#নিকুঞ্জ_কানন
#নুজহাত_আদিবা
[পর্ব ১৮]
পুরো বাড়িতে আনন্দের পুলকিত আবেশে ছড়াছড়ি। প্রথম কারণটা তরীর এ প্লাস পাওয়ার খুশিতে। আর দ্বিতীয় কারণটা হলো এ প্লাস পাওয়ার খুশিতে তরীর অজ্ঞান হয়ে যাওয়া! তরীকে কোলে নিয়ে আহসান তখন পানি ছিটা দিয়েছে। এবং দীর্ঘ আধাঘন্টা শোভা আর রুমি তরীর মাথায় পানি ঢালার পর তাঁর জ্ঞান ফিরেছে। সেকি হাসাহাসি তরীকে নিয়ে! তরী লাজুক মুখে ভেজা চুল নিয়ে নিজের পাসের মিষ্টি খেলো। তরী জ্ঞান হারানো নিয়ে এত মাতামাতির মাঝে মাজদাকই মিষ্টি আনিয়েছেন। মধুবিবি তো তরীর সামনে বারবার বলেই যাচ্ছেন,
” দেখছো? কইসিলাম না খাজা বাবার মাজারের তাবিজ কোনোদিন বিফলে যায় না। ঠিকই তো ভালোমতো পাস দিয়া বাইর হইলা। আজকা একবার যাইয়ো আমার সঙ্গে। মানতের মোমবাতি মাজারে দিয়া আসুম।”
মধুবিবির কথা শুনে আহসান পাশ ফিরে মুখে হাত দিয়ে হেসে ফেললো। ইশ! তাবিজের লেখাটা যদি একবার মধুবিবিকে পড়ে শোনাতে পারতো! হাহা!
★
সেদিন সকালে আর আহসান কাজে গেল না। দুপুরের খাবার খেয়ে একেবারে কাজে গেল। মাজদাক অবশ্য মিষ্টিমুখ করেই কাজে চলে গেছেন। আহসানের কাঁধে খুশির আনন্দে আলসেমি ভর করেছে। কী যে হলো তাঁর! তরীকে ফেলে কাজে যেতে ইচ্ছেই হলো না। দুপুরে খেয়ে নিজেকে বেশ ঠেলেঠুলেই অফিসে গেল সে। আজ শোভা তরীর খুশিতে পোলাও আর রোস্ট রান্না করেছে। তরীর সবচেয়ে পছন্দ খাবার পোলাও রোস্ট বলেই এই আয়োজন। তবে, দুঃখের বিষয়! এত পছন্দের খাবার হওয়া সত্ত্বেও তরী খেতেই পারলো না। খাবারটা মজা হয়েছে। কিন্তু তরীর শরীরটা আজ ভালো নেই। মুরগি তো মুখে ছোঁয়াতেই পারলো না। কেমন তিতকুটে একটা গন্ধ! অনেক কষ্টে অল্প ক’টা সাদা পোলাও খেলো। তাও হজম হলো না! খেয়েদেয়ে উঠতেই গড়গড়িয়ে বমি হলো। তরী সবার শেষেই খেতে বসেছিল। শোভা কয়েকবার আহসানের সঙ্গে তরীকে খেতে জোরাজোরি করেছিলেন। তরী শরীরের খারাপের অজুহাত দিয়ে পরে খাবো বলে এড়িয়ে গিয়েছিল। সবার খাওয়া শেষে রুমি আর তরী একসঙ্গে খেতে বসেছিল। তরীর বমি হওয়ার পরপরই মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। রুমি তরীকে পেছন থেকে ধরে বললো,
” কী হয়েছে ভাবী? শরীর খারাপ?”
তরী রুমির কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে বললো,
” সকাল থেকেই জানি না কী হলো। মাথাটা কেমন যেন ঘুরছে। গা’টা কেমন যেন গুলিয়ে আসছে।”
রুমি তরীকে পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
” বেশি খারাপ লাগছে ভাবী? একটু স্যালাইন গুলে দেই?”
তরী মাথা দুলিয়ে না বোঝালো। ফের বললো,
” কিছু লাগবে না। আমি একটু ঘরে গিয়ে ঘুমোলেই ঠিক হয়ে যাবে।”
রুমি আর কিছু বললো না। তরীকে ঘরে দিয়ে এসে ফ্যানের পাখাটা বাড়িয়ে দিলো। শোভার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো শোভা ঘুমোচ্ছেন। আজ সকাল থেকেই বাড়িতে কাজ একটু বেশি ছিল কিনা। প্রথমে সব তরিতরকারি কুটে ফেলেছিলেন। তরীর পাসের খবর শুনে সব ফ্রিজে রেখে আবার মশলা বেঁটে রোস্ট চুলোয় দিয়েছিলেন। রুমি মধুবিবির ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মধুবিবি বললেন,
” এই রুমি! এদিকে আয় তো।”
রুমি দরজা ধরে উঁকি দিয়ে বললো,
” কী হয়েছে বুবু?”
মধুবিবি আলনা থেকে বোরকা বের করে বললেন,
” তোর ভাবীরে বল ভালো কাপড় পইড়া ঘোমটা দিতে। খাজা বাবার মাজারে মোমবাতি দিতে যামু।”
রুমি প্রত্যুত্তরে বললো,
” ভাবী কীভাবে যাবে? ভাবীর তো শরীর ভালো নেই।”
মধুবিবি পানের পিক ফেলে বললেন,
” কেন? কী হইসে তাঁর?”
রুমি ঘরে এসে বললো,
” জিজ্ঞেস করলাম ভাবী বললো শরীর ভালো নেই। খাবার টেবিলেও তেমন কিছু খায়নি। যা খেয়েছিল বমি করে উগলে দিয়েছে।”
মধুবিবি সবটা শুনে রুমিকে বললেন,
” আমি একটু তোর ভাবীর কাছে গেলাম। তুই আমার ঘরে বয়।”
মধুবিবি সচারাচর তরীদের ঘরে সেভাবে আসেন না। আজ কী হলো কে জানে! ঘরে ঢুকেই তরীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
” এই বউ? কী হইসে তোমার? ”
তরী মধুবিবির গলা শুনে মাথা তুলে কোনো রকমে উঠে বসলো। টলমল করতে করতে বললো,
” কিছু না বুবু। ওই মাথাটা একটু ঘুরছে।”
মধুবিবি তরীকে ভালোমতো পর্যবেক্ষন করলেন। তাঁর চেনা চোখ কখনো ভুল করতেই পারে না। তরীকে ফিসফিস করে বললেন,
” এই মাসে সবকিছু ঠিকঠাক হইসে তোমার?”
তরী প্রথমে বুঝতে পারলো না। মধুবিবি আবার ইঙ্গিত করতেই বললো,
” না বুবু।”
মধুবিবি তরীকে ইশারায় উঠে দাঁড়াতে বললেন। তরী উঠে দাঁড়াতেই মধুবিবি তরীর পেট টিপে-টুপে কী যেন দেখতে লাগলেন। তরীর সেসব ঠিক বুঝলো না। মধুবিবি তরীর শাড়ির আঁচলটা ঠিক করে দিয়ে বললেন,
” তুমি হাত-মুখ ধুইয়া বসো। আমি দিলুর মায়রে ফোন লাগাইতেসি।”
তরী ধীর পায়ে হাতমুখ ধুতে চলে গেল। মধুবিবি ঘরে গিয়ে রুমিকে নিজের বাটন ফোনটা দিয়ে বললেন,
” দিলুর মা-রে একটা ফোন লাগা তো রুমি। আমার নাম নিয়া বল তাড়াতাড়ি আইতে।”
আধাঘন্টা পরে দিলুর মা সত্যি সত্যি এলো। বোরকা পরিহিত এক মধ্য বয়স্কা নারী। তরী তাঁকে দেখে উঠে দাঁড়ালো। মধুবিবি দিলুর মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
” বউয়ের মাথা ঘোরে; বমি হয়। আমার তো মনে হইতাসে পেটে পোনা আসছে। তুমি একটু ভালোমতো দেখো তো দিলুর মা। বয়স হইসে ভুল ও হইতে পারে।”
দিলুর মা তরীকে বিছানায় বসিয়ে কী কী অদ্ভুত সব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন। মধুবিবির মতো পেট টিপে দেখলেন। চোখ, জিহ্বা সব দেখলেন। তারপর মধুবিবিকে বললেন,
” যা ভাবসেন তাই চাচী। পেটে সন্তান আসছে! মাসিকের তারিখ ধরলে এক বা দেড় মাসের মতো চলে। তাও একটু ডাক্তারের কাছে নিয়া টেস্ট করাইয়া দেইখেন। খাওয়া দাওয়া বাড়াইয়া দেন। বউয়ের শরীর অনেক দূর্বল। এমনেই চিকনা-চাকনা তাঁর মধ্যে এখন পেটে আরেকজন। খেয়াল রাইখেন চাচী; আমি আসি।”
তরী সবটা শুনে বিস্মিত! খালাম্মা এটা কী বললো? আহসান বারবার করে বলে দিয়েছিল এখন যেন সন্তানের কথা তরী মাথায় না আনে। পিলগুলোও তো ঠিকঠাক নিয়েছিল। বাবুটা কীভাবে এলো পেটে? বাবুটার জন্যই কী আজকাল এত খারাপ লাগে? শুধু বমি পায় আর দূর্বল লাগে! তরী আহসানের বলা কথাগুলো মনে করতেই ভয়ে আতংকে কেঁদে ফেললো। আহসান বাবুটার কথা শুনলে তাঁকে আর আস্ত রাখবে না। যদি বার করে দেয় বাড়ি থেকে? বাবুটাকে যদি না মেনে নেয়? তরী বালিশে মুখ গুঁজে ঠোঁটে আঁচল গুঁজে কাঁদতে লাগলো। মধুবিবি তরীর কান্না দেখে হতবিহ্বল হয়ে বললেন,
” এই বউ? কী হইসে তোমার? শরীরটা বেশি খারাপ লাগতাসে? এমনে কানতাসো কেন? এক গ্লাস ঠান্ডা লেবুর শরবত কইরা দেই?”
তরী মধুবিবির শাড়ির আঁচল চেপে ধরে বললো,
” বুবু উনি আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন। উনি এখন বাবু চান না। উনি বলেছিলেন বাবুর কথা যেন এখন একেবারেই মাথায় না আনি। উনি যে-ই ঔষধগুলো খেতে বলেছিলেন। আমি তো ওগুলো খেতাম। বাবুটা কীভাবে চলে এলো? উনি জানতে পারলে আমাকে ছেড়ে দেবেন। আমি সত্যি বলছি বুবু! আমি বাবুটাকে আনিনি। বাবুটা কী করে এলো আমি জানি না। আমি এখন কী করবো? ঔষধ খেয়ে নষ্ট করে দেবো বুবু?”
তরীদের কয়েক বাড়ি পরেই আনিস চাচাদের বাড়ি। আনিস চাচার দুটো বাবু। প্রথম বউ হঠাৎ স্ট্রোক করে মা’রা যাওয়ায় দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের সময় নতুন চাচীকে শর্ত দিয়েছিলেন কোনোদিন সে বাবু নিতে পারবে না। কিন্তু, বিয়ের আটমাস পরেই কীভাবে যেন নতুন চাচীর পেটে একটা বাবু চলে আসে। আনিস চাচা বাবুটার কথা শুনেই এলাকায় সালিশ বসিয়েছিল। মুরুব্বিদের সামনে বেলী চাচীকে বলেছিল যে বাচ্চাটা রাখলে চাচীকে সে তালাক দেবে। সংসার হারানোর ভয়ে পরে বেলী চাচী বাবুটা ঔষধ খেয়ে নষ্ট করে দিয়েছিল। আহসান এখন যদি সত্যি সত্যি তরীর নামে সালিশ বসায়? ভয়ে তরীর মুখ লাল হয়ে গেল। মধুবিবি তরীর অবস্থা দেখে বললেন,
” ছি ছি! কী কও এসব বউ? পেটের পহেলা প্রথম বাচ্চা। আল্লাহর রহমত এমনে নষ্ট করতে চাও? শোনো বাচ্চাটা আল্লাহ তোমারে রহমত হিসাবে দিসে। আমার আহসানরে আমি ভালো কইরাই চিনি। বাড়ি ফিরলে শান্ত হইয়া তারে বুঝায়া বললে সে বুঝবো। আর যত যাইহোক ভুলেও ওইসব উল্টাপাল্টা ঔষধ খাইবা না। আল্লাহর মাল আল্লাহ বুঝবো। ব্যাডা মানুষ ওইরকম অনেক কথাই কয়। সব কথা ধরতে নাই। হুদাই কাইন্দা শরীর খারাপ কইরো না। যাঁর কথা শুইনা কানতাসো। পরে দেখবা সন্তানের খুশিতে সেই ফালাইতাসে।”
মধুবিবি উঠে গিয়ে তরীর জন্য লেবুর শরবত বানালেন। তরী ঝাপসা চোখে গ্লাস হাতে নিয়ে বসে রইলো। বাবুটা তাঁকে কী মসিবতে ফেললো! তরী পেটে হাত রেখে বললো,
” তোমার বাবা তোমাকে চায় না বাবু। তুমি কেন আসলে? এখন যদি আমাকে উনি বার করে দেয়? আমার নামে সালিশ বসালে আমি কী করবো? তুমি কথা শোনো না কেন বাবু?”
তরী ঘর ছেড়ে সেদিন বেরোলোই না। কোথায় পাস করেছে আনন্দ করার দিন। বাবুটা তাঁকে কী বিপদে ফেললো! আহসান আসার আগে লুকিয়ে পরতে হবে। মধুবিবি আহসানকে সব বলে দিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে! আহসান যদি তাঁকে মা’রে?
★
আহসান রাতে হেলতে দুলতে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরলো। বাড়িতে ঢুকতেই মধুবিবি তাঁকে ডেকে পাঠালেন। আহসান গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছে মধুবিবির ঘরে গিয়ে বসলো। মধুবিবি রুমিকে ইশারা দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বললেন। রুমি তাই করলো। রুমি চলে যেতেই মধুবিবি আহসানকে বললেন,
” তোমার বউ তো কাইন্দা কাইটা ভাসায়া ফেলতেসে!”
আহসান হতভম্ব হয়ে বললো,
” কেন? পাসের খুশিতে? মেয়েটার কী হলো? খুশিতে বেহুশ হয়ে যাচ্ছে। আবার খুশিতে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে!”
মধুবিবি পানের খিলি বানাতে বানাতে বললেন,
” কী হইসে জানবা কেমনে? তুমি হইলা ব্যস্ত মানুষ। বউয়ের খবর রাখার সময় তোমার আছে?”
আহসান ভ্রু কুঁচকে বললো,
” কী হয়েছে বুবু তরীর?”
মধুবিবি পানের খিলি মুখে পুরে বললেন,
” কী হইসে শুনতে চাও? তাঁর পেটে তোমার সন্তান আসছে। দেড় মাসের সন্তান। সকালে সে এই কারণেই বেহুশ হইসে। দুপুরেও বমি কইরা সব উগলায়া দিসে। তুমি বউটার দিকে একটুও খেয়াল রাখো না।”
সন্তানের কথাশুনে আহসান চমকে উঠলো। বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা অনুভূতির সৃষ্টি হলো। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
” তরী বলেছে তোমাকে এসব?”
মধুবিবি কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,
” তাঁর বলতে হইবো কেন? আমার চোখ নাই? দিলুর মা’রে ডাক দিয়া পাঠাইসিলাম। সেও দেইখা একই কথা বলসে।”
আহসানের শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল। সন্তান আসছে তাঁর? আবার ভয় হয়! তরীর অপোক্ত শরীর। এত ধকল সইতে পারবে তো? বাচ্চাটার জন্য তরীর যদি ক্ষতি হয়? আহসানকে নীরব থাকতে দেখে মধুবিবি বললেন,
” শোনো ভাই, সন্তান হইলো আল্লাহর তরফ থেইকা আসা নেয়ামত। তুমি তারে বলসো তুমি এখন সন্তান চাও না। তোমার ভয়ে সে আমারে বলতেসে ঔষধ খাইয়া বাচ্চা নষ্ট কইরা ফেলবো। বাচ্চাটার দোষ কী? সন্তানের কথা শুইনা তাঁর সঙ্গে রাগারাগি কইরো না। আল্লাহ খুশি হইয়া দিসে; মাইনা নেও। বাচ্চায় যখন আব্বা কইয়া ডাকবো। তখন দেখবা কইলজা কেমন ঠান্ডা হইয়া যায়।”
আহসান মুখে কিছু বললো না। তরীর ওপরে মনে মনে প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হলো। নাহয় কথার ছলে তরীকে সে বলেছিল যে এখন তাঁর বাচ্চা চাই না। ইচ্ছে ছিল তরীর পড়াশোনা একটা স্টেবল পর্যায়ে এলে সন্তান নেওয়ার। কিন্তু, এখন যখন বাচ্চাটা চলেই এসেছে। তাঁকে ঔষধ খেয়ে নষ্ট করবার মতো ভয়ানক কথা কী করে মুখে তুললো তরী? যতই হোক সন্তানটা তাঁর। তরী সন্তানটাকে এভাবে হেলায় হারিয়ে দিতে কেন চাইছে? বাচ্চাটার শরীরে আহসানের র’ক্ত বইছে। সেটা কী ভুলে গেছে তরী? আহসান শান্ত স্বরে বললো,
” বুবু আমি এখন সন্তান চাইনি সেটা সত্য। তরীর বয়স কম; অপরিপক্ক শরীর। চেয়েছিলাম তরীর পড়াশোনা একটা স্টেবল পর্যায়ে এলে সন্তান নেবো। সন্তান এসেছে তা নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু, তরীর ওপরে প্রচন্ড মেজাজ খারাপ লাগছে। কী বুঝতে কী বুঝেছে কে জানে! নিজের সন্তান নিয়ে ওসব কেউ ভাবে?”
মধুবিবি আহসানের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
” বুঝে নাই হয়তো। থাক তারে বকাঝকা কইরো না। একটু খেয়াল রাইখো। শরীরটা অনেক দূর্বল। এখন তো আর একলা না। পেটে আরেকজন আছে।”
আহসানকে মধুবিবির ঘর থেকে বের হতে দেখে তরী বুক খামচে ধরলো। সর্বনাশ! বুবু সব বলে দিয়েছে আহসানকে। কী হবে এখন? ভয়ে তরী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। আহসান ঘরে ঢুকতেই নিচে বসে আহসানের পা জড়িয়ে ধরে বললো,
“বিশ্বাস করুন আমার ভুল হয়ে গেছে। বাবুটা কীভাবে এলো জানি না। আপনি পিলগুলো দিয়েছিলেন না?ওগুলো নিয়ম করে সত্যি খেয়েছিলাম। আপনি না চাইলে ঔষধ খেয়ে বাবুটাকে নষ্ট করে দেবো। আপনি তাও আমাকে ছেড়ে দেবেন না! আপনি যা বলবেন তাই করবো। আমাকে দরকার হলে বাড়ি পাঠিয়ে দিন। তাও আমাকে তালাক দেবেন না!”
আহসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে তরীকে টেনে ওপরে তুললো। কাঁদতে কাঁদতে তরীর হেঁচকি উঠে গেছে। তরীর গালে হাত রেখে বললো,
” তুমি আমাকে এতটা খারাপ ভাবো তরী? একটা সন্তান বাবা মায়ের ভুল হয় কখনো? এই সন্তানটা তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার প্রতীক।আর তুমি ওকে নষ্ট করতে চাইছো?”
তরী কোনো জবাব দিতে পারলো না। আহসান তরীকে বিছানায় বসিয়ে বুকে টেনে নিলো। কপালে চুমু দিয়ে বললো,
” এখন থেকে আর হেয়ালি করবে না। রোজ এক গ্লাস করে দুধ আর দুটো ডিম খাবে। ভারী কাজ করার দরকার নেই। এখন কিন্তু আর একা নও। বাবুটার একটু খেয়াল রাখতে হবে তো নাকি?”
তরী আহসানের বুক থেকে মাথা উঁচু করে বললো,
” আপনি আমার ওপরে রেগে নেই তো? আমি কিন্তু ইচ্ছে করে..”
আহসান তরীকে বাকিটুকু শেষ করার আগেই থামিয়ে দিয়ে বললো,
” ওসব থাক। বাবু নিজে থেকে আসতে চেয়েছে। তাই এসেছে! ওসব নিয়ে এত ভেবে কাজ নেই। যা বলেছি মনোযোগ দিয়ে শুনবে। শরীরের কী হাল দেখেছো?নিজের আর বাবুর দুজনের খেয়াল রাখবে।”
তরীকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে আহসান যে-ই না তরীর পেটে হাত রাখলো। তরী সুরসুরিতে খিলখিল করে হেসে উঠলো।আহসান পেটে হাত রাখা অবস্থাতেই বললো,
” বাবুর আম্মু হাসছে কেন?”
তরী খিলখিল করে হাসতে হাসতে বললো,
” বাবুর বাবা বাবুর আম্মুকে বকেনি তাই!”
★
সকালে আহসান তরীকে নিয়ে ডক্টরের কাছে গেল। তরীকে বেশ কিছু টেস্ট আর আল্ট্রা করতে দেওয়া হলো। ডক্টর খাওয়া দাওয়ার একটা চার্ট দিয়ে দিলেন। সেই থেকে তরীর ওপরে অত্যাচার শুরু হলো। সকালে নাস্তায় আহসান তাঁকে ঠেসেঠুসে জোর করে খাওয়ায়। দুপুর থেকে শোভা একটার পর একটা তরীর জন্য তৈরি করতেই থাকেন। রাতের কথা মনে করলে তরীর আরো ভয় হয়। বাবু আসার পর থেকে রীতিমতো তাঁকে খাওয়া দাওয়া নিয়ে কী যে ঝামেলায় পরতে হচ্ছে। কিছুই মুখে রুচে না। মধুবিবি বাজার থেকে শুকনো বরই আর তেঁতুল কিনে তরীর জন্য আঁচার করেছেন। তরী এতে বেজায় খুশি। আজকাল তাঁর আরো বেশি বেশি টক খেতে ইচ্ছে হয়। মধুবিবিও আজকাল খুব ব্যস্ত। দিনরাত এক করে বাবুর জন্য কাঁথা সেলাই করেন।
চলবে…
#নিকুঞ্জ_কানন
#নুজহাত_আদিবা
[পর্ব ১৯]
রুমির আজ প্রথম কলেজ যাওয়ার দিন। সকাল থেকেই উল্লাস আর উৎফুল্লতার অন্ত নেই। কলেজের ড্রেস পড়ে মাজদাকের হাত ধরে প্রথমবারের মতো কলেজ গেল সে। আহসান আজকে প্রথম কলেজ যাওয়ার উপলক্ষে রুমিকে একশো টাকার দু’টো নোট দিয়েছে। সেগুলো দিয়ে আজকে বেলপুরি, ফুচকা আর ঝালমুড়ি খাবে সে। কলেজে যাওয়ার পথেই ফাইল নিয়ে হেঁটে বলা রঙ্গনের সঙ্গে দেখা হলো তাঁর। রঙ্গন লক্ষ্য করলো সাদা ধবধবে কলেজ ড্রেস; পরিহিত বিনুনি বাঁধা একটা মেয়ে মাজদাকের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। রুমির কথা মাথায় আসতেই রঙ্গন দ্রুত হেঁটে গিয়ে মাজদাককে সালাম দিয়ে বললো,
“কেমন আছেন খালুজান?”
মাজদাক হেসে সালামের জবাব নিয়ে বললেন,
” ভালো বাবা। এত তৈরি হয়ে ফাইল নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?”
রঙ্গন চুলে হাত বুলিয়ে ফাইলটা শক্ত করে ধরে বললো,
” দোয়া করবেন চাচা। চাকরির পরীক্ষা দিতে চাচ্ছি। চাকরিটা হলে আপনার মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে চলে যাবো।”
শেষের কথাটা বিরবির করে বলায় মাজদাক শুনতে পেলেন না। রুমি অবশ্য রঙ্গনকে দেখে মনে মনে তাঁকে ভেংচি কেটে বললো,
” তুই শা’লা ফেল করবি ফেল!”
★
আজ মনোয়ারা আর গুনগুন এসেছে তরীকে দেখতে। গুনগুন এখন ক্লাস ফাইভে পড়ে। তাঁর এখন দশ বছর হয়েছে। তরীকে মা আর বোনের আকষ্মিক আগমনে বেজায় খুশি। মনোয়ারা শোভাকে অনুরোধের সূরে বললেন,
” তরীকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাই? এই অবস্থায় থাকুক না আমার কাছে কয়েকটা দিন। ওর বাবা বেঁচে থাকলে কী যে খুশি হতেন! মেয়েকে মাথায় তুলে রাখতেন।”
শোভা গুনগুনকে কোলে বসিয়ে বললেন,
” আসলে প্রথম বাচ্চা তো আমরা চাইছিলাম আমাদের কাছেই থাকুক। আপনার ভাই তো তরীকে এখনই চোখে হারায়। আপনি বলেছেন যেহেতু আমি অবশ্যই তরীকে পাঠাবো। কিন্তু আজ নয়। এখনই সন্ধ্যা নেমে গেছে। আপনাদের যেতে যেতে রাত হয়ে যাবে। কাল সকাল সকাল আহসান গিয়ে দিয়ে আসবে। একটু খেয়াল রাখবেন ওর। আর তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দেবেন। ওকে ছাড়া বাড়ি ফাঁকা ফাঁকা লাগে।”
মনোয়ারা মুচকি হেসে শোভার সঙ্গে গল্পে মেতে উঠলেন। হায়দারের মৃত্যুর পর এই বাড়িতে এই প্রথম তাঁর আসা। হায়দার বেঁচে থাকাকালীন অনেকবার তাঁর সঙ্গে এসেছে সে। মানুষটা নেই আজ কতটা দিন হয়ে গেল!
গুনগুন তরীর কাছে চুপটি করে বসে বললো,
” মা ঝর্না খালামনিকে বলছিল তোমার পেটে নাকি একটা বাবু আছে। কোথায় সেই বাবুটা? আমাকে দেখাও!”
তরী গুনগুনের গাল টেনে দিয়ে বললো,
” এখন না। আরো অনেকগুলো দিন যাক। তারপর আমি বাবু আর তুমি একসঙ্গে পুতুল খেলবো। ঠিক আছে?”
গুনগুন মাথা দুলিয়ে বললো,
” বাবুটাকে রাতে আমাদের মাঝখানে রেখে ঘুমাবো হ্যাঁ? আমাদের খাটটা উঁচু না? যদি পরে যায়?”
তরী সায় দিয়ে বললো,
” হ্যাঁ। ও খুব ছোট্ট এখনও। বাবু তোমার কথা সেদিন বলেছে জানো?”
গুনগুন বড়বড় চোখে চেয়ে বললো,
” কী বলেছে বুবু? ও খেলবে আমার সঙ্গে? ”
তরী গুনগুনের গালে চুমু বসিয়ে বললো,
” হুম। ও বলেছেন গুনগুন খালামনি কোথায়? গুনগুন খালামনি কোথায়? পঁচা খালামনিটা কেন দেখতে আসে না আমায়?”
গুনগুন ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,
” কোথায়? আমি তো এলাম আজকে। বাবুটাকে বলে দেবে আমি ওর সঙ্গে কাট্টি নিয়েছি। ও পঁচা বলেছে আমাকে!”
তরী জবাবে বললো,
” বাবু তো তাহলে অনেক কাঁদবে! গুনগুন খালামনিকে ও অনেক ভালোবাসে। গুনগুন খালামনি কাট্টি নিলে ও কার সঙ্গে পুতুল খেলবে?”
গুনগুন মুখ ভার করে কী যেন ভাবলো। অতঃপর বললো,
” না থাক বাবুর সঙ্গে কাট্টি শেষ। ওর সঙ্গে ভাব ভাব ভাব! ওকে বলে দেবে ও যেন না কাঁদে। আমি ওর সঙ্গে পুতুল খেলবো।”
তরী হেসে গুনগুনের ফোলা গালে আবারও চুমু বসালো। রুমি এসে গুনগুনকে তাঁর ঘরে নিয়ে সাজিয়ে দিলো। এই বয়সেই সাজগোজের প্রতি কী দূর্বলতা! ও বাড়িতে থাকাকালীন তরীর পিছু পিছু চিরুনি নিয়ে শুধু ঘুরতো। সুন্দর করে চুল বেঁধে দেওয়ার জন্য।
★
আজ সকালে তরীর জন্য ঔষধপত্র, ফলমূল কিনতে গিয়ে সৌম্যর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কথা প্রসঙ্গে আহসানই দিলশানের প্রসঙ্গে জানতে চেয়েছিল। সৌম্য নতমুখে দিলশানের ব্যাপারটা খুলে বললো। দিলশান সৌম্যর সঙ্গে নতুন একটা জীবন শুরু করতে রাজি নয়। বারবার করে সৌম্যকে বলেছে সৌম্য যেন বিয়ে করে নেয়। স্ত্রী, সন্তান নিয়ে সুখে থাকে। সৌম্য যাওয়ার পথে আহসানকে দিলশানের নাম্বারটা দিয়ে বলেছে,
” সময় করে ওকে ফোন করে একটু বুঝিয়ে বলিস বন্ধু। দিলশান ছোট বাচ্চা নয়। একটু হলেও তোর কথা বুঝবে।”
কাজের ফাঁকে সৌম্যর দেওয়া নাম্বারটায় কল করলো আহসান। দু’বার রিং হলো; তৃতীয় বারের বেলায় দিলশান কলটা ধরে বললো,
” হ্যালো, কে বলছেন?”
আহসান শান্ত গলায় বললো,
” আহসান। পলাশনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তোমার ব্যাচমেট বলছি।”
দিলশান বিষ্মিত হয়ে বললো,
” আরে আহসান! কেমন আছো আহসান? কতবছর পর তোমার সঙ্গে কথা। পুষ্পিতার কাছে শুনেছিলাম বিয়ে করেছো। তোমার ওয়াইফ কেমন আছে?”
আহসান তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,
” আমি আমার ওয়াইফ দুজনেই ভালো আছি। তুমি কেমন আছো দিলশান? জীবনকাল কেমন চলছে?”
দিলশান মৃদু হেসে বললো,
” ছোটখাটো প্রাইভেট স্কুলের মাস্টারনির জীবন আর কেমনই হতে পারে? তোমার কেমন চলছে তাই বলো।”
আহসান হেলান দিয়ে বসে বললো,
” কিছুদিনের মধ্যেই প্রাইমারী স্কুলের জয়েনিং। বাবা হচ্ছি দোয়া করো দিলশান।”
দিলশান আফসোসের সূরে বললো,
” তুমি কী সুন্দর নিজের জীবনটাকে সাজিয়ে নিয়েছো আহসান। বিয়ে করেছো, বাবা হচ্ছো। সৌম্য যদি একটু নিজের দিকটা দেখতো! ও কী পারতো না সবকিছু ভুলে গিয়ে নতুন করে শুরু করতে?”
আহসান ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
” সেটাই তো করতে চাচ্ছে দিলশান। একবার ভেঙ্গে গুড়িয়ে ছাড়খাড় করে দিয়েছো মানুষটাকে। সবকিছু ভুলে তোমার সঙ্গে একটা নতুন কিছুর সূচনা করতে চেয়েছিল। তুমি আগের বারের মতোই হেলায় হারিয়ে দিচ্ছো। তুমি খুব কঠিন দিলশান। একটা মানুষকে কয়বার ভাঙ্গবে দিলশান?”
দিলশানের চোখে জল চলে এলো। ভেজা গলায় আহসানকে বললো,
” আমি ডিভোর্সি আহসান। একটা মিসক্যারেজ হয়েছিল। নানারকম মেয়েলী সমস্যায় এখনও ভুগছি। ইউটেরাস এতটাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যে, ভবিষ্যতে মা হতে পারবো কিনা তাও জানি না। আমি কীভাবে সৌম্যর মতো একটা আনম্যারেড ছেলেকে নিজের সঙ্গে জড়াই?”
আহসান নির্বিগ্নে বললো,
” তাই বলে এবারও খালি হাতেই ফিরিয়ে দেবে?”
দিলশান কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
” আমার যে দেওয়ার মতো কিছুই অবশিষ্ট নেই আহসান! কী দেবো সৌম্যকে আমি?”
আহসান প্রত্যুত্তরে বললো,
” তোমার চেয়ে বড় পাওনা সৌম্যের কাছে আর কী হতে পারে দিলশান?”
দিলশান কান্না সামলে বললো,
” সৌম্যকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে জলদি একটা বিয়ে দিয়ে দাও। সংসারের চাপে আমাকে ভুলে যাবে। আমি একটা ডিভোর্সি মেয়ে। সন্তান সুখও দিতে পারবো না। তাছাড়া সমাজ কী বলবে আহসান? সৌম্য আনম্যারেড ছেলে। বিয়ে করলে ওর সব হবে। আমি তো ওকে ওর প্রাপ্য কিছুই দিতে পারবো না।”
আহসান নরমসূরে বললো,
” ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই এক কথা দিলশান। তুমি দুইদিন না খেয়ে থাকো সমাজ কিছু বলবে না। কিন্তু খিদের তাড়নায় একটা রুটি চুরি করে দেখো? দেখবে তোমার বিচারে কত বীরপুরুষদের আগমন! সমাজের কথা ভুলে যাও দিলশান। নিজেকে নিয়ে ভাবো। নিজের জন্য স্বার্থপর হওয়াটা মন্দ কিছু নয়। তোমার জীবনেও তো কম কিছু ঘটেনি। অতীতটাকে না ঘাটিয়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে একটু ভাবো। তোমার একটা ছোট্ট সংসার হলো সৌম্যের সঙ্গে। একটু ভেবে দেখো না দিলশান? খুব মন্দ হবে কী এমনটা হলে?”
দিলশান চোখ বুঁজে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এমনই তো একটা স্বপ্ন ছিল তাঁর। সৌম্যের সঙ্গে ছোট্ট একটা সংসারের। সেটা তো হলোই না! যাকে বিশ্বাস করে ঘর করেছিল। সেটাও নিভৃতে ভেঙ্গে গেল!
★
মনোয়ারা গুনগুনকে নিয়ে সন্ধ্যার পরপরই আহসান আসার আগে চলে গেছেন। শোভা বারবার করে বলেছিল খেয়ে যেতে। গুনগুন ছোট মানুষ আবার সঙ্গে কোনো পুরুষ মানুষ নেই বিধায় তাড়াতাড়িই চলে গেছেন। আহসান মনোয়ারার আসার কথা শুনে দ্রুতই বাড়ি ফিরলো। তবুও তাঁদের দেখা পেলো না। মনোয়ারা ততক্ষণে বেরিয়ে গেছেন। আহসান ঘরে ফিরলে এখন আর সঙ্গে সঙ্গেই তরীর কাছে তাঁকে যেতে দেননা মধুবিবি। আহসান সন্ধ্যার পরপরই বাড়ি ফেরে। পাছে আহসানের পিছু ধরে খারাপ জিনিষ না তরীর কাছে যায় সেই ভয়ে; আহসানকে চুলোর কাছে নিয়ে হাত গরম করে সূরা-কারাত পড়িয়ে গায়ে ফু দিয়ে তারপর তরীর কাছে পাঠান। আহসান প্রথম প্রথম বিরক্ত হলেও এখন আর কিছু বলে না। রুমির পরে এতবছর পর বাড়িতে বাচ্চা আসছে তাই সবার বাড়াবাড়িটা একটু বেশি। এখন রুমিকেও ডাক দিলে আগের মতো আর খুঁজে পাওয়া যায় না। মধুবিবির সঙ্গে বসে বসে রুমিও এখন কাঁথা সেলাই করে। আহসান ঘরে গিয়ে দেখলো তরী বিছানায় শুয়ে আছে। আহসানকে দেখে দ্রুত উঠে বসে বললো,
” জানেন আজ গুনগুন এসেছিল! গুনগুন বলেছে আমাদের বাবুর সঙ্গে পুতুল খেলবে। হিহি!”
আহসান তরীর পাশে গিয়ে বসলো। তরীকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে বললো,
” তা খেলুক। আমার পুতুল তো আমার তুলতুল।”
তরী আহসানের পাঞ্জাবির বোতাম ঘোরাতে ঘোরাতে লজ্জায় মুখ গুঁজলো। আহসান কয়েক মিনিট নীরব থেকে বললো,
” বাবুর বয়স কতদিন হলো? কথা বলতে পারে সে?”
তরী মাথা তুলে বললো,
” দুইমাস দুই দিন। আমার সঙ্গে অনেক গল্প করে বাবু। কিন্তু, আপনার সঙ্গে রাগ করেছে তাই কথা বলবে না।”
আহসান তরীর চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললো,
” উম ভাবার বিষয়! আমাদের বাবুর একটা নাম রেখেছি জানো?”
তরী উৎসাহী হয়ে বললো,
” কী নাম?”
আহসান মুচকি হেসে বললো,
” তুবা! নামের আগপিছু কী হবে তা এখনও ভাবিনি। ডাকনাম হবে তুবা। সুন্দর না?”
তরী আহসানের বুক থেকে সরে গিয়ে বললো,
” কীসের তুবা? এটা তো মেয়েদের নাম। আমার তো আপনার মতো একটা ছেলেবাবু চাই!”
আহসান তরীকে ফের বুকে টেনে নিয়ে বললো,
” উহুম! আমাদের মেয়ে বাবুই হবে। তুলতুলের মতো অভিমানী, কাঁদুনি একটা মেয়ে বাবু। তুমি আমার তুবার আম্মু!”
তরী ভ্রু কুঁচকে বসে রইলো। এই লোক সবসময় বেশি বোঝে! বাবুটা তাঁর সঙ্গে সারাদিন কথা বলে। সে বুঝি জানে না বাবু ছেলে নাকি মেয়ে? তরীর তো একটা ছেলেবাবু চাই। আহসানের মতো ঠোঁট টিপে মুচকি হাসা ছেলে বাবু।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘরে এসে; আহসান বিছানায় তরীকে জড়িয়ে ধরে বললো,
” কালকে নাকি তুবার নানুবাড়ি যাচ্ছেন তুবার আম্মু? কয়দিন থাকবেন?”
তরী উৎফুল্ল হয়ে বললো,
” মা বলেছে কমপক্ষে একমাস যেন থাকি। অনেকদিন পর যাচ্ছি তো।”
আহসান মৃদু চিৎকার করে বললো,
” একমাস?”
তরী আহসানের আপত্তি আছে বুঝতে পেরে বললো,
” আচ্ছা পনেরো দিন থাকবো তাহলে।”
আহসান নিরাশ হয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,
” পনেরো দিন? আমার তোমাকে আর বাবুকে ছাড়া ঘুম আসবে বলো তুলতুল? আমার দিকটাও একটু বিবেচনা করা দরকার। পনেরো দিন অনেক বেশিদিন। আমি তোমাদের ছাড়া থাকতে পারবো না!”
তরী কয়েক লহমা ভেবে ভেবে বললো,
” আচ্ছা এক সপ্তাহ থাকবো। আপনি কিন্তু আর রাগ করতে পারবেন না। বাবু বলেছে বাবু নানাবাড়ি ঘুরতে চায়। আমার কী দোষ?”
আহসান আর আপত্তি করলো না।কথামতো তরীকে ঠিকই পরদিন সকালে বাড়িতে রেখে এলো আহসান। মনোয়ারা মেয়েকে দেখে ভেবেছিলেন কমপক্ষে একমাস তো কাছে রাখবেনই! আহসানের কাছে তরীর থাকার মেয়াদ এক সপ্তাহ শুনে মনটা খারাপ হলো। কিন্তু কীসের এক সপ্তাহ? দিনে ত্রিশবার করে তরী-ই মনোয়ারার ফোন থেকে আহসানকে কল করে। রাতে ঘুমোতে গিয়েও বাদ নেই। ফিসফিস করে মাঝরাত অবধি আহসানের সঙ্গে গল্প করে। শেষ অবধি না থাকতে পেরে চারদিনের দিনই তরীকে বাড়ি নিয়ে গেল আহসান। মনোয়ারা এসব কীর্তিকলাপ দেখে বেজায় হাসলেন। বিয়ের কথা শুনে যে মেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই নাকোচ করে দিয়েছিল।বিয়ের দিনও মুখ গোমড়া করে বসেছিল। সে আজ বরকে ছাড়া এক সপ্তাহও থাকতে পারছে না। কী ভয়ংকর সুন্দর ব্যাপার-স্যাপার! এই জীবনে ম’রে গিয়েও শান্তি এক জায়গায়ই।তরীকে তিনি ভুল কারো হাতে তুলে দেননি। সারাজীবন যেন এভাবেই সুখে থাকে মেয়েটা।
চলবে…