নিকুঞ্জ কানন পর্ব-০৫

0
26

‎#নিকুঞ্জ_কানন
‎#নুজহাত_আদিবা
[পর্ব ৫]

‎তরী কলেজ ড্রেস পড়ে আয়নার সামনে বসে বিনুনি বাঁধছে। আহসান চোখ ফিরিয়ে ফিরিয়ে কয়েকবার তাঁকে দেখলো। দেখতে যেন ছোট্ট খুকিটি লাগছে। সাদা কলেজ ড্রেস মাঝে সিঁথি করে দুপাশে বিনুনি বাঁধা। কাল রাতেও না শাড়ি পড়ে এই মেয়েটাকে পাকা গিন্নী লাগছিল? আজ আবার খুকিদের মতো লাগছে কেন?

‎নাস্তা করে তরীকে নিয়ে বের হলো আহসান। সেদিনের মতো সাই করে তরীকে কলেজের গেটের সামনে রেখে এলো। তরীকে বিদায় জানাবার সময় তরী লাজুক মুখে বললো,

‎” আপনি কী ছুটি হলে আমাকে নিতে আসবেন?”

‎কী নির্মল সেই চাহনি! আহসান যেন চোখ ফেরাতেই পারলো না। অতি শক্ত হৃদয়ের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও তরীর কাছে হার মানলো সে। তরীর সঙ্গে কথা বলতে গেলেই কথা যেন দলা পাঁকিয়ে যায় তাঁর। ক্লাসে প্রেজেনটেশন দেওয়ার সময়েও কথা বলতে এতটা আড়ষ্টতা কাজ করেনি। যতটা এখন কাজ করে। আহসান আমতাআমতা করে বললো,

‎” আসবো।”

‎আহসান বাইক ঘুরিয়ে চলে যাবার সময় তরী হাত নেড়ে টা-টা দিলো। লুকিং গ্লাসে সেটা দেখে আহসান মৃদু হাসলো। পরোক্ষনেই বুকে কেমন যেন পীড়াদায়ক অনুভূতির সৃষ্টি হলো। কিছু কী ফেলে যাচ্ছে সে?

‎তরীকে অচেনা আগন্তুকের সঙ্গে বাইকে করে; কলেজে আসতে দেখে ক্লাসের মেয়েদের চক্ষু চড়কগাছ! অবশ্য এতে তাঁদের পুরোপুরি ভাবে দোষ দেওয়াও যায় না। হাতে গোনা কয়েকজন বাদে তরীর বিয়ের খবর বান্ধবীমহলের সেভাবে কেউ জানে না। তরী ক্লাসে ঢুকতেই সকলে তাঁকে ঘিরে ধরলো। আজ সকলের মধ্যমনি তরী। সকলের মুখে একটাই প্রশ্ন। ওই বাইকের ছেলেটা কে? তরী লাজুকলতার মতো ইনিয়ে বিনিয়ে বললো,

‎” ওটা আমার বর। আর তোদের দুলাভাই। ”

‎মুহূর্তেই সকলে হা করে তরীর দিকে তাকিয়ে রইলো। তাঁরা কী ঠিক শুনলো? তরীর আসলেই বিয়ে হয়ে গেছে? এত তাড়াতাড়ি? সেদিন ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে সবাই তরীর থেকে বিয়ের গল্প শুনলো। টিফিনের ব্রেকেও তরী ছাড় পেল না। তবে, বাসররাতের গল্প শুনতে চাওয়ায় তরী কেমন মিইয়ে গেল। কথার ছলে বারংবার প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেল। কিন্তু, মেয়েদের কৌতুহল মোটেও কাটলো না। তরীর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ক্লাস ক্যাপ্টেন নাতাশা তো বলেই বসলো,

‎” এই তরী! বল না বাসর রাতে কী হয়েছিল? দুলাভাই কাছে এসেছিল তোর? চুমুটুমু খেয়েছিল? চুমু খেলে কেমন লাগে রে তরী? আদর করেছিল তোকে? ইন্টুপিন্টু হয়েছিল তোদের? ”

‎লাজে তরীর গাল লাল হয়ে গেল। সাদা স্কার্ফটা দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো সে। পাশ থেকে তরীর বান্ধবী সুহা এসে তরীকে সুরসুরি কেটে বললো,

‎” ভাইয়াকে দেখে তো মনে হলো তোর চেয়ে বেশ লম্বা। পেটানো শরীর ঠিক যেন ফিল্মের হিরোদের মতো। ওরকম শক্তপোক্ত শরীরের ভার সারারাত কী করে সইলি রে তরী?”

‎তরী দুইহাতে মুখ ঢেকে বসে রইলো। এই মেয়েগুলো কী সব আজেবাজে কথা বলছে! তরী কী করে তাঁদের বোঝাবে? যে ওই লোকটার সঙ্গে তরীর এখনও কোনো ইন্টুপিন্টু হয়নি। লোকটার সামনে গেলেই তো তরীর বুক কাঁপে। হাত কাঁপে আবার পা-ও কাঁপে। তাঁকে কী করে চুমু খাবে তরী? নাতাশা তরীর টুকটুকে গালে চিমটি কেটে বললো,

‎” শোন তরী, দুলাভাইকে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরবি। প্রথমে কানের লতিতে চুমু খাবি। তারপর পেছন ঘুরিয়ে সুরুৎ উম করে চুমুটা খেয়ে ফেলবি। উফ কী রোমান্টিক ব্যাপার!”

‎নাতাশার কথামতো দৃশ্যটা মনে মনে একবার কল্পনা করলো তরী। লাজে চোখ বড়বড় হয়ে গেল তাঁর। কী রোমাঞ্চকর ব্যাপার!

‎ছুটি হওয়ার আগে আগে বারবার কলেজের জানালার দিকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলো তরী। লোকটা এখনও আসছে না কেন? ক্লাসের মেয়েগুলোরও আজ কৌতুহলের অন্ত নেই। ক্লাস শেষ হলেই তাঁরা আজ আহসানের পিছু ধরবে। দুলাভাই হিসেবে একটু শায়েস্তা করবেই!

‎নির্ধারিত সময়ে ছুটির ঘন্টা পড়তেই সকলে দৌড়ে বের হয়ে গেল। তরী কলেজের বাইরে আসতেই দেখলো আহসান বাইক নিয়ে হাজির। তরী আহসানের কাছে পৌছানোর আগেই;দুষ্ট মেয়েগুলোর দল আহসানের নিকট ধেয়ে গেল। নাতাশা আহসানকে সালাম দিয়ে বললো,

‎” কেমন আছেন দুলাভাই? ”

‎আহসান সালামের জবাব নিলো। ফের বললো,

‎” আমি ভালো আছি। তোমরা কেমন আছো? তোমাদের পড়াশোনা কেমন চলছে? ”

‎নাতাশা কিছু বলার আগেই সুহা বললো,

‎” পড়াশোনার কথা বাদ দিন দুলাজান। আজকে শালীর দাবি নিয়ে আপনার কাছে এসেছি। এক দফা এক দাবি! মানতে হবে ;মানতে হবে।”

‎তরীর অপর ক্লাসমেট সোহাগী এসে বললো,

‎” আমার ভাই তোমার ভাই। আহসান ভাই আহসান ভাই। আহসান ভাইয়ের আগমন; শুভেচ্ছায় স্বাগতম। ”

‎আহসান মুচকি হেসে দুষ্টুমির ছলে বললো,

‎” তা আপনাদের দাবিটা কী?”

‎নাতাশা নির্দ্বিধায় জবাব দিলো,

‎” চাই তো আপনার সঙ্গে সিনেমা হলে গিয়ে মুভি দেখতে। কিন্তু, এখন তো আপনি বিবাহিত! কী আর করার? সব এই পোড়া কপালের দোষ। এখন ট্রিট দিয়ে আমাদের দুঃখ দূর করুন। আমরা ফুচকা খেতে চাই।”

‎আহসান মৃদু হেসে সায় জানালো। পাশের দোকানের ফুচকাওয়ালাকে বললো সবাইকে আজ মনমতো ফুচকা খাওয়াতে। তরী ফুচকার প্লেট হাতে নিয়ে মুখে ফুচকা পুরতে পুরতে দেখলো; ক্লাসের সবচেয়ে লুচু মেয়ে ববিতা হা করে আহসানের দিকে তাকিয়ে আছে। তরীর বড্ড হিংসে হলো! একটু আগেও নাতাশা আর সুহা যখন দূর থেকে আহসানের সঙ্গে কথা বলছিল। ববিতা তখন আহসানের গায়ে হেলে পরছিল। রাগে গটমট করতে করতে তরী ফুচকার বাটিটা শেষ করলো। কালকে ক্লাসে গিয়ে মেয়েটাকে আচ্ছা করে শায়েস্তা করবে। পাঁজি মেয়ে একটা! কত বড় সাহস তরীর বরের দিকে নজর দেয়! মেয়েটার মনে মনে অনেক প্যাঁচ। নেহাতই আহসান ভালো মানুষ বলে বুঝতে পারেনি। আহসানকে বাড়ি গিয়ে আজ সাবধান করে দিতে হবে। যেন ভবিষ্যতে এই লুচু মেয়েটার থেকে দূরে দূরে থাকে।
‎★
‎সন্ধ্যায় আহসান কাজ শেষে বাড়ি ফিরতেই; তরী বইখাতা নিয়ে পড়ার ঘরে গেল। আহসান চেয়ারে বসে মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে। তরীকে দেখামাত্রই বইটা রেখে সোজা হয়ে বসলো। তরী টেবিলের সামনে চেয়ারটা টেনে বসতেই আহসান বললো,

‎” রুমি কোথায়?”

‎তরী মিহিস্বরে বললো,

‎” রুমিকে ডাকতে গিয়েছিলাম। রুমির শরীরটা আজ ভালো নেই। খুব পেটে ব্যাথা আর মাথা ঘুরছে বললো।”

‎মেয়েলী সমস্যা ভেবে আহসান আর সেভাবে খুঁটিয়ে জানতে চাইলো না। তরীর বই খুলে পৃষ্ঠা উল্টে পাল্টে বললো,

‎” ইংরেজি কেমন পারো তুমি? ইংলিশে বেসিক ক্লিয়ার না থাকলে ফাইনালে কিন্তু বড়সড় ঝামেলায় পড়তে হবে।”

‎তরী কলম ঘোরাতে ঘোরাতে বললো,

‎” মোটামুটি পারি। কিন্তু, আমাকে বুঝিয়ে দিলে আরো ভালো পারবো।”

‎আহসান গ্রামার বই বের করে তরীকে সবটা বুঝিয়ে দিলো। লক্ষ্য করলো তরীর জ্ঞান খুব ভালো। অল্প বোঝালেই বুঝে যায়। বারবার রিপিট করতে হয় না। তরীকে হিসাব বিজ্ঞানের একটা অংক করতে দিয়ে আহসান হেলান দিয়ে বসলো। তরী খাতায় ছক কাটতে কাটতে বললো,

‎” মা বলেছিল আপনি আপনার বাবার ব্যবসা সামলান। পড়াশোনা ও নাকি শেষ। তাহলে, চাকরির বই দিয়ে কী করেন আপনি? আপনার বুঝি পড়াশোনা করতে খুব ভালো লাগে? ”

‎আহসান স্লান হেসে বললো,

‎” না ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। আমি বাবার ব্যবসা সামলাই এটা সত্য। কিন্তু, এটাকে আমি পেশা হিসেবে নিতে চাই না। বেকারত্বের হাত থেকে রেহাই পেতে ব্যবসাকে খুঁটি হিসেবে ধরেছি। বেকার শব্দটার অনেক ভার। আমি এত ভার বইতে পারবো না। সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করছি। পাশাপাশি বাবাকে ব্যবসায় সাহায্য করছি। এত কষ্ট করে বাবা পড়িয়েছেন আমাকে। আমি এত সহজে হাল ছাড়লে চলবে?”

‎তরী মন্ত্র মুগ্ধের মতো আহসানের কথা শুনলো। এই মানুষটা যখন গভীর মনোযোগে ঠোঁট নেড়েচেড়ে কথা বলে। তরীর তখন খুব ভালো লাগে।
‎অংকটা তরী নির্ভূল ভাবে শেষ করে খাতাটা আহসানের দিকে এগিয়ে দিলো। আহসান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অংকটা দেখলো। কোথাও একটুও ভুল খুঁজে পেলো না। লাল কলম দিয়ে আহসান রাইট দিলো খাতায়। তরীর মুখে জ্বলজ্বলে হাসি ফুটে উঠলো। সে পেরেছে হিহি! আহসান গম্ভীর স্বরে বললো,

‎” কাল থেকে আমরা টেস্ট পেপার সলভ করবো। নতুন টেস্ট পেপার না বের হওয়া অবধি পুরনোটা দিয়েই করবো। টেস্ট পেপার ধরে অংক কষলে ফাইনালে দূর্দান্ত একটা রেজাল্ট আসবে।”

‎তরী মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো। বইখাতা গুছিয়ে ওঠবার সময় আহসানকে বললো,

‎” আপনার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে।”

‎আহসান বিষ্মিত হলো! তরী তাঁকে এই কথা বললো? মনে তীব্র উচ্ছাস নিয়ে আহসান বললো,

‎” বলো কী বলবে।”

‎তরী অভিমানের সূরে বললো,

‎” কলেজে আমাকে আনতে গেলে আপনি আমার; ক্লাসের ওইসব মেয়ের সঙ্গে একদম কথা বলবেন না। আজ যখন আপনি দাঁড়িয়ে ছিলেন। ববিতা নামের একটা মেয়ে আপনাকে হা করে দেখছিল। সে কেন আপনাকে দেখবে?”

‎তরী মিষ্টি অভিমান আহসানের মনে শান্তি জোগালো। ঠোঁটে হাসি চেপে রেখে আহসান বললো,

‎” চোখ আছে তাঁর। তাই আমাকে সে দেখতেই পারে। কী করবো বলো?”

‎তরী কন্ঠে তীব্র প্রতিবাদ নিয়ে বললো,

‎” না দেখবে না সে আপনাকে। কেন দেখবে? কী অধিকার তাঁর? আপনাকে শুধু আমি দেখবো।”

‎তরীর বলা ❝আপনাকে শুধু আমি দেখবো। ❞ কথাটা শুনে আহসান পিলে চমকে উঠলো। বুকে ছুঁচ ফোটানোর মতো বিঁধে গেল যেন কথাটা। তরী কী অধিকার খাটাচ্ছে তাঁর ওপরে? তবে, খাটাক! তরীর পরিপূর্ণ অধিকার আছে তাঁর ওপরে। তরী-ই তো সম্পূর্ণ রূপে তাঁরই! তাঁর নয় কী? জীবনে এরূপ অধিকারের দাবীদারেরই অভাব ছিল তাঁর। আজ কী তরী সেটাও পূর্ণ করে দিলো? দিলো তো!
‎আহসান প্রতিত্তরে বললো,

‎” দেখলেই বা কী? যা তোমার তা দিনশেষে তোমারই থাকবে। তোমার জিনিস ছিনিয়ে নেবার সাধ্য আছে কী কারো?”

‎তরী ঢোক গিলে বললো,

‎” তবুও কেউ দেখবে না আমাকে। আপনাকে কেউ ওভাবে দেখলে আমার কষ্ট হয়।”

‎আহসানের বিস্ময় এক ধাপ ওপরে উঠে গেল। সে কী তবে তরীর কষ্টের কারণ হচ্ছে? তরী কী জানে না তরীকে কষ্ট পেতে দেখলে তাঁরও কষ্ট হয়? আহসানকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তরী-ই আবার বললো,

‎” আপনি বলেছিলেন না? কেউ আপনার সামনে কাঁদলে আপনার খুব কষ্ট হয়। বুকে কেমন চিনচিনে ব্যথা হয়। আমারও ঠিক সেরকম কষ্ট হয়। মনে হয় যেন আমি ম’রেই যাবো।”

‎আহসান তরীর চোখের দিকে তাকালো। চোখে টলটলে নোনা পানি। মিনিটখানেকের মধ্যেই হয়তোবা তা কপোল ছুঁয়ে গড়িয়ে পড়বে। সেই আদুরে চোখদুটোর দিকে তাকিয়েই আহসান বললো,

‎” যদি খুব কষ্ট হয় তাহলে সেটা বরং তুমি আমার সঙ্গে ভাগ করে নিও। আমি আমার ভেবে তুমিসহ তোমার দুঃখ বেদনাকেও আপন করে নেবো।”

‎তরী চাপাস্বরে বললো,

‎” মা বলেছেন বিয়ের পর নাকি স্বামী স্ত্রীকে;একে অপরের সুখ দুঃখকে ভাগাভাগি করে নিতে হয়। আপনি কী আমার সুখ দুঃখের ভাগ নেবেন?”

‎আহসান নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো,

‎” নেবো। তোমার দুঃখগুলো আমার হোক। বিনিময়ে আমার বরাদ্দের সকল সুখ তোমার হোক।”

‎তরী চোখ মুছে বললো,

‎” আপনি খুব বোকা! সবাই শুধু সুখ চায়;দুঃখ কেউ চায় না। আপনি নিজের সুখ ছেড়ে শুধু আমার দুঃখগুলোকে চাইলেন?”

‎আহসান দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললো,

‎” যা তোমার তা কী আমার নয়?”

‎সেদিন তরীর কী হলো সে নিজেও জানে না। রাতে আহসানকে শক্ত করে চেপে ধরে তাঁর পিঠে মুখ গুঁজে ঘুমালো। আহসান যা ইচ্ছে ভাবুক;তরীর অধিকার আছে তাঁর প্রতি!

চলবে…