নিকুঞ্জ কানন পর্ব-০১

0
27

নিকুঞ্জ_কানন
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১

নিজের চেয়ে ১০ বছরের বড় বাবার বন্ধুর ছেলেকে বিয়ে করার কথা ভাবতেই চমকে উঠলো তরী। তাও আবার মাত্র আঠারো বছর বয়সে!

‎না না! এটা হতেই পারে না। এক নয় দুই নয় প্রায় গোটা দশেকের মতো বয়সের পার্থক্য!

‎পাত্রের নাম আহসান সারোয়ার। তরীর বাবার বাল্যবন্ধুর ছেলে। পেশায় ব্যবসায়ী;বাবার সঙ্গে ব্যবসার কাজ সামলায়। তবে, তরী মানুষটাকে ছোটবেলায় কয়েকবার দেখলেও; বড় হবার পর তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ এর সংখ্যা মাত্র দুই। তরী চোখ বন্ধ করে সেই স্মৃতিচারনের চেষ্টা করলো। আবছা আবছা কিছু বিষয় মনেও পরলো। লোকটা উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের;চেহারার গঠন লম্বাটে। কন্ঠস্বর বেশ ভারী। মুখমন্ডলে ছিল অকৃত্রিম আভিজাত্যের ছাপ।আহসান নামক লোকটির কথা ভাবতেই তরীর সর্বাঙ্গ সহসাই কেঁপে উঠলো! চোখ খুলে সে এদিক ওদিক তাকালো। এরূপ অপরিচিত আগুন্তকের সঙ্গে সে কীভাবে সারাজীবন কাটাবে? কথা তো দূরে থাক লোকটির দিকে সে কখনো মাথা তুলে সরাসরি তাকিয়েও দেখেনি। যেটুকু অবলোকন করেছে তাও ঘটেছে আড়চোখে। তবে? তরী আর কিছু ভাবতে পারলো না।
‎এক দৌড়ে ছুটে গেল মা মনোয়ারার কাছে। মনোয়ারা চাল থেকে কংকর বাছতে ব্যস্ত তখন। নিজের ইতস্তত বোধ কাটানোর সহায়ক হিসেবে; তরী ওরনার আঁচল হাত দিয়ে মোড়ামুড়ি করতে লাগলো। মনোয়ারা স্বল্প আওয়াজ পেয়ে মেয়ের দিকে ফিরে তাকালো। তরীর মাথা নিচু দেখে কিছুটা আন্দাজ হয়তো করেই ফেললো। মায়ের মন বলে কথা। তরী ভীত স্বরে বললো,

‎” আমি কিছু বলতে চাই।”

‎মনোয়ারা জবাবে বললেন,

‎” বলো। আমি তো মুখ বেঁধে রাখিনি তোমার। ”

‎তরী মাথা নিচু করে বললো,

‎” বিয়ের বিষয়ে কথা বলতে চাই।”

‎মনোয়ারা চালের পাত্র ছেড়ে সোজা হয়ে বসে মেয়ের দিকে তাকালেন। তরী এবার মায়ের কাছে এসে বসলো। ইতস্তত বোধটা যেন কিছুটা কমলো তাঁর। শান্ত গলায় বললো,

‎” আমি এই বিয়েটা করতে চাই না।”

‎মনোয়ারা প্রতুত্তরে বললেন,

‎” কেন? পাত্রের ভেতরে কোনো কমতি আছে? স্বভাবে কোনো দোষ দেখেছো কী?”

‎তরী আড়ষ্ট হয়ে বললো,

‎” আমি আরো পড়তে চাই; জানতে চাই। বিয়ে হলে পড়াশোনার কী হবে?”

‎মনোয়ারা শান্ত স্বরে বললেন,

‎” পড়াশোনার ব্যাপারে কখনো বাঁধা দেইনি। ভবিষ্যতেও কোনো বাঁধা দেবো না। পড়াশোনার ব্যাপারে পাত্রপক্ষেরও কোনো দ্বিমত নেই। ইচ্ছে থাকলে বিয়ের পরেও পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়া যায়। আহসান তো বাচ্চা আর ছেলে নয় যে তোমার বইখাতা কুটিকুটি করে ছিঁড়ে দেবে।”

‎তরী অত্যন্ত নরম স্বরে বললো,

‎” ওনার বয়সটা খুব বেশি। গুনে গুনে আমার চেয়ে দশ বছরের বড়।

‎মনোয়ারা উত্তরে বললেন,

‎”আমার আর তোমার বাবার বয়সের পার্থক্যও দশ বছর। তবুও কী আমাদের মধ্যে কোনো অশান্তি, ঝগড়া বিবাদ দেখেছো কখনো?”

‎তরী নিচু স্বরে বললো,

‎ “কিন্তু আমি তো প…”

‎মনোয়ারা আর বাকি কথাটুকুও শোনার অপেক্ষা করলেন না। কঠিনস্বরে বললেন,

‎” পড়াশোনার বিষয়টা তোমার নিছকই বাহানা। পাত্র তোমার পছন্দ হয়নি এই তো? তবে, কেমন পাত্র চাও? রাজপু্ত্র? ঘোড়ায় চড়ে পরীর দেশ থেকে তোমায় নিতে আসবে? এসব অহেতুক আশাকে মন থেকে বিতারিত করো। রাজপুত্র বিয়ে করতে হলে তোমাকেও রাজকন্যা হতে হবে। তুমি কী রাজকন্যা? ”

‎তরীর দিকে প্রশ্নের বান ছুঁড়ে দিতেই তরী; এদিক ওদিক মাথা দুলিয়ে না বোঝালো। মনোয়ারার কন্ঠস্বর এবার কিছুটা নরম হলো। মেয়েকে কোমল হয়ে বললেন,

‎” বাবামরা মেয়েদের এই সমাজে কেউ মূল্য দেয় না মা। তোমার বাবা আমাকে নিঃস্ব করে দিয়ে চলে গেছেন। বাড়িতে এখন কোনো পুরুষ মানুষ নেই। তোমাকে আর গুনগুনকে বুকে জড়িয়ে ধরে ভয়ে রাত কাটাতে হয়। পাছে যেন কেউ আঁচড় অবধি না কাটতে পারে! আমার কিছু হয়ে গেলে গুনগুনকে বা তোমাকে কে দেখবে? জানি আমাকে হয়তো এখন তোমার খুব কঠিন হৃদয়ের পাষান বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু, আমি তোমার ভালো বৈ মন্দ ভাবছি না। তোমার বড় চাচা তাঁর জুয়াড়ি ছেলের সঙ্গে তোমার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। আমি একা তোমায় সূরক্ষিত রাখতে পারবো না। ভেবে নাও আমি নিজের জায়গায় আহসানকে রেখে তাঁর হাতে তোমাকে তুলে দিচ্ছি। এইটুকু বিশ্বাস আমাকে করতে পারবে না?”

‎তরী কোনো জবাব দিলো না। মায়ের যুক্তির কাছে সে হেরে গেছে। শুধু মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বোঝালো।

‎ মনোয়ারা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। স্বামী হায়দারকে হারানোর পর থেকে সংসারে একের পর এক ঝামেলা যেন লেগেই রয়েছে। বাড়ির কর্তা ব্যাতীত দুটি সন্তানকে এক হাতে মানুষ করা চাট্টিখানি কথা নয়। হায়দার গত হয়েছেন ছয় মাস তবে;মনোয়ারার মনে হয় এটা যেন মাস নয় বছর। সম্পদ নিয়ে হায়দারের ভাই বোনেদের দ্বন্দ্ব বিবাদের অন্ত নেই। অপরদিকে হায়দারের বড় ভাই হারুনের চোখ পড়েছে নিজ ভাতিজী তরীর দিকে। যেকোনো মূল্যে তরীকে নিজের নেশারু জুয়ারি ছেলের বউ করে ঘরে তুলতে চান। হায়দার বেঁচে থাকাকালীনও হারুন বেশ কয়েকবার প্রস্তাব পাঠিয়ে ছিলেন। হায়দার তা কৌশলে এড়িয়ে গেছেন। কেউ কী চাইবে নিজের মেয়েকে অমন অপাত্রের হাতে তুলে দিতে? পরিস্থিতি আজ হাতের বাইরে চলে গেছে। হারুন বিভিন্ন কলাকৌশলে তরীকে হাত করতে চাইছেন। তরীর পেছনে যেন উঠে পড়ে লেগেছেন। তাই, পরিস্থিতি সামাল দিতে হায়দারের ছোটবেলার বন্ধু ও ব্যবসায়ের সঙ্গী; মাজদাক সারোয়ারের বিবাহ যোগ্য ছেলের সঙ্গে নিজ কন্যার বিয়ে ঠিক করেছেন মনোয়ারা। হায়দারের কাছে সে অনেকবার শুনেছে আহসানের কথা;সরাসরি দেখেছেও। আচরনে গগন-চুম্বী নম্রতা ভদ্রতা। মিষ্টভাষী ও বেশ হাসিখুশি। একেবারে তরীর জন্য সুযোগ্য পাত্র! আহসানকে হাতছাড়া করার মতো ভুল মনোয়ারা করতে চাননি। নিজে থেকে বিয়ের কথা তুলতেও বড্ড ইতস্তত বোধ করছিলেন। কিন্তু অদৃষ্টের কী লিলাখেলা!মনোয়ারাকে বিষ্মিত করে দিয়ে মাজদাক ও মাজদাক গিন্নি শোভা আহসানের জন্য তরীকে চেয়ে বসলেন কোনো দাবিদাওয়া ছাড়াই। যোগ্য পাত্রকে হাতের মুঠোয় পেয়ে মনোয়ারাও আর বিলম্ব করলেন না। বিয়ের পাকাপোক্ত কথা শেষ করে দ্রুতই বিয়ের আয়োজন শুরু করলেন।

‎একগুচ্ছ অনিচ্ছা নিয়ে তরী বিয়েতে রাজি হলো। নিতান্তই মায়ের কথা ভেবে তাঁকে বিয়েটা করতে হচ্ছে। নাহলে, তাঁর চেয়ে বয়সে এত বড় একটা লোককে বিয়ে করতে বয়ে গিয়েছিল! তরীর বান্ধবীরা তাঁর বিয়ের কথা শুনে হেসে কুটিকুটি! তরী বারবার বলতো পড়াশোনা পর্ব চুকিয়েই সে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে। আজ তাঁর সেই মিথ্যে অহংকার চূর্ণ হবার পথে। তরীর বান্ধবীরা যখন তাঁর বিয়ে নিয়ে খুচরো আলাপে ব্যস্ত। তরী তখন মন খারাপে আসক্ত। আজ তাঁর বাবা বেঁচে থাকলে কখনোই তাঁকে এরূপ পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না।

‎” কীরে বউ! সাজের বহর তো ভালোই দেখছি;যেন এক লালপরী। এত সেজেগুজে লাভ কী? রাতে তো দুলাভাই সবকিছুর ওপরে তান্ডব চালাবে।”

‎তরী নিজের বান্ধবী মিশ্মির এরূপ বক্তব্য শুনে মুখ নামিয়ে নিলো। অন্যরা হেসে ফেললেও তরী হাসলো না। কিংবা লজ্জা পাওয়ার ভানও করলো না। খুব গম্ভীর করে বসে রইলো। কাঁটার মতো বিঁধছে তাঁর গায়ে কথাগুলো।তবে, তরীর বান্ধবীগনের হাসিঠাট্টা বেশিক্ষন স্থায়ী হলো না। মনোয়ারা এসে সকলকে বললেন,

‎” কাজী সাহেব নিচে এসে বসে আছেন। বরযাত্রা ও এসে গেছে। তাড়াতাড়ি তরীকে নিচে পাঠা।”

‎মনোয়ারার তাড়া খেয়ে তরীকে নিচে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। তরী নিচে গিয়ে বসতেই কাজি সাহেব বিয়ে পড়াতে শুরু করলেন। তরী মাথা নিচু করে বসেই রইলো। তরীর অপর পাশে বরের বেশে বসে থাকা আহসানকে একবারও মাথা উঁচু করে দেখার প্রয়োজনও বোধ করলো না। কবুল বলার ঠিক আগমুহূর্তে তরী মাথা তুলতেই পরস্পরের চোখাচোখি হলো। তরী মুহূর্তেই নিজের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো। সরাসরি না বললেও তরী চোখের ভাষাই বলে দিতে সক্ষম ছিল যে সে এই বিয়েতে রাজি নয়।

‎অতঃপর দুই পক্ষের সম্মতি দান ও কবুল বলার মাধ্যমে বিয়ে কার্য সম্পাদন হলো। মনোয়ারা তরীর দিকে তাকিয়ে চোখ মুছলেন। তরীর বিয়ে নিয়ে হায়দারের কত স্বপ্ন ছিল। সবসময় বলতেন তরীকে তিনি রাজপুত্রের সঙ্গে বিয়ে দেবেন। তরী পড়াশোনা করে অনেক বড় হবে। মনোয়ারা কখনোই ভাবেননি হায়দার চলে যাওয়ার পর সবকিছু এভাবে এলোমেলো হয়ে যাবে। তরীর বিয়েতে তাঁর চাচা ফুপিদের দাওয়াত করলেও হারুনের জের;ধরে তাঁরা কেউ-ই আসেননি। পাড়া প্রতিবেশী ও স্বল্প মানুষ নিয়েই বিয়েটা হয়েছে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই তরীর বিদায় বেলা এগিয়ে এলো। বিদায়ের সময়ে মা মেয়ে উভয়ের কান্না দেখে সকলের চোখেই পানি চিকচিক করছিল। নয় বছরের ক্লাস ফোরে পড়ুয়া অবুঝ গুনগুন তো কিছুতেই বোনকে ছাড়তে চাইছিল না।নিজের নরম কোমল হাত দিয়ে তরীর শাড়ির আঁচল আগলে বসে রইলো। কিন্তু, বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারলো না। তরী কাঁদতে কাঁদতে গাড়িতে গিয়ে বসলো। গাড়ির মাঝ বরাবর সিটে বসেছে সে। বাম সাইডে বসেছে আহসান নামক এক অসহ্য লোক। ডান সাইডে একটা কম বয়সী মেয়ে। খুব সম্ভবত সে আহসান সাহেবের বোন। তরী সেদিকে তেমন মনোনিবেশ করলো না। তাঁর এখন বুক ফেটে যাচ্ছে! চেনা মুখগুলোকে ছেড়ে যেতে তাঁর বড্ড কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা, গুনগুন কীভাবে তাঁকে ছাড়া থাকবে? তরীও যে গুনগুনকে না জড়িয়ে ধরলে ঘুম আসে না। এসব ভেবে তরীর চোখে আবারও জল এলো। ফুঁপিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে উঠলো সে। এবার এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটলো! বাম পাশ থেকে একটা হাত আকাশী রঙের রুমাল এগিয়ে দিলো তরীর দিকে। তরী ঝাপসা চোখে নিজের বাম পাশের দিকটায় তাকালো। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের একজন পুরুষ। ললাটে তাঁর বিন্দু বিন্দু ঘাম। থুঁতনিতেও বেশ কিছুটা ঘামের ছিটেফোঁটা দেখা যাচ্ছে। কালো চোখের মনির চারিপাশে অবাধে বিচরণ করছে ঘন পাপড়ি। তরী ক্ষনিকের জন্য সবটা ভুলে গেল। ব্যাক্তিটি তরীকে ফের বিষ্মিত করে দিয়ে বললো,

‎” কেঁদো না।”

‎ভারী পুরুষালী কন্ঠ শুনে তরীর ঘোর কাটলো। মুহূর্তের মাঝেই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে; কাঁপা কাঁপা হাতে রুমালটা দিয়ে চোখ মুছলো। পুরোটা পথে সে একবারও নিজের বাম পাশে ঘুরে তাকিয়ে দেখবার প্রয়োজন অবধি বোধ করলো না।

‎ কিছুসময় অতিবাহিত হওয়ার পর আহসানদের বাড়ির সামনে এসে গাড়িটা থামতেই সকলে যেন তরীকে ঘিরে দেখলো। তরী ভয়ে উদ্বিগ্নতায় কিছুটা পিছিয়ে গেল। ঘোমটার ফাঁকে মাথা উঁচু করে চারিপাশটা ভালো করে দেখলো। এটার নামই বুঝি শশুর বাড়ি? তরীর ভাবনার সূতায় কাটা পরলো। একজন বৃদ্ধ নারী তরীর সামনে আসতেই মাজদাক তরীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‎” মা এটা তোমার দাদী শাশুড়ী মধুবিবি।সালাম করো তাঁকে। ”

‎তরী মাথা ঝুঁকিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করার আগেই মাজদাক ফের বললেন,

‎” আহা! এভাবে মাথা নিচু করে সালাম করতে নেই। তুমি সাধারণ ভাবেই সালাম দাও।”

‎তরী একটা লম্বা সালাম দিলো। মধুবিবি সালামের জবাব নিতেই তরী আলতো ভাবে ঢোক গিললো। কেমন যেন ভয় লাগছে তাঁর। মধুবিবি এগিয়ে এসে, নিজ গলা হতে একটা মোটা সোনার হার খুলে; তরীর গলায় পড়িয়ে দিয়ে বললেন,

‎” এই হার যত্ন কইরা রাইখো। আমাদের বংশের ধারা এইটা। তুমিও তোমার নাতীর বউরে এইটা তাঁর বিয়ার দিনে পড়ায়া দিবা। তোমার কাছে আমানত রাখলাম।”

‎তরী মাথা নাড়লো। সিরিয়ালে সে দেখেছিল নায়িকার বিয়ে হওয়ার পর নায়কের দাদী কথায় কথায় নায়িকাকে অপমান করে। সংসারে শুধু অশান্তি করে। কিন্তু বড় বিষ্ময়কর বিষয় তরীর এই বৃদ্ধাটিকে মোটেও সেরকম মনে হচ্ছে না। আশ্চর্য! উনি এখনও তরীকে অপমান কেন করছেন না? রগচটা স্বরে কেন বলছেন না যে,

‎” তোমাকে আমি এই বাড়ির বউ হিসেবে মানি না। এক্ষুনি বেড়িয়ে যাও এই বাড়ি থেকে” এই বাড়িতে তোমার কোনো ঠাঁই নেই।”

‎ বিয়ে উপলক্ষে রুমির কাজের শেষ নেই। এঘর থেকে ওটা আন! সেই ঘর থেকে সেটা আন! সব তো তাঁকেই করতে হচ্ছে নাকি? নতুন বউয়ের জন্য শরবত নিয়ে যাওয়ার পথে বিরাট জোরে ধাক্কা খেলো সে। ভারী ট্রে হাতে রুমি বড় বড় চোখে দেখলো। এটা আর কেউ নয়! ভাইয়ার একটা বাঁদর বন্ধু আছে। তাঁর নাম রঙ্গন। এই বাঁদরটাকে বিয়েতে দাওয়াত দেয়ার কী প্রয়োজন ছিল? লেজকা’টা বাঁদর!

‎ শোভা আর আহসানের বোন রুমি তরীকে একটা ঘরে বসিয়ে রেখে গেছে। ফুল নামক বস্তুর প্রতি তরীর ছোটবেলা থেকেই এক বিশেষ দূর্বলতা রয়েছে। কিন্তু আজ যেন সবকিছু কেমন ম্লান লাগছে। পুরো ঘর ফুল দিয়ে সাজানো তবুও তরীর সেসবের প্রতি বিন্দু পরিমাণ আগ্রহ কাজ করছে না। বরং ইচ্ছে হচ্ছে হাত দিয়ে সব কুটিকুটি করে ছিঁড়ে দিতে। বিছানার মাঝে আবার ফুল দিয়ে লাভ বানানো হয়েছে। তাতে লিখা রয়েছে এ প্লাস টি। এ মানে আহসান টি মানে তরী। তাঁদের দুজনের নামটা কী তবে একসঙ্গে জুড়ে গিয়েছে? ঘরে তরী ব্যাতীত কেউ নেই। দরজার বাইরে থেকে অনেক হইহট্টগোলের আওয়াজ আসছে। তরীর অবশ্য সেদিকে মন নেই। গুনগুনের কাঁদো কাঁদো মুখখানা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই তরী ফের কেঁদে ফেললো। কপোল ছুঁয়ে নোনা পানির স্রোত গেল। পেয়ে তরী বড় একটা ঘোমটা তুলে সটান হয়ে বসে রইলো। ঘোমটার আড়ালে টলটলে অশ্রু মুছতে ব্যস্ত হয়ে গেল সে। হঠাৎ কী যেন ঠিক নড়ে উঠলো! তরী ভয়ে সিলিংফ্যানের দিকে তাকালো। শৈশবের ভয় যেন মাথাচাড়া দিয়ে মনের ভেতরে ঢুকে গেল। সিলিংফ্যানটা খুলে পরবে না তো গায়ে? তবে, ঘটনা ঘটলো তাঁর ঠিক উল্টো! সিলিংফ্যানের কিছুই হলো না। বিকট শব্দে তরীর যে-ই বিছানার ওপরে বসে ছিল সেটা ভেঙে গেল।তরী ভয়ে ছিটকে বিছানার অপর হাতলটা ধরে এক প্রকার নিজেকে বাঁচিয়ে নিলো। অযাচিতভাবে প্রখর শব্দের আওয়াজে সবাই সেই ঘরে হানা দিলো। দরজা দিয়ে বড় ছোট সকলেই উঁকিঝুঁকি দিয়ে তরীকে দেখতে লাগলো। সেই মুহূর্তে পুরো বাড়িতে রটে গেল ‎❝নতুন বউ খাটের ওপরে বসে খাট ভেঙে ফেলেছে!❞

চলবে…..