নিকুঞ্জ কানন পর্ব-১১+১২

0
26

‎#নিকুঞ্জ_কানন
‎#নুজহাত_আদিবা
[‎পর্ব ১১]

‎ফোনের ক্রিং ক্রিং শব্দে আহসানের ঘুম ভাঙ্গলো। তড়িঘড়ি করেই ফোনটা সে কানে তুললো। কয়েকবার হ্যালো বললেও অপর প্রান্ত থেকে কোনো জবাব এলো না। আহসান প্রচন্ড বিরক্ত বোধ করলো। এই সাত সকালে এভাবে ফোন দেওয়ার মানে কী? ফোন দিয়ে আবার কথাও বলছে না। কী আজব বিষয়! অতঃপর ক্ষুদ্ধ হয়ে কলটা সে নিজেই কেটে দিলো। প্রায়ই ব্যবসার প্রয়োজনে অপরিচিত নম্বর হতে মাল খরিদদারদের কল আসে। সেকারণেই অপরিচিত নম্বরের কলও ধরতে হয় তাঁকে। তবে, বিগত কিছুদিন যাবত এই কল দিয়ে লুকোচুরি খেলার ঘটনায় সে প্রচন্ড অসন্তুষ্ট! এটা রীতিমতো একধরনের প্রতারনা। সময়ে অসময়ে কল দিয়ে সময়ের বিঘ্ন ঘটানোর মানে কী? অপ্রয়োজনে এসব কর্ম সাধন কী বাঞ্ছনীয়?
‎★
‎আজ শুক্রবার স্কুল, কলেজ সব বন্ধ। রুমি তরী সকাল থেকেই কী নিয়ে যেন মহাব্যস্ত। দুজনকে নাস্তার টেবিলেও গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করতে দেখা গেছে। আহসান সেসব নিয়ে অবশ্য মাথা ঘামায় না। একসঙ্গে আছে মিলেমিশে থাকাটাই সবচেয়ে বড় কথা। আহসান বিছানার তোশকের নিচ থেকে টাকার বান্ডিল বের করে হিসাব কষতে বসলো। সচারাচর যেদিনকার হিসাব সেদিনই সে কষে ফেলে। তবে, কাল বাড়ি ফিরতে দেরি হয় গেছে বিধায় ক্লান্ত শরীরে এত ধকল পোষায়নি। সহসাই তরী ঘরে এলো। আহসানকে এত টাকা গুনতে দেখে সে বিষ্মিত হয়ে বললো,

‎” আচ্ছা, আপনি কী অনেক বড়লোক?”

‎আহসান মাথা উঁচু করে এক পলক তাকিয়ে রইলো তরীর দিকে। চোখেমুখে তাঁর বেশ উৎকন্ঠা। আহসান তরীর প্রশ্নের উত্তর দিলো না। নিজেই আরেক দফা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বললো,

‎” হঠাৎ এটা কেন মনে হলো?”

‎তরী আমতাআমতা করে বললো,

‎” আপনার কাছে অনেক টাকা আছে। তাই মনে হলো…..”

‎আহসান তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। টাকাগুলো ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে তরীর দিকে এগিয়ে এলো। ঠান্ডা গলায় বললো,

‎” যদি টাকার অংকে মাপো তাহলে বলবো তুমি ভুল। আমি বড়লোক নই। তবে, যদি সুখ, শান্তি ও সাচ্ছন্দ্যকে পরিমাপ করো তাহলে আমি অনেক বড়লোক। একটা সুন্দর পরিবার আছে আমার। শান্তিপূর্ণ একটা জীবন আছে। কাঁধে ঋনের বোঝা নেই। সুস্থ আছি ;ভালো আছি। আমি কী বড়লোক নই তরী? আর সবশেষে একটা সরলমনা বউ আছে। যে কিছুই বোঝে না!”

‎তরী ঠোঁট টিপে হেসে ফেললো। পরোক্ষনেই মনটা যেন পুলকিত হয়ে উঠলো। আহসান বউ বলে সম্মোধন করলো তাঁকে? বউ-ই তো সে। আহসানের বউ!

‎বিছানার ওপরে চকচকে একশত টাকার নোট দেখে তরী চোখ ফিরিয়ে বারবার সেটাকে দেখলো। আগে বাবা কাজ থেকে ফিরলেই চকচকে নোটগুলো তরী আর গুনগুনকে দিতেন। তাঁরা সেটা মাটির ব্যাংকে জমাতো। এভাবে জমাতে জমাতে অনেকগুলো টাকা হয়েছিল। ওগুলো দিয়ে তরী আর গুনগুন হাঁসের ছানা কিনেছিল। কিন্তু, দুর্ভাগ্যের বিষয় একটা ছানাও শেষমেশ বাঁচেনি। সেই দেখে তরী আর গুনগুন বাড়িতে যা হুলস্থুল কান্ড ঘটিয়েছিল! কেঁদেকুটে কী একাকার অবস্থা। তরীর আজও মনে পরলে দুঃখ পায়। কী ফুটফুটে সুন্দর ছিল ছানাগুলো।
‎তরীকে ইনিয়ে বিনিয়ে কচকচে নোটের দিকে; তাকিয়ে থাকতে দেখে আহসান তরীর হাতে সেটাকে গুঁজে দিলো। তরীর মুখে নিমিষেই খুশির ঝলক দেখা গেল। আঁচলে টাকাটা গিট দিয়ে বেঁধে সে বললো,

‎” জানেন, বাবা যখন আগে কাজশেষে বাড়ি ফিরতো। আমাদের দু’বোনের কাজ ছিল বাবার থেকে কচকচে নোট যোগাড় করা। সেগুলোকে আমরা মাটির ব্যাংকে জমাতাম। ব্যাংক ভাঙ্গার পর অনেকগুলো টাকা পেয়েছিলাম।”

‎আহসান কৌতুহলী হয়ে বললো,

‎” তা কী গতি হলো টাকাগুলোর?”

‎তরী প্রতিত্তরে বললো,

‎” অনেকগুলো হাঁসের ছানা কিনেছিলাম। কিন্তু একটাও টেকেনি! আমরা সেদিন যা কেঁদেছিলাম সবাই সেটা নিয়ে খুব হেসেছিল। আমি হাঁসের ছানাগুলোর মা ছিলাম। গুনগুন ছিল খালামনি। কাঁদবো না বলুন?”

‎আহসান ঠোঁট কামড়ে বললো,

‎” উম। আচ্ছা আমি কবে হাঁসের ছানা জন্ম দিলাম তরী? তুমি মা হলে আমি তো বাবা। আমার সন্তানদের তুমি কোথায় লুকিয়ে রেখেছো তরী? কোথায় আমার সেই অর্ধমানব অর্ধহাঁস সন্তানগুলো? সত্যি করে বলো তো তরী!”

‎আহসানের কৌতুক শুনে তরী হেসে ফেললো। লাজুকস্বরে বললো,

‎” তখন আপনার সঙ্গে আমার ভাবই হয়নি। বিয়ের আগের কথা ।”

‎আহসান জিহ্বা কামড় দিয়ে বললো,

‎” কী বলছো! বিয়ের আগেই এতগুলো সন্তানের জননী ছিলে? আমার সঙ্গে কী তবে ধোঁকা হলো? ছি ছি! কী অনাচার কান্ড! আমায় এভাবে ঠকালে তরী?”

‎তরী লজ্জায় আঁচলে মুখ গুঁজে দৌড়ে পালালো। কথা নেই আর লোকটার সঙ্গে তাঁর। খালি লজ্জায় ফেলে তাঁকে!

‎সেদিন রাতে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটলো। আহসান রাতে সত্যি সত্যি একটা মাটির ব্যাংক নিয়ে হাজির হলো। এরপর থেকে রোজ তরী আহসান বাড়ি ফিরলেই কচকচে নোটের জন্য তাঁকে ঘিরে ধরে। এবারের টাকাগুলো দিয়ে একটা সিক্রেট কাজ করবে সে। খুব খুব খুব সিক্রেট জিনিস। কাউকে বলা-ই যাবে না!

‎রোজকার মতো ব্যস্ততার সময়ে ফোনটা পূর্বের ন্যায় বেজে উঠলো। আহসান দ্রুত রিসিভ করে তা কানে তুললো। উচ্চস্বরে ‘হ্যালো’ বললেও ওপাশ থেকে জবাব এলো না। বিক্ষিপ্ত কন্ঠে অতঃপর সে বললো,

‎” রোজ রোজ কী আপনি ফাজলামো করছেন আমার সঙ্গে? যদি কথা বলার মতো ভাষা না থাকে; তাহলে দয়া করে কাউকে ফোন দিয়ে অযথা বিরক্ত করবেন না। সবাই আপনার মতো অকাজ নিয়ে বসে থাকে না!”

‎এতদিন পর অপর প্রান্তের ব্যাক্তিটির নীরবতা ভাঙ্গলো। অতি সুধাময়ী নেশালো নারী কন্ঠটি বললো,

‎” আপনি যা চাচ্ছেন তা অসম্ভব। রোজ বেলা করে একবার আপনার কন্ঠস্বর শুনতে না পেলে শুন্য মনে হয় সবটা। কী যাদু করেছেন আমায় বলুন তো? এতটা সুদর্শন কেউ কী করে হতে পারে?”

‎আহসান কড়কড়ে গলায় বললো,

‎” দেখুন, আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আপনি রং নাম্বারে কল করেছেন। আপনি যাকে ভাবছেন আমি সে নই।”

‎ওপাশ থেকে জবাব এলো,

‎” উহুম! আপনাকে চিনতে ভুল আমি করতেই পারি না। যাকে নিয়ে সারাটাদিন ভাবি তাঁকে চিনবো না? এতটা বেখেয়ালি আমি নই।”

‎আহসান বিষ্মিত হয়ে বললো,

‎” আমি কী আপনাকে চিনি?”

‎ওপাশ থেকে হাসির আওয়াজ শোনা গেল। মিনিট খানেক নিস্তব্ধতা পালনের পর বললো,

‎” না চেনেন না। কিন্তু, আমি বেশ ভালো করেই চিনি এবং জানি আপনাকে। চিনি বলেই আপনাকে এতটা অনুভব করতে পারি। বলুন না কী এমন কমতি আছে আমার ভেতরে? এতটা দূরে কেন ঠেলে দিচ্ছেন? আপনাকে ভালোবাসাটা বুঝি আমার অপরাধ?”

‎আহসান আর কিছু শুনলো না। দ্রুত কলটা কেটে গেল। কোথাকার কোন পাগল; যা তা অবস্থা ছিহ!

‎দুপুরে বাড়ি ফেরার পথে নিত্যদিনের মতো তরীকে নিয়েই বাড়ি ফিরলো সে। তরী কলেজের পোশাক বদলে শাড়ি পড়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে আহসানের ঘরে এলো। বিছানার ওপরে ক্রিং ক্রিং করে আহসানের ফোনটা বেজেই চলেছে। এদিকে আহসান ঘরে নেই। তরী জরুরি ফোন ভেবে কলটা রিসিভ করে কানে তুলতেই একটা মেয়েলী কন্ঠ শুনতে পেলো। খুব অভিমানের সূরে বলছে,

‎” আমার কলটা তখন কেন কেটে দিলেন আহসান? কতটা কষ্ট পেয়েছি জানেন? জানি অনেক ব্যস্ত মানুষ আপনি। তাই বলে এতটা অবহেলা? কতটা ভালোবাসি তা জানেন না?”

‎তরী স্তব্ধ হয়ে বসে পরলো। এসব কী শুনেছে সে? ফোনটা নিমিষেই হাত থেকে পড়ে গেল। কী করে এটা করলো তাঁর সঙ্গে আহসান? এই মেয়েটা কী আহসানের বউ? লুকিয়ে লুকিয়ে বিয়ে করেনি তো আহসান? তরীদের দু’বাড়ি পরে ময়না খালাম্মাদের বাড়ি। অনেক সুখের সংসার থাকা সত্ত্বেও ময়না খালাম্মার স্বামী শহরের আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করেছে। এখন ময়না খালাম্মা তাঁর বাবার বাড়ি থাকে। তাঁর স্বামী কখনো খোঁজও নেয় না। আহসান ও কী শহরের কোনো সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করেছে? ক্রোধে, উন্মাদনায় তরীর চোখে জল এলো। আহসান হাত, মুখ ধুয়ে সবেমাত্র ঘরে ঢুকতেই তরীকে দেখে মিষ্টি হেসে বললো,

‎” দুপুরের খাওয়া হয়েছে তুলতুল?”

‎তরী কোনো জবাব দিলো না। কাঠকাঠ কন্ঠে বললো,

‎” মেয়েটা কে?”

‎আহসান পিছু ফিরে বললো,

‎” কোন মেয়ে?”

‎তরী কাঁদো-কাঁদো হয়ে বললো,

‎” ওই যে যে-ই মেয়েটাকে আপনি বিয়ে করেছেন। শহরে থাকা সুন্দরী মেয়ে। কবে বিয়ে করেছেন তাঁকে? সে কী অনেক সুন্দরী? ”

‎আহসান নিজ হাতের সবুজ ঘামছাটা ছুঁড়ে ফেলে কৌতুকের ছলে বললো,

‎” আমার একটাই বউ। তাঁর নাম তুলতুলি বেগম।”

‎তরী নরম-নমীয়তার খোলস ছেড়ে বাইরে এলো। রনমূর্তির ন্যায় ছুটে গিয়ে বললো,

‎” একদম মিথ্যে বলবেন না। একটা মেয়েকে বিয়ে করেছেন আপনি। রোজ আপনার খবর নিতে সে আপনাকে ফোন করে। আমি জানি না ভেবেছেন? আপনি একটা বাজে লোক! খুব খুব খুব বাজে লোক!”

‎আহসান মুহূর্তেই সবকিছু অনুধাবন করতে পেরে তরীকে সবকিছু খুলে বলতে চাইলো। তবে, ধরনী আজ তাঁর সমর্থনে ছিল না যেন। উচ্চস্বরে ফোনটা বেজে উঠতেই আহসান তা ধরলো। অর্ক ফোন করেছে; আহসান হ্যালো বলতেই অর্ক বললো,

‎” বন্ধু সৌম্যর বাবা ইমতিয়াজ আংকেল ব্রেইন স্ট্রোকে মৃত্যুবরন করেছেন। তুই জলদি আয়! সৌম্যকে সামলে উঠতে পারছি না।”

‎আহসান দিশাহারা হয়ে ক্রস্ত পায়ে দৌড়ে বাইক নিয়ে বের হয়ে গেল। সৌম্যর বাবাকে এলাকার সবাই চেনে। ভদ্রলোক প্রকৃতির মানুষ তিনি। এত ভালো মানুষটা কী করে যে….
‎তাড়াহুড়োয় তরীকে সবটা খুলে বলতে বেমালুম ভুলে গেছে সে। বিপদের সময় তাঁর মাথা ঠিকঠাক থাকে না। তরী বিছানায় শুয়ে শুয়ে বালিশে মুখ ডুবিয়ে কাঁদলো। ময়না খালাম্মার স্বামী যখন আরেকটি বিয়ে করেছিল। পুরো এলাকাতে জানাজানি হওয়ার পর মুরব্বিরা ময়নার খালাম্মার স্বামীকে কিছু বলেনি। উল্টো ময়না খালাম্মাকে জেরা করে বলেছিল,

‎” তুমি কেমন ধারার মাইয়া যে স্বামীরে বাইন্দা রাখতে পারো নাই? জামাইরে আঁচলে বাইন্দা রাখতে হয়। ব্যাডা মানুষ সুযোগ পাইলে এইদিক ওইদিকে মুখ দিবোই। তুমি একটু খেয়াল রাখবানা?”

‎তরী ভয়ে লজ্জায় আরো বেশি বেশি কাঁদলো। আহসানকে তো সে বেঁধে রেখেছিল। তরীর আঁচলের সঙ্গে গিট্টু দিয়ে। আহসান কেন করলো এমনটা তাঁর সঙ্গে? তাঁকে ছেড়ে আরেকটা মেয়েকে কেন বেছে নিলো? আহসানের সঙ্গে যখন তাঁর বিয়ের কথা হলো। তখন তরীর তাতে মোটেও মত ছিল না। কিন্তু, বিয়ের পর আহসানের ভেতরের অভ্যন্তরীন সত্তা তরীকে তোলপাড় করে দিয়েছিল। হ্যাঁ, ভালোবেসে ফেলেছে সে আহসানকে। খুব করে ভালোবেসেছে! আহসান সেই ভালোবাসার মূল্য দিক না দিক। তাতে তরীর কিছু যায় আসে না। আহসানকে সারাজীবনের জন্য মন দিয়ে বসেছে সে। তাঁর পক্ষে আহসানের মতো দু’নৌকায় পা দিয়ে চলা অসম্ভব। অর্ন্তদহনের কোন্দলে তরী খেই হারিয়ে ফেললো। হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। রুমি শব্দ পেয়ে তরীর কাছে ছুটে এসে বসলো। তরীর দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় বললো,

‎” কী হয়েছে ভাবী?”

‎তরী সবকিছু ধামাচাপা দিয়ে বললো,

‎” তেমন কিছু না। হঠাৎ বাবার কথা মনে পরলো।”

‎রুমি গিয়ে শোভার কাছে সবটা খুলে বললো। শোভা মাজদাককে ফোন করে তরীর বিষয়ে; বলতেই মাজদাক বাড়িতে এসে তরীকে তৈরি হতে বললেন। তরী না যেতে চাইলেও আহসানের প্রতি তীব্র অভিমানে মাজদাকের সঙ্গে চলে গেল। মাজদাক তরীকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে সৌম্যের বাবার জানাযায় গেল। এদিকে তরীর অকস্মাৎ আগমনে মনোয়ারা আর গুনগুন উভয়েই স্তম্ভিত! গুনগুন ইতিমধ্যেই খুশিতে লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে। অনেকদিন পর তাঁর আপা এসেছে। মনোয়ারা যদিও তরীর এমন সহসাই আগমনকে কিছুটা সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখলেন। তরীকে কৌতুহলের বশে জিজ্ঞেস করতেই তরী বললো,

‎” বিয়ের পর বেড়াতে এলেও দোষ?”

‎মনোয়ারা আর কথা বাড়ালেন না। তরীকে তাঁর হালতে ছেড়ে দিলেন। বিয়ের পর স্বামী এবং স্ত্রীর মধ্যে অনেককিছুই ঘটে। মাঝেমধ্যে ঝগড়া, অভিমান সম্পর্কের গুরুত্ব অনুভব করায়। একে অপরকে নিয়ে ভাবতে শেখায়। ভালোবাসা ও সম্পর্কের মর্ম বোঝায়।

চলবে….

‎#নিকুঞ্জ_কানন
‎#নুজহাত_আদিবা
[‎পর্ব ১২]

‎গুনগুন তরীর পিছুই ছাড়ছে না। তরী যখন যেদিকে যাচ্ছে গুনগুন সেদিকেই যাচ্ছে। তরীর আঁচল টেনে গুনগুন বললো,

‎” বুবু তুমি কী একেবারের জন্য চলে এসেছো? ওই পঁচা লোকটা আর নিয়ে যাবে না তো তোমাকে? লোকটা এত পঁচা কেন বুবু? তাঁর কী বুবু নেই? শুধু আমার বুবুকে নিয়ে টানাটানি করে কেন?”

‎তরী গুনগুনের প্রশ্নের উত্তর দিলো না। আহসান লোকটা আসলেই পঁচা। নাহয় তরীকে ফেলে আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করতে পারতো?

‎আহসানের বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হলো। আনুমানিক বারোটার বেশি বাজছে তা নিশ্চিত। জানাযা শেষ হয়েছে এশার পরে। জানাযা দিয়ে লা’শকে অনেক আগেই দাফন করা হতো কিন্তু সৌম্যদের শহরের আত্নীয়দের অপেক্ষায় জানাযা পড়াতে বিঘ্ন ঘটেছে। সৌম্যরা দুইভাই; সৌম্য বড় আর ছোটজনের নাম সৌভিক। সৌম্যের মা দু’বছর আগে ইন্তেকাল করেছে। এতদিন বাবাই ছিল দু’ভাইয়ের বটগাছ। বেঁচে থাকার একমাত্র খুঁটি। বাবার আকষ্মিক মৃত্যুতে দুজনেই দিক বেদিক ভুলে দিশেহারা হয়ে গেছে। দুজনকে সামলাতে দিয়ে তাঁকেসহ অর্ক আর রঙ্গনকে বেগ পেতে হয়ে হয়েছে। তবে, এই দুঃখ কী ঘোচাবার মতো? পিতা ও মাতা সন্তানের জন্য সম্পদ সমতুল্য। সেই বিয়োগ কী মেনে নেওয়ার মতো? আহসান আজ প্রকৃতপক্ষে ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। সৌম্যের অবস্থা মুখে প্রকাশ করবার মতো নয়। কী বলে সান্ত্বনা দেবে সে বুঝেই আসেনি।

‎আহসান ক্লান্ত আজ। শারীরিক ও মানসিক উভয় ভাবেই সে বিপর্যয়গ্রস্থ। ঘরে ঢুকতেই তরীকে খুঁজে পেলো না সে। তরীকে তখন কিছু বুঝিয়ে বলার মতো অবস্থায় ছিল না সে। তরীকে সবটা বুঝিয়ে বকা দরকার। সম্পর্কে ভুল বোঝাবোঝি মিসআন্ডারস্যান্ডিং বড্ড খারাপ জিনিস। সম্পর্ককে এক নিমিষেই ধ্বংস করে দেয়। আহসান রুমিকে ডাক দিয়ে তরীর কথা জিজ্ঞেস করতেই রুমি বললো,

‎” ভাইয়া, ভাবী তো বাবার বাড়ি গেছে। ভাবীর আজ মন ভালো নেই। হঠাৎ করে বাবার কথা মনে পরায় খুব করে কেঁদেছে। পরে বাবা গিয়ে ভাবীকে দিয়ে এসেছে। মা বললো ভাবীকে কটাদিন ওখানে থেকে আসতে। মনটা তাহলে হালকা হবে কিছুটা।”

‎আহসান আর কিছু বললো না। রুমি খাবারের প্লেট নিয়ে এসে আহসানের ঘরে দিয়ে চলে গেল। আহসানের মনে বিতৃষ্ণা ভর করেছে। তরী যে বাবার মায়ায় বাড়ি ছেড়েছে তা ভুল। তরী বাড়ি ছেড়েছে তীব্র অভিমানে। তরীর ওপরে প্রথমে বেশ রাগ হলো তাঁর। ফের মনে হলো ❝অভিমান সেখানেই জন্মায় যেখানে ভালোবাসার উপস্থিতি রয়েছে।❞ আহসানের প্রতি তরীর অধিকারবোধ এখন ভালোবাসায় রূপ নিয়েছে। যদি ভালো সে না-ই বাসতো তবে, অন্য মেয়ের কথা শুনে আহসানের প্রতি এতটা অভিমান- অভিযোগ তাঁর থাকতো না। তরীর অভিমান, ক্রোধ প্রমাণ করে দিচ্ছে তাঁর ভালোবাসা, সম্পর্কের প্রতি টানকে। তরী বোকা মেয়ে! মেয়েটার প্রতি যেখানে রাগ হওয়ার কথা। সেখানে তাঁর ক্রতি ভালোবাসা, মায়া উপচে পরছে। আহসান আনমনে বললো,

‎” তরী কী সুধা ছড়ালে গো?”

‎আহসানের ত্বরিত চোখ গেল বিছানার ওপরে রাখা বালিশের কোনে। একটা ভাঁজ করা কাগজের ঝলক দেখা যাচ্ছে। আহসান কাগজটা বালিশের কোন থেকে টেনে তুললো। তাতে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা,

‎” প্রিয় বাজে লোক আহসান,

‎আপনার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর আমি বিয়েতে রাজি ছিলাম না। আপনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। কিন্তু, বিয়ে হওয়ার পর সবকিছু কেমন যেন পাল্টে গেল। আমার আপনাকে খুব ভালো লাগে।আমি ভালোবেসে ফেলেছি আপনাকে। আপনাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবলে কষ্ট হয়। আপনাকে কারো সঙ্গে সহ্য-ই হয় না আমার। চুল ধরে টেনে কুটিকুটি করে দিতে ইচ্ছে হয়। আপনি আমাকে ভালোবাসেন না সেটা জানি। নাহলে, আমায় ছেড়ে আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করতে পারতেন? মেয়েটা খুব সুন্দর সেটা জানি। আপনি সুন্দর তাই আপনার সঙ্গে সুন্দরকেই মানায়। আমি চলে যাচ্ছি। আপনি চাইলে ওই মেয়েটাকে নিয়ে সংসার করতে পারেন। কিন্তু, কখনও তাঁকে আমার সামনে নিয়ে আসবেন না। আপনার সঙ্গে কাউকে দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়। বুকের ভেতর কেমন কেমন যেন হয়। সবকিছুর শেষে বলতে চাই, আপনি একটি নিতান্তই বাজে পঁচা লোক! খুব পঁচা! ”

‎আহসান চিঠিটা পড়ে চিঠিতে ছোট্ট করে চুমু খেলো। চিঠিতে তরীর তাঁর প্রতি তীব্র ঘৃনা প্রকাশ পাচ্ছে। সে পাক! তরীর সবকিছু তাঁর। তরীর ঘৃনাগুলোও একান্ত তাঁর। যে স্থান তরী অর্জন করেছে তা আজ অবধি কেউ পারেনি। তাই বা কম কীসে?
‎★
‎মনোয়ারা তরী আর গুনগুনকে একসঙ্গে বসিয়ে ভাত খাইয়ে দিয়েছে রাতে। মনোয়ারা বিছানার অপর প্রান্তে শুয়েছে। গুনগুন আর তরী একসঙ্গে শুয়েছে। গুনগুন মাঝে আর তরী সাইডে। তরীর ঘুম আসছে না। এপাশ ওপাশ ফিরে কয়েক দফা ঘুমানোর চেষ্টা করলো কিন্তু ঘুম এলো না। তরীর ছটফট দেখে মনোয়ারা ঘুম থেকে উঠে বসলেন। শান্ত গলায় বললেন,

‎” কী হয়েছে সত্যি করে বল।”

‎তরী জবাব দিলো না। আঁচলে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মনোয়ারা উঠে গিয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

‎” কী হয়েছে? আহসান কিছু বলেছে? ঝগড়া হয়েছে তাঁর সঙ্গে? ”

‎তরী তখনও কোনো প্রত্যুত্তর করলো না। একেবারে ক্ষীন শব্দে কাঁদতে লাগলো। মনোয়ারা নমনীয় কন্ঠে বললেন,

‎” জীবনে অনেক পরিস্থিতি আসে। স্বামী এবং স্ত্রীর মাঝে মনোমালিন্য হওয়াটা অস্বাভাবিক কোনো কিছু না। জীবনে যদি শীত না আসে তবে বসন্তের গুরুত্ব কী করে বুঝবি? সম্পর্কের মাঝে ভুল বোঝাবোঝি, রাগ ও অভিমান আসবেই। অভিমানের তিক্ততা না বুঝলে ভালোবাসার মিষ্টি স্বাদ কী করে পাবি? সবসময় একটা কথা মাথায় রাখবি। দিনের কাজ দিনে করতে হয়। রাতে ঘুমানোর আগে সারাদিনকার সব মনোমালিন্য, ঝগড়ার সমাধান করবি। তাতে চিৎকার, চেঁচামেচি যাইহোক না কেন। অভিমান ঝগড়া করে ঝেড়ে ফেলবি। অভিমান পুষে রাখলে সম্পর্কে ফাটল ধরে। ”

‎তরী বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। মনোয়ারার ফোনটা দিয়ে আহসানকে কল দিলো। সারাদিনের বিশৃঙ্খলতার মাঝে আহসানের মনে শান্তি নেই। ঘুমের ঔষধ খেয়ে নিদ্রাগ্রস্থ সে। তবুও ঘুমের ঘোরেই ফোনটা তুললো সে। নিদ নিদ কন্ঠে বললো,

‎” হ্যালো কে?”

‎তরী অভিমানের সূরে বললো,

‎” কেউ না আমি আপনার।”

‎আহসানের সম্বিত ফিরতেই সে পিলে চমকে উঠলো। ঘড়িটার দিকে এক পলক তাকালো সে। রাত তিনটা বাজছে! তরী এখন তাঁকে কল দিয়েছে? আহসান কন্ঠে জড়তা জড়িয়ে বললো,

‎” ঘুমোতে যাওনি এখন?”

‎তরী জবাবে বললো,

‎” সবাই আপনার মতো অশান্তি করে পড়ে পড়ে ঘুমায় না।”

‎আহসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

‎” বাড়ি ছেড়ে কে গিয়েছিল চলে? আমি?”

‎তরী প্রতিবাদী স্বরে বললো,

‎” আপনি নিতে এসেছিলেন আমায়?”

‎আহসান গম্ভীর স্বরে বললো,

‎” সৌম্যর বাবা মারা গিয়েছেন। জানাযাসহ সব শেষ করে আসতে আসতে রাত হয়ে গেছে। আমার মানসিক অবস্থা সেরকম নেই তরী। আমি নিতে পারছি না সবটা। সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে তুমি অভিমান করে চলে যেতে আর আমি বুঝি তোমায় যেতে দিতাম?”

‎তরী সবকিছু শুনে ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে ফেললো। আহসান বিষ্মিত হলো! তরী কাঁদছে? আহসান কিছু বলার আগেই তরী বললো,

‎” আমি এখনই আপনার কাছে আসতে চাই। আমার আর কিছু ভালো লাগছে না। আমি আপনার পাশে একই বালিশে ঘুমোতে চাই। আপনাকে জড়িয়ে ধরে।”

‎এই অনুরোধের সূর কী আহসান ফেরাতে পারে? ঘুমের ঔষধের প্রভাব তখনও কাটেনি। আহসান এলোমেলো পায়ে বাইকের চাবিটা নিয়ে বের হলো। বাইরে ঝিঁঝি পোকার তীব্র আওয়াজ। নিঝুম গভীর রাত; গ্রাম্য এলাকা বিধায় কাকপক্ষীও জেগে নেই। আহসান সবকিছু ফেলে তরীর পানে ছুটলো।

‎ঘুম-টুম সবকিছু ফেলে তরী আবার ব্যাগ গুছালো। আহসান তাঁকে নিতে আসছে। সে এখনই চলে যাবে। মনোয়ারা ঝিমুতে ঝিমুতে মেয়ের কান্ড দেখলো। দু’জনের কথোপকথন তিনি শুনেছেন। ঝামেলা মিটমাট হয়েছে এই শান্তি তাঁর।

‎রাত সাড়ে তিনটার দিকে সত্যি সত্যি আহসান এলো। তরী ব্যাগ নিয়ে ছুটলো আহসানের দিকে। আজ তরীর মোটেও ভূতের ভয় করছে না। আহসানের বাইকের আলোতে তেনারা পালিয়েছেন! মনোয়ারা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তরীর চলে যাওয়া দেখলেন। কী ছেলেমানুষ মেয়ে তাঁর!


‎” সত্যি করে বলুন তো মেয়েটা কে ছিল?”

‎আহসান তরীর থুতনিতে হাত রেখে বললো,

‎” জানি না।”

‎তরী ফের প্রশ্ন করলো,

‎” আপনি কী বিয়ে করেছেন তাঁকে? সত্যি করে বলুন।”

‎আহসান বালিশে মাথা রেখে বললো,

‎” একজনের মান অভিমান নিয়েই পারছি না। আবার আরেকজন? কী যে বলো না তরী!”

‎তরী আহসানের বুকে ভর দিয়ে শুধালো,

‎” বলুন না মেয়েটা কে ছিল?”

‎আহসান চোখ বুজে বললো,

‎” আমি জানি না তরী। আমার মনে হচ্ছে রং নাম্বার। অন্যকেউ ভেবে আমায় কল দিয়েছে নিশ্চিত।”

‎তরী আর কিছু বললো না। আহসানের বুকে মাথা রেখে পাঞ্জাবীর বোতাম ঘোরাতে ঘোরাতে কখন যে ঘুমিয়ে পরলো….
‎★
‎সকালে তরীকে বাড়িতে দেখে এক প্রকার হাসাহাসির রোল পড়ে গেল! শোভা আর মধুবিবি তখন থেকে তরীকে দেখে হাসছেন। লজ্জায় তরী আহসানের ঘরে গিয়ে গা ঢাকা দিলো। আহসান তখন আলমারির খুলে কী যেন খুঁজছে। তরী গিয়ে তাঁকে বললো,

‎” কী খুঁজছেন? আমায় বলুন আমি দিচ্ছি। ”

‎আহসান দুষ্ট চাহনি নিক্ষেপ করে বললো,

‎” চাই তো অনেককিছুই।”

‎তরী সেসবের মানে বুঝলো না। আহসানকে সরলমনে প্রশ্ন করলো,

‎” কী চান? কী লাগবে আপনার? আমি খুঁজে দেবো? ”

‎আহসান কৌশলে উত্তর দিলো,

‎” না থাক। বাচ্চা মেয়ে তুমি; এত ভার সামলাতে করতে পারবে না।”

‎তরী তেতে উঠে বললো,

‎” কে বলেছে আমি বাচ্চা মেয়ে? আমার অনেক শক্তি আছে। মা রোজ আমায় আর গুনগুনকে এক গ্লাস দুধ আর ডিম সেদ্ধ করে দিতো। আমি দাঁত দিয়ে সুপারি ভাঙ্গতে পারি। আমার অনেক শক্তি! ”

‎আহসান তরীর দিকে এগিয়ে এসে বললো,

‎” তোমার অনেক শক্তি?”

‎তরী জবাবে বললো,

‎” হ্যাঁ। আমি অনেক ভার সহ্য করতে পারি। একবার ১০ কেজি চালের বস্তা তুলেছিলাম।”

‎আহসান ঠোঁট টিপে হেসে বললো,

‎” তবে সামলাও!”

‎এটুকু বলেই সে তরীর কোমর চেপে ধরে তরীকে নিজের কাছে নিয়ে এলো। টুপ করে তরীর ঠোঁটে একটা চুমু খেয়ে বের হয়ে গেল। তরী চোখ বড় বড় করে দাঁড়িয়ে রইলো। এটা কী হলো? বাজে লোকটা চুমু খেলো তাঁকে?

চলবে…