নব্বই পাতার ডায়েরী পর্ব-১৪+১৫

0
821

#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_১৪
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন

– “ভোর পাঁচটার সময় এককাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে যাওয়া। এটাকে কি খুব সহজ ব্যাপার মনে হয়?”
অ্যানির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো প্রজ্ঞা। উত্তরের আশায় না থেকে নিজেই বললো,
– “কী খাবো,কী পরবো,কোথায় যাবো…কিচ্ছু জানিনা। ছেলেটা তো চাইলে আমাকে ঠকাতেও পারে। যেকোনো বিপদে পড়ে যেতেই পারি। সবচেয়ে বড় কথা, এই কাজটা যে অত্যন্ত খারাপ তা জেনেও কেন মানুষ পালিয়ে যায়?”

– “বিপরীত মানুষের প্রতি বিশ্বাস থাকে বলেই।”

প্রজ্ঞা বালিশ কোলে নিয়ে আরাম করে বসলো। মুচকি হেসে বললো,
– “হুম, অবশ্যই। তবে বাবা মায়ের মনে কষ্ট দিয়ে এমন একটা কাজ করা কিন্তু কোনো সমাধান হতে পারেনা। হ্যা,কিছু ক্ষেত্রে আর কোনো উপায় না থাকলে সেটা আলাদা কথা। তবে আমি একেবারেই নিরুপায় ছিলাম,সেটা কিন্তু সত্যি নয়। অনেক উপায় ছিলো আরো। কিছুদিন অপেক্ষা করা যেত, মা’কে বোঝানোর চেষ্টা করা যেত, কিংবা দু তিনবছর এর প্রতিশ্রুতি দিয়ে যোগাযোগ বন্ধও রাখা যেত। এমনকি, সুই’সা’ইড অ্যাটেম্প করা যেত!
ঐমুহূর্তে দাঁড়িয়ে বিয়ে করতেই হবে, এমন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাবার মতো ঘটনা কিন্তু ঘটেনি।”

অ্যানি গম্ভীর দৃষ্টিতে চেয়ে জানতে চায়,
– “বলতে কী চাইছো? সিদ্ধান্তটাকে এখন ভুল মনে হয়?”

– “আমার কতটা কী মনে হয় সেটা নিয়ে ভাবছিনা। তবে তোমার ভাইয়ের মাঝেসাঝেই মনে হয়। আবেগের বশে কী একটা বোকামিই না করেছিলো!”

– “ওর ভালোবাসাটাকে তোমার এখন বোকামি মনে হচ্ছে?”

– “আমার না,ওর নিজের ই এমনটা হয়।”

অ্যানি দৃঢ়কণ্ঠে শুধায়,
– “বলেছে তোমাকে?”

প্রজ্ঞা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চোখ তুললো,
– “না বললে, আমি তোমাকে বলতাম না অ্যানি।”

অ্যানি চুপ করে যায়। বিস্ময়তা ছেয়ে যায় মুখজুড়ে। প্রজ্ঞা চোখ নামিয়ে রেখেই বলে,
– “ছেলের কারণে আটকে আছি, লাইফের পাঁচটা বছর জলে দিলাম, এই ধরণের কথা শুনতে কেমন লাগে অ্যানি?”

– “ভাইয়া…”

– “বন্ধুদের সঙ্গে এই আফসোসের কথাই বলে বেড়ায় ও। উঁহু,ভেবোনা কারো সূত্রে জেনেছি… নিজের কানেই শুনেছি। ইনফ্যাক্ট ও সরাসরি আমাকেও অনেক কথাই বলে। ডিরেক্টলি,ইন্ডিরেক্টলি অনেক ধরণের কথা শুনেছি গত এক বছরে। আমাকে নিয়ে, আমার ফ্যামিলি নিয়ে, ওর স্যাক্রিফাইস নিয়ে… অনেক ভাবেই।”

অ্যানি জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
– “বলে থাকলেও তা মজার ছলে কিংবা রাগের বশে বলেছে।”

প্রজ্ঞা চোখ তুলে বললো,
– “তোমার ভাইয়ের রাগ,মজা আর মনের কথার মধ্যে পার্থক্য বুঝি আমি। এটুকু জ্ঞান হয়েছে অন্তত।”

কিছুক্ষন নির্বাক রইলো দুজন। প্রজ্ঞা একহাতের নখগুলোর দিকে চোখ রেখে শুধায়,
– “প্রায় পাঁচবছর, সময়টা কিন্তু কম নয়। এই পুরোটা সময় জুড়ে ওর ধ্যান ধারণা ছিলো একটাই, আমার একটা পরিবার চাই।
অ্যানি, একটা কথা হয়তো বিশ্বাস করবেনা। সেই বিয়ের পর থেকে মায়ের সঙ্গে ওর ঠিক কী কী কথা হয়েছে আমি তার অর্ধেকটা আজও জানিনা। শুধু এইটুকু জানি, মা ওর সামনে কিছু শর্ত ছুড়েছিল। আমাকে পেতে চাইলে আমার সমানে আসতে হবে। কেবল প্রতিষ্ঠিত হলেই চলবেনা। আমার পরিবারের জন্য যথাযোগ্য হতে হবে। ঠিক কতটা উন্নতির শর্ত দিয়েছিলো, তা আমি জানিনা। কিন্তু নিজের চোখে দেখেছি,উপলব্ধি করেছি, ঐ ছেলেটা আমাকে পাওয়ার জন্য দিন রাত কীভাবে খেটে গেছে!”

গর্বের সহিত বলছিলো সে কথাগুলো। হুট করেই তার কণ্ঠ নিচু হয়ে আসে,
– “অথচ নিজের লক্ষ্য অর্জনের পর ওর মনে হচ্ছে, আমি কেন এতকিছু করলাম?
আগের বছরগুলোতে বন্ধুবান্ধবকে সময় দেওয়া, জীবনটাকে উপভোগ করা, এগুলোর প্রতি ওর কোনো আগ্রহই ছিলোনা। অথচ আমাকে পুরোপুরি নিজের কাছে পাওয়ার পর থেকে ওর মনে হচ্ছে, আমার জন্য সে নিজের উপর বড্ড জুলুম করেছে। যৌবনটাকে উপভোগই করতে পারেনি। এন্ড হি ফিলস রিগ্রেট ফর ইট!
মজা নয় অ্যানি। এটা সত্য কথা।”

– “সরি…কিন্তু আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা।”

প্রজ্ঞা হেসে বলে,
– “আচ্ছা, আমিতো এখানে এসেছি প্রায় আড়াইবছর হচ্ছে। তুমি কী শুরুর দিকে, কিংবা ছয় মাস,এক বছরের মাঝেও আমাদের দুজনকে কোনোপ্রকার তর্কে জড়াতে দেখেছো?”

অ্যানি একটু ভেবে দুদিকে মাথা নাড়লো। প্রজ্ঞা আরো বলে,
– “তেমনটা চললে হয়তো এখন অবধি আমাদের একসঙ্গে দেখতেনা। আরো আগেই…”

দীর্গশ্বাস ছেড়ে বলে সে,
– “যেকোনো বিষয়ে অতিরিক্ত রিয়্যাক্ট করা, এই অভ্যাস কিন্তু আমার মধ্যে আগে ছিলোনা। একটু ভেবে দেখলেই বুঝবে, আমি খুব সিরিয়াস মাইন্ডের মানুষ। যেকোনো কথাকেই গুরুত্ব দিয়ে ফেলি। একটা সময়ে গিয়ে মনে হয়েছে, প্রতিটা কথা মস্তিষ্কে রেখে দিলে এর প্রভাব আমার এই শখের সংসারে পড়বে।
আমার ভাবনা ভুল হতেই পারে। কিন্তু এই খুঁটিনাটি বিষয়ে তর্ক কিছুটা স্বেচ্ছায় করেছি বলতে পারো। এখন সেটা স্বাভাবিকভাবেই অভ্যাস হয়ে গেছে। আমার ও, তোমার ভাইয়ের ও।

জিজ্ঞেস করতে পারো, এর ফলে লাভটা কী হলো? লাভ এটাই, সিরিয়াস মাইন্ডে আমরা কথা খুব কম বলি। যার ফলে মনে পুষে রাখা কিছু সত্য কথা কেবল মনেই থেকে যায়।”

একটু থেমে বলে প্রজ্ঞা,
– “তবুও অনেক সময় প্রকাশ পেয়ে যায়। কিছু বিরক্তি, অনাগ্রহ।
তোমার কী মনে হয়, এমন ছোটখাটো বিষয়ে ঝগড়া করে আমি উকিলের কাছে চলে যাবো ডিভোর্স চাইতে? বাচ্চা নই আমি! হ্যা, সিদ্ধান্তটা রাগের বশেই নিয়েছি। তবে সামান্য কারণে নয়।”

– “তাহলে?”

মুখভঙ্গি শক্ত হয়ে আসে প্রজ্ঞার। গম্ভীর গলায় বলে,
– “বিয়ের প্রথম দিকেই কনসিভ করেছিলাম না আমি? তিন চার মাসের মাথায়? এটা নাকি আমার প্ল্যান ছিলো! ওকে আটকে রাখার। যেন কিছু দিন পর নিজের বোকামি বুঝতে পেরে চাইলেও আর এই সম্পর্ক থেকে বেরোতে না পারে। আর মায়ের সঙ্গেও নাকি যুক্তি করেছি আমি। এই সূত্রে ও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে। মাঝে বিরক্তি এলেও পিছুটান থেকে যাবে।
ও বলতে চেয়েছে, আমি ওকে ভালো ঠিকই বেসেছি। তবে টাকা-পয়সা,গাড়ি-বাড়ি সবকিছুই চেয়েছি। সাধারণ এনজামের সঙ্গেতো আমি থাকতে পারবো না!”

বলতে গিয়ে নাকের পাটা কাঁপলো প্রজ্ঞার। অ্যানি কিছু বলার পূর্বে নিজে থেকেই চোখ তুলে বললো,
– “এর অর্ধেকটা হলেও ওর মনের কথা। কত্ত বোকা এই পুরুষজাতি!
আমি ওর এসব কথায় চুপ করে থাকি। প্রতিবাদ জানাই না তেমন। কারণ একটাই, ও আমার জন্য অনেককিছু করেছে। তাই বলে আমার ছেলেটাকে নিয়ে এসব বলবে? সরি অ্যানি… রাগের বশেও এই ধরণের কথা বলা যায়না। অন্তত আমি মানতে পারিনা।”

অ্যানি বলার মতো শব্দ খুঁজে পেলোনা। প্রজ্ঞার চোখদুটো জ্বলছিল অনেকক্ষন যাবৎ। লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে সে পুনরায় মাথা নুইয়ে বসে রইলো কিছুক্ষন। চোখদুটো ভরে উঠতেই তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো,
– “তোমরা কী মনে করো, কয়েক বছরে খুব আরামের জীবন কাটিয়েছি আমি। আনন্দ-ফুর্তি করেছি? বউয়ের কোনো দায়িত্ব পালন করতে হয়নি। বিয়ের পরও বাপের বাড়িতে থেকেছি এতদিন। কী কপাল!”

চোখ বুজে হাসলো প্রজ্ঞা। অ্যানির দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললো,
– “প্রেগন্যান্সির পাঁচমাসের দিকে বাচ্চারা একটু একটু মুভমেন্ট শুরু করে, পেটে কিক করে মাঝেমধ্যে। তুমিতো ফিউচার ডক্টর, জানো অবশ্যই।

একটা মেয়ের জন্য ঐ সময়টা না খুব স্পেশাল হয়। আরো যদি বয়স কম থাকে, প্রতিটা বিষয়েই বুকটা কেঁপে ওঠে একদম! যখন প্রথমবার নিজের বাচ্চার অস্তিত্ব অনুভব করা যায়,ইচ্ছে করে সময়টা এখানেই থমকে যাক। সেই মুহূর্তে প্রিয় মানুষকে জড়িয়ে ধরতে মন চায়। তার হাতটা পেটের উপর রেখে বলতে ইচ্ছে করে, ইয়েস… হি অর শি ই হিয়ার!”
কণ্ঠস্বর কাঁপলো প্রজ্ঞার। চোখ থেকে দু ফোটা নোনাজল গড়িয়ে পড়তেই সে দুদিকে মাথা নেড়ে শুধায়,
– “আমি সেটা বলতে পারিনি। একাএকা কত কেঁদেছি! তোমার ভাইকে কল করে নিঃশব্দে কাঁদতাম। তবুও ওকে বলতাম না এসব কথা। শুনলে তো ওরও আমার মতোই কষ্ট হবে! সবসময় আমার সঙ্গে থাকার ইচ্ছে জাগবে। এই বিশেষ মুহূর্তগুলো উপভোগ না করতে পারার যন্ত্রণাটা আরো বেশি কষ্ট দেবে ওকে। তাই বলিনি…”

ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলে নিলো প্রজ্ঞা। খানিকক্ষণ বাদে বললো,
– “মায়ের সাথে ঝগড়া লেগেই থাকতো। যাকে ছোট থেকে ভয় পেতাম তারই মুখের উপর কত কথা বলেছি! কতবার চলে আসতে চেয়েছি,তার হিসেব নেই। মায়ের চেয়ে বেশি আমায় বাঁধা দিয়েছে তোমার ভাই। সে মাথা উঁচু করে সবার সামনে আমার হাতটা ধরতে চেয়েছে। আমি মেনে নিয়েছি।

ও কিন্তু আমাদের বাড়িতে গিয়ে খুব বেশি সময় থাকতোনা। মা থাকতে বলতো,তবুও থাকতো না। প্রতিবার ও চলে আসতো, আমি হাসিমুখে বিদায় দিতাম। সচরাচর থাকতে বলতাম না। ওর আত্মসম্মান কে গুরুত্ব দিতে চাইতাম।

ও কাজের পিছনেই লেগে থাকতো। মাঝেমধ্যে ক্লান্ত হয়ে পড়তো। দিনশেষে রোজ ওকে অভয় দিতাম। বলতাম,আমি আছি। অতটুকুতেই ও মুচকি হাসতো, আর আমি তা দেখে তৃপ্তি পেতাম।
ছেলেটা যখন আমার আধোআধো গলায় কথা বলা শিখবে, সবসময় চাইতাম ও আগে বাবা ডাকুক। আমি তো ওকে কাছে পেয়েছি, ওর বাবা তো পায়নি। এইটুকু সে ডিজার্ভ করে।
প্রণয়ের হামাগুড়ি দেওয়া,হাঁটতে শেখা,কথা বলা, সবকিছু ক্যামেরাবন্দি করা একটা নিত্যদিনের দায়িত্ব হয়ে গেছিলো। একপ্রকার ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকতাম! যেন বাচ্চাটার ছোটখাটো দুষ্টুমিগুলো ওর বাবা মিস না করে ফেলে। ছেলের কাছে থাকতে না পারার আফসোস যেন একটু হলেও লাঘব হয়…”

প্রজ্ঞা আচমকা হেসে উঠলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
– “অ্যান্ড আই ডিড অল দিস থিংগস ফর টুডে…. ‘অপেক্ষা ব্যতীত কী আর করেছো?’ এই কথা শোনার জন্য!”

অ্যানি কিছু বলতে চাইলো। প্রজ্ঞা চোখদুটো মুছে তাকিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলে,
– “প্লিজ, ডোন্ট সে ‘এসব তো হয়েই থাকে’। উঁহু… আমি মানতে পারছিনা। একজন মানুষকে ভালোবেসেছি আমি। তাকেও দেখেছি, আমায় পাগলের মতো ভালোবাসতে। আমি নিজের জান দিতে পারি অ্যানি। শুধুমাত্র এই ভালোবাসার জন্য। তার চোখে নিজের জন্য খাঁটি ভালোবাসা দেখেছিলাম বলেই কোনোদিক না ভেবে তার হাতটা ধরতে পেরেছি।

বাস্তবতা বুঝিনা আমি। বুঝতে চাইও না। কিন্তু আমার প্রতি তার বিরক্তি, এটা আমি সহ্য করতে পারিনা। নিজের পরিবারেই দেখেছি আমি, কেবল স্বামী স্ত্রীর নাম ধরেই সারাজীবন কাটিয়ে দিয়েছে আমার বাবা-মা। আমি সেটা পারছিনা। ছেলের জন্যও না। বলতে পারো,খারাপ মা আমি। সন্তানের কথাও ভাবিনা। হ্যা,কিছু ক্ষেত্রে হয়তো বোকামিই করি। এটা আমার ভুল,মেনে নিচ্ছি।

আমার কাছে সম্পর্কের ভিত হলো ভালোবাসা। সন্তান,রেজিস্ট্রি পেপার নয়। আসল ভিতই নড়বড়ে হলে সেই সংসারের মানে কী? থাকে হয়তো। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ এর ক্ষেত্রে অহরহ ঘটে। কারণ সেখানে তারা নিজেদের ওভাবেই গড়ে তোলে।
কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে তো তেমনটা নয়। আমি ওর চোখে কেবল ভালোবাসা দেখেই অভ্যস্ত। বিরক্তি, আফসোস এগুলো আমি দেখতে পারিনা! একবছর যাবত অনেককিছু লক্ষ্য করেছি, তার অর্ধেকটা এড়িয়েও গেছি। পরিচিত মানুষটাকে আজকাল অপরিচিত মনে হয় আমার। নিজের অজান্তে বলে ফেলা মনের কথাগুলো শুনে অবাক লাগে খুব। মনে হয়,কাছে আসাটাই কী কাল হয়ে দাঁড়ালো? এত দূরত্বও আমাদের মধ্যকার প্রেমে আঁচড় কাটতে পারেনি। কাছে থাকলে বুঝি সত্যিই সম্পর্কের রঙ বদলায়?”

অ্যানি এবার মুখ খুললো। তার হাতটা ধরে বললো,
– “কিন্তু ভাইয়া তোমাকে খুব ভালোবাসে ভাবী! আমি নিজের চোখে দেখেছি তো ওকে। এত কঠিনভাবে ভেবো না। একটু সহজ হও!”

– “ভালোবাসায় মানুষের নজর লাগে রে।”

– “আরেকটু ভেবে দেখো।”

– “ভাবছিই তো! প্রতি মুহূর্তে ভেবেই চলেছি। ঐদিন তো রাগের মাথায় ডিভোর্স এর কথা তুলেছিলাম। কিন্তু ধীরেধীরে ওটাকেই ডেসটিনি মনে হচ্ছে।
মাঝেমধ্যে আমার নিজেকে অপারগ মনে হয়। কেন যে মন দিয়ে সংসার করতে পারিনা! সবকিছু মাথায় জেঁকে বসে থাকে। আবার মনে হয়, আমি নিজের জন্য ছেলেটাকে কষ্ট দিচ্ছি। সবকিছু মিলিয়ে আমি প্রচন্ড টেনসড।
আমাকে খুব চিল পারসন মনে হয় না? অথচ তোমার ভাই অবধি বুঝতে পারেনা আমার মধ্যে কী চলছে।”

লম্বা দম টেনে মাথা চেপে ধরে বললো,
– “আমি তবুও ভেবেই যাচ্ছি অ্যানি। ভাবার সময় দিচ্ছি এনজাম কেও। অথচ ওর মাঝে খুব বেশি পরিবর্তন খুঁজে পাইনা। যখনই ভাবি, নাহ,আমি ভুল। তার কিছু সময় বাদেই ও এমন কিছু বলে… আবার ভেঙে যেতে হয়। মনে প্রশ্ন জাগে, আবেগের বশে নেওয়া সিদ্ধান্তটা কী আসলেই ঠিক ছিলো? প্রেম আর সংসার এক নয়, কথাটাই কী সত্যি?”

ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলো প্রজ্ঞা। এতটা দেরি হয়ে গেছে! তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নামে সে। অ্যানির উদ্দেশ্যে বলে,
– “সময় নেই গো। প্রণয়কে একটু খাইয়ে দিও কেমন? অফিসে লেইট হয়ে যাবে নাহয়”

অ্যানি তার সামনে এসে বাঁধ সাধলো। তার চোখেমুখে প্রশ্নের ছড়াছড়ি। নিজের চোখে গড়তে দেখা এমন এক সুন্দর সম্পর্ক ভেঙে যাবে? এও সম্ভব? যাদেরকে দৃষ্টান্তস্বরূপ দেখে এসেছে এত বছর, তাদের সেই খাঁটি ভালোবাসায় ফাটল ধরে কী করে?
প্রজ্ঞা তার কাঁধে হাত রেখে মৃদু হেসে জানায়,
– “কথা দিচ্ছি তোমায়, যতদিন সে আমাকে চাইবে,আমি তার সঙ্গেই থাকবো। তবে যদি কখনো জোর গলায় বলে, ‘ভুল ছিলাম আমি। তোমার সঙ্গ চাইনা।’ দ্যাট টাইম আই উড বি থট, দিস শুড এন্ড হিয়ার।”

#চলবে?

#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_১৫
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন

দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা পেইন্টিংটার দিকে তাকিয়ে শাফায়াতের চেম্বারের চেয়ারটাতে বসে আছে অ্যানি। মুখখানা তার হতাশায় আচ্ছন্ন। কী হচ্ছে এসব? কেন হচ্ছে? সে সবসময় চাইতো বর-বউ এর মধ্যকার এই অহেতুক ঝগড়া কমে আসুক। অথচ এখন মনে হচ্ছে, নাহ,ওগুলোই ঠিক ছিলো। পাঁচমিনিট ঝগড়ার পর দু মিনিটের মাথায় মিটমাট হয়ে যেত সব। গত দুদিনে তাদের ঝগড়ার আভাস পাওয়া যায়নি সেভাবে। পেলেও তা সর্বমোট দু তিনবার। এনজাম ব্যস্ত অফিসের কাজে। মাসখানেক এর মধ্যে তাকে একবার সিঙ্গাপুর যেতে হবে কাজের সূত্রে। পদোন্নতির নেশা একদম জেঁকে ধরেছে তাকে। কর্মক্ষেত্রে সে ব্যাপক পরিশ্রমী একজন মানুষ। পরোক্ষভাবে এর কৃতিত্ব সামান্য হলেও প্রজ্ঞাকে দিতে হয়।

শাফায়াত গালে হাত ঠেকিয়ে বসে দেখছিলো মেয়েটিকে। বেবি পিঙ্ক রঙের টপস এর সাথে সাদা স্কার্ফটা মাথায় পেঁচিয়ে রাখা তার। শাফায়াত আজ অবধি তাকে যে কবার দেখেছে, হালকা হলেও লিপ্সটিক ছিলো ঠোঁটে। কাজল ও দিতো। আজ মন খারাপের কারণে এর কোনোটাই নেই। তার তাকিয়ে থাকার মাঝে অ্যানি ফিরে তাকালো। অকস্মাৎ সোজা হয়ে বসে বললো,
– “আপনি কিছু করুন না,প্লিজ!”

– “আমি কী করবো?”
শান্তস্বরে বললো শাফায়াত। অ্যানি প্রতিত্তরে বলে,
– “আপনার কাছেই তো এসেছে ওরা। একজন দায়িত্ববান উকিল হিসেবে তাদের বোঝাতে পারেন।”

শাফায়াত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুধায়,
– “কাকে বোঝাবো বলে দিন। তারা যদি নিজেদের চিন্তাধারা না বদলায়, আমি আর বুঝিয়ে কী করবো?”

– “ভাইয়াকে বলুন কিছু। আপনার হয়তো ওকে খারাপ মনে হচ্ছে, কিন্তু আসলে ও তেমন নয়। আমি নিজেও কনফিউজড ভাবীর কথাগুলো নিয়ে। ও এমনটা কেন বলবে? এভাবে বদলে যাবে কেন?”

শাফায়াত নিজের গোফ-দাড়িতে হাত চালিয়ে বলে,
– “আনফরচুনেটলি, আপনার ভাবী যেমনটা বলছে,তার সঙ্গে আপনার ভাইয়ের ভাষ্য ঠিক মিল খাচ্ছেনা ম্যাম।”

অ্যানি ভ্রু কুঁচকে তাকায়। শাফায়াত চোখ নামিয়ে শুধায়,
– “আপনার ভাইয়ের সঙ্গে মাঝে একদিন দেখা হয়েছিলো আমার। বউ-বাচ্চা নিয়ে ঘুড়তে গিয়েছিলেন। আমিও ছিলাম সেখানেই।”

— — —

প্রীতির গাম্ভীর্যতা টিকলো না বেশিক্ষন। ফুচকা খেয়ে এসেই বোনকে নিয়ে হাঁটা ধরলো। গল্পের ঝুলি খুলে বসলো একদম। এনজাম আর গেলোনা বোনেদের মাঝে। প্রণয়ের হাতে একটা ললিপপ ধরিয়ে দিয়ে একা একা হেঁটে চলে। শাফায়াত ছিলো এক পিজ্জা কার্টের পাশে। ভাগ্যক্রমে সাক্ষাৎ হয়েই যায় তাদের। শাফায়াত নিজে থেকেই গিয়ে হাত মেলায় তার সঙ্গে। প্রণয়কে দেখে বলে,
– “ছেলেকে নিয়ে এলেন নাকি?”

এনজাম প্রশস্ত হেসে জানায়,
– “শুধু ছেলে নয়। ছেলের মা-কেও এনেছি। সে নিজের বোনকে পেয়ে আমাদের ভুলেই বসেছে।”

শাফায়াত হাসলো তার কথায়। এগিয়ে গিয়ে দুজন বসলো একটা বেঞ্চে। এনজাম প্রণয়কে কোলে বসিয়ে রাখে। একটু তাড়া দিয়ে বলে,
– “তাড়াতাড়ি শেষ করো। মাম্মা এসে দেখলে তোমাকে,আমাকে দুজনকে বকবে। আজ সকাল থেকে কতগুলো ললিপপ খেয়েছো হিসেব আছে?”

প্রণয় ফিঁক করে হেসে আবারো ললিপপ টা মুখে ঢুকিয়ে নেয়। শাফায়াত তা দেখে হেসে হাত বুলিয়ে দেয় বাচ্চাটির মাথায়। নিজ পেশা থেকে বেরিয়ে সাধারণ মানুষ হিসেবে বলেই বসে,
– “এমন মিষ্টি একটা বাচ্চা থাকতে এসব আজব চিন্তাভাবনা মাথায় আনেন কী করে? একটা পরামর্শ দেই, কখনো কোনো বিষয় নিয়ে সন্দিহান হলে,অস্থির লাগলে ওর সঙ্গে সময় কাটাবেন দুজন। আল্লাহর দেওয়া এমন অমূল্য উপহার থাকতে আর কী লাগে জীবনে?”

এনজাম মৃদু হেসে ছেলেকে মিশিয়ে নিলো নিজের সঙ্গে। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো,
– “লাগে স্যার। উপর উপর বলা সহজ হলেও বাস্তবে সবকিছু এত সহজ নয়। একটা সংসার সাজিয়ে রাখা অতো সহজ কাজ নয়। এতে ইফোর্টস দিতে হয়। চেষ্টা থাকতে হয়।”

শাফায়াত এর দূরে দাঁড়িয়ে গল্পে মত্ত প্রজ্ঞা-প্রীতিকে দেখে নিলো। অত:পর এনজামের দিকে চেয়ে বললো,
– “ঠিক বলেছেন। সাধারণ বিষয়ে কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত না নিয়ে চেষ্টা করুন এগুলোর সমাধান খুঁজে বের করার। যদিও আপনাদের টোকাটুকি বেশ উপভোগ করেছি আমি। তবুও বলবো, একটা লিমিটের মধ্যে থাকুন। অনেক সময় অপ্রত্যাশিতভাবে কিছু কথা বেরিয়ে যায় মুখ থেকে, যা অপর ব্যক্তিকে কষ্ট দিতে পারে।”

– “আসল প্রবলেম টা তো সেখানে নয় স্যার!”
কপালে আঙুল ঘষে বললো এনজাম। পাশ ফিরে প্রজ্ঞার দিকে দৃষ্টি রেখে বললো,
– “ইচ্ছে,চেষ্টা এগুলো তো থাকা জরুরি। কিন্তু তার এদিকে কোনো ইন্টারেস্ট ই নেই। সি জাস্ট ডাস’ন্ট ওয়ান্ট টু ফিক্স ইট। আমার একার ইচ্ছে দিয়ে হবে টা কী? সবকিছুর বাহিরে গিয়ে মানুষের মধ্যে মিনিমাম ম্যাচিউরিটি থাকা উচিৎ।”

– “বোধ হয় একবার বলেছিলেন, আপনার ওয়াইফ বয়স হিসেবে ভীষন ম্যাচিউর ছিলেন।”

– “হ্য বলেছি। তাই ছিলো ও। কিন্তু সেই আগের প্রজ্ঞার সাথে বর্তমানের আকাশ পাতাল তফাৎ। এটা আমি না বললেও সত্য।”

– “যেমন?”

এনজাম একটু গম্ভীর হলো। শূন্যে চেয়ে বললো,
– “আপনাকে বলা হয়নি, আমাদের বিয়ের সময়টা প্রায় সাতবছরের হয়ে এলেও একসঙ্গে আছি সবে দু আড়াই বছর হয়েছে। এর আগে রোজরোজ ‘আমাকে নিয়ে যাও’ বলে মাথা খেতো। অথচ আমরা একসঙ্গে থাকা শুরু করার পর থেকে সে এমন কিছু কাজ করে যা দেখে অবাক হয়ে যাই আমি।

সি ইজ আ ওয়ার্কিং ওম্যান। জবে ঢুকেছে প্রায় দু বছর হতে চললো। আমি সব বিষয়ে ওকে স্বাধীনতা দিয়েছি,দিতে চেয়েছি। এক কথায় আমি ওর পড়াশোনা,ক্যারিয়ার এসব নিয়ে ভাবিই নি। ওর জীবন, ও নিজের ইচ্ছেমতো চলতেই পারে। কিন্তু তাই বলে যেকোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমার মত অবধি চাইবে না?
ইন্টার্ভিউ এর দুদিন আগে জানায় আমাকে জবটার ব্যাপারে। একটু খোঁজ খবর নিলাম। সেভাবে কোনো আপত্তি জানাইনি। ছেলেটার তখন চার বছর হয়নি। বাবা,মা একজনকেও পাবেনা অনেকটা সময়। তাই একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘ম্যানেজ করতে পারবে সবদিক? তুমি চাইলে আরো কিছুটা সময় নিতে পারো। এখনি জবে ঢোকার কোনো তাড়া তো নেই।’
আমি কিন্তু জাস্ট বলেছিলাম। ডিসিশন ওর কাছেই। কোনোপ্রকার আপত্তি জানাইনি। অথচ এই সামান্য বিষয়ে ও এমনভাবে রিয়্যাক্ট করেছিল! সরাসরি বোঝাতে চাইলো, আমি ওকে টাকা দিয়ে কিনেই এনেছি।”

শাফায়াত ভ্রু কুঁচকে জানতে চায়,
– “এমনটা ভাবার কারণ?”

– “আমাদের সম্পর্কটা এত সহজ ছিলোনা,স্যার। হাওয়ায় ভেসে ওকে পেয়ে যাইনি আমি। কষ্ট করে,একটা পজিশনে গিয়ে তবেই ওকে কাছে নিয়ে আসার সাহস করেছি। এর সবটা কেবল ওর জন্যই। এন্ড শি হ্যাড সাপোর্টেড মি।
আমি ভাবতেই পারিনি এই দূরে থাকাটা ওর উপর ইফেক্ট ফেলবে। ও আমাকে ভুল বুঝতে পারে, এটা আমার ধারণার বাহিরে ছিলো।”

প্রণয় ললিপপ টা শেষ করেছে। কাঠিটা ফেলে দিয়ে বাবার গলা জড়িয়ে কাঁধে মুখ লুকিয়ে চোখ বুজলো সে। ছেলের এই এক অভ্যাস,কোথাও ঘুড়তে এলেই ঘুম পায়। এনজাম তার পিঠে হাত রেখে তাকায় শাফায়াতের দিকে। খানিকক্ষণ বাদে বলে,
– “এটা বাদই দেই। অন্য কথায় আসুন। প্রজ্ঞার সাথে রিলেশন থাকাকালীন কিংবা বিয়ের পরও, প্রায় পাঁচবছরের সম্পর্কে ও আমাকে সন্দেহর ‘স’ ও করেনি কখনো। যেখানে আমরা দূরে ছিলাম, ওর মনে চিন্তা আসতেই পারতো। কিন্তু সেটা হয়নি। আমি বরাবর নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেছি।
কিন্তু গত দু বছরে ওর কেন যে আমার উপর সন্দেহ বেড়ে গেল এটাই বুঝতে পারিনা আমি। মাঝেমধ্যে বাচ্চাদের মতো বিহেভ করতো। এখন যদিও একটু কমেছে।

এছাড়াও, আমার সব বিষয়ে ওর একটা বাড়াবাড়ির অভ্যাস হয়ে গেছে। যেটা আগে ছিলোনা। আমি বন্ধুদের সময় দিলে ওর সমস্যা। বাসায় ছেলেকে সময় না দিয়ে কেন আমি অন্য জায়গায় থাকবো। এগুলো কী ইম্যাচিউরিটি নয়? একটা জীবন তো রয়েছে আমার। নানান চিন্তার মাঝে ক’টা বছরে নিজেকেই ভুলে বসেছিলাম। তারপর প্রজ্ঞাকে পেলাম,ছেলেটাকে পেলাম। সময়টাতো আমারই হবার কথা! জীবনটাকে আমি উপভোগ তো তখনি করবো। যেখানে মাথায় কোনো চিন্তা থাকবেনা।”

শাফায়াত এতদিনে তাদের সঙ্গে অন্যান্য দম্পতির মিল খুঁজে পেলো। ভিন্নতার মাঝেও যারা একই। গম্বীর গলায় বললো সে,
– “কথা বলেছেন তার সঙ্গে কখনো? আপনার দিকটা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন? সে কী চায় তা জানতে চেয়েছেন?”

– “কী জানতে চাইবো? যে বিষয়গুলোতে ওর প্রবলেম, সেগুলো তো ও নিজেই করে বসে থাকে। আমরা ঠিক কতটা সময় পাই একসঙ্গে থাকার? বলেছিলাম একবার, অফিসের শিফট চেঞ্জ করার চেষ্টা করতে। কিন্তু নাহ,সে পারবেনা। সাংসারিক হবার কোনো ইচ্ছেই ওর মধ্যে দেখিনা আমি। অনেক বিষয় বোঝার চেষ্টাই করেনা।
এটা ওর বোঝা উচিৎ, সময়ের সাথে মানুষের মধ্যে পরিবর্তন আসে। সারাজীবন কেউ একইভাবে কাটিয়ে দিতে পারেনা।”

— — —
– “আরে, ও নিজেই তো এই কথাটা বুঝতে পারছেনা। বউকে বলার আগে নিজের দিকেও একটু তাকা ভাই!”

কপাল চাপড়ে বললো অ্যানি। শাফায়াত তার প্রেক্ষিতে বলে,
– “তা তো ওনার মিসেস এরও বোঝা উচিৎ। বরের দোষ খোজার আগে নিজের দিকেও তাকানো উচিৎ।”

অ্যানি ভ্রু কুঁচকে বলে,
– “আমরা কী এখন দুজনের দিক থেকে লড়াই করছি নাকি?”

শাফায়াত ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো,
– “আপনি করতে পারেন। তবে আমি করছিনা। একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন,
প্রজ্ঞা ম্যাডাম মনে অনেক কষ্ট,অভিযোগ পুষে রেখেছেন। কারণটা এনজাম। তার কিছু কঠিন কথাতে হার্ট হয়েছেন তিনি। একটু বেশিই।
এবার ভাবুন অন্য দিকটা। এনজাম স্যারের এই কথা,কিঞ্চিৎ বিরক্তির পিছনে দোষ ম্যাডামের কিনা। স্যারের সঙ্গে কথা বলে আমার তবুও মনে হয়েছে, তিনি নিজের দিকটা সম্পূর্ন প্রকাশ করতে পারেননা। ছেলেদের ক্ষেত্রে এমনটা হয়েই থাকে।

এর জন্য কী আমি ম্যাডামকে দোষ দিচ্ছি? উঁহু। আরো গভীরে গেলে দেখা যাবে এমন ব্যাবহারের পিছনেও তার নিজের একটা যুক্তি রয়েছে।
অর্থাৎ,এদের সমস্যাগুলো একই সুতোয় গাঁথা। দুজনের মাঝেই কিছু ব্যার্থতা রয়েছে। কারো বেশি,কারো কম। এইটুকুই…”

অ্যানি পুনরায় হতাশাগ্রস্থ হলো। দুহাতে মাথা চেপে ধরে বললো,
– “আল্লাহ, বর-বউয়ের মাথায় একটু সুবুদ্ধি দিন!”

— — —

সকাল সাড়ে আটটা বাজে। প্রণয়ের স্কুল বন্ধ বলে আর তার ঘুমের দিন। এনজাম একটু আগেই উঠেছে ঘুম থেকে। সহজ কথায়,ঘুম ভেঙে গেছে। কানে ইয়ারফোন গুঁজে ফোনে গেইমস খেলছে। প্রজ্ঞা আয়নার সামনে বসে চুল ঝেড়ে নিচ্ছে। মনটা আজ বেশ ভালো তার। খুব কষ্টে দুদিন নিজের মুখটা নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। অযথা তর্কে জড়াতে চায়নি। তবুও হয়েই যায়। এটুকু বন্ধ করার ক্ষমতা তার নেই। এইতো কাল, এনজাম বহুদিন বাদে তার জন্য স্বেচ্ছায় ফুল নিয়ে এসেছিলো। যদিও নেতিয়ে যাওয়া। এই নিয়ে একধাপ ঝগড়া করেছে তখন।
.

– “তুমি কি ফুলের দোকানে গিয়ে বলেছিলে, ‘সবচেয়ে ক্লান্ত ফুলগুলো দাও?’”

– “এগুলো স্পেশাল ফুল, সময়ের সৌন্দর্য নিয়ে এসেছে। তাই তোমার জন্য আনলাম।”
প্রজ্ঞার গাল টেনে দিয়ে বললো এনজাম। প্রজ্ঞা ফুলটার দিকে তাকিয়ে বলে,
– “সময় তো দেখছি ফুলের জীবন নিয়েই চলে গেছে! এটা দিয়ে কি বলতে চাও?”

– “তুমি তো এমন ভাবছো, যেন আমি ঝড়বৃষ্টিতে গাছ থেকে টেনে এনেছি!”

– “টেনে না আনলেও অন্তত দোকান থেকে ফ্রেশ কিছু আনতে পারতে। এগুলো তো দেখে মনে হচ্ছে, ফুলটাও জীবন নিয়ে হতাশ!”

– “আচ্ছা, তুমিই বলো, ফুলের আসল সৌন্দর্য কী?”

প্রজ্ঞা ভেবে উত্তর দেয়,
– “ফ্রেশ থাকা। আর এগুলো দেখে মনে হচ্ছে, বিদায়ের গান গাইছে!”

– “তুমি আসলে সৌন্দর্য বুঝো না! ফুলের ক্লান্তি মানে ভালোবাসার গভীরতা।”

– “গভীরতা! ভালোবাসা দিয়ে তো পুরো ফুলের প্রাণ টেনে নিয়েছো!”

– “তাহলে আর আনবো না। তুমি নিজের জন্য নিজেই গাছ থেকে তাজা ফুল নিয়ে আসো!”

– “তোমার এনেও লাভ নেই। আমি বরং কৃত্রিম ফুল কিনে ফুলদানি তে সাজিয়ে রাখি!”
.
এসব ভেবে হাসলো প্রজ্ঞা। কী একটা অবস্থা! মিষ্টি মিষ্টি কথা তো মুখেই আসেনা আর! অতি আনন্দে থাকলেও মুখ থেকে তেতো কথাই বেরোয়।

– “এসব কী?”

এনজামের ভারী কণ্ঠ শুনে পাশে তাকালো প্রজ্ঞা। ভ্রু কুঁচকে বললো,
– “কোনটা কী?”

ফোনটা তার সামনে দেখিয়ে বললো এনজাম,
– “এই মেয়েটাকে ব্লক করেছে কে? তুমি জানো ও আমার অফিসের জুনিয়র? এমন ফাজলামোর মানে কী?”

প্রজ্ঞা ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে জোরেজোরে পড়লো,
– “ইউ আর সো হ্যান্ডসাম! আপনাকে দেখে বোঝাই যায়না এত বড় একটা ছেলে আছে। বিলিভ মি, ইউ লুকড ড্যাশিং ইন দ্যা ব্লু শার্ট টুডে।
সুন্দর মেসেজ,তাইনা?”

এনজাম দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
– “যে মেসেজ ই হোক, আমি কী দেখেছিলাম? রিপ্লাই দিয়েছিলাম? দেন হোয়াই ডিড ইউ ব্লক হার? বেয়াদবি বোঝার মতো বুদ্ধি কী নেই তোমার?”

প্রজ্ঞা বুকে হাত গুঁজে জোর গলায় বললো,
– “জামাই এর বেলায় ওসব কেউই বোঝে না। তোমার তো থ্যাংক ইউ বলা উচিৎ। এখনো অবধি নজরে রাখি।”

এনজাম তার কথায় আরো গম্ভীর হলো,
– “থ্যাংক ইউ সো মাচ। কিন্তু নিজের এই অতিরিক্ত নজরদারী বাদ দাও। এটাকে নজর রাখা না,টোটালি ডাউট করা বলে। ডোন্ট ইউ আন্ডার্সট্যান্ড,একে অপরের প্রতি একটা মিনিমাম রিসপেক্ট থাকা উচিৎ?”

– “রিসপেক্ট তো তুমি আগে চাওনি সোনা। হুট করে চাইলে তো হবেনা। আর কী বললে,ডাউট? ডাউট থাকলে তোমাকে সরাসরিই বলতাম। সেটাতো বলিনি। কিন্তু অতো সাধু হতে পারছিনা।”

– “আগে পারতে কী করে?”

প্রজ্ঞা হাসলো একটু,
– “ব্যাপারটা কী বলতো, আগে আমার সব জিনিসই তোমার ভালো লাগতো। ঝগড়া করলেও তা মধুর শোনাতো, রাগলেও ভাল্লাগতো, একটু পসেসিভ হলেও ভালোই লাগতো। এখন সেটা লাগেনা। সরাসরি বলে দাও।”

উঠে দাঁড়ালো প্রজ্ঞা। মুখের হাসিকে বিদায় জানিয়ে শক্ত গলায় বললো,
– “এভরি গার্ল শুড বি পসেসিভ লাইক ইউ, কে যেন বলেছিল?”

এনজাম তার চোখে চোখ রেখে জানায়,
– “পসেসিভ…নট ওভারপসেসিভ।”

– “আরে ভাই,ওটা তোমার সমস্যা। ভালো লাগছেনা বলেও সবকিছু ওভার ওভার লাগছে।”

এনজাম ফোনটা রেখে দিলো ড্রেসিং টেবিলের উপর। দুদিকে মাথা নেড়ে বললো,
– “তোমায় কিছু বলতে চাওয়াটাই বোকামি।”

– “আগে বলতে ইচ্ছে করতোনা?”

– “না করতোনা। কারণ আগে তুমি এমন ছিলেনা!”
কণ্ঠস্বর দৃঢ় হলো এনজামের। প্রজ্ঞাও জোর গলায় বলে,
– “তোমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে শুধু। আগেও আমি এমনি ছিলাম।”

– “নাহ ছিলেনা। আর থাকলেও তখন আর এখনের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ইউ বিহেভস লাইক আ কিড নাও!”

একটু তাচ্ছিল্য করে মৃদুস্বরে বললো এনজাম,
– “প্রেমিকা আর বউ এক জিনিস না। লোকে ঠিকই বলে।”

– “কী বলতে চাইছো?”
ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে প্রজ্ঞা। এনজাম তার নিকটে এসে কাটকাট গলায় বলে,
– “বললাম, তুমি না একজন প্রেমিকা হিসেবেই ঠিক আছো। বউ হিসেবে নয়…”

প্রজ্ঞা বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়। রাগের আভা কেটে যায় মুখ থেকে। কয়েক সেকেন্ড বাদে সেভাবেই তাকিয়ে বলে ওঠে,
– “আ’ম ব্লেসড টু হ্যাভ আ ওয়াইফ লাইক ইউ।”
এনজাম পলক ফেললো চোখের। সরে এলো কিছুটা। প্রজ্ঞা দৃষ্টি স্থির রেখে বলে,
– “কথা কীভাবে ঘুরে যায় মানুষের! আচ্ছা,আমি তোমার প্রেমিকা কদিনের আর বউ কদিনের?”

– “বউ হিসেবে তোমাকে পেয়েছি কদিন? তার আগে তো প্রেমিকা রূপেই ছিলে একপ্রকার।”

– “ওটাই তো! পুরুষ মানুষের তো বউকে ভালো লাগবেনা, এ তো চিরন্তন সত্য!”

এনজাম তেঁতে উঠলো তার কথায়,
– “তুমি কথা অন্যদিকে নিচ্ছো!”

প্রজ্ঞাকে একটু পাগলাটে মনে হলো। কাছে এসে হাত নাড়িয়ে বললো,
– “উঁহু। ঠিক দিকেই নিচ্ছি। বলে ফেলো, আর কী কী বলবে?”

এনজামের মুখের কাছে মুখ এনে বললো সে,
– “এই প্রেমিকার জন্য তুমি একসময় জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিলে।”

– “তা এখনো…”
হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিলো প্রজ্ঞা,
– “থাক। তোমার জীবন আর না নেওয়াই ভালো। বলো তো জীবন যেটুকু নিয়েছি তাও ফেরত দিয়ে দিতে পারি।”

একটু থেমে বলে সে,
– “জাস্ট সে ইট ওয়ান্স, আই উইল লিভ দিস প্লেস রাইট নাও।”

এনজাম যতটা অবাক হলো, তার দ্বিগুণ ক্ষেপে উঠলো। কঠিন গলায় জানালো,
– “আটকে রেখেছি নাকি? যাওনা… যখন খুশি।”

প্রজ্ঞাকে একটু অপ্রস্তুত দেখালো। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে শক্ত ঢোক গিললো একবার। চোখে জল এলোনা একটুও। বরং এনজামের তুলনায় দ্বিগুণ তেজি স্বরে বললো,
– “ভেবেছো কী? কেঁদেকেটে ম’রে যাবো তোমায় ছাড়া? দেন ইউ আর রং। যখন খুশি যেতে বললেনা? একবার চলে গেলে তুমি আমায় চাইলেও ফিরিয়ে আনতে পারবেনা।”

– “তুমি কেন ভাবছো,আমি ফিরিয়ে আনতে চাইবো?”

এনজাম হয়তো বুঝলোনা প্রজ্ঞার কথার গভীরতা। তাই নির্দিধায় বলে ফেললো কথাটা। তবে তার পরবর্তী পদক্ষেপ এর জন্য প্রস্তুত ছিলোনা সে।
প্রজ্ঞা মিনিটখানেক এর মাঝে ভ্যানিটিব্যাগ এর মধ্যে নিজের ফোন,পার্স ঢুকিয়ে নিলো। ওড়নাটা ছড়িয়ে দিলো বুকের উপর। ব্যাগটা হাতে নিয়ে এনজামের সামনে এসে বললো,
– “ঘুমের ছেলেকে তুললাম না। কিন্তু ওকেও নিয়ে যাবো। আর…”

চোখের পলকে নিজের হাতে থাকা সোনার আঙটিটা খুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে দিলো সে। পরমুহূর্তে হাত দিলো গলার চিকন চেইনের উপর। ছোট্ট একটা ডায়মন্ডের লকেট আছে এর সাথে। খুব সাবলিল ভঙ্গিতেই সেটা খুলে রেখে দিলো। এনজামের সামনে এসে বললো,
– “তোমার কোনো জিনিস সঙ্গে নিলাম না। নেবোও না।”

– “সবকিছু রেখে যাবে?”
একদৃষ্টে চেয়ে শুধায় এনজাম। প্রজ্ঞাও জবাব দেয়,
– “হুম। সবকিছু।”

মাথা নুইয়ে হাসে এনজাম। প্রজ্ঞার মুখেও হাসি ফুটলো। এনজামের গালে হাত রেখে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কিছুক্ষন চেয়ে রইলো। অত:পর বললো,
– “কিছু কথা বলে যাই। প্রেমিক আর স্বামীর মধ্যেও কিন্তু অনেক তফাত রয়েছে,জানোতো? ইউ আর আ গ্রেট লাভার… বাট নট আ গুড হাজবেন্ড। যেমনটা আমাকে বললে।”

একটু থামে প্রজ্ঞা। দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
– “আর আমি চ্যালেঞ্জ করে গেলাম, এ জীবনে তুমি কারো কাছেই একজন অসাধারণ স্বামী হতে পারবেনা। ইউ ডোন্ট হ্যাভ দ্যাট কোয়ালিটি।”

গাল থেকে হাত সরিয়ে নিলো প্রজ্ঞা। পিছু ঘুরতেই এনজাম তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে,
– “ফিরে এসোনা।”

পুনরায় পিছু ঘুরলো প্রজ্ঞা। ধীর কণ্ঠে বলে গেল,
– “ফিরিয়ে আনতে যেওনা।”

#চলবে?

[বিশাল পর্ব! রিচেক করা হয়নি।🙂]