নিকুঞ্জ কানন পর্ব-২৪+২৫

0
27

‎#নিকুঞ্জ_কানন
‎#নুজহাত_আদিবা
[পর্ব ২৪]

তরীর জীবনে এখন নতুন কিছু বিষয় সংযুক্ত হয়েছে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্বও অনেকটা বেড়ে গেছে। এডমিশন ফ্রেজ চলাকালীন আহসান তাঁকে প্রচুর সাহায্য করেছে। তরীও অবশ্য কম চেষ্টা করেনি। অনলাইন কোর্সের পাশাপাশি আহসানের দেওয়া গাইডলাইন’স গুলোও তাঁর খুব কাজে এসেছে। আহসানের ইচ্ছে ছিল তরী তাঁর ভার্সিটিতেই পরুক। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছেতে সেটা হয়েছে। সবচেয়ে মজার বিষয় তাঁদের সাবজেক্ট ও সেম। একাউন্টিং! নাতাশাও তরীর সঙ্গে একই ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে। কিন্তু সাবজেক্ট ভিন্ন। তরীর একাউন্টিং আর তাঁর ফিন্যান্স। আপাতত তৃতীয় বর্ষের ক্লাস চলছে তাঁদের। নাতাশার কাছ থেকে গোপন সূত্রে তরী শুনেছে। তাঁদের ক্লাসের ওই ব’দ মেয়ে ঝুমুর যে আহসানকে ফোন দিতো না? সে পরীক্ষায় ফেল করেছে। শুনে তরীর প্রথমে খারাপ লাগলেও পরে ভালোই লেগেছে। পড়াশোনা বাদ দিয়ে অন্যের বরকে ফোন করে প্রেমালাপ জুড়ে বসলে এমনই হবে!
আর রুমিটাও এই বছর প্রথম বর্ষে উঠেছে। কয়েকদিন হলো ক্লাস শুরু হয়েছে তাঁদের। আহসান খুব চেষ্টা করেছিল রুমিকে পাবলিকে চান্স পাইয়ে দেয়ার। কপাল মন্দ বলে রুমি পেল না! সেকেন্ড টাইম দিতে চেয়েছিল। কিন্তু, আহসান আর দিতে দেয়নি। বাড়ি থেকে কাছাকাছি পরে সেরকমই ভালো একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিয়েছে। প্রথম প্রথম রুমির এই নিয়ে মন খারাপ হলেও এখন আর হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা মন্দ লাগছে না। নতুন নতুন বান্ধবী হয়েছে তাঁর!

” আম্মা আমার রুমিরে লাগবো। আপনে বলসিলেন সরকারি চাকরি পাইলে রুমিরে ঘরে তুলবেন। পাইসি না চাকরি? এখন নিজের কথা রাখেন। রুমিরে আইনা দেন!”

নাহার বেগম চিন্তিত হয়ে বললেন,

” রুমি কী বাজারের বিক্রি করা সবজি যে চামু আর দিয়া দিবো? কবে কোন কথা বলসি তা ধইরা বইসা থাকলে হইবো?”

রঙ্গন তীব্র প্রতিবাদ করে বললো,

” কী? আপনে আমারে কথা দিসিলেন! এত কথার বরখেলাপ করলে আমি বাড়ি ছাইড়া যামু গা। এতদিন বেকার আছিলাম খানার খোঁটা দিয়া দমায়া রাখসেন। এখন আর পারবেন না!”

নাহার বেগম রঙ্গনের তেজ দেখে বুঝে গেলেন ছেলেকে দমানোর মতো সাধ্য তাঁর নেই। বসে বসে ভাবতে লাগলেন কী করে রুমিকে তিনি চাইবেন। রঙ্গন নিজের কথা সত্যিই রেখেছে। একের পর এক পরীক্ষা দেওয়ার পরও যখন তাঁর চাকরি হচ্ছিলো না। শেষে আহসান পরামর্শ দিলো স্কুলের টিচার পদে নিয়োগ দিচ্ছে। সেখানে চেষ্টা করার জন্য। আপাতত রঙ্গন ফিন্যান্সের শিক্ষক হিসেবে ঢুকেছে। আহসানও চাকরির মধ্যেই আরো বিভিন্ন জায়গায় পরীক্ষা দিচ্ছে। ভালো জায়গায় টিকে গেলে প্রাইমারীর পদটা ছেড়ে দেবে।

রঙ্গন অনেক চিন্তা ভাবনার পর অর্ককে ফোন দিলো। অর্ক তখন মাত্র অফিস থেকে ফিরেছে। সে ব্যাংকার হিসেবে জয়েন করেছে চারমাস হলো। আগে আহসানের মতো প্রাইমারী সেক্টরে ছিল। অর্ক ফোন ধরেই বললো,

” কী অবস্থা বন্ধু? কেমন যাচ্ছে দিনকাল?”

রঙ্গন ভনিতা বাদ দিয়ে বললো,

” আর ভালো থাকা!”

অর্ক সিরিয়াস হয়ে বললো,

” কেন কী হয়েছে? ”

রঙ্গন শুধু বললো,

” ফোনে এতকিছু বলতে পারবো না। সন্ধ্যার মোড়ের চায়ের দোকানে আসিস।”

বিকেলে আহসান বাড়িতেই কিছু ছেলেমেয়েকে ব্যাচে পড়ায়। ছোট ছোট প্রাইমারী স্কুলের বাচ্চা। ওপাশের খালি একটা ঘর ছিল। বাড়ির পুরনো জিনিস রাখা হতো সেখানটায়। আহসান সেখানেই পুরনো কিছু বেঞ্চ ফেলে পড়ানোর ব্যবস্থা করেছে। সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে সে। সকালে স্কুল, বিকালে বাচ্চা পড়ানো আর শেষে সন্ধ্যায় বাবার সঙ্গে ব্যবসার কাজ। সেই নিয়ে তরীর সঙ্গে গতকালও বেশ মন কষাকষি হয়েছে! আগের মতো আহসান তাঁকে মোটেও সময় দেয় না। অবশ্য আহসানকে দোষ দিয়ে লাভ কী? সে তো নিজেও পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকে। তবুও আহসানের ওপরে মান অভিমানের শেষ নেই তাঁর। বিকেলে বাচ্চাদের ছুটি দিয়ে আহসান ঘরে এসেছিল। পরনে শার্টটা ঘামে ভিজে গেছে। সেটা পাল্টে এখন সে কাজে যাবে। তরী বিছানায় বসে আড়চোখে তাকিয়ে তাঁকেই দেখছিল। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের শরীরে ঘাম যেন চকচক করছে। আহসান এখন ভীষণ তাড়ায় আছে। তরীর খুব ইচ্ছে হলো তাঁকে একটু জ্বালাতন করবার। একটু বাজিয়ে দেখলে কেমন হয়? তরী পেছন থেকে আহসানের গলা জড়িয়ে ধরে বললো,

” কোথায় যাচ্ছেন আহসান মাস্টার?”

আহসান শার্টের বোতাম লাগিয়ে নিতে নিতে বললো,

” বাবা অপেক্ষা করছে। আজকে নতুন মাল আসবে। বাবা একা সামলাতে পারবে না।”

তরী মিছে অভিমান করে সরে গেল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচলটা বক্ষস্থল থেকে বেশ কিছুটা নিচে নামালো। চুলের খোঁপাটা খুলে চুলগুলো এলোমেলো করলো। ব্লাউজটার পিঠ খোলা বিধায় গলা কিছুটা বড়। আহসানকে প্রলুব্ধ করার কৌশল আরকি! তরী কিছু না বোঝার ভান করে দরজা আঁটকে; দরজাটাকে আড়াল করে অমন আবেদনময়ী হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আহসান তৈরি হয়ে বের হওয়ার সময় তরীকে ওভাবে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল। একি অবস্থা! তরীর ভাবখানা এমন যেন সে কিছুই জানে না। আহসান তাঁর কৌশল বুঝতে পারলো। তরীকে সহসাই কোলে তুলে নিতেই তরী পালানোর জন্য আকুপাকু করতে লাগলো। ঘাট হয়েছে তাঁর! আহসান সত্যি সত্যি এবার কিছু একটা করেই বসবে। আহসান তরীর কোনো কথা শুনলোই না। দুম করে বিছানায় এনে ফেললো তাঁকে। মসৃন কোমরে একটা হাত রেখে তরীর ওষ্ঠদ্বয় নিয়ে মেতে উঠলো। নিজের ফাঁদে তরী যেন নিজেই পিছলে পরলো। ছাড়া পাবার জন্য অস্থির হয়ে উঠলো। আহসানই বা কম যায় কীসে? তরীকে এক ছটাকের ছাড় দিতেও রাজি নয় সে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য তরী টুস করে একটা কামড় দিলো আহসানের চঞ্চুতে। আহসান ব্যাথা পেয়ে সরে যেতেই তরী দৌড়ে পালালো। আহসানকে প্রলুব্ধ করার শখ আজীবনের মতো মিটে গেছে তাঁর! আহসান মিটিমিটি হাসতে হাসতে তরীকে উদ্দেশ্য করে বললো,

” কোথায় যাচ্ছো তরী রানী? বড্ড আদর পাবার ইচ্ছে না? এসো আদর করছি!”

তরীর সে-সব শোনার সময় আছে? কান চেপে ধরে দৌড়ে পালালো সে। পিছু ফিরে একবার তাকালো না অবধি!

সন্ধ্যার পর অর্ক আর রঙ্গন চায়ের দোকানে গিয়ে বসলো। অর্ক চায়ে চুমুক দিয়ে রঙ্গনকে বললো,

” কী হয়েছে বন্ধু? তোমার মন মেজাজ খারাপ দেখছি? বাড়িতে কিছু হয়েছে? ”

রঙ্গন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

” গত কয়েকবছর যাবত এক জ্বালায় ম’রছি! আমি বিয়ে করতে চাই!”

অর্ক মশকরা করে বললো,

” সেটা তো স্বাভাবিক। কোথায় চাকরি পেয়েছিস বিয়ে করে আমাদের গান-বাজনার সুযোগ করে দিবি। আমি একটু গিটারটা নিয়ে বসবো! সেখানে নিজেই মন খারাপ করে বসে আছিস।”

রঙ্গন কপালে হাত রেখে বললো,

” আমি যাকে বিয়ে করতে চাই। তাঁকে পেতে গেলে অনেককিছু বিসর্জন দিতে হবে। সর্বপ্রথম স্যাক্রিফাইস করতে হবে বন্ধুত্ব!”

অর্ক চোখ কপালে তুলে বললো,

” মানে! রঙ্গন ঠিক করে বল কী বলতে চাচ্ছিস! আমার মাথায় কিন্তু অন্য চিন্তা আসছে।”

রঙ্গন দু’হাতে মাথা চেপে রেখে বললো,

” যা ভেবেছিস তাই। আমি রুমিকে পছন্দ করি। রুমি আমার বাচ্চকালের ভালোবাসা। আহসানের অগোচরে রুমির সঙ্গে বর-বউ খেলতে খেলতে সেই ইচ্ছেটা কবে যে মাথায় চড়ে বসলো! বিশ্বাস কর রুমির প্রতি আমার ভালোলাগাটা মোহ নয়। তোরা রুমিকে চিনিস ভার্সিটিতে উঠে। আমি তো ক্লাস ওয়ান থেকে আহসানের সঙ্গে পড়েছি। আহসানদের বাড়িতে গিয়ে এক থালায় আহসানের সঙ্গে ভাতও খেয়েছি। বড় হওয়ার পর রুমি সেভাবে আমার সামনে আসে না। কিন্তু, ছোট বেলায় ও আমার সামনেই বড় হয়েছে। এটাকে আর যাই বলা হোক মোহ বলা যায় না। আমি রুমিকে অনেক পছন্দ করি। আমি জানি আমি ভুল করেছি। আহসান আমার বন্ধু! আহসানের বোনকে আমার নিজের বোনের চোখে দেখা উচিত ছিল। কিন্তু আমি চেষ্টা করেছি। হয়নি! রুমিকে আমি বোনের জায়গায় ভাবতে গেলেই আমার সবকিছু উল্টোপাল্টা লাগে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কখন যে রুমির প্রতি আমার অনুভূতি পাল্টে গেল জানি না। আমি যদি রুমিকে চাই আহসান হয়তো দেবে না। বন্ধুত্ব আর রুমি দুটো জিনিষই চিরজীবনের মতো হারিয়ে ফেলবো। আমার মাথা কাজ করছে না। আমি এই দুটো সম্পর্ককেই আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চাই। আহসান আমার ছোটবেলার বন্ধু। অপরদিকে রুমি আমার পছন্দের মানুষ। আমি জানি না কী করবো!”

অর্ক মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনলো। রঙ্গনকে ভেঙ্গে পরতে দেখে খারাপ লাগছে তাঁর। অর্কের মাথায় তখনই চমৎকার একটা আইডিয়া এলো। এভাবে সাপও ম’রবে না আবার লাঠিও ভাঙ্গবে না। অর্ক চায়ের কাপটা ত্বরিত টেবিলে রেখে বললো,

” আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। খুব রিস্কি বাট কাজের। তুই আগে খালাম্মাকে রাজি করা। তারপর বাকিটা আমি দেখছি।”

রঙ্গন মুখ দিয়ে ‘চ’ জাতীয় শব্দ উচ্চারণ করে বললো,

” আম্মা তো রাজি! রুমিরে এখন বিয়ে করে নিয়ে ঘরে ঢুকলেও সে মেনে নেবে। সমস্যাটা হচ্ছে আহসান!”

অর্ক ভ্রু কুঁচকে চৌকস হেসে বললো,

” সেটাই তো! খালাম্মাকে তুই আহসানদের বাড়িতে পাঠাবি। বলবি রুগ্ন অসুস্থ হওয়ার ভান করে যেতে। গিয়ে বলতে বলবি একেবারে কাঁদো কাঁদো হয়ে তোর সঙ্গে রুমির বিয়ের প্রস্তাব দিতে। এখন খালাম্মার একটিং এর ওপর বাকিটা নির্ভর করছে। খালাম্মার অভিনয় যতটা প্রাণবন্ত হবে বিয়ের বাজনা তত তাড়াতাড়ি বাজবে। আর তুই আগেই আহসানকে নিজে থেকে ফোন করবি না। খালাম্মার কান্নাকাটি দেখলে আহসানই তোকে বাধ্য হয়ে ফোন করবে। তখন তুই সবকিছু না জানার ভান করবি। দিন-দুয়েক পরে খালাম্মাকে আবার পাঠাবি। আগের মতো অভিনয় শিখিয়ে পাঠাবি। এরপর আহসান তোর সঙ্গে ফাইনাল ডিসকাশনে আসতে চাইলে; তখন বলবি যে খালু মা’রা যাওয়ার পর খালাম্মাই তোর সব। রুমিকে তুই বোনের চোখেই দেখেছিস। কিন্তু, এখন খালাম্মা অসুস্থ মৃত্যূর আগে শেষ চাওয়া রুমিকে নিজের ঘরের বউ করা। তাই তুই এখন রুমিকে বিয়ে করতে রাজি আছিস। আর কথাগুলো স্বাভাবিক ভাবে বলবি না। চোখে প্রয়োজন হলে পেঁয়াজ ডলে নিবি। এরপর কান্নামাখা গলায় সবটা বলবি। আহসানের যদিও মন নরম। খালাম্মার কান্না দেখলেই গলে যাবে। তোর কাঁদার প্রয়োজন হবে না। তবে, সেফটি ফার্স্ট! সো বি কেয়ারফুল! বন্ধুত্ব ছিন্ন না করে রুমিকে বিয়ে করার এটাই মোক্ষম উপায়। সাপও ম’রলো না আর লাঠিও ভাঙ্গলো না। খালাম্মাকে ঠিকঠাক বুঝিয়ে তারপর পাঠাবি। খালাম্মার একটিং এর ওপরেই কিন্তু এখন সবটা! আর একদমই তাড়াহুড়ো করবি না। ঠান্ডা মাথায় সবটা বুঝেশুনে কোঁ’প দিবি। আমি আর সৌম্য আহসানের ক্লোজ। আহসান অবশ্যই আমাদের সবকিছু বলবে। আমি তোর দিক থেকে তোর হয়ে সাফাই গাইবো। ভাব ধরবো আমি অগ্রীম কিছুই জানি না। কিন্তু আহসান সব বলার পর তোর পজিটিভ দিকগুলো আহসানের কাছে তুলে ধরবো।”

রঙ্গন হা করে এতক্ষন সবটা শুনে ‘থ’ বনে গিয়েছিল। অর্ককে একারণেই বোধ হয় বিটলা বলা হয়। কী সুনিপুণ কৌশল! রঙ্গনের মাথায় এসব কিছু একবারও আসেনি! রঙ্গন নিজের চুলে হাত বুলিয়ে বললো,

” আম্মাকে কবে পাঠাবো?”

অর্ক ভেবে ভেবে বললো,

” কাল বা পরশু। এরপরে দুইদিন সরকারি ছুটি আছে। আহসান রুমি আর আহসানের ওয়াইফ তিনজনই সেদিন বাড়িতে থাকবে। খালাম্মা এত মানুষের মাঝে ঘাবড়ে গিয়ে একটিং করতে পারবেন না। কাল বা পরশু সবকিছু খোলা। দুপুরের আগে আগে খালাম্মাকে পাঠাবি। আহসানের বাবা থাকলে থাকবেন। বাট মেইন ফোকাস আহসানের মা আর দাদী। ওনাদের থেকে কথা পাস হয়ে খালু আর আহসানের কানে যাবে। এরপর আরেকদিন আহসান বাড়িতে থাকাকালীন খালাম্মাকে পাঠাবি।”

রঙ্গন পকেট থেকে মানিব্যাগটা বার করে বললো,

” তাহলে কালই পাঠাবো আম্মাকে। চল বাজার থেকে আম্মার জন্য একটা নতুন শাড়ি কিনবো। নতুন শাড়ি পড়ে আম্মা ছেলের বিয়ের জন্য প্রস্তাব নিয়ে যাবেন। বেয়াইন বাড়িতে পুরনো শাড়ি পড়ে যাওয়া মানায় বল?”

রঙ্গনের কথা শুনে অর্ক হেসে ফেললো। বাইকে চড়ে শাড়ি কেনার উদ্দেশ্যে দুই বন্ধু বাজারের দিকটায় গেল।

চলবে…

‎#নিকুঞ্জ_কানন
‎#নুজহাত_আদিবা
[পর্ব ২৫]

রঙ্গন নতুন শাড়ি কিনে নিয়ে মনের আনন্দে নাচতে নাচতে বাড়ি এলো। ঘরে ঢুকেই ব্যাগটা নাহার বেগমের হাতে দিয়ে বললো,

” ধরেন আম্মা আপনের লেইগা গিফট আনসি গিফট! ”

নাহার ব্যাগটা খুলে সত্যিই দেখলেন ভেতরে একটা শাড়ি। মতলব কী এই ছেলের? এত সভ্য ভদ্র ছেলে তো তাঁর নয়! রঙ্গনকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন,

” আমার লেইগা শাড়ি কিনা আনছিস? বাপ সত্যি কইরা বল তো তোর মাথায় কী ঘুরতাসে? মানুষের পোলাপান খুশি থাকলে তাঁদের বাপ, মা খোদা তায়ালার দরবারে শুকরিয়া আদায় করে।,অথচ তোরে খুশি দেখলে আমার ডর লাগে। না জানি আমার মাথায় কখন কাঁঠাল ভাইঙ্গা খাস!”

রঙ্গন বিছানায় বসে বাইকের চাবি আঙ্গুলে ঘোরাতে ঘোরাতে বললো,

” কালকে নতুন শাড়ি পইড়া আপনে রুমিদের বাড়িতে যাইবেন। ঘুরতে না! আমার আর রুমির বিয়ার পাকা কথা সারতে!”

নাহার বেগম আকাশ থেকে পরলেন যেন। চিৎকার করে বললেন,

” কী? তুই কী পাগল হইছোস রে রঙ্গইনা!এমন থাবড়া দিমু যে জন্মের বিয়ার স্বাদ মিট্টা যাইবো!”

রঙ্গন দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বললো,

” আপনে বিয়া দিবেন না আমারে?”

এই কথা বলেই সে পাশের ঘরে গিয়ে খাটের তলা থেকে ইঁদুর মা’রার বিষ এনে; নাহার বেগমের সামনে সেটা তুলে ধরে বললো,

” যদি কালকে বিয়ার কথা কইতে রুমিদের বাসায় না যান তাইলে এই বিষ সব পেটে ঢালুম। আপনের এত সহায়-সম্পত্তি সব কাউয়ায় খাইবো!”

নাহার বেগম মুখ ভেংচি কেটে বললেন,

” খা! এই বিষের মেয়াদ গেসে গা। ওইদিন দেখলাম বিষের মধ্যে পিঁপড়া পরসে। খায়া দেখতে পারোস। তয় তুই ম’রবি না! কৈ মাছের প্রাণ লইয়া আসছোস। এই ইঁদুরের বিষে তোর মতো জাউড়া হা’রামজাদা ম’রবো না।”

রঙ্গনের মেজাজ চটে গেল। এবার বিষের বোতল ফেলে সে রান্নাঘরে গেল। রান্নাঘরে সাজিয়ে রাখা অব্যবহৃত ছুড়িটা নিজের হাতের কবজিতে ধরে বললো,

” যদি কালকে বিয়ার কথা কইতে না যান।তো আমি রঙ্গন ব্যাপারী ওয়াদা করলাম এই ছুড়ি দিয়া হাতের র’গ কাটুম। থাইকেন আপনি একলা!”

বলেই সে গটগট করতে করতে বড় পায়ে বেরিয়ে গেল। নাহার বেগম রঙ্গনের কান্ড দেখে কেঁদে উঠলেন। পাগলার মাথা চটেছে। বিগত কয়েকবছর এই সেই বুঝ দিয়ে ছেলেকে দমিয়ে রেখেছিলেন। এখন আর সেই উপায়ও নেই। অবশ্য ছেলে এখন চাকরি করে বিয়ে না দিয়ে উপায় কী? তিনি চোখ বুঁজলে আসলেও রঙ্গনকে কে দেখবে? রুমি অবশ্য মেয়ে খারাপ নয়। রূপ যৌবনের দিকে বিবেচনা করলেও রুমি পিছিয়ে নেই। নাহার বেগম সবসময় চেয়েছিলেন ঘরে শিক্ষিত বউ আসুক। পড়াশোনার খুব ইচ্ছে ছিল। ক্লাস এইটে উঠবার পরেরই বিয়ে হয়ে গেল। রঙ্গনের বাবাকে খুব করে বলেছিলেন তিনি পড়তে চান। রঙ্গনের দাদী ধমকে উঠে বলেছিলেন,

” বিয়া হইসে বাচ্চা পালবা আর ঘর সামলাইবা! এত পইড়া কী করবা? ডাক্তারি পাশ দিবা নাকি উকিল ব্যারিস্টারি পড়বা?”
পড়াশোনার চাকা ওখানেই থেমে গেল। রুমি তো পড়াশেনাও করছে। কথাটা কী কাল আসলেও একবার পেরে দেখবে নাকি?

রঙ্গন বাড়ি ফিরলো রাতে। ঘেমে জবজব করছে শরীর। নাহার বেগম প্লেটে ভাত বাড়তে বাড়তে বললেন,

” তোর মামারে কালকে আসতে বলসি। তারে নিয়া কালকে রুমিদের বাড়িতে যাবো।”

রঙ্গন চোখ বড়বড় করে মায়ের দিকে তাকালো। দ্রুত এসে মায়ের আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে বললো,

” আম্মা সত্যি! আপনে আসলেই রুমিদের বাড়িতে যাইবেন?”

নাহার বেগম কোনো জবাব দিলেন না। এমনিতেই ছেলের মাথা গেছে। আর কিছু বললে সর্বনাশ হবে।

সকালে আজ রঙ্গন প্রতিদিনকার মতো স্কুলে গেলেও স্কুল ছুটি হওয়া অবধি আজ আর অপেক্ষা করলো না। অসুস্থতার অজুহাত দিয়ে টিফিন টাইমে বাড়ি চলে এলো। নাহার বেগমকে রাতে যদিও সব রঙ্গন বুঝিয়ে দিয়েছে। তাও মামা আর মাকে সে আবারও সব শিখিয়ে পড়িয়ে দিলো। কীভাবে অভিনয় করতে হবে তাও বুঝিয়ে বললো। নাহার বেগম নতুন শাড়ি আর কানে কান পাশা পড়ে তৈরি হয়েছেন। বের হওয়ার ঠিক আগে আগে রঙ্গন ডয়ার থেকে একটা মলম বের করলো। নাহার বেগমের চোখের নিচে সেটা ঘষে ঘষে লাগিয়ে দিলো। নাহার বেগম কৌতুহলের সহিত প্রশ্ন করলেন,

” এটা কীরে বাপ? মাজা (কোমর) ব্যাথার ঔষধ চোখের নিচে লাগাইতেছিস কেন বাপ?

রঙ্গন মুচকি হাসতে হাসতে বললো,

” বেয়াই বাড়ি যাইবেন রং ঢং এর তো একটা ব্যাপার আছে নাকি? এটা চোখের নিচে লাগাইলে চকচক করে। বয়স কম কম লাগে আর খুব ইয়াং লাগে।”

নাহার বেগম এতকিছু আর ভাবলেন না। সত্যিই তাঁকে খুব সুন্দর লাগছে ভেবে মনে তৃপ্তি অনুভব করলেন। রঙ্গন তাড়াতাড়ি মামা আর মাকে রিকশায় তুলে দিলো। আজকে যা খেল জমবে না!
.
মাজদাক সারোয়ার নাস্তা করেই বেরিয়ে গেছেন। আহসান স্কুলে গেছে। রুমি আর তরী কলেজে গেছে। আসতে আসতে দুপুর প্রায়। শোভা তখন দুপুরের রান্না সারছিলেন। মধুবিবি পাশে বসে বসে পুঁইশাকের পাতা বেছে দিচ্ছেন। তখনই আহসানদের বাড়ির সামনে রিকশা থামলো। রিকশা থেকে নামলেন নাহার বেগম আর তাঁর ভাই তৈয়ব আলী। নাহার বেগম রিকশা থেকে নেমে বাড়ির গেটে এসে কড়া নাড়তেই শোভা এসে গেটটা খুলে দিলেন। ভদ্রমহিলা যে রঙ্গনের মা তা শোভা আগে থেকেই জানেন। আগে আহসানকে স্কুল থেকে আনতে গেলে দেখা হতো দুজনার। শোভা বিস্মিত হয়ে বললেন,

” ভাবী আপনি! কত বছর পরে দেখলাম আপনাকে! ভেতরে আসুন ভাবী ভেতরে আসুন।”

নাহার বেগম ভাইকে সঙ্গে করে ভেতরে ঢুকলেন। মধুবিবিকে দেখে নিজেও সালাম দিলেন। আগে রঙ্গনকে নিয়ে এই বাড়িতে মাঝেমধ্যে আসা হতো তাঁর। রঙ্গনের বাবা মা’রা যাওয়ার পর থেকে; সবকিছু কেমন বিবর্ন লাগে বিধায় কোথাও যাওয়া হয় না।নাহার বেগম সোফায় বসলেন। শোভা নাস্তা নিয়ে আসতেই তিনি বললেন,

” এসব কেন করতে গেছেন ভাবী? আপনের রান্না খুব মজা। কিন্তু আমি আজকে কিছু খেতে আসি নাই। আসছিলাম একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে।”

শোভা কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

” কী কথা ভাবী?”

নাহার বেগম অনুভব করলেন তাঁর চোখ দুটো জ্বলে যাচ্ছে। কেমন যেন মৃদু ঝাঁঝালো গন্ধ টের পেলেন। তবুও স্বাভাবিক হয়ে বললেন,

” ভাবী রঙ্গনের বাপ মা’রা যাওয়ার পর থেইকা আমার রঙ্গনের আর কেউ নাই। আমার শরীলটাও আজকাল ভালো যাইতেসে না। কখন চোখ বুজি কে জানে! আমার পর রঙ্গনরে কেউ দেইখা রাখবো সেই ব্যবস্থাও নাই। রঙ্গন এখন চাকরি করে। বিয়ের বয়স ও হইয়া গেসে। আমার ইচ্ছা ছিল একটা মেয়ে সন্তানের। রঙ্গনের পরে তো আল্লাহ কোনো সন্তান দিলো না। যাও একজন ছিল আল্লাহ নিয়া গেল। তাই চাইসিলাম রুমিরে রঙ্গনের জন্য চাইতে। আপনারা যদি একটু ভাইবা দেখতেন ভাবী।”

এটুকু বলেই নাহার বেগম চোখ বন্ধ করে ফেলতেন। চোখে তীব্র জ্বালাপোড়ার কারণে টপটপ করে চোখ দিয়ে পানি পরতে লাগলো। নাহার বেগম হাত দিয়ে বারবার পানি মোছার চেষ্টা করলেন। যতবার চোখে হাত যাচ্ছে। জ্বালাপোড়া যেন আরো বাড়ছে। তৈয়ব আলী এবার বললেন,

” আপনার মেয়েকে আমরা রানী করেই দেখবো। আমার বোন আর কতকাল? বয়স হয়েছে তাঁরও তো সংসারের চাপ থেকে মুক্তি পেতে ইচ্ছে হয়। এখন রান্নাবান্না ছেড়ে নামাজ রোজা করার সময়। আপনার মেয়েরও তো বিয়ের বয়স হয়েছে। একদিন না একদিন তো বিদায় দিতেই হবে। রঙ্গনকে তো আপনি ছোটবেলা থেকেই দেখেছেন। আপনার ঘরের ছেলে! চাকরি করছে এখন বিয়েটা হয়ে গেলেই আমার বোন ঝক্কি-ঝামেলার থেকে বাঁচে। ”

নাহার বেগমের চোখ থেকে টপটপ করে পানি পরছে। সে ভেজা গকায় কোনো রকমে বললেন,

” রুমিরে আমি ছোটবেলা থেইকাই মেয়ের নজরে দেখসি। কালকে রাইতেও স্বপ্নে দেখলাম রঙ্গনের বাপরে। আমার মনে হয় সময় চইলা আসছে। আমি আর মনে হয় বাচুম না। ভাবী আপনার মেয়েটারে আমার ছেলের জন্য দেন। ওরে আমি মাথায় তুইলা রাখুম।”

নাহার বেগমের কান্না দেখে তৈয়ব আলীও ভরকে গেলেন। এত বছরের সংসারে দুলাভাইয়ের সঙ্গে এত ঝগড়া হয়েছে। তাও চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি পরেনি। আজ ছেলের বিয়ের কথা বলতে এসে এভাবে কাঁদছেন? আসলেই কী ওসব স্বপ্ন-টপ্ন কিছু দেখেছেন নাকি? শোভা চিন্তিত গলায় বললেন,

” আসলে রঙ্গনকে ছোটবেলা থেকেই দেখেছি। ও আমার ছেলেরই মতোন। আপনাদের ওপরেও যথেষ্ট বিশ্বাস আছে আমার। বিয়ে একটা সামাজিক এবং ধর্মীয় পবিত্র বন্ধন। আমার একা’র কথায় তো আর সব হবে না। রুমির ও তো একটা মতামত আছে। আপনি বলেছেন আমি শুনেছি। আহসানের বাবা বাড়ি এলে অবশ্যই তাঁকে বলবো। এরপর সবাই বিবেচনা করে যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটা জানাবো আপনাদের।”

নাহার বেগম আর বসলেন না। তৈয়ব আলীকে সঙ্গে করে বেরিয়ে গেলেন। চোখ দুটো যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে! কী যে হলো চোখে! রঙ্গন কোনো কারসাজি করেনি তো?
.
বাড়ির সামনে রিকশা থামতেই রঙ্গন দৌড়ে বেরিয়ে এলো। মাকে রিকশা থেকে নামতে সাহায্য করে বললো,

” কী বলসে আম্মা? রুমিরে দিবো বলসে? বিয়ার তারিখ দিসে? কবে বিয়া আম্মা?”

নাহার বেগম হাঁটতে হাঁটতে বললেন,

” আমি ম’রলে!”

রঙ্গন প্রত্যুত্তরে বললো,

” আপনি কবে ম’রবেন আম্মা?”

নাহার বেগম রেগে ছেলের দিকে তাকাতেই রঙ্গন চুপ হয়ে গেল। তৈয়ব আলী টিভি ছেড়ে বসেছেন। নাহার বেগম ভেতরে ঢুকতেই রঙ্গন বললো,

” রুমিরে দিবো আম্মা? বলেন না!”

নাহার চোখ মুছতে মুছতে চিৎকার করে বললেন,

” হ! বাজারের ব্যাগের মধ্যে ঢুকায়া আনসি রুমিরে আয় নিয়া যা! ওরে পাগলের বংশধর একদিনে বিয়ের পাকা কথা হয়? আমি প্রস্তাব দিসি তাঁরা বিবেচনা কইরা ভালো বুঝলে দিবো।”

রঙ্গন মুখ ভোঁতা করে বললো,

” আমার বিয়া তাইলে কবে আম্মা?”

নাহার বেগম কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বললেন,

” লাল শুক্কুরবারে! আর এইদিকে আয় তুই। আমার চোখে কী দিছোস সত্যি কইরা ক! চোখ জ্বলতাসে! পানি পরতাসে! চাইতে পারতাসি না ভালো কইরা।”

রঙ্গন সরল মুখে নাহার বেগমের মাথায় হাত রেখে বললো,

” সত্যি আমি কিছু দেই নাই আম্মা। আপনের কসম!”

নাহার ত্বরিত সরে গিয়ে বললেন,

” হাত সরা কু্তাবাসা! তোরে দিয়া কোনো বিশ্বাস নাই। তুই আমারে মা’রতে পারলে বাঁচোস!”

রঙ্গন হাই তুলতে তুলতে বললো,

” আপনে এত সহজে ম’রবেন না আম্মা। আপনে ম’রলে তো হইসিলই! গয়নাগাটি, জমি বেইচ্চা ঢাকার গুলশানে গিয়া বাড়ি কিনতাম!”

নাহার বেগম সঙ্গে সঙ্গে পায়ের জুতোটা খুলে নিক্ষেপ করলেন রঙ্গনের গায়ে!

দুপুরে সবাই যখন খেতে বসলো। গোলযোগের সেই মুহূর্তেই শোভা রুমির সম্বন্ধ আসার কথাটা বললেন। আহসান বিষম খেলো প্রায়! রঙ্গনের আম্মা হঠাৎ এমন কিছু করে বসবেন কেউই ভাবতে পারেননি। মাজদাক সারোয়ার শুরু থেকে সবকিছু শুনে শোভাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন,

” তোমার রঙ্গনকে কেমন লাগে আহসানের আম্মা?”

শোভা তরী আর রুমিরে প্লেটে খাবার বেড়ে দিতে দিতে বললেন,

” ভালোই। এখন তো ভালো চাকরিও করে। ছোটবেলা থেকেই তো আমাদের বাড়িতে আনাগোনা। ছেলে মন্দ নয় খুব সহজ সরল। আমার মনে হয় না রুমিকে অযত্নে রাখবে। রঙ্গনের আম্মা কেঁদে কেঁদে বিয়ের প্রস্তাব রাখলেন। কীভাবে হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছিল তা যদি দেখতে!”

রুমি তখনই মনে মনে রঙ্গনকে ভেংচি কাটতে কাটতে বললো,

” শা’লার বুইড়া বয়লার মুরগিকে বলে সহজ-সরল! ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না হুহ! ওরে তোরা কেউ জানিস না! ভাজা মাছ কাটাশুদ্ধো পেটের ভেতর ঢুকিয়ে বসে আছে! ”

রঙ্গনকে মনে মনে কয়েক দফা গালাগালি করলো। সরাসরি গালিই দিতো কিন্তু সামনে ভাই আর বাবা বসে আছে;দেখে সে আর ওসবের সাহস করলো না। মাজদাক সারোয়ার রাতে এসে ওসব; নিয়ে আলোচনা করবেন বলে খেয়ে বেরিয়ে গেলেন। আহসান খেয়ে চিন্তিত হয়ে ঘরে এলো। রঙ্গনের বিষয়টা তাঁর মাথা থেকেই যাচ্ছে না। রঙ্গন তো রুমির দিকে চোখ দেবার মতো ছেলে নয়। রুমিও কখনো নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে রঙ্গনকে ধরা দেবার পাত্রী নয়। তবে, কী রঙ্গনের আম্মাই নিজের সিদ্ধান্তে এসব করেছেন? ওদিকে রঙ্গনের আম্মা প্রস্তাব দিয়েছে শুনে রুমির ভয়ে ম’রম’র দশা! বাপ ভাইয়ের মুখের ওপরে কথা বলবার মতো এত সাহস তাঁর নেই। যদি আসলেই বিয়ে হয়ে যায় ওই ফাজিল চন্দ্র দেবদাসের সঙ্গে? না না! ওসব হতেই পারে না। দরকার হলে ডেটল খেয়ে রুমি উধাও হয়ে যাবে। তবুও ওই মর্কটকে বিয়ে করার প্রশ্নই আসে না। রুমির বিয়ে হবে সালমান শাহ এর হ্যান্ডসাম তরুন যুবকের সঙ্গে। যাকে দেখলেই টুস করে চুমু খেতে মন চাইবে। উম্মাহ!

তরী আহসানের পিছু পিছু এসে বললো,

” রঙ্গন ভাইয়ার কী বিয়ে হবে রুমির সঙ্গে?”

আহসান গম্ভীর গলায় বললো,

” সম্বন্ধ রাখলেই বুঝি বিয়ে হয়ে যায়?”

তরী আহসানের গলা জড়িয়ে ধরে বললো,

” যায় তো! আপনার বাবা মা যখন আমাকে দেখতে এলেন। মাও একি জিনিস বলে আমায় বুঝ দিয়েছিলেন। এখন দেখুন? বিয়ে করে সংসারী হয়ে স্বামী ধর্ম পালন করছি।”

আহসান তরীকে কোলে বসিয়ে বললো,

” তা কেমন লাগছে আমার সংসার করে?”

তরী কৃত্রিম সূরে বললো,

” খুব বাজে! খেয়াল রাখেন না;ভালোবাসেন না! শুধু বকুনি খাই!”

আহসান তরীর দিকে এগিয়ে এলো। উন্মুক্ত পিঠে ছুঁয়ে দিতে দিতে তরীর ওষ্ঠের দিকে এগোতেই; তরী তাঁকে প্রথমবারের মতো নিজে থেকে চুম্বন করলো। তরী আবেদন করলে আহসান কী সাড়া না দিয়ে পারে? সেদিন দুপুরটা ওভাবেই বিছানায় কেটে গেল। কপোত- কপোতী কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। বিকেলে ছেলেমেয়ে পড়াতে গিয়ে আহসান হাঁচি দিতে দিতে কুপোকাত! একদিনে দু’বার গোসল করার ফলাফল!

সন্ধ্যার পর রঙ্গনই ফোন করলো অর্ককে। রঙ্গন কিছু বলার আগেই অর্ক বললো,

” খালাম্মা তো আজকে ছক্কা মে’রে দিয়ে এসেছে বন্ধু!”

রঙ্গন হতবিহ্বল হয়ে বললো,

” তুই কী করে জানলি বন্ধু? আহসান ফোন করেছিল তোকে?”

সৌম্য সায় জানিয়ে বললো,

” হ্যাঁ। এই একটু আগেই কথা হলো আহসানের সঙ্গে। আমি ভান করেছি আমি কিছুই জানি না। একটু মশলা এড করেছি আরকি। আহসান বলছিল যে বিয়ের বিষয়টা নিয়ে ভাবাটা ঠিক হবে নাকি। আমি তোর গুনগান গেয়েছি। এবং এটাও বলেছি যে খালাম্মার বয়স হয়েছে। রুমিকে বিশ্বাস করে হয়তো সংসারের ভার তুলে দিতে চাচ্ছেন। তুই একটু ভেবে দেখতে পারিস। রঙ্গন পরিচিত আমাদের। রুমিকে মনে হয় না কোনো কিছুর কমতি বুঝতে দেবে।”

রঙ্গন খুশিতে দাঁত ক্যালাতে ক্যালাতে বললো,

” বেশ করেছিস বন্ধু! আমার রুমির সঙ্গে সেটিং হয়ে গেলে। আমাদের বিয়েতে তুই হবি স্পেশাল গেস্ট। আমার বিয়ের টেবিলের খাসিটা আস্ত তোর পাতেই দেবো।”

সৌম্য হাসতে হাসতে বললো,

” আচ্ছা তা দিস! আমার খাওয়া দাওয়ার বেলায় কোনো না নেই। একটা কথা বল এবার। খালাম্মা এত চমৎকার একটিং করলো কী করে? সত্যি সত্যি নাকি আহসানদের বাড়িতে গিয়ে আহসানের আম্মার সামনে কেঁদে ফেলেছেন। এই কর্ম সাধন হলো কী করে বন্ধু? এত বড় শিল্পী অভিনেত্রী তোদের বাড়িতে কেন এখনও? খালাম্মাকে ধরে বেঁধে বিটিভিতে দিয়ে আয়!”

রঙ্গন ভেংচি কেটে বললো,

” অভিনয় না ছাঁই! এত বছরের সংসারে আব্বার সঙ্গে ঝগড়া করেও কখনও কাঁদতে দেখিনি। সে কিনা ছেলের বিয়ের প্রস্তাব দিতে গিয়ে সেখানে বসে কাঁদবে?যা বলিস না! যাওয়ার সময় যখন সেজেগুজে তৈরি হচ্ছিলো। তখন ডয়ার থেকে মুভ (Moov) টা বের করে চোখের নিচে ঘষে দিয়েছি। কাহানী মে বহত সারা টুইস্ট হ্যাঁ দোস্ত!”

অর্ক হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেতে রাখলো! শেষ অবধি মুভ?

চলবে….