নব্বই পাতার ডায়েরী পর্ব-১৬+১৭+১৮

0
869

#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_১৬
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন

দিনটা শুক্রবার। সকাল সকাল উঠে পরোটা বানাতে ব্যস্ত প্রজ্ঞা। রান্নাঘরে এলেই একেবারে ঘাম ছুটে যায় তার। অতিরিক্ত যত্নে কেন যে বড় করলো মা! ভুলবশত রান্নাঘরে ঢুকলেও শ’খানেক বকা শুনতে হয়েছে। হাত কেটে যাবে,হাত পুড়ে যাবে আরো কত কী!
অনার্সে ওঠার পর থেকে প্রীতি আর সে লুকিয়ে লুকিয়ে রান্নাঘরে যেত। আর কিছু না পারলে নিজেরা চা বানিয়ে খেত। টুকটাক নাস্তা,মিষ্টি বানানোর চেষ্টা করতো। সময়টা বেশ মজায় কাটতো তাদের। ছোট্ট প্রণয় মা অথবা খালার কোলে চড়ে চুপচাপ দেখে যেত সব। তবুও রান্নাটা পুরোপুরি আর শিখে ওঠা হয়নি।

এইযে এখন পরোটা বানাতে গিয়েই হিমশিম খেতে হচ্ছে। মোটা হচ্ছে নাকি পাতলা হচ্ছে বোঝা দায়। অথচ তার ধ্যানধারণা একটাই, সুন্দর করে নাস্তা বানিয়ে বরকে ঘুম থেকে তুলবে। এমন সুযোগ সে বারবার পায়না। এক আত্মীয়ের বিয়ে উপলক্ষে তিন-চারদিনের জন্য এসেছে নিজের বরের কাছে।

প্রজ্ঞার আশা আর পূরণ হলোনা। এনজাম উঠে এলো আগেই। চোখদুটো ডলতে ডলতে এসে দাঁড়ালো প্রজ্ঞার পিছনে। এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে তাকে জড়িয়ে ধরলো পিছন থেকেই। হাতদুটো এক করলো পেটের কাছে, কাঁধে থুঁতনি বসিয়ে চোখ বুজলো আবারো। প্রজ্ঞা কিছুটা হকচকিয়ে উঠলো,তবে পিছু ঘুরতে পারলোনা। মিনিটখানেক বাদে নিচু গলায় বললো,
– “ঘরে যাও,প্রণয় ভয় পাবে। নাস্তা তৈরি হয়ে গেলে আমিই ডেকে দেবো।”

– “নাস্তা কে খেতে চায়?”

– “হু? না খেয়ে থাকবে,নাকি নিজে বানাবে? তুমিও কিন্তু আহামরি রান্না জানোনা,তাই খোঁটা দিলে চলবেনা।”

এনজাম কিঞ্চিৎ হেসে এক লম্বা দম টানলো। মৃদুস্বরে বললো,
– “হাউ ডিড ইউ বিকাম লাইক আ ড্রাগ টু মি? ছাড়তেই ইচ্ছে করেনা!”

প্রজ্ঞা লাজুক হেসে শুধায়,
– “অত্যাধিক ড্রাগ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এবার যাও না বাবা… কাজ করতে দাও।”

তার হাত থেকে বেলনটা সরিয়ে দিলো এনজাম। নিজের দিয়ে ঘোরানোমাত্রই শক্ত হাতে কোমড়টা চেপে ধরে বসিয়ে দিলো সিঙ্ক এর পাশের জায়গাটাতে। যুবকের চোখেমুখে দৃশ্যমান হতাশা পরখ করতে সময় লাগেনা প্রজ্ঞার। মুচকি হেসে দুহাতে তার গলা জড়িয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বসলো। খানিকক্ষণ বাদে বললো,
– “মন খারাপ?”

এনজাম উত্তর দেয়না। প্রজ্ঞা টুপ করে তার গালে একটা চুমু বসিয়ে বলে,
– “থাক,মন খারাপ করেনা। আরো দুদিন থেকে যাই?”
শেষের কথাটা বেশ উৎসাহ নিয়ে বলে প্রজ্ঞা। এনজাম বিপরীতে ফিঁক করে হেসে ফেললো। দু আঙুলে তার মুখটা আলতোভাবে চেপে ধরে বললো,
– “বললেন যে,এতেই মন ভালো হয়ে গেছে। কিন্তু আর এক ঘণ্টা পর থেকেই দেখবেন,আপনার আম্মাজান ফোনের উপর ফোন করে মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। দরকার কী? যেতে যখন হবেই…যাও।
দুদিন থেকে গেলে বরং বউয়ের প্রতি আসক্তি বেড়ে যাবে। আর ছাড়তেই মন চাইবে না!”

প্রজ্ঞা মুখে হাসি রেখে বলে,
– “কারো অভ্যাস হওয়া কিন্তু আমার অনেকদিনের শখ।”

– “আচ্ছা… কেমন অভ্যাস?”

প্রজ্ঞা মিটিমিটি হেসে জনায়,
– “এই যেমন, সে আমাকে ভালোবাসবে।”

– “আর?”

– “আর আমাকে সবসময় চোখের সামনে দেখতে চাইবে।”

– “হুম…আর?”

প্রজ্ঞা গাল ভেঙে হেসে শুধায়,
– “আমার বিরহ সহ্যই করতে পারবেনা। একদিন না দেখতে পেলেই মনের কষ্টে মাতাল হয়ে থাকবে। ঐযে কিছু সাইকো নায়ক হয়না? ঐরকম। ধরো,দু চারটে চড় মা’রলেও আবার নিজেই এসে চুমু খাবে।”

এনজাম ভ্রু কুঁচকে নিলো। নিজেও হাসলো প্রজ্ঞার সঙ্গে। পরক্ষণে তার গালের সঙ্গে গাল ঘষে শিথিল কণ্ঠে জানালো,
– “তুমি আমার নিত্যদিনের অভ্যাস হয়ে ওঠো। দিনের শুরুটা হবে যার মুখ দেখে, আর শেষটাও হবে তাকে বুকে জড়িয়ে। এমন এক অভ্যাস, যাকে দেখতে না পেলে সত্যিই পাগল হয়ে যাবো। তাকে ধরেবেঁধে হলেও নিজের কাছেই রেখে দেবো।”

— — —

– “বাবা? ও বাবা?”
ছেলের ডাকাডাকিতে হুশ ফিরলো এনজামের। দু আঙুলে কপালটা টিপে তৎক্ষণাৎ কোলে তুলে নিলো প্রণয়কে। ল্যাপটপ টা রেখে দিলো বিছানার অন্যপাশে। প্রণয়ের মুখ ভার। এনজাম তার ডাকে জবাব দিলো,
– “বলো।”

প্রণয় বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদোকাঁদো গলায় জানতে চাইলো,
– “মাম্মা আসেনা কেন? কখন আসবে?”

এনজাম হকচকিয়ে উঠলো তার কথায়। কী উত্তর দেবে এখন? সকালে তো বলেছিলো মাম্মা অফিসে গেছে,কাজ আছে বলে। বাধ্য হয়ে এবারো মিথ্যে বলতে হলো তাকে,
– “কাজ শেষ হলেই চলে আসবে।”

– “কাজ শেষ হবে কখন?”

– “একটু পরেই।”

– “একটু পরে কখন?”

এনজাম পড়লো মহা বিপত্তিতে। তবে একটা বিষয় ভাবাচ্ছে তাকে। প্রজ্ঞা বাপের বাড়িতে যাওয়া মাত্রই তার ফোনে প্রীতির কল আসার কথা। যে সেয়ানা মেয়ে, নিশ্চিত বুঝে যাবে তার বোন বেড়াতে আসেনি। কিন্তু সকাল থেকে তার কোনো কল আসেনি ফোনে। এনজামের হুট করে খেয়াল হলো, কয়টা বাজে এখন? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দ্রুত সময় দেখলো সে। একি! সাড়ে দশটার মতো বাজে। সে কোন দুনিয়ায় ছিলো এতক্ষন?
প্রণয়কে কোলে নিয়ে এবার উঠে দাঁড়ালো এনজাম। আদুরে গলায় বললো,
– “বললাম তো, কাজ শেষ হলেই চলে আসবে। তুমি এখন চলো। বাবা খাইয়ে দেই? তারপর ঘুমিয়ে পড়বে। কাল স্কুল আছে না?”

প্রণয় মাথা নেড়ে বলে,
– “নাহ,খাবোনা। মাম্মা খাইয়ে দেবে। মাম্মাকে আসতে বলো।”

– “এমন করেনা বাবাই! আচ্ছা শোনো, মাম্মা এসে যদি দেখে তুমি না খেয়ে বসে আছো,তাহলে রাগ করবেনা?”

প্রণয়ের খুব মন খারাপ হলো। ঘুম থেকে উঠে অবধি মা-কে দেখেনি ছেলেটা। সে সহজে কাউকে মারেনা। ছোট থেকেই ভীষন ভদ্রসভ্য। তবে এখন রাগ হলো তার। ছোট্ট হাতের দ্বারা বাবার বুকে একাধারে বেশ কয়েকটা কিল বসিয়ে বললো,
– “নাহ,মাম্মাকে আসতে বলো। মাম্মাকে কল করো।”

এনজাম বেশ চিন্তিত হলো। এখন অ্যানির কাছে গেলেও তো প্রজ্ঞার কথাই জানতে চাইবে। তার উপর ছেলেকে সামলানোও দুষ্কর। কোনোমতে তাকে শান্ত করে বিছানায় বসলো এনজাম। ফোনটা হাতে নিলো। তবে প্রজ্ঞার নম্বরে ডায়েল করলোনা। কলটা করলো প্রীতির নম্বরে। তিনবার রিং হতেই সে রিসিভ করলো কলটা। হাস্যজ্জল কণ্ঠে বললো,
– “আসসালামু আলাইকুম দুলাভাই। সূর্য কী আজ পশ্চিমে উঠলো নাকি? আমার একমাত্র দুলাভাই কিনা তার শালীকে কল করেছে!”

এনজাম মৃদু হেসে সালামের উত্তর দিয়ে বলে,
– “কেন,আমি কী কল করিনা তোমায়? এমনভাবে বলছো যেন খোঁজ খবর ই রাখিনা।”

– “তা রাখেন বটে। তবে এমনি এমনি এই সময়ে কল করেছেন বলে তো মনে হয়না। হয়েছে কী? প্রজ্ঞার সাথে ঝগড়া টগড়া হয়েছে? মাফ চাই বাবা, আমি তোমাদের ঝামেলা আর মেটাতে পারবোনা।”

– “তা কেন মনে হলো?”

– “এমনিই,মনে হলো। নাহলে তোমার বউও সারাদিনে আমার সাথে কথা বললোনা কেন? একটা কল ও নেই। খুব রেগে আছি কিন্তু!”

এনজাম নিশ্চিত হলো,প্রজ্ঞা ও বাড়িতে যায়নি। তাহলে গেলো কোথায় মেয়েটা?
– “হ্যালো? ভাইয়া?”
এনজাম ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো। জিহ্বা দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
– “প্রীতি,আমার না একটা ইম্পর্টেন্ট কল আসছে। পরে কথা বলছি তোমার সাথে…”

– “ওহ..ওকে ওকে।”

কলটা কাটতেই প্রণয় আবারো অস্থির হয়ে উঠলো। রিতীমতো খামচি দিলো বাবার হাতে। এনজাম তার হাতটা চেপে ধরে পুনরায় কোলে বসালো। সমগ্র মুখে, মাথায় পরম যত্নের সহিত হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
– “বাবাকে মারছো তুমি,হুম? ব্যাথা লাগছে কিন্তু আমার।”

প্রণয় তার হাতে আদর করে বললো এবার,
– “তাহলে মাম্মাকে কল করে দিচ্ছোনা কেন? আমি কথা বলবো তো!”

এনজাম তার গালে হাত রেখে মৃদুস্বরে বললো,
– “আগে খেয়ে নাও। তারপর…”

– “না না না…আমি খাবোই না।”

আর কোনো উপায় নেই এনজামের হাতে। বাধ্য হয়ে প্রজ্ঞার নম্বরেই ডায়েল করলো। কিন্তু কল ঢুকলোই না। একটাও রিং না হতেই শোনা গেল, “আপনার কাঙ্ক্ষিত নম্বরটি এই মুহূর্তে ব্যাস্ত আছে।”
এনজাম ভ্রু কুঁচকে অন্য নম্বর থেকে কল করলো। এবারেও একই ঘটনা। নেমে যাওয়া রাগটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। সাহস কত মেয়ের! তার দুটো নম্বরই কিনা ব্লক করে রেখেছে! দাঁত কিড়মিড় করে সে তাকিয়ে ছিলো স্ক্রিনের দিকে। প্রণয় আবারো হাত ধরে টেনে বলে,
– “ও বাবা,দাওনা মাম্মাকে কল!”

একেতো মাথায় রাগ চড়ে ছিলো। তার উপর প্রণয়ের মুখে বারবার একই কথা শুনে নিজের অজান্তেই তাকে উচ্চস্বরে ধমকে উঠলো এনজাম,
– “আরে কল না ধরলে আমি করবোটা কী?”

প্রণয়ের শরীরটা কেঁপে উঠলো ধমকে। দু কদম সরে গিয়ে দাঁড়ালো। ঠোঁট ভেঙে এলো,চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো নোনাজল। হেচকি উঠে এলো রিতীমতো!
এনজাম হাতভম্ব হলো নিজ কাজে। ছেলেটার সাথে আজ অবধি উঁচু গলায় কখনো কথাও বলেনি। সে কিনা আজ…
প্রণয়কে কাঁদতে দেখে বুকটা কেঁপে উঠলো তার। চটজলদি হাটু গেড়ে বসে জড়িয়ে ধরলো ছেলেকে। চোখদুটো মুছিয়ে সমগ্র মুখে একাধিক চুমু খেয়ে ভাঙা গলায় বললো,
– “আ’ম সরি বাবাই! রিয়েলি সরি! এভাবে বলতে চাইনি আমি। কেঁদোনা প্লিজ..এইযে বাবা কান ধরছি দেখো।”
কোনো কথাই খুব একটা প্রভাব ফেললোনা প্রণয়ের উপর। সে চোখমুখ কুঁচকে ঠোঁট উল্টে বললো,
– “মাম্মা..”

এনজামের নিজেকে একপ্রকার দিশেহারা মনে হলো। শক্ত একটা ঢোক গিলে প্রণয়কে বুঝ দিলো,
– “মাম্মার ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছে বোধহয়। আচ্ছা,আমরা তো মাম্মার অফিসে কল করতে পারি। চলো, মাম্মার অফিসে কল করি।”

প্রণয় দু হাতের পিঠে চোখের জল মুছে নিলো। আগ্রহী দৃষ্টিতে চেয়ে বসলো। এনজাম অবাক হলো ভীষন। প্রণয় কখনো মায়ের জন্য এমন পাগলামো করেনি। পিপি, বাবা, খাম্মি, টুশি এরা কাছে থাকলে সে মায়ের কথা মনেও করেনা খুব একটা। সারাদিন কাটিয়ে দিতে পারে। আজ ছেলেটা এমন করছে কেন?
এনজামের ও এবার চিন্তা হলো। গলায় কিছু একটা আটকে রইলো। হ্যা,প্রজ্ঞা আত্মনির্ভরশীল মেয়ে। একাই চলাফেরা করে। পুরো শহর ঘুরে আসতে পারে। তবুও… সে একজন মেয়ে। বিপদ তো আর বলে কয়ে আসেনা।

তড়িঘড়ি করে প্রজ্ঞার অফিসের নম্বরে কল করলো এনজাম। দু তিনটে নম্বর দিয়েছিলো সে। ভাগ্যক্রমে প্রথম নম্বরের মালিক ই রিসিভ করলেন কলটা।

– “আসসালামু আলাইকুম।”
কিছুটা ভারী কণ্ঠ। কোনো মাঝবয়সী পুরুষ মনে হলো। এনজাম সালামের উত্তর দিতেই তিনি জানতে চান,
– “কে বলছেন?”

এনজাম কিছুটা অপ্রস্তুত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– “মিসেস প্রজ্ঞা চৌধুরী কী অফিসে আছেন?”

– “ম্যাডাম? হ্যা আছে তো,আপনি?”

এনজাম হাফ ছেড়ে বললো,
– “ওনার হাসবেন্ড।”

লোকটি গাম্ভীর্যতা ছেড়ে এবার হাসি মুখে বলে,
– “ওহ আচ্ছা,স্যার… ম্যাডাম কে দিবো?”

এনজাম প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
– “আব… তার শিফট তো নয়টায় শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। আসলে ওনার ফোনে চার্জ নেই বোধ হয়। তাই জানাতে পারেনি।”

– “হ্যা,ম্যাডাম এর শিফট তো নয়টা বাজেই শেষ। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, সে বললো কাজ জমা আছে। তা শেষ করে যাবে। আচ্ছা স্যার, আমি দিচ্ছি ম্যাডামকে।”

এনজাম বিপরীতে কিছু বলার পূর্বেই লোকটি ফোন নিয়ে ছুটলো প্রজ্ঞার জন্য নির্ধারিত কেবিনের দিকে। সামনে কিছু ফাইল খুলে রেখে বসে আছে সে। দৃষ্টি ঠিক কোথায়,বলা যায়না। লোকটি অনুমতি নিয়ে ভিতরে এসেই বললেন,
– “ম্যাডাম, আপনার বাড়ি থেকে কল এসেছে। আপনাকে বোধ হয় ফোনে পাচ্ছেন না।”

– “একটু ব্যাস্ত আছি রফিক ভাই। পরে কথা বলে নেবো।”
প্রজ্ঞার গলার স্বর শোনামাত্র এনজাম অপর প্রান্ত থেকে নিচু স্বরে বলে,
– “ম্যাডামকে একটু বলুন,তার ছেলে কথা বলবে।”

লোকটিও যথাযথভাবে প্রজ্ঞার সামনে এসে বলতে নেয়,
– “ম্যাডাম,আপনার ছেলে..”

আর বলতে হলোনা। ফোনটা একপ্রকার ছিনিয়ে নিলো প্রজ্ঞা। কানে ধরে বললো,
– “হ্যালো?”

এনজাম কান থেকে ফোনটা সরিয়ে প্রণয়ের কানে ধরতেই সে উৎসাহী কণ্ঠে বলে,
– “মাম্মা..তুমি কখন আসবে?”

প্রজ্ঞার কণ্ঠস্বর কাঁপলো খানিকটা। কী উত্তর যে দেয়! শুকনো ঢোক গিলে বললো সে,
– “হ্যা বাবা, আসবো তো। কাজ শেষ করে নেই।”

– “না,তুমি তাড়াতাড়ি আসো।”

– “কেন সোনা? কী হয়েছে? বাবা আছে না? তুমি খেয়েছো?”

– “নাহ খাইনি। তুমি খাইয়ে দেবে।”

– “মাম্মা তো একটু ব্যাস্ত। তুমি এক কাজ করো। বাবাকে বলো, বাবা তোমাকে খাইয়ে দেবে। তারপর গুড বয় এর মতো রাইমস শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়বে। একদম কান্নাকাটি না,হুম?”

– “তুমি কখন আসবে?”

প্রজ্ঞার ইচ্ছে করলো এই মুহূর্তে ছুটে চলে যেতে। গোল্লায় যাক তার কথা,ঝগড়া। সন্তানের উপর আর কিছু আছে নাকি?

– “আই মিস ইউ মাম্মা!”

কী আহ্লাদী স্বর! কোন মা সামলাতে পারে নিজেকে এমন কথা শুনে? আচ্ছা,এগুলো কী এনজাম শুনতে পারছে না? ছেলের জন্য অন্তত ফোনটা নিয়ে বলতে পারতো, ‘অনেক হয়েছে। তাড়াতাড়ি আসো।’
কিন্তু বললোনা। প্রজ্ঞা জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। জোর গলায় জানালো,
– “খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো সোনা। মাম্মা সময় হলে ঠিক চলে আসবে। আচ্ছা,তুমি চোখ খুলেই আমাকে দেখতে পাবে। ওকে? ইউ আর আ গুড বয়,না?”

প্রণয় মাথা নেড়ে এবার নিচু স্বরে সম্মতি জানালো। প্রজ্ঞার প্রতিটা কথা শুনলো এনজাম। মেয়ের কঠিনতা দেখে বিরক্ত হলো। এত রাগ দেখানোর কী আছে? শেষ অবধি তবুও বললোনা, ‘তুমি অপেক্ষা করো,আসছি আমি।’

কল কাটতেই ফোনটা বাবার হাতে দিলো প্রণয়। মুখে না বললেও তার রাগ হয়েছে। বাবা বকা দিলো কেন?
মুখ ফুলিয়ে সে বসে রইলো খাটে। এনজাম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একটা প্লেটে করে তার জন্য খাবার নিয়ে এলো। প্লেটটা রেখে তার পাশে মেঝেতে বসে পড়লো। বাচ্চাদের মতো মুখ করে বললো,
– “বাবা সরি বলেছে তো। তারপরও রাগ? আচ্ছা,আর কখনো বকবোনা। এখন কী কান ধরে উঠবোস করবো? নাকি ব্যাঙ সাজবো?”

প্রণয় খিলখিলিয়ে হেসে উঠে বললো,
– “হ্যা হ্যা, ব্যাঙ সাজো।”

এনজাম কাঁদোকাঁদো মুখে তাকালো ছেলের দিকে। বলেও তো জ্বালা। কী আর করার! ছেলের রাগ ভাঙাতে কোনোমতে ব্যাঙ সাজলো। তারপর উঠে এসে খাইয়ে দিলো তাকে। কী ভদ্র ছেলে তার! খাওয়া নিয়ে কোনো জ্বালাতন নেই। প্রজ্ঞার চেয়ে শান্তির জীবন আর আছে কার?

.
প্রণয়কে খাওয়ানো শেষে অ্যানির কাছে দিয়ে এলো এনজাম। এগারোটা বেজে গেছে,প্রজ্ঞার আসার নাম নেই। এত রাতে সে বাপের বাড়িতেও যাবেনা। সেখানের হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে চাইবেনা।
আরো পাঁচ দশমিনিট বাদে শার্ট,প্যান্ট বদলে গাড়ির চাবিটা নিয়ে বেরোলো এনজাম। দিনের বেলা হলে জীবনেও যেত না সে। নেহাতই রাতের বেলা, একা একটা মেয়ে…

প্রজ্ঞার অফিসের সামনে এসে গাড়ি থামলো ১১:২০ এর দিকে। এই মেয়ে কী আজ নাইট শিফট এও থাকার চিন্তায় আছে নাকি? মানে…মনে কোনো ভয়ভীতি নেই তার?
চতুর্থ তলায় গিয়ে লিফট থেকে বেরিয়ে কাচের দরজাটা খুলে ভীতরে প্রবেশের আগমুহূর্তে সিকিউরিটি গার্ড বলে ওঠে,
– “এক্সকিউজ মি স্যার,কার কাছে এসেছেন?”

বারবার এক প্রশ্নের উত্তর দিতে বিরক্ত লাগলো এনজামের। তবুও বললো,
– “মিসেস প্রজ্ঞা চৌধুরি আছেন? তার হাজবেন্ড আমি।”

– “ওহ,সরি স্যার,চিনতে পারিনি আমি। আপনি যেতে পারেন।”

ভিতরে প্রবেশ করলো এনজাম। আগে আরো তিন চারবার এসেছে এখানে। প্রজ্ঞার কেবিনের সামনে গিয়ে একটু থামলো সে। লম্বা দম টেনে অনুমতি না নিয়েই ভিতরে প্রবেশ করলো।
দরজাটা লাগিয়ে সামনে তাকাতেই বড্ড হাসি পেলো তার। টেবিলে মাথা রেখে চোখ বুজে আছে প্রজ্ঞা। ঘুমিয়েই পড়েছে।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধীর পায়ে তার পাশে এসে দাঁড়ালো এনজাম। কান্নাকাটি করলেও তো মেয়েদের চোখ ফুলে যায়। নাকের ডগা লাল টকটকে হয়ে থাকে। ঘুমন্ত মেয়েটির মাঝে তার কোনো চিহ্নই নেই। কেবল ভ্রুদ্বয়ের মাঝে কিঞ্চিৎ ভাজ পরে আছে। নিচু ঝুটি বাঁধা চুলগুলো সারাদিন থাকার ফলে কিছুটা এলোমেলো হয়েছে। এনজাম তার কাছে এগিয়ে আসে। একদৃষ্টে চেয়ে কপালের উপর থেকে সরিয়ে দেয় চুলগুলো।

কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্ষ অনুভব করতেই হকচকিয়ে উঠলো প্রজ্ঞা। আচমকা ঘুম ছুটে যাওয়ায় তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়াতে নিলেই হাটুর দিকটাতে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভূত হলো। মৃদু আর্তনাদে ‘আহ’ বলে চেঁচিয়ে পুনরায় বসে পড়লো চেয়ারে। চোখ তুলে চাইলো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটির পানে।
সেই ব্যক্তি ভ্রু কুঁচকে প্রজ্ঞার পায়ের দিকে তাকালো একবার। হাটু গেড়ে বসে বলে,
– “কী হয়েছে?”

হাটুর কাছে ছিলো প্রজ্ঞার হাতটা। সেখানে হাত দিতেই ছিটকে সরে যায় প্রজ্ঞা। মুখটা ঘুরিয়ে নেয় অন্যদিকে। এনজাম একপ্রকার জোর করেই তার হাতটা ঘুরিয়ে দেখলো। তালুর কিছু জায়গায় ছুলে গেছে সামান্য। সেদিকে তাকিয়ে বললো এনজাম,
– “পড়ে গিয়েছিলে নাকি কোথাও?”

উত্তর দেয়না প্রজ্ঞা। এনজাম একনজর তাকালো তার পায়ের দিকে। জুতোটা দেখেই কটমট চোখে চেয়ে বললো,
– “হাই হিল পড়তে বারণ করি কী এমনি এমনি?”

প্রজ্ঞা মুখটা ঘুরিয়ে বললো,
– “সামনে যা পেয়েছি তাই পড়েই বেরিয়েছি।”

– “এইজন্যই রাত সাড়ে এগারোটা অবধি অফিসে বসে থাকা?”

– “মোটেই না! কাজ ছিলো। আর আমার যেখানে ইচ্ছে সেখানে থাকবো। কারো চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।”

এনজাম উঠে দাঁড়িয়ে বুকে হাত গুঁজল।
– “এক্সকিউজ মি… কাউকে নিয়ে ভেবে ম’রে যাচ্ছিনা আমি। নেহাতই একজন ভালো বাবা হিসেবে ছেলের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। কিছু মায়েরা যে মাত্রাতিরিক্ত নির্দয় হতে পারে, তা আসলে জানা ছিলোনা।”

প্রজ্ঞা দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
– “কাকে নির্দয় বলছো? আর তুমি নিজেকে এত ভালো বাবা দাবি করো কী করে? যেখানে ছেলে তোমার সঙ্গে থাকতেই চাইছে না!”

এনজাম ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। কপালে আঙুল ঘষে বললো,
– “বাজেদিকের তর্ক করার জায়গা, সময় কোনোটাই নেই আপাতত। একা হেঁটে যেতে পারবে বলে মনে হচ্ছেনা।”

– “বলেছি, কারো ভাবতে হবেনা।”

এনজাম হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বেশ ঠান্ডা গলায় বলে,
– “তেল মাজতে আসিনি এখানে। ওঠো,হাতটা ধরো।”

– “জীবনেও না…”

ভেঙচি কেটে পুনরায় মুখ ঘুরিয়ে নেয় প্রজ্ঞা। এনজাম আগের ন্যায় গম্ভীর মুখভঙ্গি ধরে রেখেই বলে,
– “লিসেন… এই মুহূর্তে যদি তোমাকে কোলে তুলে নিয়ে যাই, আমার কিছুই এসে যাবেনা। কিন্তু এখানে কাজ তুমি করো। পরবর্তীতে লজ্জায় পড়তে হতে পারে। আবারো বলছি, ভালোভাবে বলছি, হাতটা ধরে উঠে এসো।”

প্রজ্ঞা আড়চোখে চেয়ে শুধায়,
– “হিরো সাজতে চাইছো?”

– “হিরোইন হারিয়ে দেবদাস মুডে আছি। কিন্তু আমি ওর মতো ছাগল না। চন্দ্রমুখী কে পেয়ে গেলে আবার পারফেক্ট হিরো মুড এ ব্যাক করবো।”

মুখ বিকৃত করে তাকায় প্রজ্ঞা। এনজাম তার বাহু চেপে ধরে একটু ঝুঁকে বলে এবার,
– “মজা করছি ভেবোনা। লাস্ট ওয়ার্নিং…এবার না উঠলে যা বলেছি তাই করবো। গায়ের জোড়ে আমার সাথে টিকবে না অ্যাটলিস্ট। আর বাঁচাও বাঁচাও বলে চ্যাঁচাতেও পারবেনা। প্রজ্ঞা, আমি তিন গুনবো….”

প্রজ্ঞা শুকনো ঢোক গিলে ভীতু স্বরে বলে,
– “তুমি এমনটা করতেই পারবে না!”

এনজাম তেড়ছা হেসে শুধায়,
– “তুমি না মানলেও, আমি অত্যন্ত রোম্যান্টিক একজন মানুষ। মেইবি ইউ ডোন্ট ফরগেট, ক্যাম্পাসের মাঝে দাঁড়িয়ে তোমায় কোলে তোলার রেকর্ড আছে আমার।”

প্রজ্ঞার একটু ভয় হলো। বুঝলো, এই মুহূর্তে জেদ এক পাশে সরিয়ে রাখাই ভালো। তাই ভেবে এনজামের হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরলো সে। চোখদুটো খিঁচে বন্ধ করে নিলো। দু পা এগোতেই এনজাম লক্ষ্য করলো,সে নিরবে চোখের জল ফেলছে। মুচকি হেসে ফিসফিসিয়ে বললো,
– “আমার জন্য কে যেন কেঁদেকেটে ম’রবে না?”

প্রজ্ঞা বিরক্তিভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকালো। মুখ বিকৃত করে বললো,
– “এহহ…আসছে! আমি তোমার জন্য কাঁদছি কে বললো? গরু কোথাকার…কাঁদছি তো পায়ের ব্যাথায়!”

#চলবে?

#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_১৭
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন

অনেক দিন ধরে ঝুলে থাকা একটা মামলার রায় দেওয়া হবে আগামীকাল। শেষদিনের জন্য সকল নথি,প্রমাণ,তথ্যাদি গুছিয়ে রেখে সবে খেতে বসেছে শাফায়াত। প্লেটে ভাত বেড়ে নিতেই ঘরে থাকা ফোনটা বেজে উঠলো। বিরক্তিমিশ্রিত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে ঘরে এলো। ফোনের স্ক্রিন দেখে তা কানে ধরেই বললো,
– “আপনাদের দুই বোনের কী আমার খাওয়ার সাথে কোনো শত্রুতা আছে নাকি?”

প্রীতি বিস্মিত চিত্তে ভ্রুজোড়া কুঁচকে নিলো। অবাক স্বরে বললো,
– “কেন? আমরা আবার কী করলাম?”

– “আগেও একদিন খেতে বসেছিলাম। তোমার বোন তখন কল দিলো। আজকে আবার তুমি। মানে খাওয়ার পরে কী কল করা যায়না?”

– “এ ভাই…আপনার বাসায় কী সিসিটিভি আছে? নাকি তার অ্যাক্সেস আমার কাছে আছে? বুঝবো কী করে খেতে বসেছেন?”

শাফায়াত তর্ক রেখে বিছানায় এসে বসলো। কপাল চেপে বললো,
– “মাফ করেন আপা। এবার বলো, কী দরকার?”

প্রীতি তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো,
– “হেল্প চাই। একটা কেস আমি আপনার কাছে হ্যান্ডওভার করতে চাই।”

– “ওমা…তা কেন?”

– “বললাম ই তো, হেল্প চাই। কিছু ডকুমেন্টস, প্রমাণ কালেক্ট করা ইম্পর্টেন্ট। আমি একা হিমশিম খাচ্ছি রীতিমত। এটা যে ডিসট্রিক্ট কোর্ট এর কেস হয় কী করে!”

শাফায়াত হেসে শুধায়,
– “তুমি কী আমাকে হাই কোর্ট থেকে ডিসট্রিক্ট কোর্টে নামানোর প্ল্যান করছো?”

প্রীতি অনুরোধের স্বরে জানায়,
– “একবারই তো বলছি। না করবেন না! আমি আপনার অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে থাকবো।”

– “কী বোকা মেয়ে! নিজের কেস অন্যকে দিয়ে আবার তারই অ্যাসিস্টেন্ট হতে চাও?”

– “মজা করবেন না। এমনিতেই প্যারায় আছি।”

– “ওককে মিস প্রীতিলতা। কাল আসুন…কথা বলে নেই।”

প্রীতি হতাশ কণ্ঠে বলে,
– “অনলি প্রীতি!”

– “তাই তো বললাম…প্রীতিলতা!”

__ __ __
রাতের নির্জন রাস্তায় গাড়ি শোঁ শোঁ করে এগিয়ে যেতেই পারে। তবে এনজাম একেবারেই ধীরে চালাচ্ছে। সঙ্গে মৃদুস্বরে গান বাজছে,
“Tune chhuaa.. toh main dhadakne laga
Dil ki duaa.. hothon pe rakhne laga”

প্রজ্ঞার নিকট বাক্যগুলো বড্ড বিরক্তির ঠেকলো। হাত বাড়িয়ে বন্ধ করে দিলো গানটা। সিটের সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে জানালার দিকে মুখ ঘোরাতেই ভীষণ সুন্দর এক দৃশ্য চোখে পড়লো তার। তাদের পাশাপাশি ধীরগতিতে চলছে একটা বাইক। ছেলেটা সামনে তাকিয়ে বাইক চালাচ্ছে। পিছনে একটা মেয়ে, শক্ত হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে পিঠে মাথা ঠেকিয়ে আছে। ঘুমঘুম চোখ তার। ছেলেটা মাঝে দুয়েকবার ঘার ঘুরিয়ে তাকে দেখার চেষ্টা করছে।

এইতো… সেই দু চার পাঁচবছর আগেগার প্রজ্ঞা-এনজাম জুটি। রাতবিরেতে এনজাম বাইক নিয়ে এসে কল দিতো। প্রণয় ঘুমের মাঝে জাগেনা কখনো। তাকে প্রীতির কাছে রেখে লুকিয়ে বেরিয়ে যেতো প্রজ্ঞা। ঠিক এভাবেই বরকে শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতো। বাইক চলতো ধীরগতিতে। না বলা শত কথার ঝুলি খুলে বসতো দুজন। আবার মাঝেসাঝে নির্বাক থাকতো। এনজাম একহাতে তার হাতদুটো আঁকড়ে ধরে রাখতো। প্রিয় পুরুষের সান্নিধ্যে মাঝেমধ্যে ঘুমিয়েই যেতো প্রজ্ঞা!

গাড়িতে তো আরো আরামে বসা যায়,ঘুমোনো যায়। তবে সেই বাইকে বসার মতো আনন্দ তো নেই! এইযে প্রজ্ঞা দূরে সরে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে আছে… বাইকে বসলে তো এটা সম্ভব হতো না। সেই তাকে ধরেই বসতে হতো।
চোখটা ভরে উঠলো প্রজ্ঞার। এইতো কদিন আগের কথা,ধীরগতিতে গাড়ি চালানো নিয়েও সে তর্ক বাধালো।
– “তুমি এত আস্তে চালাচ্ছো যে মনে হচ্ছে বৃষ্টির সময় গ্লাসে পানি জমিয়ে রাখছো!”

এনজাম না তাকিয়েই বললো,
– “মিনারেল ওয়াটারের মতো বৃষ্টি উপভোগ করো। গাড়ি দ্রুত চালালে তো ফোটা দেখার সুযোগই পাবে না।”

– “আমি উপভোগ করছি না, কষ্ট পাচ্ছি। কারণ আমাদের গন্তব্যে পৌঁছতে সারাটা দিন লাগবে।”

কপাল চাপড়ে বলে প্রজ্ঞা। এনজাম মেকি হেসে শুধায়,
– “তাহলে গন্তব্য বাদ দিয়ে বৃষ্টি উপভোগ করো। এটা তো ফ্রি!”

আজ কেন পারছেনা? গলা থেকে টু শব্দটি বের করা সম্ভব নয়। ঠোঁট কামড়ে ধরে মুখটা আরো একটু ঘুরিয়ে নিলো সে। এত কান্না পাচ্ছে কেন?
এনজাম তবুও লক্ষ্য করে বসলো। আড়েআড়ে চেয়ে দেখলো। মেইনরোড দিয়ে না গিয়ে ঢুকলো অন্য রাস্তায়। এখান থেকে ঘুরে যেতে কিছুটা বেশি সময় লাগে। প্রজ্ঞা এতেও বলেনা কিছু। সময়ের সাথে এনজাম বুঝতে পারে,সে ক্ষণেক্ষণে ফোঁপাচ্ছে। হাতের পিঠে গালটা মুছে নিচ্ছে বারবার।
বুকের মাঝে অনুভূত সূক্ষ্ম ব্যাথা নিশ্চিত করলো, মেয়েটির রাগ,জেদ,অভিমান সবকিছু সহ্য নরে নিলেও কান্না জিনিসটা সে আজও সহ্য করতে পারেনা।

প্রজ্ঞার কান্নার বেগ বেড়েই গেল। একপর্যায়ে স্পষ্টভাবে তা কানে এলো এনজামের। শক্ত এক ঢোক গিলে গম্ভীর গলায় বললো,
– “স্টপ ইট! কান্না থামাও।”

প্রজ্ঞা তাকালো তার দিকে। অশ্রুসিক্ত চোখজোড়া দেখে বললো এনজাম,
– “এখন কী হয়েছে? পায়ের ব্যাথা?”

দুদিকে মাথা নাড়লো প্রজ্ঞা। চোখ সরিয়ে নিলো পুনরায়। এনজাম বড্ড অবাক হলো। হৃদয়ের সবচেয়ে কাছের মেয়েটার সঙ্গেও তার জড়তা কীসের? কথা গুছিয়ে বলতে পারছেনা। নিজের সিটে সোজা হয়ে বসলো সে। স্টেয়ারিং এ হাত রেখে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো,
– “তাহলে সমস্যা কী? যাবেনা? তোমার বাড়িতে দিয়ে আসবো?”

প্রজ্ঞা এবারেও উত্তর না দিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকালো। এনজাম বিরক্ত হয়ে বলে,
– “করবো টা কী? আইসক্রিম খাবে?”

– “উঁহু।”

– “দেন স্টপ ক্রাইং!”

সে কান্না থামালোই না। বরং মাথা ঝুকিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। প্রজ্ঞা এভাবে কাঁদেনা কতদিন… মনে পড়লোনা। এনজাম বাধ্য হয়ে তার বাহু চেপে ধরে টেনে আনলো নিজের কাছে। থুঁতনি ধরে তার মুখখানা ঘুরিয়ে নিলো। খানিকক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে থেকে বললো,
– “কথা জানোনা কোনো? এমনি সময় তো খঁই ফোঁটে মুখ থেকে। এখন এমন করার মানে কী?”

– “কিছু হয়নি। ছাড়ো।”
ধরা গলায় বললো প্রজ্ঞা। এনজাম মুহূর্তের মাঝে তার ঠোঁট আঁকড়ে ধরলো। কয়েক সেকেন্ড বাদেই ছেড়ে দিলো। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বসে রইলো কিছুটা সময়। নিজের অজান্তেই তার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে বসলো,
– “আই ডিড’ন্ট ওয়ান্ট দিস,বিলিভ মি। কক্ষনো না…নেভার এভার!”

পরক্ষণেই সরে গেল সে। নিজ স্থানে বসে আবারো গাড়ি স্টার্ট দিলো। এবার আর ধীরে নয়, স্বাভাবিক গতিতেই চললো গাড়ি। প্রজ্ঞা কান্না থামিয়ে চেয়ে রইলো সামনে থাকা লুকিং গ্লাসের দিকে। মিনিট দুয়েক বাদে এক অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়লো।
দু আঙুল নিজের দু-চোখের কিনারে একবার চেপে ধরলো এনজাম। ছেলেদের চোখে জল আসতে নেই…একদম না! কী বিশ্রি লাগে! ইচ্ছে করে ঠা’স করে গালের উপর একটা চ’ড় বসিয়ে বলতে,
– “কীরে! তুই কী মেয়ে? নাহ,তুই হচ্ছিস ছেলে। রেগে কথা বলতে পারলে মিষ্টি কথাও বলতে পারবি। এত ইগো থাকবে কেন? জীবনে হাজারবার ঝগড়া হলে হাজারবার ই তুই এসে রাগ ভাঙাবি বউয়ের। এই দায়িত্ব সর্বদাই তোর।”

গ্যারেজে এসে গাড়ি থামালো এনজাম। নিজে বেরিয়ে অপরপাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। প্রজ্ঞা তার অপেক্ষা না করে একাই বেরোলো গাড়ি থেকে। ডান পায়ের হাটুতে লেগেছে মূলত। উঠে দাঁড়াতেই পা ভেঙে এলো যেন। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দু কদম এগিয়ে সেভাবেই ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রইলো সে। এনজাম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এগিয়ে এলো। কিচ্ছুটি না বলে কোলে তুলে নিলো তাকে। প্রজ্ঞা তৎক্ষণাৎ উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
– “নামিয়ে দাও,আমি একাই যেতে পারবো। কী হলো…অ্যাই!”

এনজাম শুনলো না। সেভাবেই গিয়ে লিফট এ উঠলো। প্রজ্ঞা আর বাঁধা দিলোনা। আটতলায় এসে খুললো লিফটের দরজা। নিজেদের ফ্ল্যাটের সামনে এসে এনজাম মুখ খুললো,
– “পকেটে হাত দাও। চাবি বের করে দরজা খোলো।”

প্রজ্ঞা বাধ্য মেয়ের ন্যায় তার শার্টের পকেট থেকে চাবি বের করে দরজার লক খুললো। নব ঘুরিয়ে দরজাটাও খুলে দিলো। এনজাম তাকে নিয়ে সোজা ঘরে চলে এলো। বিছানায় বসিয়ে দিয়ে গাড়ির চাবি,গেইটের চাবি ঠিক জায়গায় রেখে দিলো। প্রজ্ঞা ঠিকঠাকভাবে পা তুলে বসে জিজ্ঞেস করলো,
– “প্রণয় খেয়েছিলো?”

– “হুম,ঘুমিয়েও গেছে।”
প্রজ্ঞার দিকে চেয়ে গম্ভীর গলায় জানতে চায় সে,
– “খাবে কি খাবেনা…একবারে বলবে। দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করবোনা।”

মাথা নাড়িয়ে না সূচক উত্তর জানালো প্রজ্ঞা। এনজাম গিয়ে টেবিলে থাকা ভাত,তরকারি,মাছ সবকিছু ফ্রিজে গুছিয়ে রাখলে। একদিন না খেয়ে থাকলে তো আর ম’রে যায়না মানুষ। রাতে খিদে পেলে নিজেই এসে খেয়ে নেবে।
বিছানার সামনে এসে প্রজ্ঞার পায়ের কাছে বসলো এনজাম। একনজর তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– “কোথায় লেগেছে?”

পা’টা অন্যদিকে সরিয়ে নেয় প্রজ্ঞা। কী অভিমানি রূপ! এমন অভিমান সে করতো বিয়ের শুরুর দিকে। বিশেষ করে গর্ভবস্থায়। গত কয়েক বছরে তো রাগ,ঝগড়ার ভারে অভিমান একেবারেই নিঃশেষ হয়ে গেছে।
তার ডান পা’টা তুলে নিজের হাটুর উপর রাখলো এনজাম। পাজামা’টা ধীরেধীরে তুললো হাটু অবধি। প্রজ্ঞা একদিকে চোখ সরিয়ে নেয়।
হাটুর দিকে অনেকটা জায়গা জুড়ে চামড়া উঠে লাল হয়ে আছে,কিছু স্থানে রক্ত জমাট বেঁধে নীলচে রঙ ধারণ করেছে। কটমট চোখে তাকিয়ে বললো এনজাম,
– “বেক্কল মেয়েমানুষ! এত বড় হয়েও কেউ রাস্তাঘাটে উষ্টা খায়?”

উত্তর দিলোনা প্রজ্ঞা। বরং আদেশের সুরে বললো,
– “একসেট জামা এনে দিয়ে বের হও। চেঞ্জ করবো আমি।”

এনজাম মুখ বিকৃত করে ওয়ারড্রব থেকে কুর্তি,প্লাজো বের করে দিলো তার কাছে। ভ্রু কুঁচকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
– “নাটক!”

প্রায় পাঁচমিনিট বাদে নিজেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে দরজা খুলে দিলো প্রজ্ঞা। বিছানায় গিয়ে হেলান দিয়ে বসলো। চোখদুটো বুজে মাথাটা হেডবোর্ডে ঠেকিয়ে রাখলো। তাদের ঘরে এমন পিনপতন নিরবতা বড্ড বেমানান। দম আটকে আসে এমন পরিস্থিতিতে। মন ভালো থাকলেও তারা কথা বলে, মন খারাপ থাকলেও। হাসি ঠাট্টা অল্প স্বল্প, আর ঝগড়া সারাদিন। তবুও নির্বাক থাকেনা। বিশেষত প্রজ্ঞা থাকতে দেয়না।

ক্ষতস্থানে কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্ষ অনুভব করেও চোখ মেললোনা প্রজ্ঞা। এনজাম আলতো স্পর্ষে মলম লাগিয়ে দিলো। একনজর তাকিয়ে দেখলো,মেয়েটার গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। মৃদুস্বরে জানতে চাইলো সে,
– “জ্বলছে?”

মাথা নাড়লো প্রজ্ঞা। এনজাম সাবধানে ফুঁ দিয়ে দিয়ে মলম লাগালো। অত:পর একটা পেইনকিলার ট্যাবলেট এনে দিলো। পানির বোতলটাও এগিয়ে দিয়ে বললো,
– “খেয়ে নাও, ব্যাথা কমে যাবে।”

চোখ খুলে তার পানে চাইলো প্রজ্ঞা। অদ্ভুতভাবে হেসে বললো,
– “জানোতো… সব ব্যাথা পেইন কিলার এ কমেনা।”

ঔষধটা সে খেলো যদিও। এনজাম স্মিত হেসে তার খোলা চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বললো,
– “বড্ড ভারী কথা বলছো। বি রিল্যাক্স না!”

প্রজ্ঞা পুনরায় নাক টানলো। এনজাম আরো কাছে এসে চোখটা মুছিয়ে দিতেই বললো,
– “ইট হার্টস মি, তুমি এমন কথা কী করে বললে? ইউ ডোন্ট আন্ডার্সট্যান্ড মাই পেইন এনিমোর…”

তার এক গালে হাত রেখে অপর গালে নাক ঘষলো এনলাম। নিজেও ক্ষীন স্বরে অভিযোগ ছুড়লো,
– “দেন, হোয়াট অ্যাবাউট ইয়োর সাইড?”

প্রজ্ঞা চোখ তুলে চাইলো। এক আঙুল ব্যাবধানে থাকা দুটি চোখ দেখে গেল একে অপরকে। আর একটা কথাও হলোনা তাদের মাঝে। সময় অতিবাহিত হলো। চির পরিচিত দুজন মানুষ একে অপরের হৃদয়ের কথা জানার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো। সঙ্গ দিলো তাদের দেহ। কে কাকে বুঝতে পারলো, কে জানে! অভিযোগ, কষ্ট, ভালোবাসার সংমিশ্রণে তাদের বুকের সূক্ষ্ম ব্যাথাটা বুঝি একটুখানি লাঘব হলো!…

ঘড়ির কাটা দুইয়ের ঘরে দৃশ্যমান। সেদিকে তাকিয়েই হেডবোর্ডের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে ছিলো এনজাম। পা নাড়ানো তার ছোটবেলার অভ্যাস। প্রজ্ঞা ভীষণ রাগ করে এতে… আজ বললোনা কিছুই।
গলা অবধি কম্বল তুলে উল্টোদিকে ঘুরে আছে সে। চোখদুটো বোজা। মূলত এই নরম বালিশ তার পছন্দ হয়নি। বর্তমানে তার জায়গা হবার কথা ছিলো পাশে বসে থাকা পুরুষটির বুকে। একটা শান্তির ঘুম দিতো। সকালে উঠে আবার আগের রূপে ফিরে যেত। কিন্তু তা আর হলো কই?
আদর-সোহাগ শেষে নিজে থেকে সরে এলো। এনজাম কিচ্ছুটি বললো না। টেনে এনে বুকে জড়িয়ে নিলোনা। বিশমিনিট যাবৎ একইভাবে বসে আছে। নাইট গার্ড এর কাজে যুক্ত হবার চিন্তা করছে নাকি?

এনজাম ঘাড় বাকা করে একবার দেখে নিলো প্রজ্ঞাকে। জিহ্বা দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে ডাকলো,
– “প্রজ্ঞা?”

– “হু…”

চোখ বুজেই জবাব দিলো প্রজ্ঞা। এনজাম আবারো বলে,
– “ঘুমিয়ে পড়েছো?”

– “উঁহু…”

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে এনজাম,
– “আমার মনে হয়……”
থেমে যায় সে। প্রজ্ঞা চোখ খুললো। মিনিটখানেক অপেক্ষা করে বললো,
– “কী?”

এনজাম চোখজোড়া প্রজ্ঞার পানে আবদ্ধ রেখে লম্বা দম টেনে বললো,
– “আই থিংক… উই শুড বি সেপারেটেড।”

প্রজ্ঞার মনে হলো,সে কানে ভুল শুনেছে। পরমুহূর্তে তড়িৎবেগে ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলো এনজামের দিকে। যুবকের স্থির দৃষ্টি তাকে থমকে দিলো ক্ষনিকের জন্য। নাহ… এ কথা তার দ্বারা উচ্চারিত হতেই পারেনা! কিছুক্ষন পূর্বের নির্ভেজাল ভালোবাসা সাক্ষী, এনজাম এমন কথা বলতেই পারেনা!

#চলবে?

#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_১৮
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন

এনজাম সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত ছিলো প্রিয়তমা স্ত্রীকে সামলে নেওয়ার জন্য। তার চোখের জল মুছিয়ে ঠান্ডা মাথায় সবটা বুঝিয়ে বলার জন্য। অথচ মিনিটখানেক তাকিয়ে থেকে প্রজ্ঞা আধশোয়া হয়ে বসলো। এনজামের মুখের দিকে এগিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে,
– “আবার বলো,শুনতে পাইনি।”

এনজাম মাথাটা পিছনের দিকে সরিয়ে নিয়ে শান্ত গলায় বলে,
– “কুল ডাউন… বলতে চাইছি যে, কিছুদিনের জন্য আমাদের আলাদা থাকা…”

কথা শেষ হবার পূর্বেই ঠা’স করে একটা শব্দ হলো। এনজাম গালে হাত চেপে বড়বড় চোখে তাকালো। নাহ, বেশি জোরে লাগেনি। তবে শব্দটা বেশিই ছিলো। প্রজ্ঞা দাঁতে দাঁত পিষে শুধায়,
– “আবার বল।”

এনজাম শুকনো ঢোক গিলে তার দু-কাঁধে হাত রাখতেই অকস্মাত প্রজ্ঞা পিছন থেকে নিজের একহাত বের করে আনে। তার গলার থেকে এক আঙুল দূরে একটা কেঁচি ধরে বলে,
– “একেবারে জানে মে’রে ফেলবো। হাত সরা…”

এনজাম খুব সাবধানে কেঁচিটা চেপে ধরলো। ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো
– “কুল ডাউন… আমার কথাটা তো শোনো! আমি ভালোর জন্যই…”

– “কী ভালোর জন্য? ভালোর জন্যই শেষ পাতে মিষ্টি খেতে দিয়ে তার মধ্যে এলাচ ঢুকিয়ে রাখবে?”

– “অ্যাহ? কীসের মিষ্টি আর কীসের এলাচ?”

ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে দিলো প্রজ্ঞা। কম্বলটা গলার কাছে চেপে ধরে কেঁচিটা ছুড়ে ফেললো মেঝেতে। আঙুল উঁচিয়ে উচ্চস্বরে বললো,
– “হ্যা! শেষপাতের মিষ্টি হচ্ছিস তুই, আর এলাচ হলো তোর মুখের কথা। আমার ইচ্ছে করছে তোর মাথাটা…”

আসেপাশে তাকিয়ে ভারী কিছু খুঁজলো প্রজ্ঞা। না পেয়ে কটমট চোখে তাকিয়ে বললো,
– “টিভির রিমোট কই?”

এনজাম একটু গম্ভীর হয়ে বললো,
– “দেখো, সিনক্রিয়েট কোরোনা। আমার কথা বোঝার চেষ্টা করো। এভাবে কতোদিন চলবে? সব ঠিক হয়ে যাবে, আবার দুদিন পর একই ঘটনা ঘটবে। লাভটা কী?”

– “আরে আমার জীবনের তো লাভ লস কিছুই নাই! তুমি থাকতে দিয়েছো? আচ্ছা তোমার মাথার কোনো স্ক্রু কী ডাক্তার জন্মের সময় খুলে রেখেছিলো? যেকোনো কথা বলার একটা টাইমিং থাকে!”

এনজাম চোখদুটো ছোটছোট করে বললো,
– “হ্যা তো? ঠান্ডা মাথায় কথা বলা বেটার না? আর তোমার না মুড অফ ছিলো? কিছুক্ষন আগে দেখি কেঁদেকেটে ভাসাচ্ছিলে।”

প্রজ্ঞা সোজা হয়ে বসে বিছানায় একটা ঘুষি মা’রলো। এনজামের চুল ধরে নিজের কাছে টেনে এনে বললো,
– “কাঁদছিলাম, সেটা তো পছন্দ হলোনা! মুড অফ ছিলো…মুড ভালো করতে বলেছিলো কে? ব্যাপারটাতো এমন হলো, মাসুম একটা বাচ্চাকে কোকাকোলার নাম করে তেতো ঔষধ খাইয়ে দেওয়া!”

– “আরে চুল তো ছাড়ো! অনেক শখের চুল আমার।”

– “শ’য়’তা’ন, তোর চুল টেনে ছিড়ে ন্যাড়া বানিয়ে অফিসে পাঠাবো আমি। আর কী বললি? উই শুড বি সেপারেটেড? মামা বাড়ির আবদার না? তুমি বলবে, বাসায় চলো। আমি চলে আসবো। আবার বলবে চলে যাও, আমি চলে যাবো? শোন,আমি না এত স্বস্তা না।”

এনজাম অতি কষ্টে নিজের চুলগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
– “সকালে কে চলে গিয়েছিলো? দয়া দেখিয়ে না আনতে গেলে কী ফিরতে আর? এখন এত ভাব দেখানোর কী আছে?”

প্রজ্ঞা ভ্রু কুঁচকে বলে,
– “তুমি বলতে পারবে, প্রেমিকা ভালো কিন্তু বউ ভালো না। আর আমি চলে যেতে পারবো না? আরে একবার না, আমি হাজারবার যাবো! স্বেচ্ছায় যাবো। এটা আমার নারীগত অধিকার। কিন্তু তুই নিজে থেকে বলিস কোন সাহসে? এইজন্যই কাউকে লাই দিতে হয়না!”

এনজাম ভারী বিরক্ত হলো। দু-হাত তুলে হতাশ স্বরে বললো,
– “মাফ কর মা। আমারই ভুল হয়েছে। আসলে আমি বুঝতেই পারিনি, দীর্ঘদিনের পাবনা ফেরত এক পাগলের সাথে সংসার করছি। তাকে ভালো কথাও বলা যাবেনা, খারাপ কথাও না। ওকে ফাইন… আই ওয়ান্ট টু ফিক্স ইট। বাট ইউ ডোন্ট, এন্ড ইটস ইয়োর ফল্ট…নট মাইন। আর কদিন আছে যেন? ষাট-পয়ষট্টি? যেতে দাও, তারপর দেখছি।”

এনজাম বালিশ টা নিয়েই উঠে গেলো। প্রজ্ঞা বড়বড় চোখে চেয়ে বললো,
– “আই ডোন্ট! ওরে বলদের ঘরের বলদ, তোরে একটু আগে লা’ত্থি দিয়ে সরাই নাই কেন আমি? এই যাস কই? দাঁড়াতে বলেছি… এনজাইমের বাচ্চা! আর এসো তুমি আমার কাছে… ষাট-পয়ষট্টি দিন না? মনে রাখলাম। ভুলবশত ও কোনো ভুল করলে তোর মাথা আর মাথার জায়গায় থাকবেনা।”

ধপ করে বালিশে শুয়ে পড়লো প্রজ্ঞা। ফোঁসফোঁস করতে করতে চোখ বুজলো। তেজের মাঝে কয়েকবার ফোঁপালো সে। সেপারেশন শব্দটাই তো কেমন ভীতিকর। ভাবতেই গায়ে কাটা দেয়। মাথায় ঘুরপাক খায় গানের দুটো চরণ,
“দূরত্ব কি ভালোবাসা বাড়ায়?
নাকি চলে যাওয়ার বাহানা বানায়?”

ভালোবাসা অনুভবের বদলে দূরত্ব যদি সত্যিই তাদের দূরে ঠেলে দেয়? কাছে আছে, পাশে আছে… শত ঝামেলার মাঝেও এটাই তো একটা শান্তির বিষয়।

প্রায় মিনিটপাঁচেক বাদে পুনরায় নিজের পাশে কারো উপস্থিতি অনুভব করলো প্রজ্ঞা। একই কম্বল টেনে আরো একজন গায়ে জড়ালো। ঠান্ডা হাতের দ্বারা তার পেট জড়িয়ে বুকের মাঝে মাথা রেখে ক্ষীণ স্বরে বললো,
– “আপাতত অফ যাও। বাকিটা কাল সকালে দেখছি।”

মুচকি হেসে পুরুষটির চুলের মাঝে হাত ডুবিয়ে রাখলো সে। আলতো হাতে দুয়েকবার টেনে দিয়ে নিজেও ডুবে গেলো ঘুমের সমুদ্রে।

— — —
পাশে দুটো ধোয়া ওঠা গরম কফির কাপ নিয়ে বসেছে প্রীতি-শাফায়াত। সামনে ল্যাপটপে সিসিটিভি ফুটেজ, টেবিলের উপর ছবি, কাগজপত্র। শাফায়াত সবটা দেখে আঙুলে কলম ঘুরিয়ে জানতে চাইলো,
– “মেয়েটার কন্ডিশন কী?”

প্রীতি ফুঁ দিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
– “বেটার… বিশেষ করে মানসিক দিক থেকে বেশ স্ট্রং। সার্জারির জন্য বাহিরে যাবে। কেসটার জন্যই আটকে আছে।”

শাফায়াত তীক্ষ্ণ চোখে কাগজগুলো পরখ করে বললো,
– “ফ্রেন্ড সার্কেল কে জিজ্ঞাসাবাদ এর জন্য ডাকা হয়েছিলো?”

– “হুম… পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কিন্তু তেমন কোনো ক্লু পায়নি। ভদ্র ঘরের মেয়ে, শত্রু থাকার কথা নয়। বিশেষ করে এসিড অ্যাটাক এর মতো।”

শাফায়াত স্মিত হেসে বলে,
– “থাকেনা তো ম্যাডাম। তাও তৈরি হয়ে যায়।”

প্রীতি কিছুক্ষন নিজে ভেবে বললো,
– “আমার কাছে ওর আরো কিছু ফ্রেন্ড এর ইনফরমেশন আছে। লাইক…খুব ভালো ফ্রেন্ড তেমন না। তবে চলাফের করতো। ওয়েট,আমার ফোনে আছে।”

শাফায়াত কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে তার ফোনের দিকে মনোযোগ দিলো। প্রীতি একটা ফাইলে প্রবেশ করে ফোনটা দিলো তার হাতে,
– “এইযে চার পাঁচজন। মাঝেসাঝে এদের সাথে চলতো।”

শাফায়াত ফোন হাতে নিয়ে একদম নিচ অবধি স্ক্রোল করলো। পঞ্চম মেয়েটিকে দেখে কপালে ভাজ পড়লো তার। প্রীতির দিকে তাকিয়ে বললো,
– “এদেরকে দেখেছিলে আগে?”

– “উঁহু। কাল রাতেই পেলাম। আর খুলে দেখা হয়নি।”

শাফায়াত ফোনটা এগিয়ে দিলো। প্রীতি সরু চোখে একবার তাকালো স্ক্রিনের দিকে। সেকেন্ডের মাঝে একইভাবে ভ্রুযুগল কুঁচকে এলো তার। আনমনে বলে উঠলো,
– “অ্যানি!”

___ ___

সকাল সকাল এক মিষ্টি সুবাস নাকে আসতে এনজামের ঘুম ভেঙে যায়। পিটপিট করে চোখ খুলতেই যেন এক অপ্সরাকে দেখতে পেল সে! ফর্সা কপালে দু চারটে ভাজ নিয়ে সে বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ারে কিছু একটা খুঁজে চলেছে। সদ্য গোসল সেরে বের হওয়ায় ভেজা চুলগুলো কানের পাশ থেকে ছড়িয়ে পড়েছে। সামান্য ঝুঁকে থাকায় তাদের অবস্থান এনজামের নাকের অতি কাছে। সুবাসটা শ্যাম্পুর, তার পরিচিত।

তবে এনজাম অবাক হলো প্রজ্ঞাকে আপাদমস্তক দেখে। সাদা রঙে ব্লাউজ পেটিকোট, তার উপর গোলাপি রঙের জামদানি শাড়িটা নামমাত্র গায়ে জড়ানো। অলংকার এর মাঝে কেবল হাতে একটা চিকন সোনার ব্রেসলেট। এটা তার বাবার দেওয়া, অনেক আগে থেকেই পরে থাকে।

নিজের কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি না পাওয়ায় হতাশ হয়ে পাশে তাকাতেই এনজামের এমন মোহগ্রস্থ দৃষ্টি নজরে এলো প্রজ্ঞার। চটজলদি সরে গিয়ে দাঁড়ালো আয়নার সামনে। এনজাম আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো। জানতে চাইলো,
– “কী খুঁজছিলে?”

– “তোমার মাথা আর আমার মুণ্ডু।”
হাতে লোসন লাগাতে লাগাতে বললো প্রজ্ঞা। এনজাম প্রতিক্রিয়া না জানিয়েই বিছানার একপাশে বসে আবারো জিজ্ঞেস করে,
– “হঠাৎ শাড়ি পড়ার কারণ?”

– “এমনি।”

চোখ ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই একটা লাগেজ চোখে পড়লো এনজামের। অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে মনেমনে হেসে বললো,
– “মেয়ে মানুষের মুড সুইং…হাহ!”
প্রজ্ঞার দিকে চেয়ে জানতে চাইলো,
– “কখন যাবে?”

– “প্রণয় উঠলেই।”

– “ভালো… যাও।”

প্রজ্ঞা মাথা নুইয়ে হাসলো সামান্য। এর আগে একদিনের জন্য বাপের বাড়ি গেলেও সে হাজারবার বলতো, “অতিরিক্ত চারবছর থেকেও কী মন ভরেনি? আবার এখন যেতে হবে কেন?”

এনজাম গোসল সেরে বেরিয়ে দেখলো প্রজ্ঞা সবে শাড়ি পরা শুরু করেছে। কুচি করছে ধীরেধীরে। আবার খুলছে, আবার করছে। কোনো মনোযোগ ই নেই। এনজাম কিছুক্ষন অপেক্ষা করে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। প্রজ্ঞার হাত থেকে এলোমেলো কুচিটা ছাড়িয়ে নিয়ে নতুন করে কুচি করলো। গোছানো কুচিগুলো প্রজ্ঞার হাতে ধরিয়ে নিজে হাটু গেড়ে বসে পায়ের কাছ থেকে কুচিগুলো ঠিকঠাক করে দিলো। প্রজ্ঞা তার পানে চেয়ে তাচ্ছিল্যের স্বরে শুধালো,
– “কেমন ঘটা করে বিদায় দিচ্ছো আমাকে! এমনভাবে তো কাছেও নিয়ে আসোনি।”

এনজাম চোখ তুললোনা। হুট করে মাথায় এলো, প্রজ্ঞার কখনো বউ সাজা হয়নি। লাল বেনারসি পড়া হয়নি, মুখে ভারী সাজ,মাথায় বউ ওড়নাটা দেওয়া হয়নি। হ্যা, নিজের প্রথম স্যালারির টাকা দিয়ে তাকে একটা সুতির লাল শাড়ি কিনে দিয়েছিলো এনজাম। নিজের হাতে পরিয়ে দিয়েছিলো, সাজিয়ে দিয়েছিলো। তবে বর-বউয়ের সাজটা তাদের দেওয়া হয়নি। হয়তো হতো…যদি প্রণয় না থাকতো। একটা বাচ্চা নিয়ে আর কীসের বর বউ সাজা!

মনে মনে একটা জিনিস ভেবে রাখলো এনজাম। প্রজ্ঞাকে যদি এবার হাত ধরে ফিরিয়ে আনে, তবে একান্তে হলেও তারা বর বউ সাজবে। এই ঘরের চার দেয়ালের মাঝেই হোক…তবুও। সঙ্গে ছেলেকেও সাজাবে। মেয়েটার এই একটা অধরা শখ কিছুটা হলেও পূরণ করবে।

শাড়ি পড়ানো শেষে নিজের প্যান্টের পকেট থেকে সেই সোনার আঙটিটা বের করে আনলো এনজাম। প্রজ্ঞার বাম হাতের অনামিকা আঙুলে পরিয়ে দিয়ে বললো,
– “এমন জিনিস খোলার সাহস করো কেন, চব্বিশ ঘণ্টা না যেতেই যা হন্য হয়ে খুঁজতে হয়?”

.
নানাবাড়ি যাওয়ার কথা শুনেই প্রণয় নাচতে নাচতে তৈরি হয়ে গেলো। খাম্মির সঙ্গে থাকেনা কতদিন!
তবে মন খারাপ হলো ছোট্ট টুশির। মুখ ভার করে খাটের একপাশে বসে রইলো। প্রজ্ঞা তা বুঝতে পেরেই কোলে তুলে নিলো তাকে। গালে দুটো চুমু খেয়ে বললো,
– “মন খারাপ করেনা মা। ভাইয়ার সাথে ফোনে কথা বলে নিও।”

– “কিন্তু আমি খেলবো কী কলে?”

– “হুমম…আসলেই তো। আচ্ছা, তুমিও তাহলে চলো আমাদের সাথে। ভাইয়ের সাথে সারাদিন খেলতে পারবে। আর তোমার প্রীতি আন্টি ও আছে। যাবে?”

টুশি চোখদুটো গোলগোল করে বলে,
– “আম্মু যাবে?”

– “নাহ,আম্মু যাবেনা। কিন্তু মামি তো আছি। তোমাকে খাইয়ে দেবো,ঘুম পারিয়ে দেবো।”

টুশি দুদিকে মাথা নাড়লো, অর্থাৎ সে যাবেনা। আগ্রহী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
– “তোমলা কবে আচবে?”

প্রজ্ঞা ঘাড় ঘুরিয়ে এনজামের দিকে তাকালো একবার। নিচু স্বরে বললো,
– “দেখি…কখন আসি।”


প্রজ্ঞা,প্রণয়ের সঙ্গে বেরোলো এনজামও। বউ ছেলেকে নিয়ে একাএকা বাপের বাড়ি যাচ্ছে,ব্যাপারটা ভালো দেখায় না। সে তাদের পৌঁছে দিয়ে তারপর অফিসে যাবে।
তবে আজ ড্রাইভিং সিটে এনজাম নয়, বসেছে প্রজ্ঞা। তার মতে সে এনজামের চেয়ে অনেক ভালো গাড়ি চালায়। মিনিট দশেক বাদে সোজা রাস্তা ছেড়ে বাঁকাপথে ঢুকতেই এনজাম বাজখাঁই কণ্ঠে বলে উঠলো,
– “এইদিকে যাচ্ছো কেন?”

– “এই রাস্তাটা ধরলেই তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাব। তুমি চুপ করে বোসো।”

– “তোমার এই ‘তাড়াতাড়ি রাস্তা’ এত ঘুরপাক খায় যে মনে হয় আমরা সড়ক মানচিত্র বানাতে বেরিয়েছি।”

প্রজ্ঞা একনজর তাকিয়ে বললো,
– “তুমি কিছুই বোঝো না! এই রাস্তায় ট্রাফিক কম।”

এনজাম মুখ বাঁকিয়ে শুধায়,
– “ট্রাফিক কম, কারণ এই রাস্তায় মানুষ ভুল করে আসে। আর তুমি এত জোরে হর্ন দাও কেন? মানুষ তো চমকে রাস্তায় পড়ে যাবে!”

– “তুমি হর্ন না বাজিয়ে চুপচাপ বসে থাকো। তারা কী নিজেরাই সরে যাবে?”

এনজাম ফোঁস করে দম ছাড়লো,
– “হর্ন বাজাতে না করছি না, শুধু বলছি তোমার হর্ন বাজানোর ধরণে মানুষকে আতঙ্কিত কোরো না।”

– “আমার কাছে এটা ড্রাইভিং কৌশল। যদি তোমার সমস্যা হয়, তাহলে কান বন্ধ করে বসে থাকো।

পিছনের সিটে বসে থাকা প্রণয় চেঁচিয়ে উঠলো তখন,
– “তোমরা হর্ন নিয়ে ঝগড়া করো, কিন্তু আমার হেডফোন কোথায়?”

.
চৌধুরী কটেজ, প্রজ্ঞার বাবার বাড়ি। বাড়ির সামনের বড় গেইটটার সামনে এসে গাড়ি থামতেই ভিতর থেকে একপ্রকার ছুটে এলেন পাপিয়া আক্তার। মেয়েটা তার কাছে এসে থাকেইনা আর। নাতিটাকেও কাছে পাননা। সকালে প্রজ্ঞা যখন ফোন করে বললো, সে আসছে, কিছুদিনের জন্য থাকবেও। আনন্দে আত্মহারা হয়ে দিকদিশা ভুলে বসেছিলেন তিনি। এত বড় বাড়িতে থাকে শুধু তারা দুই মা মেয়ে,আর দুজন কাজের লোক। তার স্বামী বহুবছর যাবৎ বিদেশেই থাকছেন। সেখানেই তার ব্যাবসা বাণিজ্য। বছরে এক দুবার আসার সুযোগ হয়।

প্রণয় গাড়ি থেকে বের হয়েই ছুটে গিয়ে নানুর কোলে উঠলো। পাপিয়া আক্তার তাকে আদর করতে করতেই এলেন মেয়ের কাছে। কিছুটা অভিমানি স্বরেই বললেন,
– “এতদিনে মনে পড়লো?”

প্রজ্ঞা হেসে বলে,
– “হ্যা,পড়লো। কিন্তু তুমি একা কেন? প্রীতি কোথায়?”

– “সে বেরিয়েছে নিজের কাজে। বাড়িতে থাকে কতক্ষন?”

এনজামও বেরিয়ে এসে সালাম দিলো শাশুড়িকে। তিনি উত্তর দিলেন হাসিমুখে। এনজামকে গাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গম্ভীর গলায় বললেন,
– “ভিতরে এসো। খেয়ে তারপর যাবে। বউ তোমার যতই ভালো রান্না শিখে যাক না কেন, শাশুড়ির হাতের রান্নাও মাঝেসাঝে খেতে হয়।”

এনজাম মৃদু হেসে বলে,
– “অফিস আছে তো আমার। অন্য এক সময়…”

– “আসতে বলেছি,আসবে। আর কিছু শুনতে চাইনা।”

এনজাম আর না বলার সাহস পেলোনা। এই মহিলাকে সে রীতিমত ভয় পায়। বয়স কম হয়নি, তবুও তার চলাফেরা,আচার-আচরণ দেখে মানুষ অবাক হতে বাধ্য।

অল্প কিছু খেয়ে এনজাম বিদায় নিলো। গ্যারেজে এলো গাড়ি নিতে। প্রজ্ঞার সঙ্গে এই সময়ের মাঝে আর কোনো কথা হয়নি তার। এভাবেই তাকে এই বাড়িতে রেখে এর আগে শতবার চলে যেতে হয়েছে তাকে। প্রতিবার প্রেয়সীর মায়াবী চোখজোড়াকে অগ্রাহ্য করতে হয়েছে। এবারেও সেই চোখদুটো দেখার লোভ জাগলো মনে। কী বুঝেই যেন পিছু ঘুরলো সে। প্রজ্ঞাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনেমনে ভীষন আনন্দ পেলো।

প্রজ্ঞা ধীর পায়ে অনেকটা এগিয়ে এলো। এনজাম তার নিচু দৃষ্টি লক্ষ্য করে জানতে চায়,
– “কিছু বলবে?”

প্রজ্ঞা শক্ত মুখে তার পায়ের দিকেই চেয়ে রইলো। অনেকটা সময় পরে শান্ত কণ্ঠে বললো,
– “ক্যান আই হ্যাভ আ টাইট হাগ…প্লিজ?”

মনে হলো,প্রজ্ঞা নিজের দম আটকে রেখেছে। প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছে,তবে বলতে পারছেনা। এনজাম রাখলো তার কথা। নিজেও দু কদম এগিয়ে দৃঢ় বাধনে জড়িয়ে নিলো তাকে। মেয়েটার মাথা এসে ঠেকলো তার বুকে। ধীর হস্তে তার মসৃণ চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে বোঝালো,
– “ইট’স নট দি এন্ড… এত ভয় কীসের?”

প্রজ্ঞা বিপরীতে খামচে ধরলো তার শার্ট। বোধ হয় বলতে চাইলো,
– “ইট ফিলস লাইক দি এন্ড…সহ্য করা যায়না!”

মিনিট দুয়েক বাদে প্রজ্ঞা নিজে থেকে সরে এলো। তবে এনজাম ছাড়লো না। ঘাড়ের পিছনে হাত রেখে একটা দীর্ঘ চুমু খেলো তার কপালে। প্রজ্ঞা অমনি ভ্রুকুটি করে বললো,
– “শুধু জড়িয়ে ধরতে বলেছিলাম!”

বিরাট আবেগঘন মুহূর্তেও হেসে ফেললো এনজাম। দু-গালে হাত রেখে আরো একটা গভীর চুমু খেলো তার ঠোঁটে। বললো,
– “বাই ওয়ান গেট টু ফ্রি।”

দূরে সরে গিয়ে কোমড়ে হাত গুঁজল প্রজ্ঞা। চোখ-নাক কুঁচকে বললো,
– “এইজন্যই বলি, পুরুষ মাত্রই সুবিধাবাদী। দাঁড়াতে দিলে বসতে চায়… আবার বসতে দিলে শুতেও চায়!”

#চলবে