বিকৃত করে বলে,
– “তোমার কাছে আসাটাই ভুল। থাকো একা…”
এনজাম রেগেমেগে উঠতেই নিচ্ছিলো, এমন সময় প্রজ্ঞার পাশ থেকে প্রণয় ঘুমের মাঝে চোখ বুজেই উঠে তাদের দুজনের কম্বলের উপর শুয়ে পড়লো। ঠিক মাঝখানে, দু-হাতে দুজনকে ধরে। প্রজ্ঞা-এনজাম হা করে চাইলো একে অপরের দিকে। ফিঁক করে হেসে উঠলো মুহূর্তেই। এনজাম তাকে উঠিয়ে এনে নিজেদের মাঝে কম্বলের নিচে শুইয়ে দিলো। দুপাশ থেকে জাপটে ধরে একসঙ্গেই জোরেশোরে চুমু খেলো তার দু-গালে। প্রণয় বিরক্ত হলো ঘুমের মাঝে, কুঁচকানো ভ্রু তার জানান দিলো। প্রজ্ঞা-এনজাম আবারো হেসে নাক ঘষলো তার গালে। এনজাম ফিসফিসিয়ে বললো,
– “এইযে বাপের রোম্যান্সে বাম হাত ঢোকাচ্ছিস ব্যাটা, একদিন তোরও বিয়ে হবে, মাথায় রাখিস!”
— — —
তিনদিন ধরে শাফায়াতের কোনো দেখা নেই। সেইযে কথা হলো, এরপর আর তাকে চেম্বারে খুঁজে পায়নি অ্যানি। তৃতীয় দিনে এসে চিন্তা হলো কিছুটা। লোকটা ঠিক আছে তো? এমনিতেই সেদিন তার কথা শোনার পর থেকে বড্ড মায়া হচ্ছে। মানুষ এমনটা কী করে করতে পারে? সন্তানের কথা কেন ভাবেনা তারা? যদিও সে উপায় না থাকে, তবে তার ভবিষ্যৎ জীবনটা এমন অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়া থেকে বাঁচাতে পারেনা কেন? তাকে সমাজের কটু কথা থেকে আড়ালে রাখার চিন্তা এদের মাথায় কেন আসেনা? কেন তারা চেষ্টা করেনা?
প্রায় ঘণ্টাখানেক যাবৎ ফোন হাতে পায়চারী করতে করতে অবশেষে শাফায়াতের নম্বরে কল করতে সক্ষম হলো অ্যানি। জিহ্বা দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে কানে ধরলো ফোনটা। তার সঙ্গে এর আগে কখনো ফোনে কথা হয়নি। কী জানি আজ রিসিভ করবে কিনা!
তিনটে রিং হবার পর অ্যানি ভেবেই নিলো, কলটা সে রিসিভ করবেনা। ফোন সামনে এনে কেটে দেওয়ার মুহূর্তেই সে রিসিভ করলো কলটা। সালামের আওয়াজ শুনে দ্রুতবেগে ফোনটা কানে ধরলো অ্যানি। উত্তর দিয়ে নিজেও সালাম দিলো। শাফায়াত এবারে উত্তর দিয়ে বললো,
– “কে বলছেন?”
অ্যানি খানিকটা ইতস্ততবোধ করলো। আমতা আমতা করে বললো,
– “আমি… মানে, আমি হলাম গিয়ে…”
– “অ্যানি?”
জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বলে শাফায়াত। অ্যানি অবাক হয়ে শুধায়,
– “বুঝলেন কী করে?”
– “বুঝিনি। মনে হলো।”
মৃদু হেসে বললো শাফায়াত। অ্যানি সময় নিয়ে বলে,
– “আপনার দেখা নেই কদিন ধরে, তাই…”
– “খোঁজ করছিলেন নাকি?”
বলেই দু-বার কেশে উঠলো শাফায়াত। অ্যানি উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে,
– “আপনি কী অসুস্থ?”
শাফায়াত কাশি থামিয়ে গলা খাকড়ি দিয়ে বলে,
– “ঐতো, কিছুটা।”
– “কী হয়েছে?”
– “দুদিন ধরে টেম্পারেচার ১০২ প্লাস ছিলো। বর্তমানে মেইবি ১০০ প্লাস। সঙ্গে ঠান্ডা,কাশি,গলা ব্যাথা ফ্রি।”
অ্যানি অবাক স্বরে বলে,
– “এটা সামান্য?”
– “হ্যা। তাছাড়াও এখন সুস্থবোধ করছি।”
– “কী করে?”
– “লোকে বলে ডাক্তারের দর্শন পেলেও নাকি রোগ গায়েব হয়ে যায়।”
অ্যানি বুঝি লজ্জা পেলো কিছুটা। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে বললো,
– “প্রথমত আমি এখনো ডাক্তার হইনি। দ্বিতীয়ত আপনি আমার দর্শন ও পাননি।”
শাফায়াত শব্দ করে হেসে বলে,
– “কণ্ঠের দর্শন ও কাজে দিতেই পারে।”
প্রসঙ্গ বদলে জানতে চাইলো অ্যানি,
– “ঔষধ খেয়েছিলেন?”
– “উঁহু। শরীরে যথেষ্ট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে, বাড়তি ঔষধ খেয়ে নিজের ক্ষতি করবো কেন? আপনি তো ভবিষ্যৎ ডাক্তার, জানার কথা।”
– “তাই বলে অসুখ নিয়ে বসে থাকবেন?”
– “বেশ ইনজয় করছি তো। সারাদিন শুয়েবসেই কাটাচ্ছি। আরাম করা হয়না বহুদিন।”
খানিক বাদে জানতে চায় অ্যানি,
– “একাই থাকেন? কোনো আত্মীয় নেই শহরে?”
– “উঁহু,নেই।”
– “কী করে পারেন? আমিতো সুস্থ অবস্থাতেও দুদিন একা থাকতে পারিনা। দমবন্ধ হয়ে আসে।”
শাফায়াত কেমন করে হাসলো যেন। শব্দ শোনা যায়না, তবে বোঝা যায়। ক্লান্তস্বরে বললো,
– “খারাপ কিংবা ভালো, কোনো সময়ই মানব সঙ্গ পেয়ে আমি অভ্যস্ত নই, অ্যানি। অভ্যাস হয়ে গেলেই মস্ত বড় ঝামেলা!”
শুকনো এক ঢোক গিললো অ্যানি। হুট করেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো,
– “খেয়াল রাখবেন নিজের। রাখছি…”
– “হুম।”
শাফায়াতই কাটলো ফোনটা। যাক, কেউ তো খবর নিলো তার!
অস্বিকার করা এক বিশাল আক্ষেপ শাফায়াতের, এ জীবনে সে প্রকৃত বন্ধু নামক কাউকে পেলোনা। যাদের পেয়েছে বন্ধু হিসেবে, তাদের অধিকাংশই নিজেদের প্রয়োজনে কাজে লাগিয়েছে তাকে। পরবর্তীতে যোগাযোগ রাখেনি। আর বাকিদের সঙ্গেও সচরাচর কথা হয়না। পরিবার এবং কর্মক্ষেত্রে ব্যতীত হাতেগোনা দু তিনজনের সঙ্গে কথা হয় তার। যার মধ্যে অন্যতম একজন হলো প্রীতি। তাকে সে সহযোগী কম, বন্ধু মানে বেশি। এর বাহিরে এই একজন, অ্যানি। গত দু-মাসে যার সঙ্গে বেশ কিছুটা সময় কাটানো হয়েছে। কথা বলা হয়েছে, অনেক ব্যক্তিগত কথাও বলা হয়েছে, যা সে সচরাচর কাউকে জানায় না।
মুচকি হেসে বিছানা ছাড়লো শাফায়াত। ভাত বসিয়ে দেবে এখন। ডিম ভেজে খেয়ে নেবে। আর কিছু রান্না করার ইচ্ছে নেই আজ।
— — —
প্রীতি কদিন ধরে প্রজ্ঞার কিছু অদ্ভুত কার্যকলাপ লক্ষ্য করছে। এই যেমন, খেতে বসলে সামান্য কিছু খেয়ে উঠে চলে যায়। মুখে বলে তার খিদে পেয়েছে কিন্তু খেতে বসলে আর গলা দিয়ে নামেনা কিছু। মাছ মাংস দেখলেই তার বমি পাচ্ছে। এই যেমন রাতে ডাইনিং টেবিলে বসে ইলিশ মাছ দেখা মাত্রই ছুটে ঘরে চলে এসেছে। প্রীতিও এলো তার পিছুপিছু। দুপুরের পর আর কিছু খায়নি, দুপুরেও অফিসে বসে কেবল একটা কমলা খেয়েছিলো বলে পেটে কিছুই নেই তেমন। বমি হলো সামান্য। প্রীতি চোখেমুখে পানি দিয়ে বিছানায় নিয়ে বসালো তাকে। ভ্রু কুঁচকে চেয়ে কিছুক্ষন পর্যবেক্ষণ করলো। পাপিয়া আক্তার প্রণয়কে খাওয়াচ্ছিলেন বিধায় আর এলেন না এদিকে।
প্রজ্ঞা চোখমুখ মুছে নিলো তোয়ালে দিয়ে। মাথা চেপে ধরে বসে ছিলো। প্রীতি জহুরীর চোখে চেয়ে বলে,
– “ঐ, এদিকে তাকা।”
প্রজ্ঞা চোখ তুলে চাইলো। কয়েক সেকেন্ড বাদে প্রীতি সরাসরি জিজ্ঞেস করে বসলো,
– “আর ইউ প্রেগন্যান্ট?”
প্রজ্ঞা যেন আকাশ থেকে পড়লো। নিজের দিকে আঙুল দেখিয়ে বিস্ময় কণ্ঠে বললো,
– “আমি?”
– “নাহ…আমি!”
মুখ বেঁকিয়ে বললো প্রীতি। প্রজ্ঞা হা করে তাকাতেই বলে,
– “তুই ছাড়া আর কে আছে এখানে?”
প্রজ্ঞা হতবিহ্বল কণ্ঠে থেমেথেমে বলে,
– “কিন্তু…আমি! কী করে?”
প্রীতি ধপ করে বসে পড়লো সোফায়। লম্বা দম টেনে কপাল চাপড়ে বললো,
– “আল্লাহ, দড়ি ফালাও, আমি উঠে আসি।
এই গর্দভ, কী বলিস তুই এগুলো?”
প্রজ্ঞা উঠে দাঁড়িয়ে ভাবুক স্বরে বলে,
– “আমি প্রেগন্যান্ট?”
– “সেটা তো তোর আর তোর জামাই এর জানার কথা। আমি কেমনে জানবো?”
– “বাচ্চা আমার পেটে থাকলে জামাই কী করে…. ওহ, হ্যা…জামাই তো জানবে। কিন্তু না, জামাই তো জানেনা!”
প্রীতি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
– “তুই আগে বল, সম্ভাবনা আছে কি না?”
প্রজ্ঞা কিছুক্ষন ভেবে মাথা উপরনিচ করতেই উঠে দাঁড়ালো প্রীতি। কাছে এসে বললো,
– “তাহলে আর এত জানা অজানার কী আছে? কাল টেস্ট করে নিস, সিওর হয়ে যাবি।”
প্রজ্ঞার গোলগোল চোখ, অবিশ্বাস্য চাহনি দেখে হেসে ফেললো সে। বোনের গাল দুটো জোরসে টেনে দিয়ে বললো,
– “ওরে আমার বোনটা রে! আ’ম সো এক্সাইটেড টু কংগ্রাচুলেট ইউ এগেইন।”
বিছানায় গিয়ে বসলো সে। প্রজ্ঞার তখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা তার কথা। ঔষ্ঠ্যদ্বয়ের মধ্যকার ফাঁকা স্থান থেকে মশাও ঢুকে যেতে পারে। পিছু ঘুরে পুনরায় খাটের কাছে এসে দাঁড়ালো সে। প্রীতির বাহুতে দু-বার খোঁচা দিয়ে বললো,
– “এই!”
– “কী?”
বিছানায় বসলো প্রজ্ঞা। গালে হাত ঠেকিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বললো,
– “আসলেই?”
#চলবে?
#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_৩২
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন
– “কোনো জাদু-টোনা করেছেন নাকি আমার বাড়ির দুই পাগলের উপর? হুট করে তাদের মধ্যকার প্রেম এমন উপচে পড়ছে যে আমি রীতিমতো বিরক্ত হচ্ছি!”
শাফায়াত হাসলো তার কথা শুনে। কফির মগে চুমুক দিয়ে বললো,
– “আমার কথা কেবলই একটা উছিলা। ওদের মধ্যে এই আন্ডার্সট্যান্ডিং টা আসার কথাই ছিলো।”
প্রীতি অবাক চোখে চেয়ে থেকে গলা ছেড়ে হাসতে আরম্ভ করলো। শাফায়াত ভ্রু কুঁচকাতেই বললো,
– “আন্ডার্সট্যান্ডিং? ভাইজান, আপনি তো ওদের চিনতেই পারেন নি! দেখবেন, দুদিন বাদে আবার চুলোচুলি করে আপনার কাছেই ছুটবে। মিলিয়ে নিয়েন এই প্রীতির কথা।
যাকগে, আপনার খবর বলুন। স্বাস্থ্য ভালো এখন?”
– “হুম, আছি ঠিকঠাক। তোমার খবর বলো।”
– “শুনুন কী হয়েছে… আজ সকালে…”
বলতেই পারলো না প্রীতি। পেট ফেটে হাসি পেলো তার। হাসি থামিয়ে আবারো বলতে চায়। এবারেও হাসির চোটে কথা আটকে আসে। শাফায়াত বিরক্ত হয়ে বলে,
– “আগে বলো, তারপর হাসো। এভাবে ইন্টারেস্ট জাগিয়ে হাসার কোনো মানে হয়?”
– “আরে আমি কী করবো? হাসি পেলে আমার দোষ? আচ্ছা, শুনুন।”
.
আনুমানিক সকাল দশটা বাজে তখন। প্রজ্ঞা অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে। প্রণয় তখনো ঘুমে, প্রীতি ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করার মাঝেই আচমকা ‘MD Swajan Haydar’ নামের এক ফেইসবুক আইডি থেকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট এর নোটিফিকেশন আসে। প্রীতি চোখ বড়বড় করে আইডি তে ঢুকে নিশ্চিত হয়, এটা আসলেই স্বজনের আইডি। কিন্তু সে নিজে থেকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট দিচ্ছে! ব্যাপারটা ঠিক হজম হলোনা। পুরাদস্তুর ম্যাচিউর এক পুরুষ সে। কোনো মেয়ের সঙ্গে বিয়ের কথা চলছে মানেই তাকে রিকুয়েস্ট দিয়ে দেবে, এমনটা হবার কথা নয়। যদিও প্রীতি শুনেছে, স্বজনের মায়ের নাকি তাকে খুব পছন্দ হয়েছে।
দু-তিন মিনিটের ভাবনা চিন্তার শেষে সে এক্সেপ্ট করলো রিকুয়েস্টটা। কিন্তু একি! মিনিটখানেক এক মাঝে তার আইডি থেকে সোজা কল চলে এলো মেসেঞ্জারে। কী ভেবে তা রিসিভও করলো প্রীতি। কানে ধরে বললো,
– “আসসালামু আলাইকুম…”
অপর পাশ থেকে ফিসফিসানো ব্যতীত কোনো আওয়াজ এলোনা কানে। প্রীতি গলা খাঁকড়ি দিয়ে শুধায়,
– “হ্যালো?”
তারও প্রায় মিনিটখানেক পরে অপর প্রান্ত থেকে এক পুরুষ ব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
– “আব… এক্সট্রিমলি সরি। আসলে কলটা আমি দেইনি। আমার দুজন ভাস্তে ফাজলামো করে… কিছু মনে করবে না… মানে, কিছু মনে করবেন না প্লিজ!”
– “আপনি?”
– “স্বজন… চেনেন বোধ হয়।”
প্রীতি ঠোঁট চেপে হেসে বললো,
– “আচ্ছা, সমস্যা নেই। ভাস্তে রা কি ছোট খুব?”
স্বজন চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
– “সাইজেই ছোট, কাজ বাজ করে বড়দের মতো।”
স্বভাবতই শব্দ করে হেসে উঠলো প্রীতি। স্বজন পুনরায় ক্ষমাসুলভ কণ্ঠে বলে,
– “ওরা কিছু বলে থাকলে মাইন্ড করো না। মানে… মাইন্ড করবেন না। সরি, আসলে প্রজ্ঞা তো আমার বোনের মতো তাই…”
প্রীতি চোখ বড়বড় করে বলে ওঠে,
– “তাই আমিও বোনের মতো?”
বলেই আবার জিভ কামড়ে নিজের মাথায় এক চাটি মারলো প্রীতি। বোঝালো নিজেকে,
– “কনট্রোল ইয়ার! কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলছিস?”
স্বজন একটু থতমত খেয়ে বলে,
– “কীহ?”
– “না না, কিছুনা। আপনি তুমি করে বলতে পারেন, সমস্যা নেই।”
কিছুটা সময় কেটে যায়। কেউ আর কথা খুঁজে পায়না। আবার ফোন কাটার কথাটাও বলতে পারেনা। প্রীতি নিজে থেকেই জানতে চায়,
– “খালা, মানে আমার খালামনির কী হন যেন আপনি?”
– “আনফরচুনেটলি, আমি নিজেও জানিনা। একবার যা শুনেছি, তা মাথায় নেই।”
– “ওহ।”
– “হুম… এগেইন,সরি।”
.
– “মানে আপনি ভাবতে পারেন! একটা কল এর জন্য এই ব্যাডায় আমারে তিন চারবার সরি বলছে। তার উপর যেভাবে মিনমিন করছিলো, তা আর না-ই বলি। অথচ সামনাসামনি এতটা বলদ মনে হয়না।”
– “কথাবার্তা তো ভালোই এগিয়েছে মনে হচ্ছে। নাহলে তার ভাস্তেরা একেবারে কলই করে ফেলবে!”
প্রীতি বিরক্তির স্বরে শুধায়,
– “আমি কী করে জানবো বলুন তো? পাত্রী হওয়ার এই আরেক জ্বালা। সব আলোচনা চলে আমার আড়ালে। কেন রে ভাই! বিয়ে আমার, সংসার আমি করবো, তো আমার সামনে সব কথা বলতে সমস্যা কীসের?”
শাফায়াত আড়মোড়া ভেঙে আরাম করে বসে বললো,
– “আসলে… বিয়ে করা উচিৎ প্রীতি।”
প্রীতি মুচকি হেসে বলে,
– “অবশেষে আপনার মাথায় বিয়ের চিন্তা উদয় হলো? কেন কেন? পছন্দ কাউকে?”
শাফায়াত মৃদু হেসে শুধায়,
– “বুঝতে পারছি না। মূলত মেয়েদের দিকে সেভাবে নজর দেই না। আজকাল একজনকে চোখে পড়ে।”
– “হয়েছে ভাই, এত ভদ্র সাজতে যাবেন না। মেয়েদের দিকে নজর না দিলে আপনার এক্স কী আকাশ থেকে টপকেছে?”
একটু হাসে শাফায়াত,
– “তার বিষয়টা ভিন্ন। সেক্ষেত্রে দুজনের ইচ্ছে ছিলো। এইটুকুই ভেবেছিলাম যে, চলে,একসাথে থাকা যায়,সময়টা ভালো কাটে।”
– “এবারের টা অন্যরকম?”
শাফায়াত মাথা নোয়ালো। প্রীতি টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে গালে হাত রেখে বসলো। তার দিকে চেয়ে শান্ত গলায় বললো,
– “ফ্রিতে একটা পরামর্শ নেবেন?”
– “হুম?”
– “কাউকে সামান্যতম পছন্দ হলেও আগে জানার চেষ্টা করবেন, সে আপনাকে পছন্দ করে কিনা। আসলে পছন্দ অনেকভাবেই করা যায়… মূল বিষয়, সে আপনাকে অন্য নজরে দেখে কিনা। এটা আগেই জানা প্রয়োজন। পরবর্তীতে আশাহত হলে তা সবাই মেনে নিতে পারেনা। যেমন আপনি পারবেন না।”
শাফায়াত ভ্রু কুঁচকে বলে,
– “আমি? ভুল ভাবছো… আমি যেকোনো কিছু সহজেই মেনে নিতে পারি। তেমন একটা প্রবলেম হয়না।”
– “সবকিছু যারা মেনে নিয়ে অভ্যস্ত, অনেক সময় সামান্য বিষয়টাতে তারাই আঘাত পেয়ে বসে।”
একটু গম্ভীর গলায় বলে আবারো হেসে উঠলো প্রীতি,
– “আমিতো আপনার ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখছি ভাইসাব। ধরুন, মেয়েটা আপনাকে রিজেক্ট করলো, আর আপনি বিরহে আচ্ছন্ন হয়ে গাইছেন,
‘প্রেমে পড়া বারণ,
কারণে অকারণ।
ঐ মায়া চোখে চোখ রাখলেও,
ফিরে তাকানো বারণ!’
তখন সামনে বসে হাসলে কিছু বলতে পারবেন না।”
শাফায়াত ভ্রু কুঁচকে শুধায়,
– “তুমি গানও গাইতে পারো?”
প্রীতি খানিকটা ভাব নিয়ে বললো,
– “আমি কী পারিনা সেটা জিজ্ঞেস করুন। নাচ,গান,পেইন্টিং,আবৃত্তি,বিতর্ক,সাতার,রান্না কোনোটাতেই না নেই। আমি সবই পারি। একেবারে অল রাউন্ডার যাকে বলে। তবুও কেউ সম্মান দেয়না। এই দুঃখ কই যে রাখি!”
প্রীতির নতুন চেম্বারে একবার ঘুরতে এসেছিলো শাফায়াত। কোর্ট চত্ত্বর এর পাশেই। গল্পগুজব শেষে তারা বেরোলো একসঙ্গে। শাফায়াত যাবে নিজের চেম্বারে, আর প্রীতি যাবে উল্টোপথে, বাড়ির দিকে। বিদায় নিয়ে রিক্সায় উঠলো প্রীতি। আকাশপানে চেয়ে হাসিমুখে গুনগুনিয়ে গাইলো,
“তোমায় যত গল্প বলার ছিলো…
সব পাপড়ি হয়ে গাছের পাশে, ছড়িয়ে রয়েছিলো
দাওনি তুমি আমায় সেসব কুড়িয়ে নেওয়ার কোন কারণ
প্রেমে বড়া বারণ…”
।
জুনিয়র কর্মচারীদের সঙ্গে কিছু বিষয় নিয়ে দীর্ঘক্ষণ যাবৎ আলোচনা করছিলো প্রজ্ঞা। এরই মাঝে এনজাম আর নাহলেও চারবার কল করেছে। কল কেটে দিচ্ছে দেখার পরও অফিস টাইমে এতবার কল করার কী মানে? সবাই চলে যাওয়ার পর ফোনটা হাতে তুলে দেখলো মোট ছয়টা মিসড কল। রেগেমেগে কল ব্যাক করেই বললো প্রজ্ঞা,
– “সমস্যা কী তোমার? কল কেটে দিয়েছি মানে বুঝতে পারছোনা ব্যস্ত আছি? অফিস টাইমে এভাবে বিরক্ত করার কোনো মানেই হয়না।”
এনজাম তার কথার প্রেক্ষিতে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো,
– “এই একই কাজ তুমি করলে কী হতো? নিজের বেলায় সাত খু’ন মাফ না?”
– “অবশ্যই। তোমাকে জ্বালানো আমার বউগত অধিকার।”
– “তাহলে আমার টাও বরগত অধিকার।”
– “নিজের অধিকার বোঝাতে কল করে বিরক্ত করছো?”
প্রজ্ঞা কথার মাঝেই ফুঁসে উঠছে বারবার। এনজাম ভ্রু কুঁচকে শুধায়,
– “যে কারণেই করিনা কেন, তুমি এমন খ্যাঁচখ্যাঁচ করবে কেন? ‘আর ঝগড়া করবোনা’ বলে কান্নাকাটি কে করছিলো? দয়া মায়া দেখিয়ে একটু কাছে টেনে নিয়েছি বলে ভেবোনা তোমার নাটক দেখবো বসে বসে।”
– “ওয়াও, দয়া-মায়া? তুমি তো এমন করে বলছো, যেন আমাকে আশ্রয় দিয়ে মস্ত বড় উপকার করছো! মনে করিয়ে দেই, নাটকটা শুধু আমিই করি না, তুমি শুরু করো!”
– “হ্যাঁ, আমার শুরু করা নাটক… কিন্তু তোমার দেওয়া সংলাপেই সুপারহিট হয়। নাটকের নাম, ‘বউ যখন ডায়লগ কুইন!”
– “পুরাদস্তুর জাজ এর কাজ শুরু করেছো নাকি? এখন স্কোর ও দেবে?”
– “অবশ্যই! এই দৃশ্যের স্কোর ৯/১০। মেজাজ ঠিক থাকলে ১০ এ ১০ পেতে।”
প্রজ্ঞা চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
– “তাহলে আমিও তোমাকে আর তোমার নাটককে মার্কস দেই। দুটোতেই ২/১০। কারণ একটাও জাতের না।”
এনজাম ফুঁসে উঠে বলে,
– “এই অজাতের ঘরে আর আসতে হবেনা। সামনে যথেষ্ট সুন্দরী মেয়ে দেখছি। একটু আকটু স্টাইল করে বের হলে একজনের বেশি-ও পটে যাবে। তোমাকে আর লাগবে না।”
প্রজ্ঞা কথা বলেনা দেখে এনজাম একটু বিব্রত হলো। ঠোঁট ভিজিয়ে কিছু বলার পূর্বেই সে কাটকাট গলায় শুধায়,
– “বাসায় আয়। সামনে দেখলেই রোম্যান্স এর নানা নানি এসে ভর করে হুম? আসিস এবার, শুধু ছেলে না, নিজের নামও ভুলবি তুই।”
এনজাম শুকনো ঢোক গিলে বলে,
– “আপাতত নিজের হোয়াটস অ্যাপ টা চেক দাও। ফালতু প্যাঁচাল পারার টাইম নাই আমার। ফোন রাখো।”
এনজাম কলটা কেটে দিতেই ফোনটা ছুড়ে মা’রতে গিয়ে থেমে যায় প্রজ্ঞা। ফোনের উপর রাগ ঝাড়া ঠিক নয়। টেবিলের উপর রেখে দিয়ে কিছুক্ষণ চোখ নাক কুঁচকে বসে রইলো সে। ফোনের দিকে চাইলো বারকয়েক। কী এমন পাঠিয়েছে? রিলস ছাড়া আর কি-ই বা এমন মহা মূল্যবাদ সম্পদ পাঠাতে পারে সে?
প্রায় দশমিনিট বাদে ফোনটা হাতে তুলে হোয়াটস অ্যাপ এ ঢুকলো প্রজ্ঞা। একটা ছবি পাঠিয়েছে এনজাম, কোনো এক চিঠি মনে হচ্ছে। ভ্রু কুঁচকে সেটা জুম করে কয়েক লাইন পড়তেই ভ্রুযুগল শিথিল হয়ে এলো তার।
স্পষ্ট লেখা, একজনের টার্মিনেশন লেটার এটা। চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। ব্যক্তির নামটা দেখে চোখ আটকে যায় প্রজ্ঞার। এটা তো সেই মেয়েটার নাম, যাকে সে এনজামের আইডি থেকে ব্লক করেছিলো। অবশ্য এনজাম ও এর আগে তার দুটো আইডি ব্লক করেছে। এর জন্যই তো তাদের মাঝে ঝামেলাটা হলো সেদিন। তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে!
সম্পূর্ন লেটার টা পড়ে আর বুঝতে বাকি রইলো না, তার চারিত্রিক ত্রুটির কারণেই এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
চোখ বুজে ফোনটা নামিয়ে রাখে প্রজ্ঞা। কী হচ্ছে? একটুখানি অপরাধবোধ? কিন্তু সে তো সন্দেহ করেনি এনজামকে। শখের বরটার প্রতি একটু বেশি যত্নশীল বলেই তো মাঝেমধ্যে বাড়াবাড়ি করে ফেলে। এটা তো কোনো দোষ নয়।
টুংটাং শব্দ তুলে দুটো মেসেজ এলো ফোনে। পুনরায় ইনবক্সে গিয়ে এনজামের পাঠানো মেসেজ দুটো পড়লো সে। প্রথমটাতে লেখা,
– “কমপ্লেইন টা আরো মাসখানেক আগের করা। মনে করে দেখো, একদিন ফোন টোন না তুলে বেশ রাত করে বাড়ি ফিরেছিলাম। এই মহিলার জন্যই মেজাজটা চটে ছিলো। আমি বদরাগী নই, আর না চরিত্রহীন। সরাসরি জিজ্ঞেস করলেই সব উত্তর পেয়ে যেতে। আমার সামনে এলেই যে বোকা হয়ে যাও, এটাই সমস্যা। একে ব্লক করা নিয়ে আমার ব্যবহার যদি অযৌক্তিক হয়, তাহলে তোমার চিন্তাগুলোও অযৌক্তিক। মানতে শেখো, বুঝতেও শেখো।”
পরের মেসেজে বেশ নরম ভাষায় লিখেছে সে,
– “পথভ্রষ্ট হয়ে যে বেশ ক’বছর যাবৎ সাগরে ভাসছে, তাকে নতুন করে পথভ্রষ্ট করার সাধ্যি আছে কার?
প্রজ্ঞা, একটা দীর্ঘ সময় আমি কাটিয়ে এসেছি। বড়সড় কোনো ভুল করার বিস্তর সম্ভাবনা ছিলো। তখনই যেহেতু ভুলটা করিনি, আজকের সময়ে এসে এই চিন্তা করো কী করে? একটা কথা বলে রাখি আজ, সবকিছু করতে পারো,মেনে নেবো। বাট আই রিকুয়েস্ট, ডোন্ট ডু দিস। ডাউট ওয়ার্ড টা ভীষন অপছন্দের।
সেদিনের ব্যবহারের জন্য সরি… এই টপিক এখানেই শেষ।”
প্রজ্ঞা কী বলবে বুঝে উঠতে পারেনা। এনজাম আবারো ভুল বুঝছে তাকে! এটা অবশ্য অস্বাভাবিক নয়। তবুও…
প্রজ্ঞার ভাবনার মাঝে আরো একটা মেসেজ পাঠালো এনজাম,
– “একজনেতে চোখ আটকে যাওয়া মানে বোঝো? তাকে ছাড়া গোটা জগতটাই ঘোলাটে লাগতে শুরু করে।
এই ঘোলাটে নজর অন্যকারো উপর পড়ার আগে নিশ্চিত দৃষ্টিশক্তিই হারিয়ে বসবো।”
প্রজ্ঞা নাক টেনে কাপাকাপা আঙুল চালিয়ে লিখলো,
– “চোখদুটো কোটরে থাকলে তো!”
মিনিটখানেক এর মাঝে আইডি এবং পাসওয়ার্ড সেন্ড করে বললো এনজাম,
– “আপনার কাছেই রাখুন ম্যাডাম। বউগত অধিকার!…”
প্রজ্ঞার নিজেকে ছোট মনে হলো কিছুটা। লিখলো,
– “চাইনি।”
পরমুহূর্তে পাসওয়ার্ড এর দিকে নজর যেতেই ভ্রু কুঁচকে এলো তার। কর্কশ কণ্ঠে ভয়েস মেসেজ পাঠালো,
– “আবার I love dragon!”
— — —
একরাশ উৎসাহের সহিত বেশ কিছুক্ষন যাবৎ ওয়াশরুমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার পর থমথমে মুখে বেরিয়ে এলো প্রজ্ঞা। প্রীতি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই হাতে থাকা স্ট্রিপটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো সে। প্রজ্ঞার মুখভঙ্গি দেখে প্রীতি ধারণা করে নিলো, রেজাল্ট নিশ্চই নেগেটিভ এসেছে। ইশ, কত উৎসাহিত ছিলো সে! উদাস হয়ে স্ট্রিপটা চোখের সামনে ধরতেই চমকে উঠলো প্রীতি। স্পষ্ট দুটো দাগ দৃশ্যমান, অর্থাৎ রেজাল্ট পজিটিভ! খুশিতে লাফিয়ে উঠলো প্রীতি। প্রজ্ঞার দিকে চেয়ে গাল ভেঙে হেসে বললো,
– “তোর জামাইয়ের কপাল খারাপ ভাই। একবারও প্রথমে জানতে পারেনা। প্রণয়ের সময়ও আমি সবার আগে জেনেছি, আর এবারেও! প্রজ্ঞায়ায়ায়ায়া, আমার নাচতে ইচ্ছে করছে!”
প্রজ্ঞার সামনে এসে তার মাথাটা বুকে টেনে বললো প্রীতি,
– “কংগ্রাচুলেশন মাই জান! এবার তোর মেয়েই হবে দেখিস।”
প্রজ্ঞা প্রতক্রিয়াহীন। প্রীতি অবাক হলো এমনটা দেখে। পাশে বসে ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো,
– “কামের বেডি সকিনার মতো লুক দিয়ে বসে আছিস কেন? এই মেয়ে… কী হয়েছে তোর?”
প্রজ্ঞা তার দিকে চেয়ে নির্বিকার কণ্ঠে বলে,
– “কী হয়েছে তুই বুঝতে পারছিস না?”
– “নাহ! তুই কী কোনোভাবে আপসেট? কিন্তু কেন? দেখ, এটা একটা উপযুক্ত সময়। প্রণয় যথেষ্ট বড় হয়েছে। আর তোর এইজটাও একদম পারফেক্ট। বোকা মেয়ে, তোর তো খুশি হওয়া উচিৎ! মানুষ কত চেষ্টা করেও বেবি নিতে পারেনা, আর তুই প্ল্যানিং ছাড়াই…”
– “এটাই তো সমস্যা। আমার সাথে কেন এমনটা হতে হবে? মানে আমার ভাগ্যে মনে হয় লেখাই আছে, এ জীবনে তোমার কোনো শখ আহ্লাদ পূরণ হবেনা। এনজাইমের বাচ্চা আমার জীবনটা শেষ করে দিলো একদম!”
ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলে উঠলো প্রজ্ঞা। প্রীতি হা করে তাকাতেই ঠোঁট উল্টে বলে,
– “মানুষের জামাই একটু পাশে বসে। হাতটা ধরে বলে, ‘দেখো জান, উই হ্যাভ টু গ্রো আওয়ার ফ্যামিলি।’ তারপর বউয়েরা একটু লজ্জা পাবে, দু তিনবার পালিয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেও মত দেবে। অর্থাৎ একটা সুন্দর আলোচনা তো থাকবে! এক্সাইটমেন্ট থাকবে, আনন্দ থাকবে। তুই জানিস আমার কত্ত শখ বাচ্চা নিয়ে ডিসকাস করার?
কিছুই হলোনা! আমার সাথেই এমন হয় সবসময়।”
প্রজ্ঞা ফুঁপিয়ে উঠলো রীতিমতো। প্রীতি কয়েক সেকেন্ড আহাম্মকের ন্যায় চেয়ে থেকে ঘর কাপিয়ে হাসতে শুরু করলো। পেট চেপে ধরে বললো,
– “চিল না! পরের বার করিস আলোচনা।”
প্রজ্ঞা বড়বড় চোখে চেয়ে বলে,
– “পেটটা একবার কাটলে বুঝতে। তখন এই পরের বার কথাটা আর মুখে আসতো না। নার্স এরা প্রণয়ের সময় এমনিতেই ভয় দেখিয়েছে, সেকেন্ড টাইম নাকি কষ্ট আরো বেশি হয়। আমার এখন ই ভয় করছে। আর সে বলছে পরের বার!”
বলেই আবারো কাঁদোকাঁদো গলায় বললো সে,
– “আমার আলোচনার স্বপ্ন!”
প্রীতি ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকে বেশ হতাশ ভঙ্গিমায় প্রজ্ঞার মাথাটা টেনে বুকে জড়িয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো। বললো,
– “কোয়ি বাত নেহি। বারি বারি দেশো মে অ্যাসি ছোটি ছোটি ঘাটনা তো ঘাটতি র্যাহতি হে না! স্বপ্ন যাবে বাড়ি আবার বলে চল আমরা এক মিনিটের নিরবতা পালন করি।”
– “কিন্তু আমার স্বপ্ন!…”
পেট ফেটে হাসি পেলো প্রীতির। বহু কষ্টে নিজেকে সামলে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। নিজেও কাঁদোকাঁদো গলায় বললো,
– “কী আর করার! বেটার লাক নেক্সট টাইম…”
#চলবে?
#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_৩৩
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন
– “প্রথমবার এলেন নাকি এখানে?”
প্রীতির প্রশ্নে স্বজন চমকে উঠলো খানিকটা। পাশের টেবিলে বসা একটা মাস চারেক এর বাচ্চার সঙ্গে চোখে চোখে আলাপ হচ্ছিলো তার। শিশু ডাক্তার হওয়ায় বাচ্চাদের সঙ্গে এক বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে তার। প্রীতির প্রশ্নের জবাবে মুচকি হেসে বললো,
– “হুম, প্রথম। এক বছর আগেও এই ক্যাফে টা তৈরি হয়নি। আর দেশে আসার পর সেভাবে বেরোনোর সুযোগ হয়ে ওঠেনি। তুমি মনে হয় আসো মাঝেমধ্যেই। ওয়েটার দেখেই চিনে ফেললো।”
প্রীতি একটু হেসে বলে,
– “হুম, আমি আবার ঘোরাফেরা একটু বেশিই করি। একাএকাই পুরো শহর ঘুরে বেড়াই। তাই সবই চেনাজানা।”
দুজনেই এদিক ওদিক তাকালো বারকয়েক। পারিবারিক ভাবেই তাদের দেখা করতে পাঠানো হয়েছে। স্বজন এবং প্রীতি, দুজনের পরিবার ই অনেকটা আধুনিক মানসিকতার। তারা বলেছেন, যারা বিয়ে করবে তারাই আগে দেখুক নিজেদের, কথা বলুক, মত দিলে তখনই বাকি কথা এগোবে। তবে স্বজনের মায়ের কথায় নিশ্চিতভাবে বলাই যায়, প্রীতির তরফ থেকে উত্তর হ্যা এলে তিনি পরদিনই এসে পাকাকথা বলে যাবেন।
– “তোমার কিছু জানার থাকলে জিজ্ঞেস করতে পারো। আই হ্যাভ নো প্রবলেম।”
প্রীতি চাইলো তার পানে। লোকটা আসলেই অতিরিক্ত ফর্সা। এছাড়া সবদিক থেকেই ঠিকঠাক, পছন্দ হবার মতো। একটু কেশে বললো প্রীতি,
– “প্রশ্নের বদলে নিজেদের ব্যাপারে কিছু বলা উচিৎ আই থিংক। মানে, আমার দিক থেকে কিছু কথা বলার আছে। সরাসরিই বলতে চাই।”
– “হুম, বলুন।”
প্রীতি চোখ নামিয়ে টেবিলে হাত রেখে শুধায়,
– “প্রথমত, বয়স এবং মেন্টালিটি, দুদিক থেকেই আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি। তাই আমার থেকে বাচ্চাসুলভ আচরণ আপনি কখনোই এক্সপেক্ট করতে পারবেন না। আমার মাঝে চঞ্চলতা পাবেন, তবে বোকামি নয়। অন্যের অযৌক্তিক কর্ম দেখতে মাঝেসাঝে মজা লাগলেও আমি নিজে ভীষন যুক্তিবাদী একজন মানুষ। তাই আমার সঙ্গে সবাই খাপ খাইয়ে নিতে পারেনা কিংবা আমি নিজেকে সবার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারিনা। একটা দোষ বলতে পারেন এটাকে।”
স্বজন দু আঙুলে ভ্রু চুলকে শুধায়,
– “মায়ের খুব ইচ্ছে ছিলো আমার জন্য একটা বাচ্চা মেয়ে খুঁজে নিয়ে আসার, তাকে একেবারে সাজিয়ে রেখে দেবে। কত কষ্টে যে তাকে মানিয়েছি তা কেবল আমিই জানি। তোমার অবগতির জন্য জানিয়ে রাখি, বোকা মেয়ে আমি কখনোই বিয়ে করতাম না। সবসময় একজন বুঝদার, শিক্ষিত মেয়েই চেয়ে এসেছি। তাই এদিক থেকে সমস্যা হবার কথা নয়। তবে খাপে খাপ মিলিয়ে কখনো সঙ্গী পাওয়া যায় বলে আমার মনে হয়না। কিছু বিষয় অ্যাডজাস্ট করে নিতেই হয়।”
– “অবশ্যই… এ টু জেড কখনোই মিলবে না। তবে কিছু বিশেষ দিক মিলতে হয়। তার মধ্যে অন্যতম একটা হলো মেন্টালিটি। খানিকটা হলেও মিল চাই। কেননা আমি অতিরিক্ত কিছুই পছন্দ করিনা। অতিরিক্ত আবেগ ও না, আবার অতিরিক্ত বিবেক ও না। আই থিংক হাজবেন্ড ওয়াইফ এর ক্ষেত্রে সবকিছুর মধ্যে একটা ব্যালেন্স থাকা উচিৎ।
যাক… অনেক কিছু বললাম। আপনার দিকটা বলুন। কিছু তো চাহিদা আছে অবশ্যই?”
স্বজন গলা খাঁকড়ি দিয়ে বেশ আঁটসাঁট হয়ে বসলো। খুবই গুরুত্বের সহিত বলতে গিয়েও হেসে বললো,
– “চাহিদা? বলতে গেলে তো সমাজের ধারা অনুসরণ করতে হয়। যেহেতু আমি একজন ফ্যামিলি সিক পারসন, একটা সাধারণ ছেলে। সেই হিসেবে কিছু কমন চাহিদাই বলি।
আমি জয়েন্ট ফ্যামিলির ছেলে। একেবারে একান্নবর্তী পরিবার। সেখানে সবাই আছে। মা-বাবা, চাচা-চাচি, ভাই-ভাবী, দাদা, ভাতিজারা সব। সেই সূত্রে আমার বিশেষ ইচ্ছে থাকবে, আমার বউও তাদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকুক। পরিবারটাকে নিজের পরিবার ভেবে নিজেকে তাদের সঙ্গে জড়িয়ে নিক। কিছু ক্ষেত্রে নিজে থেকে এগিয়ে যাক।
উঁহু, তোমাকে ঘরের কাজ করতে হবেনা। রান্না বান্নাও করার সৌভাগ্য সেভাবে হবেনা, কেননা আমার মা চাচিরা এখনো বেশ তরতাজা। রান্নাঘরের দায়িত্বে তারাই থাকেন। তবে তাদের পাশে গিয়ে একটু দাঁড়ালে তারা কী যে খুশি হয়! ঐযে পাশে গিয়ে দাঁড়ানো, জিজ্ঞেস করা কিছু লাগবে কিনা, তারা এইটুকুতেই সন্তুষ্ট। নিজের বউয়ের মাঝে ঐটুকু গুণ থাকলেই আমার চলবে। আর তেমন কিছুই চাইনা।”
প্রীতি কিঞ্চিৎ হেসে শুধায়,
– “জয়েন্ট ফ্যামিলি শুনে লোভ লাগছে হুট করেই। আমার ফ্যামিলির কথা তো জানেন ই। বড় হয়েছি একেবারেই একা। তাই বড় পরিবারের দিকে একটা আগ্রহ আছে বলতে পারেন।”
খানিক বাদে প্রীতি তাকালো স্বজনের দিকে। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে বললো,
– “জানেন তো,এক জীবনে সবকিছু পেয়ে গেলে মানুষ কৃতজ্ঞতা হারিয়ে ফেলবে। সে জন্য-ই বোধহয় ওপরওয়ালা আমাদের সবকিছু দেননা। না পাওয়ার আক্ষেপ থাকে বলেই কিছু পেয়ে যাওয়ার মূল্য থাকে। আজ গোটা জগৎ আমায় নিয়ে আফসোস করলেও আমি জানি, সৃষ্টিকর্তা আমার জন্য অসম্ভব ভালো কিছু লিখে রেখেছেন। এই আশা, এই বিশ্বাস আছে বলেই আমি আজ ভালো আছি। ভীষণ ভালো আছি…”
স্বজন অবাক চোখে তাকাতেই সে আরো বললো,
– “অনেকের প্রেমের সম্পর্ক থাকে না? কিছু ক্ষেত্রে পূর্ণতা ও পেয়ে যায়, আবার অনেকেরটা পায়না। যারা প্রিয় মানুষকে পেয়ে যায়, তাদের মাঝে এইজন্য সামান্য হলেও একটা কৃতজ্ঞতা থাকে। তারা ভাবে, ‘আমি তো মানুষটাকে নাও পেতে পারতাম! তবুও পেয়েছি, উপরওয়ালা দিয়েছেন।’ এই ভাবনা থেকে তারা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার একটা স্পৃহা পায়। যদিও সবক্ষেত্রে না। আবার ধরুন একজন মেয়ে তার পছন্দসই স্বামী পেলো। সেও কিন্তু ভাবে, ‘লোকটা তো এতটা ভালো না-ও হতে পারতো! নিশ্চই আমার ভাগ্য ভালো,তাই তাকে পেয়েছি।’ এসব ভাবনা আজকাল মানুষের মধ্য থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। কৃতজ্ঞতা জিনিসটাই যেন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। কেউ সুখি না, সবার কত্ত দুঃখ! অথচ তারা ভাবেনা, দুঃখের মাত্রা এর চেয়েও বেশি হতে পারতো। কিংবা যেটাকে সে সুখ ভাবছে, পরিণতিতে গিয়ে সেটাই চরম দুঃখে পরিণত হতে পারতো।
আমি খুব ভাবি এসব নিয়ে। একজন মানুষের ভাবনায় প্রভাবিত হয়ে আজকাল আধ্যাত্মিক পর্যায়ে চলে যাচ্ছি।”
বলেই হেসে উঠলো প্রীতি। স্বজনের চোখে বিস্ময় নাকি মুগ্ধতা, সে ধরার চেষ্টা না করে খানিকটা গম্ভীর কণ্ঠে শুধায়,
– “আমি নিজের জীবন নিয়ে কৃতজ্ঞ থেকে এসেছি। বাবা দূরে থেকেছেন। বিশেষ দিনগুলোতে, স্কুলের প্রোগ্রামে থাকতেন না বলে প্রজ্ঞা কাঁদতো। আমি কাঁদতাম না। নাচের ম্যাডাম ছোটবেলায় শিখিয়েছিলো, সবার চেয়ে একটু বেশি ভাবতে। আমি ভেবেছি, আমার সঙ্গে মা থাকছে। অনেকের সঙ্গে তাও থাকছে না। এটা ভেবে বেশ ভালো সময় কাটিয়েছি। মনে কষ্ট রেখে মুখে হাসি, তেমনটা কিন্তু নয়। আমি মন থেকে ভালো থাকতে জানি।
ভবিষ্যৎ জীবনটাতেও নিজের এই বৈশিষ্ট্য আমি ধরে রাখতে চাই। সবসময় কৃতজ্ঞ থাকতে চাই। এমন কিছু কখনো আমার জীবনে না ঘটুক, যার কারণে অকৃতজ্ঞতা ভর করবে মনে।
আমি প্রেমিক চাইনা। বিয়ে করলে একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ চাই, যোগ্য স্বামীই চাই। কেননা আমি বিশ্বাস করি, একজন যোগ্য প্রেমিক স্বামী হয়ে উঠতে না পারলেও একজন যোগ্য স্বামী অবশ্যই ভালো প্রেমিক হয়ে উঠতে পারে। আমি কোনো অসাধারণ সম্পর্ক চাইনা। একটা সুস্থ, স্বাভাবিক, সাধারণ সংসার চাই। যেখানে পরিপূর্ণ আন্ডার্সট্যান্ডিং থাকবে। রাগ,অভিমান,মনোমালিন্য দুজনের দিক থেকে হলে সেটা মেটানোর দায়িত্বও দুজনের ই থাকবে। কেবল একজনের নয়।
আমি আমার সঙ্গীকে গোটা দুনিয়ার সামনে দাঁড় করিয়ে অহংকারে বুক ফুলিয়ে হাঁটতে চাইনা। আমি চার দেয়ালের মাঝে তাকে নিয়ে স্বপ্ন বুনতে চাই। অহংকারী না হয়ে রোজ নিয়ম করে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। এমন একজন মানুষ চাই, যে দিনশেষে গিয়ে আমার মধ্যে প্রশান্তি খুঁজে নেবে। পরশেষে, যে আমাকে এই সুবিশাল দুনিয়ার মাঝে এক বিশেষ ব্যক্তি হিসেবে হৃদয়ে জায়গা দেবে।”
অনেকগুলো কথা বলে হাফ ছাড়লো সে। এরপর হুট করে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
– “আশা করি আমার কথা বুঝতে পেরেছেন। যদি বলেন আপনার মাধ্যমে আমার এই আশাগুলো পূরণ হওয়া সম্ভব। তবে এই হাতটা ধরতেই পারেন। কথা দিতে পারেন।”
স্বজন তার সূক্ষ্ম চোখদুটো দ্বারা প্রীতির হাতের দিকে চাইলো একবার, পরক্ষনে চাইলো তার মুখপানে। ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক হাসি ফুটিয়ে নিচু গলায় শুধালো,
– “সবাই তো হাত ধরে কথা দেয় ম্যাডাম। আমি নাহয় কথা দিয়ে তবেই হাতটা ধরি? যেখানে ওয়াদা পালনের দায়বদ্ধতা থাকবে, সঙ্গে থাকবে অগাধ ইচ্ছে।”
প্রীতি হাতটা গুটিয়ে নেয় ধীরেধীরে। চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে বামদিকের কাচের গ্লাসে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখেও লক্ষ্য করে লোকটা তাকে মনোযোগ সহকারে দেখছে। সত্যিই খানিকটা অপ্রস্তুত হলো সে। ঠোঁট ভিজিয়ে মজার ছলেই বললো,
– “মেয়ে দেখতে এসে এভাবে তাকিয়ে থাকতে নেই।”
– “কেন?”
– “বিপরীত ব্যক্তি অপ্রস্তুত হতে পারে… লজ্জা পেতে পারে।”
– “তুমি লজ্জা পাচ্ছো?”
– “কিছুটা…হয়তো।”
।
গালে হাত ঠেকিয়ে চোখ ছোটছোট করে তাদের দিকে চেয়ে রইলো প্রজ্ঞা। তার পাশে প্রণয় বসেবসে ফোনে গেইমস খেলছে। প্রজ্ঞার সামনেও ফোন। স্ক্রিনে দৃশ্যমান তার স্বামীর মুখখানার দিকে চেয়ে নাক কুঁচকালো সে। কানের ইয়ারফোনটা ঠিকঠাকভাবে লাগিয়ে মুখের সামনে মাইক্রোফোন এনে চাপা স্বরে বললো,
– “শেখো শেখো, প্রাণের বড় ভাইয়ের থেকে অন্তত কিছু শেখো! এসে তার পা ধোয়া পানি খাবে। কথা দিয়ে তবেই হাত ধরবে… আহা! আবেগে আপ্লুত হয়ে যাচ্ছি। আর তুমি কী করেছো? কেঁদেকেটে মাথা খারাপ করে দিয়েছো একদম।”
এনজাম কাজ রেখে ফোনটা সামনে এগিয়ে আনলো। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
– “তো তুমি বিয়ে করেছিলে কেন আমাকে?”
– “কারণ তুমি বলেছিলে, ‘আমাদের প্রেমের গল্প ফিল্মি হবে’। এখন দেখছি, সেটা হরর সিনেমায় বদলে গেছে!”
– “হ্যাঁ, কারণ তুমি হরর সিনেমার ভিলেনের মতো আচরণ করো। শুধু ড্রামা, ড্রামা, ড্রামা! তুমি পালিয়ে বিয়ে না করলে আমার জীবনটা হয়ত এমন নাটকীয় হতো না।”
প্রজ্ঞা অবাক কণ্ঠে শুধায়,
– “তাহলে আমাকে থ্যাংকস দাও। নাটকীয় জীবন পেয়েছো, এটাই বা কম কীসের!”
এনজাম কপাল চাপড়ানোর ভঙ্গিতে বলে,
– “হ্যাঁ, এখন বুঝি। প্রতিদিন তুমি একটা নতুন এপিসোড বানাও। আমি শুধু দর্শক!”
– “দর্শক না, তুমি তো পুরাদস্তুর সহ-অভিনেতা। ভুলে যেও না, বিয়ের সময় কী দুঃসাহসী ডায়লগ দিয়েছিলে!”
– “এখন বুঝি, ডায়লগ নয়, সেটা ছিল আমার লাইফ কনট্রাক্ট!”
প্রজ্ঞা কিছু বলতে চাইলেই এনজাম আঙুল উঁচিয়ে বাধা দেয়,
– “এই তুমি কখনো চুপ করে থাকতে পারো না কেন?”
প্রজ্ঞা ফুঁসে উঠে বললো,
– “তোমার জীবনে কোলাহল আনার জন্য আমাকেই বিয়ে করলে কেন?”
– “আমার ভুল। মনে করেছিলাম, বিয়ের পর আমি তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করব। এখন তুমি আমাকে নিয়ন্ত্রণ করো।”
– “নিয়ন্ত্রণ তো করতেই হবে। নাহলে তোমার মতো মানুষ জীবন শেষ করে ফেলত।”
– “ভালো, তবে এই নিয়ন্ত্রণ আরও কিছুদিন থাকলে আমি পালিয়ে যাব!”
প্রজ্ঞা মেকি হেসে শুধালো,
– “আচ্ছা, পালানোর আগে ভাড়া আর খরচ আমাকে দিয়ে যেও।”
প্রণয় তাদের নিচু স্বরের ঝগড়াতেই বিরক্ত হলো খুব। তার গেইম খেলায় সমস্যা হচ্ছে। রেগে গিয়ে একদম প্রজ্ঞার কান থেকে ইয়ারফোনটা টেনে খুলে ফেললো। ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,
– “উফফ মাম্মা! আমি খেলতে পারছিনা তো!”
প্রজ্ঞা অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে একটু চোখ খুলে চাইলো ফোনের দিকে। সেটা হাতে তুলে ইয়ারফোনের দিকে চেয়ে দেখলো তা ফোনের সঙ্গে যুক্ত করাই হয়নি! চোখ বুলিয়ে আসেপাশে নজর দিলো একবার। পাশের টেবিলের মানুষ কেমন হা করে তাকিয়ে আছে। তার সামনের টেবিলে বসা প্রীতি কটমট চোখে চেয়ে আছে তার পানে। কয়েকবার চোখের পলক ফেলে ফোনের দিকে চাইলো সে। এনজামের প্রশ্নাতুর দৃষ্টি দেখে ঠোঁট উল্টালো। অসহায় চোখে চেয়ে বলতে চাইলো,
– “আমার সাথেই কেন!”
#চলবে