নারকেল ফুলের মালা পর্ব-১০

0
6

#নারকেল_ফুলের_মালা
#ফারহানা_কবীর_মানাল

১০.
তিন্নি রাতে কিছু খেতে পারল না। স্তব্ধ ভঙ্গিতে বসে রইল। আফিফা অনেকবার করে তাকে খেতে বললেন। সে উঠল না। বিছানায় বসে রইল। জীবনের একটা সময়ে মানুষ হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে। আশেপাশের অবস্থা বুঝতে পারে না। কী ঘটছে, কী ঘটা উচিত সে-সব বিচার বিবেচনা করতে পারে না। তিন্নির অবস্থা তেমনই। পরিস্থিতি বেশ জটিল। ঝড়ের পূর্বাভাস দিয়ে বিপদ সংকেত চলমান মুহূর্তের মত জটিল। হোসেন এখন জে’লে। তবে খুব বেশিদিন সে জে’লের ভেতরে থাকবে না। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এলেই সবটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। নিরপরাধ মানুষকে খুব সহজে ফাঁ’সি’য়ে দেওয়া গেলেও শেষ রক্ষা করা সহজ হয় না। হোসেন নির্দোষ নয়, তবে সে সরিফাকে খু’ন করেনি। খু’নের সময়ে বাড়িতে ছিল না। অভিযোগ মিথ্যে প্রমাণিত হবে। সুমনও কিছু স্বীকার করতে চাইছে না। উল্টো কথা বলছে। অথচ সে গোটা ব্যাপারটা জানে। নির্দিষ্ট ও কঠুরি শর্তে বাংলাদেশের আইন পরিচ্ছন্নভাবে স্বীকৃতি দেয়– নিজের প্রাণ রক্ষার জন্য বিচারিকভাবে হ’ত্যাও বৈধ হতে পারে। কিন্তু সুমনের সাক্ষ্য সব বদলে দেবে। তাকে কেউ বিশ্বাস করবে না। সে ফেঁ’সে যাবে। বাচ্চারা মিথ্যে বলে না– এই কথাটা সবসময় সত্যি নয়। তিন্নির মাথা ধরে গেল। সে দু’হাতে নিজের কপাল চে’পে ধরল। অস্পষ্ট স্বরে বলল, “ইয়া আল্লাহ! সাহায্য করুন।”

ঘড়িতে রাত একটা মতো বাজে। তিন্নি একা শুয়েছে। মোটামুটি মাঝারি ধরনের একটা রুম। রুমের বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে খাট পাতানো। খাটের পাশে টেবিলের মত ছোট চৌকি। একটা চেয়ার। মাথায় উপরে ফ্যান আছে। ফ্যান ঘুরছে। বেশ পুরনো ফ্যান। ঘটঘট শব্দ হচ্ছে। তিন্নি উঠে দাঁড়াল। সুমনের কাছে যাবে। কথা বলে ব্যাপারটা মিটিয়ে রাখতে হবে। দেরি করার সুযোগ নেই। পুলিশের কথা বলা যায় না। যখন তখন যা কিছু হয়ে বসতে পারে। সে নিঃশব্দে দরজা খুলল। শান্ত পায়ে হেঁটে সুমনের ঘরের দিকে গেল। সুমন তার রুমে একা শুয়েছে। আফিফা ছেলের সাথে ঘুমুতে চেয়েছিলেন। সুমন রাজি হয়নি। তিন্নি রুমের সামনে এসে দাঁড়াল। রুমের বাতি জ্বলছে। দরজা ভেজিয়ে রাখা। তিন্নি দরজার উপরে হাত রাখল। ভেতরে ঢুকবে ঠিক সেই মুহূর্তে মানুষের কথা শুনতে পেল। আফিফা গলা। তিনি বেশ সর্তক ভঙ্গিতে কথা বলছেন। খুব গুছিয়ে বলার মতো করেই বলছেন। তিন্নি কান খাঁড়া করল।

“শোন বাবা। যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এখন আর কোন ভুল করা যাবে না। তুই কিছুতেই নিজের নাম বলবি না। বলবি– খু’নের কারণের ব্যাপারে তোর কিছু জানা নেই। গায়ে জ্বর ছিল তাই নিজের ঘরে শুয়ে ছিলি। হঠাৎই চিৎকার শুনে বসার ঘরে ছুটে গিয়েছিস। গিয়ে দেখিস– তিন্নি তোর ফুফুকে মে’রে ফেলেছে। র’ক্ত দেখে তুই খুব ভয় পেয়ে যাস আর অজ্ঞান হয়ে পড়িস।”

“ঠিক আছে মা। তুমি যা বলতে বলবে আমি তা-ই বলব।”

“তিন্নি তোকে এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করেছে বা বলেছে?”

“করেছিল। বলেছে– সেদিন রাতের কথা মনে আছে কি-না।”

“তুই কী বলেছিস?”

“তোমার শেখানো কথাগুলো বলেছি। আমি তোমার কাছ থেকে দূরে যেতে চাই না মা।”

তিন্নি কিছু বুঝল। অল্প কিছু নয়, পুরোটাই বুঝল। আফিফা নিজেকে ছেলেকে এসব ঝামেলায় জড়াতে চাইছেন না। অথচ তার ছেলেও ম’র’তে বসেছিল। তিন্নি তাকে সাহায্য করেছে। মানুষ এতটা অকৃতজ্ঞ হয় কী করে? কেন তারা উপকারের কথা ভুলে যায়? সে দরজার সামনে থেকে সরে গেল। সুমনের সাথে কথা বলে কোন লাভ নেই। সে তার মায়ের কথা শুনবে। ভদ্রমহিলা খুব বেশি স্বার্থপরের মত কাজ করে ফেললেন।

আকরাম সাহেবের ঘুম ভাঙল সকালে। খুব ভোরে না, আবার খুব বেশি দেরিও হয়নি। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমতে পারেননি। মাথায় নানান ধরনের চিন্তা ঘুরছে। হোসেনের ব্যাপারটা নিয়ে তাকে কিছু করতে হবে। সেগুলোর মধ্যে প্রথম– হোসেনের বাড়িতে না থাকার ব্যাপারটা পুলিশকে জানতে দেওয়া যাবে না। যে করে হোক এই প্রমাণ সরিয়ে ফেলতে হবে। তিনি চোখ কচলে বিছানা ছেড়ে নামলেন। কাঁধের উপর তোয়ালে ফেলে বাথরুমে ঢুকে গেলেন। পানি বরফের মতো ঠান্ডা। শরীর জুড়িয়ে যায়। তিনি আয়েশ করে গায়ে পানি মাখলেন। সাবান ঘষে মুখ ধুয়ে ফেললেন। কলিং বেল বাজাচ্ছে। এত সকালে কে এসেছে? পুলিশ? নাহ! তাদের এখন এখানে আসার কোন কারণ নেই। এই সময়ে সবাই সকালের নাস্তা করে। নাস্তা ফেলে কেউ তার কাছে ছুটে আসবে না।

আকরাম সাহেব কৌতুহলী মুখে দরজা খুললেন। তিন্নি দাঁড়িয়ে। তার চোখ-মুখ শান্ত এবং সহজ। সে বেশ স্বাভাবিক গলায় বলল, “আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

“ভেতরে এসো। বাইরে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলা যায় না।”

তিন্নি ঘরের ভেতরে ঢুকল। সোফায় বসতে বসতে নরম গলায় বলল, “আমি একটু পানি খাব।”

আকরাম সাহেব পানি এনে দিলেন। অন্যরকম গলায় বললেন, “কোন সমস্যা হয়েছে? সাহায্য চাইতে এসেছ?”

“প্রশ্নের উত্তর জানতে এসেছি? হোসেনকে ফাঁসালেন কেন? সে কী আপনার নিজের ছেলে না?”

“নিজের ছেলে। ওর শরীরে আমার র’ক্ত বইছে।”

“তাহলে কেন এমন করছেন?”

“যদি বলি তোমাকে বাঁচাতে– আমার কথা বিশ্বাস করবে?”

“বিশ্বাস শব্দের উপর থেকে আমার বিশ্বাস উঠে গিয়েছে। সত্যিটা জানতে চাই।”

“বাইরে থাকলে হোসেন তোমাদের মে’রে ফেলত। এমন হোক চাইনি।”

“শুধু আমাদের জন্য এমন করেছেন?”

“না। নিজের জন্য করেছি।”

“নিজের জন্য করেছেন! ঠিক বুঝতে পারিনি।”

আকরাম সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। মিটসেফের উপর রাখা কাঁচের বয়াম নিয়ে পিরিচ ভর্তি করে চানাচুর ঢাললেন। তিন্নির সামনে রাখতে রাখতে বললেন, “শুকনো মুখে গল্প শুনতে ভালো লাগে না। খাওয়া শুরু কর।”

তিন্নি হাত বাড়িয়ে চানাচুর তুলল। আকরাম সাহেব বললেন, “রাশিফল, জন্মসময় এসবে কোন ধারনা আছে?”

সে মাথা নাড়ল। যার অর্থ হ্যাঁ হতে পারে আবার নাও হতে পারে। আকরাম সাহেব বললেন, “আমার জন্ম হয়েছিল সূর্য গ্রহণের সময়। আধ্যাতিক চিন্তায় এসবের গুরুত্ব অনেক। হোসেন মাত্র দু’দিন আগে ব্যাপারটা জানতে পেরেছে। আমিই কথায় কথায় বলে ফেলেছিলাম। বুঝিনি সে আমাকেও মা’রার চিন্তা করতে পারে।”

“কখন বুঝলেন?”

“বাড়িতে ফেরার পর।”

“আমাকে কী বলতে চেয়েছিলেন?”

“বলতে চেয়েছিলাম– হোসেন তোমাদের নামে নারকেল ফুলের মালা গেঁথেছিল। মালাটা যত শুকাবে, কালোজাদুর প্রভাব ততই বাড়বে। ওগুলো নষ্ট করে ফেলেছি। এসব ব্যাপার নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে। জমজম কূপের পানি দিয়ে গোসল করে ফেলবে। সুমনকেও গোসল করতে বলবে।”

“সুমনের ব্যাপারে একটা কথা বলতে চাই।”

“বলো।”

“আম্মার খু’নের ব্যাপারে সে আমাকে দোষ দিচ্ছে। বলছে আমি নাকি তাকে খু’ন করেছি।”

আকরাম সাহেব বিস্মিত হলেন। সুমনের থেকে এমন কিছু আশা করেননি তিনি। আফিফার থেকেও না। তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিন্নি বলল, “আপনি আমাকে আর কিছু বলতে চান?”

“চাই না। তবে তুমি চিন্তা করো না। সত্যির জোরে হোসেন ছাড়া পেলে তুমিও পাবে।”

তিন্নি আশ্বস্ত হলো। সরল চোখে আকরাম সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইল। বিয়ের পর থেকে এই মানুষটাকে গম্ভীর মনে হয়েছে। আজ আর তেমন লাগছে না। স্বচ্ছ কাঁচের মত মনে হচ্ছে। সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

তিন্নি ভেবেছিল– আকরাম সাহেবের সাথে তার কথোপকথন দীর্ঘ হবে। তাকে বিশেষ কিছু বলবে। তেমন হয়নি। সে আশাহত মুখে ঘরে থেকে বেরিয়ে হলো। সদর দরজা পার হওয়ার সময় একবার পেছনে ঘুরে তাকাল। কত-শত স্মৃতি উঁকি দিচ্ছে। জীবনের অনেক সময় সে এই ঘরে সংসার করেছে। বউয়ের দায়িত্ব পালন করেছে। বেঁধেছে, স্বামীর সেবা করেছে। তার চোখ জ্ব’লে উঠল। থমকে দাঁড়াল। পরমুহূর্তেই চোখের উপর রুমাল চে’পে ধরে বেরিয়ে গেল।

রোদ পড়ে এসেছে। খানিক বাদে সন্ধ্যা নামবে। সবকিছু কেমন স্তব্ধ। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। হোসেন মাথা নিচু করে আছে। নাইমের কথার জবাব দিচ্ছে না। দেওয়ার প্রয়োজনও মনে করছে না। নাইম বলল, “চুপ থেকে পার পেয়ে যাবেন এমন মনে করলে ঠোঁটের আঠা লাগিয়ে রাখুন। সুপার গ্লু আনিয়ে দেব?”

“অহেতুক প্রশ্নের কোন জবাব হয় না।”

“অহেতুক প্রশ্ন?”

“হ্যাঁ তাই। বারবার করে জিজ্ঞেস করছেন আমি আমার মা’কে কেন মে’রে’ছি। যেখানে আমি এসবের কিছুই জানি না।”

“জানেন না?”

“না জানি না। তখন আমি বাড়িতে ছিলাম না। পাহাড়ে গিয়েছিলাম। বাস কাউন্টারে গিয়ে খোঁজ নিলেই এই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। হোটেলেও খোঁজ নিতে পারেন। কিন্তু না। আপনি সে-সব কিছু করছেন না। সারাক্ষণ একই প্রশ্ন করছেন। একবার দুবার না। বারবার করে জিজ্ঞেস করছেন।”

“আপনার কী মনে হয় আমি আপনার কথা যাচাই করিনি?”

হোসেন ভ্রু কুঁচকে ফেলল। সরু গলায় বলল, “যাচাই করেছেন?”

“হ্যাঁ করেছি। আপনি শুনলে আশ্চর্য হবেন কি-না জানি না। তবে আপনার সব কথাই মিথ্যে। বাস কাউন্টারের কেউ আপনার কথা মনে করতে পারছে না। হোটেলের ব্যাপারে খোঁজ নিলাম। সেখানকার অবস্থাও তাই।”

হোসেন আশ্চর্য হলো। বিস্মিত গলায় বলল, “মিথ্যে বলছেন?”

“না।”

“আমার কাছে বাসের টিকিট ছিল। আমাদের বাড়িতে রাখা আছে। আমার ঘরে টেবিলের উপরে। আপনি গিয়ে দেখতে পারেন।”

“নিশ্চয়ই দেখব।”

হোসেনের চোয়াল শক্ত হয়ে গিয়েছে। চোখ-মুখে অদ্ভুত রকমের কাঠিন্য। সে হিসহিসিয়ে কিছু বলল। গলার স্বর খুব হালকা। এত হালকা কথা কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যায়।

সন্ধ্যার মুহুর্তে নাইম হোসেনদের বাড়িতে ঢুকল। আকরাম সাহেব সবে ওজু করে এসেছেন। হাতমুখ থেকে পানি পড়ছে। তিনি ভেজা হাতে দরজা খুলে দিলেন। দরজার হাতলের কাছে খানিকটা অংশ ভিজে গেল। নাইম বলল, “আপনার বাড়ি তল্লাশি করতে হবে।”

“নামাজের সময়ে এসেছেন। আমাকে খানিকটা সময় দিন।”

“ঠিক আছে। আপনি নামাজ শেষ করুন। আমি যাব। তপন পাহারায় থাকবে।”

নাইম বেরিয়ে গেল। আকরাম সাহেব নামাজে দাঁড়ালেন। সালাম ফিরিয়ে বললেন, “তোমাদের স্যারকে ডেকে নিয়ে এসো। ঘরের তল্লাশি নিতে বলো।”

তপন ফোন বের করে নাইমের নম্বরে কল দিলো। নম্বর ব্যস্ত। অন্য কোথাও কথা বলছে। সে কল কে’টে দিলো। হালকা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “স্যার আসছে।”

নাইম সত্যিই এলো। হন্তদন্ত গলায় বলল, “এক্ষুনি থানায় যেতে হবে। আকরাম সাহেব আপনিও আসুন।”

আকরাম সাহেব বললেন, “কী হয়েছে?”

“হোসেন পালিয়ে গিয়েছে। মাত্রই খবর পেলাম।”

তিনি খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ব্যস্ত গলায় বললেন, “আমি জানি সে কোথায় যেতে পারে।”

“কোথায় যেতে পারে?”

“তিন্নির কাছে।”

নাইম সময় নষ্ট করল না। তক্ষুনি বেরিয়ে পড়ল।

চলবে