নারকেল ফুলের মালা পর্ব-০৯

0
7

#নারকেল_ফুলের_মালা
#ফারহানা_কবীর_মানাল

৯.
আফিফা বেগমের অবস্থায় শোচনীয়। তিনি তাকিয়ে আছেন ফ্যাকাসে মুখে। কথা বলবেন, ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না। দু’দিন আগে, মাঝরাতে হুট করেই তার ফোন বেজে উঠলো। তুমুল ঝড়বৃষ্টিতে আকাশ ফেটে যাচ্ছে। তিনি শাড়ির আঁচল গায়ে জড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলেন। অচেনা নম্বর থেকে কল এসেছে। দুষ্ট ছেলেপেলে রাত বিরেতে অচেনা নম্বরে কল দিয়ে বিটলামি করে। শহরে এসব ছেলে দ্রুত বাড়ছে। তিনি কল রিসিভ করলেন না। পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন। আবারও কল বেজে উঠল। সুমনের বাবা বললেন, “কল রিসিভ করছ না কেন? দরকারি হতে পারে।”

আফিফা কল রিসিভ করলেন। ওপাশ থেকে ভীত-সন্ত্রস্ত কণ্ঠ শোনা গেল।

“মামি, আমি তিন্নি কথা বলছি। আমরা খুব বিপদে পড়েছি।”

“সেকি! তোমরা খুব বিপদে পড়েছ মানে? কার কী হয়েছে?”

“আমি আর সুমন। আমাদের দু’জনের। ফোনে এত কথা বলার সময় নেই। আপনার সাহায্য চাই। এই একটা উপকার করতে হবে।”

উৎকন্ঠায় তার দম আটকে যাচ্ছে। তিনি পরপর দু’টো ঢোক গিললেন। ব্যস্ত গলায় বললেন, “বলো মা, বলো। কী করতে হবে?”

“আমাদের জন্য একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে। খুব গোপনে করতে হবে। কাউকে জানতে দিলে চলবে না। মামাকেও না।”

তিনি স্বর নিচু করলেন। ফিসফিসিয়ে বললেন, “তোমরা এখন কোথায়?”

তিন্নি দোকানের বোর্ডে জায়গায় নাম পড়ল। আফিফা বললেন, “ওখানেই থেকো। একটা ব্যবস্থা করছি।”

কল কে’টে গেল। সুমন তিন্নির হাত জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সামনে সুন্দর চেহারার এক ভদ্রলোক। ছিপছিপে লম্বা গড়ন, চোখমুখ ব্যক্তিত্বের ছাপ স্পষ্ট। এমন পুরুষ মাঝরাতে রাস্তায় কী করছে? এত রাতে ভালো মানুষেরা রাস্তায় থাকে না। নাকি ভদ্রলোকের ব্যক্তিত্ব নকল? নকল ব্যক্তিত্বে ঠাঁসা মানুষের অভাব খুব কম। বেশিরভাগ লোক মেকি ভাব ধরে থাকে।

তিন্নি বলল, “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমাদের গাড়ি চলে আসবে।”

তিনি হাত বাড়িয়ে নিজের ফোন নিলেন। কথার জবাব দিলেন না। বৃষ্টিটা তখন একটু ধরেছিল। তিনি বেরিয়ে গেলেন।

আকাশের অবস্থা ভালো না। আবারও বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তিন্নি সুমনকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। সুমন গা গরম। আবারও জ্বর আসবে বোধহয়। এই ছেলের নার্ভ শক্ত। অন্যকেউ হলে এতক্ষণে অজ্ঞান হয়ে যেত। সুমন যায়নি। সে স্বাভাবিক এবং শান্ত। যেন কিছুই হয়নি।

গাড়ি আসতে ঘন্টা খানেক সময় লাগল। সুমনের বাবা অটোরিকশা নিয়ে এসেছেন। আফিফাও এসেছেন। তিনি ব্যস্ত ভঙ্গিতে নামলেন। কাতর গলায় বললেন, “তোমরা ঠিক আছো?”

“ঠিক আছি মামি। আমরা ঠিক আছি।”

তিন্নির কণ্ঠে বিচলিত ভাব নেই। গলার স্বর ঠান্ডা এবং কোমল। আফিফা তাদের নিয়ে বাড়িতে ফিরলেন। চিন্তিত গলায় সুমনের বাবাকে বললেন, “বাড়িতে কেউ নেই। হোসেন কী একটা কাজে বাইরে গিয়েছে। আপা দুলাভাইও বাড়িতে নেই। ওরা দু’জন খুব ভয় পেয়েছে। সকালে হুজুরের কাছে নিয়ে ঝাড়ফুঁক করে আনব। রাতটা আমাদের কাছেই থাকুক।”

সুমনের বাবা বিস্মিত হলেন, কথার জবাব দিলেন না। মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে সবকিছু এলোমেলো লাগে। তার একটু বেশিই লাগে। গোটা ব্যাপারটা স্বপ্ন মনে হয়। স্বপ্নের ব্যাখ্যা থাকে না। স্বপ্নে যা খুশি করা যায়, মানুষ আকাশে উড়ে বেড়ায়। ডানা লাগে না, প্লেন লাগে না। শুধু শুধুই ওড়ে। বিস্ময়কর ব্যাপার!

হোসেন তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। বাজখাঁই গলায় বলল, “ভং ধরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? চাবি নিয়ে আসুন।”

আফিফা একটু কেঁপে উঠলেন। মিনমিনে গলায় বললেন, “চাবি দিয়ে কী হবে? তুমি আমার ঘর তল্লাশি করার কে?”

“আমি কেউ না। তবে আপনি যাদের লুকিয়ে রেখেছেন, তারা খু’নি। আমার মা’কে খু’ন করে এখানে ঘাপটি মে’রে আছে। আপনি তাদের সাহায্য করছেন। লুকিয়ে রেখেছেন। অপরাধীকে সাহায্য করা সমান অপরাধ। ভালোয় ভালোয় চাবি আনুন। কুৎসিত কোন কাজ করতে বাধ্য করবেন না আমাকে।”

“তোমার সস্তা হু’ম’কিতে আমি ভয় পাই না। তাছাড়া তোমার মামা ঘরে নেই। একা মেয়ে মানুষকে যা খুশি বলতে পারো না।”

“মামি, দয়া করে আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিবেন না। দয়া করে না। সুমনের কোন ক্ষ’তি করব না। তিন্নিকে নিয়ে চলে যাব। সে আমার স্ত্রী। আপনি তাকে আ’ট’কে রাখতে পারেন না।”

হোসেন গলার স্বর বদলে গিয়েছে। কথা বলছেন বিনয়ী ভঙ্গিতে অনুরোধের সুরে। আফিফা একটু ভড়কে গেলেন। নরম গলায় বললেন, “তোমার স্ত্রী নিজে থেকে এখানে আছে। আমি তাকে আ’ট’কে রাখিনি।”

“অর্থাৎ তিন্নি এখানেই আছে। পাশের ঘরে লুকিয়ে আছে। চমৎকার ব্যাপার!”

হোসেন হাসল। খুব কুৎসিত লাগল সে হাসি দেখতে। আফিফা জিভ কা’ম’ড়ে বললেন, “এসব বাজে কথা।”

“কোন সব বাজে কথা মামি?”

তিনি কথার জবাব দিতে পারলেন না। এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন। হোসেন অল্প হেসে তার দিকে এগোতে লাগল। দাঁত চিবিয়ে বলল, “বাঁচতে চাইলে চাবি নিয়ে আসুন। আমার শরীর যথেষ্ট শক্তি আছে। দরজা ভাঙা কোন ব্যাপার না। তবে তেমনটা করতে হলে আপনাকে ম’র’তে হবে। যে আমার কাজে লাগে না, তাকে আমি বাঁচিয়ে রাখি না।”

সে আফিফার গলা চে’পে ধরল। একটু জোরেই ধরল। ঠিক সেই মুহূর্তে একজোড়া হাত শক্তভাবে হোসেনের হাত সরিয়ে দিল। বরফ শীতল গলায় বলল, “গলা ছেড়ে দিন।”

হোসেন নিজের হাত আগলে নিয়ে চারপাশে তাকাতে লাগল। আকরাম সাহেব এসেছেন। একা আসেননি। সাথে করে পুলিশ নিয়ে এসেছেন। তার চেহারা শান্ত, চোখ দু’টো জ্বলজ্বল করছে। হোসেন বলল, “এসবের মানে কী আব্বা? আপনি পুলিশকে নিয়ে এখানে কেন এসেছেন?”

“তোকে পুলিশ দিয়ে ধ’রি’য়ে দিতে এসেছি।”

“এ কথার মানে কী?”

আকরাম সাহেব মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। পুলিশের পোশাক পরা অল্প বয়সী ছেলেটা মুখ খুলল। তার বুকের কাছে লেপ্টে থাকা নেমপ্লেটে ‘নাইম’ লেখাটা জ্বলজ্বল করছে।

নাইম বলল, “না জানার ভান করে নিস্তার পাবেন না। কাজেই আমার পরামর্শ সত্য স্বীকার করে আত্মসমর্পণ করুন। এতেই সবার মঙ্গল।”

“কী বলতে চাইছেন আপনি? কোন সত্যি স্বীকার করব?”

“লোকের এই এক সমস্যা। সোজা কথা সোজাভাবে বুঝতে পারে না। মিস্টার হোসেন, আপনাকে আপনার মায়ের খু’নের দায়ে গ্রে’ফ’তা’র করা হচ্ছে।”

“কিসব বাজে বকছেন? আমি আমার মা’কে খু’ন করিনি।”

“আপনার বাবা আমাদের কাছে অভিযোগ করেছেন– আপনিই আপনার মাকে খু’ন করেছেন।”

“মিথ্যে কথা। এসব কিছু মিথ্যে। আরে আমি তো বাড়িতেই ছিলাম না। পাহাড়ে গিয়েছিলাম।”

“উনি আমাদেরকে প্রমাণ দেখিয়েছেন।”

“কি প্রমাণ? কিসের প্রমাণ?”

“আপনি আপনার মায়ের লা’শ গু’ম করার চেষ্টা করছেন।”

“আমি তো…”

হোসেন কথা শেষ করতে পারল না। পুলিশ ছেলেটা তার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিলো। শক্ত গলায় বলল, “যা বলার থানায় গিয়ে বলবেন।”

সে আকরাম সাহেবের দিকে তাকাল। হিসহিসিয়ে বলল, “এর ফল ভালো হবে না। মিথ্যের ফল কখনো ভালো হয় না। আপনি কেন এমন করছেন জানি না, তবে আপনার উদ্দেশ্য সফল হবে না।”

আকরাম সাহেব মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। নাইম হোসেনকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। আফিফা বললেন, “এসব কী হচ্ছে?”

আকরাম সাহেব বললেন, “তিন্নি তোমাকে কিছু বলেনি?”

“না বলেনি। কিছু জিজ্ঞেস করলেই এড়িয়ে যাচ্ছে। বলছে পরে বলবে।”

“আমাকে ওর কাছে নিয়ে চলো। কথা বলতে চাই।”

চরম অনিচ্ছায় আকরাম সাহেবকে নিয়ে পাশের ঘরে ঢুকলেন। তিন্নি তখন বিছানায় শুয়ে ছিল। শ্বশুরকে দেখে ধড়ফড়িয়ে বিছানায় উঠে বসল। জড়ানো গলায় সালাম দিয়ে বলল, “আপনি এখানে?”

আকরাম সাহেব অল্প হেসে তাকে আস্বস্ত করতে চাইলেন। কোমল গলায় বললেন, “ভয় নেই। কেউ তোমাদের ক্ষতি করতে আসবে না।”

নাইমা চেয়ারে বসে টেবিলের উপর পা তুলে রেখেছে। সোজা চোখে ব্যাপারটা বেশ বিরক্তির। বিশেষ করে থানার ভেতরে এ ধরনের কাজকর্ম অশোভন৷ তবুও সে এমন করেই বসেছে। এভাবে বসতে তার বেশ ভালোই লাগছে। চিন্তার ভার একটু কম মনে হচ্ছে। তবে চিন্তা যা আছে তা-ও কিছু কম নয়। বাপ ছেলের বিরুদ্ধে হ’ত্যার অভিযোগ তুলেছে। তা-ও সে নিজের মা’কে খু’ন করেছে৷ পুলিশের জীবন সে অনেক ধরনের কে’স দেখেছে। খু’নের, ধ’র্ষ’ণের, চু’রি, ছি’ন’তা’ই– সেগুলোর কোনটাকেই এত জটিল মনে হয়নি।

নাইম উঠে দাঁড়াল। টেবিলের উপরে রাখা গ্লাস তুলে পানি পান করল। হোসেন গরাদের ভেতরে আছে। মেঝেতে বসে নিজের চুল খামচে ধরে আছে। নাইম তার সামনে গিয়ে বসল। সহজ গলায় বলল, “কেমন আছেন?”

হোসন বিরক্ত চোখে নাইমের দিকে তাকাল। একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল, কথার জবাব দিলো না। নাইম বলল, “আপনার বাবা বলছেন– আপনি আপনার মা’কে খু’ন করেছেন। টাকাপয়সা নিয়ে আপনাদের মধ্যে নাকি কীসব ঝামেলা চলছিল। আপনি টাকা চাইছিলেন কিন্তু আপনার মা আপনাকে টাকা দিতে রাজি হচ্ছিল না।”

“এসব সস্তা কথা বিশ্বাস করে পুলিশের চাকরি করছেন কীভাবে? আমি বেকার ছেলেপেলে নই। মাস শেষে মোটা টাকা রোজগার করি। টাকা জন্য কারো কাছে হাত পাতার প্রয়োজন পড়ে না।”

“এ কথা সত্য। তবে সরল চোখে। সরল চোখে দেখা জিনিস সবসময় সত্যি হয় না।”

“আপনি বাঁকা চোখে যা দেখছেন সে কথাও সত্যি না।”

“আপনার বাবা আপনাকে কেন ফাঁ’সা’বে? আপনি কী তার নিজের সন্তান না?”

“হ্যাঁ, নিজের সন্তান। তবে তিনি আমাকে কেন ফাঁসালেন জানি না।”

“এমন কী হতে পারে যে উনি নিজেই খু’ন করেছেন, আইনের হাত থেকে বাঁচতে আপনাকে ফাঁসিয়ে দিচ্ছেন।”

“জানি না।”

“আপনি অনেক কিছু জানেন। বলতে চাইছেন না।”

“বলতে চাইব না কেন?”

“এই কারণটাও আপনি জানেন। আমি জানি না। বুঝতে পারছি না।”

“মা’য়ের লা’শ পো’স্ট’ম’র্টে’ম করা হবে?”

“হবে। ইতিমধ্যেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি পোস্টমর্টেম রিপোর্ট চলে আসবে। এসব নিয়ে চিন্তা করবেন না।”

“বেশ ভালো। রিপোর্ট আসলে বুঝতে পারবেন– এসবে আমার কোন হাত নেই। তখন আমি এই শহরেই ছিলাম না।”

“এসবের সাথে আপনার হাত না থাকলে পুলিশকে না জানিয়ে লা’শ পুঁতে দিচ্ছিলেন কেন?”

হোসেন ভ্রু কুঁচকে ফেলল। পরক্ষণেই কুঁচকে থাকা ভ্রু মসৃণ করে বলল, “অহেতুক আমাকে এখানে আটকে রেখেছেন। কারো কথায় এমন করার আইন নেই।”

নাইম চোখ-মুখ শক্ত করে ফেলল। কঠিন গলায় বলল, “আমাকে আইন শেখাতে আসলে ভুল করবেন। আইনের ব্যাপারটা আমি ভালোই জানি। জানি না যেটা তা হলো রসায়ন। উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময় পরপর দুই পরীক্ষায় এই বিষয়ে ফেল করেছিলাম। আপনি চাইলে আমাকে রসায়ন শেখাতে পারেন।”

হোসেন একটু ভড়কে গেল। বিব্রত মুখে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। নাইম নিজের চেয়ারে এসে বসল। এই কে’সটা জটিল, যতটা জটিল তার চেয়ে অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং এবং রহস্যময়। সে এই কে’সের শেষ দেখতে চায়।

আফিফা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। তার মনে হচ্ছে সে কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে। খুব বাজে একটা দুঃস্বপ্ন। এক্ষুনি তার ঘুম ভেঙে যাবে। ধড়ফড়িয়ে বিছানায় উঠে বসবেন। গায়ে হাত দিয়ে দেখবেন সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। খুব জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে। তবে তেমন কিছু হলো না। তিনি ঘুমিয়ে নেই, জেগে আছেন। চোখমুখে অবিশ্বাসের ছাপ নিয়ে আকরাম সাহেবের কথা শুনছেন।

তিন্নি বলল, “আমরা খু’নের ব্যাপারে কিছু জানি না। ওইদিন আম্মা কিসব করছিলেন। ভয় পেয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম।”

আকরাম সাহেব অল্প হাসলেন। সরু গলায় বললেন, “কিছু করলে বলে দাও। কে’সটা পুলিশের হাতে পড়ে গেছে। মিথ্যে বলে রেহাই পাবে না।”

তিন্নি কিছু বলল না। মাথা নিচু করে রইল। আকরাম সাহেব বললেন, “তিন্নি তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চাই। একান্তেই বলতে চাই। তবে আজ নয়। আমার কিছু কাজ আছে। উঠতে হবে।”

কাউকে কোন প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন। গেলেন সোজা থানায়। হোসেনের সাথে দেখা করলেন। হোসেন দাঁতে দাঁত চেপে তার দিকে তাকিয়ে রইল। কঠিন মুখে বলল, “আমাকে ফাঁসিয়ে আপনি বাঁচতে পারবেন না। আমি কিছু করিনি। সময়মত ছাড়া পেয়ে যাব।”

আকরাম সাহেব অল্প হাসলেন। গলার স্বর অনেকখানি নিচু করে বললেন, “হয়তো মা’য়ের খু’ন করোনি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তুমি কিছুই করোনি।”

“কী বলতে চাইছেন আপনি?”

“বলতে চাইছি তুমি নিষ্পাপ না। খু’নের চেষ্টা করা, বা কাউকে খু’ন করতে চাওয়াটাও একটা অপরাধ। মারাত্মক রকমের অপরাধ। এর শা’স্তিও মৃ’ত্যু’দ’ন্ড হতে পারে।”

“কী চাইছেন?”

“সবকিছু শেষ করতে চাইছি। নিজের বোকামিতে যে কুৎসিত অধ্যায় রচনা করেছিলাম তার সমাপ্তি চাইছি। আশা করছি তুমি বুঝবে– আমার এই চাওয়া দোষের কিছু না।”

“মাকে কে মে’রে’ছে? আপনি?”

“সে কথা আমি জানি না। তবে আমি তাকে মা’রি’নি।”

“কাকে স’ন্দে’হ করছেন?”

“তোমাকে!”

“আমাকে? আপনার কেন মনে হয় আমি মা’কে খু’ন করেছি। একটা কারণ বলুন।”

“তোমার মা নিজেই সুমন এবং তিন্নিকে ব’লি দিতে চেয়েছিল। ক্ষমতার লড়াইয়ে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব বলে কিছু হয় না। সবার লক্ষ্য শুধু একটাই– ক্ষমতা।”

হোসেন বিস্মিত হলো। ভীষণ রকমের বিস্মিত হলো। হতভম্ব মুখে বলল, “মা এমন করতে পারে না।”

“কিন্তু সে করেছে। ঘুমের ওষুধ মেশানো চা খাইয়ে আমাকে তার রাস্তা থেকে দূরে রেখেছে। তিন্নিকে দিয়ে সুমনের নামে পোঁতা গাছ তুলেছে। এমনকি তিন্নিকেও মা’র’তে চেয়েছিল। তোমার মা’কে খু’ন করার জন্য এই একটা কারণই যথেষ্টের চেয়ে ঢের বেশি।”

হোসেন ফ্যালফ্যাল করে তাকাল, কথার জবাব দিলো না।

তিন্নি অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করছে। তার মাথায় কাজ করছে না। সে সরিফাকে খু’ন করেনি। করেছে সুমন। তবুও তার ভয় হচ্ছে। সুমন অনেক ছোট, বাচ্চা ছেলে। এমন বিভৎস খু’ন সে করতে পারে না। অন্তত লোকেদের এমনই মনে হবে। কা’লো’জা’দুতে সবার বিশ্বাস নেই। সে দু’হাতে নিজের চুল খামচে ধরল। বোকামি করে ফেলেছে। খুব বড় বোকামি করে ফেলেছে। সেদিন রাতে পুলিশকে কল দিয়ে সব জানিয়ে দিলে ভালো করত। এখন এসব ফ্যাকড়ায় পড়তে হতো না। তিন্নি কী করবে বুঝতে পারল না। দিশাহীন চোখে সুমনের দিকে তাকাল। সুমন খাটে বসে পা দোলাচ্ছে। তাকে দেখে বিচলিত মনে হচ্ছে না। সে সুমনের কাছে গিয়ে বসল। তরল গলায় বলল, “সুমন, সেদিন রাতের কথা তোমার মনে আছে?”

সুমন অবাক চোখে তাকাল। বিস্মিত ভঙ্গিতে বলল, “কোনদিন রাতের কথা?”

“যেদিন রাতে তুমি খু’ন করেছিলে।”

“উঁহু!”

সুমন মাথা নাড়ল। অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলল, “আমি কাউকে খু’ন করিনি। তুমি করেছ।”

রাত নেমে গিয়েছে। আকাশে চাঁদ উঠেছে। কয়েকটা তারাও দেখা যাচ্ছে। থেমে থেমে শীতল বাতাস বইছে। বৃষ্টির আগে বাতাস এমন ঠান্ডা থাকে। তবে আকাশে কোন মেঘ নেই। মেঘ ছাড়া কী বৃষ্টি হয়!

চলবে