#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_৪০
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন
দীর্ঘ দু ঘন্টা যাবত সোফার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে থেমে থেমে কাঁদছে প্রণয়। ভদ্রসভ্য বাচ্চাটা জেদ এর বেলায় সবার উপরে। প্রজ্ঞা-এনজাম পাশে বসে এত বোঝাচ্ছে, কোলে তোলার চেষ্টা করছে, কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছেনা। সে মুখ তুলবেই না। এনজাম শেষ অবধি আশাহত হয়ে তাকালো প্রজ্ঞার দিকে। অসহায় কণ্ঠে জানতে চাইলো,
– “ওর মাথায় এসব ভুলভাল কথা ঢুকিয়েছে কে?”
প্রজ্ঞা বিস্ময় কণ্ঠে শুধায়,
– “আমি ঢুকিয়েছি? তোমার কি তাই মনে হয়?”
– “তোমার কথা বলেছি একবারো?”
প্রজ্ঞা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
– “ওর কোন বান্ধবী যেন বলেছে, বাড়িতে ভাইবোন এলে মা আর আদর করেনা। শুধু নতুন বাচ্চাকেই ভালোবাসে।”
এনজাম কপালে হাত রেখে চাইলো তার ছেলের পানে। কান্না থেমেছে তার, তবে মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে ঘুরে আছে। খবরটা সে পেয়েছে পিপির থেকে। অতি উত্তেজনার বসে অ্যানি সবার আগেই জানিয়ে দিয়েছে প্রণয়কে। বলেছে, ‘তোদের বাসায় একটা ছোট্ট বাচ্চা আসবে কদিন পর। এইটুকু একটা বোন আসবে দেখিস।”
ব্যাস, সেই থেকেই মনে অভিমানের পাহাড় জমিয়ে কথাবার্তা বন্ধ করে দিয়েছে সে। নতুন বাবু কেন আনতে হবে? সে-ই তো আছে, একটা সুন্দর বাচ্চা। মাম্মা বাবা নতুন বাবুকে নিয়ে এলে নিশ্চই তাকে ভুলে যাবে। নিশা যে বলে, মা তাকে খাইয়ে দেওয়ার ও সময় পায়না। ভাইকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে শুধু। তার ভাই যেমন তার আদরে ভাগ বসিয়েছে, প্রণয়ের ক্ষেত্রেও এমনটাই তো হতে পারে। মা তাকে আদর করবেনা, বাবা আবদার মেটাবে না, এসব ভাবতেই তো কান্না পাচ্ছে তার। পিপি সেখানে কত্ত খুশি! তার দিকটা কেউ বোঝেই না, তাকে কেউ ভালোই বাসে না।
পুনরায় ফুঁপিয়ে ওঠামাত্র কেউ একজন মাথায় হাত রাখে তার। বাবা, মা অথবা ফুপ্পির হাত ভেবে তা সরিয়ে দেয় প্রণয়। তবে সে আবারো হাত রাখে, এবার একটু টান দেয় চুল ধরে। প্রণয় ভ্রু কুঁচকে ঘাড় ঘোরাতেই দেখে টুশি ঠোঁট উল্টে তাকিয়ে আছে। চোখ জলে টইটম্বুর। যেন এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে।
প্রণয় তাকাতেই সে তার গায়ে হাত বুলিয়ে বড়দের ন্যায় বোঝানোর সুরে বললো,
– “মন খারাপ করোনা ভাইয়া। আমরা নতুন বাবুর সাতে একতুও খেলা করবোনা। ওকে খামচি দিবো, মালবো। তাহলেই ও বাসা থেকে চুলে যাবে।”
টুশির বুদ্ধি দেখে চোখদুটো রসগোল্লার আকার ধারণ করলো দুজনের। একে অপরের দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিললো প্রজ্ঞা-এনজাম। প্রণয় ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে বোধ হয় ভাবছিলো, এমনটা করা যায় কিনা। এনজাম সুযোগ বুঝে কোলে তুলে নিলো তাকে। অমনি চেঁচিয়ে উঠলো প্রণয়। হাত পা ছোড়াছুঁড়ি করলো নেমে যাওয়ার জন্য। পাশে প্রজ্ঞা ছিলো বিধায় এনজাম তড়িঘড়ি করে তার হাতদুটো ধরে রেখে বললো,
– “কী করছো বাবাই? মাম্মার পেটে লাগবে তো! বাবু ব্যাথা পাবে এতে। তুমি কী বাবুকে ব্যাথা দেবে?”
একটু অবাক চোখে চাইলো প্রণয়। প্রজ্ঞার পেটের দিকে তর্জনী উঁচিয়ে জানতে চাইলো,
– “বাবু এখানে?”
প্রজ্ঞা এগিয়ে এসে তার হাতে চুমু খেয়ে বললো,
– “হ্যা, বাবু এখানে। খুব ছোট। ও ধীরেধীরে বড় হবে, কয়েক মাস পর আসবে আমাদের কাছে। তুমি ওকে দেখতে পারবে, কোলে নিতে পারবে… ওর সাথে খেলতে পারবে! কত্ত মজা না?”
প্রণয় আবার ফুঁসে উঠে বুকে হাত গুঁজল,
– “না, মজা না।”
টুশিও সামনে এসে সুর মিলিয়ে বললো,
– “হ্যা, মজা না। বাবু লাগবেনা। মামি, তুমি বাবু আনবেনা। ঠিক আছে?”
প্রজ্ঞা কাঁদোকাঁদো মুখ করে কোলে বসালো টুশিকে। গাল টেনে দিয়ে বললো
– “কিন্তু বাবু তো আসতে চায় মা! আমাকে শুধু বলে, ‘আমি ভাইয়ার সাথে খেলবো, আপুর সাথে খেলবো’। তোমরা এভাবে বললে কিন্তু ও কষ্ট পাবে খুব। কান্নাও করবে। ও এলে তোমাদের কত ভালোবাসবে বলো তো!”
– “সত্যি?”
এনজাম বললো,
– “তিন সত্যি।”
প্রণয় তবুও মুখ গোমড়া করে রইলো। এনজাম দীর্ঘশ্বার ছেড়ে তাকে বোঝায়,
– “আচ্ছা বাবাই, তোমার নানুর কয়টা বাচ্চা বলো তো? দুটো বাচ্চা। তোমার মাম্মা আর খাম্মি। নানু কী কাউকে কম আদর করে?”
প্রণয় একটু ভেবে মাথা নাড়ে। এনজাম তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
– “তাহলে? তোমার কেন মনে হয় মাম্মা বাবা তোমাকে আদর করবেনা আর? মাম্মা বাবা দুজনকেই সমান আদর করবে, ভালোবাসবে। তুমি যেমন টুশির সাথে খেল, ওর সাথেও খেলতে পারবে। বড় ভাই না তুমি? এমন করলে চলে?”
– “বলো ভাই? অন্নেক বলো?”
হাতের দ্বারা পরিমাণ দেখিয়ে জানতে চাইলো টুশি। প্রজ্ঞা মুচকি হেসে প্রণয়ের দিকে চেয়ে উত্তর দেয়,
– “হুম। প্রণয় তো এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। বড় ভাইয়ের কত দায়িত্ব! দেখোনা, তোমার মামা খালামনিকে মাঝেমধ্যে শাসন করে আবার ভালোও বাসে, ওর ও সেসব করতে হবে।”
প্রণয়ের রাগ বোধ হয় কমলো একটু। খুশিখুশি অনুভূত হলো। প্রজ্ঞা তা ধরতে পেরে টুশিকে এনজামের কাছে দিয়ে প্রণয়কে নিজের কোলে বসালো। গালে গাল ঘষে বললো,
– “আচ্ছা বেশ, বাবুর সব কাজ তুমি করবে। ওকে খাওয়াবে,ঘুম পাড়াবে। ও তোমার কাছে থাকবে, আর তুমি থাকবে আমার কাছে। এবার ঠিক আছে?”
প্রণয় চোখ পিটপিট করলো। মা কী বলে এগুলো? সে তো নিজেই হাত দিয়ে খেতে পারেনা, ছোট বাবুকে কী করে খাওয়াবে? প্রণয়ের মুখভঙ্গি দেখে হেসে ফেললো তারা। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদোকাঁদো গলায় বললো প্রজ্ঞা,
– “একটু তো খুশি হয়ে যা বাবা! তুই মন খারাপ করলে মাম্মার ভালো লাগে?”
প্রণয় মায়ের মুখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,
– “আমাকে বেশিবেশি আদর করবে তো?”
– “সবার চেয়ে বেশি!”
এতক্ষনে হাসি ফুটলো প্রণয়ের মুখে। নিজেও মায়ের বুকের সাথে মিশে রইলো। টুশি তাকে খুশি হতে দেখে হাততালি দিয়ে মামার গলা জড়িয়ে ধরলো। এনজামও ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে কাছে এগিয়ে এলো। স্বভাবতই ছেলের উদ্দেশ্যে বললো,
– “আ তে কী হয় বলতো?”
প্রণয় তাকায় বাবার দিকে। বরাবরের ন্যায় তার দু-কানের কাছে মুখ এনে একসঙ্গে বললো দুজন,
– “আ তে, আমরা প্রণয়কে ভালোবাসিইই…”
— — —
শাফায়াতের থেকে প্রীতির বিয়ের দিন চিঠি পেয়েছিলো অ্যানি। তারপর প্রায় বিশদিন কেটে গেছে, কোনোপ্রকার যোগাযোগ করেনি সে। শাফায়াত কল করে বিরক্ত করার মতো ছেলে নয়। ‘তাকে চাই, তাকে পেতেই হবে’ এমন মনোভাব নিজের মাঝে থাকলে হয়তো প্রথম প্রেমিকার সঙ্গেই সুখের সংসার গড়তে পারতো সে। জোর করতে পারতো, নানান আবেগী কথা বলে তাকে দূর্বল করতে পারতো। করেনি, ইচ্ছে হয়নি। সে মনের কথা ব্যক্ত করতে জানে, বিপরীত ব্যক্তিকে নিজের দিকটা বোঝানোর চেষ্টা করে। তবে তাকে ছাড়া থাকতেই পারবে না,এমন মনোভাব রাখেনা। ভাগ্যের লিখনের উপর বিশ্বাস রাখে সে। তাইতো একটা চিঠির পর আর কোনোপ্রকার অস্বস্তিতে ফেলতে চায়নি অ্যানিকে। বাকি সিদ্ধান্ত তার উপরই ছেড়ে দিয়েছে।
প্রায় বিশদিন কেটে যাওয়ার পর যখন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধরেই নিলো শাফায়াত, চিঠিটা অবহেলায় কোথাও রেখে দিয়ে তাকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখান করছে অ্যানি, ঠিক তখনি তাকে অবাক করে দিয়ে চেম্বারের দরজায় এসে দাঁড়ালো মেয়েটি। দুবার টোকা দিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে শুধালো,
– “আসতে পারি?”
বিস্মিত এনজাম তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ায়। আপাদমস্তক তাকে একবার দেখে নিয়ে বলে,
– “হ্যা, আসুন।”
ধীর পায়ে ভিতরে এলো অ্যানি। হাতব্যাগটা টেবিলে রেখে চেয়ার টেনে বসলো। শাফায়াত কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বসলো নিজেও। নিরবতা ভেঙে সামান্য হেসে বললো,
– “ভেবেছিলাম ভাই ভাবীর দ্বিতীয় বিয়ের দিন আসবেন আপনি। এলেন না যে? কোনোভাবে আমার কারণেই…”
– “ভুল ভাবছেন। এক্সাম ছিলো আমার, তাই যেতে পারিনি।”
– “আজ এলেন যে?”
চোখ তুলে তার দিকে তাকালো অ্যানি। শান্ত মুখভঙ্গি নিয়ে বসে থাকা শাফায়াত তার নিকট হতে অনেক কিছু শুনতে চায় বলে মনে হলো অ্যানির। কিছু কাঙ্ক্ষিত কথা হয়তো। মৃদু হেসে আগেপিছে না ভেবে জানতে চাইলো সে,
– “আপনি দেখেছেন টা কী আমার মধ্যে?”
– “কেন?”
উত্তর দিলোনা অ্যানি। একটুক্ষণ থেমে শাফায়াত টেবিলে হাত রেখে বললো,
– “কিছুই না… আবার অনেক কিছু। সঠিক বলতে পারছিনা।”
অ্যানি ভ্রু কুঁচকে শুধায়,
– “একবার ভেবে দেখুন, আপনার সঙ্গে আমার যায়না!”
শাফায়াত হাসে তার কথা শুনে।
– “নিজেদের মধ্যে প্রপার আন্ডার্সট্যান্ডিং থাকা সেইম মেন্টালিটির কাপলরাও আমার কাছে ডিভোর্স চাইতে আসে।”
– “ভিন্ন মতের মানুষও আসে নিশ্চই।”
– “আপনার আমার মত কী এতই ভিন্ন নাকি? কই, খুঁজে পেলাম না তো।”
অ্যানি চোখ নামিয়ে বললো,
– “আগেও বলেছি, এসব প্রেম ভালোবাসার উপর আমার কোনোপ্রকার বিশ্বাস নেই।”
– “আজীবন সিঙ্গেল থাকার ইচ্ছে আছে নাকি?”
অ্যানি মাথা নেড়ে বললো,
– “তা তো বলিনি। কিন্তু আমার বিয়ে করতে এখনো অনেক দেরি আছে। নিজে ইস্টাবলিশড না হওয়া অবধি আপা আমার বিয়ে হতে দেবেন না। কম বয়সে বিয়ে হওয়ায় নিজের পড়াশোনা আর ঠিকভাবে করতে পারেনি। তাই আমাকে নিয়ে খুব স্বপ্ন ওর।”
শাফায়াত লম্বা দম টেনে হেলান দিয়ে বসে বলে,
– “আরো দু তিন বছর না? সমস্যা নেই। আজকাল ছেলেরা আধবুড়ো হয়েও বিয়ে করে।”
অ্যানি হা করে চাইলো তার পানে। অবাক হয়ে বললো,
– “এমন নাছোড়বান্দা হয়ে আছেন কেন?”
শাফায়াত শব্দ করেই হেসে ফেললো। পেপারওয়েট টা ঘুরিয়ে বললো,
– “নাছোড়বান্দা হওয়ার মতো কী করলাম ম্যাডাম? আপনাকে বিরক্ত করেছি? বারবার কল করে অসভ্যের পরিচয় দিয়েছি? দেইনি তো… আজ আপনি না এলে, ভবিষ্যতেও কখনো নিজে থেকে কথা বলতে না চাইলে আমি আর এগোতাম না। এটুকু বোধ হয় চেনেন আমায়।”
– “মিথ্যে বলবো না, আপনার জন্য মায়া হয় আমার।”
– “মানুষের প্রতি মায়া থাকাটা খুব খারাপ একটা বিষয়। একটা নির্দিষ্ট সীমা পেরিয়ে গেলে সেটা ভালোবাসায় রূপ নেওয়ার বিস্তর সম্ভাবনা থাকে।”
অ্যানি কিছু বলার মতো শব্দ গুছিয়ে উঠতে ব্যার্থ হলো। শাফায়াত আরো কিছুটা সময়ের নিরবতা শেষে সাবলীল কণ্ঠে শুধায়,
– “আপনার মধ্যে কী দেখেছি? এর উত্তরে নির্দিষ্টভাবে কিছু বলা যায়না। ছোটখাটো অনেকগুলো দিক। যেমন, আপনার ভবিষ্যৎ পেশা। ডাক্তারি আমার বরাবরেই পছন্দের, হয়তো এটা একটা কারণ। দ্বিতীয়ত আপনার সাদামাটা জীবন, তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই সেখানে। তৃতীয়ত আপনার পরিবার, ভীষন আকৃষ্ট করলো। এর বাহিরে আমি একটা কথায় বিশ্বাসী, কাউকে ভালো লাগার নির্দিষ্ট কারণ থাকেনা।”
অ্যানি ঢোক গিললো একবার। বললো,
– “ভালো লাগা কেটে যাবেনা, এর কী নিশ্চয়তা আছে?”
– “নেই। তবে কী জানেন, পরিবারের গুটিকয়েক সদস্য ব্যতীত আমার আপন বলতে তেমন কেউ নেই। সেই হিসেবে, কাউকে নিজের ভাবতে পারলে তার প্রতি অকারণে ভালোলাগা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।”
অ্যানি এদিক ওদিক তাকিয়ে বিব্রত কণ্ঠে বললো,
– “প্রায় তিনবছর… প্রমাণবিহীন কোনো সম্পর্কে এতদিনে ভাঙন ধরবেনা বলছেন?”
শাফায়াত জোর গলায় বলে,
– “আমার দিক থেকে না, এটুকুর নিশ্চয়তা দিতে পারি।”
মুচকি হাসে অ্যানি। পরক্ষনেই বলে ওঠে,
– “তবুও মনে হচ্ছে আমি আপনাকে ঠিককরে বুঝতে পারবোনা। এটার কী করি?”
ঠোঁট চেপে হেসে বললো শাফায়াত,
– “ডাক্তার মানুষ যেহেতু, কারো মনের চিকিৎসা আপনি ঠিকঠাকই করতে পারবেন বলে বিশ্বাসী।”
– “আর ভুয়া ডাক্তারি করে বসলে?”
– “দু বছরে পুরাদস্তুর আসল ডাক্তার হয়ে উঠতে পারলে আর ভুয়া ডাক্তার হবেন কী করে?”
– “আপনি কথার জ্বালে ফাঁসাচ্ছেন আমাকে!”
শাফায়াত স্মিত হেসে গালে হাত ঠেকিয়ে বলে,
– “ফেঁসে যান।”
লজ্জা পেলো অ্যানি। লাজুক হেসে চোখ নামাতেই শাফায়াত বলে উঠলো,
– “আনাহিতা… আপনার আসল নামটা পছন্দের আমার। ঐ নামে ডাকতে পারি?”
হালকা ঘাড় কাত করে সম্মতি জানায় অ্যানি। হুট করে ক্যালেন্ডার এর দিকে চোখ পড়তেই চমকালো শাফায়াত। মার্চের ৩০ তারিখ, শনিবার। প্রজ্ঞা-এনজাম তার কাছে এসেছিলো পহেলা জানুয়ারি। গুনেগুনে নব্বই দিন পূর্ণ হলো আজ। আর আজই অ্যানির নিকট হতে এক নিরব সম্মতি পেলো সে। গল্পটা তো তারও, বেশ কয়েক বছর পর নব্বই দিনের এই বিশেষ গল্পটা সে মনে করলেও করতে পারে।
– – –
নব্বই দিন অতিবাহিত হলো ঠিকই, তবে সেই বিশেষ দম্পতীর বৈবাহিক জীবনে খুব একটা বদল এলোনা বোধ হয়। একানব্বই দিনের দিন সকালে এনজাম-প্রজ্ঞাকে চেম্বারে উপস্থিত দেখে শাফায়াতের তাই মনে হলো। অনেকটা সময় যাবত তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো সে, এখন আবার কী হলো?
এনজাম এর মুখভঙ্গি নির্লিপ্ত। দেখে মনে হচ্ছে তার দিক থেকে কিছুই হয়নি। তবে প্রজ্ঞা বুকে হাত গুঁজে অন্যদিকে চেয়ে আছে। শাফায়াত জিজ্ঞেস করার পূর্বেই কর্কষ কণ্ঠে বলে উঠলো,
– “অনেক সহ্য করেছি স্যার, কিন্তু এবারে ও সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে হয় আমাকে পাগল হতে হবে নাহয় ছাদ থেকে ঝাপ দিতে হবে। আর কোনো উপায় নেই।”
শাফায়াত বরাবরের ন্যায় জানতে চাইলো,
– “এমন কী হলো ম্যাডাম? না মানে আপনারা তো মিটমাট করে নিয়েছিলেন সবটা।”
– “হ্যা করেছিলাম। কিন্তু দুদিন যেতেই বুঝলাম এই লোক কদিন সিনেমার হিরোর রোল প্লে করছিলো আমার সামনে। শুটিং শেষ, এরপর যেই লাউ সেই কদু।”
এনজামের দিকে চেয়ে ফোঁসফোঁস করে বললো সে,
– “গত পরশু খুব সাধ করে বলেছিলাম বাজার থেকে মানকচু আনতে। ভর্তা বানাবো। সে কী নিয়ে এসেছে জানেন?”
– “কী এনেছে?”
– “লাউ! ইয়া বড় একটা লাউ নিয়ে এসেছে। তাও আবার কচি না। এমন লোকের সাথে মানুষ কী করে সংসার করবে?”
শাফায়াত একটু হেসে এনজামের উদ্দেশ্যে বললো,
– “কেন ভাই? এসব জিনিস তো খেয়াল করতে হয় একটু।”
এনজাম ভদ্রলোকের ন্যায় বসে ছিলো। শাফায়াতের কথা শুনে চোখ ছোটছোট করে বলে,
– “আমার কী দোষ বলুন? সে কচু এমনভাবে উচ্চারণ করেছে যে আমি শুনেছি কদু। কদু মানে তো লাউ, বরিশালের মানুষ বলে কথা! তাই তো ভালোবেসে বড় সাইজের লাউ নিয়ে এসেছি।”
প্রজ্ঞা চোখ কপালে তুলে আঙুল উঁচিয়ে বলে,
– “ডাহা মিথ্যে কথা! আমিতো কাগজে লিখেও দিয়েছিলাম।”
– “তোমার চ আর দ এর মধ্যে পার্থক্য বোঝা যায় আদেও? যাহাই চ তাহাই দ। কচু হোক বা কদু, খাওয়ার ই তো জিনিস।”
– “ঐ কদু তোমাকেই ভর্তা বানিয়ে দেবো… সাতদিনের খাবার তোমার ওটা।”
শাফায়াত মাথা চুলকে তাদের পরামর্শ জানায়,
– “আপনি একটা কাজ করতে পারেন ম্যাডাম। এরপর থেকে বাজারের লিস্ট এ নামের পাশে ছোট করে ছবি একে দেবেন। তাহলে আর কচু কদু নিয়ে কনফিউশন তৈরি হবেনা।”
– “অ্যাহ!”
একসঙ্গে বলে উঠলো দুজন। শাফায়াত হেসে হাত নেড়ে শুধায়,
– “জাস্ট জোকিং। এরপর বলুন, আর কী করেছেন উনি?”
প্রজ্ঞা কাঁদোকাঁদো গলায় বললো,
– “ওকে একদিন কাপড় ধোয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলাম, আর ও কী করেছে! আমার সব সাদা জামা, শাড়ি, ওড়না সব গোলাপি হয়ে গেছে!”
এনজাম গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
– “এটা কৃতিত্বের বিষয়, জানেন? এত বছরেও লন্ড্রি কোম্পানিগুলো রঙিন কাপড় আর সাদা কাপড় একসঙ্গে ধুয়ে এমন ইউনিফর্ম কালার বানাতে পারেনি, যা আমি একদিনেই করে ফেলেছি!”
– “কৃতিত্বের জায়গায় কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করছে! আমার সাদা শাড়ি এখন বাচ্চাদের টেডি বিয়ারের মতো লাগছে!”
শাফায়াত হাসি চেপে বলে,
– “মানে, আপনার কাপড়গুলোর নতুন ফ্যাশন ট্রেন্ড শুরু হয়ে গেছে!”
– “আরেকটা জিনিস শুনুন। জিন্স ধুতে গিয়েছিলো, সেটার রঙ উঠে সব গামছার মতো দেখাচ্ছে!”
এনজাম তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো,
– “আসলে আমি ইন্টেনশনালি এমন করেছি, যেন পোশাকের মধ্যে একটা ‘ভিনটেজ’ লুক আসে!”
– “ভিনটেজ লুক না, এটা ‘ধ্বংসপ্রাপ্ত লুক’ হয়েছে!”
শাফায়াত ঠোঁট কামড়ে হেসে শুধায়,
– “মনে হচ্ছে, মিস্টার খান আর্কিটেক্ট এর কাজ ছেড়ে ‘ডিজাইনার ফ্যাশন ব্র্যান্ড’ খুলে ফেলতে পারেন!”
– “সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার শুনবেন? ও নিজের মোজা আর আমার ওড়না একসঙ্গে ধুয়েছে!’
এনজাম ভ্রু কুঁচকে বলে,
– “স্যার, আপনি কি জানেন, বিজ্ঞানের মতে, পানি সবকিছুকে শুদ্ধ করে! তাই মোজা আর ওড়না একসঙ্গে ধুলেই বা সমস্যা কোথায়?”
প্রজ্ঞা দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
– “একটা অসহ্য মানুষ! তোমার লজিক শুনলে মনে হয়, তুমিই বিজ্ঞানের আবিষ্কারক। ওহ হ্যা,আরেকটা কাণ্ড করেছে। আমার সিল্কের শাড়িটা ওয়াশিং মেশিনে ঢুকিয়ে দিয়েছে!”
এনজাম ভোলাভালা দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
– “আমি কী করবো, বলুন? লেখা ছিল ‘ড্রাই ক্লিন অনলি’। তো আমি ড্রাই অবস্থায়ই মেশিনে ঢুকিয়েছি, পানি পরে লেগেছে!”
শাফায়াত মাথায় হাত রেখে বলে,
– “ওয়াশিং মেশিন আর সংসার একসঙ্গে চালাতে গেলেই এমন হবে। আপনি বরং ওয়াশিং মেশিন ইউজ করাই ছেড়ে দিন। যাকগে ম্যাম, আপনি এরপর বলুন।”
প্রজ্ঞা কটমট চোখে এনজামের দিকে তাকিয়ে বলে,
– “উনি কত ভালো স্বামী না, বলুন? কাল মাঝরাতে আমি বললাম, ‘ফুচকা খেতে ইচ্ছে করছে।’ উনি কী বললেন জানেন?”
এনজাম কথা ছিনিয়ে নিয়ে শুধায়,
– “বলেছি, স্বপ্নে খেয়ে নাও!”
– “মানে আমি ফুচকা চাই, আর সে চাইছে আমার সাইকিক পাওয়ার জাগ্রত হোক!”
– “এখন ফুচকার কেসে আমাকে জেলে ঢোকাবেন?”
শাফায়াত মেকি হেসে বললো,
– “আসলে এটা খাবারের বিচারালয়, আর আমি হয়তো এখন থেকে ফুচকা-বিচারপতি!”
থতমত খেয়ে চুপ করে যায় প্রজ্ঞা। পরক্ষনেই এনজামের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে বলে,
– “এভাবে চললে কিন্তু আমি আর ওর সাথে থাকতে পারবোনা।”
শাফায়াত তাদের দিকে তাকিয়ে গলা খাকড়ি দিয়ে বললো,
– “ইয়ে মানে, লোকমুখে শুনলাম আপনাদের অভিনন্দন জানানোর মতো একটা খবর আছে নাকি? নাহ… গুজব ও হতে পারে, বলা তো যায়না।”
অপ্রস্তুত হয়ে চোখ নামিয়ে নিলো প্রজ্ঞা। শাফায়াত এনজামের দিকে তাকিয়ে জানতে চায়,
– “খবরটা কী গুজব?”
এনজাম প্রজ্ঞার দিকে একনজর তাকিয়ে নিচু গলায় বলে,
– “নাহ, গুজব নয়। সত্যিই।”
শাফায়াত বেশ আশাহত হওয়ার ভঙ্গিতে প্রজ্ঞার উদ্দেশ্যে বললো,
– “নব্বই দিন যেহেতু কেটেই গেছে, আমি তো আজই আপনাদের ডিভোর্স টা করিয়ে দিতে পারতাম ম্যাডাম! কিন্তু, এই সময়ে তো ডিভোর্স কার্যকর হয়না। তাই… কী আর করার! তবে আপনি চাইলে পরিবর্তীতে আবার আসতে পারেন, ততদিন একটু দেখুন। আসলে মানুষের মাঝে পরিবর্তন কখন চলে আসে কেউ তো বলতে পারেনা।”
এনজাম মুখে হাত চেমে হাসলো। প্রজ্ঞা তা দেখে রাগী স্বরে বললো,
– “ঠিক আছে। তবে এ কদিন ই। এরপর আর সহ্য করবোনা। আপনি কাগজপত্র রেডি রাখবেন। সাতটা মাস পর যদি ওর মধ্যে বুদ্ধিশুদ্ধি না আসে তাহলে আর এক ঘণ্টাও থাকবোনা আমি। হসপিটাল থেকেই সোজা এখানে আসবো।”
– “জি জি, অবশ্যই।”
নিজের ব্যাগটা নিয়ে হনহনিয়ে চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেল প্রজ্ঞা। শাফায়াত নিজেও এবার হেসে ফেললো। এনজামের দিকে তাকিয়ে মজার স্বরেই বললো,
– “পরেরবারের সময়টা কী নব্বই দিনের ই দেবো নাকি নয় দশমাসের দেবো স্যার? যদি আপনি বলেন আরকি…”
এনজাম লজ্জা পেলো তার কথায়। দু আঙুলে কপাল ঘষে মুচকি হেসে বললো,
– “নব্বই বছরের দিয়েন বরং।”
শাফায়াত হেসে বলে,
– “সে অবধি বেঁচে থাকবেন?”
– “মৃত্যুর আগে তো ছাড়ছিনা তাকে। আর সেও ছাড়তে পারবেনা। সর্বোচ্চ কি হবে? একসময় রাগ কমে গিয়ে বলবে, ‘শুনছো? এক কাপ চা করে দাও তো!”
#চলবে?
#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_৪১ [প্রথমাংশ]
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন
গ্রীষ্ম তখন শেষের পথে, আকাশে প্রায়ই সাদা-ধূসর মেঘের আনাগোনা লক্ষ্য করা যায়। গতকাল রাতে বৃষ্টিও হয়েছে, রাস্তাঘাটে কিছু জায়গায় পানি জমে আছে, গাছপালা ধীরেধীরে সতেজ হতে শুরু করেছে। প্রীতির নিকট এই বর্ষা এবার প্রেমের মরশুম হয়ে ধরা দিলো। ভোরবেলা বরের ফোনকলেই ঘুম ভেঙেছিল। তার কথাতেই কিছু না খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে প্রীতি। নাস্তাটা একসঙ্গেই করে নেবে, তারপর খানিকটা সময় ফুটপাত ধরে হেঁটে যাবে হাতে হাত রেখে।
চলতি পথে স্কুল-কলেজ এর কিছু ছেলে মেয়ে আড়চোখে দেখে যায় তাদের। প্রীতি মুচকি হেতে বরের হাতের মাঝে হাত ঢুকিয়ে আরো নিকটে এসে হাঁটতে শুরু করে। বর্তমান সময় এমন জুটি দেখলেই লোকের মনে প্রশ্ন জাগে, ‘এরা কি প্রেমিক-প্রেমিকা নাকি স্বামী-স্ত্রী?’ প্রীতি বেঁচে গেছে এদিক থেকে। কোনোপ্রকার দ্বিধা জাগ্রত হয়না মনে, কৈফিয়ত দেবার ভয় নেই। বিয়ের পরের এই স্বল্প প্রেমটা সে বেশ উপভোগ করছে বলা চলে।
রাস্তার পাশেই এক লোক চায়ের ফ্লাক্স নিয়ে বসে ছিলো। মাথায় হাত তার, লোকজন এখন আর রাস্তার পাশে বসে চা খাওয়ায় আগ্রহ প্রকাশ করেনা বোধ হয়। হাতে হাত রেখে ধীর পায়ে হেঁটে সময় পার করার মতো প্রেমিকযুগল এর সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। স্বজন পা থামিয়ে প্রীতির দিকে চেয়ে বলে,
– “চা খাবে?”
প্রীতি এক লম্বা দম টেনে বলে,
– “এতক্ষনে বললেন! সকালে চা না খাওয়ায় মাথা ঝিমঝিম করছে আমার।”
স্বজন মৃদু হেসে তাকে নিয়ে বসলো ফুটপাতে। কিছু ধুলোবালি লাগলো পরনের পোষাকে, সেদিকে নজর না দিয়ে মধ্যবয়সী লোকটির উদ্দেশ্যে বললো সে,
– “দু-কাপ চা দিন তো কাকু।”
লোকটি মাথা থেকে হাত সরিয়ে ফ্লাক্স থেকে চা ঢেলে দিলেন তাদের। কড়া লিকার এর লাল চা দেখে প্রীতি চোখ ছোট করে বলে,
– “এতে কী মাথা ধরা ছাড়বে? দুধচা হলে ভালো হতো!”
স্বজন কড়া চোখে চেয়ে শুধায়,
– “খাও তো ঐ এক দুধ চা-ই, সাথে তিন চামচ চিনি। চা তো না এককথায় চিনির সিরা। অভ্যাস বদলাও, এটাই খাও।”
প্রীতি হতাশামিশ্রিত দম ফেলে গরম কাপটা ওড়নায় পেঁচিয়ে হাতে নিলো। খানিক বাদে স্বজন তাকে সুযোগ দিয়ে বললো,
– “মায়ের কাছে যতদিন আছো, খেয়ে নাও চা। আমার কাছে এলে সপ্তাহে সর্বোচ্চ দুদিন দুধচা খেতে পারবে, তার বেশি না।”
– “তাহলে বলেকয়ে সময় বাড়ানো উচিৎ। বিয়ের পর বাপের বাড়ি থাকার মজাই আলাদা! এটা এখন বুঝতে পারছি।”
স্বজন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
– “মজা নিচ্ছো?”
প্রীতি চায়ের কাপে ফুঁ দিতে দিতে ফিঁক করে হেসে ফেললো। ভ্রু নাচিয়ে বললো,
– “আপনি কি জানেন,এনজাম ভাই প্রায় পাঁচটা বছর বউ ছাড়া বিবাহিত ব্যাচেলর অবস্থায় জীবন কাটিয়েছে? সেখানে আপনি তিনটে মাসেই অস্থির হয়ে যাচ্ছেন!”
মিটিমিটি হাসে প্রীতি। স্বজন চোখ সরিয়ে বলে,
– “তিন মাস দূর, তিন দিন ও বউ ছাড়া থাকা উচিৎ না। এই বয়সে বিয়ে করেছি কি বউকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য? তোমার আব্বু কি আদেও নগদে আসবেন? নইলে সিরিয়াসলি তুলে নিয়ে যাবো একদিন।”
প্রীতি চোখ বড়বড় করে শুধায়,
– “এত অধৈর্য কেন আপনি, ডিয়ার ডাক্তারবাবু?”
– “বাবু?”
– “মা আপনাকে বাবু বলে না?”
– “হ্যা, কিন্তু তোমার তো বাবুর বাবা বলা উচিৎ। ভুলভাল সম্মোধন!”
হা করে চাইলো প্রীতি। স্বজন ঠোঁট কামড়ে হেসে তার কানেকানে বলে,
– “ছোট ভাইদের এক বাচ্চা বড় হয়ে আরেক বাচ্চাও আসার পথে, সেখানে আমার স্থান কোথায়? এখনো যদি বাপের বাড়ি বসে থাকো তাহলে আম্মুর বদলে আমার ই হারপিক খাওয়ার দিন চলে আসবে।”
প্রীতি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
– “এমনভাবে বলছেন যেন বিয়ের তিন বছর কেটে গেছে। সবুরে মেওয়া ফলে মিস্টার, ধৈর্য ধরুন। ঠিক সময়ে আপনার কাছে চলে আসবো। একবার এলে আর এই ভালোমানুষির মুখোশ পরে থাকতে পারবোনা বাবা। তখন আবার আমার যন্ত্রণায় বলে না বসেন, ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি!”
প্রীতির সেই মনখোলা হাসি দেখে চোখ জুড়ায় স্বজনের। মানুষকে হাসাতে সে বড্ড ভালোবাসে, একেবারে ছোটবেলা থেকে। কেউ তার দ্বারা উপকৃত হবে, তার মাধ্যমে কারো কষ্ট লাঘব হবে, তার কারণে কারো মুখে ক্ষনিকের জন্য হলেও হাসির দেখা মিলবে… এই বিষয়গুলো তার খুব পছন্দের। তবে জীবনের বিশেষ এই নারীকে হাসতে দেখাটা বোধ হয় একটু বেশিই আনন্দের।
প্রীতি তার মুগ্ধ চাহনি লক্ষ্য করে কপালের চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে জানতে চায়,
– “দেখছেন কী?”
– “তোমার হাসি।”
প্রীতি চোখ নামিয়ে স্মিত হেসে শুধায়,
– “বউকে হাসতে দেখতে ভালো লাগে?”
স্বজন সোজা হয়ে বসতেই একটা কুকুরছানা এসে বসে তার পায়ের কাছে, জিভ বের করা দেখে মনে হলো সে কিছু খেতে চায়। মধ্যবয়স্ক লোকটির থেকে দুটো বিস্কিট নিয়ে সে খেতে দিলো তাকে। মুচকি হেসে প্রীতির দিকে চেয়ে বললো,
– “কোনো প্রকৃত পুরুষের মাঝে দুটো সত্ত্বা বাস করে,জানো? একটা তার স্বামী সত্ত্বা,অন্যটা প্রেমিক সত্ত্বা। স্বামী নিজের দায়িত্ববোধ থেকেও তার স্ত্রীর মুখে হাসি ফোটাতে চায়। আর তার সেই হাসির মাধ্যমেই প্রেমিকের মনে দমকা হাওয়া বয়ে যায়। তাই বলা যায়, আমার ভিতরে থাকা স্বামী বউকে হাসাতে চায়, আর প্রেমিকের সেই হাসি দেখতে ভালো লাগে।”
প্রীতি অবাক কণ্ঠে বলে,
– “আপনি বেশ ভালো একজন প্রেমিক হতে পারতেন। কেন যে জীবনে একটা প্রেম করলেন না!”
– “আমার দৃষ্টিতে সেই প্রেমিক সবার উর্ধ্বে, যে তার বউকে ভালোবাসতে পারে। আমি সবার উপরে থাকতেই পছন্দ করি, প্রীতি। বউয়ের মুখে ভালো প্রেমিক উপাধি পাওয়াও কিন্তু সৌভাগ্যের ব্যাপার!”
– – –
প্রজ্ঞার গর্ভাবস্থার চারমাস কেটে পাঁচমাস চলছে। রোজই অফিসে যায় সে। এনজাম বারণ করেনি। শরীর সায় দিলে কাজ করতে অসুবিধা নেই। অসুস্থতার মাঝে বড় সমস্যা একটাই, ঠিকঠাক খাওয়াদাওয়া করতে পারেনা প্রজ্ঞা। কোনো কিছুতেই রুচি নেই। ইউটিউবে কত রেসিপি দেখে বর-বউ মিলে রান্না করে, অথচ প্রজ্ঞা শেষ অবধি গিয়ে একটাও মুখে তুলতে পারেনা। হতাশ হয়ে খাবারের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। প্রণয়ও নিজ হাতে মা-কে খাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, অথচ সে খেতে পারেনা। কী এক যন্ত্রণা!
এইতো সেদিন, প্লেটভর্তি হরেক রকম ফল সাজিয়ে তার সামনে নিয়ে এলো এনজাম। কিন্তু প্রজ্ঞার একদমই খেতে ইচ্ছে করছে না। এনজাম জিজ্ঞেস করে,
– “কী ব্যাপার? মুখ বাঁকিয়ে বসে আছো কেন?”
প্রজ্ঞা গালে হাত ঠেকিয়ে বলে,
– “কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।”
– “মানে? এই যে সামনে আপেল, কলা, পেয়ারা সব তো রাখা আছে!”
– “না মানে, এসব খেতে ভালো লাগছে না।”
– “তাহলে কী খেতে ভালো লাগবে?”
– “হুমম… একটু কাঁচা আম থাকলে ভালো হতো।”
এনজাম একটুও বিরক্ত না হয়ে বললো,
– “ওকে, নিয়ে আসছি।”
নিচেই একটা ভ্যান এ কাঁচা আম পেয়ে যাওয়ায় পাঁচ মিনিটের মাথায় ফিরে এলো এনজাম। আম কেটে প্রজ্ঞার সামনে দিতেই সে নাক কুঁচকে বলে,
– “কাঁচা আম ভালো লাগছে না।”
এনজাম এবারে বিরক্ত হয়ে বলে,
– “আরে! তাহলে কী লাগবে?”
প্রজ্ঞা এটুকুতেই বেজায় রেগে গেল,
– “এত চেঁচাচ্ছো কেন? একটা বাচ্চা গর্ভে রেখেছি, তুমি একটু খেয়াল রাখতে পারবে না?”
এনজাম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফলের দিকে তাকিয়ে বসে ছিলো তখন। বকাঝকা করা থেকে সাময়িক বিরতি নিয়েছে সে।
আজও তেমনই হলো। অফিস থেকে ফেরার পর কিচ্ছুটি মুখে তোলেনি প্রজ্ঞা। মুখ গোমড়া করে বসে আছে বিছানায়। পাশে বসে এনজাম পড়াচ্ছে ছেলেকে। বউয়ের মন খারাপ ধরতে পেরে কাছে এসে জানতে চাইলো,
– “কী হয়েছে ম্যাডাম? মুখটা এমন প্যাঁচার মতো করে আছেন কেন? কোনো সমস্যা?”
প্রজ্ঞা কাঁদোকাঁদো গলায় বললো,
– “আমার একটা জিনিস খেতে ইচ্ছে করছে।”
এনজামকে খুশি হতে দেখা গেল। এই মেয়ের ফুচকার প্রতিও রুচি নেই, যা খায় সবটাই অভক্তি করে, কেবল বাচ্চার কথা ভেবে। তার মুখে খাবার ইচ্ছের কথা শুনে এনজাম ব্যস্ত কণ্ঠে জানতে চাইলো,
– “কী খাবে বলো? এক্ষুনি এনে দিচ্ছি।”
প্রজ্ঞা ঢোক গিলে ঠোঁট উল্টালো। বললো,
– “কাচ্চি!”
এনজামের মুখটা চুপসে যায় তার আবদার শুনে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
– “নাহ প্রজ্ঞা, যা এনে দেবোনা তা নিয়ে কথা বলবেনা। গতবার কাচ্চি খেয়ে গ্যাস্ট্রিক এর সমস্যায় পুরো একদিন ভুগতে হয়েছে সে কথা মনে নেই?”
প্রজ্ঞা তার হাতটা ধরে অনুরোধের স্বরে বললো,
– “প্লিজ! কিচ্ছু হবেনা এবার, অল্প একটু খেতে দাও!”
এনজাম তার গালে হাত রেখে বোঝায়,
– “খেয়ে তারপর তিন চারবার বমি করতে কষ্টটা কার হয়? আমার তো হয়না, একেবারে দূর্বল হয়ে যাও তখন!”
– “না খেতে পেরেও তো দূর্বল ই হয়ে যাচ্ছি!”
এনজাম চিন্তায় পড়ে যায়। দাড়িতে হাত ঘষে কিছুক্ষন ভেবে বলে,
– “হেলদি অ্যান্ড টেস্টি কিছু ট্রাই করো! আচ্ছা,ভাবতে দাও আমাকে।”
এনজাম ভেবে বলে,
– “চিকেন স্যুপ?”
মাথা নাড়ে প্রজ্ঞা। এনজাম আবারো ভেবে বলে,
– “চিংড়ি ভর্তা? এটাতো তোমার পছন্দ!”
এবারেও মাথা নাড়ে প্রজ্ঞা। এনজাম হতাশ হয়ে পুনরায় মনে করে বলে,
– “লাচ্চি?”
প্রজ্ঞা চোখ বড়বড় করে চাইলো এবার। এই জিনিসটার কথা তো মনেই ছিলোনা। ঠান্ডা ঠান্ডা লাচ্চি, ভাবতেই তো জিভে পানি চলে আসছে তার। খুশিমনে সে সম্মতি জানিয়ে বললো,
– “অবশ্যই! তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো প্লিজ!”
– “আনবো না, বানাবো নিজে। জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ।”
ফোন হাতে নিয়ে ইউটিউবে ঢুকলো সে। একটা দুটো পদ্ধতি দেখেই উঠে দাঁড়ালো। প্রণয়ের বইখাতা গুছিয়ে রেখে বললো,
– “কাম উইথ মি, মাই বয়। হেল্প করবে আমাকে।”
প্রণয় খুশিমনে গেলো বাবার সঙ্গে। প্রজ্ঞাও তাদের পিছনে গিয়ে দাঁড়াতেই এনজাম তাকে ধরে এনে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললো,
– “বসেবসে দেখে যাও, কোনো কথা বলবেনা। তোমার কথা শুনতে গেলেই যত ঝামেলা লাগে।”
প্রজ্ঞা হা করে চেয়ে রইলো। কেউ তাকে পাত্তাই দিচ্ছেনা যেন! কী মনোযোগ সহকারে বাবার কাজে সাহায্য করছে প্রণয়! এত মনোযোগ জীবনে পড়াশোনায় দিলে নিশ্চিত বড় হয়ে নিউটন লাইট হতে পারতো। দই, পানি, চিনি, গোলাপ জল, এলাচ গুড়ো, বরফ সব মিশিয়ে ব্লেন্ড করে শেষে গ্লাসে ঢেলে লাচ্চি পরিবেশন করলো দুই বাপ-ব্যাটা। বাবার সঙ্গে প্রণয়ও অধির আগ্রহে বসে রইলো প্রজ্ঞার খাওয়ার অপেক্ষায়, একটু প্রশংসা পাওয়ার আশায়। কিন্তু চোখের সামনে লাচ্চি দেখা মাত্রই চোখমুখ কুঁচকে এলো প্রজ্ঞার। দুজনের উৎসুক চোখের দিকে তাকিয়ে হতাশ কণ্ঠে বললো,
– “এখন খেতে ইচ্ছে করছেনা।”
এনজাম ছোট চোখে চেয়ে হাটু গেড়ে মেঝেতে বসলো এবার। প্রজ্ঞার পেটের সঙ্গে কান ঠেকিয়ে বললো,
– “আম্মিজান, আপনি কী খাবেন একটু সিওর হয়ে বলুন বাবাকে। বাবা সেটাই এনে দেবে। এত ঘনঘন চয়েস বদলালে কি চলে?”
প্রণয়ও এসে পাশে দাঁড়ায়। কোমড়ে হাত রেখে ভেংচি কেটে বলে,
– “ও খেতে চায়না, ও তো ভালো না। আমি সব খাই, আমি ভালোনা মাম্মা?”
প্রজ্ঞা হেসে উঠে তাকে কাছে টেনে বললো,
– “একদম, তুমি তো বেস্ট! কিন্তু বোনকেও বুঝিয়ে বলতে হয়। তুমি বললেই ও শুনবে, তখন আর মা-কে জ্বালাবে না।”
– “আমি বললে শুনবে?”
অবাক কণ্ঠে শুধায় প্রণয়। এনজাম সম্মতি জানিয়ে বলে,
– “একদম। বলেই দেখো না!”
বাবার কথা শুনে প্রণয়ের মনটা উৎসুক হয়ে উঠলো। কিন্তু তা সে প্রকাশ করতে নারাজ। কপালে দুটো ভাঁজ রেখেই মায়ের পেটের দিকে তাকালো। তাকে শেখানো হয়েছে, কারো সঙ্গে কথা বলতে গেলে আগে সালাম দিতে হয়। পেটের কাছে কান পেতে সে মুখ ফুলিয়ে বলে,
– “হ্যালো? আসসালামু আলাইকুম।”
কানটা একদম চেপে রাখলো সে পেটের সঙ্গে। বুকটা টিপটিপ করলো। কেউ কী উত্তর দেবে? কিন্তু না। কেউ কিচ্ছু বললোনা, সাড়াই দিলোনা! উৎসাহ কাটিয়ে রেগে গেল প্রণয়। সরে গিয়ে বুকে হাত গুঁজে ফোঁস করে দম ছেড়ে বললো,
– “ও উত্তর দেয়না… ও খারাপ, ও পঁচা। ওকে আদর করা যাবেনা না না!”
ছেলের রাগ দেখে প্রজ্ঞা ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো। প্রণয় ফোলা মুখে আঙুল চেপে বললো,
– “ওয়ালাইকুম আসসালাম। এইযে আমি উত্তর দিয়েছি। বোনু ছোটনা এখনো? তাই তো কথা বলতে পারেনা। ওর হয়ে আমি বলে দিচ্ছি।”
– “নাহ হবেনা। ওকেই বলতে হবে। নাহলে আমি খেলবোনা ওর সাথে, ওকে খেলতেও নেবোনা, টুশির সাথেই খেলবো আমি।”
প্রণয় রাগ করে চলে যায় ফুফির বাসায়। বোনটা তার খুবই খারাপ। মা-মে শুধু বিরক্ত করে, খেতে দেয়না, ঘুমোতে দেয়না। কই, সে তো এমন করেনা। সে মায়ের কত খেয়াল রাখে! বাবা বলেছে বলে মায়ের পাশে শুলেও মাঝে বালিশ দিয়ে রাখে যেন মা ব্যাথা না পায় পেটে। মায়ের কোলেও ওঠার বায়না করেনা, খাবার নিয়ে একটুও দুষ্টুমি করেনা। তার বোন কিনা এত দুষ্টু! হতেই পারেনা!
পরদিন প্রজ্ঞা অফিসে যায়নি, সকালে রান্না করে বারোটার দিকে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলো। প্রণয় রোজকার ন্যায় স্কুল থেকে ফিরলো একটার দিকে, ফুফিই নিয়ে এসেছে তাকে। ঘরে এসে মা-কে ঘুমোতে দেখে আর বিরক্ত করলোনা। একাএকা স্কুলের জামা পাল্টে বাসার জামা পরে একেবারে নিঃশব্দে ড্রয়ার খুলে দুটো ডেইরি মিল্ক চকলেট বের করলো। একটা টুশিকে দিকে আবার ঘরে এলো সে। মায়ের পাশে শুয়ে চকলেট মুখে দেওয়ার সময় চোখ পরলো তার পেটের দিকে। একটুখানি ফুলেছে তার পেট। প্রণয় ভাবে মাঝেমধ্যে, এটুকু পেটে বাবু থাকে কী করে? সে কী খায়? ঘুমানোর জন্য বালিশ পায় কোথায়? তার কী খেলতে ইচ্ছে করেনা? পড়াশোনাও করেনা।
ভ্রু কুঁচকে হাতে থাকা চকলেট এর দিকে একবার তাকায় প্রণয়, পরক্ষনেই আবারো তাকায় মায়ের পেটের দিকে। খানিক বাদে উঠে বসে চকলেট টা পেটের দিকে এগিয়ে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে,
– “তুমি কী খেতে চাও?”
মুহূর্তেই সেটা সরিয়ে নিয়ে জিভ দেখিয়ে ভেংচি কেটে বললো না,
– “দেবোনা তোমাকে, তুমি পঁচা বাবু।”
নিজে খেতে গিয়ে আবারো থামে প্রণয়। ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে,
– “অল্প দিলে নেবে? তুমি কী চকলেট খেতে পারো? অনেক মজা চকলেট!”
কেউ উত্তর দিলো ঠিকই, তবে সে সামান্য চকলেট ভেঙে প্রজ্ঞার পেটের কাছে ধরে আরো ফিসফিসিয়ে বললো,
– “তুমি চুপিচুপি এসে নিয়ে যাও, আমি মাম্মাকে বলবো না। মাম্মা তোমাকে বকবে না।”
আশ্চর্য, বাচ্চাটা একটা কথাও শোনেনা! প্রণয় তবুও রাগ করলোনা। চকলেটটুকু সরিয়ে এনে বুদ্ধি বের করলো, হাসি চওড়া করে খুশিমনে বললো,
– “আচ্ছা, আমি ফ্রিজে রেখে দেই। তুমি যখন আসবে, তখন দেবো। কিন্তু তখন তুমি একা খেলে আমার লোভ লাগবে না?”
প্রণয় এটার জন্যও নতুন বুদ্ধি বের করলো। বিছানা থেকে নেমে সমান মাপে আরো এক টুকরো চকলেট ভেঙে নিয়ে সেই দু টুকরো চকলেট প্যাকেটে ঢুকিয়ে ফ্রিজে রেখে দিলো। বাকিটা মায়ের পাশে শুয়েশুয়ে সময় নিয়ে খেলো। মাঝে বললো একবার,
– “তুমি কিন্তু দুটো নিয়ে নেবেনা। একটা আমার, একটা তোমার। দুটো খেয়ে ফেললে বকা দিবো, তারপর আর দেবোনা চকলেট।”
#চলবে?
#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_৪১ [শেষাংশ]
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন
প্রায় তিনমাস পর শাফায়াত সময় করে দুদিনের জন্য গিয়েছিলো যশোরে। এর আগে যে সময় পায়নি, তেমনটা নয়। সময়,সুযোগ সবই ছিলো, তার যাওয়ার ইচ্ছেটা ছিলোনা শুধু। অ্যানির কথায় বাবার প্রতি খানিকটা চিন্তিত হয়েছিলো। বাড়িভর্তি লোক থাকলেও সেই ব্যক্তি একা, দিনশেষে রকিং চেয়ারে বসে গল্প করার মতো কেউ তো নেই তার। এতবছরে তার বিয়ে না করার আসল কারণ কেউ জানেনা, তিনি বলেননি কখনো। হয়তো প্রাক্তন স্ত্রীর স্মৃতি মুছতে পারেন নি মন থেকে, অথবা ছেলের কথা ভেবেই তার এই সিদ্ধান্ত নেওয়া। ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরিতে সফল হননি ঠিকই, তবে মনেমনে হয়তো তাই চেয়েছিলেন! সেই ছেলে চাপা ক্ষোভ ধরে রেখে তার থেকে দূরে সরে থাকে, বিষয়টা তো তার জন্যও বেদনাদায়ক হতে পারে।
অ্যানি খুব শান্ত গলায় বলেছিলো কথাগুলো। শাফায়াত শুনেছে, বোঝার চেষ্টা করেছে, শেষে মুচকি হেসে তার কথার মান রেখেছে।
ঢাকা ফেরার পরদিন বিকেলবেলা দু ঠোঙা বাদাম নিয়ে দুজন হাঁটছিলো সোহরাওয়ার্দি উদ্যান এর পথ ধরে। শাফায়াতকে বেশ ফুরফুরে মেজাজে দেখে অ্যানি জানতে চাইলো,
– “ব্যাপার কী? এত খুশি… শহরে গিয়ে স্কুল লাইফের বান্ধবীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো নাকি?”
শাফায়াত ভ্রু কুঁচকে জানায়,
– “স্কুল লাইফের বান্ধবীরা কয়েক বছর পর তাদের মেয়ের বিয়ের জন্যই পাত্র খুঁজবে।”
– “তাহলে? আঙ্কেল কিছু বলেছেন?”
শাফায়াত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুধায়,
– “উঁহু, তেমন কিছু বলেনি। আমিই আগ্রহ দেখিয়ে কথা বললাম। ঘুরলাম ফিরলাম, ক্রিকেট খেলতে গেলাম। মায়ের কাছেও গিয়েছিলাম। যা খুশি হলো আমাকে দেখে!”
– “খারাপ লাগেনি আপনার?”
নিচু স্বরে জানতে চাইলো অ্যানি। শাফায়াত মাথা নেড়ে বলে,
– “নাহ। সেটা আগেও লাগতো না। তাদের বাড়িতে গিয়েছি অনেক, থেকেওছি ছোটবেলায়। তাছাড়াও, আমাকে দেখে তাদের বিরক্ত হবার মতো সময়টা এখন পেরিয়ে গেছে। বাড়তি কোনো ঝামেলা হিসেবে উড়ে এসে জুড়ে বসার বয়সটাও আর নেই আমার। এখন আমি গেলে হাসিমুখেই আপ্যায়ন করে। সবচেয়ে বড় বিষয়, আম্মু ভালো আছে সেখানে। এই দিকটা আগে ভাবার চেষ্টা করিনি। এখন ভাবছি, তাই ভালো লাগছে। আফটার অল, সন্তান কখনো মা বাবার খারাপ চাইবে না। তাদের আনন্দে থাকতে দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।”
– “আপনার মনে এখনো কিছুটা অভিমান জমে আছে তাদের নিয়ে। মুখে যতই বলুন না কেন, একটু হলেও আছে।”
শাফায়াত অ্যানির দিকে তাকিয়ে তার ঠোঙা থেকে দুটো বাদাম হাতে নিলো। খুটে মুখে দিতে দিতে বললো,
– “যে অভিমান এর কথা বলছেন, তা হয়তো আমি চাইলেও এ জীবনে মুছতে পারবোনা। তাই বলে যে তাদের খারাপ চাই, তেমনটা তো নয়। সাথে না থাকুক, তবে তারা সুস্থ সবলভাবে বেঁচে থাকুক, আমার প্রতিদিনের মোনাজাতে থাকুক। তাদের জন্যই তো পৃথিবীর আলো দেখতে পেরেছি, আজ এখানে দাঁড়িয়ে আছি। কিছু ভুল নাহয় করেছেন, তাই বলে তাদের উপর রেগে থাকার ক্ষমতা তো আমার নেই। অভিমান… সেটা একটু থেকেই যাবে।”
অ্যানি লম্বা দম টেনে নিজে থেকেই বাদামের খোসা ছাড়িয়ে দিলো তাকে। বললো,
– “এক কাজ করবেন, মাঝেসাঝে পড়াশোনা নিয়ে মোটিভেশন দেবেন কিছু। রাত হলেই যত আজেবাজে চিন্তারা উঁকি মারে। পড়ায় মন বসেনা, মনে হয় আমার মতো ডিপ্রেসড মানুষ দুনিয়ায় দুটো নেই।”
– “ব্যক্তিগত মোটিভেশনাল স্পিকার বানাবেন, কোনো মাইনে দেবেন না?”
অ্যানি হেসে বললো,
– “ভালো কেক বানাতে পারি, খাওয়াবো একদিন।”
– “কতকিছুই তো খাওয়াবেন বলেছেন। আজ অবধি একটার ও দেখা পেলাম না!”
হতাশ কণ্ঠে শুধায় শাফায়াত। অ্যানি অপরাধীর ন্যায় চোখ নামিয়ে বলে,
– “সময় পাইনা, সত্যি! পরদিন পাক্কা…”
শাফায়াত তার ভঙ্গিমা দেখে হেসেই ফেললো। মনেমনে হিসেব কষে নিলো, তারা সমাজের খুব সাধারণ একটি জুটি হবে। দুই রুমের একটা ফ্ল্যাটে একারা সংসার সাজাবে। ঘুড়বে ফিরবে,খাবে দাবে। অত্যাধিক বিলাসিতা থাকবেনা সেখানে। থাকবে শুধু আনন্দ, আর একটুখানি ভালোবাসা।
– – –
আনন্দে ভরা জীবন কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয়না, অতি সুখ পেয়ে গেলে কিছু মানুষ হয়তো সৃষ্টিকর্তাকেই ভুলে বসতো। তাইতো এ জগতে পরিপূর্ণ সুখী মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
এইযে প্রজ্ঞা জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়টা পার করছিলো, বরের যত্নে আহ্লাদী হয়ে উঠছিলো, এমনই সময় একটা চিন্তার খবর শুনতে হলো। যে ভয়টা সে শুরু থেকেই পেয়ে এসেছে।
তৃতীয়বারের মতো চেকাপে যাওয়ার পর ডাক্তার তাদের জানায়, বাচ্চার অবস্থান পুরোপুরি ঠিক নেই। প্লাসেন্টার অবস্থানের ভিত্তিতে তার গর্ভাবস্থায় বিশেষ ঝুঁকি রয়েছে। বাচ্চার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রভাব পড়তে পারে, র’ক্ত’পাত হতে পারে, ভাগ্য খারাপ হলে মায়ের ও স্বাস্থ্যঝুঁকি হতে পারে।
প্রণয়ের সময়ও এই একই সমস্যায় ভুগেছে প্রজ্ঞা। শেষের দুটো মাস বাড়ি থেকেই বের হয়নি, শেষ অবধি আটমাসের সময় সি সেকশন এর সিদ্ধান্ত নেয় ডাক্তার।
এবারে তিনি সবকিছু বুঝিয়ে বললেন প্রজ্ঞা, এনজামকে। সব ধরণের পরিশ্রমের কাজ থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি পরিপূর্ণ বেডরেস্ট এর পরামর্শ দিলেন। ভাগ্য ভালো থাকলে পরের এক দুমাস এর মাঝে সব ঠিক হয়েও যেতে পারে।
ডাক্তার কেবল সতর্কতা জানালেও তা প্রজ্ঞার মনে বিরাট প্রভাব ফেললো। একপ্রকার হতাশ হয়ে পুরোটা রাস্তা চুপচাপ থেকে বাড়ি ফিরতেই এনজাম পাশে বসে বোঝালো তাকে। তার কথা প্রজ্ঞার মনোবল বৃদ্ধি করতে পুরোপুরি ব্যার্থ হলো। সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো, ক্লান্তস্বরে বললো,
– “আমার সাথেই প্রতিবার কেন এমন হয়? একটু সুস্থ থেকে কি সময় কাটাতে পারবোনা আমি?”
এনজাম নিজের চিন্তাটুকু সরিয়ে রেখে তাকে স্বান্ত্বনা দিলো,
– “এত চিন্তার কিছু নেই তো। তুমি এখন অবধি সুস্থ, ইন-শা-আল্লাহ বাকি সময়টুকুও সুস্থ থেকেই কাটাতে পারবে। শুধু একটু সতর্ক থাকতে হবে, এই যা…”
প্রজ্ঞা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তার কাঁধে মাথা রেখে বসে রইলো খানিকটা সময়। এনজাম তার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত গলায় বললো,
– “ছুটি নিয়ে নাও অফিস থেকে,একটু কষ্ট করো কয়েকটা মাস।”
– “রাখো তোমার অফিস… ওসব নিয়ে ভাবছে কে? গোল্লায় যাক চাকরি, আমার বাচ্চাটা অন্তত ভালো থাকুক।”
প্রণয় চোখ ডলতে ডলতে ঘরে এলো তখন। সে খুব জেদ ধরেছিলো, মা বাবার সঙ্গে হসপিটালে যাবে বলে। ডাক্তার নাকি বাবুকে দেখবে, সেও একটু দেখতে চেয়েছে। কিন্তু মা-বাবা তাকে নিয়ে যায়নি। রাগ হয়েছিলো তার, কষ্ট পেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ঘুম ভাঙলো, সঙ্গে তার রাগও ভেঙে গেলো। ছুটে বাবার কাছে এসে বললো,
– “বাবা, তুমি না বললে বাবুর ছবি আনবে? কোথায় ছবি?”
এনজাম প্রজ্ঞাকে ছেড়ে কোলে বসালো তাকে। দু’গালে চুমু খেয়ে বললো,
– “এনেছি তো। এক মিনিট,দেখাচ্ছি।”
আল্ট্রাসনোগ্রাফীর রিপোর্টটা বের করে সে দেখালো প্রণয়কে। সে হা করে তাকিয়ে রইলো। এখানে বাবু কোথায়? কিছুই তো বোঝা যাচ্ছেনা! এনজাম তাকে বুঝ দিয়ে বলে,
– “এইযে মাঝখানে, এখানেই আছে। ঠিককরে দেখো, পেয়ে যাবে।”
– “দেখিনা তো!”
প্রজ্ঞা তার কথার ভঙ্গিমা শুনে চিন্তার মাঝেও হেসে ফেললো। চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললো,
– “বলেছিনা,খুব ছোট ও। ডাক্তার বুঝতে পারে, আমরা বুঝবোনা। আর কিছুদিন গেলে তারপর বুঝতে পারবো।”
– “আর কতোদিন? ততোদিনে তো আমার চকলেট নষ্ট হয়ে যাবে!” বেশ চিন্তিত শোনালো তার কণ্ঠ। এনজাম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
– “তুমি বোনের জন্য চকলেট রেখে দিয়েছো?”
প্রণয় চোখ পিটপিট করে বলে,
– “হ্যাঁ, ও খেতে চাইছিলো তো। আমি বললাম তুমি লুকিয়ে নিয়ে যাও, কিন্তু এলোনা। পঁচা বোন, আমার কথাই শোনেনা!
তাই ফ্রিজে রেখে দিয়েছি।”
প্রজ্ঞা কাঁদবে না হাসবে বুঝে উঠতে পারলোনা। ছেলে তার বোনকে পছন্দই করেনা, অথচ চকলেট রেখে দেয়!
এনজাম চেপে ধরে আদর করলো ছেলেকে। বুঝিয়ে বললো,
– “বোনের আসতে এখনো দেরি আছে বাবাই। কিন্তু তুমি এক কাজ করতে পারো। চকলেটটা মাম্মাকে খাওয়াতে পারো। তাহলেই সেটা বোন পেয়ে যাবে।”
– “সত্যি?”
সন্দিহান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে প্রণয়। এনজাম মুচকি হেসে সম্মতি জানাতেই কোল থেকে নেমে ছুটে যায়। ফ্রিজে রেখে দেওয়া চকলেটটুকু নিয়ে এসে বসে মা-বাবার মাঝে। বোনের ভাগটা মায়ের মুখের সামনে ধরে বলে,
– “নাও, এটুকু ওর। অন্যটা আমার।”
প্রজ্ঞা তার হাতটা ধরে মুখে নিলো চকলেটটুকু। প্রণয় জিজ্ঞেস করে,
– “ওর পছন্দ হয়েছে?”
প্রজ্ঞা নাক টেনে তার সারামুখে চুমু খায়। আবেগী স্বরে বলে,
– “আমার সোনা বাবাটা, বোনের খুব পছন্দ হয়েছে। ও তোমাকে থ্যাংক ইউ ও বলেছে। আরো কী বলেছে জানো?”
মাথায় নাড়ে প্রণয়, সে জানেনা। হাসির রেখা দীর্ঘ হলো প্রজ্ঞার। তার দু’গালে হাত রেখে বললো,
– “বলেছে, আমার ভাই সবার চেয়ে ভালো, একদম বেস্ট।”
।
পরদিন থেকে আর অফিসে যায়নি প্রজ্ঞা। কাজের মধ্যে কেবল রান্নাটাই করে সে। একেবারে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে মানসিকভাবে আরো অসুস্থ হয়ে পড়তো। তাও এনজাম সব কেটেকুটে দিয়ে যায়, যেন তার বসে কোনো কাজ না করতে হয়। অফিস শেষে কোনোদিক না তাকিয়ে বাসায় ফিরে আসে। সময়টা অবশ্য খুব একটা খারাপ কাটেনা প্রজ্ঞার। আনজুম ডাক্তারের বলা কথাগুলো জানার পর থেকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় এসে খবর নিয়ে যায় তার। তাদের মাঝে গল্প করার মতো সম্পর্ক না থাকলেও পাশে বসে নানান পরামর্শ দেয়। সে একা শুয়ে থাকলে প্রণয়,টুশিকে বলে তার পাশে বসে সাবধানে খেলতে। এই সময়ে অধিক চিন্তা করাটাও বাচ্চার জন্য ক্ষতিকর, তাই তাকে স্বাভাবিক রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ।
এনজাম বাড়ি ফিরতেই প্রজ্ঞা হাসিমুখে এসে দরজা খুললো। কদিন যাবৎ সে মনমরা হয়েই থাকছে অধিকাংশ সময়। আজ এমন হাসিমাখা মুখখানা দেখে খুশি হওয়ার পাশাপাশি অবাকও হলো এনজাম। যথারীতি অফিস ব্যাগটা শু র্যাকের উপর রাখার ভুলটা করে প্রজ্ঞার কাঁধে হাত রেখে টাই খুলতে খুলতে বললো,
– “বাহ! ম্যাডামের চিন্তা একটু কমেছে তাহলে?”
প্রজ্ঞা মিটিমিটি হেসে শুধায়,
– “হুম, কিন্তু বিষয় সেটা নয়।”
– “আচ্ছা, তো কী বিষয়?”
প্রজ্ঞা তার হাতটা সরিয়ে গ্লাসে পানি ঢেলে দিলো। একদম মুখের কাছে তুলে ধরে বললো,
– “সারপ্রাইজ, এখন বলবোনা।”
এনজাম পানিটুকু খেয়ে তাকে সঙ্গে নিয়েই ঘরে এলো। ভ্রু কুঁচকে বললো,
– “তোমার সারপ্রাইজ এর চক্করেই একদিন পাগল হয়ে যাবো। যাই হোক, রেস্ট করো। ফ্রেশ হয়ে আসি।”
– “সারাদিন রেস্ট করতে করতে মাজা ব্যাথা হয়ে গেছে। মন চাইছে ঘণ্টাখানেক খোলা আকাশের নিচে হেঁটে আসি। ঘরে থেকে দমবন্ধ লাগছে একদম!”
ফোস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে এনজাম,
– “দু নম্বর জুনিয়রকে একবার আসতে দাও দুনিয়ায়, তারপর সবাই মিলে সাজেক ঘুরে আসবো, প্রমিস।”
প্রজ্ঞা হেসে শুধায়,
– “ঠিক আছে, বিশ্বাস করলাম।”
বাথরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে এসে ফোন নিয়ে বিছানায় বসলো এনজাম। একপাশে বসে তোয়ালে দ্বারা কপালে পড়ে থাকা ভেজা চুলগুলো মুছতে মুছতে ফোন স্ক্রোল করে বললো,
– “প্রণয়ের স্কুলে প্যারেন্টস মিটিং আছে কাল। মায়েরাই তো যায় বেশিরভাগ। ভেবে দেখো যাবে কিনা। গেলে আমি অফিসে কথা বলে রাখবো। তোমাকে আবার পৌঁছে দিয়ে তারপর…”
– “এনজাম, হাতটা দাও।” আচমকা বলে উঠলো প্রজ্ঞা। এনজাম ভ্রু কুঁচকে বলতে নেয়,
– “কেন? হাত দিয়ে কী…”
প্রজ্ঞা সময় খরচ না করে নিজে থেকে হাতটা টেনে নিলো তার। সুতি কামিজের উপর থেকেই হাতটা চেপে ধরলো নিজের পেটের উপর। এনজাম চিন্তিত হয়ে বলে,
– “কী হয়েছে? পেটে ব্যাথা করছে? কোনো সমস্যা?”
– “চুপ!”
প্রজ্ঞার ধমকে চুপ করলো এনজাম। ঠিক তখনই মাথায় এলো কাঙ্ক্ষিত এক বিষয়ের কথা। চোখ বড়বড় করে সে হাতটা আরো একটু চেপে রাখলো। কয়েক সেকেন্ড কাটে, ঘরে যেন পিনপতন নিরবতা বিরাজমান। তার মাঝে কেবল দুজন ব্যক্তির হৃদস্পন্দনের শব্দই শোনা সম্ভব।
এনজাম ধৈর্য হারা হয়ে পেটের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে হাত রাখে উন্মুক্ত পেটে। এইতো…কিছু একটা অনুভূত হলো! আর কেউ নয়, তার সন্তান, তার মেয়ের নড়াচড়া একটু একটু বুঝতে পারছে সে।
আনন্দে হেসে ফেললো প্রজ্ঞা। এনজামের হাতের উপর হাত রেখে জানতে চাইলো,
– “ক্যান ইউ ফিল ইট?”
এনজাম একটুখানি তাকিয়ে শব্দহীন মাথা দুলায়। এই অসম্ভব সুন্দর অনুভূতির সঙ্গে সে পরিচিত। এখনো মনে পড়ে, প্রণয় প্রজ্ঞার পেটে থাকাকালীন যে সময়টুকু সে তার সঙ্গে থাকতো, কেমন চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা করতো! প্রজ্ঞার পাশেই বসে থাকতো। পেটে হাত বুলিয়ে আবদার করতো, ‘একটু সাড়া দাও না বাবা!’
আজ প্রজ্ঞা তার কাছে, বাচ্চাও তার কাছে। আর তার সময় ফুঁড়িয়ে যাওয়ার চিন্তায় হতাশ হতে হবেনা। এ এক বড় প্রাপ্তি!
হাতটা সরিয়ে আচমকা প্রজ্ঞাকে জড়িয়ে ধরলো সে। আবেগী হয়ে বললো,
– “দেখেছো, তুমি খামোখা চিন্তা করছিলে! ও একদম ঠিক আছে, এখন তো জানান ও দিচ্ছে।”
প্রজ্ঞা তার চুলে হাত ডুবিয়ে শুধায়,
– “জানো, খুব ইচ্ছে ছিলো সর্বপ্রথম তোমাকে জানাবো এই কথাটা। আমি এবার সফল!”
তার মুখটা সামনে এনে যত্নের সহিত কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো এনজাম। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি রেখে বিস্ময় কণ্ঠে শুধায়,
– “মুহূর্তগুলো এমন মারাত্মক সুন্দর কেন প্রজ্ঞা? পারলে তোমাকে কোলে তুলে নাচতাম এখন। আল্লাহ এত সুখ দেন মানুষকে!”
তাকে ছেড়ে মেঝেতে হাটু গেড়ে বসে এনজাম। পেটের উপর বারকয়েক চুমু খেয়ে আদর করে বাচ্চাদের মতো আবদার করে,
– “আম্মিজান! আরেকবার প্লিজ!”
– “তোমার কথা শুনবে না। আমি বললে শুনতেও পারে।”
– “তুমি চুপ থাকো। আম্মু, তুমি শুনবে না বাবার কথা?”
এনজাম অধির আগ্রহে অপেক্ষা করলো আরেকবার তাকে অনুভব করার জন্য। এরই মাঝে দরজার কাছ থেকে একটি বাচ্চা অভিমানী স্বরে বলে ওঠে,
– “আবার তুমি ওকে আদর করছো। শুধু ওকেই আদর করো, আমাকে আর আদর ই করোনা!”
প্রজ্ঞা তাকিয়ে দেখলো তার ছেলের চোখ ভেজা, কেঁদে ফেলবে ভাব! এনজাম দ্রুত সরে গিয়ে তাকে কোলে তুললো। প্রজ্ঞার পাশে বসিয়ে বললো,
– “এইতো আদর করছি। কে বলে আমি তোমাকে আদর করিনা?”
– “করোই না!”
এনজাম তার মনে উৎসাহ জাগিয়ে বলে,
– “একটা জিনিস দেখবে বাবাই?”
প্রণয় তাকায় তার পানে। এনজাম তাকে নিয়ে মেঝেতে বসে আবারো। তার কানটা প্রজ্ঞার পেটের সাথে ধরে বলে,
– “দেখো, কিছু টের পাও কিনা।”
প্রণয় শুরুতে কিছুই বুঝলো না। প্রায় মিনিটখানেক বাদে কেউ তাকে ধাক্কা দিলো বলে মনে হতেই তড়িৎবেগে সরে আসে। ভয় পেয়ে ঠোঁট উল্টে কেঁদেই ফেলে! প্রজ্ঞা অবাক হয়ে তার মুখটা ধরে বলে,
– “আমার সোনা, কী হয়েছে? কাঁদছো কেন?”
প্রণয় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে পেটের দিকে তর্জনী উঁচিয়ে বলে,
– “বাবু মেরেছে আমাকে!”
এনজাম হতভম্ব হয়ে চাইলো তার পানে। দ্রুতবেগে মাথা নেড়ে বললো,
– “না না বাবাই, মারেনি। ও তো আদর করেছে।”
– “আদর?” কান্না থামে প্রণয়ের। প্রজ্ঞা তাকে কাছে টেনে নিয়ে বলে,
– “হ্যা,আদর। চকলেট দিয়েছিলে না, তাই থ্যাংকস বলছে তোমাকে।”
প্রণয় অবাক চোখে তাকিয়ে রয়। তার মনে এই প্রথম বিশেষভাবে সাধ জাগে বোনকে দেখার। সে কি হাত দিয়ে আদর করলো? ছোট ছোট হাত? প্রণয়কে যারা আদর করে, সেও তাদের খুব ভালোবাসে। তাই বোধ হয় বোনকেও আজ পছন্দ হয়ে গেল। মায়ের হাত টেনে উৎসুক স্বরে জানতে চাইলো,
– “বোন কবে আসবে মাম্মা?”
ছেলের উৎসাহ দেখে মন জুড়িয়ে যায় প্রজ্ঞার। যাক, অবশেষে সে চায় নিজের বোনকে। এনজাম তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে জানায়,
– “তুমি চাইছো যখন, তাড়াতাড়িই চলে আসবে।”
— — —
রাতের ঘুম নিয়ে খুব একটা সমস্যা হয়না প্রজ্ঞার। সারাদিনে এইজন্য না ঘুমোনোর চেষ্টা করে, যেন রাতে ঠিকঠাক ঘুম হয়। যতই হোক, সকালে এনজামের অফিস থাকে। সে একা কখনোই জাগবে না, জাগতে হলে এনজামকে সঙ্গে নিয়েই জাগবে। এই সময়ে সে অভিযোগও জানাবে না। বসে থাকবে তাকে নিয়ে। বরকে নিয়ে সে একটু আকটু চিন্তা করে, তাই আর এই সমস্যাটা সৃষ্টি করতে চায়না।
রোজকার ন্যায় আজও ঠিক সময়ে সে শুয়েছিল ঠিকই, তবে ঘুম নামলোনা চোখে। মনটা বড্ড আনচান করছে, কেমন অস্থির অস্থির ভাব! একপর্যায়ে হাপিয়ে উঠলো সে। শোয়া থেকে উঠে বসে রইলো হেলান দিয়ে। তার পাশে এনজাম, তারও পাশে প্রণয়। অ্যানি টুর এ গেছে দুদিনের জন্য, তাই প্রণয় আজ তাদের সঙ্গেই শুয়েছে। ছেলের দিকে তাকিয়ে থেকে বুকটা আরো ভার হয়ে এলো তার। অদ্ভুত সব খারাপ চিন্তারা হানা দিলো মস্তিষ্কে। হাসফাস লাগলো খুব। শেষ অবধি আস্তে করে ডাকলো এনজামকে। এটুকুতে এনজাম ওঠেনা কখনো, আজ উঠলো। পিটপিট করে চোখ খুলে প্রজ্ঞাকে বসে থাকতে দেখে ফোনে একবার সময় দেখে হাই টেনে উঠে বসে বললো,
– “কী হয়েছে? ঘুম আসছে না?”
দুদিকে মাথা নাড়ে প্রজ্ঞা। এনজাম চোখ ডলে নিজের ঘুমটুকো তাড়িয়ে দিতে চায়। প্রজ্ঞাকে কাছে ডেকে বলে,
– “এদিকে আসো। ঘুম আসবেনা কেন? বাবু ডিস্টার্ব করে?”
পুনরায় মাথা নাড়ে প্রজ্ঞা। এনজামের ডাকে এগিয়ে এসে তার বুকে মাথা রেখে আধশোয়া হয়ে বসে। চোখটা বুজে বলে,
– “ভালো লাগছেনা আমার।”
– “কেন?” মাথায় হাত বুলিয়ে জানতে চায় এনজাম। প্রজ্ঞা মৃদুস্বরে জবাব দেয়,
– “জানিনা।”
এনজাম কথা বলেনা আর। খানিক বাদে প্রজ্ঞা মুখ তুলে স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করে,
– “এত যে জ্বালাই তোমাকে, অসহ্য লাগেনা?”
– “তুমি জ্বালালে অবশ্যই লাগতো। যেহেতু অন্য কেউ এমনটা করছে, তাই সব মাফ।”
প্রজ্ঞা এক ক্লান্ত হাসি হেসে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো তাকে। চোখ বুজে বললো,
– “হুট করে এত ভয় করছে কেন আমার? প্রণয়ের সময় এর এক ভাগ ভয়ও পাইনি আমি।”
– “তখন ভয় পাওয়ার মতো সময়টাই পাওনি আলাদা করে।”
– “তবুও… আচ্ছা, ঘুম পাড়িয়ে দাও। তারপর নিজেও ঘুমাও।”
এনজাম কথা বাড়ায় না। ঘুমোতে পারলেই সে ঠিক থাকবে এখন। না ঘুমিয়ে কথা বলতে গেলেই আরো চিন্তায় পড়ে যাবে।
প্রজ্ঞার ঘুমোতে সময় লাগলো। প্রায় আধঘণ্টা পর গভীর ঘুমে মগ্ন হলো সে। এনজাম আস্তে করে তার মাথাটা তুলে বালিশে রাখে। রাত তিনটে বাজে তখন, ঘুম কেটে গেছে তার। প্রজ্ঞার কপালে একটা চুমু খেয়ে সাবধানে বিছানা থেকে নামলো সে। একটা বালিশ টেনে তার পায়ের নিচে দিয়ে অন্য রুমের বাথরুম থেকে ওযু করে এলো। অন্ধকারের মাঝে ঘরে এসে হাত মুছে নিতেই দেখলো প্রণয় উঠে বসেছে। প্রজ্ঞাকে না ডেকে বসে ভেবে দ্রুত তার কাছে আসে এনজাম। পাশে টেনে এনে ঠোঁটে আঙুল দেখিয়ে বলে,
– “হুশশ… মাম্মাকে ডেকোনা বাবাই।”
প্রণয়ও একইভাবে ফিসফিসিয়ে বললো,
– “আমি তো ডাকিনি।”
– “আচ্ছা। শোও, ঘুমিয়ে পরো।”
প্রণয় শুলো না। বললো,
– “তুমি আসো।”
এনজাম তার গালে হাত রেখে বলে,
– “একটু নামাজ পড়ে আসি? তুমি শুয়ে থাকো।”
– “নামাজ পড়বে? আমিও পড়বো।”
এনজাম হেসে বললো,
– “তুমিও পড়বে? আচ্ছা বেশ, এসো। আস্তে, মাম্মার যেন ঘুম না ভাঙে।”
প্রণয়কে নিয়েই জায়নামাজে দাঁড়ালো সে। বাবার সাথে মসজিদে যায় সে, দোয়া দুরূদ তেমনভাবে না পারলেও নিয়ম কানুন জানে। এনজাম পিছনে দাঁড়িয়ে তাকে পাশে একটু সামনে দাঁড় করায়। রাতের আধারের মাঝে চার রাকাত তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে নেয়। প্রণয় হাত বাধে, আড়চোখে বাবাকে দেখে সবকিছু করে। সূরা বলতে না পারলেও বিড়বিড় করে, তার সাথেই সালাম ফিরায়।
এনজাম সবশেষে ছেলেকে টেনে কোলে বসায়। নিজের মাথার টুপিটা খুলে পড়িয়ে দেয় তার ছোট্ট মাথায়। জিজ্ঞেস করে,
– “এখন কী করতে হবে বলো তো?”
প্রণয় বিজ্ঞদের ন্যায় উত্তর নেয়,
– “মোনাজাত ধরতে হবে।”
– “হ্যা, হাত দাও। আমার সাথেসাথে বলবে কেমন?”
– “আচ্ছা।”
এনজাম নিজের হাতের মাঝে তার ছোট হাতদুটো রেখে মোনাজাত ধরলো। ধীরেধীরে বললো,
– “বলো, হে আল্লাহ…”
– “হে আল্লাহ।” বললো প্রণয়।
– “তুমি আমার মাম্মাকে সুস্থ রেখো।”
– “তুমি আমার মাম্মাকে সুস্থ রেখো।”
– “আর আমার বোনকেও সুস্থ রেখো।”
– “আর আমার বোনকেও সুস্থ রেখো।”
– “বোনকে সুস্থভাবে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিও।”
– “বোনকে সুস্থভাবে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিও।”
– “আমি তাকে অনেক ভালোবাসবো।”
– “আমি তাকে অনেক ভালোবাসবো।”
– “আদর করবো, আর যত্নেও রাখবো।”
– “আদর করবো, আর যত্নেও রাখবো।”
– “তুমি আমার দোয়া কবুল করো,মাবুদ।”
– “আমার দোয়া কবুল করো মাবুদ।”
– “আমিন…”
একসঙ্গে মুখে হাত বুলিয়ে বললো প্রণয়,
– “আমিন।”
সঙ্গেযঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে জানতে চাইলো,
– “আল্লাহ শুনেছে?”
এনজাম সম্মতি জানিয়ে বলে,
– “অবশ্যই! তিনি সবকিছু শুনতে পান, সবার কথা। আর তোমার মতো বাচ্চাদের কথা তো সবার আগে শুনতে পান।”
উঠে দাঁড়িয়ে জায়নামাজ ভাজ করে রাখে এনজাম। প্রণয়কে সাথে নিয়ে প্রজ্ঞার মাথার পাশে মেঝেতে বসে বলে,
– “নাও, এবার মাম্মার মাথায় ফুঁ দিয়ে দাও তো।”
– “আচ্ছা।”
প্রণয় কাছে এসে তার মুখে হাত বুলিয়ে মাথায় ফুঁ দিলো। এনজামও পাশে থেকে দোয়া পড়ে মাথায়, পেটে ফুঁ দিয়ে দিলো তার। মাথায় হাত বুলিয়ে আরো একবার চুমু খেকো কপালে। এনজামও বাবার দেখাদেখি একই কাজ করলো। ঘুমের মাঝেও প্রজ্ঞা কী অনেকটা শান্তি পেলোনা এতে? এই দুজন ব্যক্তি জীবনে থাকতে কোন চিন্তার সাধ্যি আছে তার মস্তিষ্কে জায়গা করে নেওয়ার?
#চলবে?