নিকুঞ্জ কানন পর্ব-২৭

0
24

‎#নিকুঞ্জ_কানন
‎#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ২৭ (প্রথমাংশ)

আজ রুমির গায়ে হলুদ। রঙ্গন ব্যাপারী নামক এক ছিঁচকে চোরের সঙ্গে। এই নিয়ে রুমির হা-হুতাশ এর অন্ত নেই। বিগত একসপ্তাহ যাবত তাঁর ওপরে কম ঝড় যায়নি। বিয়েটা কোনোভাবে পিছাতে পারলে বেশ ভালো হতো। কিন্তু, সামনে পুজোর ছুটি পরেছে বিধায় আহসান এবং রঙ্গনের দুজনেরই ছুটি আছে। সেই অনুযায়ীই বিয়ের ডেট ফিক্সড করা হয়েছে। রুমি যা কেলেংকারী কর্মকান্ড ঘটিয়ে ছিল বাড়িতে। বিয়ে না করার জন্য আম’রন অনশন ধরে বসেছিল। শেষে শোভা আর মাজদাক মিলে বোঝালেন। আহসানও আদর করে বুঝিয়ে বললো। তবে, আসল চিড়ে ভিজলো মধুবিবির কথায়। মধুবিবি রুমিকে নিজের ঘরে বসিয়ে বললেন,

” শোন বোইন, আজকালকার জামানা ভালো না। ব্যাডা মানুষের শরীরের চিপায় চিপায় শয়’তানী। আমারে আমার বাপ বিয়া দিসিলো একপাল আন্ডাগুষ্টি ওয়ালা পরিবারে৷ সারাদিন থালাবাটি মাজো। রান্ধন বাড়ন করো ঘরের কাজ করো! কী কাউয়া ম’রা জীবন! রঙ্গন আর রঙৃগনের মা ছাড়া পরিবারে কেউ নাই। কাজ কামের ঝামেলাও নাই। আমারে আমার শাশুড়ী বাপের বাড়ি যাইতে দিতো না। দূরে দেইখা একলা যাইতেও পারতাম না। তুই যখন মন চায় আসতে পারবি। আহসান তোর বাপ যখন তখন তোরে নিয়া আসবো। এখনকার পোলাপান বউয়ের উপরে খুব জোর খাটায়। রঙ্গন সেইটা পারবো না। তোরে ছোটোবেলা থেইকা চিনে একটা মায়া পইরা গেসে। তোর বাপ বাইচা আছে। আহসান আছে! বেশি উত্তুবুত্তু করলে আহসান গিয়া তোরে ছাড়ায়া আনবো। সবদিক দিয়া বিবেচনা করলে তুই রঙ্গনরে জাইত্তা ধর। তোর সবদিক দিয়াই লাভ। বাপের বাড়ির সাথেই থাকবি। নাটক করলে লাথি মা’ইরা আইসা পড়বি!”

রুমির মাথা কথাগুলো একেবারে আঁটকে গেল। কথাগুলো খারাপ বলেনি বুবু। রঙ্গনকে ওরকম ছেলে যদিও মনে হয় না রুমির। মাথার তারদুটো ছেঁড়া কিন্তু মা’রামা’রি করবার মতো ছেলে সে নয়। যথেষ্ট ভদ্র! বলে দেবে কী হ্যাঁ? ভাবাভাবির পর্ব শেষ করে রুমিও সংকোচ নিয়েই সায় জানিয়ে দিলো। বিয়ের কার্যক্রম এভাবেই শুরু হয়ে গেল। রঙ্গন তো এই সেই বাহানায় এই কয়েকদিন বারবার রুমিকে দেখতে আসতো। রুমি পালিয়ে পালিয়ে বেরানোর চেষ্টা করতো। ঠিকই খুঁজে নিতো রুমিকে সে। কালরাতে রঙ্গন একটা বিচ্ছিরি রকমের অশ্লীল কথা বলে গেছে রুমিকে। সেই নিয়ে রুমির মেজাজ খারাপ। কাল সন্ধ্যার পর রঙ্গন তাঁদের বাড়ি এসেছিল। রুমি মধুবিবির ঘরে লুকিয়ে ছিল। মধুবিবি তা টের পেয়ে ধরিয়ে দিয়েছিলেন রুমিকে রঙ্গনের হাতে। যাবার সময় রুমিকে ইশারায় নিজের কাছে ডেকেছিল রঙ্গন। রুমি কাছে যেতেই রুমির কানে সে ফিসফিস করে বলেছিল,

” পলান্টিস খেলছো নাকি রোমানা ইয়াসমিন? কতদিন লুকিয়ে থাকবে? রুমি রুমি বিয়ের পর তোমার সঙ্গে খেলবো আমি চুমোচুমি! ”

এই বিচ্ছিরি কবিতা শুনে রুমি মুখ লুকিয়ে পালিয়ে ছিল। কি কথার ছিরি ছি!

আজ সকালে রঙ্গনদের বাড়ি থেকে লোক এসেছিল বিয়ে আর গায়ে হলুদের জিনিষগুলো দিতে। সেখানেও রঙ্গন এক বিপত্তি ঘটালো। বিয়ের এসব জিনিষ দিতে আসে বাড়ির বড়রা। রঙ্গন বিয়ের ডালা হাতে তুলে সকলেরও সঙ্গে নিজেও হাজির! বাড়িতে সে-সব নিয়ে একপ্রকার হাসাহাসি পড়ে গিয়েছিল। বেলাজ ছেলে কোথাকার! রুমির লজ্জায় গত হবার অবস্থা!

মনোয়ারা আর গুনগুন আহসানদের বাড়িতে বিকেলে এলেন। গুনগুন একটা হলুদ শাড়ি পড়েছে। এটা তাঁকে আহসান কিনে দিয়েছে। সে এখন ক্লাস এইটে পড়ে। আহসান তাঁকে এখনও ফোকলা বলে রাগায়। গুনগুনের এখন সবগুলো দাঁত আছে। তাও দাঁত নিয়ে কী ঘোর অবিচার তাঁর ওপরে। গুনগুন তরীর কাছে যাওয়া মাত্রই তরী তাঁকে কাঁচা ফুলের গয়না পড়িয়ে দিলো। বাড়ির সকল মেয়েদের জন্য আহসান কাঁচা ফুলের গয়না কিনে ফ্রিজে রেখে দিয়েছে। তরী আর গুনগুন একই রকম শাড়ি পরেছে। ফোনে আলাপ করে একই রকম ভাবে সেজেছেও অবধি। আহসান সেই দেখে দু’বোনের দিকে বারবার তাকায়। গুনগুনটার চেহারার আদলটা একেবারে তরীর মতো! কী মিল দুই বোনের! গুনগুন ফুলের গয়না পড়ে বাইরে বের হলো। রুমি পার্লারে সাজতে গিয়েছে বান্ধবীদের সঙ্গে। উঠোনে বড় করে স্টেজ বসানো হয়েছে। গুনগুন সেখানে বসে একটা ছবি তুললো। ছবিটা তাঁকে তুলে দিলো তরী। তখনই হঠাৎ করে এক যুবকের আগমন ঘটলো। তরীর কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে বললো,

” কেমন আছেন ভাবী?”

তরী সালামের জবাব দিয়ে ছেলেটার সঙ্গে হেসে কথা বলতে লাগলো। গুনগুন তাঁকে চেনে না বিধায় অস্বস্তিতে চোখ নামিয়ে নিলো। এদিকে ওদিক তাকিয়ে বাড়ির ডেকোরেশন দেখতে লাগলো। আজ সবাইকে খুব সুন্দর লাগছে। আহসান ভাইয়া তরীর বুবুর সঙ্গে ম্যাচিং করে পাঞ্জাবি পড়েছেন। খুব সুন্দর লাগছে দুজনকে। গুনগুন আসার পরই দুজনকে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে মনোয়ারার ফোন দিয়ে একটা ছবি তুলেছে। গুনগুন তরীর দিকে তাকালো। তরীর সঙ্গে কথা বলতে থাকা ছেলেটার দিকেও তাকালো। আহসানের কী হয় ছেলেটা? দুজনের চেহারায় খুব মিল। আহসানের মতোই খুব লম্বা ছেলেটা। ছেলেটা তরীর সঙ্গে কথা বলা শেষ করেই ভেতরে চলে গেল। গুনগুন তরীকে গিয়ে বললো,

” বুবু এটা কে? ভাইয়ার কিছু হয় কী? চেহারায় খুব মিল দুজনের। ”

তরী মুচকি হেসে বললো,

” এটা আহসানের চাচাতো ভাই উচ্ছ্বাস। আহসানের ছোট চাচার ছেলে। আমাদের বিয়েতেও তো এসেছিল। দেখিসনি? অবশ্য তুই তো তখন খুব ছোট্ট ছিলি। এতকিছু মনে থাকবে কী করে!”

গুনগুন আর কথা বললো না। তরীর পিছু পিছু ভেতরে চলে গেল।

রুমি পার্লার থেকে এলো সন্ধ্যার দিকে। এরপরই আসল অনুষ্ঠান শুরু হলো। একের পর একজন করে করে রুমির গালটাকে হরির লুটের মাল ভেবে হলুদ ছুইঁয়ে দিতে লাগলো। গালটা খুব জ্বালা করছে। কে যে আবিষ্কার করেছিল এই হলুদ লাগানোর বিষয়টা! হতচ্ছাড়া কোথাকার!

উঠোনে গানের আসর বসলো এক প্রকার। অর্ক আর সৌম্যও এসেছে। তবে, আজকের প্রধান আর্কষন দিলশান। সৌম্য আর দিলশান ম্যাচিং করে শাড়ি আর পাঞ্জাবি পড়ে এসেছে। অর্ক এসেছে গিটার নিয়ে। আজ সে গিটার বাজিয়ে গান গাইবে। আহসান, সৌম্য আর অর্ক সকলের ডবল দাওয়াত। প্রথমে তাঁরা রুমির হলুদ খেয়ে রঙ্গনদের বাড়িতে যাবে। ডবল মাস্তি! এই ভরা অনুষ্ঠানের মাঝে হঠাৎ অর্ককে কল করলো রঙ্গন। গানের আওয়াজে সেভাবে কিছু শোনা যাচ্ছে না। অর্ক তাও কল রিসিভ করামাত্রই রঙ্গন বললো,

” শা’লা কই তোরা? কখন আসবি?”

অর্ক ফোনটা চেপে ধরে বললো,

” আগে রুমির হলুদটা শেষ করি। তারপর সৌম্যকে সঙ্গে নিয়ে আসছি।”

রঙ্গন হতাশ হয়ে বললো,

” রুমিরে আজকে অনেক সুন্দর লাগতেসে না? আমার মন চাইতাসে ফাল দিয়া ওই বাড়ি যাইতে। আম্মার কারণে যাইতে পারতাসি না।”

অর্ক ঠোঁট টিপে হেসে বললো,

” তুই আসলেই বলদ! তুই এভাবে আসলে সবার চোখে লাগবে। তুই খালাম্মার বোরকাটা গায়ে দিয়ে চলে আয়। রুমিকে দেখে যা বউয়ের গায়ে হলুদও লাগিয়ে যা”

রঙ্গনের মাথা নিমিষেই ঘুরে গেল। ওয়াশরুমে যাওয়ার কথা বলে স্টেজ থেকে নেমে ঘরে গিয়ে নাহার বেগমের বোরকাটা পড়ে নিলো। বাইক নিয়ে গেলে সবার সন্দেহ হবে তাই পায়ে হেঁটেই রওনা দিলো।

রুমি তখন ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ছিল৷ ক্যামেরা ম্যান রুমির একের পর এক ছবি তুলেই যাচ্ছে। সেই সময়ে বোরকা পরিহিতা একজন নারী স্টেজে উঠলেন। বেশ মোটাতাজা শরীর। হলুদ ছোঁয়ানোর সময় ভদ্রমহিলার হাত দেখে সন্দেহ হলো রুমির। নিকাব পড়া বিধায় চিনতেও পারছে না সে। রুমি শুধু সন্দেহের বশে জিজ্ঞেস করলো,

” কে আপনি? নাম কী আপনার?”

রঙ্গন নারী কণ্ঠস্বর নকল করে বললেন,

” আমার নাম সকিনা বানু। আমি শামসুইল্লার আম্মা!”

রুমি দ্বিধায় পরে গেল তাঁদের পুরো গুষ্টিতে শামসুল নামের কেউ নেই। মহিলাটি আসলে কে? আর কিছু ভাবার আগেই নাচের আসর শুরু হলো। ডিজে গানে মাতালের মতো নাচছে বাড়ির ইয়াং ছেলেমেয়েগুলো। লাল নীল লাইটের আলোর খেলায় কখন যে বোরকা পরিহিতা নারীটি অদৃশ্য হয়ে গেলেন তা রুমি টেরও পেল না।

দিলশান আর তরীর মধ্যে খুব ভাব হয়েছে। বয়সের খুব ডিফারেন্ট’স থাকা সত্ত্বেও দুজনের বনেছে খুব ভালো। একটা খুব আনন্দের ঘটনা ঘটেছে। বিয়ের পরপরই সৌম্য দিলশানকে দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য নিয়ে গিয়েছিল। উন্নত চিকিৎসায় দিলশানের শরীরের উন্নতি ঘটেছে। দেশে আসার পরও দিলশান গাইনি চিকিৎসকের আওতায় ছিল। চিকিৎসায় কোনো কমতি রাখেনি সৌম্য। দুজনের চেষ্টা দেখে সৃষ্টিকর্তা তাঁদের দোয়া কবুল করেছেন৷ দিলশান এখন প্রেগনেন্ট! বেবির বয়স চারমাস চলছে। প্রেগনেন্সির কারণে জবটা সে ছেড়ে দিয়েছে। আগে একবার মিসক্যারেজে সে ভেঙ্গে পরেছিল। এবার তাই খুব সতর্ক সে। বাবু সুস্থভাবে পৃথিবীতে আসলে একটু বড় হলে। তারপর আবার জবে জয়েন করবে সে। তরীর খুব ভালো লাগছে দিলশানকে দেখে। সন্তান একবার সেও হারিয়েছে। তাই দিলশানের কষ্টটা সে বোঝে। সৃষ্টিকর্তা সকল দিলশানকে দিক। যা তাঁর সত্যিকার অর্থেই প্রাপ্য।

আহসান হঠাৎই তরীকে ইশারা দিয়ে ঘরে আসতে বললো। আহসানের কিছু লাগবে ভেবে তরী উঠে গেল ঘরের দিকে। দরজার সামনে যেতেই আহসান তাঁকে টান দিয়ে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিলো। মতলব বুঝে তরী বললো,

” কী করছেন? বাড়ি ভর্তি মেহমান কী ভাববে সবাই?”

আহসান তরীর কানে ফিসফিস করে বললো,

” ভাববে আমি আমার বউকে আদর করছি!”

বলেই তরীর কোমর চেপে ধরে ঠোঁটে চুম্বন করলো। গলায় ঘাড়ে ছোট্ট ছোট্ট কামড় দিলো। তরী কম যায় কীসে? আহসানের চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলার দশা প্রায়। আরো বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই বাইরে থেকে আহসানের ডাক পরলো। অর্ক তাঁকে ডাকছে। আহসান প্রথমে সাড় দিলো না। কিন্তু শেষ অবধি অর্কের ডাকাডাকিতে না গিয়ে পারলোও না। যাবার সময় তরীর কানে কানে বলে গেল,

” আজ রাতে তুমি ছাড়বো না সুন্দরী। তোমার ব্যাপারটা মাথায় রইলো!”

তরীও খুব করে ভেংচি কাটলো। বয়েই গেছে আহসানের কাছে ধরা দিতে তাঁর! আহসান চলে যেতেই তরী শাড়ির কুঁচি ঠিক করে বের হলো। গুনগুন এসে প্রশ্ন করলো,

” বুবু তোমার গলায় কী হয়েছে? এত লাল হয়ে আছে কেন?”

তরী আমতা আমতা করে বললো,

” কোথায়? কই কাঁচাফুলের মালা পরেছি না গলায়? পোকা টোকা কামড়েছে হয়তো!”

শোভা তরীকে ডেকে পাঠালেন তখনই। গুনগুন তখন স্টেজের সাইডে দাঁড়িয়ে ছিল। পেছন কে যেন হঠাৎ গুনগুন বলে ডাকলো। একটা পুরুষালী কণ্ঠ! আহসান ভাই ডাকলো কী? গুনগুন পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলো আহসানের ভাই ওটা! ওই যে উচ্ছ্বাস না কী নাম যেন। উচ্ছ্বাস গুনগুনের সামনে এসে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত এগিয়ে দিয়ে বলো,

” আমি মুনিম সারোয়ার উচ্ছ্বাস। তুমি?”

গুনগুন এদিক ওদিক তাকিয়ে হ্যান্ডশেক না করেই বললো,

” গুনগুন।”

এরপর আর দাঁড়ালো না। ভয়ে আতংকে দৌড়ে চলে গেল। উচ্ছ্বাস ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইলো। এমন অদ্ভুত কেন মেয়েটা? কথা-ই তো বলতে চেয়েছিল। ওভাবে দৌড়ে পালিয়ে গেল কেন? তবে, মেয়েটা খুব সুন্দর। চোখ ফিরিয়ে দু’বার ঘুরে তাকিয়ে দেখার মতো সুন্দর!
উচ্ছ্বাসরা এখানে থাকে না। গ্রামে তাঁদের পাকা ঘর তোলা আছে। মাঝেমধ্যে ছুটিতে এসে থাকে তাঁরা। উচ্ছ্বাসের বাবার ব্যবসা আছে শহরে। ছোটবেলায় এখানেই থাকতো তাঁরা। জীবন জীবিকার তাগিদে উচ্ছ্বাসরা ঢাকায় চলে এলো। উচ্ছ্বাসের বাবার নাম মুস্তফা সারোয়ার। মাজদাক সারোয়ার আর তিনি দেড় বছরের ছোট বড়। মুস্তফা সারোয়ারের বড় একটা মেয়ে আছে। তাঁর নাম উষা।আহসানের চেয়ে একবছরের ছোট। সে বিবাহসূত্রে দেশের বাইরে থাকে। রুমি আর উচ্ছ্বাস সমবয়সী । উচ্ছ্বাস রুমির চেয়ে তিন মাসের বড়। ছোটবেলায় উচ্ছ্বাসের হাতে সবচেয়ে বেশি মা’র খেয়েছে রুমি। দুজনের মধ্যে যেমন ভাব ছিল। আবার ঝগড়াও সবচেয়ে বেশিই হতো। উচ্ছ্বাসরা চলে যাওয়ার পর অনেকদিন রুমির মন খারাপ ছিল।

রঙ্গন মশার কামড় খেয়ে বোরকা পড়ে বাড়িতে ঢুকলো। কী সুন্দর লাগছে আজ রুমিকে! কিন্তু কী কপাল তাঁর! মেয়েরা নাকি স্বামীর হাত দেখলেই চিনে ফেলে। রুমি তাঁকে চিনলো না অবধি। বোরকা খুলে রঙ্গন ফের স্টেজে উঠলো। ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে চিকনি চামেলী গানে নাচতে লাগলো। কালকে তাঁর বিয়ে নায়ে ভর দিয়ে! যা নাচার এখন নেচে নিচ্ছে রঙ্গন। আহসান আসলে নাচগান সব বন্ধ। তখন সে ভং ধরবে। ভদ্র হবার ভং! ঝুমকা লাগালি রূপের বিজলি গিরানী রুমিকে দেখে লাগছে রে মন রিমিক্স কাওয়ালী!

চলবে…

‎#নিকুঞ্জ_কানন
‎#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ২৭
(শেষাংশ)

আহসানরা পুরো পরিবার মিলে স্টেজে উঠে ফ্যামিলি ফটো তুলছিল। মাজদাক আর শোভা মধুবিবিকে নিয়ে বসেছেন রুমির সঙ্গে। পেছনে আহসান আর তরী দাঁড়িয়ে। ছবি তোলা শেষে খাওয়া দাওয়ার পর্ব চলছিল। খেয়ে মধুবিবি ভেতরে চলে গেলেন। তাঁর এসব গানবাজনা ভালো লাগে না। অর্ক হঠাৎ এসে আহসানের কানে কানে বললো,

“রঙ্গন বারবার ফোন করছে। ওদের বাড়িতে যাবি না?”

আহসান সবকিছু মাজদাকের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে তরী, দিলশান, সৌম্যকে নিয়ে অর্কের সঙ্গে রঙ্গনদের বাড়িতে রওনা দিলো। অর্কের কাঁধে গিটারের ব্যাগ। ভেতরে ঢোকা মাত্রই ফুলহাতে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েরা ওদের মাথায় ফুলের পাপড়ি ছেটালো। গাঁদা ফুলের ছোট্ট একটা কলি হঠাৎ অর্কের চোখে এসে বিঁধলো। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে সে বারবার চোখ ডলতে লাগলো। পাশ থেকে এক মেয়েলী গলায় কে যেন বলে উঠলো,

” সরি ভাইয়া, বেখেয়ালে ফুলের পাপড়ি ছেটাচ্ছিলাম। খেয়াল করিনি! আপনার চোখে একটু পানির ছিটা দিন। ভালো লাগবে।”

রঙ্গন ঝাপসা চোখে মেয়েটার দিকে তাকালো। চোখ ডলতে ডলতে চোখ দিয়ে পানি পরছে তাঁর। একটা ঝাঁকড়া চুলের মেয়ে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে। সবুজ রঙের শাড়ি পড়া। মেয়েটা আর দাঁড়ালো না। কেউ পেছন থেকে মেহজাবীন বলে ডাকায় মেয়েটা চলে গেল। কে এই মেয়েটা?

রঙ্গন এতক্ষন স্টেজ কাঁপিয়ে নাচছিল। আহসানদের দেখা মাত্রই স্টেজে সং সেজে বসে রইলো। মুখে কোনো হাসি নেই। যেন কেউ জোর করে ধরে বেঁধে স্টেজে বসিয়ে দিয়েছে। আহসান আর সৌম্য স্টেজে উঠেই বাটিভর্তি হলুদ সব রঙ্গনের মুখে, গলায় আর শরীরে মাখিয়ে দিলো। অর্ক চোখ ধুতে গেছে। নাহলে তাঁকেও হলুদে ডুবিয়ে রাখার সুযোগ পাওয়া যেতো। স্টেজ থেকে নামার সময় সকলের অগোচরে সৌম্য দিলশানের গালে হলুদ লাগিয়ে দিলো। পুচকুটা থাকলে তাঁকেও হলুদ লাগানো যেতো!কবে যে আসবে! দিলশানও বা কম যায় কীসে? মুঠোভর্তি হলুদ নিয়ে সে সৌম্যর গলায়, গালে ঘষে দিলো। সৌম্যর সাদা পাঞ্জাবি পুরো হলুদ বর্ণ ধারন করলো! আহসানের মাথায় দুষ্টবুদ্ধি চাপলো। ছবি তোলার সময় তরী যখন তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। চুপটি করে সে তরীর পেছন থেকে হাত ঘুরিয়ে তরীর পেটে হলুদ লাগিয়ে দিলো। সবচেয়ে আনকমন হলুদ খেলা! তরী সুরসুরিতে মিইয়ে গেল। লোকটাকে আজ রাতে সে বাড়ি গিয়ে দেখে নেবে! যখন তখন তরীকে জাপ্টে ধরে চুমু খায়! রাতেও শরীর থেকে সরানোই যায় না। তরীর পুরো শরীর জুড়ে নিয়ে ঘুমিয়ে থাকে। সবাই বলে বিয়ের কয়েক বছর চলে গেলেই স্ত্রীর প্রতি স্বামীর টান কমে যায়। সেটা শারীরিক হোক কিংবা মনস্তাত্ত্বিক। কিন্তু, আহসানের ভেতরে সে-সব কিছুই আসেনি। উল্টে তরীর প্রতি তাঁর অধিকারবোধ বেড়েছে। আগে ছোট বলে তরীকে সে খুব ছাড় দিতো। এখন কীসের কী! এই তো কিছুদিন আগেরই ঘটনা। সকালে তরী বাড়ি ছিল। ক্লাস ছিল না বিধায় গোসল শেষে শাড়ি পড়ে তৈরি হচ্ছিলো। ওমা! অমনি আহসান দুম করে এসে তরীর শাড়ির কুঁচি ধরে হেঁচকা টান! পুরো শাড়ি খুলে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছিলো। শোভা ভেবেছিল আহসান আর তরী হয়তো ঘুমাচ্ছে। তাই সে কয়েকবার ঘুম থেকে তোলার জন্য ডেকে অবধি গিয়েছিল। তরী সেদিন লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল। দিনের বেলায় ওসব অপকর্ম…
ছি ছি! লজ্জা লজ্জা!

অর্ক গিটার নিয়ে গান শুরু করলো। দিলশান মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলো। ভার্সিটি লাইফের কথা খুব মনে পরছে। অর্ক যখন আগে ভার্সিটিতে গান গাইতো। সবাই এসে এসে ভীড় করে অর্কের গান শুনতো। সৌম্য তো সেই ফাঁকেও বারবার দিলশানের সঙ্গে আলাপ জমাতো। কথার টপিক খুঁজে না পেলে বারবারই একই টপিক নিয়ে কথা বলতে চাইতো। দিলশান শুরুর দিকে বেশি গায়ে পড়া ভেবে এড়িয়ে যেতো। পরে লক্ষ্য করলো সৌম্য সবার সঙ্গে এমনটা করে না। সবার সঙ্গে খুব মেপে মেপে কথা বললেও তাঁর সঙ্গেই কথার ভান্ডার খুলে বসে। এরপর থেকে দিলশান আর এড়িয়ে চলতো না তাঁকে। ওরকম মিষ্টি হাসি যে হাসে! তাঁকে কী করে এড়িয়ে চলা যায়?

অর্কের গান শেষ হওয়ার পরই সবাই হাততালি দিলো। তরী হা করে অর্কের গান শুনলো। কী সুন্দর গান গায় সে! গান শোনার সময় আহসান তাঁর পাশেই বসে ছিল। একটুও শান্তিতে গান শুনতে দেয়নি তরীকে। এই পিঠে হাত দিচ্ছে এই আবার পেটে! আজ আসুক খালি কাছে একবার! হাড়ে হাড়ে সবটা বুঝিয়ে দেবে! অর্ক গান গাওয়ার পর যখন সবাই হাততালি দিচ্ছিলো। অর্ক আড়চোখে ওই মেহজাবীন নামের মেয়েটার দিকে তাকাচ্ছিল। মেয়েটা খুব উৎসুকভাবে অর্কের গান শুনছিল। মেয়েটার কী ভালো লেগেছে অর্কের গান? একবার জিজ্ঞেস করে দেখবে কী? নাহ থাক!

যদিও আহসানদের বাড়ি থেকে সবাই খেয়ে এসেছে। তবুও নাহার বেগমের জোরাজোরিতে সবাই অল্প করে খেলো। খাওয়ার পর ভাগাভাগির পর্ব এলো। অর্ক থাকবে রঙ্গনদের বাড়িতে। সৌম্য আর দিলশান থাকবে আহসানদের বাড়িতে। রাত হয়ে যাচ্ছে বিধায় তরী আহসান সৌম্য আর দিলশানকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেল।অর্ক থেকে গেল রঙ্গনের সঙ্গে।দিলশানের শরীরটা ভালো নেই। বেশি রাত হয়ে গেলে চলাফেরা করাটা বাবুর জন্য নিরাপদ নয়।
আহসানরা চলে যেতেই রঙ্গন নিজের রূপে ফিরে এলো। রঙ্গনকে স্টেজে উঠে পাগলের মতো নাচতে লাগলো। অর্ক তো এক অদ্ভুত রকমের গান আবিষ্কার করলো। লাইনগুলো ঠিক এরকম

” টিকাতুলির মোড়ে একটা হল রয়েছে রঙ্গন নাকি রুমি বোনের প্রেমে পরেছে! হায় টিকাতুলির মোড়ে একটা হল রয়েছে। রঙ্গন নাকি রুমি বোনের প্রেমে পরেছে!”

খুশির ঠ্যালায় রঙ্গন পকেট থেকে একশো টাকার বান্ডিল বের করে টাকা ছিটালো। কচিকাঁচারা টাকাগুলো কুড়িয়ে নিয়ে নাচতে লাগলো। এগুলো দিয়ে তাঁরা মজা খাবে। রঙ্গন পাঞ্জাবি পাল্টে একটা সাদা সেন্ডো-গেঞ্জি পরে এলো। প্যান্টের বদলে পরনে তাঁর লুঙ্গি। সাউন্ড বক্সে লুঙ্গি ড্যান্স গান দিয়ে সে অর্কের সানগ্লাস পড়ে নাচতে লাগলো। মুছো কো থোরা রাউন্ড ঘুমাকে। আন্না কে জ্যাসা চাশমা লাগাকে!

আহসানদের বাড়িতে মেহমান অনুসারে শোয়ার জায়গা কম। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো ওপর নিচ করে শোয়া হবে।আহসানের পড়ার ঘরেও বেঞ্চগুলো সরিয়ে বিছানা পাতা হলো। মাজদাক আর মোস্তফা সারোয়ার একঘরে ঘুমাবেন। মধুবিবি, মোস্তফা গিন্নি রুবি, দিলশান, রুমি মধুবিবির ঘরে। আর পড়ার ঘরটা বড় বিধায় সেখানে তরী, গুনগুন, মনোয়ারা, শোভা সেখানে ঘুমোবেন। দুই বেয়াইন রাতে বসে বসে গল্প করবেন তাই এই ব্যবস্থা। দিলশান তরীর ওইঘরে সঙ্গে নিচে ঘুমাতে চেয়েছিল। মধুবিবি দিলশানকে ধমকে দিয়ে বলেছেন,

” নিচে অনেক ঠান্ডা। তুমি এইঘরে উপরে ঘুমাও। বাবু প্যাটে নিয়ে এই ঠান্ডায় ঘুমাইলে বাচ্চা প্যাটে থাইকাই ঠান্ডা নিয়া দুনিয়াতে আসবো। কী জানি কয় এইটারে! ওই যে নিউমোনিয়া।”

পরে দিলশান আর নিচে শোয়ার সাহস করেনি। চুপচাপ মধুবিবির সঙ্গে উপরে শুয়ে পরেছে।

আহসানরা বাইরে আড্ডা দিচ্ছে। তরী এসে তাঁদের ঘরটা গুছিয়ে দিলো। আহসান, সৌম্য আর উচ্ছ্বাস রাতে তাঁদের ঘরে শোবে। তরী আলমারি থেকে বালিশ বের করে বিছানায় রাখলো। নিজের নরম বালিশটা সঙ্গে করে বেরুবার সময় আহসান তাঁকে আঁকড়ে ধরে বললো,

” কোথায় যাওয়া হচ্ছে ম্যাডাম? আজকের রাত শুধু আপনার আর আমার! রূপ দেখিয়ে লোভে ফেলে চলে যাচ্ছেন?”

বলেই তরীর কানে আরো খুব বাজে একটা কথা বললো। তরী ভ্রু কুঁচকে ফেললো। কী সব বলছে লোকটা! মিটিমিটি হেসে সে বললো,

” আপনার পরিকল্পনায় ছাঁই! বাড়িতে শোয়ার জায়গা নেই। আপনি সৌম্য ভাইয়া আর উচ্ছ্বাস এখানে ঘুমোবেন। আমি পড়ার ঘরে মা আর গুনগুনকে নিয়ে শোবো। ঘুমিয়ে পরুন তাড়াতাড়ি আপনারা। কালকে কিন্তু অনেক কাজ আছে।”

আহসান ভোঁতা মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। একি অবস্থা! কই ভেবেছিল রাতে বউকে খানিকটা আদর সোহাগ করবে। তা আর হচ্ছে কোথায়? বউটার থেকে আলাদা করে দিলো! আহসানের তুলতুলে বউ!

তরীরা সবাই আজ ক্লান্ত। গল্প শেষে লাইট বন্ধ করে শুয়ে পরলো তাঁরা। মাঝরাতে হঠাৎ গুনগুনের খুব তৃষ্ণা পেলো। আশেপাশে হাতিয়ে পানি খুঁজতে লাগলো সে। কোথাও পানি নেই। বাইরে রান্নাঘরের সঙ্গে খাবার টেবিলে পানি দেখেছিল সে। নিয়ে আসবে কী? প্রথমে ভূত এবং অন্ধকারের ভয়ে সে এগুতে চাচ্ছিলো না। কিন্তু এদিকে তৃষ্ণায় গলা ফেটে চৌচির। হাত বাড়িয়ে মনোয়ারার ফোনের ফ্ল্যাশ লাইটটা জ্বালিয়ে গুনগুন পানি আনতে বের হলো। খাবার টেবিল থেকে বোতল নিয়ে পানি খেলো। একটা বোতল পাঁজা কোলা করে বগলে তুলে হাঁটা দিলো। হঠাৎ পেছনে কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে ভয়ে গুনগুনের লোম দাঁড়িয়ে গেল। বুকে প্রচন্ড সাহসের সঞ্চয় করে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো। ওই উচ্ছ্বাস নামের ছেলেটা। গুনগুনের ভয়ার্ত চেহারা দেখে সে বললো,

” ভয় পেয়েছো? এত রাতে এখানে কী করছো?ঘুমিয়ে পড়ো নয়তো শরীর খারাপ করবে।”

কী আপন ভেবে গুনগুনকে কথাগুলো বললো ছেলেটা। যেন গুনগুনকে খুব করে চেনে। গুনগুন মিনমিন করে বললো,

“পানি খেতে এসেছিলাম।”

এই বলে পানির বোতলটা নিয়েই সে দৌড়ে চলে গেল। আশ্চর্য বিষয় এই উচ্ছ্বাস নামের ছেলেটা গুনগুনের এত পায়ে পায়ে ঘুরছে কেন?

চলবে…