নিকুঞ্জ কানন পর্ব-২৮+২৯

0
28

‎#নিকুঞ্জ_কানন
‎#নুজহাত_আদিবা
[পর্ব ২৮]

সকাল থেকেই রুমি খুব কান্নাকাটি শুরু করেছে। নানা ভাবে বুঝ দিয়েও তাঁকে বোঝানো যাচ্ছে না। কখনো মধুবিবিকে ধরে কাঁদছে। কখনো মাকে ধরে কাঁদছে। শেষে না পারতে শোভা তরী আর গুনগুনের সঙ্গে রুমিকে পার্লারে পাঠিয়ে দিলেন। মেয়ের কান্নাকাটি তাঁর একদমই সহ্য হয় না। ছোট বলে সবার টান রুমির প্রতি একটু বেশিই।
তরীকে একটা শাড়ি কিনে দিয়েছে আহসান। হালকা গোলাপী রঙের বেনারসি শাড়ি। গুনগুনকেও একই রঙের একটা চুড়িদার কিনে দিয়েছে। গুনগুন পার্লারে সাজতে চায়নি। ওসব ভারী মেকআপ তাঁর সহ্য হয় না। শোভা জোর করেই পাঠালেন। দিলশানকেও পাঠাতে চেয়েছিলেন সঙ্গে। দিলশানই বুঝিয়ে সুঝিয়ে না করে দিয়েছে। বাবু পেটে আসার পর থেকে অতিরিক্ত গরম লাগে তাঁর। এরমধ্যে ওসব মেকআপ করে চলাফেরা করা কষ্টকর। বিয়েতে পাওয়া হালকা আকাশী রঙের একটা শাড়ি তোলা আছে তাঁর। আজ সেটাই পরবে সে।
ওদিকে আহসান আর মাজদাক সকাল থেকে ভীষণ ব্যস্ত। বাড়ির উঠোনে বড় করে প্যান্ডেল করা হয়েছে। তাতে চেয়ার আর বড় বড় টেবিল বসানো হয়েছে। বাইরে বাবুর্চিরা বড় ডেগচিতে করে রান্না করছে। সকাল থেকেই ওসব নিয়েই পরে আছে বাপ ছেলে। বাড়ির একমাত্র মেয়ের বিয়ে। কোনো কিছুতে মোটেও কমতি রাখা যাবে না।

সারারাত স্টেজে নাচাকোঁদার পর পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে রঙ্গন। কোনো তালই নেই তাঁর। কতবার যে সকাল থেকে ডেকে গেছেন নাহার বেগম হিসেব নেই। অর্ককেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ঘুমের অথৈই সাগরে সেও ডুব মে’রেছে। দুজনের ঘুমের মাঝে বাগরা দিতে এলো সৌম্য। রঙ্গনের ঘরে ঢুকেই এলোপাতাড়ি পানির ছিটা দিতে লাগলো। রঙ্গন বিরক্তি নিয়ে বললো,

” এই কেরে? ঘুমে তাকাতে পারছি না। কীসের পানি ছিটাছিটি করছিস!”

সৌম্য পানির গ্লাসটা রেখে বললো,

” তোর হুশ জ্ঞান কই গেছেরে রঙ্গনইন্না! উঠ জলদি! আজকে তোর বিয়ে। উঠে নাস্তা করে বস। আমি আসার সময় ফেসিয়াল স্ক্রাব নিয়ে এসেছি। বিয়ে করতে যাবি একটা লুকফুকের তো ব্যাপার আছে নাকি?”

বিয়ের কথা আমলে আসতেই রঙ্গন লাফ দিয়ে উঠে বসলো। আজকে তো আসলেই তাঁর বিয়ে। রুমির সঙ্গে চুমোচুমি খেলার দিন। তাড়াতাড়ি নাস্তা করে চোখ বন্ধ করে বসলো। সৌম্য রঙ্গনের গালে ফেসিয়াল স্ক্রাব লাগিয়ে দিচ্ছে। চোখে আহসানদের বাড়ির বাবুর্চিদের কাটা সালাদের বোল থেকে উঠিয়ে আনা দুটো শসার টুকরো। অর্ক সাইড থেকে বললো,

” আমাকেও একটু লাগিয়ে দে বন্ধু। আমারও তো একটা সুন্দর হতে ইচ্ছে করে নাকি?”

সৌম্য ফেসিয়াল স্ক্রাবের প্যাকেটটা অর্কের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,

” নিজেরটা নিজে মাখ। তোর বিয়ে লাগুক তখন তোকেও লাগিয়ে দেবো।”

অর্ক আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই স্ক্রাব লাগালো মুখে। রঙ্গন হাতদুটো সৌম্যের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

” খালি মুখ সুন্দর হলে হবে? আমার হাতেও লাগিয়ে দে৷ বাদ যাবে না একটি শিশুও। হাতে পায়ে সব জায়গায় লাগাবো।”

সৌম্য তাঁকে ভেংচি কেটে বললো,

” শখ দেখলে হাসি পায়! নিজে লাগিয়ে নে! মুখে লাগিয়ে দিচ্ছি সেটাই তোর পরম সৌভাগ্য। এসেছে আবার হাতে পায়ে লাগাতে!”

রঙ্গন অর্কের হাত থেকে প্যাকেটটা ছিনিয়ে নিয়ে হাতে পায়ে সব জায়গায় লাগালো। তাঁর বিয়ে আজ! সে এসব করবে না তো কে করবে?

রঙ্গন মুখ ধুয়ে এলো। মুখে আসলেই একটা চকচকে ভাব দেখা দিচ্ছে। বিয়ের পর রোজ রোজ রুমির চুমু খেলে সে আরো সুন্দর হয়ে যাবে। সৌম্য এবার সিরিয়াস ডিসকাশনে বসলো। রঙ্গনের সঙ্গে বরযাত্রায় সৌম্য যাবে। আর অর্ক থাকবে আহসানদের বাড়িতে।

রুমি তরী গুনগুন সেজেগুজে পার্লার থেকে এলো। রুমির পরনে লাল টকটকে বেনারসি শাড়ি। শাড়িটা পছন্দ করে কিনেছে রঙ্গন। নাহার বেগম সেদিন বলেছিল রুমিকে। পাগলা দাশুর পছন্দ খারাপ না। শাড়িটা খুব সুন্দর! রুমির মাথায় বড় খোঁপা করে তাতে গোলাপ ফুল গাঁথা। মাথায় বড় গোল্ডেন কালারের ওরনা। রুমির বান্ধবীরাও বাড়িতে এসেছে। সব বান্ধবীদের মাঝে রুমির বিয়ে সবার প্রথমে হচ্ছে।
তরী সেজেগুজে ঘরে গেল। গোলাপি বেনারসির সঙ্গে হালকা গোল্ড পড়েছে সে গলায়। চুলে দুটো গোলাপ দিয়ে খোঁপা করা। গুনগুনের চুলে খেজুর বেনী বাঁধা। মুখে একেবারে হালকা মেকআপ। তাঁর বড্ড অস্বস্তি হয় মেকআপে। আহসান তরীর পিছু পিছু ঘরে ঢুকলো। তাঁরও রেডি হতে হবে। তরী আলমারি থেকে আহসানের গোল্ডেন কালারের শেরওয়ানিটা বের করে রাখলো। আহসান ঘরে এসেই পাঞ্জাবি পাল্টে শার্ট পরলো। দরজা খোলা বিধায় ফিসফিস করে তরীকে বললো,

” কাল রাতে ধুলো ছিটিয়ে পালিয়েছো! আজ রাতে নিস্তার নেই। তৈরি থেকো সুন্দরী! আজকে তোমাকে ভালোবাসার আগুন ভস্ম করে দেবো!”

এটুকু বলেই ঠোঁট চোখা করে তরীর দিকে তাকিয়ে চুমুর ইঙ্গিত করলো। তরী লজ্জা দরজা দিয়ে পালালো।
রুমিকে ইতিমধ্যে স্টেজে বসানো হয়েছে। ফটোগ্রাফার এসে টুসটুস করে রুমির ছবি তুলছে। গুনগুন হা করে তাকিয়ে সে-সব দেখছিল। যখন তাঁর বুবুর বিয়ে হয় তখন সে খুব ছোট ছিল। নাহলে সে-ও খুব আনন্দ করতো। কেন যে বুবুটার এত তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে গেল! অবশ্য ভালোই হয়েছে। আহসান ভাইয়া খুব ভালো। তরীর বিয়ে না হলে আহসানের মতো ভাই পেতো কী করে সে? গুনগুনের খুব খেয়াল রাখে সে। মনোয়ারার কাছে ফোন করে গুনগুনের খোঁজ খবরও নেয়। গুনগুনের আধপাঁচ ভাবনার মাঝখানেই কে যেন গুনগুনের পাশে এসে দাঁড়ালো। গুনগুন পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো। ওই যে উচ্ছ্বাস নামের ছেলেটা। গুনগুনকে দেখামাত্রই হেসে বললো,

” কীসে পড়ো তুমি?”

গুনগুন ইতস্ততভাবে জবাব দিলো,

” ক্লাস এইট।”

উচ্ছ্বাস মুচকি হেসে বললো,

” এত পুচকি মেয়ে!”

গুনগুন আর জবাব দিলো না। ঠোঁট কামড়ে ওপাশ থেকে সরে গেল। গুনগুন তো এখন বড় হয়েছে। তাঁকে পুচকি বলে ডাকলো কেন? তরী অকস্মাৎ এসে গুনগুনের হাতে শরবতের গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে বললো,

” এই তাড়াতাড়ি এদিকে আয়। বর এসেছে আনার গেট ধরবো।”

তরী, গুনগুন আর দিলশান সামনে এসে দাঁড়ালো। পেছনে রুমির বান্ধবীরা। তাঁদের সবার একটাই দাবি। পঞ্চাশ হাজার টাকা দাও তারপর বউ নাও। রঙ্গন শেরওয়ানি পাগড়ি পরে ভেতরে ঢোকার বহু চেষ্টা করছে। সৌম্য দরদাম করেই যাচ্ছে। এরমাঝে রঙ্গন বললো,

” এতকিছুর দরকার নেই। আমার বউ দেন আমি চলে যাই!”

দিলশান চিৎকার করে বললো,

“উহুম! একদমই না! নো মানি তো নো হানি।”

শেষ অবধি পঞ্চাশ হাজারকে দশ হাজারে রূপান্তরিত করা হলো। টাকা দিয়েই শেষ অবধি রঙ্গন ভেতরে ঢুকলো। রঙ্গনের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল মেহজাবীন। রঙ্গনের হাত ধরে সেই ভেতরে ঢুকলো। রঙ্গনের আপন ভাইবোন নেই বিধায়। রঙ্গন মেহজাবীনকে বোনের মতোই দেখে। এটা তৈয়ব আলীর মেয়ে। রঙ্গন ভেতরে ঢুকে দেখলো স্টেজে রুমি বসা। লাল টকটকে শাড়ি চুড়ি পড়ে একেবারে বউয়ের মতো। কী সুন্দর লাগছে রুমিকে! একেবারে বউ বউ টাইপ। বউ-ই তো রুমি তো তাঁরই বউ। মাথায় করে রাখবে রুমিকে সে। একটা মাত্র বিড়াল বউ তাঁর। রুমি বউ! স্টেজে গিয়ে এক অহেতুক কান্ড ঘটালো রঙ্গন। টুপ করে সকলের সামনে জড়িয়ে ধরলো রুমিকে। রুমি পুরোই বিস্মিত! কেউ শিষ বাজাচ্ছে কেউ আবার হাতে তালি দিচ্ছে! ছি! বড়দের সামনে এমনটা না করলে হতো না? রঙ্গন নিজের কাজে অটল থাকলো। দু’হাতে জাপ্টে ধরে রাখলো রুমিকে। রুমির শরীর থেকে একটা বউ বউ টাইপ মিষ্টি ঘ্রান বেরুচ্ছে।

কাজী সাহেব বিয়ে পরাতে স্টেজে এলেন। শুরুতেই রুমিকে বললেন,

” দশ লাখ টাকা মোহরানায় আবুল কাসেম ব্যাপারীর একমাত্র পুত্র রঙ্গন ব্যাপারীকে বিয়ে করতে রাজি তুমি? রাজি থাকলে বলো মা কবুল।”

রুমি এদিক ওদিক তাকালো। তাঁর চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। আহসান তাঁর একটু পেছনে দাঁড়িয়েই আছে। সে আহসানের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ভেঙে ভাইয়া বলে কেঁদে ফেললো। আহসান রুমির কাছে জড়িয়ে ধরলো তাঁকে। রুমি এরপর চোখ মুছে কোনো রকমে ঢোক গিলে বললো,

” কবুল।”

পরপর তিন বার কবুল বলার পর রঙ্গনকেও একই প্রশ্ন করা হলো,

“দশ লাখ টাকা মোহরানা ধার্যক্রমে মাজদাক সারোয়ারের কনিষ্ঠ কন্যা রোমানা ইয়াসমিনকে বিয়ে করতে রাজি তুমি? রাজি থাকলে বাবা বলো কবুল।”

রঙ্গনের মনে যেন লাড্ডু ফুটছে। গটগট করে তিনবারই সে কবুল বলে দিলো। এদিকে রুমি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেই চলেছে। তরী তাঁর পাশে বসে তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। বিয়ের দিন তরী যখন রুমির মতোই কাঁদছিল। আহসান তখন বারবার তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিলো। তরী জেদের বশে এড়িয়ে গেছে। এখন এসব ভাবলে খুব হাসি পায়। উপেক্ষায় আহসানের মুখটা শুকিয়ে গিয়েছিল একেবারে।

বরযাত্রা খাওদা দাওয়ার একেবারে শেষ প্রান্তে রুমিরা খেতে বসলো। বড় টেবিলে রুমি রঙ্গন, আহসান তরী এবং তরীর পাশে গুনগুন। সৌম্য, অর্ক, দিলশান এবং উচ্ছ্বাস। আহসান পরে বসতে চেয়েছিল খেতে। মাজদাক সারোয়ার জোর করে আহসানকে খেতে বসিয়ে দিয়েছেন।সেই সকাল থেকে গাধারখাটুনি খাটছে ছেলেটা। বিশ্রামের তো একটু প্রয়োজন আছে। কথামতোই বিয়ের টেবিলে রাখা বড় খাসির মাংস ছিঁড়ে সে আগে অর্কের পাতে দিলো। এই মাংসের ইতিহাস শুধু অর্ক আর তাঁর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বড় খাসিটার সিংহভাগই অর্কের পেটেই গেল। এত ভারী পোশাকের কারণে হাত দিয়ে রুমি সেভাবে খেতে পারছিল না। পাশ থেকে তাঁকে তরী একটু একটু করে ছিঁড়ে খাইয়ে দিচ্ছিলো। অবশ্য আহসান সামনে না থাকলে এই কাজটা রঙ্গনই করতো।

খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে বিকাল অবধি ফটোসেশান পর্ব চললো। রুমি প্রায় বিরক্ত হয়ে পরলো। কালকে থেকে ছবি তুলে এখন ক্যামেরা দেখলেই তাঁর বিরক্ত লাগছে। অর্ক হঠাৎ রঙ্গনের পাশে এসে বসলো। ফিসফিস করে মেহজাবীনকে ইশারা করে রঙ্গনকে বললো,

” এই মেয়েটা কে?”

রঙ্গন স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো,

” আমার মামাতো বোন।”

অর্ক ফের বললো,

” কীসে পড়ে?

রঙ্গন উত্তরে বললো,

” এই বছর গ্র্যাজুয়েশন শেষ হবে।”

অর্ক ঠোঁট কামড়ে বললো,

” সিঙ্গেল?”

রঙ্গন অর্কের কথার মানে বুঝতে পেরে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বললো,

” একদম আমার বোনের দিকে চোখ দিবি না। আমার বোন মানে তোরও বোন!”

অর্ক ভেংচি কেটে বললো,

” এহ! তুমি যে আহসানের বোন নিয়ে টাংকিবাজি করলে? আমি আজই বাড়ি গিয়ে আব্বার সাথে কথা বলবো!”

রঙ্গন ভ্রু কুঁচকে বললো,

” শোন আহসানের বোন আমার বউ। কিন্তু আমার বোন তোর বোন। তোর মতো ফাজিলের সঙ্গে আমি আমার বোন বিয়ে দেবো না। তোর বিয়ে ঠিক হওয়ার আগেই ক্যান্সেল!”

অর্ক বাঁকা চোখে রঙ্গনকে দেখতে লাগলো। বিয়ে সে এই মেয়েকে করবেই! লিখে নিও বস!

বিদায় বেলায় রুমি কাঁদতে কাঁদতে বেহুশ হয়ে যাবার দশা। আহসানও মন ম’রা হয়ে কাঁদছে। মাজদাক সারোয়ারের বুকের ধন পরের বাড়িতে চলে যাচ্ছে। শোভা আর মাজদাক দুজনেই কাঁদছেন। মাজদাক রঙ্গনের হাতে রুমির হাত দিয়ে বললো,

” বাবা আমার একটাই মেয়ে। আমি আজকে কীসের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি সেটা তুমি বাবা না হওয়া অবধি বুঝবে না। আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো বাবা। আজ থেকে ওর দায়িত্ব তোমাকে দিলাম। কখনো চোখে জল আসতে দিও না। যদি বোঝা মনে হয় তাহলে আমার মেয়েকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিও। তাও কষ্টে ওর মনটা বিষিয়ে দিও না।”

রঙ্গন উপরে উপরে ভালো মানুষীর ঢং করলেও মনে মনে সে বললো,

” কাঁদবে আপনার মেয়ে অবশ্যই কাঁদবে। কিন্তু দুঃখে না! বিছানায় আমার ভালোবাসার জোয়ারে!”

রঙ্গন আধাঘন্টা যাবত গাড়ির সামনে দাঁড়িয়েই আছে। রুমির কান্নাকাটির পর্ব শেষই হচ্ছে না। একে ওকে ধরে সে কেঁদেই যাচ্ছে। রঙ্গন মনে মনে বিড়বিড় করে বললো,

” ওরে আমার বউটারে এবার ছাড় রে! আর কত কাঁদাবি? চোখের পানি সব একদিনেই ফুরিয়ে যাবে রে!”

রুমি প্রায় একঘন্টা পর কেঁদেকুটে গাড়িতে উঠলো। রঙ্গন তাঁর পাশে বসে। গাড়িতে আরো অনেক মানুষ আছে। তাঁদেরকে রুমি বিশেষ চেনে না। রঙ্গন হঠাৎ রুমির হাতটা চেপে ধরলো। ভয়ে হাতদুটো ঠকঠক করে কাঁপছিল এতক্ষন। রঙ্গনের ছোঁয়ায় কাঁপতে থাকা হাতগুলো কেমন নির্জীব হয়ে গেল!

ওই বাড়িতে গিয়ে রুমি যখন গাড়ি থেকে নামলো সবাই তখন ঘিরে ধরলো রুমিকে। পাড়া-পড়শীরা অনেকেই রঙ্গনের নতুন বউ দেখতে এসেছে। রাত অবধি বউ দেখার জন্য প্রতিবেশীদের আনাগোনা চলতেই লাগলো। রুমিকে বসার ঘরে ফ্যানের নিচে বসিয়ে রাখা হয়েছে। রঙ্গন রুমির পাশ থেকে সরছেই না। চিপকে আঠার মতো লেগেই আছে। যেন কলিজার ভেতর ঢুকে যাবে যখন তখন। নাহার বেগম এসে রুমিকে খাইয়ে দিলেন। রঙ্গনের ঘরে মনের সুখে অর্ক, সৌম্য, দিলশান এবং মেহজাবীন বাসর ঘর সাজাচ্ছে। দিলশানের এসব দেখে নিজের কথা মনে পরে গেল। এভাবে বাড়ির ছোটরা মিলে তাঁর আর সৌম্যের বাসর রাত সাজিয়ে ছিল। বাসর রাতে সৌম্য তাঁকে একটা গোল্ডের ব্রেসলেট উপহার দিয়েছিল। সেটায় দিলশানের নাম লিখা ছিল। মেহজাবীন ফুলের পাপড়ি দিয়ে লাভ বানাচ্ছে বিছানায়। অর্ক এসে তাঁকে বললো,

” আস্তে কলি ছিটাবেন। কখন আবার কার চোখে না পড়ে যায়।”

মেহজাবীন মুচকি হেসে বললো,

” ভুল বারবার হয় না। কাল ভুল করে আপনার চোখে পরেছিল।”

অর্ক নিজমনে বিড়বিড় করে বললো,

” হয়তো! ভুল করে ভুল হয়। ভুল করে আবার প্রেমও হয়। এই যে আমি পরেছি!”

রাত সাড়ে নয়টার দিকে অর্ক, সৌম্য এবং দিলশান চলে গেল। নাহার বেগম খুব অনুরোধ করেছিলেন থেকে যেতে। অর্ক আর সৌম্য বাহানা দিয়ে চলে গেছে। শেষে নাহার বেগম জোর করে ওদের খাইয়ে তারপর বাড়ি পাঠিয়েছেন। সবকিছু শেষ করে ছাড়া পেতে পেতে ঘরে ঢুকতে রঙ্গনের রাত এগারোটা বাজলো। ঘরে ঢুকতেই দেখলো বিছানায় একটা লালপরী ফুলের মাঝে বসে আছে। রঙ্গন পা টিপে টিপে বিছানায় গিয়ে বসলো। ঘোমটাটা খুলেই দেখলো কেঁদেকেটে রুমির চোখ ফুলে মৌচাক হয়ে গেছে। গলাও বসে গেছে অনেকটা।

রঙ্গন রুমির মাথায় একটা চুমু খেলো। ঠোঁটের দিকে এগুতেই রুমি সরে গিয়ে বললো,

” আপনি যা চাচ্ছেন তা হবে না। আমার একটু মেয়েলী সমস্যা চলছে।”

রঙ্গনের ভেতরে কোনো দুঃখ টুঃখ দেখাই দিলো। শুধু হেসে সে বললো,

” তাহলে একটা চুমু গালে শুধু? একটাই!”

বলেই রুমির গালে টুস করে চুমু খেলো। রুমি বিষ্ময়ে ঢোক গিললো। রঙ্গন বিছানা থেকে উঠে গিয়ে আলমারি খুললো। একটা রিং এর বক্স রুমির হাতে দিয়ে বললো,

” এটাতে একটা গোল্ডের রিং আছে। আমার প্রথম তিনমাসের স্যালারি দিয়ে কেনা। প্রথম স্যালারি দিয়ে সবাইকে সবকিছু দিয়েছি। মাকে দিয়েছি, মামা মামী এবং বোনদের দিয়েছি। তুমি তো আমার বউ। সেই হিসেবে তোমার কিছু পাওয়া আছে তো। এটা তোমার জন্য কিনেছি। একমুঠে কেনার মতো এতটাকা তখন হাতে ছিল না। তাই তিনমাস টাকা জমিয়ে কিনেছি।”

বলেই রুমির আঙ্গুলে রিংটা পরিয়ে দিলো। রিংটা খুব সুন্দর খুব চকচক করছে। রিংটার পেছনে খুব সুন্দর করে হলমার্কের মতো করে আর প্লাস আর লিখা। রঙ্গন তখনই ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,

” আমার উপহার কোথায় রুমি? বাসর রাতে উপহার দিতে হয় জানো না?”

রুমি আমতাআমতা করে বললো,

“, আমি তো জানি না। আমার কাছে কোনো উপহার নেই।”

রঙ্গন বাঁকা হেসে বললো,

” আছে তো! তুমিই তো একটা উপহার রুমি!”

এটুকু বলেই রুমির ঠোঁটে একটা টুস করে চুমু খেলো সে!

বাড়ি থেকে মেহমানরা চলে গেছে। আছেন শুধু রুবি, মোস্তফা সারোয়ার আর উচ্ছ্বাস। সেই ঘুরে ফিরে রাতে তরীকে আহসানের ঘরেই আসতে হলো। তরী তখন সবেমাত্র ঘরে ঢুকেছে। আহসান তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে কোলে তুলে নিলো। তরী মৃদু চিৎকার করে বললো,

” এই বাজে লোক ছাড়ুন বলছি!”

আহসান তাঁকে বিছানায় ফেলে দিয়ে বললো,

” বাজে বলেছো? আচ্ছা আজকে বাজে হয়েই দেখাবো! দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা!”

বলেই তরীকে ইচ্ছে মতো সুরসুরি দিলো। তরী খিলখিলিয়ে হেসে পালিয়ে যেতে চাইলো। আহসানের তরীকে পালিয়ে যেতে দেওয়ার মতো ইচ্ছে আছে কী? তরীর আঁচল খানা টান দিয়ে নিজের কাছে এনে ফেললো। এরপর যা হলো তা কাউকে বলা যায় না। ভীষণ ভীষণ বাজে কথা ওসব!

চলবে…

‎#নিকুঞ্জ_কানন
‎#নুজহাত_আদিবা
[পর্ব ২৯]

তরীর শরীরটা ভালো নেই। গত দুইদিন যাবত শরীরের খারাপের কারণে ক্লাসে যাওয়া হয়নি। উচ্ছ্বাসরা অনেকদিন পর বাড়িতে এসেছিল বিধায় অনেকদিন ছিল। তাই এই বাহানায় তরী ক্লাস মিস করেছে। আজ একেবারে না গেলেই নয়। আহসান ক্লাস মিস করা একেবারেই পছন্দ করে না। উচ্ছ্বাসরা দিন কয়েক আগেই চলে গেছে। উচ্ছ্বাস ছেলেটা খুব ভালো। ভাবী ভাবী বলে তরীর সঙ্গে খুব গল্প করতো। উচ্ছ্বাস যাবার সময় তরীকে সবার আড়ালে ডেকে বলেছিল,

” ভাবী আপনার কাছে আমার খুব মূল্যবান জিনিষ রেখে গেলাম। ভেবে নিন আমানত রাখলাম। সময় হলে আমার জিনিষ আমি ঠিকই ফেরত নেবো। ততদিন নাহয় আপনার কাছেই থাকুক।”

তরী বারবার করে জিজ্ঞেস করেছিল কী জিনিষ সেটা বলতে। উচ্ছ্বাস মুচকি হেসে এড়িয়ে গেছে। এমনকি উচ্ছ্বাস চলে যাবার পর তরী সারাবাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেছিল। উচ্ছ্বাস কিছু ফেলে গেছে কিনা। কিন্তু, তরী হতাশ! উচ্ছ্বাস কিছু ফেলেই যায়নি! কীসের কথা বলে গেল তবে?

তরী আলসেমি করে বিছানায় শুয়ে রইলো। ক্লাসে যেতে একদমই শরীরে কুলোচ্ছে না। কিন্তু, তাঁকে তরী কীভাবে আহসানকে বোঝায় যে সত্যিই তরীর শরীরটা ভালো নেই। আহসান ভাববে তরী নিশ্চয়ই অজুহাত দিচ্ছে। মাথাটা বড্ড ঘোরে, কেমন গা গুলিয়ে বমি হয়। গত একসপ্তাহ যাবতই এই সমস্যায় ভুগছে সে। তুবা পেটে আসার পর যেমনটা হয়েছিল ঠিক তেমনটা। আচ্ছা…. ওয়েট! এই মাসে তাঁর পিরিয়ড মিস গেছে! মনের কোণে কোথায় যেন একটা আশার আলো দেখা দিলো তরীর। দেখবে কী একবার পরীক্ষা করে? ক্লাস শেষে ফেরার পথে একটা কিট কিনে আনলে কেমন হয়?
তরী বিছানা থেকে কোনো রকমে উঠে দাঁড়ালো। আহসান স্কুলে চলে গেছে ভোরে। টলমলে পায়ে তরী কোনো রকমে তৈরি হয়ে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে গেল। মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। গতরাতে তলপেটেও খুব ব্যাথা হয়েছিল। আহসান শেষে গরম পানি দিয়ে সেঁকে দিয়েছিল পেটটা।

রুমি রোজ ক্লাসে একা-ই যায়। ঘুম থেকে উঠে রেঁধে বেড়ে তৈরি হয়ে বের হয়ে যায়। কিন্তু, ছুটি হলে রঙ্গন তাঁকে নিয়ে আসে বাড়িতে। রুমি বারবার নিষেধ করেছিল রঙ্গনকে। রঙ্গন বেহায়া বিড়াল তবুও আসে। ক্লাসের ভেতরে দিনে চৌদ্দবার করে রুমিকে কল করে। ভয়ে রুমি এখন সবসময় ফোন সাইলেন্ট করে বসে থাকে।
আজও তাঁর ব্যাতিক্রম হলো না। রুমি ক্লাস শেষে বের হয়ে দেখলো রঙ্গন দাঁড়িয়ে। রুমিকে দেখেই হেসে এগিয়ে এসে দুম করে জড়িয়ে ধরলো। রুমি তাড়াতাড়ি ছাড়িয়ে নিলো নিজেকে। রাস্তাঘাটে এসব কী? মানুষজন কী ভাবে কে জানে! এই লোকের কোনো আক্কেল জ্ঞান নেই! রুমি রেগে গিয়ে বললো,

” রাস্তায় দাঁড়িয়ে এসব কী করছেন? আমার ভালো লাগে না একদম এসব। বাড়িতে গিয়েও সারাদিন শরীরের সঙ্গে চিপকে থাকেন আঠার মতোন। এখন বাইরে এসেও তাই করছেন!”

রঙ্গন সে-সবের ধার ধারে নাকি! হাই তুলতে তুলতে সে বললো,

” আমার বউকে আমি জড়িয়ে ধরেছি তাতে কার বাপের কী? যা শা’লা নিজেদের বউকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে চুমু খা! আমার ভাগেরটার দিকে নজর দিচ্ছিস কেন?”

রুমি গটমট করতে করতে রঙ্গনের দিকে তাকালো। রঙ্গন সরল মুখে বললো,

” আজব তো? আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছো কেন রুমি? আমি আবার কী করলাম?”

রুমি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,

” নাহ! আপনি কেন কিছু করতে যাবেন? দোষ হয়েছে আমার কপালের!”

রুমি রেগেমেগে বাইকে গিয়ে বসলো। রঙ্গন উঠে দ্রুত বাইক স্টার্ট দিলো।

বাড়ি ফিরেই রুমি ঘরে ঢুকে আলমারি খুললো। গরমে শরীর ঘেমে একেবারে একাকার। গায়ের জামাটা পাল্টে নেওয়া দরকার। রুমি খুঁজে একটা পাতলা সুতির শাড়ি বের করলো। রঙ্গন তখন ফোন হাতে রুমিকে উদ্দেশ্য করে বললো,

” রুমি দরজা-টা দিয়ে দিও। আমার একটু কাজ আছে।”

রুমি তখন সবেমাত্র জামার বোতামে হাত দিয়েছে। শাড়িটা বিছানার ওপরে রেখে বললো,

“কোথায় যাচ্ছেন?”

রঙ্গন রুমির কাছে এলো। রুমির পেটে একটা চিমটি কেটে বললো,

” সৌম্য ফোন দিয়েছে সুন্দরী! তুমি এখন চেঞ্জ করবে?”

রুমি ওরনাটা গলা থেকে খুলে বললো,

” হ্যাঁ। খুব গরম বাইরে। শরীর ঘামে ভিজে গেছে।”

রঙ্গন ত্বরিত হাতে থাকা ফোনটা কানে তুলে বললো,

” সৌম্য আমার একটা দরকারী কাজ পরে গেছে আজ আসতে পারবো নারে। কাল দেখা হবে।”

রুমি অবাক হয়ে বললো,

” আপনি না এইমাত্র বললেন সৌম্য ভাইয়া ডেকেছে? এখন বলছেন যাবেন না। কাহিনী কী?”

রঙ্গন পরনে শার্ট খুলতে খুলতে বললো,

” তুমি এখন চেঞ্জ করবে তাই না রুমি? এত মনোরঞ্জন দৃশ্য ফেলে বাইরে যাই কী করে? তোমার না গরম লাগছে? কই করো চেঞ্জ!”

রুমি তেতে উঠে বললো,

” আপনি বাইরে যান বলছি! ক্যারেক্টারলেস বে’হায়া লোক! আমি কিন্তু চিৎকার করবো। আম্মাকেও ডেকে আনবো! এখনই বের হন আপনি রুম থেকে।”

রঙ্গন রুমির কোমরটা ধরে তাঁকে কাছে টেনে বললো,

” তুমি তো রোজ রাতেই চিৎকার করো রুমি। আম্মার সয়ে আছে! ছেলের নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে। আম্মা বুঝবে! কাছে এসো অনেক ভালোবাসে দিবো কলিজা। উম্মাহ!”

ধাক্কা দিয়ে কামড়ে দিয়েও ছাড় পেলো না রুমি। কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে ঠিকই…. ছিছি!

নাহার বেগম খাবার বেড়ে রুমিকে ডাকতে এলেন। দরজা ভেতর থেকে লাগানো দেখে আর বিরক্ত করলেন না। বিয়ের প্রথম বছর দিনরাত কোনো ব্যাপার না। মনে মনে রঙ্গনকে গালি দিয়ে বললেন,

” ফাজিল পোলা! মাইয়াটারে দিনেও একটু ছাড় দিলি না! এক্কেরে বাপের স্বভাব! ”

ক্লাস শেষে ফেরার পথে ফার্মেসি থেকে একটা প্রেগনেন্সি কিট কিনলো তরী। ব্যাগে ভরে বাড়ির পথে হাঁটা দিলো। আহসানকে আগেই কিছু বলা যাবে না। পজিটিভ আসলে বলবে। আল্লাহ না করুক নেগেটিভ আসলে আহসানের মৃদু হলেও মন খারাপ হবে। তরীর একদমই ভালো লাগে না আহসানকে ওভাবে দেখতে।

বিকেলে আহসান যখন ছেলেমেয়ে পড়ানো শেষে বাইরে গেল। তখনই তরী ব্যাগ থেকে কিটটা বের করলো। কিটে দু’ফোটা ইউরিন দিয়ে অপেক্ষা করতে শুরু করলো। পাঁচ মিনিট যেন পাঁচ ঘন্টার মতো লাগলো! আল্লাহর নাম নিয়ে তরী কিটের দিকে তাকালো। এটা কী হলো! কিটে দু’টো লাল দাগ দেখা যাচ্ছে। তাঁর মানে তরী প্রেগনেন্ট! তরী পেটে হাত রাখলো। এই ছোট্ট পেটে এখন আরেকজন বেড়ে উঠছে? তরীকে আম্মু আর আহসানকে বাবা বলে ডাকবে সে? সত্যি? তরীর যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। আনন্দে পুরো ঘরময় সে পায়চারি করতে লাগলো। আহসান ফিরলেই আজ আহসানকে সে সবার প্রথমে বাবুর খবরটা দেবে। যদিও এক সপ্তাহ ধরেই তরীর সন্দেহ হচ্ছিলো। তাও পিরিয়ডের ডেটের জন্য অপেক্ষা করছিল সে। আহসানের প্রাপ্যটুকু আহসানকে আজ ফিরিয়ে দেবে সে। আনন্দে চোখটা কেমন চিকচিক করে উঠলো তরীর! তুবা তরীর কোল জুড়ে আবার আসবে? আসবে তো! তরীর তুবা!

বিকেলে রুমি ঘর থেকে কোনো রকমে বের হলো। রঙ্গনকে কোনো রকমে সরিয়ে উঠে এসেছে সে। কুম্ভকর্ণটা এখন পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে! ভাবখানা এমন যেন সে কিছুই বোঝেন না। বিগত কয়েকদিন যাবত রুমিকে সারারাত জ্বালিয়ে খাচ্ছে। রুমির বুকের ওপরে পড়ে পড়ে ঘুমোয়! কেন রে বজ্জাত? পুরো বিছানা থাকতে তাঁর বুকেই কেন আস্তানা গাড়তে হবে? রঙ্গনের অত্যাচারে মাথাটা প্রচন্ড চড়ে থাকে রুমির। রাতে ঘুমোতে না দিলে পড়া হয়? ক্লাসে লেকচার শোনার সময় ঘুমে সে তাকাতে অবধি পারে না। বাবার বাড়ির নাম তো ভুলতে বসার উপক্রম প্রায়। এতদিন ভাবী যখন বাপের বাড়ি যেতো। ভাইয়ের খচখচানি দেখে বেজায় হাসতো সে। তরীর ওপর খুব রাগ হতো। কেন ভাইকে ফেলে চলে যায় সে? এখন তরীর জায়গায় এসে সবটা টের পাচ্ছে সে। পরশু ক্লাস শেষে রঙ্গনকে না পেয়ে বাড়িতে গিয়েছিল সে। মিনিট দশেকের মাঝে রঙ্গন এসে হাজির! ইচ্ছে ছিল রাতে থাকবার। কিন্তু, পাজি বজ্জাতটার কারণে চলে আসতে হয়েছে। মধুবিবি রুমির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মুখ টিপে টিপে হেসে বলেছিলেন,

” বরের আদরে দেখি তোর রূপ বায়া পরতাসে রুমি! জামাইটারেও বলিহারি! মাইয়াটারে একটু ছাড় দিলেও তো পারে। পুরা ত্যানা বানায়া দিসে আমার নাতনীটারে!”

রুমি লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পারেনি। কী লজ্জা কী লজ্জা! একটু উঠোনে গিয়েও শান্তি নেই। পিছু পিছু গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নাহার বেগমের ঘরে গিয়ে একটু গল্প করার সুযোগটাও দেয় না। বারবার ইশারায় এসে রুমিকে ডেকে যায়। রুমি না গেলে এই সেই বাহানায় নাহার বেগমকে দিয়েই রুমিকে ডেকে পাঠায়। এই নির্লজ্জের কারণে রুমির জীবনটা অতিষ্ঠ প্রায়। ছোট বাচ্চা ফিডারের জন্য মায়ের পেছন পেছন যেভাবে ঘোরে। রঙ্গনের অবস্থা হয়েছে তাই। রুমি যেখানেই যাক না কেন সেখানে গিয়ে রুমির কাজে বাগড়া না দিলে তাঁর চলেই না!

রুমি টেবিলে বসে ভাত খেলো। দুপুরের খাবার পেটে গেল বিকেলে। টেবিল গুছিয়ে উঠতেই রঙ্গন এসে হাজির। রুমি কোনো রকমে রঙ্গনকে ভাত বেড়ে দিয়ে কে’টে পরতে চাইলো। তা আর হলো কোথায়? রঙ্গন রুমির হাত চেপে ধরে বললো,

” একটু খাইয়ে দেও না বউ! তুমি না ভালো বউ! দাও খাইয়ে দাও!”

রুমি ভেংচি কেটে বললো,

” হাত নেই আপনার? নিজের হাত দিয়ে খান। এসব রঙ ঢঙ আমি করতে পারবো না।”

রঙ্গন তখনই খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে পরলো। প্লেটটা রুমির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

” খেতে হবে না আমার তাহলে। খিদে নেই খিদে ম’রে গেছে। বাইরে ভুলু ঘেউঘেউ করছে। ওকে দিয়ে এসো যাও।”

মুখ ভার খাবার রেখেই উঠে পরলো। প্লেটটা টেবিলের ওপরে রেখেই ঘরে চলে গেল। রুমির খুব মন খারাপ হলো এতে। যত যাইহোক খাবার ফেলে এভাবে কেউ চলে যায়? খাবারের প্লেটটা হাতে নিয়ে ঘরে এলো রুমি। রঙ্গনের শার্টের কলার ধরে কাছে টেনে আনলো। রঙ্গন মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। রুমি লোকমা তুলে রঙ্গনের মুখের সামনে তুলে ধরে বললো,

” হা করুন।”

রঙ্গন অভিমানের সূরে বললো,

” খাবো না;খিদে নেই।”

রুমি চোখ রাঙিয়ে বললো,

” খাবেন না তো ভাত বাড়ালেন কেন আমাকে দিয়ে? চুপচাপ খেয়ে নিন নয়তো আপনার ঘাড় ধরে সবগুলো ভাত গেলাবো!”

বলেই রঙ্গনের মুখে জোরপূর্বক খাবার পুরে দিলো। রঙ্গন এমন একটা ভাব ধরলো যেন তাঁর খাবার ইচ্ছেই নেই। রুমিই তাঁকে জোর করে ধরে খাওয়াচ্ছে। রুমি তো জানে না! এটা রুমির হাতে খাওয়ার জন্য তাঁরই চাল!

রঙ্গনকে খাইয়ে দিয়ে রুমি দুপুরে বের; করে রাখা শাড়িটা নিয়ে গোসলখানার দিকে ছুটলো। রঙ্গন মনে মনে বদ মতলব আঁটতে শুরু করলো। রুমি যখন গোসলখানায় ঢুকবে। কাপড় নিয়ে রুমির পিছু পিছু সে-ও গোসলখানায় ঢুকে যাবে। রুমির অগোচরে আলমারি থেকে সে-ও শার্ট আর লুঙ্গি বের করলো। রুমি যে-ই না গোসলখানায় ঢুকলো অমনি রঙ্গনও টুপ করে ঢুকে পরলো। রুমি রাগে কিড়মিড় করতে করতে বললো,

” কী হলো এটা? বেরিয়ে যান এখনই! এখনই বের হন বলছি!”

রঙ্গন ওসব কথা গ্রাহ্যই করলো না। উল্টো দাঁত ক্যালাতে ক্যালাতে বললো,

” তোমার সঙ্গে গোসল করবো বউ। মাথায় একটু শ্যাম্পু করে দিয়ে শরীরটা মেজে দাও তো বউ!”

রুমিকে ঘৃণায় নাক সিটকে বললো,

” ছি! আমি ওসব পারবো না। আপনি জলদি বের হন!”

রঙ্গন শার্টটা খুলে গায়ে পানি ঢাললো। সাবান আর শরীর মাজুনিটা রুমির হাতে দিয়ে বললো,

” তোমার তুলতুলে হাতটা দিয়ে আমারটা শরীরটা মেজে ধন্য করে দাও আমায় রুমি। দাও না বউ!”

রুমি মিষ্টি হেসে বললো,

” দিচ্ছি। আগে পিঠে সাবান ডলে দিচ্ছি। আপনি একটা সামনের দিকে ঘুরে দাঁড়ান।”

রঙ্গন খুশিমনে সামনে ঘুরে তাকাতেই রুমি রঙ্গনের পিঠে ইয়া বড় নখের আঁচড় কেটে দরজা দিয়ে বাইরে হয়ে পালালো। পালানোর সময় গোসলখানার বাইরে থেকে দরজার সিটকিনি লাগিয়ে লাইটটা বন্ধ করে দিলো। বিকাল ছিল বলে গোসলখানার বেন্টিলিটার থেকে পর্যাপ্ত আলো ভেতরে আসছিল বলে রঙ্গন এই যাত্রায় বেঁচে গেল। দরজার ওপাশ থেকে বারবার রুমি রুমি বলে চিৎকার করতে লাগলো। রুমির এসব শোনার সময় নেই! খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে সে নাহার বেগমের গোসল খানায় গিয়ে গোসল করলো। আরো এসো রুমির সঙ্গে গোসল করার সাধ নিয়ে! একেবারে জন্মের শিক্ষা হয়েছে বদটার! রঙ্গন মনের দুঃখে পানি গায়ে ঢেলে নিজেই গোসল সারতে লাগলো। পাজি মেয়ে এত জোরে তাঁর পিঠে আঁচড় কেটেছে যে পিঠটা তাঁর পানির সংস্পর্শে এসে জ্বলছে ভীষণ!

কাজ শেষে আহসান বাড়ি ফিরলো রাতে। খিদেতে হাত, পা রীতিমতো কাঁপছে তাঁর। আজকে খুব পরিশ্রমের একটা দিন গেল তাঁর। একটু ফুরসত মেলেনি সারাদিনেও। দুপুরেও ব্যবসার হিসাব মেলাতে গিয়ে একটু বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেওয়ার সুযোগ মেলেনি। আহসান খাওয়ার সময় তরীকেও টেবিলে ডেকে এনে একসঙ্গে খেলো। আহসান তরীকে ফেলে কখনোই একা খেতে বসে না। আজ তরী সেভাবে রাতে খেতে পারলো না। প্রথমত খাবারটা খুব টক আর গন্ধ লাগছে। দ্বিতীয়ত আহসানকে খবরটা দেওয়ার জন্য খুব এক্সাইটেড সে। আহসানের রিয়াকশন কী হবে তা ভেবেই পেটে কেমন সুরসুরি হচ্ছে। খাওয়া দাওয়া শেষে আহসান যখন ঘরে এলো। তরী তখন তাঁর পথ আগলে দাঁড়ালো। লাজুক মুখে হেসে বললো,

” আপনাকে একটা উপহার দেবো আজ। খুব পছন্দ হবে আপনার। আপনার জীবনের সেরা উপহারও বলা যায়!”

আহসান কিছু বলার আগেই তরী আহসানের বুকে মাথা রেখে বললো,

” আমাদের আরেকটা তুবা আসছে আহসান। আপনাকে বাবা বলে ডাকার জন্য কেউ আসছে!”

আহসান কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তরী তাঁকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আহসানের কী যে হলো! শক্তপোক্ত আহসান তরীকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ঠিক যেন ছোট্ট একটা বিড়ালের বাচ্চা! তরী নরমসূরে বললো,

” আপনার প্রাপ্য আজ আপনাকে ফিরিয়ে দিলাম আহসান। আমার ভুলে আপনি এক সুন্দর সুখ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। দীর্ঘদিন অনুতপ্ত হয়ে পুড়ে ম’রেছি। এখন থেকে আর নয়। বাবুর সঙ্গে আনন্দে দিন কাটাবো আমরা।”

আহসান চোখ মুছে তরীকে আরো শক্ত করে চেপে ধরে বললো,

” ভুল বলেছো তরী। তুবা তাঁর বরাদ্দের রিজিক নিয়েই এসেছিল। হায়াত শেষ তাই তুবাও চলে গেছে। তাতে তোমার দোষ কী তরী? আর একটা কথা। তুমি বাবুর কথা তিনমাস না হওয়া অবধি কাউকে বলবে না। বাড়ির কাউকেও না। ফের কোনো অঘটন ঘটলে। সবাই তোমাকে দায়ী করবে। আমার খুব খারাপ লাগে তরী। তোমাকে কেউ কষ্ট দিলে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে!”

এরপর তরীর গালে, ঠোঁটে আর পেটে কত-শত চুমু যে খেয়েছিল আহসান। সারারাত তরীকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদেই গেছে। তরীকে কতবার করে বুঝিয়ে বললো। কিছুতেই কিছু কাজ হলো না। বোকা লোকটা কেঁদেই গেল।

বিকেলে দীর্ঘসময় গোসল করার কারণে রঙ্গনের শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এলো। বিছানায় কাঁথা গায়ে দিয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলো। রুমি রাতে খাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছিল। বহু সময় নিয়ে ডাকাডাকি করার পরও রঙ্গন যখন উঠলো না। রুমি সন্দেহের বশে কপালে হাত রাখতেই চমকে গেল। ভয়ানক জ্বর এসেছে! নাহার বেগমকে ডেকে আনতেই নাহার বেগম রঙ্গনকেই দীর্ঘসময় গোসল করার জন্য বকাঝকা করলেন। মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিলেন। ভয়ে রুমির মুখ শুকিয়ে গেল। কেন যে সে গোসলখানার দরজাটা বাইরে থেকে লাগিয়ে দিয়েছিল! ইশ! দরজাটা না লাগালেই পারতো। দরজা খুলতে না পেরেই রঙ্গন গরমে বারবার শরীরে পানি ঢেলেছে। নিশ্চিত তাই জ্বর এসেছে! রঙ্গনের জ্বরের ঘোরে রাতে তেমন কিছু খেলো না। দুধ রুটি খেয়েই শুয়ে পরলো। রাতে রুমি লাইট নিভিয়ে বিছানায় যেতেই রঙ্গনের গোঙ্গানির আওয়াজ শুনতে পেল। ভয়ার্ত গলায় রুমি বললো,

” কী হয়েছে আপনার? বেশি খারাপ লাগছে?”

রঙ্গন গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে বললো,

” শীত লাগছে জড়িয়ে ধরো তো বউ। শক্ত করে ধরবে। অনেক শীত বাইরে! অনেক ঠান্ডা! ”

রুমি সত্যিই রঙ্গনকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরলো। রঙ্গন গুটিশুটি মে’রে সারাশরীরের ভর রুমির ওপরে ছেড়ে দিয়ে রুমির বুকে মুখ গুঁজে ঘুমালো। রঙ্গনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে রুমি ঘুমিয়ে গেল। রঙ্গন রুমির বুক থেকে মাথা উঁচু করে রুমির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। হেহে! জ্বর একা একা আসেনি! রঙ্গন জ্বরের গুষ্টিশুদ্ধ বংশধরকে ডেকে এনেছে। গোসল শেষে রুমের সবগুলো লাইট অন করে এবং ফ্যান বন্ধ করে ঘরটাকে গরম করেছিল রঙ্গন। রুমি তখন নাহার বেগমের সঙ্গে সংসারের কাজ করছিল। এই ফাঁকে রঙ্গন রান্নাঘর থেকে চার কোয়া রসুন এনেছিল। গরমের মধ্যে দুই কোয়া করে রসুন দুই বগলে; চেপে ধরে গরমের মধ্যে একঘন্টা ফ্যান বন্ধ করে বসেছিল। ফলাফল এই রাতে রুমির আদর সোহাগসহ বুকে ঘুমানোর সুযোগ! এসব জ্বর-ফরে কিছুই হয় না রঙ্গনের। ছোটবেলায় স্কুলে যেতে না ইচ্ছে হলে বগলে রসুন গুঁজে কড়া রোদের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতো রঙ্গন। কমপক্ষে দুইদিন জ্বরের বাহানা দিয়ে স্কুলে যেতে হতো না তাঁর! জীবনে জিততে হলে টেকনিক খাটাতে হয় টেকনিক! ইহা বলিয়াছেন স্বয়ং রঙ্গন ব্যাপারী! রুমির প্রতি প্রেম তাঁকে কবি বানিয়ে তুলছে।

চলবে..