#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_১৯
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন
– “রাখো টাকাগুলো, চাইলে দিও।”
প্রজ্ঞা অবাক হয়ে টাকার বান্ডিলদুটোর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– “কীসের টাকা?”
এনজাম হেলান দিয়ে বিছানায় বসে বলে,
– “কীসের আবার… স্যালারির।”
– “তো এটা আমাকে দিচ্ছো কেন? তোমার টাকা, তুমি রাখো জায়গামতো।”
এনজাম ফোনের লক খুলে স্মিত হেসে বলে,
– “আমার আর কী…সব তো আপনারই। সংসার আপনার, আপনিই রাখুন।”
হয়তো এনজাম স্বাভাবিক ভাষ্যেই বলেছিলো কথাটা, তবে প্রজ্ঞার নিকট তা অযথাই অপমানের ঠেকলো। গম্ভীর মুখে তাকিয়ে শুধায়,
– “বলতে কী চাইছো?”
– “কী বলতে চাইবো?”
– “আমি কখনো বলেছি,স্যালারির টাকা এনে আমার হাতে দেবে? বলিনি তো। ইউ আর দ্যা হেড অফ আওয়ার ফ্যামিলি,আমি এটাই মানি। তাহলে এভাবে টাকা ছুড়ে বোঝাতে চাইছো টা কী? আমি টাকার জন্য তোমার কাছে এসে থাকছি?”
এনজাম প্রজ্ঞার কথা শুনে সোজা হয়ে বসলো। ভ্রুকুটি করে বললো,
– “সামান্য একটা কথাকে এত গভীরে নেওয়ার কী আছে? আর এসব কথা তোমার মাথায় আসে কী করে?”
– – –
– “প্রশ্নটা তো আমিও করতে পারি। ছোট একটা বিষয়, আপনি কেন ঘেটে ঘ বানাতে গেলেন?”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে প্রজ্ঞা। চোখ নামিয়ে শুধায়,
– “মানসিকভাবে ঠিক ছিলাম না তখন। আমি যখন ওর সঙ্গে একই ফ্ল্যাটে থাকা শুরু করি, তার মাসখানেক বাদেই ওর বোন আসে পাশের ফ্ল্যাটে। স্যার… আই কান্ট এক্সপ্লেইন,কীসব কথা শুনতে হয়েছে আমাকে! উঠতে বসতে সামনে পেলেই ওর বোন কথা শোনাতো আমায়। ইচ্ছে করে একজন বাবাকে ছেলের থেকে দূরে রেখেছি, আমার জন্য তার ভাই দিনরাত মেহনত করেছে। আমার জন্য তার বাবা মা-কে অপমানিত হতে হয়েছে…আরো কত্ত কী! আমি জাস্ট বিরক্ত ছিলাম এসব নিয়ে। একসময় মনে হচ্ছিলো আসলেই সব দোষ আমার।”
শাফায়াত একটু অবাক হয়ে জানতে চায়,
– “তার বোন?”
– “বড় বোন।”
শাফায়াতের মনে পড়লো, এনজাম এর একটা বড় বোনও আছে। দু হাতের আঙুল এক করে সে বললো,
– “আপনার স্বামীকে বলেছিলেন এসব?”
– “উঁহু। আর যাই হোক, শশুর বাড়ির কারো নামে সেভাবে বদনাম করতে চাইনি। আই থট দ্যাট ও বুঝবে আমার দিকটা। অথচ নিজেও তাচ্ছিল্য করে বলেছিলো, ‘তুমি না-ই আসতে পারো, কিন্তু তোমার মা তো তাই দেখেই পাঠিয়েছে। নাহলে দেখতে দুদিনের মধ্যেই চলে আসতো ফিরিয়ে নিয়ে যেতে’।
এটা শুনতে কী আমার খুব ভালো লেগেছে? একেতো ওর বোন রোজ কথা শুনিয়েছে। তার উপর ও নিজেও… আমি কী করে সহ্য করবো এগুলো?”
– “উঁহু,পারবেননা। তাহলে একবার ভেবে দেখুন, যেই ছেলেটা প্রায় পাঁচটা বছর ধরে আপনাকে পাওয়ার চেষ্টা করে গেলো, আপনারই মুখে তার অন্যরকম কথা শুনতে কেমন লেগেছিলো?”
মুখটা চুপসে যায় প্রজ্ঞার। সহসাই চোখদুটো বুজে ফেললো সে। শাফায়াত গালে হাত ঠেকিয়ে বললো,
– “আপনাদের আসলে বুঝতে পারিনা আমি। প্রথম দেখায় কেউ ধারণাও করতে পারবেনা আপনাদের সম্পর্কের যে এতএত দিক! আমি আজও ধরতে পারলাম না, প্রেমের বিয়ের ক্ষেত্রেও স্বামী-স্ত্রীর মাঝে এত প্রখর ভুল-বোঝাবুঝি হয় কী করে? যেখানে আপনারা একে অপরকে জানেন।”
– “জানার কোনো শেষ নেই স্যার। একটা মানুষকেই আপনি অনেকভাবে খুঁজে পাবেন, যার একটা রূপের সঙ্গে অন্য রূপ মিলবেনা।
যেমন ধরুন আমার যখন এনজামের সঙ্গে প্রথম আলাপ, আলাপ বলতে কেবল নবীন বরণে দেখা হয়েছে। প্রচণ্ড ভদ্রসভ্য একটা ছেলে,মনে হতো পড়াশোনার প্রতি খুব সিরিয়াস,মিশুক নয় একদমই। তারপর ধীরেধীরে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি জানতে শুরু করলাম। একটা সময়ে গিয়ে আর তার বন্ধু কিংবা জুনিয়র রইলাম না। সবার চেয়ে আলাদা জায়গায় চলে গেলাম। অন্যদের সঙ্গে তার ব্যবহার আর আমার সঙ্গে তার ব্যবহার এক ছিলোনা।
আর তারপর এলো এই স্বামী-স্ত্রীর খেতাব। পুরো জগতের কাছে সে একরকম, আর আমার কাছে অন্যরকম। ভেবে দেখুন, প্রায় পাঁচবছর আমরা রেজিস্ট্রি পেপার সমেত প্রেম করেছি!”
একটু হাসে প্রজ্ঞা। ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,
– “এরপর তার প্রকৃত স্ত্রী হওয়ার ভাগ্য হলো। তখন মনে হলো, এত চেনা মানুষটাকেও আমার চেনা বাকি! এতদিন সর্বক্ষন তার সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও রোজ তাকে দেখতে পাইনি। আর যখন রোজ সকালে চোখ খুলে তার দর্শন পাওয়ার সৌভাগ্য হলো, তখন ধীরেধীরে আগের কষ্টগুলো হারিয়ে গেলো। ঠিক কী হলো, কেন হলো এটাই আমি বুঝতে পারিনা।”
– “আপনাদের সম্পর্কের ধাপ অনেকগুলো। চাইলে একটা বই লিখে ফেলতে পারেন।”
– “ধাপ? হ্যা,তা ঠিক। আমাদের সম্পর্ক সাইকেল,বাইক,গাড়ি তিনটে ধাপে ভাগ করতে পারেন।”
– “হু?”
ভ্রু কুঁচকে বললো শাফায়াত। প্রজ্ঞা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বলে,
– “সর্বপ্রথম আমি ভালোবেসেছিলাম এক বেকার ছেলেকে। তার কালো রঙের সাইকেলটাতে করে কলেজের পাশের দুটো গলিই ঘুড়েছি শুধু। আবার ঐ সাইকেলে করেই ভোরবেলা বাড়ি থেকে পালিয়েছি।
বছর ঘুরতে আমার প্রণয় এলো। তারও প্রায় এক বছর পর একটা বাইক এলো। সেই বাইকে করে তিনটে বছর পুরো শহর চষে বেরিয়েছি। যাকে বলে লিগ্যাল প্রেম। ধরা পড়ে যাবার চিন্তাই নেই!”
দুজনেই হেসে উঠলো একসঙ্গে। প্রজ্ঞা খানিক বাদে হাসি থামিয়ে বললো,
– “আল্লাহর ইচ্ছেতে ওর জীবনে সফলতা এলো। খুব দ্রুত প্রমোশন পেলো,স্যালারি বাড়লো। আমি ওর কাছে চলে আসার প্রায় ছয় মাস বাদে একটা গাড়ি যুক্ত হলো গ্যারেজে। বাইকটা পরে রইলো এক কোণায়।
অ্যান্ড নাও আই ফিল দ্যাট, আমাদের ঐ সাইকেল আর বাইকের সময়টা না অনেক সুখের ছিলো। রেস্টুরেন্ট এ না গিয়ে রাস্তার ফুড ফার্ট এর পাশে বসে গল্প করার মুহূর্তটাই ভিন্ন ছিলো।
জানেন ভাইয়া,কত স্বপ্ন দেখতাম আমরা! সাধারণ একটা সুতির শাড়ি উপহার দিয়ে খুব বড় গলায় বলেছিলো সে, আল্লাহর ইচ্ছে থাকলে একদিন দোকানের সবচেয়ে দামি শাড়িটাও আমি কিনে দেবো তোমায়।
সরি…ভাইয়া বললাম।”
শাফায়াত একদৃষ্টে চেয়ে বললো,
– “বলতে পারেন,সমস্যা নেই। আমি আপনার ভাইয়ের ই মতো।”
কৃতজ্ঞতা স্বরূপ মুচকি হাসলো প্রজ্ঞা। ভাইব্রেশন এ থাকা ফোনটা বেজে উঠতেই সেদিকে তাকালো সে। ‘Better half’ নামটা দেখে একবার তাকালো শাফায়াতের পানে। ‘এক মিনিট’ বলে ফোনটা তুলেই বললো,
– “একটু বেরিয়েছি আমি। প্রণয় বাড়িতে। আম্মুর নম্বরে কল দাও, আর নাহয় আমি বাড়িতে গিয়ে করবো।”
– “আচ্ছা।”
এনজামই কেটে দিলো কলটা। গত দুদিনে তাদের মাঝে এই দু তিন শব্দ ব্যতীত আর কোনো কথা হয়নি। এনজাম কল করে,প্রণয়ের সঙ্গেই কথা বলে। আবার প্রণয় মাঝেমধ্যে কল করে। অর্থাৎ কথাটা বাবা-ছেলের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে। প্রজ্ঞার সঙ্গে তেমনভাবে কথা বলা হয়নি। এটাও স্বেচ্ছায় বলা চলে।
শাফায়াত ফোনের দিকে তাকিয়ে জানতে চায়,
– “আপনার মিস্টার?”
মাথা নাড়লো প্রজ্ঞা। শাফায়াত গলা খাঁকড়ি দিয়ে রসিকতার ছলেই বলে,
– “সালাম কালাম দিয়ে কথা বলুন। আল্লাহর রহমত বর্ষিত হবে।”
একটু লজ্জাই পেলো প্রজ্ঞা। শাফায়াত খানিকটা গম্ভীর হয়ে বলে,
– “একেবারে মজার কথা নয় কিন্তু। হতেই পারে তিনি আপনাদের উপর অসন্তুষ্ট।”
প্রজ্ঞা চকিত চোখে তাকায়। শাফায়াত মৃদু হেসে বলে,
– “নিজে ভেবে দেখুন তো, সম্পর্কের শুরু থেকে আপনাদের সামনে কোনো বড় বাঁধা এসেছে? আসেনি কিন্তু। আর এলেও তা আপনারা উতরে আসতে পেরেছেন। উপরওয়ালা না চাইলে কিন্তু সবকিছু এত সহজ হতোনা।
হতেই পারতো, এতদিনের দূরত্বে আপনাদের মাঝে ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি। কিংবা মিস্টার খান এর ক্যারিয়ার এত তাড়াতাড়ি নাও গড়তে পারতো। অনেক কিছু হতে পারতো…কিন্তু হয়নি।
তবে হলো কখন, যখন এতদিনের ইচ্ছে পূরণ হলো। আল্লাহ কী আপনাদের উপর অসন্তুষ্ট হতে পারেন না ম্যাডাম?”
পুনরায় চোখ নামিয়ে নেয় প্রজ্ঞা। শাফায়াত কিছুক্ষন চুপ থেকে আরো বলে,
– “আমার কাছে সমাধান চাইতে এসেছেন, ভালো কথা। তবে সাহায্য টা উপরওয়ালার কাছেও চাইতে পারেন। আফটার অল, সবটা তারই হাতে।
ভাই যখন বলেছেন, তখন কথাটা ভাই হিসেবেই বলছি। সম্পর্ক খারাপ হবার একটা বৃহৎ কারণ আমার কাছে, সৃষ্টিকর্তার উপর কৃতজ্ঞ না থাকা। তিনি আপনাদের এতকিছু দিয়েছেন, এমন ফুটফুটে একটা সন্তান অবধি দিয়েছেন। তবুও আপনারা নিজেদের মধ্যকার সমস্যাগুলো কেন মেটাতে পারছেননা?
জানেন তো, আল্লাহ মাঝেসাঝে আমাদের পরীক্ষা নেন। কার সম্পর্কের জোর কতটা, এটাও বোঝানোর চেষ্টা করেন। তাই বলবো, মনের কথা আর কাউকে না বলতে পারলে তাকেই বলুন।”
শাফায়াত ঘড়িতে সময় দেখে জানতে চায়,
– “আলাদা থাকছেন নাকি?”
– “হুম।”
– “গুড ডিসিশন। যদিও উকিল হিসেবে বলা উচিৎ, একসঙ্গে থাকুন। তবে মানুষ হিসেবে পরামর্শ দেই, দূরে যখন আছেন, কথাবার্তাও কমিয়ে বলুন। এতে যদি নিজেদের প্রয়োজনটা বুঝতে পারেন।”
– “প্রয়োজন বোঝার বদলে যদি দূরত্বে অভ্যস্ত হয়ে যাই?”
কণ্ঠে তার ভয় স্পষ্ট। শাফায়াত টেবিলে হাত রেখে মৃদু হেসে বললো,
– “আপনাদের ভালোবাসা হেরে গেলে,ভালোবাসা শব্দটার উপর থেকে কিঞ্চিৎ বিশ্বাসটুকু উঠে যাবে আমার।”
– – –
বাসায় ফিরে গোসল সেরে এনজাম ফোন নিয়ে বসলো আটটার পর। গত দুদিনে ব্যাচেলর জীবন মোটামোটি ভালোই উপভোগ করছে সে। বোন আগেই বলে দিয়েছে,রান্নাঘরে ভুলেও যাবিনা। তাই রান্না নিয়ে তার চিন্তা নেই। তবে রাতের বেলা মশারি টাঙাতে বড্ড কষ্ট হয়। আর যাই হোক,প্রজ্ঞা তাকে দিয়ে এই কাজটা করায়নি কখনো। সে যাওয়ার পর থেকে বুঝি মশার উপদ্রব ও বেড়ে গেছে।
আরো একটা ব্যাপার, মাঝরাতে বিছানায় নিজের পাশের খালি জায়গাটার দিকে তাকিয়ে একটু আকটু খারাপ লাগে। প্রজ্ঞা ঘুমোয় একদম হাত পা ছড়িয়ে। এই বদঅভ্যাস এর কারণেও তাকে সবসময় জাপটে জড়িয়ে ধরে ঘুমায় সে, তখন একদম শান্ত বিড়ালছানা হয়ে থাকে।
ফোন হাতে নিয়ে সর্বপ্রথম প্রজ্ঞাকেই কল করলো এনজাম, প্রণয়ের সঙ্গে কথা বলার উদ্দেশ্যে। ফোনটা তুললোও সে। কানে ধরেই বললো,
– “হ্যালো বাবা!”
– “ইয়েস বাবা… কী করছো?”
– “আমিতো টিভি দেখছি। তুমি কী করছো?”
– “আমিও টিভিই দেখছি।”
একটু সময় থেমে প্রণয় জানতে চায়,
– “তুমি কী বাসায় এসেছো?”
– “হ্যা,এসেছি তো।”
আবারো থেমে রয় প্রণয়। কয়েক সেকেন্ড বাদে বলে,
– “তুমি কি কিছু খেয়েছো?”
এনজাম ভ্রু কুঁচকালো। কিছু ভেবে জিজ্ঞেস করলো,
– “বাবাই, তোমায় কী কেউ কিছু শিখিয়ে দিচ্ছে?”
প্রণয় তার পাশে বসে থাকা মায়ের দিকে চোখ তুলে তাকালো। প্রজ্ঞা চোখ বড়বড় করে মাথা নাড়াতেই বললো,
– “নাহ, মাম্মা বলেছে কেউ শিখিয়ে দিচ্ছেনা।”
মুখটা প্যাঁচার মতো করে চোখ বুজে ফেললো প্রজ্ঞা। কাঁদোকাঁদো মুখ করে কপাল চাপড়ালো।
এনজাম নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকে রাখে। ফোনের স্পিকার এর জায়গাটা চেপে ধরে হেসেই ফেলে শব্দ করে। পরক্ষণেই তা কানে ধরে বলে,
– “এখনো কিছু খাইনি বাবাই। কিন্তু কফি বানিয়ে খেয়ে নেবো। তুমি খেয়েছো কিছু?”
– “হ্যা,নানু তো মিষ্টি বানিয়েছে আমার জন্য। আরো পিঠাও বানিয়েছে।”
বাবা-ছেলের গল্প শেষ হলো গুনেগুনে পাঁচমিনিট বাদে। প্রণয় ফোনটা কেটে মায়ের দিকে তাকালো। তার গোমড়া মুখ দেখে হতাশ কণ্ঠে বললো,
– “মাম্মা,আমি কী কিছু করেছি?”
প্রজ্ঞা ছেলের কথায় হেসে ফেললো। মাথা নেড়ে বললো,
– “উঁহু,সোনা। আমার ভুল। এক বলদের ছেলেও যে আরেক বলদ, সেটা বুঝতে পারিনি। সরি…”
প্রণয় বুঝলোই না মায়ের কথা। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইলো। প্রজ্ঞা এসে তার ফোলাফোলা গালে দুটো চুমু খেয়ে ফোনটা নিয়ে বিছানায় বসলো।
সকাল থেকে পাঁচবছর আগের একটা মেমোরি ফেইসবুক নিউজফিডে দেখাচ্ছে। এই ফেইসবুক টাও না! কেমন আবেগঘন মুহূর্তের স্মৃতিচারণ করিয়ে দেয়।
ব্যাপার সেটা নয়। এই একটা পোস্ট এনজাম প্রতিবছর শেয়ার করে নিজের আইডিতে। এ বছর এখন অবধি করেনি। তার ফিডে এ অবধি শতবার ঘুড়ে এসেছে প্রজ্ঞা, এই একটা পোস্ট এর আশায়। প্রতিবার আশাহত হওয়ার পরও পুনরায় সে ঢুকলো আইডিতে। নাহ,কোনো পোস্ট নেই। এবার গা-ছাড়া ভঙ্গিতেই একবার রিফ্রেশ করলো। তবে আঙুল চালিয়ে একটু নিচে যেতেই মুখে হাসি ফুটলো তার। চোখটা চিকচিক করে উঠলো। পোস্টটা মাত্রই শেয়ার দিয়ে লিখেছে এনজাম, “And it’s been 7 years… The first rose giving day…” শেষে একটা বিব্রতবোধ এর ইমোজি।
ছবিটা যখন তোলা হয়, প্রণয়ের বয়স সাত কী আটমাস হবে। ঘুমে ছিলো সে। তার বামহাত একটা ডায়েরীর উপর। ছোট্ট হাতটা ধরে রেখেছে এনজাম-প্রজ্ঞা। ডায়েরীর পাতার উপর একটা শুকনো গোলাপ। ভীষণ সুন্দর ছবিটির ক্যাপশনে লেখা,
– “Two years ago on this day, I gave her the first rose of our life.
And after two years, here we are…with the best rose ever she has given me.
Thank you dear…
And our heart, mamma and baba will always hold your little hand tightly like this, we promise you.”
প্রজ্ঞা উঠে গিয়ে নিজের টেবিল থেকে বের করলো সেই ডায়েরীটা। শুকনো গোলাপটা এখানেই থাকে। প্রণয়কে ডেকে এনে সেই আগের মতোই একটা ছবি তুললো সে,কেবল এনজামের হাতটা অনুপস্থিত।
সেই ছবিটিই পোস্ট দিয়ে লিখলো,
– “And here I am, with two special roses of my life.”
#চলবে?
#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_২০
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন
টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে সম্পূর্ন পানিটুকু খেয়ে নিলো অ্যানি, অত:পর জড়সড় হয়ে চোখ নামিয়ে বসলো। চঞ্চল মেয়েটার চোখেমুখে ভয়ের ছাপ। শাফায়াত,প্রীতি একে অপরের দিকে তাকায় একনজর। শাফায়াত তাকে আত্মস্থ করে অ্যানির উদ্দেশ্যে বললো,
– “লিসেন, এত হাইপার হবার মতো কিছুই হয়নি। আমরা জাস্ট আপনার থেকে কিছু তথ্য জানতে চেয়েছি। আর আপনার ব্যবহারে নিশ্চিত হচ্ছি, আংশিক হলেও জানেন এই ব্যাপারে।”
অ্যানি মাথা নুইয়ে নিজের নির্বাক রূপ বজায় রাখলো। প্রীতি পাশে এসে তার কাঁধে হাত রেখে বলে,
– “চুপ করে থেকোনা অ্যানি। একটা মেয়ের জীবনের ব্যাপার। অ্যাসিড অ্যাটাক কোনো ছোটখাটো বিষয় নয়। ফিউচারেও একই ব্যক্তি ওর ক্ষতি করতে পারে। বুঝতে পারছো আমার কথা?”
অ্যানি চোখ তুলে বললো,
– “আমি বুঝতে পারছি আপু। কিন্তু এসব ইস্যু তে বড্ড ভয় করে আমার।”
শাফায়াত তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো,
– “ভয়টাকে আকাশে উড়িয়ে দিন কিছুদিনের জন্য। উই জাস্ট নিড ইয়োর হেল্প। যতটা খবর আমরা জানতে পেরেছি, সে বিষয়ে আমি নব্বই শতাংশ নিশ্চিত। আপনাকে শুধু সাক্ষী দিতে হবে। দ্যাটস ইট।”
অ্যানি চোখ বড়বড় করে বললো,
– “ভাইয়া মানবেই না কখনো! আইনি ব্যাপারস্যাপার এ আমার চৌদ্দ গুষ্টির প্রচণ্ড ভয় উকিল সাহেব।”
প্রীতি তার পাশে বসলো। হাতটা ধরে বললো,
– “তাদের জানাচ্ছে কে? দেখো, আমি এনজাম ভাইকে চিনি। সো,তাকে বিষয়টা জানানোর কোনো প্রয়োজন নেই। আমি বলছি, কেউ কিচ্ছু বলবেনা তোমায়। জাস্ট একদিন কোর্টে সত্যটা বলতে হবে।”
অ্যানি একটু ভাবনায় পড়লো। শাফায়াত তার দিকে আরো একগ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বলে,
– “ভাবুন। একদিন সময় দিলাম। আপনাকে কিন্তু পুলিশও জিজ্ঞাসাবাদ এর জন্য ডাকতে পারে। তাই… ভালো হয় যদি স্বেচ্ছায় রাজি হয়ে যান। ভালো কাজে দ্বিমত করতে নেই।”
— — —
প্রণয় বাসায় থাকলে এনজামের দ্রুত বাড়ি ফেরার একটা তাড়া থাকে সবসময়। যতই ফুফি থাকুক পাশে, তবুও বাবা মায়ের মাঝে অন্তত একজন তার কাছে থাকাটা দরকার। যদিও সে এসে থেকে ছেলেকে নিয়ে টিভির সামনে বসে যায়। প্রণয় কী বোঝে জানা নেই, তবুও তাকিয়ে থাকে। তারপর খিদে পেলে দুই বাপ-ব্যাটা মাঝেসাঝে রান্নাঘরে যায়। এনজাম অমলেট বানায়, প্রণয় সিঙ্ক এর পাশে বসে দেখে। মনে হয় কত বিজ্ঞ সে রান্নার ব্যাপারে, দু তিনবছর পর তাদের চেয়ে ভালো রান্না শিখে যাবে!
প্রণয় নেই বলে বাড়ি ফেরার তাড়াটাও নেই আর। কোনো ভাবনা নেই। যেন একটা যন্ত্রমানব সে। ফিরছে, খাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে এই তো। কাজের চাপ না থাকলেও সে ইচ্ছে করে দেরিতে ফিরলো বাসায়। প্রায় আটটা বেজে গেছে তখন। ঘরে এসেই তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো। হাতমুখ ধুয়ে বের হওয়া মাত্রই দেখতে পেলো, বিছানার উপর মুখ গোমড়া করে বসে আছে টুশি। যেন এক্ষুনি কেঁদে দেবে! এনজাম ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে এসে কোলে তুললো তাকে। থুতনিটা ধরে শুধালো,
– “একি মামা! মন খারাপ কেন? আম্মু বকেছে?”
মাথা নাড়ে সে। এনজাম আরো একটু ভেবে জানতে চায়,
– “তাহলে কী বাবা বকেছে? খালামনি রাগ করেছে? আমি বকে দেবো ওকে,হুম?”
– “খালামনি বকে নি তো।”
– “তাহলে কী হয়েছে?”
টুশি ঠোঁট উল্টেই কান্না জুড়ে দিলো। চোখ ডলতে ডলতে বললো,
– “পন্নয় কবে আতবে?”
এনজাম তার চোখটা মুছিয়ে দিয়ে বলে,
– “এইতো কদিন বাদেই চলে আসবে। এইজন্য মন খারাপ তোমার?”
– “হ্যা! আমি কেলতে পারিনা!”
এনজাম তার ক্রন্দনরত মুখখানা দেখে হেসে ফেললো আনমনেই। এই মেয়েরাও যে এত্ত মিষ্টি হয়! বিশেষ করে বাচ্চারা। হাসুক,কাঁদুক যাই করুক না কেন, এদের দেখে মনটা ঠান্ডা হয়ে যাবেই। এমনিতেই তার মেয়ের ভীষন শখ। অন্যদিকে প্রজ্ঞার চাই ছেলে। তার গর্ভাবস্থার সময় এনজাম খুব আশা দেখিয়ে বলতো,
– “কোনো চিন্তাই কোরোনা। আল্লাহ তো যমজ ও দিয়ে দিতে পারেন! একটা ছেলে,একটা মেয়ে। উফফ প্রজ্ঞা! বাই এনি চান্স এমনটা হলে কেমন হয়?”
প্রজ্ঞা খুবই বিরক্ত হতো। এসব কথা তার বলা উচিৎ। সে বলবে, এনজাম শুনবে, আর মুচকি হাসবে। তা না… এই ছেলেই সারাদিন ভবিষ্যদ্বাণী করতে থাকে। যমজেই আটকে নেই সে, একদিন মাঝরাতে ফোন করে বললো, “আচ্ছা তিনটা বেবিও তো হতে পারে। দুটো মেয়ে একটা ছেলে। মেয়ে দুটোকে আমি কোলে নেবো,ছেলেটাকে তুমি রেখে দিও।”
প্রজ্ঞা বিরক্তিমিশ্রিত চিত্তে তার কথা শুনতো। মাঝেমাঝে ভাবতো, এই ছেলে এতো মেয়েলী টাইপ কেন? ওর মধ্যে কী কোনো সমস্যা আছে?
শেষ অবধি তাদের কোলজুরে এলো এক ছোট্ট ছেলে। একেবারে ছোটছোট হাত,পা,মুখ। মাথাভর্তি কালো মিচমিচে চুল। খুব কম বয়সে মা-বাবা হয়েছিলো তারা। একজনের তেইশ অন্যজনের উনিশ। তথাকথিত ‘ম্যাচিউরিটি’ বিষয়টা তখনো পুরোপুরি আসেনি তাদের মাঝে। অথচ তারা বুঝলো, তাদের কাঁধে অনেক দায়িত্ব। তারা একজনের বাবা-মা। কত গভীর একটা শব্দ!
আশ্চর্য হলো এনজাম। এই মুহূর্তগুলো তার ভাবা উচিৎ। মনে করা উচিৎ। এইযে এখনও,গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। নিশ্চুপ হয়ে যায় সে। ব্যক্ত করতে পারেনা নিজের অনুভূতিগুলো। প্রজ্ঞার নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশের বেলায় শব্দহারা হয়ে যায়।
প্রণয়ের জন্মের সময় মেয়েটার বয়স নেহাতই কম। তার উপর কিছু জটিলতার কারণে নির্দিষ্ট তারিখের বিশদিন আগের তার সি সেকশন করা হয়। রক্তশূন্যতা, শ্বাসকষ্ট, লো প্রেশার থেকে শুরু করে নানান সমস্যায় ভুগতে হয়েছে তাকে। সময়ের ব্যাবধানে সেসব ঠিক হয়ে গেলেও মেরুদন্ডের ব্যাথা একটা স্থায়ী সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
কিছুদিন পরপর এই মেরুদন্ডের ব্যাথায় কষ্ট পেতে হয়েছে তাকে। প্রেসক্রিপশন,ঔষধ সামনে নিয়ে শতবার দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়েছে।
এনজাম তার উপর রাগ করতো না। কখনো উঁচু গলায় কথা বলতোনা। তাকে খুব আদরে,আহ্লাদে রাখার চেষ্টা করতো। এইযে মেয়েটার কষ্টগুলো, এগুলো তো আর তাকে সহ্য করতে হয়নি। বাবা হিসেবে কিছুটা কষ্ট সে-ও পেতে পারতো। কিন্তু পায়নি। সৃষ্টিকর্তা তাকে আনন্দটুকুই দিয়েছেন।
গত দু বছর ধরে অনেকটাই সুস্থ প্রজ্ঞা। মেরুদণ্ডে আগের মতো ব্যাথা হয়না। মাঝেসাঝে হলেও তা সহ্যাতীত নয়। তার যত্ন নেওয়ার মাত্রা কী এই কারণেই কমে গেছে?
– “মামা বলো, কবে আতবে ভাইয়া?”
খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চায় টুশি। মামি,আম্মু,খালামনি সবসময় বলে, প্রণয়কে ভাইয়া বলতে। বড়দের সম্মান করতে হয়। তাই বোধ হয় সে সম্মান দেখিয়ে বলেছে, যেন খেলার সঙ্গী জলদি ফিরে আসে।
এনজাম তাকে নিয়েই বসলো বিছানায়। কোলের মাঝে বসিয়ে তার গালে নাক ঘষে বললো,
– “আমরা কিন্তু একটা কাজ করতে পারি।”
– “কী কাজ?”
– “প্রণয়ের সঙ্গে একদিন টুক করে গিয়ে দেখা করে আসতে পারি। কী,যাবি আমার সাথে?”
– “হ্যা, দাবো দাবো। আম্মুকে বলো।”
পর্দা সরিয়ে ঘরে উঁকি দিলো অ্যানি। ফিঁক করে হেসে বললো,
– “আম্মুকে কী বলা হচ্ছে?”
টুশি মুখে হাত চেপে হাসলো। মাথা নাড়িয়ে বললো,
– “বলবোনা। তুমাকে নিবোনা! আমি আল মামা যাবো!”
অ্যানি বিছানায় এসে বসলো। জিজ্ঞেস করলো,
– “কোথায় যাবি?”
এনজাম উত্তর দেয়,
– “ঐতো,প্রণয়কে দেখে আসবো বলছিলাম।”
– “দেখে আসবি কেন? এক সপ্তাহ হতে চললো। এবার ফিরিয়ে নিয়ে আয়। ভাবী তো এতদিন বাপের বাড়ি থাকেনা কখনো।”
জহুরীর চোখে ভাইকে পরখ করলো অ্যানি। টুশির দিকে তাকিয়ে বললো,
– “আম্মু ডাকছে তোকে, জলদি যা।”
টুশি চটজলদি নেমে ছুটলো নিজের বাসার দিকে। এনজাম নড়েচড়ে বসলো একটু। অ্যানি গম্ভীর গলায় জানতে চাইলো,
– “হয়েছে টা কী বল তো। ভাবী সর্বোচ্চ পাঁচদিনের বেশি থাকার ই কথা না। যুদ্ধ করেও রাখা যায়না। সেখানে এতদিন? বিনা কারণে?”
– “তোর এত কী রে? মনে হচ্ছে সারাদিন ভাবীর লেজ ধরে ঘুরে বেড়াস।”
আর কথা বললোনা এনজাম। ফোন হাতে কাউকে কল করতে করতে বারান্দার দিকে চলে গেল। অ্যানিকে আপাতত ভাগানো দরকার।
– – –
রাত তখন অনেকটাই এগিয়েছে। প্রায় একটা বাজে। প্রণয় ঘুমিয়েছে তার নানুর সঙ্গে। ঘরে কেবল প্রীতি এবং প্রজ্ঞা। দুই বোন মিলে একটা কষ্টের মুভি দেখা শেষ করে কম্বল গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়লেও প্রীতি এত জলদি ঘুমোয় না। সে স্পিকারে মৃদু আওয়াজে গান বাজিয়ে রেখেছে,
– “আমি বুকটা পেতে আগলে রাখতে জানি,
তুমি এই বুকেতেই রাখবে মাথা মানি।”
প্রজ্ঞার দিনটাই কাটছে বিরক্তির মধ্য দিয়ে। দীর্ঘ সাতটা দিন মুখ থেকে কোনো আবোল তাবোল কথা বের করা হয়নি। মনে হচ্ছে, এক্ষুনি গিয়ে ঘণ্টাখানেক ঝগড়া করতে না পারলে তাকে বদহজম এর কারণে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
তার জন্য ফোন করাটা কোনো ব্যাপার ই না। চাইলেই ফোন করে কথা বলা শুরু করে দিতে পারে। কিন্তু এবারে সে খুব দৃঢ়ভাবে ভেবে রেখেছে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। অভ্যাস বদলাতে হবে কিছুটা। নিজের একটা আত্মসম্মান ধরে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
গানটা বন্ধ হলো কিছুক্ষন পরে। ফোন রেখে ঘুমানোর উদ্দেশ্যে চোখ বুজলো প্রীতি ও। প্রজ্ঞা চেয়ে রইলো মাথার উপর থাকা স্থির ফ্যানটির দিকেই। কষ্ট হচ্ছে,নাকি রাগ হচ্ছে,নাকি বিরক্তি… কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখটা বোজামাত্রই বালিশের পাশে থাকা ফোনটা ভাইব্রেট হলো। তড়িৎবেগে চোখ খুললো প্রজ্ঞা। উঠে বসে দ্রুত ফোনটা সামনে নিয়ে এলো। কিছুটা অবাক হলো। রাত একটা বাইশ বাজে, এমন সময় এনজাম কেন কল করবে? সে তো এতোও ভালো মানুষ নয় যে মাঝরাতে ফোন করে বলবে, “তোমায় ছাড়া ঘুম আসছেনা বউ।”
তাহলে কেন কল করছে? সে ঠিক আছে তো?
#চলবে?
#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_২১
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন
প্রজ্ঞা কিছুটা আতঙ্কিত চিত্তে কল রিসিভ করলো। অপর প্রান্ত হতে তখন শান্ত গলায় বললো এনজাম,
– “হ্যালো…”
তার কণ্ঠ শুনে হাফ ছাড়লো প্রজ্ঞা। যাক, ঠিক আছে তাহলে। পরমুহূর্তেই তার মধ্যকার মেয়েলী সত্ত্বা অভিমান করে বসলো, ঠিক অষ্টাদশী কিশোরীর ন্যায়। ফলস্বরূপ, গম্ভীর গলায় বললো,
– “প্রণয় ঘুমোচ্ছে। সকালে উঠলে আমি…”
– “প্রণয়ের মা-কে দরকার ছিলো। পাওয়া যায়?”
প্রজ্ঞা থমকালো কয়েক সেকেন্ড এর জন্য। ডাকটা এনজামের অতি প্রিয়। বিশেষ করে প্রণয়ের জন্মের পর সে অধিকাংশ সময় ‘প্রণয়ের মা’ বলে ডাকতো তাকে। রাতবিরেতে কল করে টেনে টেনে বলতো, “প্রণয়ের মা-কে পাওয়া যাবে?”
তবে এই ডাক প্রজ্ঞার মোটেই পছন্দ ছিলোনা। কেমন বয়স্ক মনে হয় নিজেদের। এই ডাক সে ব্যবহার করতে পারে ছেলে বিয়ে দেওয়ার পর। বৌমা, নাতি-নাত্নিদের সামনে বলতেই পারে। তবে এখন নয়।
প্রজ্ঞার নিকট হতে উত্তর না পেয়ে এনজাম শক্ত এক ঢোক গিললো। কথার স্বর একই রেখে বললো,
– “কেউ কী আছেন?”
প্রজ্ঞার ঘোর কাটে তার কণ্ঠ শুনে। পাশে ঘুমিয়ে তাকা প্রীতির দিকে একনজর চেয়ে উঠে দাঁড়ায়। চলে যায় বারান্দায়। ঠান্ডা বাতাসে হাত পা শিরশিরিয়ে ওঠে তার। খানিকক্ষণ বাদে উত্তর দেয়,
– “হুম। কী দরকার?”
এনজাম শোয়া থেকে উঠে বসলো। আগের ন্যায় টেনে টেনে বললো,
– “ফ্রুট কাস্টার্ড এর রেসিপিটা পাওয়া যায়?”
প্রজ্ঞা ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেললো তার কথায়। গম্ভীর গলায় বললো,
– “গুগলে সার্চ করা যায়?”
– “ধ্যাত! বউ থাকতে কেউ মামার কাছে যায় নাকি?”
– “মামা?”
– “ঐতো,গুগল আরকি।”
প্রজ্ঞা শব্দ করেই হেসে ফেললো এবার। এনজাম বিস্ময়তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। সব মেয়েরাই কী এমন দুটো বাক্যে আনন্দিত হয়ে যায়? কে জানে! প্রজ্ঞার ক্ষেত্রে তো তেমনই হয়। এ জীবনে তার রাগ একদিনের বেশি স্থায়ী হতে পারেনি। রেগে বোম হয়ে থাকবে, অথচ সে হাতটা ধরলেই গলে যাবে। এসব কী! এনজাম ভারী অসন্তুষ্ট ছিলো এই নিয়ে। তাকে বলতো,
‘এইযে তুমি নিজেকে খুব বুদ্ধিমতি দাবি করো,বড়দের মতো কথা বলো…তুমি কিন্তু বাস্তবে খুব বোকা। সেধে বন্ধু পাতাও না, অথচ কেউ দুটো মিষ্টি কথা বললেই গলায় গলায় ভাব। মানুষের প্রতি তুমি এত দূর্বল কেন হও প্রজ্ঞা?’
প্রজ্ঞা এতেও হাসতো। হাসিমাখা কণ্ঠে বলতো,
‘আমি এখনো বাচ্চা না? বড় হলে অনেক কঠিন হয়ে যাবো। কিন্তু হ্যা, তোমার ক্ষেত্রে একরকম ই থাকবো। তোমার তো শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ। এমন লক্ষ্মী বউ ক’জনের কপালে জোটে বলো তো?’
– “রাত ক’টা বাজে?”
হাসি থামিয়ে জানতে চাইলো প্রজ্ঞা। এনজাম ঘড়ির দিকে না তাকিয়েই জানায়,
– “টাইম দেখিনি…জানিনা।”
– “তো এতক্ষণ কী বসে বসে…”
থেমে যায় প্রজ্ঞা। লম্বা নিঃশ্বাস টেনে বোঝায় নিজেকে, ‘রাগা যাবেনা। নিজে থেকে ঝগড়া করা যাবেইনা।’ এনজামই আগ বাড়িয়েই বললো,
– “মশার কামড় খাচ্ছিলাম। শরীরের রক্ত তারাই খেলো। তাই এখন খিদে পেয়েছে। ফটাফট বলে দাও রেসিপি।”
প্রজ্ঞা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
– “এই রাতে তুমি আসলেই ফ্রুট কাস্টার্ড খাবে?”
– “হ্যা…তো কি মিথ্যে বলছি? হুদাই কল করতাম নাকি?”
এইযে, দিলো মুড এর বারোটা বাজিয়ে। আগ বাড়িয়ে দুটো কথা বাড়তি বলতে কে বলেছিলো তাকে? প্রজ্ঞা নিশ্চিত, এই ছেলের আজকাল তার হাসির সঙ্গে অ্যালার্জি তৈরি হয়েছে। তবুও স্বল্প রাগটুকু দমিয়ে রেখে সে তাড়া দিয়ে বললো,
– “রান্নাঘরে যাও।”
এনজাম উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করে বলে,
– “গেলাম।”
– “এবার ফ্রিজ থেকে দুধ বের করো। আর ফল বের করে আনো। সাথে একটু কাজু,কিসমিস নেবে। প্রথমে দুধটা জাল করে নাও। তারপর আরেকটা বাটিতে কাস্টার্ড পাউডার গুলিয়ে সেটা ধীরেধীরে দুধের মধ্যে দিয়ে দেবে। সাবধানে,যেন দলা না পাকে। তারপর…”
ধীরেধীরে সবকিছু বললো প্রজ্ঞা। প্রায় বিশমিনিট পর এনজাম বলে উঠলো,
– “ডান।”
প্রজ্ঞা সন্দেহের কণ্ঠে শুধায়,
– “তুমি আসলেই কাস্টার্ড বানিয়েছো? এই রাতে?”
– “ছবি তুলে পাঠাবো?”
– “নাহ,থাক।”
এনজাম বাটিটা নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ বাদে জিজ্ঞেস করলো,
– “ঘুমিয়ে ছিলে নাকি?”
প্রজ্ঞা চটজলদি জবাব দেয়,
– “হ্যা। তোমার জন্য ঘুম ভাঙলো।”
– “হ্যা হ্যা,জানা আছে। সকালে যে দশটার আগে উঠবেনা তাও জানি।”
– “ফোন রাখো তুমি।”
নিজে থেকেই সে কেটে দিলো কলটা। এনজাম ফোনটা পাশে রেখে কাস্টার্ড এর বাটিটা সামনে নিয়ে এলো। সময় নিয়ে ঠান্ডা করলো। তবে আগ্রহের সহিত এক চামচ মুখে দিতেই চোখেমুখে হতাশার ছাপ পড়লো তার। প্রজ্ঞার চেয়ে দক্ষ রাঁধুনি দাবি করা সে আজ কাস্টার্ডে চিনিই দেয়নি। বাহ…কী সুন্দর!
প্রজ্ঞা বিছানায় গিয়ে বসে ছিলো আরো কিছুক্ষন। একটু আকটু ঘুম পেতেই শুয়ে পড়লো বিছানায়। প্রায় ঘুমিয়েই গিয়েছিলো। তখনই হঠাৎ মনে পড়লো, এনজাম তো কাস্টার্ড বানাতে জানে। তাকে কতবার বানাতে দেখেছে…নিজেও বানিয়েছে এক আধবার। তার মনেই ছিলোনা! কী সুন্দর বোকা বানিয়ে দিলো ছেলেটা!
— — —
মনের ভয়কে সত্যিসত্যি আকাশে উড়িয়ে সেদিন কোর্টে সাক্ষীটা অ্যানি ই দিলো। তাও আবার নিজেরই খুব কাছের বন্ধুর বিরুদ্ধে। অ্যাসিড অ্যাটাক এর স্বিকার হওয়া মেয়েটার নাম আহিয়া। খুব সুন্দরী মেয়ে হওয়ায় অনেক ছেলেরাই তাকে পছন্দ করতো। প্রেমের প্রস্তাব দিতো। সে অবশ্য কিছুতে রাজি হয়নি।
অ্যানির খুব কাছের বন্ধু রুমি। আহিয়ার সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের অব্যাক্ত দ্বন্দ্ব। রুমির প্রেমিক তাকে সময় দিচ্ছেনা অনেকদিন যাবৎ। আহিয়ার পিছন পিছন ঘুরছে, তা ওর চোখে পড়ে। নিজের প্রেমিককে বলেছে, কান্নাকাটি অবধি করেছে। সে কিছু না বলে সরাসরি ব্রেকাপ করতে চাইলো। রুমির তখন প্রেমিকের বদলে সবটুকু রাগ গিয়ে জমলো আহিয়ার উপর। মনে হলো, এই মেয়েটার জন্যই প্রেমিক তাকে দূরে সরিয়েছে। একপ্রকার পাগল হয়ে উঠলো। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটিয়ে বসলো। যার ফল এখন ভুগতে হচ্ছে আহিয়াকে।
অ্যানি অবশ্য এতকিছু জানতোনা। সে কেবল নিজের জানা এবং সন্দেহটুকু ব্যক্ত করেছে। বাকিটা সামলে নিয়েছে শাফায়াত নিজেই। প্রীতি ছিলো তার সহকারী হিসেবে। কী দারুণ বিশ্লেষণ লোকটার! কেমন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে সব প্রমাণ এক করলো! প্রীতিও অবশ্য কম যায়না, যথেষ্ট সহায়তা করেছে।
রায়ের শেষে কোর্ট চত্ত্বরে দাঁড়িয়ে ছিল অ্যানি। চারিদিকটা ঘুরেঘুরে দেখছিলো। খানিকক্ষণ বাদে সেখানে উপস্থিত হলো শাফায়াত। কোর্ট অ্যাপ্রোনটা একহাতে নিয়ে অন্য হাত গুঁজল পকেটে। অ্যানির পাশে এসে হাসিমুখে বললো,
– “খুশি খুশি লাগছেনা এখন? খামোখা ভয় পাচ্ছিলেন।”
অ্যানি একটু চমকে পাশে তাকালো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
– “ওখানে দাঁড়িয়ে হাত-পা কাঁপছিলো আমার। আর দু মিনিট থাকলে নির্ঘাত সেন্সলেস হয়ে যেতাম। তার উপর অপোনেন্ট যেসব প্রশ্ন করছিলেন!”
শাফায়াত হেসে উঠলো। পাশে তাকিয়ে বললো,
– “আপনাকে দেখলেতো এতো ভীতু মনে হয়না। মনে হয় দুনিয়া বেচে খেতে পারবেন।”
– “ওমা…কী বলেন এসব! আমিতো রাস্তা পার হওয়াই শিখেছি এই দু তিন বছর হলো। ভাইয়ার কাছে কত্ত বকা যে খেয়েছি!”
শাফায়াতের হাসি প্রসারিত হলো। অ্যানির দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো,
– “বাট আফটার অল, থ্যাংক ইউ। না এলে একটু ঝামেলা হয়ে যেত।”
অ্যানি মুচকি হেসে তার ধন্যবাদ গ্রহণ করলো।
কোনো এক সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলে হাতে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে হাসতে হাসতে তাদের দিকেই আসছিলো প্রীতি। প্যাকেটটা খুলে হাতে একটা মিষ্টি তুলেই বলতে নিলো,
– “স্যার আপনার…”
অ্যানিকে দেখে একটু থামলো সে। বিশেষত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো শাফায়াতের দিকে। ঠোঁটে স্মিত হাসি রেখে মেয়েটির দিকেই তাকিয়ে ছিল সে। হুট করে প্রীতির ডাক শুনে চোখ সরালো। তাকে দেখেই এগিয়ে এসে বললো,
– “থামলে কেন? আমার কী?”
প্রীতি একটু বিব্রতবোধ করলো। হেসে উঠলো পুনরায়। হাতে থাকা মিষ্টির প্যাকেটটা শাফায়াতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
– “মেয়ের মামা দিলো। আপনাকে স্পেশাল ধন্যবাদ ও জানিয়েছেন। বলেছেন,এখন তারা একটু নিশ্চিন্তে বিদেশ যেতে পারবে। অ্যাটলিস্ট,অপরাধী শাস্তি তো পেলো।”
শাফায়াত একটা মিষ্টি তুললো। নিজের মুখে পুরে ইশারায় বোঝালো, ‘তুমিও খাও।”
প্রীতি অ্যানির দিকে চাইলো এবার। এগিয়ে এসে বললো,
– “তোমারও একটা ক্রেডিট আছে। নাও নাও, মিষ্টি খাও।”
অ্যানি মিষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে,
– “কিন্তু আমিতো মিষ্টি খাইনা আপি।”
শাফায়াত মুখে থাকা মিষ্টিটা শেষ করে বললো,
– “মিষ্টি খেলে ব্রেইন ভালো থাকে ম্যাডাম। ডাক্তার মানুষ, আপনার তো আরো বেশিবেশি মিষ্টি খাওয়া উচিৎ!”
অ্যানি তার কথায় একটা মিষ্টি ভেঙে মুখে দিলো। গালে রেখেই বললো,
– “আমি এখনো ডাক্তার হইনি। আরো তিন চারবছর লাগবে।”
– “তাতে কী? আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে চারবছর পরে তো হবেন ই ইন-শা-আল্লাহ। ঐতো,ফিউচার ডক্টর। একই কথা।
কী হলো প্রীতিলতা? তুমিও কী মিষ্টি খাওয়া বাদ দিয়েছো নাকি?”
প্রীতির উদ্দেশ্যে বললো সে। অ্যানি তার সম্মোধন শুনে হেসে উঠলো,
– “প্রীতিলতা?”
– “হ্যা…মিস প্রীতিলতা চৌধুরী। ঠিক না?”
স্বভাবতই ভ্রু কুঁচকালো প্রীতি। পরক্ষণে মৃদু হেসে অর্ধেকটা মিষ্টি মুখে দিলো। আঙুল উঁচিয়ে বললো,
– “অনলি প্রীতি!”
#চলবে?