#নিকুঞ্জ_কানন
#নুজহাত_আদিবা
[পর্ব ১৩]
আজ দুপুরে খেতে এসে আহসান রুমি কিংবা শোভা কাউকে দেখতে পেলো না। আজ তরী বাড়িতেই আছে।তাঁর আজ কলেজ নেই। তাই, আহসানও কাজ শেষে একেবারে বাড়িতেই চলে এসেছে। তবে, রুমি আর শোভা কোথায়? বাড়ি এত নীরব কেন? আহসান কয়েকবার রুমি রুমি বলে ডাকলো। কিন্তু, কোনো জবাব এলো না। অতঃপর আহসান মধুবিবির ঘরে গিয়ে তাঁকে বললো,
” মা কোথায় বুবু?”
মধুবিবি পানের ডাবা রেখে আহসানকে বললেন,
” আর বইলো না ভাই। তোমার নানী নাকি অসুস্থ হইয়া গেছে। তোমার মা সেই কথা শুইনা রুমিরে নিয়া সেইখানে গেসে। তোমার বাপ একটু আগেই গাড়িতে উঠায়া দিলো। তোমার বউরে নিতে চাইসিলো আমি একলা দেইখা রাইখা গেসে।”
আহসান চিন্তিত হয়ে হেঁটে ঘরে চলে এলো। শোভাকে একবার ফোন করে নানুআপার খবর নিলো।ডায়বেটিস আছে বিধায় হুটহাট অসুস্থ হয়ে পড়েন। বার্ধক্যজনিত কারণে বোধশক্তিও কমে গেছে। হুটহাট মানুষ দেখলে চিনতে পারেন না।
আজ আহসান দুপুরের পর আর কাজে গেল না। কাল ঢাকায় চাকরির পরীক্ষা দিতে যাবে সে। দুপুরের খাবার খেয়েই বইপত্তর গুছিয়ে টেবিলে বসলো সে। নবম-দশম শ্রেনীর গণিত বইটা খুবই উপকারী। বইটা থেকে অনেক ম্যাথ কমন পড়ে পরীক্ষায়। আকষ্মিক দমকা হওয়ায় বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো উলটপালট হয়ে গেল। আহসান জানালার দিকে একবার উঁকি দিলো। বাইরে ঝড় হচ্ছে সঙ্গে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। বিদ্যুৎ ক্ষনে ক্ষনে চমকে উঠছে। দমকা বাতাসের হাতছানি আহসানের মন্দ লাগছে না। অলসতার ভীড়ে উঠে গিয়ে জানালাটা আর বন্ধ করলো না সে। কিন্তু, বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো বাতাসে বারবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির ছিটেফোঁটা খাতায় এসে পড়ে খাতা ভিজে যাচ্ছে। আহসান আলসেমি পরিত্যাগ করে জানালার কাছে গেল। এই জানালা বাতাসের খেলা তাঁর মনোযোগ নষ্ট করছে। হাত বাড়িয়ে জানালাটা বন্ধ করার সময়ই উঠোনে তরীকে দেখলো সে। তরী? তরী এই ঝড়ের মাঝে উঠোনে কী করছে? আহসান মৃদুস্বরে তরীকে কয়েকবার ডাকলো। তরীর কান অবধি তা পৌঁছালোই না। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দৌড়ে উঠোনে গেল আহসান। বারবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বোকা মেয়েটার কোনো জ্ঞান বুদ্ধি নেই? আহসান ফের ডাকলো তরীকে। তরী ডাক শুনে পিছু ফিরে তাকালো। একি অবস্থা তরীর! তরীর দু’গালে-সহ শাড়ির আঁচলে ছোট ছোট কাঁচা আম। এই ঝড়ের মাঝে আম কুড়ানোর শখ হয়েছে তাঁর? আহসান ছুটে গিয়ে তরীর হাত ধরে তাঁকে ঘরে টেনে আনতে চাইলো। তরী মাথা দুলিয়ে না বোঝালো। সে আরো আম কুড়াতে ইচ্ছুক। আহসান কেন ঘরে নিয়ে যাচ্ছে তাঁকে? আগে যখন ঝড় হতো সে আর গুনগুন মিলে আম কুড়াতে যেতো। আশেপাশের বাড়ির ছোট ছোট ছেলেপেলেরাও আসতো। আম কুড়ানো শেষে সবাই সমান ভাগে ভাগ করে নিতো। তরীর না বোধক ইশারা শুনে আহসান বললো,
” অনেক হয়েছে তরী। অনেক আম কুড়িয়েছো। আর না! কীভাবে বিদ্যুৎ চমকে বাজ পড়ছে দেখছো না? এই সময়ের বৃষ্টি ভালো নয়। কালবৈশাখী ঝড়ের বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসে। সামনে পরীক্ষা এখন মোটেও জ্বর-টর বাঁধানো যাবে না।”
আহসান এক প্রকার জোর করেই ঠেলেঠুলে ঘরে নিয়ে এলো তরীকে। পড়ার ঘরের বইগুলোকে ভাঁজ করে রেখে এসেছে সে। তরী মুখ ফুলিয়ে বিছানার ওপরে বসে আছে। শরীর বৃষ্টির পানিতে ভেজা। টপটপ করে পানি গড়িয়ে বিছানায় পরছে। সেদিকে তাঁর বিন্দুমাত্র মনোযোগ নেই। আহসানের প্রতি সে প্রচন্ড রেগে আছে। একটু আম-ই কুড়োতে গিয়েছিল সে। তাই বলে এভাবে টেনে নিয়ে এলো? আহসান ঘামছা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে তরীর দিকে তাকালো। তরীকে খুঁজে আনতে গিয়ে সেও ভিজে গেছে। আহসান ঘামছা হাতে তরীর দিকে এগিয়ে গেল। তরীর মাথাটা মুছে দিতে চাইলো। তরী মাথাটা সরিয়ে দিয়ে সরে বসলো। আহসানের সঙ্গে কথা নেই তাঁর। বাজে লোক!
” ঠান্ডা বসে যাবে তরী। শাড়িটা পাল্টে নাও।”
তরী কিছু না শোনার ভান করে বসে রইলো। তাঁর অনেক রাগ হয়েছে। কিছুতেই আজ সে আহসানের সঙ্গে কথা বলবেই না! আহসান হাঁটু গেড়ে বসে তরীর হাত দুটো ধরে বললো,
” ঝড়-বাদলা শেষ হোক। আমি নিজে গাছে উঠে তোমায় এত এত আম পেড়ে দেবো। তুমি আচার করে খেও কেমন?”
তরী বিষয়টা নিয়ে ভেবে দেখলো। কথাটা মন্দ বলেনি আহসান। আহসান যা বলে পরে হলেও সেটাই করে। আহসান সত্যি তাঁকে আম পেড়ে দেবে; সেটা বেশ করেই জানে তরী। তরী উঠে দাঁড়িয়ে আলমারি থেকে শাড়ি বের করলো। আহসান গামছা হাতে দাঁড়িয়ে রইলো। তাঁর পাঞ্জাবিটাও ভিজে গেছে। তরী চলে গেছে ভেবে আহসান পাঞ্জাবিটা খুলে ফেললো। তরী পিছু ফিরে শাড়ি নিয়ে বেরুবার পথে আহসানের রূপ জৌলুসের তাড়নায় থমকে পড়লো। যৌবনের ছাপে মাখা শক্তপোক্ত পেটানো শরীর তাঁর। পানির ছিটেফোঁটায় ভেজা শরীরটা জ্বলজ্বল করছে মুক্তোর মতো। তরী চোখ ফিরিয়ে ঢোক গিললো। বড্ড হাঁসফাঁস লাগছে তাঁর।
আহসান আলমারির দিয়ে এগোতে গিয়েই তরীর দৃষ্টিতে বাঁধা পরলো। ভেজা শরীরে শাড়িটা দেহের সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে। অক্ষিকোটর দিয়েই পরিমাপ করা যাচ্ছে দেহের প্রতিটি ভাঁজ। খামখেয়ালী-পনায় মেয়েটার উদরের পাশ থেকে শাড়ির আঁচলটা যে কখন সরে গেছে! পৃথিবীর সকল মোহের আজ অবস্থান করছে তরী। তরীর এই রূপের কাছে সকল সৌন্দর্য যেন ফিঁকে পড়ে যাচ্ছে। তরী সেই ফুটন্ত ফুল যা আহসান ছুয়ে দিতে চায়। তবে, তরী যদি সেই ছোঁয়া সহ্য করতে না পারে? নীরবতায় যদি নেতিয়ে পড়ে?
সময় যত গড়ালো নীরবতা নিরবচ্ছিন্নতা ততই প্রগাঢ় হলো। দুজন যেন গোপন অভিলাষে একে অপরের নিকট বাঁধা পড়লো। চোখে চোখে সন্ধি হলো তাঁদের। কখন যে একে অপরকে কাছে পাওয়ার বাহানায় কুপোকাত হলো! এরপর? এরপর আর কী! দু’পক্ষ ভাব-ভালোবাসায় বিছানাগামী হলো। তারপরের অংশটুকু মনে পরলেও তরীর লজ্জা পায়! সেদিন আহসান তাঁকে যেভাবে ছুঁয়েছিল আজ অবধি তরীকে; সেভাবে কেউ ছোঁয়ার সাহস করেনি। অধিকারই ছিল না তাঁদের। যে-ই স্থান আহসানের ছিল তা কেউ কী করে রপ্ত করতো? তরীর পুরো অঙ্গ জুড়ে সেদিন বাজে লোকটা বিরাজ করছিল। প্রতিটা ভাঁজে ভাঁজে খাঁজে খাঁজে ঠোঁট ছুঁইয়ে ছিল। তরীর তুলতুলে শরীরটা পিষ্ট হয়েছিল সেদিন বলিষ্ঠ বুকের নিচে। ছিহ! কী লজ্জার কথা! লজ্জায় সেদিন সারাদিন তরী আহসানের সামনেই এলো না! কেন এলো না তা তরী কাউকে বলতে পারবে না। সে ভারী লজ্জার কথা! ওসব কথা কাউকে খুলে বলা যায়?
★
মধুবিবি বার কয়েক ঘুরে ফিরে তরীকে দেখলেন। তরী লজ্জায় গুটিসুটি মেরে মধুবিবির ঘরে আস্তানা জমিয়েছে। সচারাচর দিনে সে আহসানের ঘরেই থাকে। মধুবিবির ঘরে দিনে তেমন একটা আসে না। রাতে শুধু ঘুমোতে চলে আসে। আজ কী হলো কে জানে? মধুবিবি এগিয়ে গিয়ে তরীর গলায় হাত রেখে বললেন,
” এই বউ! গলায় কী হইসে তোমার?”
তরী আমতাআমতা করে বললো,
” পোকা কামড় দিয়েছে। জানালা খোলা ছিল তো।”
মধুবিবি মুখে কিছু বললেন না। মনে মনে বেজায় হাসলেন। তাঁর অভিজ্ঞ চোখ এই দাগের মানে ঠিকই জানে। নাতী তাঁর সঠিক পথেই পা বাড়িয়েছে। মাথা থেকে শয়তানের ক্যারা বেরিয়ে গেছে। উঠে গিয়ে ফ্রিজ থেকে বরফের চাকা বের করে তরীর হাতে দিয়ে বললেন,
” বরফ লাগাও। বিয়ের প্রথম বছরে এরকম অনেক পোকা কামড়ায়। গালে কামড়ায়, ঘাড়ে কামড়ায় আরো কত জায়গায় কামড়ায়! এরপর থেকে পোকা যখন কামড়াইতে আসবো তুমিও পোকার গালে, ঘাড়ে জখম করে সিল মাইরা দিবা। লজ্জায় যাতে কয়েকদিন ঘর থেইকা কয়েকদিন না বাইর হইতে পারে!”
তরী লজ্জায় বরফ হাতে বালিশে মুখ গুঁজে বসে রইলো। ধরনী দ্বিধা হও!
মধুবিবি তরীর পরে আহসানকে শিকার বানালেন। দুপুরের অনাকাঙ্ক্ষিত সুন্দর ঘটনার পর আহসান গোসল সেরে সবে মাত্র রান্নাঘরে ছিল। একটু গরম পানি প্রয়োজন তাঁর। দিনে দু’বার গোসল করে গলা, কান ঠান্ডায় তিরতির করছে। মধুবিবি আহসানের পিছু গিয়ে দাঁড়ালেন। টিপ্পনী কেটে বললেন,
” তোমার গলায়, ঘাড়ে এত জখম কীসের ভাই?”
আহসান পাঞ্জাবির কলার দিয়ে ক্ষতটা ঢাকার চেষ্টা করে বললো,
” কোথায় জখম? বিষ পিঁপড়া কামড় দিয়েছে। দুপুরে শুয়েছিলাম না? ঝড়ে কোথা থেকে উড়ে পোকার ঝাঁক বিছানায় উঠে গেল!”
মধুবিবি হাসি চেপে রেখে বললেন,
” হ্যাঁ তাই তো! পোকা পুরা বাড়ির মানুষ রাইখা তোমারে আর তোমার বউরেই খালি কামড় দেয়। আমরা তো মানুষ না। আমাদের চোখেই দেখে না!”
আহসান বুঝেও না বোঝার ভান করে চুপ করে রইলো। বজ্জাত বুড়ি বুঝলেই তাঁকে জ্বালিয়ে মা’রবে!
সারাদিন আহসানের থেকে লুকিয়ে চুরিয়ে থাকলেও রাতে তাঁকে আহসানের নিকট ধরা দিতেই হলো। রুমি আর শোভা আজ ও-বাড়িটায় রয়ে গেছে। মধুবিবি ছেলে আর নাতীকে রেঁধে খাইয়েছেন রাতে। তরীর তাই সামনে পড়তে হয়নি কারোর। কিন্তু, বিপত্তিটা ঘটলো রাতে। রোজকার মতো তরী মধুবিবির সঙ্গেই শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। মধুবিবির আজ কী হলো কে জানে! তরীকে বালিশ হাতে আহসানের ঘরে যাওয়ার জন্য আদেশ দিলেন। তরী পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার বেশ চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। মধুবিবি মজার ছলে বললেন,
” এত রঙ্গ তামাশা করিও না। নাগরের সঙ্গে যা হওয়ার হইয়া গেসে। এত শরম কীসের তোমার?তোমার উপরে তাঁর অধিকার সবচেয়ে বেশি।এখন থেইকা আমার কাছে শুইয়া তোমার কাজ নাই। যাঁর জায়গা যেইখানে তাঁর সেইখানে থাকাই ভালো।”
তরী বালিশ হাতে আহসানের ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কীভাবে সামনে যাবে সে? দ্বিধা নিয়েই এক দৌড়ে ঘরে ঢুকে বালিশে মুখ গুঁজে বসে পরলো সে। আহসান হতবিহ্বল! সারাদিন মেয়েটা পালিয়ে বেরিয়েছে। এখন আসার সময় হলো তাঁর? আহসান দৌড়ে তরীর পাশে গিয়ে বসলো। পিঠে আর পেটে সুরসরি কাটলো তরীর। তরী খিলখিল করে হেসে ফেললো। আহসান কোলে তুললো তাঁকে। যেমনটা আজ দুপুরে তুলেছিল। তরী লাজুকলতার মতো আহসানের কোলে লেপ্টে রইলো।
” এত লজ্জা কীসের তুলতুল বউ?”
তরী আহসানের উন্মুক্ত বুকে আঁকিবুঁকি করছিল তখন। আহসানের প্রশ্নে সবকিছু জড়িয়ে গেল তাঁর। লাজুকতার সূরে বললো,
” জানি না। আপনি খুব বাজে লোক!”
আহসান তৎক্ষনাৎ তরীকে বিছানায় ফেলে দিলো। নিজে বিছানায় হেলান দিয়ে বললো,
” লজ্জা না কাটলে আবার লজ্জা ভাঙ্গানোর ব্যবস্থা করি? আচ্ছা, কার যেন গলার নিচে একটা ডট আছে? আবার গলার একটু নিচে…
আহসান কিছু বলার আগেই তরী তাঁর মুখ চেপে ধরলো। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বললো,
” আমিও জানি হুহ! কার যেন কানের লতিতে তিল আছে? আবার ঘাড়েও আছে! বেশ করেছি কামড়ে দিয়েছি। আরো দেবো!”
আহসান ফের তরীর ওপরে হামলা চালালো। তরী পূর্ব প্রস্তুতি নিয়েই বসে ছিল। সে আজ আচ্ছা করে কামড়ে দেবে! বাজে লোক! তারপর দুজনার মাঝে আরেক দফা ভালোবাসা-বাসি হলো!
চলবে…