নব্বই পাতার ডায়েরী পর্ব-১১+১২+১৩

0
120

#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_১১
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন

– “আপনি চা খাওয়া কবে থেকে শুরু করলেন?”

নদীর থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকায় শাফায়াত। আইনজীবীর পোষাক পরিহিত মেয়েটির নিকট হতে পাওয়া প্রশ্ন শুনে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি এঁটে বলে,
– “আগেও তো খেতাম। পছন্দ না, তবে একেবারে খাইনা যে তেমনটা তো নয়।”

মেয়েটি গাল ভেঙে হেসে শুধায়,
– “আমি আপনাকে দু বছরে সর্বোচ্চ পাঁচবার চা খেতে দেখেছি। ধরে বেঁধেও চায়ের টঙে বসানো যায়না। সেই লোক কিনা আজ আমাকে নিজে থেকে বলে, ‘চলো চা খাই।’ কী অদ্ভুত! কেসটা কী বলুন তো? চা খাওয়ার সঙ্গী টঙ্গী পেলেন নাকি?”

শাফায়াত মাথা নুইয়ে দু আঙুলে ভ্রু চুলকে নিলো। কী সেয়ানা মেয়ে! প্রসঙ্গ পাল্টে সে জানতে চায়,
– “আমার কথা বাদ দাও। তোমার কথা বলো। ফার্স্ট টাইম কেস জিতলে বলে কথা! অনুভূতি কেমন, মিস প্রীতিলতা চৌধুরী?”

প্রীতি সহসাই রেগে যায়,
– “নট প্রীতিলতা! ইট’স প্রীতি, অনলি প্রীতি। একটা কিউটি পিউটি নাম।”

– “হলো একই।”

– “একই না! আর আপনি এমনভাবে বললেন যেন আগে কয়েকটা কেস লড়ে এই প্রথমবার জিতেছি। এটা আমার ফার্স্ট কেস। হাহ… প্রথমবারেই জেতা চারটে খানি কথা না। একটা মাস যাবৎ দিনরাত খেটেছি আমি। আপনার অ্যাপ্রেশিয়েট করা উচিৎ, একটু প্রশংসা করুন।”

শাফায়াত প্রশস্ত হেসে শুধায়,
– “ওহহো,অনেক মহান কাজ করেছেন! অভিনন্দন।”

প্রীতি এতেও ভ্রু কুঁচকে বলে,
– “হচ্ছেনা। সুন্দর করে বলতে হয়। যেন ফুলতে ফুলতে আকাশে উড়ে যাই।”

একসঙ্গে হেসে উঠলো দুজন। আশেপাশে শতশত মানুষের শোরগোল হলেও জায়গাটা স্নিগ্ধ খুব। প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য সেরা একটা জায়গা। শাফায়াত এখানে বেশ কয়েকবার এসেছে। প্রীতির সঙ্গে এই নিয়ে আসা হয়েছে তিনবার। দারুণ মেধাবী একটি মেয়ে। প্রায় দু বছর আগে এক মামলায় শাফায়াতের সহকারী হিসেবে কাজ করেছিলো, সেই থেকে এ অবধি বেশ কিছু কেস এ একসঙ্গে কাজ করেছে তারা। আর এবার প্রথম একা প্রধান হিসেবে কেস লড়লো,এবং জিতে ফিরলো।
প্রীতি চায়ের কাপটা রেখে দুহাতে মুখ লুকিয়ে উৎসাহী স্বরে জানায়,
– “জানেন, আমার ক্লায়েন্ট যে বয়স্ক মহিলা? রায় আসায় পর এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছিলো! যেভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছিলো আমাকে! আই জাস্ট ফিল দ্যাট, আমি এখানেই সফল। লাইফে যা চেয়েছি তা আমি পেয়েই গেছি। অথচ এখনো অনেক…অনেককিছু করা বাকি।”

শাফায়াত মুচকি হাসে। পরমুহূর্তে কিছুটা গম্ভীর গলায় বলে,
– “প্রথম অবস্থাতেই বেশ কঠিন কেস হাতে নিচ্ছো, সাবধানে থেকো। আজকে সবকিছু রঙিন মনে হলেও দুদিন বাদে বিপদে পড়তে পারো। মোদ্দা কথা, নিজের সেইফটি নিজের কাছে।”

প্রীতি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুধায়,
– “সাবধানে থাকবো, কীভাবে? মানে ঠিক কীভাবে সতর্ক থাকতে হবে? সাজেশন দিন গুরু।
আর নাহলে একটা ভালো আইডিয়া আছে মাথায়।”

– “কী আইডিয়া?”

– “বিয়ে করে নেওয়া উচিৎ। তারপর আমার সব দায়িত্ব জামাইয়ের হাতে। আমার খেয়াল সেই রাখবে। আমাকে আর কষ্ট করতে হবেনা।”

শাফায়াত মৃদু হেসে বলে,
– “দারুণ বুদ্ধি! এমনিতেও বহুদিন হলো কারো বিয়ে খাইনা। ইউ আর ইস্টাবলিশড নাও। সো,এখন ভাবতেই পারো এসব নিয়ে।”

প্রীতি কিছুটা ভাবুক কণ্ঠে শুধায়,
– “সিরিয়াসলি, ভাবাই উচিৎ। এক দু মিনিট এর ছোট বোন আমার বিয়ে করে সংসার করে আবার ডিভোর্স এর চিন্তাও করছে। আর আমি বসেবসে দেখছি তাদের। কপাল…সবই কপাল!”

আলতোভাবে কপাল চাপড়ালো প্রীতি। তার ভঙ্গিমা দেখে হেসে উঠলো শাফায়াত। খালি কাপটা পাশে রেখে বললো,
– “ওদের কথা আর বলোনা! তুমি যা বলেছিলে এরা তো দেখছি তার চেয়েও বড় পাগল।”

– “হুশশ! দেওয়াদের ও কান থাকে। আর আপনি কে ভাই? আমি কী আপনাকে চিনি?”

গম্ভীর ভঙ্গিতে বলেই ফিঁক করে হেসে ফেললো প্রীতি। গালে হাত রেখে বললো,
– “আপনাকে যে ফ্রিতে বিনোদন পাইয়ে দিলাম, এর জন্য অন্তত কিছু খাওয়ানো উচিৎ। বোন আমার ইনিয়ে বিনিয়ে বলে, কোনো ভালো লয়্যার এর খোঁজ দিতে। আমি ওর বোন! আমাকে ছেড়ে আমার কাছেই অন্য কারো খবর চায়, কী লেভেল এর বলদি বুঝে দেখুন! পাগলে জানেও না, আপনি ওদের এ টু জেড কাহিনী আগে থেকেই জেনে বসে আছেন।”

শাফায়াত ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে। বিস্মিত কণ্ঠে জানতে চায়,
– “এদের তুমি টলারেট করছো কী করে?”

প্রীতি কোর্টের কলারের দিকটা ঠিক করে বেশ ভাব নিয়ে বলে,
– “বুঝুন তাহলে, কত ধৈর্য আমার! এদের অভিযোগ শুনেশুনে আধপাগল হয়ে বসে আছি। কিন্তু প….”

শাফায়াতের পিছনে খানিকটা দূরে চোখ যেতেই থেমে যায় প্রীতি। তিনজন ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ চিনতে পারা মাত্রই চোখদুটো বড়বড় হয়ে আসে তার। শাফায়াত তার অকস্মাৎ থেমে যাওয়ায় ভ্রু কুঁচকে বলে,
– “প কী?”

– “প প প্রজ্ঞা! আরে ওরা এখানে কী করছে?”

.
সকালে মত না দিলেও দুপুর হতেই নিজে থেকে সেজেগুজে তৈরি হয়ে যায় প্রজ্ঞা। তারপর প্রণয়কে সঙ্গে নিয়ে এনজামের কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান শুরু করে দেয়। এনজাম প্রজ্ঞার এহেন বাচ্চামোতে আনমতে হেসেই উঠে গিয়ে তৈরি হয়।
তারা প্রায়ই ছুটির দিনে ঘুড়তে বেরোয়। ছেলেকে সময় দেওয়ার চেষ্টা করে। তবে ঘুড়তে এসে বাবা মায়ের তর্ক দেখেই শখ মিটে যায় প্রণয়ের। এই যেমন এখন, এনজাম ফোন হাতে নিয়ে চারিদিকের শতশত ছবি তুলতে ব্যস্ত। প্রজ্ঞার দিকে তাকিয়ে বলে,
– “দাড়াও, একটা ছবি তুলে দেই।”

প্রজ্ঞা তৎক্ষণাৎ সরে গিয়ে বলে,
– “নাহ! আগের বার কী তুলেছিলে? নাক দেখে মনে হচ্ছিলো, এটা কি বিখ্যাত শিল্পকর্ম না কি টেলিভিশন স্ক্রীনের কাল্পনিক চরিত্র!”

এনজাম তার কথায় ভেংচি কেটে শুধায়,
– “তো তুমি কিসব ফিল্টার দিয়ে ছবি ঘোলা,ঝিরঝির বানাও, তা খুব ভালো হয়?”

প্রজ্ঞা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হতাশ কণ্ঠে শুধায়,
– “গোঙ্গার বাচ্চা, ওটাকে অ্যাসথেটিক বলে!”

– “অ্যাসথেটিক? তুমি তো ফিল্টার দিয়ে ছবির মুখে এত রং মেশাও, মনে হয় রংমিস্ত্রি এসে কাজ শুরু করলো!”

– “আর তুমি তো এতই ন্যাচারাল ছবি তুলো, যে একদম রিয়েল মনে হয়। যেন বউ পিটিয়ে আদর আহ্লাদ দেখাতে নিয়ে এসেছো। ছবির মধ্যে জ্যান্ত একটা রাগী বানর এসে বসে আছে।”

– “তাহলে কি অ্যাসথেটিক মানে শুধু অগোছালো ছবি তোলা, আর তার পর হঠাৎ হোয়াইট, ব্ল্যাক ফিল্টার দেওয়া?”

– “হ্যা। কারণ তোমার ফিল্টার ছাড়া ছবি দেখলেই মনে হবে, ‘এটা আমি নাকি আমার প্রতিবেশী?’ ছাড়ো। এসব জিনিস বুঝবেনা…”

– “ওয়েট আ মিনিট… তুমি কি আমাকে আনস্মার্ট বলতে চাইছো?”

প্রজ্ঞা এবারে নাটকীয় ভঙ্গিতে গালে হাত রেখে বলে,
– “বালাইষাট! আনস্মার্ট! তোমাকে? না নাহ… বরং তোমার স্মার্টনেস এর গভীরতা এতই বেশি, মাঝেমধ্যে তার তলাই খুঁজে পাওয়া যায়না!”

এনজাম কড়া চোখে চাইলো তার পানে। পাশে দাঁড়ানো প্রণয় খুবই বিরক্ত তাদের কথাবার্তায়। মাথায় হাত রেখে একটু উচ্চস্বরেই বলে,
– “উফফ! থামো তোমরা। আমাকে আগে ঝিলিমিলি বেলুন কিনে দাও।”

এনজাম,প্রজ্ঞা দৃষ্টি সরিয়ে পাশে তাকায়। একজন বয়স্ক লোক অনেকগুলো বেলুন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোকজন আসছে, ছবি তুলছে। কেউ কেউ কিনেও নিয়ে যাচ্ছে বেলুন। এনজাম গালভরে হেসে কোলে তুলে নেয় প্রণয়কে। আঙুল দ্বারা বেলুনের দিকে নির্দেশ করে বলে,
– “ওগুলো?”

– “হ্যা হ্যা।”

– “ঠিক আছে,চলো।”
এনজাম পা বাড়ানোর পূর্বেই প্রজ্ঞা এসে দাঁড়ায় তার পাশে। মুখ গোমড়া করে বলে,
– “আমাকেও!”

এনজাম ঠোঁট কামড়ে হাসলো। একহাতে প্রণয়কে ধরে অন্যহাতে প্রজ্ঞার কাঁধ জড়িয়ে ধরে বললো,
– “আপনি না ওয়ার্কিং ওম্যান? নিজেই কিনে নিন। আমার কাছে চাওয়ার কী আছে?”

প্রজ্ঞা ভোঁতা নজরে চেয়ে শুধায়,
– “এগুলো নিজেরা কিনতে হয়না। প্রেমিকেরা গিফট করে। যেহেতু আমার কপাল পোড়া, প্রেম করার বয়সে বাচ্চা পালছি, তাই বর হিসেবে তোমার দায়িত্ব এটা।”

এনজাম ফিসফিসিয়ে জানায়,
– “আমি কিন্তু তোমার ফিউচার এক্স!”

প্রজ্ঞা তারই কথা ঘুরিয়ে বলে,
– “বর্তমান তো! এতেই চলবে।”

.

– “এই আপনি সরুন। অন্যদিকে যান।”

– “কেন?”
ভ্রু কুঁচকে বললো শাফায়াত। প্রীতি উঠে দাঁড়িয়ে তাড়া দিয়ে শুধায়,
– “বুঝতে পারছেন না কেন? প্রজ্ঞাকে জানতে দেওয়া যাবেনা যে আপনি আমার অনেক দিনের পরিচিত। জাস্ট আমিই চিনি আপনাকে। এইটুকুই। তাই দেখা হলে এমন একটা ভাব ধরবেন যেন আপনি একা এসেছেন। আর আমাকে একদম চেনেন ই না।”

শাফায়াত এসব লুকোচুরির কথা শুনে বিরক্ত হলো বেশ। তবুও প্রীতির কথা রেখে একটু দূরে গিয়ে বসলো। এনজাম দুটো বেলুন কিনে দিলো বউ বাচ্চাকে। দিনশেষে দুটোই হবে প্রণয়ের। প্রজ্ঞা তো এমনিই চেয়েছে।

প্রীতি সর্বপ্রথম ধরা পড়লো প্রণয়ের নজরে। খাম্মিকে দেখামাত্রই প্রণয় চিৎকার দিয়ে ডেকে উঠলো। বাবার হাত ছেড়ে ছুটে এলো রিতীমতো। প্রীতি নিজেও এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো ভাগ্নে কে। ছেলেটা তার সবচেয়ে আদরের। ছোট থেকে কোলেপিঠে বড় করেছে যে!

প্রণয় হুট করে ছুটে যাওয়ায় একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলো প্রজ্ঞা। পরমুহূর্তে প্রীতিকে দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। প্রীতি ততক্ষনে প্রণয়ের দু গালে একাধিক চুমু খেয়ে বলে,
– “ওরে আমার পরান! কেমন আছিস?”

– “আমি রাগ করেছি। তুমি কল দাওনা আমাকে!”

প্রীতি ঠোঁট উল্টে শুধায়,
– “সরি সোনা! খাম্মি ব্যস্ত ছিলাম খুব।”

প্রজ্ঞা,এনজাম এসে হাজির হলো তার সামনে। প্রীতি তাদের দেখেই হাসিমুখে বলে,
– “বাহ বাহ, ঘুরতে এসেছো নাকি?”

প্রজ্ঞা এগিয়ে এসে বলে,
– “তুই এখানে কী করিস? তাও একা একা?”

– “আর কাকে নিয়ে আসবো? আমার কী তোর মতো লেজ আছে?”
এনজামের দিকে তাকিয়ে বলে সে,
– “আপনি দূরেই থাকুন ভাইসাব। নেমোখারামির একটা সীমা থাকা উচিৎ! প্রয়োজন ফুঁড়িয়ে গেলে আর কোনো খবর ই নেই। বাহ!”

এনজাম শালিকার অভিমানি কণ্ঠ শুনে বলে,
– “আরেকটা উপকার করে দাও। সঙ্গে করে এটাকেও নিয়ে যাও। কদিনের জন্য শান্তিকে ফিরিয়ে আনি।”

প্রজ্ঞা তার পানে চেয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে ওঠে,
– “শান্তি কে?”

– “মাই ফিউচার। তোমার পরে সেই আসবে জীবনে।”

প্রজ্ঞা কড়া চোখে তাকাতেই মুখ ফিরিয়ে নেয় সে। প্রীতি বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজন ছেলে-মেয়েকে লক্ষ্য করছিলো। দুজন মেয়ে, একজন ছেলে। ছেলেটির মুখ ঠিকঠাক বোঝা যাচ্ছেনা। বারেবারে তারা তাকাচ্ছে এদিকেই। প্রীতি প্রজ্ঞার বাহুতে একটু খোঁচা দিয়ে বলে,
– “আই নো,প্রীতি ইজ সো প্রিটি। তাই বলে মেয়েরা তাকিয়ে থাকবে কেন? কোনো সমস্যা আছে নাকি এদের?”

প্রজ্ঞা তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকায়। মেয়েদুটো তখনই ধীরেধীরে এগিয়ে আসে তাদের দিকে। আশেপাশে কিছু পরোয়া না করে প্রীতির উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করে,
– “একটু কথা বলা যাবে আপু?”

প্রীতি বাকিদের দিকে একনজর তাকিয়ে বলে,
– “জি বলুন।”

– “আপু,আপনি কী সিঙ্গেল?”
ভ্রুদ্বয় কুঁচকে আসে প্রীতির। বলা নেই,কওয়া নেই, এসব কী জিজ্ঞেস করছে? প্রজ্ঞা এবং এনজামও অবাক হয়ে চাইলো একে অন্যের দিকে। প্রীতি তাদের বিপরীতে জিজ্ঞেস করে,
– “কেন?”

দুজনের মাঝে একজন মেয়ে মিটিমিটি হেসে বলে,
– “বুঝতেই তো পারছেন আপু। যদি আপনার কোনো কন্ট্রাক্ট নম্বর দেওয়া যেত আরকি। আসলে, বন্ধুর তরফ থেকে এলাম তো!”

পেট ফেটে হাসি পেলো প্রীতির। এ জীবনে সে প্রেম প্রস্তাব কম পায়নি। তাই বলে এভাবে! এনজাম,প্রজ্ঞা অতি কষ্টে হাসি আটকালো নিজেদের। এনজাম বুদ্ধিমানের ন্যায় বলে উঠলো,
– “কোন বন্ধু? তাকেই আসতে বলুন। আপনাদের কেন নম্বর দেবে? এদিকে আমরা ওর গার্জিয়ান ও আছি। সরাসরি কথা বলুন। ভেবে দেখি আমরাও।”

প্রজ্ঞা অবাক চোখে তাকিয়ে রয়। এই ছেলে আবার কী বলছে? অন্য মেয়েটি এবার চোখ নামিয়ে বলে,
– “আসলে,সে একটু পপুলার মানুষ তো। তাই আরকি, কেউ দেখে নিলে সমস্যা হতে পারে।”

– “ওহহো! ভালো তো। তা নামটা বলুন, দেখি আমরাও চিনি কিনা তাকে।”
উৎসাহী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো প্রীতি। মেয়েদুটো একে অপরের দিকে তাকিয়ে জানায়,
– “চিনে থাকবেন হয়তো। নাম তার বাবু বাহাদুর।”

দু সেকেন্ড চুপ করে থেকে প্রজ্ঞা হুট করেই লাফিয়ে উঠে বললো,
– “টিকটকার টিকটকার?”

#চলবে?

#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_১২
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন

এনজাম হাসি নিয়ন্ত্রণে ব্যার্থ হয়ে একহাতে মুখ ঢেকে কেশে উঠলো। প্রীতি তখনো দাঁতে দাঁত আটকে তাকিয়ে আছে,হাসা যাবেই না। মেয়েদুটো তড়িঘড়ি করে মাথা নাড়িয়ে বললো,
– “না না আপু। টিকটকার কেন হতে যাবে? সে এমনিতেই কিছুটা জনপ্রিয়।”

– “যাহ! জনপ্রিয়, অথচ আমি এই নাম জিন্দেগীতে প্রথম শুনলাম। হ্যা গো, আমি কী অন্য গ্রহে থাকি নাকি?”
প্রজ্ঞার কথা শুনে এনজাম চোখ গরম দিলো একবার। অথচ মেয়েদুটো যেন বুঝলোই না, তাদের কীভাবে অপমান করা হচ্ছে। তারা পুনরায় হাসিমুখে বললো,
– “আপু শুনেছেন হয়তো। আপনার মনে নেই।”

– “তা সে কোন ক্ষেত্রে জনপ্রিয় সেটা তো বলুন!”

মেয়েদুটো মুচকি হেসে জানায়,
– “একটি ফেইসবুক গ্রুপের অ্যাডমিন। নতুন উদ্যোক্তাদের অনেক সহযোগীতা হয় সেই গ্রুপ থেকে।”

হা করে একে অপরের দিকে চাইলো তিনজন। এনজাম ভ্রুদ্বয় এক করে জানতে চাইলো,
– “কেমন গ্রুপ? নাম কী?”

– “পাশে থাকলে পাশে পাবেন (বেইমান গ্রহণযোগ্য নয়)”

উৎসাহী মুখখানা ভোঁতা হয়ে আসে এনজামের। প্রজ্ঞা,প্রীতি চোখ পিটপিট করে চায়। তবে কয়েক সেকেন্ড যেতেই মেয়েদুটো হো হো করে হাসতে শুরু করে। প্রজ্ঞা,প্রীতি,এনজাম অবাক হয়ে তাকাতেই হাসি থামিয়ে বলে একজন,
– “সরি আপু, সরি ভাইয়া! আসলে একটা ছোট্ট প্র‍্যাঙ্ক ছিলো। ঐযে দেখুন,আমাদের ক্যামেরাম্যান? ওরই চ্যানেল। টুকটাক ফানি ভিডিও বানিয়ে থাকি আমরা। আপনাদের কী বিরক্ত করলাম?”

তাদের কথা শুনে বিস্ময়তা ছেড়ে হেসে ফেললো সকলে। প্রীতি প্রণয়কে ঠিকঠাকভাবে কোলে তুলে বললো,
– “আরেকটু হলে ফিট খেতাম এখানেই। ভাগ্যেস শেষ করলেন!”

– “রিয়েলি সরি আপু!”

– “আরে না না। সরি বলার কী আছে? আমরা তো বরং মজাই পেলাম।”

মেয়েদুটো খুশি হয়ে যায়। উৎসাহী কণ্ঠে বলে,
– “আপনাদের কোনো আপত্তি না থাকলে আমরা কী ভিডিওটা চ্যানেলে দিতে পারি? যদি আপনারা না চান, তাহলেও সমস্যা নেই।”

প্রজ্ঞা এবারে মুচকি হেসে শুধায়,
– “তেমন কোনো সমস্যা নেই। চাইলে আপনি দিতেই পারেন।”

মেয়েদুটো হাসিমুখে বিদায় নেয় তাদের নিকট হতে। প্রণয় দুহাতে প্রীতির গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ লুকিয়ে বলে,
– “খাম্মি,বাসায় চলো। আমরা ক্লে দিয়ে সুন্দর সুন্দর জিনিস বানাবো।”

প্রীতি ঠোঁট উল্টে শুধায়,
– “আমার পরান বলেছে বলে কথা, আমি কী না গিয়ে পারি? কিন্তু কী করবো সোনা? এত্ত ব্যাস্ত আমি! দেখা যাবে,তোকে সময় ই দিতে পারছিনা। তখন আরো মন খারাপ হবেনা বল? তার চেয়ে বরং আমি একটু ফ্রি হয়েই অনেকদিন এর জন্য চলে আসবো। ততদিন মাম্মা বাবাকে বলবে, ওরা তোমাকে অনেক কিছু বানিয়ে দেবে কেমন?”

প্রণয় ঠোঁট চেপে ফুসলো কিছুক্ষন। মুখ তুলে অভিযোগ জানালো,
– “মাম্মা বাবা তো শুধুই ঝগড়া করে! আমার সাথে খেলেই না। খেলতে বললে বলে, এখন না পরে। তারপর আর খেলেনা!”

প্রীতি ভ্রু কুঁচকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকায় দুজনের পানে। থতমত খেয়ে চোখ নামিয়ে নেয় প্রজ্ঞা। এনজাম সরু চোখে তাকিয়ে নিজের সাফাই গেয়ে বলে,
– “এটা কেমন কথা বাবা? আমি তো ব্যস্ত থাকি। তোমার জন্য যে খেলনা,গাড়ি,চকলেট নিয়ে আসি, সেগুলো? তোমার মাম্মাই তো আলসেমি করে,আমি না!”

প্রজ্ঞা ক্ষেপে উঠে বলে,
– “আমি কী সারাদিন শুয়েবসে থাকি? এমনভাবে বলছো যেন বাসার সব কাজ তুমি করে দাও?”

– “কী এমন কাজ করো? যা রাঁধো,তাও তো মুখে তোলা খুব একটা সুখকর হয়না। মাংসের বদলে মনে হয় কার্বন ফাইবার খাচ্ছি।”

– “তুমি রেঁধে খাওয়াও না ভাই! দেখি,কত সুস্বাদু খাবার রান্না করো। নিজে যে রান্নার ভয়ে অর্ধেক জীবন মাইকেল ফলসূদন খান হয়ে কাটিয়েছো সেটা বলি এখন?”

প্রীতি চোখ খিঁচে চেঁচিয়ে উঠলো,
– “আর একটা কথা বললে তোমাদের ধাক্কা দিয়ে এই নদীতে ফেলবো আমি। একদম চুপ!”

সহসা এনজাম,প্রজ্ঞা দুজনেই থেমে যায়। প্রণয় খুশি হয়ে একগাল হেসে বলে,
– “খাম্মি বকেছে,ইয়ে… আরো বকা দাও খাম্মি।”

প্রীতি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
– “লজ্জা সরম কী একটুও নেই তোমাদের? এইটুকু ছেলে অবধি বলছে, মাম্মা বাবা খালি ঝগড়া করে। সিরিয়াসলি! তারপরও তর্ক করিস কোন মুখে? প্রজ্ঞা,ফারদার বাচ্চার মুখে এমন অভিযোগ শুনলে কানের নিচে একটা দিবো তোর।”

– “এমনভাবে বলছিস যেন সব দোষই আমার!”

– “আবার কথা!”

পুনরায় চোখ নামিয়ে নেয় প্রজ্ঞা। প্রীতি প্রসঙ্গ পাল্টে প্রণয়কে আদর করে বলে,
– “জানিস,খাম্মি আজ হেব্বি খুশি। আইসক্রিম খাবি? না নাহ,ঠান্ডা লেগে যাবে। তার চেয়ে বরং ফুচকা খাই। চলবে?”

– “হ্যা,খাবো।”

– “ওককে… এইযে টম এন্ড জেরি, সত্যি সত্যি আরেকবার আমার সামনে চুল টানাটানি করলে দিবো এক ধাক্কা। এখনো চিনো নাই আমারে?
আছি আসেপাশেই। এসব পাগল ফুচকা ট্রিট এ নট আলাউড। ঠিক না পরান? শুধু আমরা মজা করবো।”

প্রণয় খুশি হয়ে দুটো হামি দিলো তার গালে। প্রীতি মুখ ভেঙচিয়ে চলে যায় ফুচকার ভ্যান এর দিকে। অমনি প্রজ্ঞা কটমট চোখে পাশে তাকিয়ে বলে,
– “তোমার জন্য সবসময় আমার কথা শুনতে হয়। তোমার বোনও কথা শোনাবে,নিজের বোন ও। এখন ছেলেও! তবুও ভাববেনা, ‘থাক,ছেড়ে দেই।’ সবকিছু তে তর্ক করতেই হবে।”

– “এই এই, কার কথা কাকে বলছো? শুরুটা করে কে? মানে তুমি কী চাইছো? ভেজা বেড়াল হয়ে তোমার আঁচল ধরে ঘুরে বেড়াবো? পারবোনায়ায়ায়া…”

প্রজ্ঞা নিচু স্বরে শুধায়,
– “এই আঁচলই প্রিয় ছিলো একসময়। সব ভুলে গিয়ে আবার বড়বড় কথা! মানুষ যে কথা দিয়ে এভাবে পল্টি খায় তা জানলে এটলিস্ট ছেলেটাকে…. যদিও এখানে পুরো দায়টা তোমার।”

এনজাম ভ্রু কুঁচকে বলে,
– “আমার? রাত এগারোটার সময় কে যেন কেঁদেকেটে বলছিলো, ‘ওহে প্রিয়,তোমাকে না দেখতে পেয়ে পেটের ভাত হজম হচ্ছেনা!”

প্রজ্ঞা বিস্মিত নজরে চেয়ে শুধায়,
– “শুধু বলেছিলাম, দেখতে ইচ্ছে করছে।”

– “তো শুধু দেখা দিয়ে তো চলেই যাচ্ছিলাম! তখন কে মন খারাপ করে হাত ধরে বলেছিলো, আর একটু থেকে যাও?”

– “তখন আমার বিবেক কাজ করলে নিশ্চই থাকতে বলতাম না?”

এনজাম বুকে হাত গুঁজে বলে,
– “আল্টিমেটলি থাকতে বলে ইয়োলো সিগন্যাল আপনিই দিয়েছিলেন ম্যাডাম। সত্য স্বিকার করতে শিখেন।”

প্রজ্ঞাও একই স্বরে বলে,
– “যদি দিয়েও থাকি, সেটাকে গ্রিন সিগন্যাল ভেবে ভুলটা আপনি করেছেন। জাস্ট আপনার এই বানরের মতো খোমার দর্শন দিতে বলেছলাম। সঙ্গে উপহারস্বরূপ একটা বাচ্চা তো আর দিতে বলিনি!”

এনজাম হাই টেনে মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলে,
-“এগুলো উদারতা। বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি।”

-“ফ্রি? ওহহো! এই জন্যই বলি, ছেলের দাঁতে,চোখে এত সমস্যা কেন!”

মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ায় প্রজ্ঞা। এনজাম তৎক্ষণাৎ তার সামনে এসে জোর গলায় বলে,
– “এই শুনো, আমার পরিবারের কারোই না চোখের সমস্যা নেই। আছে তোমার বাপ-মায়ের। জেনেটিকালি এই সমস্যার দায় কারো হলে সেটা অবশ্যই তোমার। নিজের কয়টা দাঁত পুরোপুরি ঠিক আছে আগে গুনে দেখো,তারপর আমাকে বলতে এসো।”

প্রজ্ঞা আড়চোখে একবার ফুচকার ভ্যান এর দিকে তাকিয়ে দেখে, প্রীতি তাদের দিকে নজর রাখছে। তাই এই মুহূর্তে সে দমিয়ে নিলো নিজেকে। কেবল গম্ভীর গলায় বললো,
– “আর যদি তোমার সাথে এসেছি ঘুড়তে, তাহলে নাম বদলে ফেলো আমার।”

পাশ থেকে একজন লোক হাওয়াই মিঠাই নিয়ে যাচ্ছিলো। গোলাপি,নীল,সাদা আরো দুয়েক রঙের। প্রজ্ঞা সেদিকে একবার তাকিয়ে আবারো চোখ সরিয়ে এনজামের দিকে তাকায়। তবে আর আবদার করলোনা। নিজে থেকে গিয়ে দুটো হাওয়াই মিঠাই কিনলো। প্রীতি,প্রণয় যেখানে বসে ফুচকা খাচ্ছিলো তার অপর পাশে একটা বেঞ্চে বসে গোমড়া মুখে হাওয়াই মিঠাই খেতে আরম্ভ করলো।
তাকে দেখে গাম্ভীর্যতা দূরে ঠেলে মুচকি হাসে এনজাম। মানে জীবনে যাই হয়ে যাক, চোখের সামনে হাওয়াই মিঠাই এলে তা কিনতেই হবে! এটা তার ছোট্ট বেলার অভ্যাস। বিয়ের আগে প্রজ্ঞার এত হাওয়াই মিঠাই খাওয়া দেখে এনজাম হেসে বলেছিলো,
– “এত হাওয়াই মিঠাই খাও কেন? এটার প্রভাবেই বোধ হয় দিনদিন আরো মিষ্টি লাগছে তোমাকে।”

প্রজ্ঞা তাকে সতর্কবাণী স্বরূপ বলেছলো,
– “ফ্লার্ট করে লাভ নেই। অধিক মিষ্টি খেলেও আমার মুখ থেকে অতো বেশি মিষ্টি কথা ঝড়েনা।”

– “তাহলে তো কানের মধ্যে হাওয়াই মিঠাই ঢুকিয়ে রাখা উচিৎ আমার। তিতা,মিঠা সব কথাই মিষ্টি শোনাবে।”

প্রেম করার সময় মানুষ কত প্রকৃতির কথা যে বানিয়ে নেয়,তা বোধ হয় তারা নিজেও জানেনা। এই যেমন এনজামের মনে হয়, ‘কী ভেবে এত তেল দিতাম? দেশে কী তেলের মূল্য কমে গিয়েছিলো?’

ভাবনা ছেড়ে প্রজ্ঞার পাশের খালি জায়গায় এসে বসলো এনজাম, এক পায়ের উপর অন্য পা তুলে। হাতে থাকা গোলাপি রঙের হাওয়াই মিঠাই অর্ধেকটা শেষ করেছে সে, আর সাদাটা এখনো খোলা হয়নি। আচমকা সেই সাদা রঙ্গের হাওয়াই মিঠাইটা তার হাত থেকে কেড়ে নিলো এনজাম। প্রজ্ঞা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে উপরের প্যাকেট খুলে তা খাওয়া শুরু করে এনজাম। প্রজ্ঞা তেজ দেখিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো।
প্রায় দু মিনিট পর, আবারো আচমকা তার হাত থেকে গোলাপি রঙের হাওয়াই মিঠাই নিয়ে সেই সাদা রঙেরটা ফিরিয়ে দিলো এনজাম। সেটাও অর্ধেকটা খাওয়া। প্রজ্ঞা তাকিয়ে থাকার মাঝেই এনজাম একটু কাছে এসে ক্ষীন স্বরে বলে,
– “ফিলস লাইক প্রেমিক-প্রেমিকা?”

প্রজ্ঞা পাশ ফিরে ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,
– “ফিলস লাইক খাঁচায় জোর করে আটকে রাখা দুই পাখি।”

চোখে চোখ আটকালো দুজনের। হয়তো ভাবলো, আসলেই তারা আটকে রাখা পাখি কিনা। নাকি স্বামী-স্ত্রী, নাকি প্রেমিক-প্রেমিকা। যাকে দেখলে প্রেম অনুভূত হয়, সেই তো প্রেমিক!
দু তিনজন ছেলে পাশে গিটার নিয়ে বসে ছিলো। অপরিকল্পিতভাবে বোধহয় এই জুটিকে উদ্দেশ্য করেই একটা গান ধরলো তারা,
– “যদি ভালোবাসা সরে গেলে মরে যেতে হয়
কেন সেই প্রেম ফিরে এলে হেরে যেতে ভয়?
যদি ভালোবাসা সরে গেলে মরে যেতে হয়
কেন সেই প্রেম ফিরে এলে হেরে যেতে ভয়?
শেষে কবিতারা দায়সারা গান হয়ে যায়….

যদি বারে বারে একই সুরে প্রেম তোমায় কাঁদায়
তবে প্রেমিকা কোথায় আর প্রেমই বা কোথায়?
যদি দিশেহারা ইশারাতে প্রেমই ডেকে যায়
তবে ইশারা কোথায় আর আশারা কোথায়?

যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা
যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা
যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা
তবে বুঝে নিও চাঁদের আলো কত নিরুপায়….”

অন্যদিকে ফুচকার ভ্যানের পাশে বসে এই অদ্ভুত মানব-মানবীকে লক্ষ্য করে ভেঙচি কেটে বললো প্রজ্ঞা,
– “এহহহ, ঢঙ!”

#চলবে?

#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_১৩
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন

– “ফিরবে কয়টায় বলে যাও। বন্ধুদের গেটটুগেদার এ যাবে নাকি?”

বিছানায় বসে কিছু কাপড় ভাজ করতে করতে প্রশ্ন ছোড়ে প্রজ্ঞা। এনজাম সবে গোসল সেরে বেরিয়েছে। কোমড়ের সঙ্গে তোয়ালে প্যাচানো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঝেড়ে নিচ্ছে চুলগুলো। প্রজ্ঞার প্রশ্ন শুনে একটু গম্ভীর গলাতেই বলে,
– “আবার ফোন চেক করেছো তুমি?”

প্রজ্ঞা কাপড়টা পাশে রেকে আঙুল উঁচিয়ে বলে,
– “ওহ হ্যালো! ঠ্যাকা পড়েনাই আমার। আর বর্তমানে তোমার ফোনের প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট ও নেই। প্রণয় গেইমস খেলছিলো। তখন নোটিফিকেশন এ দেখলাম।”

– “থাক থাক। নাটক করতে হবেনা।”
একপেশে হেসে বলে এনজাম। প্রজ্ঞার একটু রাগ হলো এতে। ফোঁসফোঁস করে বললো,
– “তোমার কেন মনে হয় আমি সবসময় নাটক করি?”

– “কারণ তুমি সেটাই করো। সিম্পল!”

প্রজ্ঞা বুকে হাত গুঁজে চোখ নামিয়ে শুধায়,
– “নাটকবাজ হলে তোমার সাথে এখন,এখানে বসে থাকতে পারতাম না। তাই,কথাবার্তা বুঝেশুনে বলবে।”

– “হুহ…তাই?”
বিস্মিত নজরে তাকিয়ে হেসে ওঠে এনজাম। প্যান্ট পরে আস্তেধীরে নেভি ব্লু শার্টটা গায়ে জড়ায়। তার হাসি দেখে প্রজ্ঞা উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
– “হাসছো কেন? এমন একটা ভাব করো যেন আমি জ্যান্ত এক জোকার! কোনো কথাই সিরিয়াসলি নেওয়া যায়না।”

– “কোনো সন্দেহ আছে?”

– “এনজাম! বেশি বেশি করছো তুমি।”
বলেই তার বাহুতে দু তিনটে কিল বসালো প্রজ্ঞা। এনজামের হাসি বরং প্রশস্ত হয় এতে। প্রজ্ঞা বিরক্ত হয়ে শুধায়,
– “হাসবেনা বলছি! আমার কিন্তু ভালো লাগছেনা।”

এনজাম চোখদুটো ছোট করে একহাতে তার গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
– “আচ্ছা, কী করলে আপনার ভালো লাগবে বলুন।”

– “সুন্দরভাবে,আদুরে ভাষায়ও কথা বলা যায়।”

এনজাম নাক কুঁচকে আয়নার সামনে গিয়ে বলে,
– “সরো… ওসব আসেনা ভিতর থেকে।”

প্রজ্ঞা তার পাশে এসে জানতে চায়,
– “আগে আসতো কী করে?”

– “আল্লাহ মালুম!”

প্রজ্ঞা ফুঁসে উঠলো তার কথায়। বিছানায় বসে পুনরায় আহাজারি শুরু করলো,
– “আসলে আমার ভাবনাই ভুল। তুমি এ জনমে আর ঠিক হবে না। হুদাই আশা করি আমি। এমন এক নি’ম’ক’হারাম এর জন্য জীবনে এতকিছু করেছি আমি, হাহ!…”

এনজাম ভ্রু কুঁচকে শুধায়,
– “আবার ওভারঅ্যাকটিং! কী এমন করেছো?”

প্রজ্ঞা অবাক নয়নে তাকায় এনজামের দিকে। ওষ্ঠদ্বয় আলগা হয়ে আসে আপনাআপনি। এনজাম গা ছাড়া ভঙ্গিতে নিজের চুল ঠিক করতে ব্যস্ত। প্রজ্ঞা সেদিকে চেয়েই বলে,
– “আর ইউ কিডিং উইথ মি?”

– “উঁহু। আসলেই। কী কী করেছো,বলতে থাকো।”

– “আমি কিন্তু সিরিয়াস।”

এনজাম গলায় টাই পরতে পরতে ঘুরে তাকালো। কয়েক কদম এগিয়ে বললো,
– “হুম,তো? তুমি এমনভাবে বললে যেন নিজের জীবনটাই জলাঞ্জলি দিয়ে দিয়েছো আমার জন্য! আর আমিতো এককথায় ওটাই করেছি।”

– “খোঁটা দিচ্ছো?”

এনজাম মুখ ঘুরিয়ে নেয়। কথা বাড়ানো ভালো নয়। তবে প্রজ্ঞা থামলোনা। গম্ভীর কণ্ঠে বললো আবারো,
– “নাকি নিজের প্রশংসা নিজে করছো? আজকাল লোককে নিজের স্যাক্রিফাইসের গল্পও শোনাও নাকি?”

– “শোনানোই যায়। আফটার অল,মিথ্যে কিছুতো আর বলিনা। মানুষ গাধা বানিয়েছে, আর আমিও খুশিমনে রাজি হয়েছি। দ্যাটস হোয়াই, এখনো এত্ত ইফোর্টস দেই।”

– “ইফোর্টস? উপস,আমিতো শব্দটা একদম চিনিই না!”

এনজাম ফিরে চায়। খানিকটা তাচ্ছিল্য করেই বলে,
– “সরি টু সে, অপেক্ষা ব্যতীত ঠিক কী ইফোর্টস দিয়েছো আর? আমার তো চোখে পড়েনা।”

তৎক্ষণাৎ চোখ নামিয়ে নিলো প্রজ্ঞা। এনজামের মাঝে রাগ নেই,তামাশার মনোভাব নেই। সে ভাবান্তরহীন। খুব সহজভাবে বলছে কথাগুলো। প্রজ্ঞা আর চোখ তুললোনা। সরে গিয়ে বিছানায় থাকা কাপড়গুলো হাতে নিয়ে বলে,
– “সেটাই, আর কীসের ইফোর্টস? অল দ্যা ক্রেডিট গোস টু ইউ।”

– “যাক,সত্য কথাও মুখ থেকে বেরোয়।”

প্রজ্ঞা কাপড়গুলো ড্রয়ারে গুছিয়ে রেখে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। এনজাম দেখেই পিছু ডাকে তাকে,
– “কই যাও?”

প্রজ্ঞা কিঞ্চিত ঘুরে উত্তর দেয়,
– “প্রণয় ঘুমোচ্ছে এখনো। উঠিয়ে তৈরি করতে হবে আবার। টেবিলে পরোটা,ভাজি,ডিম রাখা আছে। খেয়ে নাও।”

প্রজ্ঞা চলে যেতেই এনজাম পায়ে মোজা পরে ডাইনিং টেবিলের সামনে চেয়ার টেনে বসে। প্লেটে ডিম,ভাজি এক এক করে তুলে নেয়। পরোটা হাতে তুলে ঘুরিয়ে দেখে বারকয়েক। নাহ, একটু জাতের হয়েছে। একটুখানি ভাজি নিয়ে মুখে তুললো সে। যাক, খাওয়ার যোগ্য। বউয়ের রান্নার হাত ভালো না হলেও চালিয়ে নেওয়ার মতো।

_______

– “আসতে পারি?”
দরজায় দুবার টোকা দিয়ে বলে অ্যানি। শাফায়াত গালে হাত ঠেকিয়ে ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকিয়ে ছিলো। মেয়েলী কণ্ঠ শুনে সামনে তাকাতেই খানিকটা চমকে ওঠে। পরমুহূর্তে মুচকি হেসে বলে,
– “আপনি? এই সকালবেলা?”

অ্যানি হাসিমুখে ভিতরে প্রবেশ করে। দু হাতে তার ওড়নার আঁচলে ধরে রাখা দু কাপ ধোয়া ওঠা গরম কফি। টেবিলের সামনে এসেই ওয়ান টাইম কাপ দুটো রাখলো অ্যানি। অনুমতি ব্যতীত চেয়ারে বসে বললো,
– “আমি যখন আসি,আপনাকে তো পাই ই না তখন! আগেও দু দিন এসেছিলাম। একদিন আপনি ছিলেন না। আর অন্যদিন কারো সাথে কথা বলছিলেন। তাই বিরক্ত করি নি। আজ সকালে এসেছিলাম পড়াতে। উঁকি দিয়ে দেখলাম আপনিও আছেন। পাশে কফির দোকান ও আছে। তাই নিয়ে এলাম।”

শাফায়াত ল্যাপটপ টা বন্ধ করে পাশে রেখে দেয়। কফির দিকে তাকিয়ে শুধায়,
– “আপনার মনে আছে? আমিতো এমনিই বলেছিলাম!”

অ্যানি খুব একটা পাত্তা দিলোনা। নিজের কাপটা তুলে তাতে ফুঁ দিতে দিতে বললো,
– “তো আমিও এমনিই আনলাম। উকিলদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা ভালো। কে জানে কখন দরকার পড়ে যায়! যদিও আমার পরিবারে একজন উকিল রয়েছে। খুব কাছের আত্মীয়।”

– “বাহ। বেশ ভালো তো। তাহলে তো আর অন্য উকিলের প্রয়োজন পড়বেনা।”
মৃদু হেসে বললো শাফায়াত। দু আঙুলের সাহায্যে তুলে নিলো গরম কাপটা। নিজে থেকেই জানতে চাইলো,
– “তা আপনার বাসার টম এন্ড জেরির খবর কী? ঝগড়াঝাঁটি কমেছে?”

– “কমেছে,তা ঠিক বলা যায়না। তবে তিন চারদিন যাবৎ তেমন একটা চ্যাঁচামেচি নেই। খুবই অদ্ভুত ব্যাপারস্যাপার!”
ভাবুক কণ্ঠে বলে অ্যানি। শাফায়াত তার প্রেক্ষিতে হেসে শুধায়,
– “এ তো ভালো খবর। আপনার তো খুশি হওয়া উচিৎ।”

– “হ্যা সেটাও ঠিক। কিন্তু..”
কথার মাঝেই ফোনটা বেজে উঠলো অ্যানির। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে সিম কোম্পানির নম্বর দেখে বিরক্ত হয়ে কেটে দিলো। ফোনটা রাখলো টেবিলের উপর। হুট করেই সেদিকে চোখ গেলো শাফায়াতের। অ্যানির কোলে থাকা বাচ্চাটাকে দেখে চেনাচেনা মনে হলো। শাফায়াতের দৃষ্টি লক্ষ্য করতেই ফোনের স্ক্রিনে তাকালো অ্যানি। ফিঁক করে হেসে বললো,
– “আমার ভাতিজা এটা। ঐযে টম এন্ড জেরি,ওদের ছেলে,প্রণয়।”

শাফায়াতে চকিতে তাকায় তার পানে,
– “কী নাম বললেন?”

– “প্রণয়। পুরো নাম এনাম খান প্রণয়। কেন?”

শাফায়াত একটু ভেবে বলে,
– “নাহ,এমনেই। বাচ্চাটা কিউট। আর ছবি আছে ওর?”

– “হ্যা হ্যা। কত্ত আছে!”

কফি রেখে ফোনটা হাতে নেয় অ্যানি। গ্যালারি খুলে বের করে প্রণয়ের ফোল্ডার। শতশত ছবিতে ভর্তি। এক এক করে সরিয়ে সেগুলো দেখালো অ্যানি। সঙ্গে শোনালো একাধিক গল্প। একটা ছবিতে এসে থামলো সে। ছবিটা প্রণয়ের জন্মদিনের। সে কেক কেটে হাতে নিয়েছে মাত্র, দুপাশ থেকে প্রজ্ঞা,এনজাম হা করে রয়েছে। দুজনেই বলেছে,আগে আমাকে খাওয়াবে। বাচ্চাটা ভারি বিপদে পরে মুখটা প্যাঁচার মতো করে তাকিয়ে ছিলো।

ছবিতে থাকা নর-নারীর দিকে নির্দেশ করে বলে অ্যানি,
– “এরাই তারা। ওর বাবা-মা,আমার ভাই আর ভাবী।”

শাফায়াত হতবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আওড়ায়,
– “এনজাম খান আর প্রজ্ঞা চৌধুরী?”

অ্যানি ভ্রু কুঁচকে চাইলো তার পানে।
– “আপনি কী করে জানলেন?”

শাফায়াত চোখ তুললো স্ক্রিন থেকে। একটু অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
– “আপনি মিস্টার এনজাম এর বোন?”

– “হ্যা! ছোট বোন। কিন্তু আপনি ভাইয়াকে চিনলেন কী করে?”

শাফায়াত ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে একবার। টেবিলে হাত রেখে জানায়,
– “আপনার ভাইকে নয় শুধু। ভাবীকেও চিনি আমি।”

– “তা তো বুঝলাম। কিন্তু কী করে?”

শাফায়াত ভনিতা করলো না। মুখ ফসকে বলেই ফেললো,
– “তারা দিন পনেরো আগে এসেছিলো আমার কাছে।”

ভ্রুদ্বয়ে গভীর ভাজ পড়লো অ্যানির। চিন্তিত স্বরে বললো,
– “কেন?”

– “ডিভোর্সের জন্য।”

বলামাত্র নিজেই থতমত খেয়ে যায় শাফায়াত। কথাটা বলা উচিৎ হয়নি।
অন্যদিকে, কোটর থেকে চক্ষুদ্বয় যেন বেরিয়েই এলো অ্যানির! চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,
– “ডিভোর্স!”

____

বেলা বারোটা বেজে গেছে আরো আগেই। প্রণয়কে স্কুল থেকে এনে গোসল করিয়ে সবে জামাকাপড় পরাচ্ছে প্রজ্ঞা। ছেলে তার চুল আছড়াতে দেয়না, শরীরে পাউডার দিতে দেয়না। এগুলো করা যে কত মেহনতের কাজ!
জামা,প্যান্ট পরতে পরতেই সে উৎসাহী স্বরে বলে,
– “মাম্মা, আজকে নিশা মিসকে কী বলেছে জানো?”

– “কী বলেছে?”

– “বলেছে ওদের বাসায় একটা বাবু আছে। এইটুকু বাবু! ওর বোন হয়। কিন্তু ওর মাম্মা ওকে আর আদর করেনা। ছোট বাবুকে আদর করে।”

শেষের কথাটা একটু মন খারাপ করেই বললো প্রণয়। প্রজ্ঞা গাল ভরে হেসে তার হাতে চুমু খেয়ে শুধায়,
– “উঁহু,তা নয়। আসলে নতুন বাবুটা খুব ছোট তো,তাই ওর মা ওকে সময় দিতে পারছেনা। বাবুটা একটু বড় হয়ে গেলে আবার দুজনকে একইভাবে ভালোবাসবে। বুঝেছো?”

প্রণয় মুখ ভার করলো। প্রজ্ঞা ভ্রু নাচাতেই বললো,
– “পিপি বলেছে, আমার ছোট বোন এলে তুমিও ওকেই ভালোবাসবে। আমাকে আর আদর করবেনা!”

প্রজ্ঞার হাসি মিলিয়ে যায়। পরমুহূর্তে পুনরায় হেসে ছেলের গালে গাল ঘষে বলে,
– “আমি সবসময় তোমাকেই ভালোবাসবো। বুঝেছো? আর এমন কথা কারো সামনে বলবেনা। এখন যাও,টুশি কতক্ষন ধরে ডাকছে। খাবার আনছি আমি, ডাকলে চলে আসবে।”

প্রণয় সঙ্গেসঙ্গে এক দৌড়ে চলে যায় ফুফির বাসায়। প্রজ্ঞা উঠে দাঁড়িয়ে পাউডার,চিরুনি সবকিছু গুছিয়ে রাখছিলো। এরই মাঝে হুরমুরিয়ে ঘরে ঢুকলো অ্যানি। রীতিমতো হাপাচ্ছে সে। প্রজ্ঞা তাকে এমনভাবে আসতে দেখে অবাক হয়ে বলে,
– “ওমা,তুমি এইসময় বাড়িতে? ক্লাস নেই? আর এত হাপাচ্ছো কেন? বোসো বোসো,পানি আনি আমি।”

তাকে যেতে দিলোনা অ্যানি। বরং হাতটা চেপে ধরে বললো,
– “পানি লাগবেনা। তুমি আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।”

– “কীসের প্রশ্ন? আগে বোসো তো তুমি!”

অ্যানি শক্ত ঢোক গিলে বিছানায় বসলো,পাশে বসালো প্রজ্ঞাকেও। ভীতু নজরে তাকিয়ে জানতে চাইলো,
– “তুমি আর ভাইয়া কদিন আগে উকিলের কাছে গিয়েছিলে কেন?”

প্রজ্ঞা চকিত দৃষ্টিতে চাইলো তার পানে। এই কথাতো তারা চার চেয়ালের বাহিরে যেতে দেয়নি এখনো। অ্যানি জানলো কী করে?”

– “কী হলো? বলো! আসলেই গিয়েছিলে উকিলের কাছে? ড… ডিভোর্স এর জন্য?”

চোখ বুজে মাথা নুইয়ে নিলো প্রজ্ঞা। সময় নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
– “তুমি কী করে জানলে?”

– “তার মানে সত্যি?”

– “ভাই বলেছে?”

অ্যানির আর বুঝতে বাকি রইলো না, সে যা শুনেছে তা সম্পূর্ন সত্য। দৃষ্টিতে তার একরাশ ক্ষুব্ধতা ফুটে উঠলো। প্রজ্ঞার হাতটা ছেড়ে দিয়ে বেশ কড়া গলায় বললো,
– “জীবনটাকে কী একটা মজা পেয়েছো? যখন যা খুশি তাই করে নেবে? আরে এতদিন যা করেছো দুজন, হেসে উড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু এসব কী? ডিভোর্সের চিন্তা করছো কী করে? ভাবী,আমি তোমার থেকে এটা আশা করিনি!”

প্রজ্ঞা স্মিত হাসে তার কথায়। অ্যানি এবার বিস্মিত কণ্ঠে শুধায়,
– “কত সাধের সংসার না তোমাদের? ডিভোর্স শব্দটা মাথায় আনার পর বুক কাঁপেনি একবারো? কোনো মায়া নেই সংসারের প্রতি?”

– “কি জানি!”

রাগের পরিধি বাড়লো অ্যানির। উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
– “আমি অবাক হচ্ছি,বিশ্বাস করো! জাস্ট স্পিচলেস। না চাইতেও মনে হচ্ছে,আপার কথাই ঠিক।”

– “কোন কথা?”

– “তোমার সংসারের প্রতি কোনো আগ্রহই নেই। নইলে সামান্য ঝগড়াঝাঁটি ধরে রেখে কেউ ডিভোর্স এর কথা ভাবে?”

প্রজ্ঞা পুনরায় চোখ নামিয়ে নেয়। আজকের দিনটাই খারাপ তার। সবার থেকে অভিযোগ শুনতে হচ্ছে। অ্যানির কথায় গুরুত্ব না দিয়ে সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
– “অফিসে লেট হয়ে যাবে গো। প্রণয়কে খাওয়াতেও হবে। রাতে এসে কথা বলি?”

– “প্রণয়কে আমি খাইয়ে দেবো। ওকে নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা। তুমি এখন আমার কথার উত্তর দেবে।”

প্রজ্ঞা বিছানায় বসলো পুনরায়। হেসে জিজ্ঞেস করলো,
– “কী উত্তর দেবো বলো।”

– “তোমরা কী আসলেই সিরিয়াস?”

– “ইয়েস। উই আর সিরিয়াস।”

অ্যানি হতবাক স্বরে শুধায়,
– “অসম্ভব! আর এত কঠিন সিদ্ধান্ত কেন? সামান্য বিষয়ে…”

– “সামান্য বিষয়ে কেউ ডিভোর্স চায়না অ্যানি। কোনো পাগল ও না।”
গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দেয় প্রজ্ঞা। অ্যানি তার পাশে বসে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
– “তাহলে এমন কী হয়েছে? সেটা অ্যাটলিস্ট বলো!”

প্রজ্ঞা মেঝের দিকে দৃষ্টি রেখে বলে,
– “জেনে কী করবে বলো তো? ছাড়োই না। যেমন চলছে চলুক।”

অ্যানি দুহাতে কপাল চেপে ধরে বলে,
– “ইউ গাইস লাভ ইচ আদার ম্যান! করছো টা কী এসব?”

প্রজ্ঞা বিছানায় দু হাত ঠেকিয়ে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে বসলো এবার। শান্তস্বরে বললো,
– “একটা কথা বলবো? খুব খাঁটি কথা।”

অ্যানি প্রশ্নাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। খানিকক্ষণ বাদে প্রজ্ঞা ঘাড় ফিরিয়ে চাইলো। বেশ জোর করায় জানালো,
– “Love marriage is very complicated. If you ever think for a moment that this was a wrong decision in your life, you will feel like the most helpless person in the world. It breaks you from the inside… completely breaks you…”

#চলবে?