#নিকুঞ্জ_কানন
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ২৬
অর্কের কথা সত্যি হয়েছে। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর রঙ্গন যখন বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো। তখনই আহসানের ফোনে তাঁর ঘোর কাটলো। দ্রুত বিছানা থেকে উঠে বসলো সে। কলটা রিসিভ করে আহসানকে বললো,
” কী অবস্থা বন্ধু? কেমন আছিস? এত রাতে?”
আহসান পড়ার ঘরে বসে নিরিবিলি রঙ্গনের সঙ্গে কথা বলছিল। টেবিলের ওপরের পেনটা ঘোরাতে ঘোরাতে বললো,
” আসলে আজকে ফিরতে দেরি হয়ে গেছে। সেই প্রসঙ্গ বরং থাক। একটা বিশেষ প্রয়োজনে ফোন করেছিলাম তোকে। খালাম্মা আজ আমাদের বাড়িতে এসেছিল। তোর জন্য রুমিকে চেয়ে গেছেন। রুমির জন্য প্রস্তাব দিয়েছেন।”
রঙ্গন কপট অবাক হবার ভান করে বললো,
” রুমি! আম্মা এসব কখন করলো? আম্মার মাথাটা গেছে বুঝেছিস! কী সব আবোল তাবোল স্বপ্ন দেখে। সারাদিন সে-সবেরই ঘোরে থাকে। রুমি আমার বোনের মতো। আমার জন্য আম্মা কেন যে রুমিকে চাইতে গেলেন!”
আহসান খানিকক্ষণ বাদে বললো,
” হুম। তুই আসলে বিবেচনা করে জানা তুই কী চাস। আমি রুমির সঙ্গেও কথা বলবো। যদি দুজনের মতামত মিলে তবে বাবা আর আমি মিলে সিদ্ধান্ত নেবো। তুই মাথা ঠান্ডা করে কিছুদিন ভেবে নে। তোর মতামত আমাকে জানাতে ভুলবি না।”
রঙ্গন প্রত্যুত্তরে বললো,
” মতামত জানানোর কী আছে বন্ধু? দেখ রুমি আমার ছোট বোনের মতো। ওর সঙ্গে আমার যায় বল? কোথায় রুমি আর কোথায় আমি। আম্মার মাথাটা সত্যিই গেছে! তুই এসব নিয়ে আর ভাবিস না। আমি আম্মাকে বুঝিয়ে বলবো। রুমি এখন পড়ছে তাই পড়তে দে।”
আহসান আর কথা বললো না। তাঁর বড্ড ঘুম আসছে। ফোনটা রেখে সে তরীর কাছে ঘরে এলো। সেই সকালে উঠে গরমে ক্লাসে করে ক্লান্ত মেয়েটা। খেয়েদেয়েই বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমিয়ে পরেছে। আহসান তরীকে ঠিক করে শুইয়ে দিলো। তরীকে জড়িয়ে ধরে গলার ভাঁজে মুখ গুঁজে দিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে গেল নিজেও!
.
রুমির চোখে আজ ঘুম নেই। বিছানায় শুয়ে সে এপাশ ওপাশ করতে লাগলো। মাজদাক সারোয়ার যেভাবে রঙ্গনকে নিয়ে সিরিয়াস হয়ে ভাবছেন। বিয়ে যেকোনো সময় ঠিক হয়ে যেতে পারে। খুব ভয় হচ্ছে! ওরকম একটা পাগলা দাশুর সঙ্গে জীবন কাটানো যায়? তবে, একটা জায়গায় খুব খটকা লাগছে। আর যাইহোক এটা শুধুমাত্র রঙ্গনের মায়ের কাজ নয়। রঙ্গনের চাহনি কথার ধরনই কেমন যেন অন্যরকম। বাড়িতে এলে এক পলকের জন্য চোখাচোখি হলেও রুমির দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতো। কলেজ চলাকালীন প্রায়ই কলেজের সামনেও ঘুরঘুর করতো। রুমির উপস্থিতি বুঝে ফেললেই আড়াল করে ফেলতো নিজেকে। রঙ্গন কী পছন্দ করে তাঁকে? কেন যেন রুমির তাই মনে হচ্ছে। আগ বাড়িয়ে সবসময় আলাপ জমাতে চাইতো রুমির সঙ্গে। কথার ভঙ্গিমাও কেমন একটা যেন ছিল। কী যে হচ্ছে কে জানে! রুমি এবারও পাশ ফিরতেই মধুবিবি চিৎকার করে বললেন,
” সকালে কেলাসে যাবি না? ঘুমাস না কেন ছেড়ি? একবার এইদিক ফিরোস তো আরেকবার ওইদিন ফিরোস। ঘুমাইতে দে আমারে! এমন লড়ালড়ি করলে আমার ঘুম আহে না। না ঘুম আইলে মাথা চইড়া থাকে। বুঝিস কইলে!”
রুমি আর কিছু বললো না। তাড়াতাড়ি বালিশে মুখ গুঁজে মধুবিবিকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরলো। ঠা’ডা পরুক ওই পাগলা দাশুর ওপরে!
★
মাঝে একটা ব্যস্তঘন দিন কেটে গেল। রাতে রঙ্গন বাড়ি ফিরলো। নাহার বেগম তখন ভাত তরকারি প্লেটে বাড়ছেন। রঙ্গন এসে হাই তুলতে তুলতে,
” কালকে কখন যাইবেন আম্মা?”
নাহার বেগম অবাক হয়ে বললেন,
” কই? কালকে আবার কই যামু?”
রঙ্গন লাফ দিয়ে উঠে বললো,
” মানে? কালকে রুমিদের বাড়িতে যাইবেন না আপনে?”
নাহার বেগম ঝাংটা মেরে বললেন,
” একবার না গেলাম বাপ রুমিদের বাড়িতে? দিসি তো প্রস্তাব নাকি? ওরা বুইঝা শুইনাই তো আমারে জানাইবো। রুমি একটা মানুষ। কোনো ফলমূল সবজি না যে চাইলাম আর দিয়া দিলো!”
রঙ্গন মুখ ভোঁতা করে বললো,
” আপনে হইলেন পোলার মা। আগে বেয়াই বাড়িতে গিয়া ভাব না বাড়াইলে মাইয়া কেমনে দিবো আপনের কাছে? একদিন কইসেন তো কী হইসে? কালকে গিয়া জোর গলায় আবার রুমিরে চাইবেন। আব্বারে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল কইরা যেমনে গয়না বানাইতেন। অমনে ব্ল্যাকমেইল কইরা বিয়ার কথাটা ফালান! বিয়ে দুই মিনিটে লাইগা যাইবো।”
নাহার বেগম চিন্তিত হয়ে বললেন,
” তোর মামা ব্যবসার লেইগা ঢাকা গেসে। তারে ছাড়া কেমনে যাই?”
রঙ্গন ত্বরিত জবাব দিলো,
” মামার কথা বাদ দেন। আপনের ভাই আস্তা ব্যাক্কল! মালা চাচীরে নিয়া যান। তাঁর আজ অবধি এক্কেরে সেইরকম রেকর্ড আছে। উনি যে-ই বিয়ায় হাত দিসে! বিয়া করায়াই ছাড়সে!”
নাহার বেগম বুঝে ফেললেন তাঁর ছেলের অলরেডি মালাকে ফোন করা শেষ। রঙ্গন কখনো কেনো কিছু ভেবে তাঁকে জানায় না। অঘটন সব ঘটিয়ে তারপর জানায়। নাহার বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন!
.
সকাল বেলা সত্যিই মালাবানু রঙ্গনের বাড়িতে সেজেগুজে এলেন। তিনি রঙ্গনদের দূরসম্পর্কের চাচী হন। রঙ্গনের বাবার আপন কোনো ভাই নেই। বড় চারবোন আছেন। তাঁরাও সবাই খুব দূরে দূরে থাকেন। রঙ্গনের বাবা মা’রা যাওয়ার পর খোঁজ খবর নেওয়া তো দূর এই বাড়িতে পা অবধি মা’ড়াননি। নাহার বেগম শাড়ি গয়না পড়ে তৈরি হলেন। মুখে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি মাখলেন। চোখ ভর্তি করে সুরমাও দিয়েছেন। হাতে ভারী মান্দাত্তার আমলের মকরমুখো বালা পড়েছেন। মালাবানু রঙ্গনকে আস্বস্ত করে বললেন,
” আমারে ডাকছোস বাপ! তোর বিয়ার বাজনা যদি না বাজাইছি তো আমার নাম মালাবানু না। এই নিয়া আটা-চল্লিশ (আটচল্লিশ) নাম্বার বিয়ার ঘটকালি করতাসি।”
রঙ্গন ফিসফিস করে বললো,
” যদি এই জায়গায় আমার লক লাগাইয়া দিতে পারেন। তাইলে আমি সামনের মাসে বেতন পাইয়াই আপনার আর আম্মার লেইগা নতুন একইরকম জামদানী শাড়ি কিন্না পাঠামু!”
উপহার পাবার কথা শুনে মালাবানুর মুখখানা চকচক করে উঠলো। দাঁতের সবগুলো পাটির দাঁত বের করে রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তখনই রিকশা ওয়ালার হাকডাক শুনে রঙ্গন তাড়া দিয়ে নাহার বেগম আর মালাবানুকে রিক্সায় উঠিয়ে দিলেন।
সেদিনের মতোই রিকশা রুমিদের বাড়ির সামনে এসে থামলো। নাহার বেগম আর মালাবানু ভেতরে ঢুকে দরজায় করাঘাত করলেন। তরী এসে দরজা খুলতেই অপরিচিত দুটো মহিলা দেখে চমকে গেল। ভেতরে তাঁদের বসতে দিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে শোভাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
” মা দুজন ভদ্রমহিলা এসেছেন বাড়িতে। আপনার খোঁজ করছিলেন। একবার শুনে যান মা একটু।”
শোভা হাতের কাজ সামলে এসে দেখলেন ড্রয়িংরুমে নাহার বেগম বসে আছেন। শোভা তরীকে ইশারা দিয়ে বললেন,
” তোমার বাবা আর আহসানকে একটু ডেকে আনো।”
মাজদাক সারোয়ারকে একবার ডাক দিতেই তিনি চলে এলেন। আহসান ছুটির দিনে সকালে ছেলেমেয়ে পড়ায়। বাচ্চাদের হাতের কাজ দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে সেও এলো। রঙ্গনের মাকে দেখে সালাম জানিয়ে বসলো। শোভা মধুবিবিকেও ডেকে আনলেন। সবাই যখন একই জায়গায় উপস্থিত হলেন। প্রথমে নাহার বেগমই মাজদাক সারোয়ারকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
” ভাই আপনেরে তো আগেই জানাইসি। সেদিন আপনের সঙ্গে দেখা হয় নাই দেইখা আজকে আবার আসা। আমার রঙ্গন এখন সরকারি স্কুলে মাস্টারি করে। বেতনের অংকটা ভালোই! পুরান হইলে আরো কয়েক বছর গেলে হয়তো আরো বাড়বো। এমনিতেও রঙ্গনের আব্বা কম কিছু রাইখা যায় নাই। জানেনই তো আমার ছেলেটার বাপ নাই। আমার একটাই সন্তান। ওর আর কোনো বড় ভাইবোন ও নাই। আমি ছাড়া ধরতে গেলে দুনিয়াতে অয় এতিম। আমি আর কয়কাল বলেন ভাই? একদিন সবাইরে যাইতেই হইবো। আজকা হোক বা কালকা। আমার শরীরটাও আজকাল ভালো যায় না। কখন খোদা তায়ালা ডাক দেয় তাও জানি না। ম’রার আগে পোলাটার একটা গতি কইরা রাখতে পারলে ভালো হইতো। আমি ছাড়া ওর আর কে আছে কন? আপনেদের বাসায় রঙ্গনরে নিয়া কত আসছি! রুমিরে আমার অনেক পছন্দ। দেইখাই বুঝা যায় খুব লক্ষী মেয়ে। কখনও চিৎকার চেঁচামেচি বা উচ্চস্বরে কথাও কইতে দেখি নাই। আমার খুব শিক্ষিত বউয়ের শখ। বিয়ার পর রুমি পড়াশোনা করলেও সমস্যা নাই৷ রঙ্গন সারাদিন থাকে বাইরে। আমি একলা মানুষ তাই রান্নাবান্নার ঝামেলা নাই। রুমি চাইলে প্রতিদিন কেলাসেও যাইতে পারবো। আপনে তো ছোটবেলা থেইকাই রঙ্গনরে দেখছেন। একটু দেখেন না ভাই! বাড়ির সবাইরে নিয়া একটু বইসা চিন্তা ভাবনা কইরা দেখেন।”
কথা শেষ হওয়ার পরপরই বিগত দিনের মতো নাহার বেগমের চোখ থেকে টপটপ করে পানি পরতে লাগলো। আজ তো রঙ্গন উল্টাপাল্টা কিছু তাঁর চোখে দেয়নি। আজ কেন চোখে জ্বালা হচ্ছে? নাহার বেগমের কান্না দেখে মালাবানু বললেন,
” ভাইসাব, এলাকায় আপনের অনেক সুনাম শুনসি। আমি রঙ্গনের চাচী লাগি সম্পর্কে। আমার জা এর শরীরটা আসলেও ভালো নাই। কী সব উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেইখা সারাদিন খালি কান্দে। কবে কী হইয়া যায়! আপনে একটু ভাইবা দেখেন ভাই। ছেলেও ভালো আবার আপনের পরিচিত। মেয়ে সন্তান হইলো মায়ের মতো। বাড়িও কাছে আমাদের। মেয়ের জন্য মন খারাপ লাগলে যখন তখন ঘুইরা আসবেন। মেয়েরে কাছে আইনা রাখতেও পারবেন। পড়াশোনা নিয়াও তো আমাদের কোনো আপত্তি নাই। মন চাইলেও চাকরিও করবো সমস্যা কী?”
মাজদাক সারোয়ার আড়চোখে নাহার বেগমের দিকে তাকালেন। ভদ্র মহিলা এভাবে হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছেন কেন? রুমিকে এতই পছন্দ হয়েছে তাঁর?
এই পুরোটা সময় দরজার আড়াল থেকে সবটা শুনছিল রুমি। রঙ্গনের মাকে বড্ড সরল সোজা মনে হলো তাঁর। বিয়ের প্রস্তাব দিতে এসে এভাবে কাঁদছেন! আহারে! আচ্ছা এত ভদ্র প্রকৃতির সরল সোজা মানুষের পেট থেকে ওই বিটকেল কী করে বের হলো?
নাহার বেগম আর মালাবানু চলে যাওয়ার পর আহসান আর মাজদাক সারোয়ার এবং শোভা ও মধুবিবি মিলি সিরিয়াস ডিসকাশনে বসলেন। ভদ্রমহিলা দুইদিন কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এসেছেন। তাঁকে কী খালি হাতে ফিরিয়ে দেওয়া যায়? রুমি মতিগতি খারাপ দেখে তরীকে ইশারা করে বললো,
” ভাবী ভাইয়ের ফোনটা একটা মিনিটের জন্য একটু এনে দেবে। একটু কাজ ছিল!”
তরী তাঁকে আহসানের ফোনটা এনে দিতেই। সেটা থেকে রঙ্গনের নাম্বারটা টুকে মধুবিবির ফোন দিয়ে রঙ্গনকে কল করলো রুমি। আননোন নাম্বার দেখে রঙ্গন প্রথম ধরলো না। কয়েকবার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ করে বললো,
” হ্যালো কে?”
রুমি ইতস্তত বোধ নিয়ে বললো,
” আমি রুমি বলছি।”
রঙ্গন চমকে উঠলো। বুকটা কেমন ধক করে উঠলো। রুমি ফোন করেছে তাঁকে? রুমির ঢোক গিলে বললো,
” আপনার আম্মা এসব কী শুরু করেছেন বলুন তো? ছেলেমানুষী কান্না করলে চলে কী? তাঁকে একটু বুঝিয়ে বলুন না! আর আপনি আমার বারো বছরের বড়। এত বেশি এজ ডিফারেন্ট’স নিয়ে আমি সংসার করতে পারবো না। আমি একটু বুঝিয়ে বলুন আপনার মাকে।”
রঙ্গন সঙ্গে সঙ্গে বললো,
” বারো বছর? বারো বছর কোথায় পাও তুমি রুমি?”
রুমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
” ভাইয়া আমার বারো বছরের বড়। আমার কিছুদিন আগে বিশে পা দিয়েছি। ভাইয়ার তাহলে বত্রিশ চলছে। আপনি আর ভাইয়া সমবয়সী। তো বারো বছর হলো না?”
রঙ্গন তেঁতে উঠে বললো,
” তোমার মাথা গেছে রুমি? শোনো আমি আমার বাপ মায়ের ব্রিলিয়ান্ট আইনস্টাইন বাচ্চা। আমি তোমার ভাইয়ের চেয়ে দুই বছরের ছোট। আমি প্লে, নার্সারি এসব পড়ি নাই। ডিরেক্ট ক্লাস ওয়ানে ভর্তি কইরা দিসে আম্মা। ক্লাস ওয়ানেই আহসানের সঙ্গে পরিচয়। আমার বর্তমান বয়স ত্রিশ। বত্রিশ কোথায় পাও তুমি? সৌম্য অর্ক আমারে আগে মাঝেমধ্যে ছোটু ছোটু বইলা খেপাইতো। শুনো নাই কোনোদিন?”
রুমি কিছু বলার আগেই মধুবিবি ঘরে এসে পরলেন। রুমি ফোনটা রেখে তাড়াতাড়ি কেটে পরলো। ধরা খেলে সর্বনাশ!
.
নাহার বেগম বাড়ি ফিরেই রঙ্গনকে চেপে ধরে বললেন,
” গোলামের পোলা সত্যি কইরা ক আমার চোখে কী দিছোস? আমার চোখ জ্বইলা যাইতাসে। মা’ইর খাওনের আগে সোজা কথায় আয়।”
রঙ্গন কিছু না জানার ভান করে বললো,
” আমি কী জানি? রাস্তায় বাইর হইলে আপনের হুশ থাকে না। চোখেচুখে কী আইয়া পরসে সেইটা দেখেন। হুদাই কিছু হইলে আমারে দোষ দেন। যত দোষ রঙ্গন ঘোষ!”
নাহার বেগম চোখে বারবার পানির ছিটে দিতে লাগলেন। চোখে যে কী পরলো!
★
আহসান আর মাজদাক মিলে খুব ভাবলো। রঙ্গন তাঁদের পরিচিত এবং বাড়িও একই এলাকায় পাশাপাশি প্রায়। মাজদাক আহসানকে বললেন রঙ্গনের সঙ্গে কথা বলতে। মাজদাক নিজে গেলেন রুমির সঙ্গে কথা বলতে। আহসান রঙ্গনকে কল করলো। রঙ্গন তখন যেন আহসানের কলেরই অপেক্ষায় ছিল। সে ভালো করেই জানতো আজকের মেলোড্রামার পর আহসান তাঁকে কল দেবেই! আহসানের কল পেয়ে রঙ্গন দৌড়ে উঠে গিয়ে ডয়ার থেকে মুভ বের করলো। চোখের নিচে মুভ খানিকটা ঘষে নিলো। নিমিষেই চোখে জ্বলন ধরে পানি পরতে শুরু হলো। সেই কাঁদো কাঁদো গলা নিয়েই রঙ্গন কল ধরে বললো,
” হ্যালো?”
আহসান রঙ্গনের অস্বাভাবিক কণ্ঠস্বর শুনে বললো,
” কী হয়েছে বন্ধু? তুই কী কাঁদছিস? গকাটা এমন শোনাচ্ছে কেন?”
রঙ্গন নাক টেনে বললো,
” আর বলিস না বন্ধু!আম্মা যে কী শুরু করেছে। কিছুই হলেই বলেন আমি ম’রে গেলে বুঝবি। আম্মা ছাড়া আমার কাছে আছে বল? কী যে করি! রুমির জন্য কী করছেন! আমি কী করে বোঝাই বলতো?”
আহসান শান্ত গলায় বললো,
” শান্ত হয়ে বস বন্ধু। শোন মাথায় ঠান্ডা কর। আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলতে কল করেছি। রুমিকে তোর কেমন লাগে?”
রঙ্গন মিছে কাঁদার ভান করে বললো,
” বন্ধু আম্মা ছাড়া আমার আর কেউ নেই। আমি একটু নিরামিষ আরকি। আমার মধ্যে ওসব আবেগ অনুভূতি কম। আম্মা রুমির জন্য পাগল হয়ে গিয়েছেন। আমার এসব দেখলে আমার বড্ড কষ্ট হয় বন্ধু। আমার কষ্ট সহ্য করতে পারি না। আম্মা যদি চায় তো আমার এই বিয়েতে অমত নেই। আম্মার খুশির জন্য আমি সব করতে পারি। বিয়ে তো একদিন না একদিন করতেই হতো। আম্মা যখন এত করে চাইছেন তো রুমিকে মেনে নিতে ক্ষতি কী?”
দীর্ঘসময় কথা বার্তা চলার পর আহসান ফোন রাখলো। রঙ্গন কোনো রকমে কল ছেড়ে চোখ ধুয়ে নিলো। চোখের অবস্থা বারোটা তাঁর! রুমির জন্যই এই অবস্থা তাঁর! তাঁকে বিয়ে করার জন্য কত কষ্ট পরিশ্রম করতে চাচ্ছে। শুধু বিয়েটা হোক! প্রতিরাতে বাসর হবে! প্রতিবছর একটা করে প্রডাকশন হবে। সারা ঘরভর্তি তাঁর আর রুমির বাচ্চা থাকবে। বাচ্চারা আব্বা আব্বা বলে কোলে, কাঁধে ঝাঁপিয়ে পরবে। কী শান্তির জীবন!
রঙ্গনের এসব ছাইপাঁশ ভাবনার মাঝেই অর্ক কল দিলো। খুব উল্লসিত কণ্ঠে বললো,
” তোমার তো বিয়ে লেগে যাচ্ছে বন্ধু! আহসানের সঙ্গে মিনিটখানেক আগে কথা বললো। কাল বা পরশুই তোদের বাড়িতে হ্যাঁ বলে যাবে আহসানের পরিবার এসে। আমিও তেলঝাল মিশিয়ে উসকে দিয়েছি। বিয়ে লাগলো বলে!”
রঙ্গন বিষ্মিত হয়ে বললো,
” সত্যি? ওরে আমার বিয়া হইতাসে রে! ওরে কেউ আমারে ধর রে! আমি জ্ঞান হারাবো। ম’রেই যাবো! বাঁচাতে পারবে না কেউ!”
অর্ক হাসির মাঝেই বললো,
” তোর গলাটা এমন শোনাচ্ছে কেন রে রঙ্গন?”
রঙ্গন উপলব্ধি করলো তাঁর চোখে তখন জ্বালাপোড়া হচ্ছে। চোখটা কোনো রকমে মুছে সে বললো,
” কুমিরের কান্না কেঁদেছিলাম রে বন্ধু। আহসান ফোন করেছিল। মুভ মেখে একটিং করেছি। কী মচৎকার একটিং! যদি তুই দেখতি রে!”
অর্ক হো হো করে হাসতে হাসতে বললো,
” তাই? খালাম্মা আজকেও গিয়ে নাকি কেঁদেছে। আজও মুভের ভেলকিবাজি চালিয়েছিস?”
রঙ্গন বাঁকা হেসে বললো,
” নারে আগের দিন ধরা খেয়ে গিয়েছি। আজ অন্য স্টাইলে কোঁ’প দিয়েছি। আম্মার সুরমার দানিতে পেঁয়াজ বেটে দু’ফোটা রস মিশিয়ে দিয়েছি। আম্মা সেই সুরমা চোখে পড়ে রুমিদের বাড়িতে গিয়েছেন।ব্যাস কেল্লাফতে!”
চলবে…
( অনেকেই জানতে চেয়েছেন বিগত কয়েক পর্বে রুমি আর রঙ্গনকে এত প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে কেন? উত্তর হলো আহসান তরীর পর গল্পের প্রধান আর্কষন রঙ্গন রুমি। পরের আরো কিছু পর্ব ওদের নিয়েই চলবে। বিরক্ত লাগলে স্কিপ করতে পারেন।)