নারকেল ফুলের মালা পর্ব-০১

0
7

সূচনা পর্ব
#নারকেল_ফুলের_মালা
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল

আপুরা, একটা ব্যাপার শেয়ার করি। আমার স্বামী ইদানিং তার মামাতো ভাইয়ের সাথে পাশের ঘরে ঘুমায়। আমার কাছে ঘুমতে বললেই রেগে যায়। কুৎসিত ধরনের কথা বলে। ব্যাপারটা নিয়ে আমি খুব চিন্তায় আছি। তাকে জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলে না। এড়িয়ে যায়। এই নিয়ে দিন দিন ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছি। আসলে আমার কী করা উচিত?

ওর মামাতো ভাই আগে আমাদের বাড়িতে থাকত না। সপ্তাহ দুয়েক আগে সে নিজে গিয়ে নিয়ে এসেছে। মামিকে বলে এসেছে– সুমন এখন থেকে আমাদের বাড়িতে থাকবে। ওকে এখানকার ভালো কোন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবে। মামিরা গ্রামে থাকে। সেখানে পড়াশোনার তেমন সুবিধা নেই। অনেক হেঁটে তারপর একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দেখা মেলে। সেই স্কুলের অবস্থাও করুণ। টিনের চাল ভেঙে ভেঙে পড়ছে। সুমন এখানে আসার পর থেকে এই সমস্যা শুরু হয়েছে। এমন নয় যে সুমন এই প্রথম আমাদের বাড়িতে এসেছে৷ এর আগেও এসেছে। তবে তখন সে একাই ঘুমত।

আরও একটা কথা বলি, আমার স্বামীর কোন ভাইবোন নেই। সেই হিসেবে সে তার মামাতো ভাই-বোনদের খুব ভালোবাসে। আদর করে। কিন্তু এই ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে। সুমন যদি বাচ্চা ছেলে হতো তাহলে হয়তো এতটা অস্বস্তি হতো না। কিন্তু তার যথেষ্ট বয়স আছে। এ বছর ক্লাস ফাইভে উঠেছে। মামাবাড়িতেও সে একাই ঘুমত। সবচেয়ে বেশি অস্বস্তি ওই আওয়াজ। আমি কী আপনাদের বোঝাতে পারছি? এখন আপনারাই বলুন আমার কী করা উচিত। কী করব আমি? আমার স্বামী কোন মতেই এই নিয়ে কিছু বলতে চাইছে না। অনেকবার জিজ্ঞেস করায় ভীষণ রেগে আছে। শেষবার তো গায়ে হাত তুলতে গিয়েছিল। শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছে।

পোস্ট করার কয়েক মুহুর্ত পর তিন্নি মোবাইলের ইন্টারনেট কানেকশন বন্ধ করে দিলো। কোন কিছুতে তার সংশয় কাটছে না। কেমন যেন ভয়ভয় করছে। পোস্ট দেওয়া নিয়েও সে খুব একটা সন্তুষ্ট নয়। বারবার মনে হচ্ছে পোস্ট ডিলিট করে দেবে। কিন্তু সে তেমন কিছু করল না। ফোন চার্জে বসিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল।

সরিফা বেগম চুলায় গরম পানি বসিয়েছেন। পানিতে বলক চলে এসেছে। হাঁড়ি থেকে বাষ্প উঠছে। তিন্নি তার শাশুড়ির গা ঘেঁষে দাঁড়াল। নরম গলায় বলল, “পানি দিয়ে কী করবেন আম্মা?”

সরিফা বেগম তার কথার জবাব দিলেন না। পানির দিকে তাকিয়ে রইলেন।

বেলা পড়ে এসেছে। বিকেলের সময় কিন্তু চারদিক দেখে মনে হয় সন্ধ্যা নামতে খুব বেশি সময় বাকি নেই। আকাশ ভর্তি কালো মেঘের সারি। থেমে থেমে শীতল বাতাস বইছে। তিন্নি আবারও কথা বলে উঠল। অন্যরকম গলায় বলল, “আম্মা, পানি তো গরম হয়ে গিয়েছে। এখনও জ্বাল করছেন কেন?”

সরিফা বেগম একটু নড়ে উঠলেন। ব্যস্ত গলায় বললেন, “তা-ই তো। ইসস রে! একদমই খেয়াল করে পারিনি।”

তিনি গ্যাস বন্ধ করে দিলেন। তিন্নি বলল, “পানি কী করবেন আম্মা?”

“হোসেন গরম করে রাখতে বলেছিল।”

“ফ্লাক্স এনে দেবো?”

“ফ্লাক্সে রাখব না। এখানেই থাকুক। পরে আবার জ্বাল করে দেব।”

তিন্নি তার কথা বুঝল না। তবে কোন প্রশ্নও করল না। চুপচাপ নিজের কাজে চলে গেল। তিন্নি বিয়ে হয়েছে ছয় মাসের বেশি সাত মাসের কম। বিয়ের আগে হোসেনের সাথে তার কোন সম্পর্ক না থাকলেও পরিচয় ছিল। হোসেন তার কলেজের সিনিয়র, শিক্ষকও বলা যায়। পড়াশোনা শেষ করে সেই কলেজেই অধ্যাপনা করে। পার্মানেন্ট চাকরি নয়। খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে যোগ দিয়েছে। তবে বেতন ভালো। কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের টিউশনি পড়ানোর সুযোগ আছে। ব্যাচেই পড়ায়। এক সাবজেক্ট সপ্তাহে তিন দিন সাতশ টাকা। সীট বিক্রির ব্যবসাও আছে। সব মিলিয়ে মাসের রোজগার লাখের উপরে।

সেদিন তিন্নি তার ক্লাসে বসে ছিল। বান্ধবীদের সাথে কথাবার্তা বলছে। হঠাৎই সে তার বিয়ের প্রসঙ্গ তুলল। অন্যরকম গলায় বলল, “জানিস, গতকাল আমাকে দেখতে এসেছিল। ছেলে দেখতে শুনতে ভালো। তবে খুব লাজুক। একবারের জন্যও আমার দিকে তাকায়নি। দু’জনে আলাদা কথা বলেছিলাম। তখনও তেমন কিছু বলল না। শুধু বলল– আপনার গালের তিলটা খুব সুন্দর। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। এই ছেলে বলে কী? আমার গালে তো কোন তিল নেই।”

তিন্নির বান্ধবীরা তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে উৎসুক চোখে তাদের দিকে এক পলক তাকালো। মাথা দুলিয়ে বলল, “আমি তো ভীষণ অবাক। বিস্মিত গলায়ই কথাটা বললাম। বললাম– আমার গালে তো কোন তিল নেই। সে বলল– আছে। খুব ভালো করে দেখলে খুঁজে পাবেন।

কথা মধ্যে এতটুকুই। উনারা চলে যাওয়ার পর আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজের চেহারা দেখতে লাগলাম। সত্যিই তো! আমার ডান গালে ছোট্ট একটা তিল ফুটছে। কুচকুচে কালো রঙের না, লালচে ধরনের। খুব খেয়াল করে না দেখলে নজরে পড়ে না। আমি তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।”

“তাহলে তো সে তোকে বেশ মনযোগ দিয়েই দেখেছে কী বলিস তোরা?”

তারা সবাই হো হো করে হেসে উঠল। কেউ আলগোছে তিন্নির গায়ে ধাক্কা দিলো। চোখ টিপে মুচকি হাসল। তিন্নি লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল। নরম গলায় বলল, “কী যে বলসি না তোরা! আমি তো উনাকে আমাকে দিকে তাকাতেই দেখলাম না।”

মিষ্টি বলল, “দাওয়াত দিস কিন্তু। একা একা বিয়ে করে ফেলবি না।।”

তিন্নি কিছু বলবে তার আগে হোসেন তাদের ক্লাসে ঢুকল। ভ্রু কুঁচকে বলল, “কী নিয়ে আলোচনা হচ্ছে?”

মিষ্টি বলল, “স্যার, আমাদের তিন্নিকে দেখতে এসেছিল। খুব তাড়াতাড়ি ওর বিয়ে হয়ে যাবে। এইচএসসি পরীক্ষা আগেই হবে হয়তো।”

হোসেন আঁড়চোখে তিন্নির দিকে তাকাল। থমথমে গলায় বলল, “সত্যি নাকি?”

তিন্নি লজ্জিত মুখে মাথা দোলালো। হোসেন এক মুহুর্তের মধ্যে চোখমুখ স্বাভাবিক করে ফেলল। বোর্ডে লিখতে লিখতে বলল, “আজকে তোমাদের সারপ্রাইজ টেস্ট। বোর্ডে প্রশ্ন লিখে দিচ্ছি। খাতার পৃষ্ঠা ছিঁ’ড়ে উত্তর লিখবে। লেখা শেষে জমা দেবে। কেউ কারোটা দেখবে না।”

রসায়নের এই অধ্যায়ের কোন কিছুই তার জানা নেই। হাতে গোনা কয়েকদিন কলেজ কামাই করেছিল। সে কদিনের মধ্যেই স্যার এই অধ্যায় পড়িয়ে ফেলেছে। বাড়িতে পড়বে পড়বে করেও পড়া হয়নি। প্রশ্নের উত্তরে কী লিখবে সেসব কিছু তার মাথায় ঢুকছে না। সে চোরা চোখে স্যারের দিকে তাকাল। হোসেন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তিন্নি শুকনো ঢোক গিলল। গোটা ক্লাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে কড়া কথা শোনার চেয়ে কঠিন আর কিছুই নেই। তারপর আবার মিষ্টি স্যারকে তার বিয়ের ব্যাপারে বলে দিয়েছে। এখন কিছু হলে স্যার নিশ্চয়ই তার বিয়ের কথাটা তুলবে। তাচ্ছিল্যের সুরে বলবে– তোমাকে দিয়ে আর পড়াশোনা হবে না। বিয়েসাদী করে সংসার করো। ওটাই তোমার জন্য ভালো।

ছেলেগুলো ছেলেগুলো নিশ্চয়ই তার দিকে তাকিয়ে হাসবে। মেয়েগুলোও হাসবে। হয়তো ইসস! কী বি’শ্রী পরিস্থিতি। তিন্নি মুখ কালো করে ফেলল। কষ্টে তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে।

ক্লাস শেষ হওয়ার পাঁচ মিনিট আগে হোসেন সবার খাতা তুলল। পকেট থেকে স্ট্যাপলার বের করে যার যার খাতা আলাদা করে পিন করল। তিন্নি জমা দিলো সাদা খাতা। খাতা নেওয়ার সময় হোসেন তার দিকে তাকাল। তার দৃষ্টি শান্ত এবং গভীর। তিন্নি কাচুমাচু মুখ করে তাকিয়ে আছে। ভয়ে তার বলা শুকিয়ে যাচ্ছে। তবে হোসেন তিন্নিকে কিছু বলল না। খাতা গুছিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল।

সন্ধ্যা নেমে গেছে। ইলেক্ট্রিসিটি নেই। থেমে থেমে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। তিন্নি জানালার পাশে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশে কোন তারা নেই। কালো মেঘ গোটা আকাশকে ঢেকে ফেলেছে৷ তবে বিদঘুটে অন্ধকার করে ফেলতে পারেনি। খুব সামান্য হলেও আলো রয়ে গিয়েছে। থেমে থেমে শীতল বাতাস বইছে। মাজেদা বিবি দরজা ঠেলে ঘরের ভেতরে ঢুকলেন। তিনি ঢুকতেই বাতি জ্বলে উঠল। মাজেদা বিবি বললেন, “ঘর অন্ধকার করে রেখেছিস কেন?”

তিন্নি বোধহয় সামান্য একটু বিস্মিত হলো। অন্যরকম গলায় বলল, “ইলেক্ট্রিসিটি চলে গিয়েছিল না? কখন এসেছে?”

“অনেকক্ষণ আগে এসেছে। ওখানে বসে কী করছিস?”

“তেমন কিছু করছি না মা। আকাশ দেখছিলাম।”

“আর আকাশ দেখে কাজ নেই। তোর কলেজের স্যার এসেছে। রেডি হয়ে বসার ঘরে যা।”

“কোন স্যার এসেছে মা?”

“হোসেন স্যার।”

ভয়ে তিন্নির গলা শুকিয়ে গেল। ভরসন্ধ্যায় এই ভদ্রলোক তাদের বাড়িতে কেন এসেছে? চা নাস্তায় খেয়ে গল্প করতে আসেনি নিশ্চয়ই। তাহলে কেন? পরীক্ষায় সাদা খাতা জমা দিয়ে এসেছে সেই ব্যাপারে নালিশ করতে নয় তো? এই স্যারকে কোন বিশ্বাস কোন বিশ্বাস নেই। সেবার ক্লাসের এক ছেলে পরীক্ষায় খারাপ করেছিল। সে তড়িঘড়ি করে ছেলের মা বাবাকে কলেজে ডাকল। নানান রকমের নালিশের ফর্দ হাতে ধরিয়ে বিদায় করল। বিদায়ের আগে বলল, ছেলে আপনার, হাঁড় আপনার। মাংস আর চামড়া আমার। সেই ছেলে তবুও দুই পেয়েছিল। তিন্নি তো তা-ও পাবে না। এক অক্ষরও লেখেনি। শুধু নিজের নাম রোল লিখে এসেছে। তা-ও ঠিকঠাক বোঝা যায় না। সে আবারও শুকনো ঢোক গিলল। ওড়নাটা কপাল পর্যন্ত টেনে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

বসার ঘর জমজমাট। হোসেন তার সাথে আরও দু’জন লোক নিয়ে এসেছে। এই দু’জন লোককে তিন্নি চেনে না। সে বিস্মিত চোখে লোকদের দিকে তাকাল। তারপরই চোখ ফিরিয়ে নিলো। মহিবুল সাহেব বললেন, “সালাম দে।”

“আসসালামু আলাইকুম স্যার।”

সে হড়বড় করে সালাম দিলো। তবে হোসেন সালামের জবাব দিলো না। জবাব দিলো বাকি দু’জন। মহিবুল সাহেব বললেন, “আচ্ছা। তোর মায়ের কাছে যা। রান্নাঘরে গিয়ে দেখ কতদূর কী হলো।”

সে রান্নাঘরে চলে গেল। আশ্চর্য গলায় বলল, “এসব আয়োজন করছ কেন মা? উনারা কেন এসেছেন?”

মাজেদা বিবি তার কথা জবাব দিলেন না, হাসলেন। চায়ের কাপ সাজিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, “এগুলো উনাদের দিয়ে আয়।”

খাবারের ট্রে রেখে তিন্নি প্রায় চলেই যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা শুনে থমকে দাঁড়াল। হোসেন অত্যন্ত স্পষ্ট গলায় বলল, “আমি তিন্নিকে বিয়ে করতে চাই।”

তিন্নির শরীর দুলে উঠল। সে কী ঠিক শুনছে? নিজেকে সামলে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল। যদি তার মা তাকে সবকিছু খুলে বলে। মাজেদা বিবি তাকে কিছু বললেন না। হেসে হেসে কাজ করতে লাগলেন।

হোসেনের প্রস্তাব দেওয়ার মাস খানেকের মাথায় তার সাথে তিন্নির বিয়ে হয়ে গেল। মহিবুল সাহেব নিজেই আগের বিয়ের কথাবার্তা ভেঙে দিলেন। হোসেনের তুলনায় সেই ছেলে কিছুই না। পড়াশোনা, সামজিক অবস্থান কোন কিছুতেই সে হোসেনের আশেপাশে নেই। অবশ্য আগের বিয়ে ভেঙে দেওয়ায় তিন্নির মন একটু খারাপ হয়েছিল। তবে তা খুব একটা গায়ে লাগল না। হোসেনকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

সারাটা দিন তিন্নির খুব খাটুনি গিয়েছে। সরিফা বেগম বালিশের তুলো রোদে দিয়েছিলেন। ঘরের যতগুলো বালিশ ছিল সবগুলোর তুলো রোদে দিয়েছিলেন। থেমে থেমে বৃষ্টি পড়েছে বিধায় বারবার করে তুলোগুলোকে ওঠানামা করাতে হয়েছে। দুপুরের রান্নায় ছ’পদের তরকারি রাঁধতে হয়েছে। এতকিছুর মধ্যে সরিফা বেগম তাকে কোন সাহায্য করেনি। বালিশের তুলো বের করে দিয়েই বিছানায় শুয়ে ছিলেন। তার কোমরে ব্যাথা করছিল। তিন্নির সব কাজ শেষ করতে সন্ধ্যা মিলিয়ে গেল। এখনো তার গোসল হয়নি, দুপুরে ভালো করে খেতেও পারেনি। সে কাপড়চোপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। তার সারা শরীর কুটকুট করছে। সময় নিয়ে গা ধুতে হবে।

তিন্নি সময় নিয়েই গোসল শেষ করল। মাথায় তোয়লে পেঁচিয়ে বিছানায় বসতেই তার সেই পোস্টের কথা মনে পড়ল। তড়িঘড়ি করে মোবাইল হাতে নিয়ে মন্তব্য দেখতে লাগাল। নানান ধরনের মন্তব্য। তবে বেশিরভাগ লোক লিখেছে– শা”লা কী স”ম”কা”মী নাকি? বউ রেখে কেউ কী মামাতো ভাইয়ের সাথে শোয় নাকি!

তিন্নির শরীর শিউরে উঠল। এ ধরনের মন্তব্যই বেশি। পঁচানব্বই শতাংশ লোক এই এক কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লিখেছে। সে আর ভাবতে পারল না। ফোন রেখে নিজের মাথা চেপে ধরল। শুকনো হাতে চোখমুখ ঢলে এদিক ওদিক তাকাতেই তার নজরে পড়ল ঘরে রাখা কুরআন শরিফের দিকে। তিন্নির বুক ধক করে উঠল। যদি এসব লোকের কথা সত্যি হয় তাহলে কী হবে? নিশ্চয়ই হোসেনের খুব বড় কোন শা’স্তি হবে। এটা যে খুব জ’ঘ’ন্য একটা পা’প। এই কারণে আল্লাহ গোটা একটা জাতিকে ধ্বং’স করে দিয়েছিলেন। হযরত লূত (আঃ)-এর জাতি। আল্লাহ্‌ তাদের উপর আসমান থেকে পাথরের বৃষ্টি ব’র্ষ’ণ করেন এবং তাদের নগরী উ’ল্টে দেন। এর ফলে তারা সম্পূর্ণ ধ্বং’স হয়ে যায়।

তিন্নি আর কিছু ভাবতে পারল না। তার হাত পা কাঁপছে। ঠিক সেই সময়েই হোসেন ঘরের ভেতর ঢুকল। ভ্রু কুঁচকে বলল, “কী হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন?”

তিন্নি হাসার চেষ্টা করল। মিনমিনে গলায় বলল, “কই কিছু না তো। সারাদিন অনেক কাজ করেছি। শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছে।”

“ওহ!”

হোসেন টেবিলের উপর মানিব্যাগ রাখল। ঘড়ি খুলতে খুলতে বাথরুমে ঢুকে গেল। তিন্নি কাঁপা হাতে পোস্ট ডিলিট করল। পাছে হোসেন এসব দেখে ফেললে। তবে তার ভয় কাটল না। বরং তার মনে বেশ জাঁকিয়েই বসল।

রাতে খাওয়া সময় আকরাম সাহেব বললেন, “তোর মামা কল দিয়েছিল। সুমনকে দু’দিনের জন্য পাঠিয়ে দিতে বলেছে।”

হোসেন খাওয়া থামিয়ে বাবার দিকে তাকাল। শক্ত গলায় বলল, “এই সময়ে সুমনের স্কুল ছুটি পাওয়া যাবে না। জোর করে ছুটি নিলে পড়াশোনায় পিছিয়ে যাবে।”

“সে জানি। তবে তোর মামা খুব জোর করছিল।”

“আমি মামাকে বুঝিয়ে বলব। এসব নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না।”

খাওয়ার সময়ে কেউ আর কোন কথা বলল না। সুমন নিজেও কিছু বলল না। বাবা বাড়ি যেতে বলেছে বলে তেমন উচ্ছাসও দেখাল না। শান্ত ভঙ্গিতে খেয়ে উঠে গেল।

তিন্নি বলল, “আজকে কী ঘরে ঘুমবে?”

হোসেন বাঁকা চোখে তিন্নির দিকে চাইল। খাটের উপরে রাখা তোয়ালেটা কাঁধের উপর ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যাওয়া সময় বলল, “দরজা লাগিয়ে দাও।”

তিন্নি কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। রাতে তার ঘুম হলো না। অদ্ভুত সব আওয়াজে জেগে বসে রইল। সুমন খুব জোরে জোরে চেঁচাচ্ছে। আশ্চর্য! তিন্নি ছাড়াও এ বাড়িতে আরও দু’জন লোক থাকে। তারা কী কিছু শোনে না? এমন নয় যে তারা ম’রার মতো ঘুমায়। বরং আকরাম সাহেবের ঘুম খুব পাতলা। প্রায়ই রাতের বেলা ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করেন। সুমনের চিৎকার থেমে গিয়েছে। কান খাঁড়া করলেও কিছু শোনা যাচ্ছে না। তিন্নি দরজা খুলে বের হলো। পা টিপেটিপে সুমনের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। ঘরের বাতি জ্বলছে না। হালকা একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে লাগছে। সে আর কিছু ভাবতে পারল না। অচেতন হয়ে মেঝেতে পড়ে গেল।

চলবে