#নিকুঞ্জ_কানন
#নুজহাত_আদিবা
[পর্ব ১০]
আহসানের মাথার ব্যান্ডেজটা আজ খুলে ফেলা হয়েছে। ক্ষতটা সেরে গেছে; তবে কালচে বর্নের একটা দাগ রয়ে গিয়েছে। হাতের কবজির আঘাতটাও ঠিক হয়ে গেছে। অসুস্থতার বাহানায় মাজদাক ছেলেকে ব্যবসার কাজে একদমই হাত লাগাতে দেননি। ঘরে শুয়ে বসেই দিন কেটেছে তাঁর এক প্রকার। কাজের মধ্যে অবশ্য একটা কাজ হয়েছে। জমিয়ে রাখা চাকরির পড়াগুলো শেষ করে ফেলেছে সে। আহসান সর্বোক্ষন বাড়িতে উপস্থিত থাকার দরুন রুমি এবং তরী উভয়কেই বেশ দৌড়ের ওপরে থাকতে হয়েছে। সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠতেই পারেনি তাঁরা!
আজ আগের রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে পরেছে আহসান। দীর্ঘদিন পর কাজে ফিরেছে সে। ঘরে শুয়ে বসে তাঁর এক প্রকার বিরক্তি ধরে গেছে। কী একঘেঁয়ে জীবন! অনেকদিন পর তরীকে পৌঁছে দিতে তরীর কলেজে গিয়েছিল আজ সে। এই কিছুদিন মাজদাকই তরী আর রুমিকে স্কুল-কলেজ থেকে আনা-নেওয়ার দায়িত্বে ছিলেন।
ব্যস্ততার ফাঁকে হঠাৎ আহসানের ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই অপরিচিত একটা নম্বর দেখতে পেলো সে। দ্রুত হাতে কলটা রিসিভ করে কানে তুললো সে। কয়েকবার ”হ্যালো” বললেও ওপাশ থেকে কোনো শব্দ পাওয়া গেল না। আহসান বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে কলটা কেটে দিলো। বেশ কিছুদিন যাবতই অপরিচিত নম্বর থেকে কল আসছে তাঁর ফোনে। তবে, রিসিভ করলে কারো শব্দ পাওয়া যায় না। কী অদ্ভুত ব্যাপার স্যাপার!
আজ কলেজ থেকে বের হয়েই বিজয়ের হাসি হাসলো তরী। কতদিন পর এই দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হয়েছে তাঁর। আহসান অসুস্থ হবার পর থেকে তরীকে মাজদাক কলেজ থেকে নিতে আসতো। যে-ই জায়গাটা আহসানের ছিল তা অন্য কাউকে দেওয়া অসম্ভব। আজ ক্লাসের ফাঁকে কতবার যে কলেজের বারান্দায় উঁকিঝুঁকি দিয়েছে তরী তাঁর হিসেব নেই। মনে তাঁর একটাই প্রশ্ন। আহসান কী এসেছে বাইক নিয়ে? তরীর ছটফটে কান্ড দেখে নাতাশাসহ সকলেই মুখ লুকিয়ে হেসেছে। বিয়ের পর স্বামীর প্রতি এরূপ অদৃশ্য সুঁতোর টান দেখতেও এতটা মধুর হয়?
★
আজ সন্ধ্যায় তরী কিংবা রুমি কেউই পড়তে বসলো না। বাসায় হঠাৎ আগন্তুকের বেশে মেহমান এসেছে। তরী অবশ্য এদের চেনে। এর আগেও দেখেছে সে তাঁদের। আহসানের বন্ধু হয় তাঁরা। আহসান অসুস্থতার সময়টুকুতে বেশ কয়েকবার এসেছে তাঁরা। বিয়ের দিন এদের আহসানের আশেপাশে দেখেছিল সে।আহসান বন্ধুদের দেখলেই প্রানখোলা হাসি জানিয়ে তাঁদের আমন্ত্রণ জানায়। এরপর আড্ডায় মত্ত্ব হয়ে দুনিয়া ভুলে যায়। তরী নাস্তার ট্রে হাতে রান্নাঘর থেকে বের হতেই; রুমি এসে অকস্মাৎ তাঁর হাত থেকে ট্রে-টা ছিনিয়ে নিলো। তরী হতবাক হয়ে রুমির দিকে তাকাতেই রুমি বললো,
” এত নাস্তা দিয়ে এদের সঙ্গে ঢং করতে হবে না ভাবী। এরা আস্ত ছোঁচা! ওই যে সবচেয়ে লম্বা করে যে ভাইয়ার সঙ্গে বসে আছে। সে সবচেয়ে বেশি ফা’জিল! বাকি দুইজন ভাইয়া ভালো। তবে, ওটা আস্ত একটা বদ! ভাইয়ার লাই পেয়ে আরো মাথায় উঠে বসেছে!”
তরী হতাশ হয়ে রুমির দিকে তাকিয়ে রইলো। লম্বা করে যিনি আহসানের পাশে বসে আছেন। তাঁর নাম রঙ্গন। পাশের দুজনের নাম সৌম্য আর অর্ক। প্রথম যেদিন তাঁরা বাড়িতে এসেছিল। আহসান নিজেই তাঁদের সঙ্গে তরীকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। এরপর থেকে তাঁরা কোনো প্রয়োজনে বাড়িতে এলে তরী-ই তাঁদেরকে নাস্তা দিয়ে আপ্যায়ন করে। রুমি অবশ্য আহসানের কোনো বন্ধুদের সামনে যায় না। শোভা-ই বারন করেন যেতে। একটা অবিবাহিত মেয়ের এভাবে ভাইয়ের বন্ধুদের সামনে যাওয়া মোটেও উচিত নয়। বলতে গেলে শোভা রুমির বিষয়ে একটু সংবেদনশীল।
রুমির বাক্য অগ্রাহ্য করেই তরী ড্রয়িংরুমে নাস্তার ট্রে-টা দিয়ে এলো। রঙ্গন, সৌম্য এবং অর্ক তরীকে দেখে ভাবী বলে সালাম দিলো। তরী লজ্জায় মাথা নামিয়ে ফেললো। বয়সে বড় তিনজন মানুষ তাঁকে ভাবী ভাবী বলে সম্মোধন করছে; বিষয়টা বড় লজ্জার! রুমি দূর থেকেই রঙ্গনকে দেখামাত্রই তাঁর অগোচরে রঙ্গনকে ভেংচি কাটলো। ছোটবেলায় ভাইয়ার সঙ্গে যখন এই রঙ্গন নামক ব্যাক্তিটি রুমিদের বাড়ি আসতো। রুমির তখন বেশ রাগ হতো। অর্ক এবং সৌম্যকে রুমি সেভাবে চেনে না। দূর থেকে অবয়বখানিই দেখেছে শুধু। আহসানের ভার্সিটি লেভেলের বন্ধু তাঁরা। তবে, রঙ্গনকে সে বেশ ভালোভাবেই চেনে। আহসানের স্কুল জীবনের বন্ধু সে। রুমি অবশ্য তাঁকে মোটেও পছন্দ করে না। বাড়িতে এলেই রুমির বিনুনি ধরে টানাটানি করতো সে। বাঁদর ছেলে!
তরী নাস্তার ট্রে রেখে চলে আসার সময়ই;সৌম্য নামের ছেলেটি তরী চলে গেছে ভেবে আহসানকে বললো,
” ভাবীকে নিয়ে কোথাও যাওয়ার প্ল্যান নেই বন্ধু? বিয়ে-শাদি করেছো হানিমুন বলেও তো একটা ব্যাপার আছে নাকি? এতদিন মাথা ভেঙে পড়েছিলে বিছানায় তাই আর বলা হয়নি। কিন্তু, এখন ভাবীকে নিয়ে কোথাও ঘুরে আসা উচিত তোর। এরপরে বাচ্চা-কাচ্চা এলে দূরত্ব আরো বাড়বে দুজনের মাঝে। নিজেদের মধ্যে ডুবে থাকার এটাই মোক্ষম সময়।”
আহসান মাথা চুলকে বললো,
” আসলে কাজের প্রেসারে এতসব নিয়ে ভাবা হয়নি। তরীর পড়াশোনার ক্ষতি হবে ভেবে আর আগাইনি ওদিকে। পরীক্ষা-টা শেষ হোক তারপর যাবো নাহয়।”
বন্ধু সমাজে অর্ক নিজ বিটলামির জন্য বিটলা নামে বেশ পরিচিত। আজও তাঁর ব্যাতিক্রম ঘটলো না। নিজ নামের মর্যাদা সে ফের প্রমান করলো। বাঁকা হেসে আহসানকে বললো,
” পরীক্ষার আশায় বসে থাকলে কিচ্ছু (কিছু) হবে না বন্ধু। যাবা নাকি ভাবীকে নিয়ে লিটনের ফ্ল্যাটে? চাবি লাগবে চাবি?”
অর্কের কথার মানে ধরতে পেরে; আহসান সোফা থেকে উঠে অর্কের পিঠে জোরেশোরে একটা চাপড় বসালো। অর্ক হাসতে হাসতে রঙ্গনের পিছু গিয়ে লুকিয়ে পরলো।
অর্ক, সৌম্য ও রঙ্গন রাতে খেয়েদেয়েই বাড়ি ফিরলো। শোভা তাঁদের না খেয়ে ফিরতে দেয়নি। ছেলের বয়সী তিনটি ছেলে যে তাঁরই ছেলের সমতুল্য। বিপদে আপদে আহসানের পাশে ওদের সবসময় দেখেছে শোভা।
রঙ্গনের উপস্থিতি অনুমান করে রুমি এতটা সময় মধুবিবির ঘরে লুকিয়ে ছিল একপ্রকার। আহসানের বন্ধুরা চলে গেছে ভেবে যে-ই;না রুমি মধুবিবির ঘর হতে বের হলো। সেই রঙ্গনের সামনে পড়েই গেল সে! রঙ্গন তখন বাইকের চাবি গুটিয়ে বের হচ্ছে সবে। যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সবার আগে সন্ধ্যে হয়! মধুবিবির ঘরটাও অতি বাজে একটা জায়গায় পড়েছে। পুরো বাড়ি শেষে একেবারে মেইন গেটের মুখোমুখি। আরেকটু পর বেরুলোই তো পারতো সে। তাহলে আর রঙ্গন নামক অনামুখোটার সঙ্গে তাঁর দেখা হতো না! রুমি রঙ্গনকে অবলোকন মাত্রই দরজার পাশ কেটে লুকিয়ে পরতে চাইলো। বিশেষ লাভ হলো না তাতে। রঙ্গন ফাঁকা গলায় নিম্নসূরে বলেই ফেললো,
” খামচি রানী কর-করানী”
রুমি রাগে গজগজ করতে করতে হেঁটে চলে এলো। পিছু ফিরে একবার চাইলো না অবধি। অবশ্য পিছু ফিরলে রুমির মেজাজের বারোটা হতে তেরোটা খুব সহজে বেজে যেতো! রঙ্গনের ওই বিটকেলের ন্যায় হাসি দেখার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়। রুমির জীবনে খামচি রানী শব্দটির উৎপত্তি বহুপূর্বেই ঘটেছে। রঙ্গনের সঙ্গে শুরু হতেই রুমির শিশুমনের বেজায় দ্বন্দ্ব। বিনুনি ধরে রঙ্গনের টানাহেঁচড়া বিশেষ পছন্দ ছিল না তাঁর। সেকারণেই তো একবার জেদের বশে রঙ্গনকে নিজের ধারালো নখ দিয়ে এমন খামচি দিয়েছিল সে। রঙ্গনের বাম হাতের ওপরের পিঠের চামড়া ভেদ করে রগরগে তরল রঞ্জক পর্দাথের সূত্রপাত ঘটেছিল। এরপরও বেহায়াপনা এক ছটাকও কমেনি তাঁর। এরপর হতে রুমিকে দেখলেই দূর হতে খামচি রানী বলে টিপ্পনী কাটে তাঁকে। রুমির বড্ড অসহনীয় লাগে এই ডাকটা। কেমন যেন একটা নাম। খামচি রানী কর-করানী! ছিহ!
রঙ্গন বাইক নিয়ে ফেরার পথে আহসানদের বাড়ির; ফটক দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো বেশ খানিকটা সময়। রুমি মেয়েটা বোঝে না তাঁকে? একটা বার পেছন ফিরে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলে খুব বেশি খারাপ হতো কী? বাইকের লুকিং গ্লাসে নিজেকে আলতোভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একবার দেখলো রঙ্গন। দেখতে এতটাও বাজে নয় সে। এলাকার বহু সুন্দরী সুশীলা রমনী দিনরাত হাবুডুবু খায় তাঁর প্রেমে। এই রুমি মেয়েটাই বড্ড পাঁজি! দুই পয়সার দামও দেয় না তাঁকে। রুমির কোন বাড়া ভাতে ছাই ফেলেছে সে? তাঁকে দেখলেই মুখটাকে অহেতুক কুঁচকে রাখার মানে কী? দুষ্টু মেয়ে রুমিঝুমি!
★
আহসান আড্ডার পাট চুকিয়ে ঘরে ফিরতেই; তরীকে বিছানায় ওপরে পা দুলিয়ে বসে থাকতে দেখে বিষ্মিত হলো। অনেক রাত হয়েছে ;সকালে যে ক্লাস আছে সে-কথা কী ভুলে গেছে আনমনা মেয়েটা? আহসান নরমসূরে শুধালো,
” ঘুমাতে যাওনি এখনও? সকালে ক্লাসে যেতে হবে না?”
তরী বিছানায় হেলান দিয়ে বেনীর আগা ঘোরাতে ঘোরাতে বললো,
” যাবো, দাদীমা ডেকে গেছেন। এক্ষুনি চলে যাবো।”
মিনিটখানেক নীরব থেকে তরী নিজেই ফের বললো,
” আচ্ছা, আপনি কী কোথাও যাচ্ছেন?”
আহসান চমকিত হয়ে প্রত্যুত্তর করলো,
” কই না তো!”
তরী ঠোঁট কামড়ে বললো,
” মিথ্যে বলছেন কেন? ওই যে ওই ভাইয়াটা যে বললো আপনি লিটনের ফ্ল্যাটে যাচ্ছেন। মা বলেছে বিয়ের পর বরের সঙ্গে সঙ্গে থাকতে হয়। আমিও যাবো আপনার সঙ্গে লিটনের ফ্ল্যাটে। প্লিজ! আমাকেও আপনার সঙ্গে লিটনের ফ্ল্যাটে নিয়ে চলুন না!”
তরী আকুতি শুনে আহসান হতবাক হয়ে মাথায় দিয়ে বসে পরলো! একি অবস্থায় পরলো সে? এই মেয়ে লিটনের ফ্ল্যাটের মানেই বোঝেনি। সবকিছু ফেলে এখন তরীকে নিয়ে লিটনের ফ্ল্যাটে ছুটতে হবে? ছি ছি ছি! অর্ককে কয়েক দফায় মনে মনে গালমন্দ করলো আহসান। তরী সেসব সম্পর্কে অবগত নয়। সে তখনও আহসানের পরিহিত পাঞ্জাবীর হাতা খামচে ধরে; লিটনের ফ্ল্যাটে যাওয়ার জন্য অনুনয়-বিনয় করতে ব্যস্ত। আহসান হতাশ, হতবাক! এতকিছু বাদ দিয়ে শেষমেশ লিটনের ফ্ল্যাট?
চলবে…