নারকেল ফুলের মালা পর্ব-১৩ এবং শেষ পর্ব

0
7

#নারকেল_ফুলের_মালা
#ফারহানা_কবীর_মানাল

১৩.
আকরাম সাহেব কাগজের পাতায় সই করলেন। হাত কাঁপছে। চোখ-মুখের অবস্থা তরল। যেন এক্ষুণি কেঁদে ফেলবেন। তিনি তার জীবনের সব সুখ বুঝে নিতে এসেছেন। সাদা কাপড়ে মোড়ানো দু’টো লা’শ। একটা ছেলের, অন্যটা স্ত্রীর। এই দু’জন মানুষের সাথে তার জীবন জড়িয়ে ছিল। যেনতেন ভাবে নয়, খুব গভীর ভাবে জড়িয়ে ছিল। আজকের পর আর থাকবে না। ক’ব’রের মাটিতে চাপা পড়া লা’শে’দে’র সাথে জীবিত মানুষের কোন সম্পর্ক থাকে না। রাখতে চাইলেও থাকে না। কীভাবে যেন হারিয়ে যায়! আকরাম সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। নাইম বলল, “লা’শ বুঝিয়ে দেওয়া শেষ। কে’সটাও খুব তাড়াতাড়ি মিটে যাবে। আশা করছি আপনি ভেঙে পড়বেন না।”

তিনি মলিন হাসলেন। নাইম বলল, “এই পরিস্থিতিতে আপনাকে স্বান্তনা দেওয়ার ভাষা আমার জানা নেই। তবে আপনি যা করেছেন ঠিক করেছেন। এই পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যারা মায়ায় পড়ে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়। তাদের বিবেক থাকে না। আপনার আছে। এটাই বা কম কিসে বলুন।”

তিনি তবুও কোন কথা বললেন না৷ মুখে হাসি ধরে রইলেন। তার বুক পু’ড়’ছে। ম’রা গাছে আ’গু’ন লাগলে এমন করেই পো’ড়ে। চিড়চিড় শব্দ হয়।

রোদের তাপ বেড়েছে। রোদের মধ্যে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। কাছেপিঠে কোন গাছ নেই। বিল্ডিংয়ের লম্বাটে ছায়া খাটো হয়ে এসেছে। মহিবুল সাহেব একটু সরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন। ব্যস্ত গলায় বললেন, “লা’শের গাড়ি চলে এসেছে। চলুন। আমাদের যেতে হবে।”

আকরাম সাহেব শূন্য চোখে তার দিকে একবার তাকলেন। তারপর মাথা দোলাতে দোলাতে গাড়ি উঠে বসলেন। তার দম জড়িয়ে আসছে। খানিকক্ষণ কাঁদতে পারলে বোধহয় একটু স্বস্তি পেতেন। বুকের ভেতরটা হালকা লাগত।

ম’রা বাড়ির পরিবেশ শান্ত হয় না। কেউ না কেউ কাঁদতে থাকে। তবে এই বাড়ি পরিবেশ শান্ত এবং থমথমে। কেউ কাঁদছে না। কয়েকটা ছেলে গম্ভীর ভঙ্গিতে ক’ব’র খুঁড়ছে। কথাবার্তা বলছে না। খুব বেশি লোকজন নেই। মাইকিং করা হয়নি। আশপাশে শুনে যতজন যা এসেছে। আকরাম সাহেব সেভাবে কোন আয়োজন করেননি। মায়ের হাতে ছেলে খু’ন, আ’ত্ম’হ’ত্যা এসব ব্যাপারে লোকের উৎসাহের শেষ নেই। মুখরোচক ব্যাপার। তিনি এই উৎসাহের পালে বাতাস দিতে চাননি। সাদামাটাভাবে সব শেষ করতে চেয়েছেন। এলাকার লোক যারা এসেছে তাদের কারো মুখেও কোন কথা নেই। ফিসফিসানির শব্দ নেই। যেন এখানকার সবাই বোবা। কথা বলতে পারে না। আকরাম সাহেব হাত ডলে চোখ মুছে ফেললেন। তার চোখ শুকনো, একটুও ভেজেনি। তবুও মুছলেন। জড়ানো গলায় বললেন, “তাড়াতাড়ি হাত চালাও। লা’শ বেশিক্ষণ বাইরে রাখা উচিত হবে না।”

তিন্নি বিছানায় বসে আছে। নড়াচড়া নেই, কাঁদছে না। পাথরের মূর্তির মত বসে আছে। মাজেদা বিবি তার পাশে গিয়ে আসলেন। অসম্ভব কোমল গলায় বললেন, “মন খারাপ করিস না মা। আল্লাহ যা করে তার উপর মানুষের তো কোন হাত নেই। সবকিছু মেনে নিয়ে জীবনের পথ চলতে হয়।”

তিন্নি যেন একটু হাসল। তরল গলায় বলল, “মা, আমার একটা প্রশ্নের জবাব দেবে? প্রথমে যে ছেলেটা আমাকে দেখতে এসেছিল তাকে না করে দিয়েছিল কেন? তার এত টাকাপয়সা, প্রতিপত্তি ছিল না বিধায়?”

“ওসব কথা কেন তুলছিস মা? তোর বাবা যা ভালো মনে করেছে তা-ই করেছে। বাবা মা সবসময়ই সন্তানদের ভালো চায়।”

“ভুল বললে মা। বাবা মা সবসময় সন্তানদের ভালো চায় না। কখনো সখনো পন্যের মত প্রদর্শন করতে চায়। তোমাদের ব্যাপার আমি জানি। তবে সে-সব নিয়ে কোন কথা বলতে চাই না। আমার আমার জীবনে ভীষণ ক্লান্ত। বেঁচে আছি, নিঃশ্বাস নিতে পারছি এতটুকুই খুব বেশি।”

মাজেদা বিবি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তিন্নি তাকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না। উঠে চলে গেল। মাজেদা বিবি মেয়ের যাওয়ার দিয়ে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মেয়েকে কী বলে বোঝাবেন? কী বললে সে বুঝবে? তিনি আবারও দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

দুপুরের পরপরই ঝুম বৃষ্টি নামল। সেকি বৃষ্টি! আকাশ ভেঙেচুরে যাচ্ছে। আফিফা বললেন, “ভালো সময়ে সব কাজ শেষ হয়েছে। আর একটু হলেই বৃষ্টিতে ধরত।”

আকরাম সাহেব বাইরের দিকে বৃষ্টি দেখলেন। নরম গলায় বললেন, “তিন্নিকে একটু ডেকে দাও। কথা বলব।”

আফিফা সরু চোখে তাকলেন। তবে কিছু বললেন না। তিন্নি তাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। আকরাম সাহেবের কথা শুনে থামল। নরম গলায় বলল, “আব্বা কী আমাকে কিছু বলবেন?”

“বলব। বেশ অনেক কথাই বলল। এখানে বসো।”

তিন্নি বসল। আকরাম সাহেব কোন প্রকার ভণিতা ছাড়াই মূল প্রসঙ্গে ঢুকলেন। সহজ গলায় বললেন, “তুমি কোথায় থাকতে চাও?”

“জানি না। এখনো কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।”

“বাবা মায়ের কাছে যেতে চাও না? তোমার আব্বা কিন্তু তোমাকে তাদের বাড়িতে নেওয়া কথা বলছিলেন।”

“জানি না। তবে আমি ওই বাড়িতে যেতে চাই না।”

মহিবুল সাহেব মেয়ের অভিমান বুঝলেন। কোমল গলায় বললেন, “তুই এখানে কার কাছে থাকবি?”

“এখানে থাকব না।”

আকরাম সাহেব প্রসঙ্গ ঘোরালেন। সহজ গলায় বললেন, “কোথায় সেটা তোমার নিজের সিদ্ধান্ত। তবে এর বাইরেও আমার কিছু কথা আছে।”

“বলুন।”

“হোসেনের জমানো টাকা আছে। আমারও কিছু আছে। বাড়িটা বাদে বাকি সব বিক্রি করে দেব। সবকিছুর অর্ধেক তোমাকে দিতে চাইছি। এছাড়া সরিফার গহনাগুলোও তুমি তোমার সাথে নিয়ে যাও। ওগুলো আর বিক্রি করব না।”

“আমার এসব চাই না।”

“তুমি না চাইলেও প্রয়োজনে এগুলো তোমার কাজে আসবে। টাকা ছাড়া দুনিয়ায় চলা যায় না। আত্মীয় স্বজনও খুব একটা আপন থাকে না। তুমি হয়তো ভাবছ আমি এসব কথা কেন বলছি। আমি খুব প্রাকটিকাল কথা বলছি তিন্নি। সময় তোমাকে এই ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেবে।”

তিন্নি তার বাবার দিকে তাকাল। মহিবুল সাহেব উসখুস করছেন। সে তার মায়ের দিকেও তাকাল৷ মায়ের চোখের দিকে তাকাল। নরম গলায় বলল, “আমাকে দিলে আপনার চলবে কীভাবে?”

“বেঁচে থাকলে চলবে। শেষ পর্যন্ত না চলতে পারলে তুমিই না হয় কিছু টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করে দিও।”

হঠাৎই তিন্নির চোখ ভিজে উঠল। সে কোন কথা বলতে পারল না। বলবে কীভাবে? তার যে গলা ধরে আসছে। চোখ জ্বলছে। চোখে পানি আসার আগে এমন করে চোখ জ্বালা করে।

তারপরের কয়েকটা দিন খুব তাড়াহুড়ায় কাটল। আকরাম সাহেব বিস্তার ছোটাছুটি করে হোসেনের জমানো টাকা তুললেন। জমিজমা বিক্রির বন্দোবস্ত করলেন। সব কিছু গুছিয়ে উঠতে দিন পনেরো সময় লেগে গেল। এর মধ্যে তিনি নিজের ব্যবস্থাও করে ফেলেছেন। কোন এক বন্ধুকে ধরে সৌদি আরবের ভিসা জোগাড় করে ফেলেছেন। এখনও হাতে পাননি। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে হাতে পেয়ে যাবেন। গতকাল সন্ধ্যায় সেই বন্ধু বাসায় গিয়েছিলেন। রাতে খাবার খেয়ে ফিরতে হলো। না খাইয়ে ছাড়লেনই না।

তিন্নি বাবা মায়ের সাথে ফিরে গিয়েছে। আপাতত তাদের বাড়িতে থাকছে। তবে সেখানে বেশিদিন থাকবে না। হোস্টেলে চলে যাবে। নতুন করে কলেজে ভর্তি হবে। অনার্স-মাস্টার্স শেষে নিজে কিছু একটা করবে। সে কারো ঘাড়ের বোঝা হতে চায় না। অবশ্য মহিবুল সাহেব তিন্নির এই সিদ্ধান্তে মত দেননি। তিনি নতুন করে মেয়ের বিয়ে দিতে চাইছেন। দুই একটা ছেলেও দেখেছেন। তবে তিন্নির সাথে পারছেন না। হোসেন মা’রা গিয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি। তিন্নির বৈধব্যের ইদ্দত শেষ হয়নি। এর মধ্যেই কী বিয়েসাদী করার ইচ্ছে হতে পারে?

সন্ধ্যা মিলিয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। রাতের অন্ধকার গাঢ় হতে শুরু করেছে। সে সবে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়েছিল। কলিংবেল বাজার শব্দ উঠে বসল। মাজেদা বিবি বললেন, “তিন্নি, দেখ তো কে এসেছে।”

তিন্নি দরজা খুলে দিলো। আকরাম সাহেব এসেছেন। তার হাতে বেশ কয়েকটা শপিং ব্যাগ। তিনি তাকে সালাম দিল। নরম গলায় বলল, “কেমন আছেন আপনি? শরীর কেমন আছে?”

“ভালো আছে। তুমি কেমন আছো?”

“ভালো আছি। আসুন। ভেতরে এসে বসুন।”

আকরাম সাহেব সোফায় বসলেন। স্বাভাবিক গলায় বললেন, “তোমার আব্বা কোথায়?”

“আব্বা একটু বাইরে গিয়েছে। কিছু বলবেন?”

“ইম! না, তাকে কিছু বলব না। তোমার সাথে কথা বলতে এসেছি।”

মাজেদা বিবি দরজার পাশে এসে দাঁড়ালেন। কথাবার্তা শুনবেন এই আশায় কান খাঁড়া করে রেখেছেন। তবে তার এত কষ্ট করতে হলো না। আকরাম সাহেব তাকে ডাকলেন। সহজ গলায় বললেন, “টাকাপয়সা হাতে পেয়েছি৷ তিন্নিকে দিতে এলাম।”

তিনি তিন্নির হাতে একটা শপিং ব্যাগ দিলেন। ব্যাগটা বেশ ভারী। ভেতরে কাগজের মোড়ানো কয়েকটা পুঁটুলি। তিন্নি বলল, “কি আছে এতে?”

“টাকা আছে। বারো লাখের মতো আছে। জমিজমা বিক্রি করে দিয়েছি৷ বেশ ভালো দাম পেয়েছি। আমি পনেরো লাখের মত রেখেছি। বাকিটা তোমাকে দিতে এলাম।”

“আমি এত…”

“তোমার সাথে আমার ছেলের বিয়ে হয়েছিল। দুনিয়া উল্টে গেলেও এই সত্যি অস্বীকার করা যায় না। আমার কথা শোনো। টাকাগুলো তোমার কাছে রেখে দাও। ব্যাংকে নিজের একটা একাউন্ট করে সেখানে রাখবে। তোমার বাবা বললেন– তুমি নাকি পড়াশোনা করতে চাও। আজকাল পড়তে অনেক খরচ। টাকাগুলো তোমার কাজেই লাগবে।”

তিন্নি ছলছলে চোখে তাকাল। আকরাম সাহেব তিন্নির হাতে আরও একটা ব্যাগ দিলেন। কোমল গলায় বললেন, “যেসব গহনা রেখে এসেছিলে সেগুলোই নিয়ে এলাম। ব্যবহার করতে না চাও। তোমার কাছে রেখে দাও। আমানত হিসাবেই না হয় রাখো। দেশে থাকব না। এগুলো আর কোথায় রাখব।”

এতটুকু করেই তিনি ক্ষ্যান্ত হলেন না। তিন্নিকে তার বাড়ির চাবি দিয়ে গেলেন। অসম্ভব কোমল গলায় বললেন, “প্রয়োজন পড়লে ব্যবহার করো। তুমি হয়তো ভাবছ আমি তোমার জন্য এতসব কেন করছি৷ কেন করছি জানি না। তবে এই দুনিয়ায় আপন বলতে আমার আর কেউ নেই।”

তিনি কথা শেষ করতে পারলেন না। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে রইলেন। মাজেদা বিবি বললেন, “রাতে না খেয়ে যাবেন না।”

“আচ্ছা যাব না।”

তিনি গেলেনও না। রাতে খেয়ে তারপর গেলেন। যাওয়ার সময় তিন্নির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গেলেন। অসম্ভব কোমল গলায় বললেন, “নিজের যত্ন নেবে। আগামী বুধবার ফ্লাইট। সুযোগ পেলে দেখা করে যাব।”

আকরাম সাহেব তার কথা রেখেছিলেন। বুধবার সকালে তিন্নির সাথে দেখা করে গেলেন। খুব সুন্দর দেখতে একখানা শাড়ি উপহার দিয়ে গেলেন৷ তিন্নি খুব কাঁদল। কোন কারণ ছাড়াই কাঁদল। আকরাম সাহেবকে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এলো। আকরাম সাহেবও কাঁদলেন। সবার অলক্ষ্যে। কয়েকটা দিনের মধ্যে তিন্নি তার খুব কাছের হয়ে গিয়েছে। যেন নিজের মেয়ে। এত ভালোবাসা, এত টান। কারণ ছাড়া কোন মানুষ কাউকে এত ভালো বাসতে পারে? বোধহয় পারে। আকরাম সাহেব যে পারছেন। স্বার্থ ছাড়াই তিন্নিকে এতটা ভালোবাসছেন।

১৪.

মাগরিবের আজান শোনা যাচ্ছে। লামিয়া মাথায় ঘোমটা টেনে দিলো। নরম গলায় বলল, “কষ্ট পাস না তিন্নি। মানুষের জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই থাকে। এতকিছুর পরেও যে তোর শ্বশুর তোকে এত ভালোবেসেছে– এটাই বা ক’জনের ভাগ্যে থাকে বল?”

তিন্নি মাথা দোলালো। অস্পষ্ট গলায় বলল, “কাল দুই বছর হবে।”

“হোসেনের মৃ’ত্যুর?”

“হুম। ভাবছি ও বাড়িতে একবার যাব। ঘুরেটুরে দেখে আসব। চাবিটা এখনও আমার কাছে আছে।”

“আচ্ছা বেশ। যা ভালো মনে করিস।”

সে অন্যমনস্ক গলায় হুম বলল। লামিয়া বলল, “একটা প্রশ্ন করব?”

“হুম। বল না। কি বলবি?”

“হোসেন কী জানত না যে তার মা তোকে মা’র’তে চায়?”

“না জানত না। সে ভেবেছিল তার মা কোন শক্তি চায় না। কিন্তু ওই মহিলা নিজেই সবকিছুর উপর আধিপত্য বিস্তার করতে চেয়েছিল। সেজন্য হোসেনকে সরিয়ে দিয়ে আমাদের দু’জনকে মা’র’তে চেয়েছিল।”

“ওহ আচ্ছা! আরও একটা জিনিস জানতে ইচ্ছে করছে। তোর শাশুড়ি কার হাতে ম’র’ল? সুমনের নাকি তোর শ্বশুরের?”

“আমি ঠিক জানি না রে। বোধহয় সুমনের হাতে।”

“এতকিছু হয়ে গিয়েছে তোর বাবা মা কিছুই জানতে পারেনি? বলেছিলি হোসেন তোর কলেজের টিচার ছিল। তাহলে তো পাশাপাশিই।”

“খুব একটা কাছাকাছি নয়। বেশ দূরেই বলা যায়। অটো রিকশায় চল্লিশ পয়তাল্লিশ মিনিট লাগে। আসল কথা কী জানিস? খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে না করলে পাশের ঘরে থেকেও খোঁজ রাখা যায় না।”

লামিয়া ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস গোপন করল। কোমল গলায় বলল, “এসব নিয়ে ভাবিস না। যা হয়েছে সেগুলো বদলানো যাবে না। আর যা বদলানো যাবে না তা নিয়ে আফসোস করার কিছু নেই।”

তিন্নি হাসল। মলিন হাসি। সে হাসি দেখতে ভালো লাগল না। লামিয়া তার রুমমেট। হোস্টেলে দু’জনে এক সাথে থাকে। কলেজের বান্ধবী বলতে এই একজনই। ভালো মেয়ে। পড়াশোনায় খুব সিরিয়াস। এখনও বিয়ে করেনি। টিউশনি করিয়ে নিজের পড়ার খরচ চালিয়ে যাচ্ছে। আজকাল তিন্নিও খুব পড়ছে। হোস্টেলে থাকে। বাপের বাড়িতে খুব একটা যায় না। কোথাও চাপা অভিমান জমে আছে। অভিমান পর্দা ছোট, তবে ভেদ করা যাচ্ছে না।

তিন্নি বেশি রাত জাগল না। রাতে খেয়ে শুয়ে পড়ল। কাল সকালে ওই বাড়িতে একবার যাবে। দু’বছরে একবারও যাওয়া হয়নি। আকরাম সাহেব দেশে ফেরেননি। ওখানে একটা কাজ নিয়েছেন। কাজ বলতে একটা বাচ্চা ছেলেকে দেখাশোনা করা। তিনি তিন্নিকে কল করেন। কথাবার্তা বলেন। তাদের দুজনের সম্পর্ক বেশ সরল।

বাড়ির চারপাশে আগাছা জমে গিয়েছে। দেখেই বোঝা যায় এ বাড়িতে লোকজন থাকে না। তিন্নি বাড়ির ভেতরে ঢুকল। হঠাৎই তার বুক ধুকপুক করছে। সে শান্ত পায়ে হেঁটে হোসেনের ক’ব’রের সামনে এসে দাঁড়াল। নাহ! কোন অনুভূতি নেই। সামান্য একটু খারাপও লাগছে না। যেন সে এই মানুষটাকে ভুলে গিয়েছে। অতীতের এসব তার স্মৃতি মনে নেই। সবকিছুই কেমন আবছা হয়ে গেছে। তিন্নি হোসেনের চেহারা মনে করার চেষ্টা করতে লাগল। পারল না। কী আশ্চর্য! চেহারাটাও ভুলে গিয়েছে। সে তালা খুলে ঘরের ভেতরে ঢুকল। ভ্যাপসা গন্ধ। তার কেমন ভয় ভয় করতে লাগল। ভেবেছিল বাড়িঘর ঘুরে দেখবে। পরিষ্কার করবে। তবে তেমন কিছু করল না। ভয়ের কারণেই করতে পারল না বোধহয়। দ্রুত হাতে তালা লাগিয়ে বেরিয়ে গেল। পেছনে ঘুরেও দেখল না।

রাস্তা ফাঁকা। লোকজন নেই। একটা রিকশাও দেখা যাচ্ছে না। তিন্নি হাঁটতে শুরু করল। রোদ ম’রে এসেছে। হালকা হালকা বাতাস বইছে। ভালো লাগছে হাঁটতে। সে হাসি-হাসি মুখ করে হাঁটতে লাগল। খানিকটা যাওয়ার পর হঠাৎই সে একটা জটলা মত দেখল। বেশ কয়েকজন বাচ্চা ছেলে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে। তিন্নি কৌতুহলী মুখে সেদিকে এগিয়ে গেল। একটা বিড়ালের বাচ্চা ড্রেনে পড়ে গিয়েছে। মাঝবয়েসী একজন ভদ্রলোক হাঁটু পানিতে নেমে বিড়ালের বাচ্চাটা তোলার চেষ্টা করছে। এসব মানবিক কাজে বাচ্চাদের দেখতে বেশি ভালো লাগে। বাচ্চাদের সরলতার সাথে এইসব ব্যাপার খুব যায়। তিন্নি একটু ভালো করে দেখল। শার্ট-প্যান্ট পরা ফর্মাল পোশাকের একজন ভদ্রলোকের সাথে হাঁটু সমান ময়লা পানিতে নেমে বিড়ালের বাচ্চা তোলার ব্যাপারটা মানাচ্ছে না। আবার অত বড় হাতে ইঁদুর সাইজের বিড়ালের বাচ্চাটাকেও খুব একটা মানাচ্ছে না। তবুও গোটা ব্যাপারটা বেশ মানিয়েছে। মনে হচ্ছে এই অবস্থায় এই দৃশ্যের চেয়ে সুন্দর আর কিছু হতে পারত না। তিন্নি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। ভদ্রলোক ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে হাত-মুখ ধুয়ে ফেলেলেন। তিন্নির দিকে তাকিয়ে লজ্জিত গলায় বললেন, “না তুললে বাচ্চাটা ম’রে যেত।”

তিন্নি হাসল। প্রাণখোলা সরল হাসি। বহুদিন বাদে সে এমন সুন্দর করে হাসল। ভদ্রলোক বললেন, “কেমন আছেন তিন্নি?”

তিন্নি চমকে উঠল। এই লোক তার নাম জানে কী করে? চেনা পরিচিত কেউ নাকি? ভদ্রলোক তার চমকানো দেখে হাসলেন। সরল গলায় বললেন, “আপনি হয়তো আমাকে চিনতে পারেননি। এতদিন বাদে আমাকে চেনার কথাও না। তখন আমার মুখে দাঁড়ি গোঁফ ছিল না। এখন আছে। না চেনাই অস্বাভাবিক।”

তিন্নি কথা বলছে না। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। ভদ্রলোক তিন্নির দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। নরম গলায় বললেন, “কেমন আছেন বললেন না তো?”

“ভালো আছি।”

“আপনার স্বামী কেমন আছেন? বিবাহিত জীবন কেমন চলছে?”

তিন্নি একটু ইতস্তত করলেও জবাব দিলো। তরল গলায় বলল, “দুই বছর হলো আমার স্বামী মা’রা গিয়েছে। আমি আর এখন বিবাহিত নই, বিধবা। আপনি আমাকে কীভাবে চেনেন?”

ভদ্রলোক কথার জবাব দিলেন না। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললেন, “আমার একটু কাজ আছে। অন্য কোনদিন বলল।”

বলেই হাঁটা ধরলেন। তিন্নি তাকে ডাকতে গিয়ে ডাকল না। থেমে গেল।

বাপের বাড়িতে আসার কোন ইচ্ছেই তার ছিল না। মায়ের কথার জন্য আসতে হলো। মাজেদা বিবি কীভাবে যেন তার এখানে আসার ব্যাপারে জেনে গিয়েছেন। লামিয়া কল দিয়ে বলেছে নিশ্চয়ই। তিনি খুব করে বলেছিলেন বিধায় তিন্নির আসতে হলো। তাছাড়া বেলা পড়ে গেছিল। হোস্টেলে ফিরতে রাত হয়ে যেত। সে এত ঝুঁকি নিতে চায়নি।

মাজেদা বিবি কোমর বেঁধে রান্নাবান্না করছেন। এতদিন বাদে মেয়ে তাদের বাড়িতে এসেছে। হোস্টেলে থাকে। কী খায় না খায়। মায়ের মন। তিনি খুব জমকালো আয়োজন করলেন। পোলাও, গরুর গোশত ভুনা, দেশি মুরগীর ঝাল, রুই মাছ ভাজা। আয়োজন দেখে মনে হতে লাগল এটা একটা বিয়ে বাড়ি। কিংবা তার চেয়েও বেশি।

নির্বিঘ্নে রাত কেটে গেল। ঝামেলা যা হওয়ার সকালে শুরু হলো। মহিবুল সাহেব কোন এক ছেলেকে ধরে নিয়ে এসেছেন। তিন্নির সাথে সম্মন্ধের কথাবার্তা চলছে। তিন্নি ভীষণ রেগে গেল। রেগেমেগে ঘরের দরজা লাগিয়ে বসে রইল। মাজেদা বিবি অনেক চেষ্টা করেও দরজা খোলাতে পারলেন না। শেষমেশ ক্লান্ত ভঙ্গিতে সোফায় বসে পড়লেন। পাত্র হিসেবে যে ছেলে এসেছে তিনি এগিয়ে এলেন। নরম গলায় বললেন, “আমি কী একবার বলে দেখব?”

মহিবুল সাহেব বললেন, “বলে দেখো। যা পারো করো।”

ভদ্রলোক দরজার উপর হাত রাখলেন। অসম্ভব কোমল গলায় বললেন, “তিন্নি, দরজা খুলুন। কেউ কথা বলতে চাইলে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত না।”

তিন্নি পণ করে বসে ছিল যা কিছু হয়ে যাক দরজা খুলবে না। তবে কণ্ঠস্বরটা তার চেনা চেনা ঠেকল। দরজা খুলে সে ভীষণ ভীষণ অবাক হলো। বিস্মিত গলায় বলল, “আপনি?”

ভদ্রলোক বললেন, “আমরা কী আলাদা কথা বলতে পারি?”

তিন্নি ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। ডান দিকে মাথা কাত করতে করতে বলল, “চলুন।”

“আপনি কী চাইছেন? বাড়ি পর্যন্ত চলে এসেছেন? আব্বা আপনাকে ঠিক করে রেখেছে তাই না? ওই বিড়ালের বাচ্চা, ওসব কিছু ফাঁদ ছিল?”

ভদ্রলোক একটু হেসে বললেন, “তেমন কিছুই না। আপনি ভুল বুঝেছেন?”

“আমি একদম ঠিক বুঝেছি। আমার বাপকে আমি হাড়েহাড়ে চিনি। আমাকে বিয়ে দিতে পারলেই যেন উনি হজের ফল পান।”

“বাবারা মেয়েদের জন্য চিন্তা করে।”

“চুপ করুন তো আপনি। আপনিও কিছু কম যান না।কালকে যেই শুনলেন আমার স্বামী মা’রা গিয়েছে। অমনি বাড়ি বয়ে চলে এলেন। কেন রে ভাই? দেশে কী মেয়ের অভাব পড়েছে?”

“তেমন কিছু নয়। কিন্তু আল্লাহ বোধহয় আপনাকে আমার জন্য লিখেছেন।”

“এ কথার মানে কী?”

“আপনার ডান গালের তিলটা খুব সুন্দর তিন্নি। বরং আগের চেয়ে একটু বেশিই সুন্দর দেখাচ্ছে।”

তিন্নি নিজের গালে হাত দিলো। চট করে তার কিছু একটা মনে পড়ল। এই সেই ছেলে, যার সাথে তিন্নির বিয়ের কথা ছিল। কী আশ্চর্য! সে ছেলেটাকে একটু চিনতে পারেনি। তিন্নি গাল থেকে হাত সরিয়ে নিলো। চোখ-মুখ শক্ত করে গটগট করে হেঁটে চলে গেল। ভদ্রলোক তাকে পেছন ডাকলেন। বেশ উঁচু গলায় বললেন, “আমাকে কী একটা সুযোগ দেওয়া যায় না?”

তিন্নি ফিরে এলো। চোখ-মুখে বিস্মিত ভাব রেখে বলল, “আপনি এখনও বিয়ে করেননি?”

“না করিনি।”

“কেন করেননি?”

“কাউকে মনে ধরেনি। জোর করে কোন মেয়ের জীবন নষ্ট করার তো কোন মানে নেই।”

“ওহ আচ্ছা!”

“তিন্নি? আমাকে…”

ভদ্রলোক কথা শেষ করতে পারলেন না। তিন্নি চলে গেল। সারাটা দিন সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে রইল। সন্ধ্যার দিকে মাজেদা বিবি তার ঘরে এলেন। গায়ে হাত রেখে বললেন, “তোর কী মত মা?”

তিন্নি তার কথার জবাব দিলো না। বিছানায় শুয়ে গায়ে উপর কাঁথা চাপিয়ে দিলো। মুখে রেগে থাকলেও আজ তার মন ভালো। খুবই ভালো।

পরিশিষ্ট,
শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোকের সাথে তিন্নির বিয়ে সম্পন্ন হলো। যা কিছু করার তিনি নিজেই করেছেন। তার কান্ডকারখানা দেখে মহিবুল সাহেব বেশ খানিকক্ষণ আফসোস করলেন। ইসস! প্রথমেই যদি এই ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতেন। তাহলে হয়তো এমন কিছু হতো না। তেমন ঘটা করে না হলেও আয়োজন কিছু কমতি ছিল না। আকরাম সাহেব পর্যন্ত এসেছিলেন। হাসিমুখে দোয়া করে দিলেন। উপহার দিলেন কিছু।

সেদিন রাতে ভরা পূর্নিমা। জানালা গলে চাঁদের আলো ঘরে ঢুকছে। বিছানা জুড়ে ফুলের সাজ। ঘরের ভেতরে ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ ম-ম করছে। তিন্নির পরনে লাল রঙের জামদানী শাড়ি। গা ভর্তি গহনা। চোখ-মুখে চাপা হাসি।

ঘড়িতে রাত এগারোটার মত বাজে। ভদ্রলোক দরজা ঠেলে ঘরের ভেতরে ঢুকলেন। কোমল গলায় বললেন, “একটু দেরি হয়ে গেল।”

তিন্নি শান্ত চোখে তাকাল। অন্যরকম গলায় বলল, “আপনি আমাকে বিয়ে করলেন কেন?”

“ভালোবাসি বিধায়!”

তার কণ্ঠস্বর অসম্ভব কোমল শোনাল। বরফের মতো শীতল কণ্ঠ। গায়ে কাটা দিয়ে যায়।

রাত বাড়ছে। চাঁদের আলো ভীষণ তীব্র। শেষ কবে চাঁদের আলো এত সুন্দর ছিল? নাহ! সে মনে করতে পারল না। নরম নিঃশ্বাস ফেলে অল্প হাসল।

সমাপ্ত