নারকেল ফুলের মালা পর্ব-১১

0
8

#নারকেল_ফুলের_মালা
#ফারহানা_কবীর_মানাল

১১.
টিন শেডের এই দোকানটা বেশ ফাঁকা। লোকজন নেই। দোকানি বসে বসে ঝিমাচ্ছে। তার চোখ-মুখ রাজ্যের ক্লান্তি। হোসেন হুড়মুড়িয়ে দোকানে ভেতরে ঢুকল। দোকানি প্রায় লাফিয়ে উঠল। হড়বড়িয়ে বলল, “কী হয়েছে? কী চাই?”

“পানি খাব। এক গ্লাস পানি দিন।”

অনুরোধ কম, হুকুম বেশি। দোকানি ভ্রু কুঁচকে ফেলল। নরম হাতে গ্লাস পরিষ্কার করে পানি ঢালল। বিরক্ত গলায় বলল, “আপনার পানি।”

হোসেন পানি পান করল। জে’ল পালানো সহজ কাজ না। নাইম ছিল না বিধায় একটু সুবিধা করতে পেরেছে। সে লম্বা শ্বাস নিলো। ইমন বলল, “আর কিছু লাগবে?”

হোসেন মাথা দোলালো। যার অর্থ হ্যাঁ হতে পারে আবার না-ও হতে পারে। দোকানি বিরক্ত হলো। ভীষণ বিরক্ত হলো। পানি বদলে সে কখনো কোন মূল্য রাখে না। তবে আজ চাইল। হোসেন বলল, “আপতত আমার কাছে কোন টাকা পয়সা নেই। মাত্রই জে’ল থেকে পালিয়ে এসেছি। পরে সময় করে দিয়ে যাব।”

লোকটা হদ্দ বোকা, না হয় মারাত্মক চালাক। সাধারণ মানুষ জে’ল পালানোর কথা এত সহজে বলতে পারে না। দোকানি তাকে পা’গ’লই ভাবল। নরম চোখে এক পলক তাকিয়ে নিজের জায়গায় বসে পড়ল। হাই তুলতে তুলতে বলল, “শান্তিতে একটু ঘুমাব। সে উপায়ও নেই!”

তার কণ্ঠস্বরে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। হোসেন দোকান থেকে বেরিয়ে এলো। ফুটপাতের সাথে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়ানো ল্যামপোস্টের আলো জ্বলছে। আলোর চারপাশে পোকার ভীড়। রাস্তা ফাঁকা। লোকজন নেই। সে সর্তক চোখে চারপাশ দেখে নিলো। থাকার মত একটা জায়গা খুঁজতে হবে। আপাতত কোন ভুল করা যাবে না। পুলিশের নজর এড়িয়ে ক’দিন গা ঢাকা দিতে হবে। তারপর আসল খেলা। এতদিন ধরে যে স্বপ্ন বুকে পুষে রেখেছে সেই স্বপ্নকে এত সহজে নষ্ট হতে দেওয়া যায় না। কিছুতেই না। সময় তাকে চমৎকার সুযোগ দিয়েছে। এক দুই নয় পুরো তিনটে প্রাণ। তিন রকমের শক্তি। মায়ের মৃ’ত্যুতে হোসেনের তেমন আক্ষেপ নেই, কষ্ট আছে৷ কষ্টটা কোথায় বুঝতে পারছে না। সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

গাড়ি চলছে শা শা গতিতে। নাইমের চোখমুখে চিন্তার ছাপ। কপাল কুঁচকে আছে। আকরাম সাহেব ঘাড় ঘুরিয়ে নাইমের দিকে তাকালেন। শান্ত গলায় বললেন, “হোসেন কোথায় যেতে পারে এ ব্যাপারে আমার ধারণা আছে। জানতে চান?”

“জানতে চাই।”

“নদীর দিকে চলুন। নদীর পাড়ের আশেপাশে পাবেন। ওখানে যাওয়ার সম্ভাবনা সর্বোচ্চ।”

“কীভাবে জানেন?”

“ছোট থেকে মানুষ করেছি। অনেক কিছুই অনুমান করতে পারি।”

গাড়ি নদীর দিকে ছুটতে শুরু করল। আকরাম সাহেব শূন্য চোখে বাইরে দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার বুকে ব্যাথা করছে। সামান্য ব্যাথা, তবে চিনচিনে। ক্রমশ বুকের ব্যাথা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছে যেন। তিনি বারবার শ্বাস নিতে লাগলেন।

হোসেনকে নদীর ধারে পাওয়া গেল। দাঁড়িগোফ লাগিয়ে সন্নাসীর ভাব ধরে আছে। উদভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিক ঘুরছে। নাইম ভীষণ বিস্মিত হলো। এতটুকু সময়ের মধ্যে ভোল বদলে ফেলেছে। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার! তবে শেষ রক্ষা হলো না। নাইম চিনে ফেলল। আকরাম সাহেবের জন্যই চিনল। শক্ত গলায় বলল, “হোসেন সাহেব জে’ল পালিয়ে শেষ রক্ষা করতে পারবেন না।”

হোসেন হাসল। নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করল না। সহজ গলায় বলল, “দোষ না করে জে’লে পঁচার কোন মানে হয় না।”

“দোষ না করলেও আপনি অপরাধী। জে’ল পালানো এক ধরনের অপরাধ। আত্মসমর্পণ করুন।”

“করব না।”

“বোকামি করবেন না। আপনার মত লোককে বোকামি মানায় না।”

“বোকামি করছি না। ঠান্ডা মাথার পরিকল্পনায় চলছি। দারোগা সাহেব, আপনি বেশ বুদ্ধিমান, একটু গভীর ভাবে ভাবুন। একটা মানুষ হুট করেই জে’ল থেকে বেরিয়ে গেল। তারপর খানিকক্ষণের মধ্যেই আপনি তাকে ধরে ফেললেন। ব্যাপারটা এত সহজ হতে পারে?”

নাইম ভ্রু কুঁচকে আকরাম সাহেবের দিকে তাকাল। তবে বাপ ছেলে মিলে তাকে এখানে নিয়ে এসেছে? প্রথম থেকে সবকিছু সাজানো? সে শুকনো ঢোক গিলল। যথাসম্ভব গম্ভীর গলায় বলল, “আকরাম সাহেব, উনি এসব কী বলছে?”

আকরাম সাহেব বিস্মিত হননি। স্বাভাবিক মুখে তাকিয়ে আছেন। হোসেন তাকে ফাঁসাতে পারে এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। চতুর শৃগাল যে কোন মুহুর্তে পথ বদলে ফেলতে পারে। হোসেনও তেমন।

নাইম বলল, “কথা বলছেন না কেন?”

হোসেন হাসল। অন্যরকম গলায় বলল, “বলার কিছু নেই দারোগা সাহেব। আপনি ফেঁসে গিয়েছেন। এখন আপনাকে ম’র’তে হবে।”

নাইম দেরি করল না। হোসেনকে গান পয়েন্ট নিয়ে বলল, “বাঁচাতে চাইলে আত্মসমর্পণ করুন।”

হোসেন হাসল। কুৎসিত রকমের হাসি। সে হাসি দেখলে গায়ে জ্বালা ধরে যায়। দাঁত চিবিয়ে বলল, “ম’র’তে হবে আপনাকে।”

বলেই তেড়ে আসতে চাইল। তার হাতে ধা’রা’লো ছু’রি চকচক করছে। কনস্টেবলের হাতে ধরে রাখা লাইটের আলোয় সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। নাইম দেরি করল না। হোসেনের পায়ে গু’লি চালাল। হোসেন ব্যাথায় কুঁকড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হাতে ধরে রাখা ছু’রিখানা নিজের গলায় বসিয়ে দিলো। ক্ষীণ গলায় বলল, “কেউ আমাকে ব’ন্দী করতে পারে না। কেউ না। আমি ফিরে আসব। খুব শীগ্রই ফিরব।”

তার কণ্ঠস্বর ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে লাগল। শেষ কথাগুলো খুবই হালকা। কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যায়।

নাইম হোসেনের সামনে বসে পড়ল। ব্যস্ত গলায় বলল, “হাসপাতালে নিতে হবে। কুইক। তাড়াতাড়ি করো।”

রাতের আকাশ পরিষ্কার। মেঘ নেই। চাঁদ উঠেনি। থমথমে পরিবেশ। নাইম চেয়ারে বসে মাথা নিচু করে রেখেছে। দু’হাতে কপাল চে’পে ধরা। তার মস্তিষ্ক কাজ করছে না। ঘটনা এত দ্রুত ঘটেছে যে কোন হিসাব মিলছে না। হড়বড়ে মনে হচ্ছে। আকরাম সাহেব শব্দ করে পানি পান করলেন। তরল গলায় বললেন, “হোসেনের লা’শ পাব কখন?”

“পোস্টমর্টেম শেষ হওয়ার পর পাবেন।”

“কতদিন সময় লাগবে?”

“জানি না। সঠিক সময় বলতে পারছি না।”

আকরাম সাহেব মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। তার চোখ জ্বলছে। চোখে পানি আসার আগে এমন করে চোখ জ্বালা করে। তিনি মুখ ঘুরিয়ে চোখ মুছে ফেললেন। নাইম বলল, “আপনার কাছে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।”

“বলুন।”

“বলব। আপনার মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে এখনই কিছু বলতে চাইছি না। তবে আপনি শহরের বাইরে যেতে পারবেন না। যতদিন না বলব ততদিন এই নিয়ম মানতে হবে।”

“মানব।”

“আর কিছু বলার নেই। ইচ্ছে করলে এখন চলে যেতে পারেন। চাইলে আরও কিছুক্ষণ বসতে পারেন।”

আকরাম সাহেব বসলেন না। উঠে চলে গেলেন। নাইম তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এই লোকটাকে তার সুবিধা মনে হয় না। রহস্যময় লাগে।

ঘড়িতে রাত তিনটে। ঘরের মধ্যে অদ্ভুত ধরনের শব্দ হচ্ছে। খানিকক্ষণ খুটখাট শব্দের পর হঠাৎই ফোসফাস শব্দ হচ্ছে। আকরাম সাহেব বিছানায় উঠে বসলেন। তার চোখে ঘুম নেই। মনের মধ্যে অস্থিরতা, উৎকণ্ঠা এবং চাপা উদ্বেগ। কোন কিছুই ভালো লাগছে না। খানিকক্ষণ ঘুমুতে পারলে হয়তো একটু শান্তি পেতেন। তবে প্রয়োজনের বাজারে ঘুমের খুব দাম। পয়সা বিকিয়েও পাওয়া যায় না। তিনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

আবারও শব্দ শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ বমি করতে চাইছে, পারছে না। তার গলায় কিছু বিঁ’ধেছে। আকরাম সাহেব ঘরের বাতি জ্বালালেন। হুলো বিড়ালটা ঘরের কোণায় বসে বমি করতে চাইছে। পারছে না। মাছ খেতে গিয়ে গলায় কাটা ফুটিয়েছে বোধহয়। তিনি বাতি নিভিয়ে দিলেন। হোসেনের ব্যাপার নিয়ে তিনি আর ভাবতে চাইছেন না। তবে ভুলে যাওয়ার উপায় কী! শত হলেও সে তার নিজের ছেলে। সাজানো একটা সংসার পুরোপুরিভাবে নষ্ট হয়ে গেলে বেঁচে থাকা মানুষটা সংসারের শোকে অ’র্ধ’মৃ’ত হয়ে যায়। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করলেন। বাড়ি ফিরে ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন। ওষুধ কাজ করছে না। ডেট ছিল কি-না কে জানে। তিনি আবারও দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

সকালের আলো ফুটতেই না ফুটতেই দরজার কড়া নড়তে শুরু করল। আকরাম সাহেব চেখ ঢলতে ঢলতে দরজা খুলে দিলেন। আফিফা এসেছেন, তার সাথে সুমন, তিন্নি এবং সুমনের বাবা। সবার চোখ-মুখে আতঙ্কের ছাপ। আফিফা বললেন, “ভাইজান, খবর কী সত্যি?”

“সত্যি। হোসেন আর নেই। কাল রাতে মা’রা গিয়েছে।”

“বাঁচানোর চেষ্টা করেননি ভাইজান?”

“করেছি। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বাঁচানো যায়নি।”

“লা’শ কোথায়? পোস্টমর্টেম করতে দিয়েছে?”

“হ্যাঁ দিয়েছে।”

আফিফা স্বর উঁচিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। আকরাম সাহেব তাকে থামিয়ে দিলেন। সহজ গলায় বললেন, “দরজার কাছে দাঁড়িয়ে না থেকে ভেতরে এসে বসো। তিন্নি তুমিও এসো। হোসেনের ঘরের দরজা খোলা। চাইলে ভেতরে যেতে পারো।”

তিন্নি ঘরের ভেতরে ঢুকল। চারদিকে এক পলক চোখ বুলিয়ে হোসেনের রুমে চলে গেল। এই রুমটা তারও। অনেক স্মৃতি জমে আছে এখানে। ভয়, আতঙ্ক, ঘৃণা সবকিছু মিলেমিশে ঘরের চার দেয়ালে লেপ্টে আছে। সে গিয়ে বিছানায় বসল। হোসেনের ব্যাপারে কাল রাতেই জেনেছে। নাইম কল দিয়েছিল। সে সব খুলে বলেছে। তিন্নির তার কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করেনি। হোসেনকে সে চেনে। এই লোক কখনো আ’ত্ম’হ’ত্যা করতে পারে না। কিন্তু সে তো করল। কেন করল? এই প্রশ্নের উত্তর নেই। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার লোকও নেই। তার কাছে সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে। হোসেনের হুট করে জে’ল পালানো। আকরাম সাহেবের অনুমান। সবকিছু একটা ধাঁধা। এই ধাঁধার উত্তর কী? সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আকরাম সাহেবের কাছে গিয়ে বলল, “আপনার সাথে আমার কথা আছে।”

“বলো কী বলবে।”

“সে পালিয়ে কোথায় যেতে পারে এ ব্যাপারে আপনার ধারণা এত স্পষ্ট কীভাবে?”

“ছোট থেকে বড় করেছি। এতটুকু ধারণা তো করতেই পারি।”

“এই কথা আমি বিশ্বাস করি না। সত্যি বলুন।”

আকরাম সাহেব তিন্নির দিকে তাকালেন। তিন্নির চোখ জ্বলছে। চোখ-মুখের বিস্মিত ভাব পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি। তিনি শান্ত হাতে এক গ্লাস পানি ঢাললেন। তিন্নির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “তোমার কী মনে হয় মানুষ খু’ন করা খুব সহজ কাজ?”

“না, আমার তা মনে হয় না।”

“হোসেনেরও মনে হতো না। তবুও সে তোমাদের খু’ন করতে চাইত।”

“এ কথার মানে কী?”

“মানে খুব সহজ। হোসেন আগে থেকেই সব ভেবে রেখেছিল। সে জানত তোমাদের মা’রা’র পর তাকে জে’লেও যেতে হতে পারে। তাই নদীর ওদিকে আগে থেকে সরঞ্জাম লুকিয়ে রেখেছিল। মাস কয়েক আগেই রেখেছিল। সবসময় আমি ওকে নজরে নজরে রাখতাম। যেখানে যা করেছে সব জানি।”

তিন্নি আর কোন প্রশ্ন করল না। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। সুমন আফিফার গা ঘেঁষে বসে আছে। উল্টোদিকে ফিরে বসেছে। মা ছেলে ফিসফিসিয়ে কথা বলছে। ফিসফিস আওয়াজ শোনা যাচ্ছে তবে কথা বোঝা যায় না। সে নিঃশব্দে তাদের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। আফিফা সর্তক গলায় বললেন, “শোন বাবা। এখন আমাদের পুলিশের সাহায্য লাগবে। তোকেই সব করতে হবে কিন্তু।”

“আচ্ছা মা।”

“একটু পর এখান থেকে বের হয়ে সোজা থানায় যাব। তুই পুলিশকে বলবি তিন্নি তোর ফুফুকে মে’রে’ছে। তুই দেখেছিস।”

সুমন কিছু বলবে তার আগে আফিফা তিন্নিকে দেখে ফেললেন। চমকে উঠে বললেন, “তুমি?”

তিন্নি তার কথার জবাব দিলো না, হাসল।

চলবে