#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_৪২
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন
দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষে কিছুক্ষন প্রণয়কে সঙ্গে নিয়ে শুয়ে ছিলো প্রজ্ঞা। ক্যালেন্ডারে আরো একবার তারিখটা দেখে নিলো। আল্ট্রাসনোগ্রাফীর রিপোর্ট অনুযায়ী সাতমাস পূর্ণ হতে আরো তিন চারদিন বাকি আছে। পেটের আকার বেড়েছে অনেকটাই, তবে ঢিলেঢালা জামা পড়লে খুব একটা বোঝা যায়না।
স্বামী,সন্তান,ননদ,ননাসের যত্নে দুটো মাস হেসেখেলে কাটিয়েছে সে। সৃষ্টিকর্তার রহমতে কোনো প্রকার সমস্যা হয়নি। তবে বাচ্চার অবস্থান এখনো ঠিক নেই, চিন্তা একটা থেকেই যায়। এনজাম রোজ তাহাজ্জুদ পড়ার অভ্যাস করেছে এখন। প্রজ্ঞা পারলে ওঠে, দেরিতে ঘুমোলে তাকে আর ডাকেনা। মাঝে প্রজ্ঞার ঘুম ভেঙেছিলো একদিন। কতক্ষন একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখলো তার আহাম্মক বরটাকে। পুরুষ মানুষের সবচেয়ে বড় দূর্বলতার জায়গা বোধ হয় তার সন্তান। কী সুন্দর নিজেকে বদলে নিলো সে! উঁচু গলায় একটা কথাও বলেনা, প্রজ্ঞা যেকোনো কারণে হাজারটা বকা দিলেও সে চুপ করে শুনে যায়। তারপর জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আচ্ছা,আর করবোনা।’ প্রজ্ঞা গলে যায়, আদর পেয়ে আহ্লাদী হয়ে ওঠে।
যদিও সে জানে, তাদের এই অতি শান্তির সংসার স্থায়ী হবেনা। বাচ্চাটা সুস্থভাবে চলে এলে আবারো শুরু হবে তাদের চুলোচুলি, পদে পদে ভুল খোঁজা। সম্পর্কের এই ভিন্ন অভিজ্ঞতাগুলো সুন্দর স্মৃতি হিসেবেই রয়ে যাবে। বুড়ো বয়সে অতীতের ডায়েরীটা খুলে খিলখিলিয়ে হেসে উঠবে দুজন। নাতি-নাত্নিদের সামনে কেউ মুখ খুললে লজ্জায় পড়ে যাবে, সেসবও আনন্দের।
সকাল থেকে সময়টা ভালো কাটলেও বিকেল চারটার দিকে এসে প্রজ্ঞা অস্থির হয়ে উঠলো। অনেকক্ষন এপাশ ওপাশ ফিরে শুয়ে থেকেও বাচ্চার নড়াচড়া টের না পেয়ে তৎক্ষণাৎ কল করলো এনজামকে। সে খুব ব্যস্ত না হলে এখন আর ফোন সাইলেন্ট করেনা। একবারেই ফোন তুললো সে। প্রজ্ঞা ঢোক গিলে বলে তাকে,
– “একটু জলদি ফিরতে পারবে?”
– “কেন?” চিন্তিত স্বরে বলে এনজাম।
– “দুপুরের আগে থেকে বাবুর মুভমেন্ট টের পাচ্ছিনা আমি। তাড়াতাড়ি এসো প্লিজ!”
এনজাম নিজের চিন্তাটুকু আড়ালে রেখে বুঝিয়ে বললো তাকে,
– “আচ্ছা আচ্ছা,আসছি আমি। ডোন্ট বি টেনসড। এমনটা হতেই পারে। তুমি চুপচাপ শুয়ে থাকো, একদম অস্থির হবেনা, হুম?”
প্রজ্ঞা ফোঁস করে দম ফেলে কাটলো কলটা। পায়ের নিচে বালিশ দিয়ে শুয়ে রইলো বিছানায়। প্রণয় উঠে বসেছিলো। মা-কে এমন চিন্তায় পড়তে দেখে জানতে চাইলো,
– “কী হয়েছে মাম্মা?”
প্রজ্ঞা চোখ মেলে তাকিয়ে তার গালে হাত রাখে। নরম গলায় বলে,
– “কিছু হয়নি বাবা। তুমি না নতুন সূরা শিখেছো? একটু পড়ে মাম্মার পেটে ফুঁ দিয়ে দাও।”
প্রজ্ঞা শুনলো তার কথা। সূরা পড়ে পেটে ফুঁ দিলো। হাত বুলিয়ে একটা চুমু খেয়ে বললো,
– “বাবু কি ঘুমোচ্ছে মাম্মা?”
– “হ্যাঁ। ওকে জাগতে বলো। এতো ঘুমোতে হয়না, মাম্মার চিন্তা হয়।” মৃদু হেসে বললো প্রজ্ঞা। প্রণয় মাথা নেড়ে পেটের কাছে মুখ এনে বলে,
– “এই শুনো, ঘুম থেকে উঠো। তোমাকে চকলেট দেবো।”
আধঘণ্টা কাটলো আরো, কিন্তু কোনোপ্রকার নড়াচড়া অনুভূত না হওয়ায় হাত পাঁ কাঁপতে শুরু করলো প্রজ্ঞার। এনজামকে আরো একবার কল করার পূর্বেই কলিং বেল বাজলো ঘরের। প্রণয় দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। এনজাম তাকে আদর করার আর সুযোগ পেলো না, ছুটে গেলো প্রজ্ঞার কাছে। এনজামকে দেখে যেন ভয়টা আরো বেড়ে যায় তার, চোখেমুখে অস্থিরতার ছাপ স্পষ্ট। এনজাম ব্যাগটা রেখেই এসে বসে তার পাশে। হাতটা ধরে বলে,
– “পাগল মেয়ে, কিচ্ছু হয়নি। তুমি এত চিন্তার কারণে হয়তো ফিল করতে পারছোনা। আগে শান্ত হও, কিছু খাও।”
– “বাজে কথা বলবেনা, অতো বোকা না আমি যে ফিল করতে পারবোনা। এত সময় ধরে কখনো হয়নি এমন। সব ঠিক আছে তো?” ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো প্রজ্ঞা। এনজাম ভেজা ঢোক গিলে তার গালে হাত রেখে বলে,
– “অবশ্যই ঠিক আছে। শান্ত হয়ে বোসো, কিছু খাও। তারপরও মুভমেন্ট না পেলে ডাক্তারের কাছেও তো যেতে পারি আমরা, হুম?”
ফ্রিজে পাস্তা রাখা ছিলো। এনজাম হাতমুখ ধুয়েই তা গরম করে নিয়ে এলো। নিজ হাতে খাইয়ে দিলো প্রজ্ঞাকে। মাঝে শ’খানেক কথা বোঝালো তাকে। ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দিলোনা তার নিজের মনে চলতে থাকা বাজে চিন্তাগুলো।
প্রজ্ঞা খাওয়া শেষ করতে পারলোনা। অর্ধেকটা খাওয়া মাত্রই পেট মুচড়ে বমি পেলো তার। পাঁচমাসের পর থেকে বমির সমস্যা নেই বললেই চলে। এনজাম বাটিটা রেখে তাকে ধরে নিয়ে যায় বাথরুমে। বেসিনের সামনে আসতেই গরগর করে বমি করে ফেললো সে… যা খেয়েছে তার কিচ্ছুটি আর পেটে নেই নিশ্চিত। এনজামের নিজেরই এবার ভয় হলো। বমি করে একেবারেই দূর্বল হয়ে পড়লো প্রজ্ঞা। কোনোমতে মুখে পানি নিতেই নেতিয়ে পড়লো, ঘনঘন দম ছাড়লো। এনজাম আগলে ধরতেই কেঁদে উঠলো সে। এনজাম তাকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে বসালো। মাথাটা বুকে আগলে নিয়ে বললো,
– “কষ্ট হচ্ছে?”
প্রজ্ঞার কপালে ভাজ পড়লো কয়েকটা। বললো,
– “কেমন যেন লাগছে, ভালো লাগছেনা আমার। এমন তো হয়না…”
প্রণয় মায়ের অবস্থা দেখে ভয় পেলো। ছুটে গিয়ে ফুফিকে ডেকে আনলো। আনজুম এসেই প্রজ্ঞার পাশে বসে। বড় বোনের ন্যায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
– “ভয় পায়না। একটু বেশি করে পানি খাও। এনজাম পানির বোতলটা দে।”
এনজাম পানি এনে দেয়, একঢোক খেয়ে আর খেতে পারেনা প্রজ্ঞা। ঠেলে সরিয়ে দেয় বোতলটা। আনজুমের দিকে তাকিয়ে বলে,
– “হুট করে কী হলো বলুন তো আপা? সকালেও আমি মুভমেন্ট টের পেয়েছি।”
– “কিচ্ছু হয়নি, মাঝেমধ্যে হয় এমন। টুশির সময় পুরো একবেলা কোনো নড়াচড়া টের পাইনি ওর, পরে তো ঠিক হয়ে গিয়েছিলো। উহু, ভাবেনা এতো, আল্লাহকে ডাকো।”
মিনিটপাঁচেক বাদে প্রজ্ঞা সোজা হয়ে বসলো। ওয়াশরুমে যাবে বললে এনজাম হাত ধরে নিয়ে যায় তাকে। পুনরায় এসে বসে বিছানায়। প্রণয় ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছে একপাশে, টুশি ঘুমোচ্ছে। আনজুম পাশে বসে বুঝ দেয় ভাইকে। এমন হয়ে থাকে, চিন্তা করতে বারণ করে। এনজাম তার কথায় একটুখানি স্থির হয়েছিলো, এমন সময় বাথরুম থেকে প্রজ্ঞার চিৎকারের আওয়াজ ভেসে এলো কানে। এনজাম কোনোদিক না চেয়ে ছুটে গেলো তার কাছে, দরজা ভিড়িয়ে রাখা ছিলো। বাথরুমে এসেই তাকে ধরলো এনজাম, পুরো শরীর কাঁপছে তার তখন। কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই টাইলসের দিকে চোখ যায় তার। গাঢ় লালরঙা তরল র’ক্তের ছড়াছড়ি দেখে আর কিছু বুঝতে বাকি রইলো না তার। যেই ভয়টা দুমাস যাবৎ পেয়ে এসেছে…
আনজুমের বুক কেঁপে উঠলো এসব দেখে, প্রণয়কে আগলে রাখলো, বাচ্চাটা ভয় পাচ্ছে খুব।
এনজামের শার্টটা চেপে ধরে প্রজ্ঞা কাপাকাপা স্বরে বললো,
– “আ আমার বাচ্চা… ও ঠিক আছে তো?”
– “ঠিক আছে, একদম ঘাবড়াবে না। আমি আছি না? সব ঠিক হয়ে যাবে, একটু শক্ত থাকো সোনা।”
এমন সময় অ্যানিও ফিরলো কলেজ থেকে। ব্যাগটা রেখে দ্রুতপায়ে ছুটে এলো ঘরে। এনজাম তাকে দেখেই একনজর তাকিয়ে বলে,
– “ওয়ারড্রবের উপর চাবি রাখা আছে, জলদি গিয়ে গাড়ি বের কর। ফাস্ট…”
প্রজ্ঞাকে কোলে তুলে নিয়ে আনজুমের উদ্দেশ্যে বললো সে,
– “বাচ্চাদের নিয়ে এসো তুমি, আমরা যাই আগে।”
প্রজ্ঞার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছিলো ভয়ে। কেবল শক্ত করে গলা জড়িয়ে রইলো তার।
পুরুষ মানুষকে সৃষ্টিকর্তা অধিক ধৈর্য, মনোবল, শক্তি দিয়েই এ দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন হয়তো। তাইতো তারা যেকোনো কঠিন মুহূর্তে নিজেদের শান্ত রেখে কাজ করতে জানে। বুকের বাম পাশের যন্ত্রটার অস্বাভাবিক কম্পনকে অগ্রাহ্য করে নিজেকে সামলে রাখতে পারে তারা।
ড্রাইভিং সিটে বসলো অ্যানি। এনজাম প্রজ্ঞাকে নিয়ে পিছনে বসতেই গাড়ি স্টার্ট দিলো সে। প্রজ্ঞা শব্দ করে কেঁদে উঠলো তখন। এনজামের দিকে তাকিয়ে বললো,
– “ওর কিছু হবেনা তো? প্লিজ!”
এনজাম তাকে আগলে রাখে। বলে,
– “বললাম তো, ঠিক হয়ে যাবে সব। তুমি শুধু শান্ত থাকো একটু। নার্ভাস হয়ে গেলে বাচ্চার সমস্যা হতে পারে।”
– “কিন্তু আমিতো খুব সাবধানে ছিলাম। এমনটা কেন হচ্ছে? আমার বাচ্চা…”
চোখ বুজে আসছিলো প্রজ্ঞার, অতিরিক্ত ভয়ে জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা। এনজাম বারকয়েক গাল চাপড়ে মাথা নেড়ে বললো,
– “তাকিয়ে থাকো, আমার সাথে কথা বলো। কিছু হবেনা তোমার বাচ্চার, বলছিতো আমি।”
কান্নার তোপে হেঁচকি উঠে যায় প্রজ্ঞার। এনজাম একহাতে ফোন বের করে সবার আগে কল করে স্বজনকে, সে এই সময় হাসপাতালেই থাকে।
বিশমিনিট লাগলো তাদের হাসপাতালে পৌঁছোতে। এখানেও আরেক বিপত্তি, যেই ডাক্তারের কাছে শুরু থেকে আসতো প্রজ্ঞা, সে কিছুদিনের জন্য ছুটিতে আছেন। ইমার্জেন্সি তে দ্রুতই অন্য গাইনোকোলজিস্ট এর আন্ডারে নেওয়া হলো তাকে। যেখানে সে পেটে কোনোপ্রকার আঘাত পায়নি, হুট করে এমন হওয়ার কারণটা ধরতে সময় লাগলো তাদের। অবশেষে যা ধরতে সক্ষম হয় তা মা ও বাচ্চা উভয়ের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির কারণ।
ডাক্তারির ভাষায় একে বলা হয় প্লাসেন্টাল অ্যাবরাপশন। এর কারণে প্রসবের পূর্বে অনেক ক্ষেত্রে প্লাসেন্টা আংশিক বা পুরোপুরি জরায়ুর দেয়াল থেকে আলাদা হয়ে যায় বা ছিড়ে যায়। এক্ষেত্রে ডাক্তারের সিদ্ধান্ত নির্ভর করে মা এবং বাচ্চার শারীরিক অবস্থার উপর।
হাসপাতালে আসার আগে অবধি পেটে ব্যাথা অনুভূত হয়নি প্রজ্ঞার, তবে ঘণ্টাখানেক এর মাঝে পেট শক্ত হয়ে আসে এবং প্রচণ্ড ব্যাথা শুরু হয়, তারই সঙ্গে ওয়াটার ব্রেক করে। প্রথমে বাচ্চার হার্টবিট সামান্য পাওয়া গেলেও পরবর্তীতে তা আর পাওয়া যায়না।
প্রীতি, পাপিয়া, আনজুম সকলেই ততক্ষনে হাসপাতালে এসে পৌঁছেছে। ডাক্তার এসে আগেই সবকিছু খুলে বলেন এনজামকে। এই অবস্থাতে বেশিক্ষন রাখলে তাতে শুধু বাচ্চাই নয়, মায়ের ও জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যাবে।
সাতমাস ও পূর্ণ হয়নি প্রজ্ঞার। এমন সময়ে ডেলিভারি করানো হলে স্বাভাবিকভাবেই বাচ্চার সুস্থতার আশা কম থাকে। তার উপর এ ধরণের সমস্যা, বাচ্চা আদেও ঠিক আছে কিনা তারা বলতে পারছেনা। বাড়ির লোকেদের একটা সিদ্ধান্ত জানাতেই হবে।
এনজাম মাথা নুইয়ে শুনলো সব কথা। পাপিয়া চোয়াল শক্ত করে বসে ছিলেন চেয়ারে। অ্যানি, আনজুম কান্নাকাটি শুরু করেছে আরো আগে থেকেই। স্বজন ছিলো প্রীতির পাশেই। তার মতো শক্ত মনের মেয়েও ছলছল চোখে তাকালো তার পানে। বাচ্চাটা যে প্রজ্ঞার কতটা শখের, সে জানে। কেবল তার নয়, এনজাম, প্রণয়ের ও অতি আদরের। প্রজ্ঞা রোজ তাকে ফোন করে তাদের পাগলামোর ঘটনা বলতো, কত খুশি ছিলো মেয়েটা!
এনজামকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে স্বজন এগিয়ে এলো তার কাছে। কাঁধে হাত রেখে বললো,
– “একটা ডিসিশন দিতেই হবে। দেখ, প্রজ্ঞার লাইফ রিস্ক এর ব্যাপার।”
এনজাম তড়িৎবেগে চোখ তুললো। লম্বা দম টেনে সামনে তাকিয়ে বললো,
– “যা ভালো হয় তাই করুন। তবে… প্রজ্ঞা মানে আমার ওয়াইফকে কিছু জানাবেন না প্লিজ। আব আমি কী একবার কথা বলে আসতে পারি?”
ডাক্তার সম্মতি দিয়ে বলেন,
– “হ্যা, যেতে পারেন। আধঘণ্টার মধ্যে তাকে ওটিতে নেবো আমরা।”
এনজাম ঠোঁট কামড়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। পা বাড়াতে গিয়েও থেমে একবার পাশে তাকায়। পাপিয়ার নিচু দৃষ্টি দেখে জিজ্ঞেস করে,
– “আপনি যাবেন মা?”
– “তুমি যাও।”
নিষ্প্রভ কণ্ঠে উত্তর দেন তিনি। এনজাম শক্তি পেলোনা আর কিছু বলার। থমথমে পায়ে এগিয়ে গিয়ে বসলো প্রজ্ঞার পাশে। প্রথমেই চোখ পড়লো তার পেটের দিকে। গতকালও এই সময় সে এবং প্রণয় মিলে আপনমনে কত কথা বলছিলো বাচ্চার সঙ্গে।
চোখ সরিয়ে প্রজ্ঞার মুখের দিকে চাইলো সে। ব্যাথা কমার জন্য ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে তাকে। পরনে হাসপাতালের পোষাক। ধীরেধীরে তার মাথায় নিজের হাতটা রাখে এনজাম। তৎক্ষণাৎ চোখ মেলে তাকায় প্রজ্ঞা, কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে গেছে একদম। এনজামকে দেখেই আবারো কেঁদে উঠলো সে। হাতটা খাঁমচে ধরে বললো,
– “সত্যি করে বলো, আমার বাচ্চা ঠিক আছে তো? ডাক্তার কিছু বলছেনা কেন আমাকে?”
এনজাম এই অবস্থাতে মিথ্যে বলতে বাধ্য হলো। হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,
– “ঠিক আছে ও। কিন্তু এখনই তাকে পৃথিবীতে আনাটা প্রয়োজন। ভয় পাবেনা হ্যা? খুশি হও, এত তাড়াতাড়ি তুমি দেখতে পারবে ওকে।”
– “পারবো তো দেখতে?”
ফুঁপিয়ে ওঠে প্রজ্ঞা। এনজামের মনে হলো কেউ তার গলাটা শক্ত করে চেপে ধরে আছে। স্বান্ত্বনাবাণী আর বেরোচ্ছে না মুখ থেকে। তবুও শক্ত ঢোক গিলে মৃদু হেসে বলে,
– “অবশ্যই পারবে।”
– “তুমি সবার আগে কোলে নেবে ওকে, ঠিক আছে?”
এনজাম মাথা নাড়লো শুধু। নার্স এলো তখন, দু হাতেই ক্যানোলা করলো প্রজ্ঞার। ব্লাড গ্রুপ বি পজিটিভ হওয়ায় ব্লাড ব্যাংক থেকে সহজেই আনা যাবে, সমস্যা হবেনা। হুইল চেয়ারে করে তাকে ওটির সামনে নিয়ে আসতেই সবাইকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লো প্রজ্ঞা। প্রীতি কাছে এসে তার মুখটা ধরে বলে,
– “কাঁদেনা পাখি, সব ঠিক হয়ে যাবে। মনের জোর ঠিক রাখতে হবে,হ্যা?”
প্রজ্ঞা তার হাতের সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে অনুরোধ জানায়,
– “আমার ছেলেটার খেয়াল রাখিস রে।”
অ্যানি, আনজুম দাঁড়িয়ে ছিলো পাশেই। তাদের দিকে চেয়েও বললো প্রজ্ঞা,
– “আপা, আমার উপর রেগে থাকবেন না। ছেলেটা তো আপনাদের ই, ওকে আগলে রাখবেন কিন্তু।”
আনজুম ওড়নায় চোখ মুছে মাথা নেড়ে বলে,
– “তোমার ছেলেকে তুমিই মানুষ করবে। একদম আজেবাজে কথা বলবে না, বকবো কিন্তু। তোমার ছেলে আমি সামলাতে পারবো না,ও দায়িত্ব তোমার ই।”
– “যদি ফিরে না আসি?”
পাপিয়া ধমক দিলেন এবার,
– “বড় হয়ে মার খাওনি আমার হাতে তুমি, তাই খুব সাহস বেড়েছে না? মুখে ওসব কথা আনলে এই মুহূর্তে মার খাবে।”
প্রজ্ঞা তার দিকে চেয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে শুধায়,
– “আমায় ক্ষমা করে দিও মা, আব্বুকে বোলো…”
পাপিয়া বুকে জড়িয়ে নিলেন মেয়েকে। তার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললেন,
– “মা হয়েছো, এখনো মায়ের মন বোঝোনা? বোকা মেয়ে একটা…”
প্রজ্ঞা আড়চোখে এবার তাকালো ছেলের দিকে। অ্যানির কোমড় জড়িয়ে পিটপিট করে তাকাচ্ছে মায়ের দিকে। মা-কে এভাবে সে কাঁদতে দেখেনি কখনো। কী হয়েছে মায়ের? বাড়ির সবাই ও কাঁদছে। সবার মাঝে থেকে এইটুকু বুঝলো, তার বোনটা আসতে চলেছে। কিন্তু এতে সবাই কাঁদবে কেন?
প্রজ্ঞে হাতের ইশারায় ডাকতেই প্রণয় ছোটছোট পায়ে এসে দাঁড়ালো তার পাশে। এতক্ষন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেও চোখের জল এবারে টপটপ করে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। ছেলেকে কাঁদতে দেখে প্রজ্ঞা নিজের কান্না থামিয়ে কাছে টেনে নেয় তাকে। চোখদুটো মুছিয়ে দিয়ে বলে,
– “উহু, কাঁদেনা সোনা। মাম্মা ঠিক হয়ে যাব একদম। তুমি ভালো বাচ্চা হয়ে থাকবে, হ্যা? আল্লাহর কাছে দোয়া করবে মায়ের জন্য, বোনের জন্য। বুঝেছো? মন খারাপ করেনা।”
সবশেষে সে তাকালো এনজামের দিকে। লোকটা না পারছে কাঁদতে, না পারছে কিছু বলতে। প্রজ্ঞা না থাকলে তার ভুলভাল কাজগুলো নিয়ে বকবে কে? কার সাথে ঝগড়া করবে সে? প্রজ্ঞার চাহনি দেখে সে মেঝেতে বসে প্রণয়কে নিজের কাছে টেনে হাতের পিঠে একটা চুমু খেলো তার। চোখ মুছিয়ে দিলো। কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বললো,
– “এখনো তোমার সংসার সাজানো বাকি। ভুলেও এসব কথা মুখে এনোনা। সুস্থ হয়ে গেলে সবকিছুর হিসেব নেবো।”
প্রজ্ঞা তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
– “মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরবোনা আমরা?”
– “ফিরবো… সবাই একসঙ্গে ফিরবো।”
আর কিছু বলা হলোনা তার। এনজাম সরে আসতেই ওটিতে ঢোকানো হলো তাকে। শিশু বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বজনও থাকবে ওটিতে। শেষে একবার এনজামের কাঁধে হাত রেখে তাকে আট্টস্থ করে ভিতরে যায় সে।
প্রণয়কে কোলে নিয়ে সবার পাশের চেয়ারটাতে বসে রয় এনজাম। একটা কথাও নেই কারো মুখে। কারো মাঝে কোনোপ্রকার উৎসাহ নেই, আছে কেবল চিন্তা। প্রজ্ঞাকে না বলা হলেও তারা অনেকটাই নিশ্চিত, কিছুক্ষন পর একটা খারাপ খবর শুনতে হবে তাদের, যা কারো জন্যই সুখকর হবেনা।
প্রণয় বাবার কাঁধে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়লো এক পর্যায়ে। এনজাম তাকিয়ে রয় তার দিকে। ভালোই তো ছিলো তারা, একটা মিষ্টি বাচ্চা নিয়েই তো জীবন কাটিয়ে দেওয়া যেত। নতুন একজন সদস্য তাদের মাঝে এলোই যখন, তাকে উপরওয়ালা কেড়ে নিতে চাইছেন কেন? সন্তান না পাওয়ার চেয়েও যে সন্তান হারানোর কষ্ট অনেকটা বেশি। এনজামের শার্টের হাতার দিকটাতে তখনো র’ক্ত লেগে আছে। সে তাকায় একবার। কত কষ্টই না পাচ্ছে মেয়েটা! সহ্য করছে সব, নিজের সন্তানের জন্য। তাকেই যদি কাছে না পায়, সহ্য করবে কী করে?
প্রায় দেড়ঘন্টা বাদে ওটির দরজা খুলে বেরোলো একজন নার্স, সম্ভবত ব্লাড নিতে এসেছে। এনজাম প্রণয়কে পাশে রেখেই ছুটে গেলো তার কাছে। শুকনো ঢোক গিলে জানতে চাইলো,
– “আমার ওয়াইফ?”
নার্স তাড়াহুড়োর মাঝেও দাঁড়িয়ে বললেন,
– “তার কন্ডিশন একটু ক্রিটিকাল। তবে আপনার মেয়ে হয়েছে।”
– “স সে ঠিক আছে?” কণ্ঠ কাঁপলো তার। পাশে এসে দাড়ালো প্রীতি। নার্স বললেন,
– “হার্টবিট চলছে, তবে আমি ঠিকঠাক বলতে পারছিনা। ডক্টর দেখছেন। সে বেরোলে জানতে পারবেন।”
নার্স দ্রুতপায়ে চলে গেলেন নিজ কাজে। এনজাম লম্বা দম ফেলে তাকালো ওটির দরজার দিকে। মনেমনে কেবল আল্লাহকে স্মরণ করলো। নার্স ব্লাড নিয়ে পুনরায় ওটিতে ঢোকার প্রায় পাঁচমিনিট পর স্বজনসহ আরো দুজন বেরিয়ে এলো। স্বজনের কোলে তোয়ালে প্যাঁচানো ছোট্ট বাচ্চাটিকে দেখে চোখদুটো ঝাপসা হয়ে এলো এনজামের। বাকিরা ছুটে এলো তার কাছে। স্বজন খানিকটা গম্ভীর গলাতেই প্রীতির উদ্দেশ্যে বললো,
– “তোমরা থাকো এখানে, প্রজ্ঞার ব্যাপারে কোনো খবর দিতে পারে। এনজাম, তুই আয় সাথে।”
এনজাম একটু কাছে এলো। স্বজন এগোতে নিলেই ক্ষীণ স্বরে বললো,
– “আমি একবার ধরতে পারি ওকে?”
স্বজন তাকায় তার দিকে। বাবা না হলেও একজন বাবার মনের অবস্থা বুঝতে পারে সে। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে তার দিকে এগিয়ে দেয় বাচ্চাটাকে। এনজাম কাপাকাপা হাতে ধরে তাকে, একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়। মুখে কিছু একটা ধরে রাখা তার, নিজে থেকে শ্বাস নেওয়ায় সমস্যা হচ্ছে হয়তো, সেই বয়স হয়নি তার।
প্রণয়কে যখন কোলে নিয়েছিলো এনজাম, তার চোখদুটো খোলা ছিলো, যেন অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলো তার দিকে। মেয়ের চোখ খোলা নেই, চোখ ফোটেনি এখনো। মুখখানা লাল বর্ণ ধারণ করে আছে। এনজাম অবাক হলো তার মাথাভর্তি চুল দেখে, এত ছোট বাচ্চার এমন চুল হয় নাকি? তার কপালে একটা চুমু খাওয়ার সাহস হলোনা এনজামের। একেবারেই পাতলা চামড়া, সামান্য ছুঁলেই বুঝি ব্যাথা পাবে সে। চোখের দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়তেই স্বজন কাঁধে হাত রাখে তার। অভয় দিয়ে বলে,
– “ঠিক হয়ে যাবে সব, চিন্তা করিস না। দে ওকে, সাথে আয়।”
এনজাম সময় খরচ না করে স্বজনের কোলে তুলে দিলো তাকে। দুজন নার্স সহ সে দ্রুতপায়ে এগিয়ে যায় লিফট এর দিকে। শিশু বিভাগ তিনতলায়, বাচ্চাকে এখন সরাসরি এন আই সি ইউ তে নিয়ে যাওয়া হবে। এনজাম পিছুপিছু যেতে গিয়েও থেমে যায়। প্রজ্ঞার কোনো খবর তো পেলোনা এখনো। প্রীতি এসে বলে তাকে,
– “যান আপনি, প্রজ্ঞার ব্যাপারে কিছু বললে আমি জানাবো। কল করবো আপনাকে।”
তার কথা শুনে স্বজনের সঙ্গেই তিনতলায় গেলো সে। এন আই সি ইউ এর ভিতরে তাকে যেতে দেওয়া হলোনা যদিও। সে গিয়ে দাড়ালো কাচের গ্লাসের সামনে। মুহূর্তের মাঝে বাচ্চাটাকে শুইয়ে দেওয়া হলো ইনকিউবেটরের ভেতর। এরপর ছোট্ট দেহটার সাথে যা যা করলো তারা, এনজাম অবাক চোখে দেখে যায় শুধু।
নাকে কোনো এক নল ঢোকানো হয় তার। মুখে লাগিয়ে দেওয়া হয় অক্সিজেন মাস্ক, তবে সাধারণ নয়। রক্ত পরিক্ষার জন্য রক্ত নিতে গিয়ে কতবার যে সুঁই ফোটানো হলো শরীরে! ঐটুকু তো শরীর, এই ব্যাথাগুলো সে সহ্য করছে কী করে? শেষে যখন মাথায় ক্যানোলা করার চেষ্টা শুরু হলো, এনজাম চোখ ঘুরিয়ে নিলো অন্যদিকে। দেখা যায়না এগুলো… সহ্য করা সম্ভব নয় তার পক্ষে।
বিশমিনিট বাদে আবারো ছয় তলায় ফিরে আসে সে। সবার বসে থাকা দেখে বোঝা যায় প্রজ্ঞাকে এখনো বের করেনি ওটি থেকে। সে গিয়ে বসার মিনিটদশেক এর মাথায় ডাক্তার হাতে স্যানিটাইজার লাগিয়ে বেরিয়ে এলেন ওটি থেকে। প্রীতি পাশে থাকায় আগেই জিজ্ঞেস করে প্রজ্ঞার কথা। এনজামও এগিয়ে আসে তার কাছে। তিনি শান্ত কণ্ঠে জানান,
– “আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করুন ওনাকে ঠিক সময়ে ওটিতে ঢোকানো হয়েছিলো বলে। আর আধঘণ্টা দেরি হলে বাচ্চা তো দূর তাকেই বাঁচানো কষ্টের হয়ে যেত।”
– “সে এখন কেমন আছে ডক্টর?”
– “ঠিক আছে। তবে অতিরিক্ত ব্লিডিং না কমলে রিস্ক থেকেই যায়। অবজারভেশন এ রাখছি আমরা। দোয়া করুন, সুস্থ থাকলে তো ভালোই। তবে ব্লিডিং অতিরিক্ত হলে সেলাই রি-ওপেন করতে হতে পারে। এক্ষেত্রে তার কষ্টটা বেশি। এছাড়া যেহেতু ইন্টারটাল ক্ষতি বেশ ভালোই হয়েছে, তাই ফিউচার এ প্রেগন্যান্সিতে সমস্যা হবার চান্স আছে। বাকিটা আল্লাহ ভরসা…”
ডাক্তার চলে যেতেই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চেয়ারে গিয়ে বসলো এনজাম। হাটুতে কনুই ঠেকিয়ে মাথা চেপে ধরে বসে রইলো। রাত প্রায় দশটা বাজে। একদিকে বাচ্চা,অন্যদিকে প্রজ্ঞা, সবমিলিয়ে মাথা ভার হয়ে এলো এনজামের। প্রণয়ের ঘুম ছুটতেই সে চোখ ডলে উঠে বসলো। এনজাম একবার তাকিয়ে নিজের কাছে টেনে নিলো তাকে। প্রণয় সবাইকে দেখলো, কিন্তু মা-কে না দেখতে পেয়ে বললো,
– “মাম্মা কোথায়?”
ঘুম থেকে ওঠায় ছেলে মাথায় ই নেই, মাকে যে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। এনজাম মুচকি হেসে বললো,
– “আছে মাম্মা, আমরা একটু পর যাবো দেখতে। তুমি বোনকে দেখতে যাবে,বাবাই?”
প্রণয় বড়বড় চোখে চেয়ে শুধায়,
– “বোন?”
– “হ্যা, যাবে দেখতে?”
প্রণয় হতবাক হয়ে মাথা নাড়ে। এনজাম কোলে তুলে নেয় তাকে। প্রীতির উদ্দেশ্যে বলে,
– “তুমি এসো। মা, আপা, অ্যানি তোমরা থাকো এখানে। কোনো দরকার হলে ফোন কোরো।”
এনজাম, প্রণয়, প্রীতি তিনতলায় গিয়ে এন আই সি ইউ এর পাশে কাচের গ্লাসের সামনে দাঁড়ায়। স্বজন আছে ভিতরে, সংক্রমণ এড়ানোর উদ্দেশ্যে এখানে নিয়ম ব্যতীত কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়না। এনজাম তর্জনী উঁচিয়ে প্রণয়কে বলে, ‘ঐযে, তোমার বোন।’
প্রণয় হা করে তাকিয়ে বলে, ‘ওর মুখে এগুলো কেন?’
– “ও একটু অসুস্থ বাবাই। তুমি আল্লাহর কাছে দোয়া করো, যেন ও তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যায়।”
বাচ্চাটাকে এমন অবস্থায় দেখে চোখ ভিজে এলো প্রীতির। স্বজন তাদের দিকে খেয়াল করে বের হলো এন আই সি ইউ থেকে। প্রীতির পাশে এসে কাঁধে হাত রাখলো তার। প্রীতি তার দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে জানতে চায়,
– “ঠিক হয়ে যাবেতো ও?”
স্বজন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
– “এক্সট্রিম প্রি-ম্যাচিউর বেবি, বাহিরে থেকে স্বাভাবিক মনে হলেও ভিতর থেকে সবকিছুর বিকাশ ঠিককরে হয়নি এখনো। চেষ্টা তো করা হচ্ছেই সব দিক থেকে। রাখার মালিক আল্লাহ, দোয়া করো সবাই।”
– – –
রাতে একবার বাসায় গিয়েছিলো এনজাম। গোসল করে জামাকাপড় বদলে সাথেসাথেই ফিরে এসেছে। প্রজ্ঞাকে আই সি ইউ তে শিফট করা হয়েছে তখন। অনুমতি নিয়েই সেখানে প্রবেশ করে সে। পাশে একটা টুল ছিলো। সেটা টেনেই বসলো প্রজ্ঞার পাশে। এটুকু সময়ের ব্যবধানে ফ্যাকাসে হয়ে আছে তার চেহারা। মুখে অক্সিজেন মাস্ক। দুহাতেই ক্যানোলা করা। একটাতে স্যালাইন চলছে অন্যটাতে ব্লাড। জ্ঞান ফেরেনি তার। এনজাম তার হাতটাও ধরতে পারলো না, যদি ক্যানোলায় টান লাগে?
বুক অবধি কম্বল টেনে দেওয়া। মাথার উপর নিজের একহাত রাখে এনজাম। হালকা গরম মনে হলো, এইসময়ে আবার জ্বর না আসুক মেয়েটার! প্রজ্ঞার কানের কাছে মুখ এনে সে নিচু গলায় বললো,
– “মেয়েকে দেখেছো তোমার? কী ছোট্ট একটা মুখ, না? ডাক্তারের পর এবার কিন্তু আমিই প্রথম কোলে নিয়েছি ওকে।”
প্রজ্ঞা শুনলোনা, সাড়া দিলনা কোনো। চেতনা ফেরেনি যে তার। এনজাম ক্লান্তস্বরে শুধায়,
– “আর ভয় দেখিও না প্রজ্ঞা। কতদিক আমি সামলাবো বলো তো? মাথা কাজ করছেনা আর। মেয়েটাকে ঐ অবস্থায় দেখা দায়… ছেলেটার শুকনো মুখের দিকেও তাকাতে পারছিনা। তোমায় ছাড়া খেতেও চাইছিলো না। মাঝে তুমিও এমন করছো? এসব কিসের শাস্তি বলতো? বোঝাতে চাইছো, তোমাকে ছাড়া বাঁচা দায় আমার? সেটাই প্রতি মুহূর্তে অনুভব করাচ্ছো?”
চোখ বুজে তার মাথার সঙ্গে কপাল ঠেকায় এনজাম। ক্ষীণ স্বরে শুধায়,
– “সবাই বলছে শক্ত থাকো, প্রজ্ঞাকে তোমারই সামলাতে হবে। আমায় কে সামলাবে বলো? আর কেউ না জানুক তুমি তো জানো আমাকে। এই দূর্বল মনটাকে কতক্ষন কঠিন সাজিয়ে রাখি? তাদের আমি কী করে বোঝাই! আমারও যে প্রয়োজন তোমাকে। তোমার কতটা প্রয়োজন জানিনা, তবে এই মুহূর্তে আমার তোমাকে ভীষণ প্রয়োজন প্রজ্ঞা!”
চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জলটুকু তার চুলের মাঝেই মিলিয়ে যায়। এনজাম স্মিত হেসে বলে,
– “দেখেছো, তোমার কাছে এসে কাঁদতেও পারি। অন্য কারো সামনে পারিনা। মাঝেও মনে হতো আমি তোমার কাছে নিজেকে প্রকাশ করতে পারিনা,বোঝাতে পারিনা নিজেকে। অথচ আজকের দিনে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে তুমি ব্যতীত আর কাউকেই নিজের দিকটা বোঝাতে পারিনা আমি।
জলদি জেগে ওঠো প্লিজ! একসঙ্গে কাঁদবো নাহয় কিছুক্ষন, গলাগলি বেঁধে। তারপর নিজেদের বুঝ দেবো। মেয়েকে সুস্থ সবলভাবেই বাড়িতে নিয়ে যাবো। জানো না কত ভীতু আমি? তোমার ক্ষেত্রে, বাচ্চাদের ক্ষেত্রে অনেক ভীতু।”
স্যালাইন লাগানো হাতটা এবার খুব সাবধানে ধরলো এনজাম। একপাশে আলতোভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফুলে যাওয়া জায়গাতে হাত বুলিয়ে বললো,
– “কথা দিচ্ছি, আর কখনো কষ্ট দেবোনা। বাবা হবার কথা তো মুখেও আনবোনা। এবারের মতো সহ্য করে নাও, সুস্থ হয়ে কয়েকটা চ’ড় মে’রে দিও নাহয়।”
হাতটা পুনরায় আগের স্থানে রেখে তার কপালে ছোট এক চুমু খেলো এনজাম। কানেকানে ফিসফিসিয়ে বললো,
– “উপরওয়ালা আমাকে বারেবারে বুঝিয়ে দেন, আমার জীবনের কতটা জায়গা জুড়ে আছো তুমি। এই তোমায় ছাড়া বাঁচা মুশকিল প্রজ্ঞা! বাঁচা মুশকিল…”
#চলবে?
#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_৪৩ [প্রথমাংশ]
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন
রাতটা পেরোলো এনজামের আই সি ইউ এর পাশের চেয়ারে বসেই। মাঝে চারবার গিয়ে অনেকটা সময়ের জন্য নির্বাক রূপে বসে রইলো প্রজ্ঞার পাশে, তিনবার গিয়ে দেখে এলো মেয়েকে, সেই দূর থেকেই। তার কাছে যেতে পারেনা এনজাম। কী অবস্থায় আছে তার বাচ্চাটা! মাথায় যে ক্যানোলা করা, চিত করে শুইয়ে বুকে কতগুলো যন্ত্র বসানো, মুখে মোটা পাইপের অক্সিজেন মাস্ক, নাকের নলের সাহায্যে সামান্য খাবার দেওয়া হচ্ছে। সে তাকাতে পারেনা, তাই গিয়ে থাকেনা বেশিক্ষন। প্রণয় ছোটবেলায় একবার ছোটাছুটি করে খেলতে গিয়ে পড়ে ব্যাথা পেয়েছিলো পায়ে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটেছে কদিন, হাটুর কাছে চামড়া ছুলে গিয়েছিলো। প্রজ্ঞা জানায়নি এনজামকে, সে নিজেই গিয়ে খেয়াল করলো। কী যে বকাঝকা করেছিলো সেবার প্রজ্ঞাকে! বিয়ের পর ঐ প্রথম তাকে রাগের মাথায় বেশ কিছু কটূ কথা শুনিয়েছিলো, সে অবশ্য রাগ করেনি তখন।
আজ তো সে কটূ কথা শোনাতো না, একটুও বকতো না। সুন্দর করে চোখের জল মুছিয়ে দিতো। কিন্তু মেয়েটা উঠলো কই? ফজরের আজান পড়তেই এনজাম পাশের মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে। নিরবে অশ্রু ঝড়িয়ে আর্জি জানায় রবের নিকট। ফিরে আসা মাত্রই শিশু বিভাগ থেকে ডাকা হলো তাকে। ফোন পেতেই বুকটা ধক করে উঠেছিলো এনজামের। ছুটে যেতেই জানতে পারলো বাচ্চাকে ব্লাড দেওয়ার প্রয়োজন। বাবা-মায়ের মধ্যে কারো সঙ্গে মিলে গেলে তাদের থেকেই দেওয়া ভালো। ভাগ্যক্রমে এনজামের সঙ্গেই মিলে গেলো মেয়ের ব্লাড গ্রুপ। প্রণয়ের সঙ্গেও মিলে যায়। তাদের সবার ব্লাড গ্রুপ ও নেগেটিভ। খুবই সামান্য র’ক্ত নেওয়া হলো এনজামের শরীর থেকে। তখন একবার তাকে এন আই সি ইউর ভিতর ডেকে নেওয়া হলো। সার্জিকাল গাউন,মাস্ক,ক্যাপ,শ্যু কভার সবকিছু পরিয়ে তাকে পাশে নিয়ে বসানো হলো। মেয়ের হাতদুটো কাছ থেকে দেখতেই চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো এনজাম। এতবার সূচ ফোটানো হয়েছে যে কালচে দাগ বসে গেছে।
মা বা বাবার শরীরের উষ্ণতা প্রি-ম্যাচিউর বাচ্চাদের দেহের তাপমাত্রা ঠিক রাখায় অনেক ভালো কাজ করে থাকে। মায়ের শরীরের ওম বেশি উপকারী। যেহেতু মা-কে আনা সম্ভব নয়, তাই বাবা হলেও চলে।
বুকের থেকে সবকিছু সরিয়ে বাচ্চাটিকে উঠিয়ে আনা হলো। অন্য একটা অক্সিজেন মাস্ক রইলো কেবল। এনজামের উন্মুক্ত লোমশ বুকের একপাশে ছোঁয়ানো হলো বাচ্চাটিকে। ইশ… তার হৃদস্পন্দনের তীব্র শব্দে মেয়েটা ভয় পেয়ে যায় যদি? দু-হাতের সাহায্যে তাকে যত্ন করে ধরলো এনজাম। তার ওজন হয়েছে ৯২০ গ্রাম। ত্বকের লালাভ বর্ণ কিছুটা কেটেছে, দেখে বোঝা যায় সেও প্রণয়ের মতোই ফর্সা গায়ের রং পেয়েছে। মেয়েকে প্রাণভরে দেখলো এনজাম। ঠোঁট কামড়ে ধরে সামলালো নিজেকে। তবুও গাল বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়লো ঠিকই।
মেয়েটা তার হাত পা নাড়ায় না তেমন, নাড়ালেও তা অতি সামান্য, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, চোখ ফোটেনি এখনো, সে কাঁদেও না। কেমন নিশ্চল একটা শরীর! এনজাম একটু সাহস করলো। একটুখানি মাথা ঝুঁকিয়ে তার নরম মাথায় চুমু খেলো একটা। নাক টেনে মৃদুস্বরে বললো,
– “মা, আমার মা… একটু কাঁদবে মা? একটুখানি কাঁদো সোনা! কথা দিচ্ছি, বাবা আর কখনো তোমায় কাঁদতে বলবেনা। সবসময় চোখের জল মুছিয়ে দেবে। বাবা তোমায় রাজকুমারীর মতো সাজিয়ে রাখবে মা।”
সে কী শুনলো বাবার কথা? শুনলেও হয়তো বুঝতে পারেনি, কিংবা প্রতিক্রিয়া দেখানোর মতো বয়স হয়নি। নইলে সে অবশ্যই শুনতো বাবার কথা। লোকে বলে মেয়েরা বাবার আদুরে হয়, সবচেয়ে কাছের, মেয়ে কখনো বাবার চোখের জল সইতে পারেন। সম্ভব ই না! আজ শোনেনি তো কী হয়েছে, তার মেয়েও একদিন বড় হবে। মায়ের মতোই বকবে বাবাকে, কাঁদলে চোখের জলও মুছিয়ে দেবে সন্তর্পণে।
এনজাম ক্ষীণ স্বরে আরো বলে,
– “তোমার ভাইয়া তোমার জন্য কত খেলনা সাজিয়ে রেখেছে জানো মা? কবে থেকে অপেক্ষায় আছে, বোনের সাথে খেলবে বলে। ভাইয়াও তোমায় আগলে রাখবে, দেখো। সুস্থ হয়ে যাও মা… বাবাই এভাবে দেখছে পারছেনা তোমাকে। কষ্ট হচ্ছে তো বাবার, বুঝতে পারো? তোমায় এই বুকেই লুকিয়ে রাখবো সোনা, চট করে ভালো হয়ে যাও তো তুমি।”
প্রায় আধাঘণ্টা ওভাবেই রাখা হলো তাকে, এরপর আবারো ইনকিউবেটরের ভিতর। এনজাম বুক ভরে নিঃশ্বাস টেনে বেরিয়ে এলো। এতক্ষনে মনটা একটু শান্ত হলো, পরক্ষনেই আবারো চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো সে। প্রজ্ঞার জ্ঞান ফিরতে বড্ড দেরি হচ্ছে, ডাক্তার এসে দেখেও গেছেন দুবার। রক্তক্ষরণ স্বাভাবিক মাত্রায় নামছেনা, এমন চলতে থাকলে চলবেনা। প্রজ্ঞার জাগা উচিৎ। কোনোমতে উঠে বসতে পারলেই সে মেয়ের কাছে আসতে পারতো। মায়ের ছোঁয়া পেলে মেয়েও হয়তো জলদি সুস্থ হতো।
রাতে হাসপাতালে ছিলো প্রীতি এবং এনজাম। স্বজন ও ছিলো, মাঝে গিয়েছে গোসল সেরে জামাকাপড় বদলে আসতে। এনজাম আবারো ছয় তলায় গিয়ে বসে। প্রীতি ঘুমায় নি। এনজাম পাশে বসে ম্লান স্বরে জানতে চায়,
– “খবর দিয়েছিলো কেউ?”
– “উঁহু।”
দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বসলো এনজাম। প্রীতি ফোন রেখে বলে,
– “একটু ঘুমিয়ে নিন। কোনো খবর এলে ডেকে দেবো। আপনার সুস্থ থাকাটা জরুরী ভাইয়া। সামনের কটাদিন ভালোই চাপ যাবে নিজের উপর থেকে।”
– “কোনো চাপই যেতোনা, তোমার বোন একবার চোখটা খুললেই সব ঠিক হয়ে যেত। সামলে নিতাম সব।”
প্রীতি তাকিয়ে দেখে তাকে। মৃদু হেসে জানতে চায়,
– “এত ভালোবাসেন ওকে?”
লম্বা দম টেনে আই সি ইউ এর দরজার দিকে তাকিয়ে বলে এনজাম,
– “একসময় মোহে পড়েছিলাম, সেই থেকে আসক্তি। তবে মনে হয়, আমি ওকে ভালোবেসেছি আরো পরে, সময়ের সঙ্গে। কবে, কখন, কতটা… বলতে পারিনা। না আমি জানি, না ও নিজে।”
।
স্বজন ফিরে এলো ছয়টার দিকে। এসেই গেল এন আই সি ইউ তে, বাকি বাচ্চাদের সঙ্গে বিশেষভাবে দেখলো তার নতুন পরিবারের সদস্যটিকে। ব্লাড দেওয়া হয়েছে, অক্সিজেন ও চলছে। তবে হার্টবিট খুব কম, প্রয়োজনের তুলনায়। বিষয়টা চিন্তার, একই সঙ্গে আতঙ্কের। আর এক দু সপ্তাহ পরে জন্মালে তাকে বাঁচিয়ে রাখা সহজ হতো, বর্তমানে তা কঠিন বললেই চলে।
গম্ভীর মুখে স্বজনকে আসতে দেখেই প্রীতি ছুটে গেলো একপ্রকার। জানতে চাইলো,
– “বাবুর কী অবস্থা?”
স্বজন উত্তর না দেওয়ায় প্রীতি ভয় পেলে সে শান্ত কণ্ঠে বললো,
– “দেখো,মন শক্ত রাখো। খারাপ লাগলেও বাচ্চার ইম্প্রুভমেন্ট আসার চান্স খুবই কম। তার উপর হার্টবিট কমে আসছে। আমি সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করবো, তবে… বুঝতে পারছো তো তুমি?”
শরীর অসাড় হয়ে এলো প্রীতির। লোকে বলে, খালার গায়ে নাকি মায়ের গন্ধ পাওয়া যায়। খালার মাঝে মায়ের মমতা লুকিয়ে থাকে। নিজে মা না হয়েও সে মা হয়েছে, প্রণয়ের মায়ের মতোই তো শেষে। ছোট থেকে তার কাছে থেকেছে, নিজের সন্তানের মতোই তো তাকে ভালোবেসেছে প্রীতি। এবারে প্রজ্ঞার সঙ্গে না থাকলেও, মায়া তো আর কম নেই তার। স্বজন তার গালে হাত রেখে বলে,
– “এনজামকে এখনি বলতে হবেনা। ও…”
আই সি ইউ দরজার সামনে চোখ পড়তেই থেমে যায় স্বজন। এনজামকে দেখতে পেয়ে খানিকটা বিব্রত হলো প্রীতিও। হাতে একটা কাগজ এনজামের,বোধ হয় কিছু ঔষধ আনতে বলা হয়েছে। এনজাম এগিয়ে এসে বলতে নেয়,
– “ব্লাড কী নতুন করে দিয়েছে? ডাক্তার এসেছিলো? ওর সেন্স…”
– “বাচ্চাটা কী ঠিক আছে ভাইয়া?”
আহত কণ্ঠে বলে এনজাম। শুকনো ঢোক গিলে শুধায়,
– “কিছু কী লুকোচ্ছেন?”
স্বজন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাত রাখে তার দু-কাঁধে। অভয় দিয়ে বলে,
– “সি ইজ অ্যালাইভ। আল্লাহর উপরে কিচ্ছু নেই, যেকোনো মিরাক্কেল ঘটতে পারে। আর আমরাতো আশা ছাড়িনি। তবে… মানসিকভাবে যেকোনো কিছুর জন্য প্রিপেয়ার থাকতে হবে। প্রজ্ঞার শারীরিক অবস্থার কথাটা মাথায় রাখতে হবে তোর… হাইপার হওয়ার ফলে যেকোনো বড় সমস্যা হতে পারে ওর।”
এনজাম বোধশূন্য অবস্থাতে পা চালিয়ে নিচে যায়। একপ্রকার টেনে নিয়ে যায় নিজেকে। পা দুটো ছেড়ে দিয়ে কিছুক্ষন চিৎকার করতে মন চাইছিলো তার। আল্লাহ এত শাস্তি কেন দিচ্ছেন তাকে? যদি ছোট মানুষটার দুনিয়াতে থাকার না-ই হয়, তবে সে এলো কেন? তাকে কোলে নেওয়ার, বুকে আগলে রাখার সৌভাগ্যটা কেন হলো? মায়া বাড়িয়ে দিয়ে তার চলে যাওয়ার কথা উঠছে কেন? এমনটা তো হবার কথা নয়। এমন কিছুতো ভাবেনি তারা।
বেলা দশটা নাগাদ প্রজ্ঞার জ্ঞান ফেরার খবর এলো। বুকে চেপে রাখা একটা পাথর নামে সবার। আই সি ইউ থেকে কেবিনে শিফট করা হয় তাকে। এনজাম বসে ছিলো পাশে, সঙ্গে বাড়ির সকলে। গতকাল থেকে এখন অবধি পানি ব্যতীত একটা দানাও মুখে তোলেনি সে, গলা দিয়ে খাবার নামতোনা।
প্রণয় এসে থেকেই মা,বোনের কথা জিজ্ঞেস করে চলেছে। এনজাম কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিতে সক্ষম হচ্ছেনা। উপরওয়ালা এই ছোট্ট বাচ্চাটার দিকে অন্তত তাকাক, তাকে এত বড় একটা আঘাত না দিক। তার আদরের বোনটাকে কেড়ে না নিক।
ডাক্তার কেবিনে ছিলো, প্রজ্ঞাকে দেখছেন। তিনি বেরোলে বাকিরা যেতে পারবে তার কাছে। এনজাম অপেক্ষায় ছিলো। এমন সময় স্বজনের ফোনে কল এলো একটা। এনজাম চোখ ঘুরিয়ে তাকায় তার দিকে। অপর প্রান্ত থেকে কিছু একটা শুনে স্বজনের মুখভঙ্গি বদলে যায় পুরোপুরি, চোখ তুলে একবার তাকায় এনজামের দিকে। তার সেই দৃষ্টিতেই থমকে গেলো এনজাম। স্বজন চোখ সরিয়ে ব্যস্তস্বরে বলে,
– “জাস্ট টু মিনিটস, আসছি আমি।”
বাকিরা খেয়াল না করলেও স্বজন চলে যেতে নিলেই এনজাম ছুটে এসে পথ আটকায় তার। জানতে চায়,
– “সব ঠিক আছে?”
স্বজন কথা ঘুরিয়ে বলে,
– “প্রজ্ঞার কাছে যা। ডাক্তার কী বলে শোন।”
এনজাম নিজেকে খুব কঠিনরূপে দেখিয়ে শুধায়,
– “চিন্তা করবেন না ভাইয়া, আপনি বলতে পারেন। কিছু লুকোনোর প্রয়োজন নেই।”
স্বজন লুকোলো না। কাঁধ চাপড়ে বললো তাকে,
– “আল্লাহকে ডাক। আমি নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারছিনা। তবে… বি প্রিপেয়ারড ফর এনি কাইন্ড অফ ব্যাড নিউজ। ওকে?”
এনজামের প্রত্যুত্তরের অপেক্ষায় না থেকে পা বাড়ায় সে। তার কথা কানে যেতেই চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন পাপিয়া। এই অবস্থাতে এমন কোনো সংবাদ তার মেয়েটা নিতে পারবেনা, সহ্য হবেনা তার। সবার হঠাৎ থমকে যাওয়ার কারণ উপলব্ধি করতে ব্যার্থ হলো প্রণয়, সে চুপটি করে বসে রইলো নানুর পাশে।
মেঝেতে দৃষ্টি রেখে এনজাম এগিয়ে আসে চেয়ারের কাছে, শরীরের ভরটুকু ধরে রাখতে না পেরে বসে পরে চেয়ারে।
আজ হুট করেই তার উপলব্ধি হলো, এ জীবনে একটা মস্তবড় ভুল করেছে সে। ভুল না, অন্যায় বলা যায় এটাকে। দুজন মা, দুজন বাবার মনে কষ্ট দিয়েছে সে। সর্বদা গম্ভীর মেজাজে থাকা পাপিয়া নিশ্চই পুরো একটাদিন মেয়ের কোনোপ্রকার খোঁজ না পেয়ে পাগলের মতো খুঁজেছেন তাকে? সে তো মা… এই মায়ের মনে তো কষ্ট দিয়েছে এনজাম, প্রবাসে থাকা এক বাবাকেও চিন্তায় ফেলেছে। তাদের মেয়েকে তাদের থেকে, তাদের অনুমতি ব্যতীত ছিনিয়ে নিতে চেয়েছে। যত যাই হোক, এটা অন্যায়। মস্ত বড় অন্যায়।
শুধু তো তাই নয়, নিজের মা বাবাকেও কম কষ্ট দেয়নি সে। গলাবাজি করেছে,তর্ক করেছে। রাগের মাথায় কত বড়বড় কথা বলেছে বাবার মুখের উপর। তার জন্য তাদের অপমানিত হতে হয়েছে, আত্মমর্যাতায় আঘাত পড়েছে। সে গোনায় ধরেনি এসবকে। নিজের কথাই ভেবেছে,নিজেদের কথাই ভেবেছে। জন্মদাতা-জন্মদাত্রীর কথা, তাদের মনের অবস্থা, কষ্ট বোঝার চেষ্টাই করেনি। বাবা একদিন মনে কষ্ট নিয়ে তাকে বলেছিলো, ‘যেদিন বাবা হবি, সেদিন বুঝবি। সন্তানের চেয়ে বড় আপন আর কেউ হয়না মা-বাবার কাছে।’
এইযে ভুল, অন্যায়… এগুলোর শাস্তিই বুঝি পেয়ে আসছে সে? মা-বাবার মনে কষ্ট দিলে নাকি সেই সংসার সুখের হয়না, তাদের অশ্রুর ভার অনেক। তাই জন্যই বুঝি তাদের সুখের সংসারেও এত বিষাদের ছাপ? তেমনটা হলে তাদের পা ধরে ক্ষমা চাইবে এনজাম, একটুও দ্বিধাবোধ করবেনা। তবে তাদের ভুলের শাস্তি কেন নিষ্পাপ বাচ্চাটা পাবে? আল্লাহ কী তাকে কষ্ট বোঝাচ্ছেন? একজন বাবার মনের কষ্ট? তার জীবনে সন্তানের মূল্য, এগুলোই?
ডাক্তার বের হলেন, কথা বললেন প্রীতির সঙ্গে, তার একটা কথাও কানে যায়না এনজামের। ডাক্তার চলে যেতেই প্রীতি,অ্যানি আসে এনজামের কাছে। ডাকে, সে সাড়া দেয়না। বাধ্য হয়ে হালকা ঝাঁকাতেই এনজাম শিথিল কণ্ঠে শুধায়,
– “তোরা যা, কথা বল ওর সঙ্গে।”
– “তুমি যাবেনা?”
দুদিকে মাথা নাড়ে এনজাম। অ্যানি প্রীতির দিকে তাকাতেই সে এনজামের কাঁধে হাত রেখে বলে,
– “প্রজ্ঞা আপনাকে ডেকেছে ভাইয়া, আপনি না গেলে ও চিন্তা করবে আরো।”
– “গিয়ে কী বলবো? কী উত্তর দেবো ওকে?”
প্রীতির দিকে টলমলে চোখে চেয়ে বলে সে,
– “যখন জিজ্ঞেস করবে, ওর মেয়ে কেমন আছে… আমি কী বলবো প্রীতি? পারবোনা আমি ওর সামনে যেতে। জোর করোনা।”
চোখ টিপে ধরে অশ্রু আড়াল করে এনজাম। পাপিয়ার দিকে একবার তাকিয়ে বলে,
– “মেয়ের কাছে যান মা। আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলে দিয়েন অফিসে জরুরী কাজ ছিলো বলে চলে গেছি।”
পাপিয়া কিছু বলার পূর্বে কেবিন থেকে একজন নার্স বের হলেন হাতে ঔষধের ট্রে নিয়ে। এসেই বললেন,
– “আপনাদের মধ্যে পেশেন্টের হাজবেন্ড কে? তিনি অনেকবার জিজ্ঞেস করেছেন। থাকলে তার সঙ্গে কথা বলে আসুন।”
এনজাম একেবারেই দিশেহারা হয়ে পড়লো। কী করবে সে? প্রজ্ঞার দিকে তাকাবে কী করে? তার আহাজারি নিজের চোখে দেখবে কী করে? কী করে সামলাবে তাকে? এও সম্ভব?
অ্যানি তার কাঁধে হাত রেখে অনুরোধের স্বরে বলে,
– “ভাবীর দিকটা ভেবে দেখো একবার। তুমি এমন করলে কী করে চলবে বলো? তুমি ব্যতীত তাকে আর কেউ বোঝাতে পারবেনা ভাইয়া। যাও তার কাছে।”
প্রণয়ের দিকে একবার তাকিয়ে উঠে দাঁড়ায় এনজাম। থমথমে পায়ে এগিয়ে যায় কেবিনের দরজার দিকে। অথচ সে জানেই না, ভিতরে গিয়ে কী করবে। প্রজ্ঞার প্রশ্নের ভার সামলাবে কী করে?
#চলবে?
#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_৪৩ [শেষাংশ]
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন
মুখের অক্সিজেন মাস্ক খোলা হয়েছে প্রজ্ঞার। দু ব্যাগ রক্ত দেওয়াও শেষ হয়েছে, স্যালাইন চলছে এখনো। ঠোঁটদুটি শুকিয়ে কাঠ। এনজাম লম্বা নিঃশ্বাসে বুকভর্তি অক্সিজেন টেনে বসলো তার পাশে। প্রীতিসহ বাকিরাও এসে দাঁড়ায় একপাশে। এনজাম চেয়েও মুখ খুলতে পারেনা, ভারী হয়ে থাকা হাতটা প্রজ্ঞার মাথায় রাখতেই সে চোখ খুলে চাইলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মৃদু আওয়াজে বললো,
– “একটু পানি…”
তৎক্ষণাৎ পানির বোতলের মুখে করে সামান্য পানি নিয়ে তার ঠোঁট ভিজিয়ে দিলো এনজাম। পুনরায় বোতলটা ঠিক জায়গায় রেখে জানতে চাইলো,
– “কেমন লাগছে এখন? ব্যাথা হচ্ছে?”
মাথা উপরনিচ করে সম্মতি জানায় প্রজ্ঞা। এনজাম জিজ্ঞেস করে,
– “নার্সকে ডাকবো?”
– “উঁহু।”
মুখখানা এনজামের দিকে ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে প্রজ্ঞা,
– “মেয়ে হয়েছে না আ আমার?”
এনজাম একটু অবাক হলো। সচরাচর বাচ্চাকে প্রথম মায়ের কাছেই নিয়ে আসে,তাকে জানায়। প্রজ্ঞা কী জানে না কিছুই?
– “বলো?”
মৃদু হেসে মাথা নাড়ে এনজাম। চোখ বুজে এক স্বস্তির দম ফেলে প্রজ্ঞা। পরক্ষনেই চোখ মেলে জানতে চায়,
– “ক কোথায় ও?”
তার প্রশ্নে থমকে যায় এনজাম। যেই প্রশ্নের ভয় পেয়েছিলো সে। বাকিদের দিকে তাকায় একবার। এনজাম উত্তর না দেওয়ায় ভ্রু কুঁচকালো প্রজ্ঞা। পুনরায় বললো,
– “আমার বাচ্চা কোথায়? নিয়ে আসো ওকে, আমি দেখবো।”
এনজাম চাইলো তাকে আশ্বাস দিতে, কিন্তু তা সম্ভব হলোনা। একজন মা-কে মিথ্যে বলবে? কী করে? কী করে ঠকায় তাকে? অথচ এই মুহূর্তে কোনো খারাপ খবরও প্রজ্ঞার কানে দেওয়া সম্ভব নয়। অপারেশন এর পনেরো ঘণ্টাও পূর্ন হয়নি,সামান্য কান্নাকাটি ও তার জন্য ক্ষতিকর। সেখানে সন্তান হারানোর কষ্ট সামলাবে কী করে?
এনজামের নির্বাক রূপ যেন অনেক কিছু বুঝিয়ে দিলো প্রজ্ঞাকে। সে মানতে চাইলো না, বিশ্বাস করতে চাইলো না। নিচু স্বরের জায়গায় উত্তেজিত হয়ে শুধালো,
– “চ চুপ করে আছো কেন? বলো, কোথায় রেখেছো আমার মেয়েকে? এনে দাও ওকে, এখনি…”
এনজাম তবুও নিশ্চুপ। এই নারীটির সম্মুখে সে যে অত্যাধিক দূর্বল, তা আবারো প্রকাশ পেলো। তাকে বোঝানোর বদলে চোখ নামিয়ে নিলো এনজাম, ডানচোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে একফোঁটা নোনাজল। নিজের শরীরে থাকা যন্ত্রণা বিলীন হয়ে যায় হৃদয়ের অসহ্য বেদনার কাছে। হাতে লাগানো ক্যানোলার কথা প্রজ্ঞা ভুলেই বসে এক মুহূর্তের জন্য। বেডের পাশে থাকা এনজামের হাতটা ধরে ঝাঁকাল দুবার, শক্ত ঢোক গিলে বললো,
– “চোখে পানি কেন? এইহ… কথা বলো!”
এনজাম চোখ না তোলায় সে হাত বাড়িয়ে চেপে ধরে তার কলার। হাতের ব্যাথাকে পরোয়া না করে কড়া গলায় বলে,
– “ত তুমি বলেছিলে না আমরা মেয়েকে নিয়ে বাড়ি যাবো? এনে দাও না ওকে! আমার কিন্তু রাগ হচ্ছে এবার… কথা বলিস না কেন তুই? কথা বল, কোথায় আমার ম… আহ!”
পেটে টান লাগতেই মৃদু আর্তনাদে ঠোঁট কামড়ে ধরলো প্রজ্ঞা। এনজাম তড়িৎবেগে তাকায় তার পানে। প্রীতি,পাপিয়া,অ্যানি ছুটে আসে তার কাছে। প্রজ্ঞা চোখ বন্ধ করে ফুঁপিয়ে উঠতে গিয়েও পেটে আঘাত পায়। কাঁদতেও পারছেনা মেয়েটা, দুচোখ বেয়ে কেবল অবাধে গড়িয়ে যায় বারিধারা। প্রীতি এসে সামলায় তাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
– “শান্ত হ একটু। অসুস্থ হয়ে পড়বি তুই!”
প্রজ্ঞা পারেনা তার কথা মানতে। দুদিকে মাথা নেড়ে বলে,
– “তাহলে তুই বল আমার মেয়ে কোথায়!”
পাশে দাঁড়ানো পাপিয়ার দিকে চেয়ে সে আকুতির স্বরে বলে,
– “ও মা! তুমি তো মা, তুমি অন্তত বলো আমার মেয়ে ঠিক আছে।”
এনজামের দিকে তাকিয়েও অনুরোধ জানায় সে,
– “দোহাই লাগে চুপ করে থেকোনা। তোমার সন্তান ও! কেমন বাবা তুমি? তুমি থাকতে তো ওর কিচ্ছু হতে পারেনা। আল্লাহ এভাবে আমার কোল খালি করবেন না!”
প্রীতির ভাইব্রেশন এ থাকা ফোনে স্বজন এর কল এলো তখন। প্রজ্ঞার কাছ থেকে দূরে সরে সে রিসিভ করে কলটা। অথচ প্রজ্ঞার আহাজারি থামার নাম নেই। সবার দিকে চেয়ে সে এবার চোখ বুজে বলে,
– “সবাই চুপ করেই থাকবে? কী বোঝাতে চাইছো? আমার বাচ্চা… ও ন নেই? ওকে একবার কোলেও নিতে পারলাম না আমি! উত্তর দাও… ওকে এনে দেবেনা আমার কাছে?”
এনজাম বুঝলো, এই মুহূর্তে এখানে থাকাটা তার পক্ষে সম্ভব নহ, কোনো প্রকার স্বান্ত্বনা দেওয়াও সম্ভব নয়। সে প্রজ্ঞার হাতটা আস্তে করে ছেড়ে চলে যেতে নেয় কেবিন থেকে। তা লক্ষ্য করতেই প্রজ্ঞার কান্নার মাত্রা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। প্রায় বেরিয়েই গিয়েছিলো এনজাম, এমন সময় প্রীতি কান থেকে ফোনটা সরিয়েই তড়িৎবেগে প্রজ্ঞার কাছে এসে বলে,
– “কেন দেবেনা? একশোবার এনে দেবে। শান্ত হ, কিচ্ছু হয়নি তোর মেয়ের। ও ঠিক আছে, ভালো আছে।”
এনজাম অবাক হয়ে থাকার তার পানে। প্রজ্ঞা কথাগুলো বিশ্বাস না করেই বলে,
– “মিথ্যে বলছিস?”
– “নাহ,সত্যি বলছি! স্বজন এইমাত্র কল করলো আমাকে। আরে ওকে অন্য একটা বাচ্চার ক্রিটিকাল কন্ডিশন এর কথা বলে ডেকে নেওয়া হয়েছিলো, একটা মিস আন্ডার্সট্যান্ডিং হয়েছে জাস্ট। তোর মেয়ে ঠিক আছে, বিশ্বাস কর!”
এনজাম দরজার সামনে থেকে ছুটে এলো তার কাছে। অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,
– “সত্যি বলছো তুমি?”
প্রীতি ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
– “হ্যা বাবা,সত্যি বলছি। বিশ্বাস না হলে কল করে দেখো।”
এনজাম ফোঁস করে দম ছেড়ে বসে পড়লো টুলটাতে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে প্রজ্ঞার হাতটা ধরতে চাওয়ামাত্রই সে সরিয়ে নেয় হাতটা। এনজাম তাকাতেই সবার সামনে এক চ’ড় বসায় তার গালে। পাপিয়া,অ্যানি,প্রীতি হতভম্ব হয়ে যায় তার এহেন কাজে। এনজাম বড়বড় চোখে তাকাতেই সে ক্ষুব্ধ স্বরে বলে,
– “একদম ছুঁবেনা আমাকে, যাও দূরে সরো। একটা কথাও বলবেনা আর। শ’য়’তা’ন একটা… নিজের মেয়েকে নিয়ে এভাবে ভয় দেখাতে লজ্জা করেনা? জানটা বেরিয়ে যাচ্ছিলো আমার!”
এনজাম অসহায় চোখে চেয়ে একপ্রকার জোর করেই তার হাতটা ধরে বলে,
– “ভুল হয়ে গেছে, মাফ করে দাও। আর দোষ কী শুধু আমার নাকি? তোমার বোনের জামাই এমনভাবে বললো যে আমরা ধরেই নিয়েছিলাম… না না, ভুল ভেবেছি। খোদার কসম, আর কখনো এমন ভুল চিন্তা করবোনা।”
রেগে থাকার,রাগ দেখানোর মতো শারীরিক অবস্থা নেই প্রজ্ঞার। যতটুকু কথা বলেছে, তাতেই শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, পেটের চারিপাশে বিষব্যাথা। হাতটা এনজামের হাতের মাঝে ছেড়ে দিয়ে ক্লান্ত চক্ষুদ্বয় বোজামাত্রই দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো আনজুম আর প্রণয়। তাকে বাহিরে ধরে রাখা যাচ্ছেনা আর। কতটা সময় পর মা-কে দেখলো সে। ‘মাম্মা’ বলে চেঁচিয়ে উঠে ছুটে এলো মায়ের কাছে। প্রজ্ঞা চোখ খুললো পুনরায়। প্রণয় এসেই পাশ থেকে গলা জড়িয়ে ধরে তার। টপাটপ দুটো চুমু খায় গালে। জল দেখে চোখ মুছিয়ে দেয়। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে প্রজ্ঞার। তার হাতের পিঠে একটা চুমু খেয়ে নিচু কণ্ঠে শুধায়,
– “কেমন আছো সোনা? খেয়েছো তুমি?”
– “হ্যা, বাবা খাইয়ে দিয়েছে তো। কিন্তু তুমি শুয়ে আছো কেন? বোন তো কাঁদবে তোমার জন্য।”
প্রজ্ঞা ভ্রু কুঁচকে শুধায়,
– “বোন কাঁদবে?”
প্রণয় আগ্রহের সহিত বলে,
– “হ্যা। আমার মন খারাপ হচ্ছিলো, তাই তো রাতে কাঁদছিলাম। বোনের মন খারাপ হলে ও কাঁদবেনা? মাম্মাকে খুঁজবেনা?”
উপস্থিত সবাই হেসে উঠলো তার কথায়। প্রজ্ঞা জানতে চাইলো,
– “তুমি দেখেছো বোনকে?”
– “হ্যা! জানো, ও কত্ত ছোট! এত্তুখানি (হাতের সাহায্যে দেখালো)। এত ছোট বাবুর সাথে আমি খেলবো কী করে?”
বড্ড চিন্তিত দেখালো তাকে। পরক্ষনেই জিজ্ঞেস করলো,
– “তুমি দেখোনি?”
দুদিকে মাথা নাড়ে প্রজ্ঞা। এনজাম জানতে চায়,
– “আসলেই দেখায়নি?”
প্রজ্ঞা তাকালো তার দিকে। বললো,
– “না তো। আমি তো কিছু টের ই পাইনি। পুরোপুরি অজ্ঞান করে নিলো, কিছুর খেয়াল ই নেই আমার। একবার দেখতেও পারিনি। কোথায় রেখেছে ওকে? আমাকে নিয়ে যাওনা একবার!”
কী মায়া তার কণ্ঠে! বাচ্চাকে দেখার কী অসীম বাসনা! এনজামের ইচ্ছে করে এখনি বাচ্চাকে তার কোলে এনে দিতে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। আর প্রজ্ঞাকেও নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সে বুঝিয়ে বলে,
– “যাবো, কিন্তু এখন না। একটু সুস্থ হও আগে।”
– “মেয়েকে দেখলেই আমি সুস্থ হয়ে যাবো। একটু ধরো আমাকে, তাহলেই উঠতে পারবো।”
এনজামের হাতটা চেপে ধরে সে ওঠার চেষ্টা করে। তবে কাঁচা সেলাই তে টান লাগায় আর উঠে বসতে পারেনা, শুয়ে পড়ে আবারো। প্রণয় তার শরীরে টেনে দেওয়া চাদরের উপর থেকে পেটে আলতোভাবে হাত বুলিয়ে জানতে চায়,
– “তোমার পেটে ব্যাথা মাম্মা?”
পেটের ব্যাথাকে অগ্রাহ্য করে মাথা নাড়ে প্রজ্ঞা। একহাতে প্রণয়ের মাথাটা কাছে টেনে কপালে চুমু খেয়ে বলে,
– “কোনো ব্যাথা নেই মাম্মার। আমার জানদুটো ভালো থাকলে, আমার আর কোনো কষ্ট নেই।”
– – –
সন্ধ্যাবেলা প্রজ্ঞা আরো অস্থির হয়ে উঠলো বাচ্চার কাছে যাওয়ার জন্য। বহু চেষ্টার পর একটুখানি উঠে বসতে সক্ষম হলেও উঠে দাঁড়িয়ে হুইল চেয়ারে বসার সক্ষমতা তার নেই। শেষ অবধি স্বজন এসে সময় নিয়ে বোঝায় তাকে। সঠিক চিকিৎসা এবং উপরওয়ালার ইচ্ছে থাকলে এমন প্রি ম্যাচিউর বাচ্চারাও সুস্থভাবে বেঁচে থাকে। বিষয়টা অনেকাংশে ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল। তাই অস্থির না হয়ে তার জন্য দোয়া করাই শ্রেয়। প্রজ্ঞা মন খারাপ করে শুয়ে থাকে। আজ তাকে কেবল তরল খাবারই খেতে দেওয়া হয়েছে। এনজাম তাই ক্যান্টিন থেকে চিকেন স্যুপ কিনে নিয়ে এলো। পাশে বসে একটু একটু করে খাইয়ে দিলো প্রজ্ঞাকে। প্রণয় আনজুমের কোলে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রীতি,অ্যানি,স্বজন রয়েছে কেবিনেই। এনজামের বাবা-মা এসেছিলেন একটু আগে। তাদের পাঠানো হয়েছে বাড়িতে। বয়স্ক মানুষ তারা, অনেকটা জার্নি করে এসেছে। কিছুটা বিশ্রামের প্রয়োজন তাদের।
পাপিয়া আক্তার বসে আছেন সোফায়। প্রজ্ঞা খেয়াল করলো, এনজাম সেই সকাল থেকে কোনো একটা বিষয়ে ভেবেই চলেছে। মুখে কথা নেই, হাসি নেই একটুও। একা পেলে জিজ্ঞেস করা যেত, তবে তাকে একা পাওয়ার মতো সৌভাগ্য হয়নি এখনো।
অর্ধেকটা স্যুপ খেলো প্রজ্ঞা। এনজাম আর জোর করেনা। স্যুপের বাটি নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে উঠে দাঁড়ায় সে। শার্টটা টানটান করে ধীর পায়ে এসে দাঁড়ায় পাপিয়া আক্তার এর সামনে। তার নজর ছিলো মেঝের দিকে। এনজামের উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ তুলতেই সে মৃদুস্বরে শুধায়,
– “কিছু কথা বলার ছিলো মা।”
– “কী কথা?”
ভারী গলায় জানতে চাইলেন পাপিয়া। এনজাম পূর্বেই ন্যায় স্থির কণ্ঠে বলে,
– “আপনি কি এখনো রেগে আছেন আমার উপর?”
– “মানে?” ভ্রু কুঁচকে শুধালেন পাপিয়া। কেবিনে উপস্থিত সকলেই একটু চমকালো তার এহেন প্রশ্নে। এনজামের মাঝে যদিও ভাবান্তর লক্ষ্য করা যায়না। নামিয়ে রাখা চক্ষুদ্বয় একটুখানি উপরে তুলে অদ্ভুত স্বরে বলে সে,
– “আপনার মেয়েকে কখনো আপনার থেকে কেড়ে নিতে চাইনি আমি।”
পাপিয়া আক্তার বিচক্ষণ মানুষ। চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলেন,
– “এসব কথা কেন উঠছে এখন?”
এনজাম আরো একটু এগিয়ে এসে হুট করেই তার পায়ের কাছে হাটু ভেঙে বসে পড়লো। তিনি অবাক চোখে তাকাতেই মৃদু হেসে বললো,
– “আপনার সাথে এ অবধি আমার চুক্তি হয়েছে অনেক। নিজে থেকে প্রতিশ্রুতি ও দিয়েছি, ততটা বোধ হয় আপনার মেয়েকেও দেইনি।”
সকলের দিকে একনজর তাকিয়ে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
– “তবে কখনো খাস দিলে ক্ষমা চাওয়া হয়নি। আজ যদি সবার সামনে আপনার কাছে ক্ষমা চাই, আপনি কি আমাকে ক্ষমা করবেন মা?”
– “তোমার অহেতুক কথা শোনার মতো মানসিকতা এই মুহূর্তে কারো নেই। বিশেষ করে আমার নেই।”
প্রজ্ঞা কষ্ট পেলো তার কথায়। সব সময় ছেলেটার সঙ্গে এভাবে কথা বলবেন কেন তিনি? আরো এমন সময়ে? কিছুটা অভিমান নিয়েই বলতে নেয় সে,
– “আম্মু তুমি…”
– “প্রজ্ঞা, চুপ! আমি কথা বলছি, মাঝে কিছু বলতে আসবেনা প্লিজ।”
এনজাম থামিয়ে দেয় তাকে। জিহ্বা দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে শাশুড়ির কঠিন মুখের দিকে তাকিয়ে শুধায়,
– “ছেলের মতোই তো আপনার, মাঝেমধ্যে কিছু অহেতুক কথা শুনে নিলেই বা কী? একসময় তো অনেক অতিরিক্ত কথাই বলেছি, বাচ্চাদের মতো। ভাবলে হাসি পায়। তখন শুনেছেন, এখনো শুনুন একটু।”
পাপিয়া চোখ ঘোরালেন। খেয়াল করে দেখলেন, এনজামের চোখ টলমল করছে। বিস্মিত হলেন তিনি। যে ছেলে এতবছরে কখনো তার নিকট স্বেচ্ছায় মাথা নত করেনি, সেই ছেলে আজ তার পায়ের কাছে বসে ক্ষমা চাইছে? কী অদ্ভুত! মায়ের মন একটু আঘাত পেল হয়তো। মুখভঙ্গিমা বদলে শিথিল হয়ে এলো তার। এনজাম পুনরায় চোখ নামিয়ে বলে,
– “আজকের বোধবুদ্ধির একাংশ যদি কয়েক বছর আগে থাকতো, আমি কখনো এমন একটা ভুল করতাম না মা। সে আপনার মেয়েকে যদি হারিয়েও ফেলতে হতো, তবুও না। সেই মুহূর্তে একবারের জন্যও মাথাতেই আসেনি, নিজের কথা ভাবতে গিয়ে কাউকে আঘাত করছি আমি। নিজেও ভাবিনি, আপনার মেয়েকেও ভাবতে দেইনি। তাকে না খুব আশ্বাস দিয়েছি, ভালোবাসার মাধ্যমে সব কষ্ট, সবার কথা ভুলিয়ে দেবো।”
এটুকু বলে হেসে উঠলো এনজাম। পাপিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
– “তখন আমি বিশ্বাসই করতে চাইনি, মা-বাবার চেয়ে বেশি সন্তানকে আর কেউ ভালোবাসতে পারেনা এই পৃথিবীতে। এটুকু বোঝার ক্ষমতা থাকলে আমি আপনার কাছে যেতাম। অনুরোধ করে, পায়ে পড়ে হলেও তাকে চেয়ে নিতাম। আপনাকে, নিজের মা-বাবাকে ছোট করতাম না। ভালোবেসে আদায় করতাম ওকে, ছিনিয়ে নিতাম না।”
বারকয়েক নাক টানলো এনজাম। দু হাত এক করে কান্নাভেজা কণ্ঠে শুধালো,
– “আল্লাহ কোনো এক উছিলায় মানুষকে নিজেদের ভুল বুঝিয়ে দেন। ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চাইলে কী তাকে ক্ষমা করা যায়না মা? আপনি বললে আমি পা ধরে ক্ষমা চাইতে পারি, তবুও… মন থেকে একবার মাফ করে দিন। আপনার দোয়ার খুব প্রয়োজন আমার, আমাদের।”
বাকিদের চোখ ভিজলো তার কথায়, কেবল স্বজন ব্যতীত। সে মুচকি হাসে শুধু। তার এই ভুলে সে সঙ্গ দিয়েছিলো, সেই হিসেবে দোষী তো সে-ও।
পাপিয়া আক্তার বুক ভরে নিঃশ্বাস টানলেন একবার। তড়িঘড়ি করে আঁচলে চোখ মুছলেন। গম্ভীর মুখে এনজামের হাতদুটো সরিয়ে দিতেই সে আহত চোখে তাকালো। পাপিয়া চোখ ছোট করে বললেন,
– “খুব বুদ্ধি উদয় হচ্ছে এখন? নতুন করে জামাই আদর খাওয়ার শখ জেগেছে? তা বললেই হয়, দু বাচ্চার বাপ হয়ে এভাবে কান্নাকাটি করার প্রয়োজন ছিলোনা। তোমার শাশুড়ির এখনো যথেষ্ট গুন রয়েছে।”
– “মা…”
হতবাক স্বরে বলে এনজাম। পাপিয়া মৃদু হেসে হাত রাখেন তার মাথায়। মৃদু স্বরে বলেন,
– “সন্তানের প্রতি মা-বাবার ভালোবাসা বুঝতে শিখেছো, তাহলে আলাদা করে দোয়া চাওয়ার কী মানে? মা-বাবার মনে কখনো সন্তানের জন্য বদদোয়া আসেনা, তারা শত অন্যায় করলেও মা চায় তারা শুধরে যাক।”
সকাল থেকে আটকে রাখা কান্নাটুকু এবার বাঁধনহারা হলো। মাথাটা পাপিয়ার হাটুতে ঠেকিয়ে নিরবে কেঁদে উঠলো এনজাম। প্রজ্ঞা কাঁদলো বিছানায় শুয়ে। প্রীতি,অ্যানি পাশে এসে সামলালো তাকে। পাপিয়া প্রথমবারের মতো হাত বুলিয়ে দিলেন ছেলেটির মাথায়। হাসিমুখে বললেন,
– “তাও যখন চেয়েছো… তো দিলাম দোয়া। খাস দিলে ক্ষমা চেয়েছো, আমিও খাস দিলে দোয়া করলাম, জীবনে সুখি হও। স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে সুখে সংসার করো। মেয়ের পছন্দের উপর যেন অহংকার হয় এই মায়ের।”
অতি আবেগঘন মুহূর্তের মাঝে স্বজন হতাশ কণ্ঠে বলে উঠলো,
– “দোয়া কি মিস করে যাচ্ছি মা?”
পাপিয়া হেসে উঠলেন। হাত বাড়িয়ে ডাকলেন,
– “তো তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? এসো এখানে, এক ছেলে বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। তুমিও শুরু করো, যত বেশি কান্না, তত বেশি দোয়া।”
স্বজন হেসে উঠে তার পাশে এসে বসলো। অন্যহাতটা তার মাথায় রেখে দোয়া করলেন পাপিয়া। প্রজ্ঞা তাদের দিকে তাকিয়ে থেকে কান্নার মাঝেও হাসলো। প্রীতির দিকে তাকিয়ে বললো,
– “সবাই আছে এখানে, শুধু আমার মেয়েটা ছাড়া। ও থাকলেই সবটা পরিপূর্ণ মনে হতো, না?”
অ্যানি হাত বুলিয়ে দেয় ভাবীর মাথায়। মুচকি হেসে বলে,
– “তোমার মেয়ে সকলের মধ্যমণি হয়ে থাকবে, দেখে নিও। পুরো পরিবারটাকে এক করে রাখবে ও।”
প্রজ্ঞা চোখ বুজে সৃষ্টিকর্তার নিকট ফরিয়াদ জানায়, তিনি যেন তার মেয়েটাকে তাদের মাঝে ফিরিয়ে দেন। অ্যানির কথাই যেন সত্যি হয়।
– – –
কথায় কথায় কেটে যায় একটা সপ্তাহ। আল্লাহ বুঝি চোখ তুকে চেয়েছেন তাদের পানে, এত মানুষের অশ্রু, দোয়ায় খুশি হয়েছেন একটু। তাইতো প্রজ্ঞা-এনজামের মেয়েকে তাদের মাঝেই থাকতে দিয়েছেন। যদিও সে এখনো মা-বাবার মাঝে আসার সুযোগ পায়নি। ইনকিউবেটরের ভিতরই দিন কাটছে তার। মা-বাবা যায় তার কাছে, তাকে ছুঁয়ে দেখে, বুকে স্থান দেয়। প্রতিবার মা কাঁদে তার জন্য। মায়ের বুকের দুধ তাকে খেতে দেওয়া হয় নলের মাধ্যমে।
স্বজনের বলা কথা অনুযায়ী, তার উন্নতি হচ্ছে ধীরেধীরে। যেহেতু অনেক আগে জন্ম হয়েছে, তাই অনেকটা সময় তাকে চিকিৎসার মাঝে থাকতে হবে। সময়টা এক মাস হতে পারে, দুমাস হতে পারে আবার তিন মাসও হতে পারে, নির্ভর করছে তার শারীরিক অবস্থার উপর। তবে আশা রাখা যায়, সে সুস্থ হয়ে মায়ের কোলে ফিরে আসবে।
প্রজ্ঞা দুদিনের দিন অনেকটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। শরীরে রক্ত কমে যাওয়ায় আরো এক ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছিলো তাকে। এরপর ধীরেধীরে সে-ও সুস্থ হয়ে উঠেছে। একাই হাঁটাচলা করতে পারে এখন। ধীরেধীরে, তবে পারে। মেয়েটা সঙ্গে থাকলে এক সপ্তাহে আরো সুস্থ হয়ে যেত হয়তো।
যেহেতু বাচ্চা এন আই সি ইউ তে আছে, তাই প্রজ্ঞার ও আর বাড়ি যাওয়া হয়নি। হাসপাতালেই থাকতে হচ্ছে। এতে তার খুব একটা কষ্ট না হলেও এনজামের উপর বড্ড খাটুনি যাচ্ছে কদিন ধরে। অফিস থেকে চারদিনের ছুটি শেষ হবার পর তিনদিন ধরে সেই সকালে অফিসে যায়। সেখান থেকে বাসায় গিয়ে গোসল করেই ছুটে আসে হসপিটালে, সকাল অবধি এখানেই থাকে। খাওয়া-দাওয়ার দিকে কোনো নজর ই নেই তার। মানুষ তো সে! এত ধকল তার শরীর সামলাবে কী করে? প্রকাশ না করলেও ক্লান্ত তো হতেই হয়।
এনজাম আসার পরপরই অ্যানি প্রণয়কে নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়, এই অবস্থাতে ছেলেটা অসুস্থ হয়ে পড়লে মস্ত বড় বিপদ। প্রীতি,পাপিয়া যায় নয়টার দিকে। এরপরের সময়টুকু তারা একাই থাকে।
এনজাম বাড়ি থেকে ফেরার পর থেকে সোফায় বসে দু আঙুলে কপাল টিপছিলো। চোখমুখ বসে গেছে একদম, প্রজ্ঞা তাকাতে পারেনা তার দিকে। প্রীতি,পাপিয়া চলে যাওয়ার পর সে বেড এ বসে ডাকলো এনজামকে,
– “এইযে, এদিকে এসো।”
এনজাম কপাল থেকে হাত নামিয়ে তাকায় তার পানে। উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
– “কিছু লাগবে? খাবে কিছু? এনে দেবো?”
প্রজ্ঞা ভ্রু কুঁচকে শুধায়,
– “আসতে বলেছি আসবে। এত প্রশ্ন কেন?”
এনজাম এসে বসে তার সামনে। প্রজ্ঞা বলে,
– “ওদিকে ঘুরে বোসো।”
– “কেন?”
– “উফফ!”
এনজাম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘুরে বসলো। প্রজ্ঞা ধীরেধীরে নেমে দাড়ালো। এনজামের পিছনে এসে দুহাত রাখলো তার চুলের মাঝে। আলতোভাবে টেনে দিলো চুলগুলো। মাঝে একহাতে টিপে দিলো কপালটা। আরাম পেয়ে চোখ বুজে ফেলে এনজাম। প্রজ্ঞা তার মাথার সঙ্গে গাল ঠেকিয়ে বলে,
– “কী হাল করছো নিজের? এত অবহেলা করলে চলে? বউ বাচ্চার খেয়াল রাখতে গিয়ে যদি নিজের এই হাল করো, তাহলে তাদের দেখবে কে শুনি?”
– “ঠিক আছি তো আমি।”
মৃদু হেসে জবাব দেয় এনজাম। প্রজ্ঞা হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলে,
– “খুব দেখতে পাচ্ছি।”
এনজাম চোখ খুলে বলে,
– “কোথায় যাচ্ছো?”
– “চুপ করে থাকো।”
কড়া গলায় বলে সে টিফিন বক্সটার দিকে এগিয়ে যায়। তবে ব্যাগে করে মেঝেতে রাখায় আর ঝুঁকে তুলতে পারে। এনজাম পাশে এসে তা তুলে দিয়ে বলে,
– “খিদে পেয়েছে? খাবে এখন?”
প্রজ্ঞা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই এনজাম প্লেটে ভাত,মাছ,ভাজি তুলে বেড এ নিয়ে আসে। প্রজ্ঞা হাত ধুয়ে এসে বসে ধীরেধীরে খাবার মেখে নেয়। মাছ বেছে আচমকা একনলা ভাত তুলে ধরে এনজামের মুখের কাছে। এনজাম হেসে তা সরিয়ে দিয়ে বলে,
– “খাও তুমি, আমি পরে খেয়ে নেবো।”
– “খেতে বলেছি!”
গম্ভীর স্বর তার। এনজাম একনজর তার হাতের দিকে তাকিয়ে মুখে নেয় খাবারটুকু। প্রজ্ঞা পুনরায় প্লেটে হাত রেখে বলে,
– “কাছে এগিয়ে বোসো। টেনে টেনে খাওয়াতে কষ্ট হয় আমার।”
এনজাম প্রতিবাদ না জানিয়ে তার কাছে এসে বসে। প্রজ্ঞা ছোট ছোট লোকমা তুলে খাইয়ে দেয় তাকে। মুখের দিকে না তাকিয়েই বলে,
– “ছেলে মেয়েকে খাওয়ানোর সময় নাকি বরকেও খাইয়ে দিতে হয়! হুহ… তিন বাচ্চা সামলাবো তো আমি একসাথে। নিজের অযত্ন করে জীবনটাই পুরো তেজপাতা বানিয়ে দাও আমার।”
এনজাম একদৃষ্টে তার পানে চেয়ে খেতে লাগলো, মুখে কোনো বুলি নেই। প্রজ্ঞা একবার তার দিকে তাকিয়ে চোখে জল দেখতেই বলে,
– “ঝাল হয়েছে খাবারে? পানি খাবে?”
– “উঁহু।”
প্রজ্ঞা কথা না বলে তাকে খাইয়ে দেয় বাকি খাবারটুকু। একটা দানাও অবশিষ্ট রাখেনা সে। শেষ অবধি তার হাতটা ধরে আঙুলগুলোও চেটেপুটে খায়। খাওয়া শেষে প্রজ্ঞা প্লেটটা রেখে এগিয়ে আসে তার নিকটে। ছলছল চোখে চেয়ে তার গালে হাত রাখে। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলটুকু বৃদ্ধাঙ্গুলে মুছিয়ে দিয়ে বলে,
– “কী হয়েছে তোমার? কথা বলোনা, ঝগড়া করোনা, সারাক্ষণ চুপ করে থাকো। এমন কেন করছো? এমনিতেই মন ভালো থাকেনা। তার উপর তুমি এমন করলে কোথায় যাই বলতো? শরীরের সব ব্যাথা সহ্য করা যায়, কিন্তু কাছের মানুষের কষ্টগুলো মেনে নেওয়া যায়না গো! মেয়ের জন্য চিন্তা হয়? চিন্তা কোরোনা। ও সুস্থ হয়ে যাবে, তোমার বুকে উঠে খিলখিলিয়ে হাসবে দেখো। মেয়ের কাছে বাবার সুপারহিরো হতে হয়। তোমাকে এমন অবস্থায় দেখলে তো জিরো ভাববে একদম!”
এনজাম বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টায়। দুহাতে তার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ ডুবিয়ে রাখে। প্রজ্ঞা একটা হাত পিঠে রাখলেই হাতের বাঁধন শক্ত করে শুধায়,
– “জানো কত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম? আসেপাশে এত মানুষ থাকতেও মনে হচ্ছিলো কেউ নেই আমার, কিচ্ছু নেই। প্রতিটা সেকেন্ডে মনে হয়েছে, এই বুঝি তোমাকে হারিয়ে ফেললাম আমি! এখনো ঘুমোতে পারিনা জানো? ঘুমোলেই সব খারাপ স্বপ্ন আসে মাথায়। এমন ভয় আর কখনো দেখিও না প্লিজ! বাচ্চাদের আমি যতটা চাই, ততটা তোমাকেও চাই। তুমি ছাড়া ওদের সামলাতে পারতাম না আমি। পারতাম না ভালো বাবা হতে। দু-বেলা নিয়ম করে ধমক না খেলে ঠিকঠাক কাজ হয়না আমার দ্বারা!”
প্রজ্ঞা ফিঁক করে হেসে ফেললো। নাক টেনে তার মুখটা সামনে এনে বললো,
– “এত নির্ভরশীলতা? এই তুমি নাকি আমায় ছাড়া থাকতে পারবে? কোনো সমস্যাই হবেনা! চাই ই না প্রজ্ঞাকে?”
– “ওসব তো কথার কথা, সত্যি সত্যি বলেছি নাকি?”
প্রজ্ঞা হেসে উঠে এলোমেলো করে দিলো তার চুলগুলো। কাছে এসে কপালে একটা চুমু খেয়ে বললো,
– “শক্ত হও মিস্টার। ফিরে এসেছি, তোমার ভাগ্য ভালো। না ফিরলে কী করতে? আমার ছেলে মেয়ের এক বিন্দু অযত্ন হলে ভূত হয়ে এসে তোমার ঘাড় মটকাতাম।”
এনজাম ঘাড়ের পিছনে হাত গলিয়ে আলতোভাবে তার চুলগুলো চেপে ধরে ঠোঁট ছোঁয়ায় ঠোঁটে। গালে নাক ঘষে বলে,
– “ও কথা আর ভাবতেও চাইছি না। নিজেকেই সামলানো দায়… ওদের কী করে সামলাতাম বলো?”
প্রজ্ঞা তার চোখে চোখ রেখে শুধায়,
– “আচ্ছা,ভেবোনা। ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবো। সামনে কিন্তু বিশাল দায়িত্ব তোমার। মেয়ে মানুষ করা এত সহজ কাজ নয়।”
– “সামলে নেবো।”
মৃদু হেসে বললো এনজাম। প্রজ্ঞার মনটা খারাপ হয়ে যায় হুট করে। মুখ ভার করে বলে,
– “আর কতদিন ওর থেকে দূরে থাকতে হবে? বুকটা কেমন খালি খালি লাগে!”
এনজাম তখনই উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
– “হাত ধুয়ে নাও। মেয়ের কাছেই যাবো,চলো।”
– “সত্যি? এখনি আসছি।”
তড়িঘড়ি করে উঠতে গিয়ে পেটে লাগলো তার। পরক্ষনেই তা সামলে হাত ধুয়ে এলো। দুজন মিলে চলে গেলো তিনতলায়, এন আই সি ইউ তে। সার্জিকাল গাউন পরিয়ে তাদের ভিতরে ঢোকানো হলো।
প্রজ্ঞা এনজাম এসে দাঁড়ায় তার পাশে, কাচের একটা বাক্সের মতো, তারই মাঝে শুয়ে আছে বাচ্চাটা। একহাত মাথার নিচে রেখে খুব আরাম করছে যেন! প্রজ্ঞা এনজামের হাতটা চেপে ধরে মুচকি হাসে। তাকে বসানো হয় চেয়ারে। প্রতিবারের ন্যায় বাচ্চাটিকে উঠিয়ে এনে তার উন্মুক্ত বুকে রাখা হয়। পর্দা টেনে দেওয়া, একজন ইন্টার্ন মেয়ে ডাক্তার, একজন নার্স এবং এনজাম ব্যতীত অন্য কেউ নেই সেখানে। প্রজ্ঞাকে অবাক করে দিয়ে বাচ্চাটা আজ প্রথমবারের মতো একটু কেঁদে উঠলো যেন! একটুখানি আওয়াজ… হ্যা, এনজামও শুনেছে তা। চোখ বড়বড় করে তারা তাকায় একে অপরের দিকে, পরক্ষনেই তাদের বাচ্চার দিকে। খুব খেয়াল করে দেখে, তার ডানচোখের একটা পাশ একটুখানি খোলা। মা-কে দেখতে পেয়েছে সে? একটু একটু করে চোখ খুলতে পারছে? আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো মায়ের মন। এনজাম তার কাঁধে হাত রাখে পিছনে দাঁড়ায়। একটু ঝুঁকে বলে,
– “ওর নাম রাখা হয়নি তো!”
প্রজ্ঞা মুচকি হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। খানিক বাদে বলে,
– “একজন এসেছিলো আমাদের প্রণয়ের অংশ হয়ে, তার নাম দিয়েছিলাম প্রণয়। আর তুমি এসেছো পূর্ণতা নিয়ে, আমাদের পূর্ণতা হয়ে। তাই তোমার নাম দিলাম পূর্ণতা। আমাদের মেয়ে, পূর্ণতা।”
#চলবে?