#নিকুঞ্জ_কানন
#নুজহাত_আদিবা
[পর্ব ৩০]
আজ ঘুম থেকে উঠতে তরীর বড্ড দেরি হলো। ভোরের দিকে একবার উঠেছিল সে। তখন আহসান স্কুলে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিলো। ঘুমু ঘুমু চোখে আহসানকে দেখে পাশ ফিরে ফের শুয়ে পরলো তরী। এই ভারী শরীরটা নিয়ে বিছানায় পাশ ফিরতেও তাঁর খুব কষ্ট হয়। নয়মাসে এমনটা হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। রাত হলেই বাবুর লাফালাফি শুরু হয়। সারাদিন দুষ্টুটা শান্তই থাকে। রাতে তরী ঘুমোতে এলেই তাঁর যত দুষ্টুমি শুরু। নড়াচড়া করতে করতে সে নিচের দিকে নেমে যায়। নয়তো হাত, পা ছোঁড়ে। আর আহসান যদি ভুলক্রমেও তাঁর পেটে হাত দেয় তবে হয়েছে কাজ! সঙ্গে সঙ্গেই সাড়া দিয়ে ওঠে দুষ্টুটা। বাবার স্পর্শ এখনই খুব ভালো করে চিনে গেছে! রাতে দুষ্টুটা বেশি বিরক্ত করলে আহসান তেল গরম করে তরীর পায়ে মালিশ করে দেয়। পেটেও আলতো হাতে মালিশ করে দেয়। পুচকুটা তখনও বাবার স্পর্শ পেয়ে দ্বিগুন হারে লাফালাফি শুরু করে।
শোভার ডাকে ঘুম থেকে উঠে বসলো তরী। শোভা নাস্তা সাজিয়ে তরীর জন্য বসে আছেন। তরী কোনো রকমে কষ্ট করে ধরে ধরে বিছানা থেকে নামলো। শরীরে পানি উঠে হাত, পা ফুলে গেছে তাঁর। রাতে ঘুমও ভালো ভাবে হয়নি। কাল রাতে ছিল অর্কের বিয়ের প্রোগ্রাম। রঙ্গন আর রুমির বিয়ের দিন রঙ্গনের এক কাজিনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল অর্কের। সেই থেকে প্রণয় এবং শেষে পরিণাম। আপুটা দেখতে ভারী মিষ্টি। তরীকে বারবার করে কাছে ডেকে শরীর স্বাস্থ্যের কথা সুধোচ্ছিল। এই ফুলকো অসুস্থ শরীর নিয়ে তরী একদমই বের হতে চায়নি। পুচকোটা পেটের আসার পর থেকে মধুবিবি সন্ধ্যার পরে তরীকে কোথাও যেতে দেন না। কিন্তু, আহসান বাচ্চাদের মতো এমন জেদ ধরলো! তরী আর বাবু সঙ্গে না গেলে সে-ও যাবে না। শেষে তরী আহসানের কথা রাখতেই কোনো রকমে একটা শাড়ি পড়ে বিনুনি বেঁধে চলে গেছে। তেমন সাজগোজও করেনি। মাথাভর্তি ছিল মধুবিবির দেওয়া তেল। মধুবিবি রোজ তরীকে তেল দিয়ে চুল বেঁধে দেন। তরী ওভাবেই আহসানের সঙ্গে অনুষ্ঠানে চলে গেছে। কাল রুমি আর রঙ্গনও এসেছিল। রুমিটা দিন দিন খুব সুন্দর হয়ে যাচ্ছে। রঙ্গন ভাই খুব আদর যত্ন করে হয়তো। দিলশান আর সৌম্যও কাল এসেছিল। দিলশানের কোলে খুব আদুরে একটা মেয়ে বাবু ছিল। একেবারে মায়ের চেহারা পেয়েছে মেয়েটা। বয়স তাঁর চারমাস। দিলশান আর সৌম্য মিলে বাবুর নাম রেখেছে কিয়ারা। তরীকে দেখেই কেমন মিটমিট করে হাসছিল। তরীকে নিজেকে সামলাতে পারেনি। ভারী শরীরে এই তুলার বস্তাকে কোলে তুলতেও তাঁর কষ্ট হয়েছিল। তবুও সে কোলে তুলে খুব করে আদর করেছিল কিয়ারা। সৃষ্টিকর্তা সবকিছু ঠিকঠাক রাখলে দিলশানের মতো একটা পুচকু তাঁকেও দেবে। বারবার করে বাবুটার গালে, কপালে চুমু খাচ্ছিলো তরী। তাঁর বাবুটা কবে আসবে?
টেবিলে বসে তরী কোনোরকমে নাস্তা সারলো। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে। সোজা হয়ে বসতে খুব কষ্ট হয় তাঁর এখন। টেবিলে সাজানো হরেকরকমের আচার। কিছু বানিয়েছেন মধুবিবি। আর কিছু বানিয়েছে নাহার বেগম। বানিয়ে এগুলোকে রুমির হাতে তরীর জন্য পাঠিয়েছেন। রুমি মাঝে এসে থেকেছিল দুইদিন। তাও সন্ধ্যার পর এসে রঙ্গন ভাই খুব জ্বালাতন করেছেন। আহসানের জোরাজোরিতে রুমিকে নিয়ে যাবার সাহস করেননি। রুমি বারবার তরীর পেটে হাত রেখে বাবুকে অনুভব করতে চাইতো। দুষ্টুটা ধুমধাম ফুপির হাতে লাথিও বসিয়ে দিয়েছিল। তরী পরে বাবুকে খুব করে বকেছে। ফুপি কত আদর করে বাবুনকে। বাবুনটা ফুপিকে বোঝেই না!
তরী চেয়েছিল সকালে খেয়েদেয়ে পড়তে বসবে। তা আর হলো কোথায়। পেটে আর কোমরে কেমন চিনচিনে ব্যাথা। তরী বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরলো সোজা। এই ভারী শরীর নিয়ে রোজ ক্লাসে যাওয়া খুব কষ্টসাধ্য কাজ। তাই সপ্তাহে দুইদিন করে ক্লাসে যায় সে। পেটে ব্যাথায় তরী পাশ ফিরে শুয়ে পরলো। শরীর কেমন দরদর করে ঘামছে। একটু ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করলে কেমন হয়? তরী বিছানা থেকে নামতে গিয়ে বিপত্তি বাঁধলো। তাঁর পানি ভাঙ্গতে শুরু করেছে। তরী ব্যাথায় চিৎকার করে শোভাকে ডাকলো। শোভা আর মধুবিবি দৌড়ে এসে দেখলো। তরীর পানি ভাঙ্গছে! তরী পেট ধরে চিৎকার করতে শুরু করলো। মধুবিবি তরীকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে শোভাকে বললেন,
” আহসানের মা তাড়াতাড়ি আহসানরে ফোন করো। তাড়াতাড়ি বাড়ি আসতে কও। ওর প্রসব বেদনা শুরু হইসে। পানি ভাঙ্গতাসে সমানে। তাড়াতাড়ি ডাক্তারখানায় নিয়া যাইতে হইবো।”
ব্যাথায় তরীর মুখ নীল হয়ে গেল। শোভা দ্রুত আহসানকে ফোন দিলেন। মাজদাক সারোয়ার মাল কিনতে শহরে গেছেন। রাত ছাড়া কোনোভাবেই ফেরা সম্ভব নয়। আহসান তখন পরীক্ষার হলে গার্ড দিচ্ছিলো। বাচ্চাদের অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা চলছে। তরীর খবর শুনে সে আতংকে ছোটাছুটি করতে লাগলো। স্কুলে ভিজিটর এসেছে এই অবস্থায় আর্জেন্ট ছুটি ম্যানেজ করাটাও রিস্কি। চাকরি যাক চুলোয়! তরীর কাছে যাওয়াটা এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আহসান হন্য হয়ে ছুটির জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলো।
গত এক ঘন্টা যাবত আহসানের আসার কোনো নাম নেই। তরী ব্যাথায় চিৎকার করে কেঁদেই যাচ্ছে। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পরছে। মধুবিবি অতিষ্ঠ হয়ে শোভাকে বললেন,
” চুলায় শাক সিদ্ধ করার পানি বসাইছিলা না? শাক পরে সিদ্ধ দিও। বালতিতে কইরা গরম পানিটা নিয়া আসো৷ সাথে পরিস্কার একটা কাপড় আনবা। একটা ব্লে’ড আইনো মনে কইরা।”
শোভা আঁতকে উঠে বললেন,
” কী করবেন আম্মা এসব দিয়ে? আহসান তো আসছেই। একটু ধৈর্য ধরুন না আম্মা!”
মধুবিবি তরীর মাথা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
” তোমার পোলা গত একঘন্টা যাবত আইতেই আছে! মাইয়াটারে কতক্ষন ধইরা ফালায়া রাখবা এমনে? তোমারে যা কইসি তাই করো৷ একটু চেষ্টা কইরা দেখি। হইলে হইবো না হইলে নাই। উচ্ছ্বাস ও তো আমার হাতেই হইসে!”
শোভা মধুবিবির বলে দেওয়া জিনিষগুলো জোগাড় করে দিলেন। মধুবিবি ইতিমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছেন। তরীকে বারবার করে বলছেন,
” মাগো তুমি জোরে চাপ দাও। আল্লাহর নাম নিয়া চাপ দাও। আল্লাহ সব ঠিক কইরা দিবো। ”
তরী মাঝে একবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। ব্যাথার তীব্রতায় তাঁর জ্ঞান এসেছে কোনো রকমে। মধুবিবির কথামতো শরীরের সমস্ত জোর দিয়ে সে চেষ্টা করতে লাগলো। হচ্ছে না! একটা সময় পর তরী বুঝতে পারলো সে আর পারছে না। শেষবার চেষ্টা করে সে বড়বড় দম নিতে লাগলো। বারবার বড় বড় ফুঁ দিয়ে ব্যাথা সামলাবার চেষ্টা করতে লাগলো। তখনই ঘটলো এক মিরাকেল। চিকন মিহিসূরে একটা বাচ্চার কান্না শুধু কানে গেল তরীর। র’ক্তক্ষরন ও মানসিক ধকল সামলাতে না পেরে তরী জ্ঞান হারালো। মধুবিবি বাচ্চাটাকে সাবধানে বের করে দেখলেন এটা একটা ছেলে বাবু। মধুবিবি আস্তে করে বাচ্চাটার পিঠে চাপড় মা’রতেই ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠলো সে। কতশত অভিমান নিয়েই যেন সে পৃথিবীতে এসেছে। ঠোঁটদুটো হয়েছে একেবারে বাবার মতো!
অনেক চেষ্টার পর একঘন্টা পর ছুটি ম্যানেজ করতে পারলো আহসান। গার্ডের দায়িত্ব আরেকজনকে বুঝিয়ে দিয়ে আসতে আসতে লাগলো আরো আধা ঘণ্টা। ভয়ে হাত পা উভয়ই কাঁপছে আহসানের। কী যে হচ্ছে! তরী ঠিক থাকলেই হয়!
বাড়িতে ঢুকতেই বাচ্চার কান্নার স্বর শুনতে পেয়ে থমকে গেল আহসান। ড্রয়িংরুমে বড় ছড়ানো বালতিতে একটা ছোট্ট বাবুকে গোসল করাচ্ছে মধুবিবি। আহসানের শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। বাবুটা কে? তাঁর আর তরীর বাবু? পরোক্ষনেই মাথায় এলো তরী কোথায়? আহসান দৌড়ে ঘরের দিকে ছুটে গেল। মধুবিবিকে বাবুটাকে পরিস্কার করতে করতে বললেন,
” কেমন বাপ তোর দেখ বাবু! তোর দিকে ফিরাও তাকাইলো না!”
বাচ্চাটা এতসব বুঝলো না। তাঁর খিদে পেয়েছে। চিৎকার করে সে সেটাই জানান দিতে লাগলো। শোভা তরীর জামাকাপড় পাল্টে দিয়েছে। মেয়েটা বেহুশের মতো ঘুমোচ্ছে। আহসান তরীকে দেখেই দৌড়ে গিয়ে তাঁকে ওঠাতে চাইলো। বারবার করে বললো,
” এই তরী! কী হয়েছে তোমার চোখ খোলো না! তরী! ওঠো না! রাগ করেছো? ভুল হয়ে গেছে মাফ করে দাও। ভুল হয়ে গেছে আমার লক্ষীটি!”
শোভা আহসানকে ফিসফিস করে বললো,
” ওকে বিরক্ত করিস না। একটু বিশ্রাম নিতে দে। একটু আগে যা ধঁকল গেল! র’ক্ত তো কম যায়নি শরীর থেকে। সর তুই! নিরিবিলি একটু ঘুমাক মেয়েটা।”
আহসানের মন সায় দিলো না। তরীর পাশ থেকে সে উঠলোই না। প্রচন্ড অনুতাপে ভুগছে সে। তরীর জীবনের যে-ই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি তাঁকেই প্রয়োজন ছিল। সেই সময়েই পাশে থাকতে পারেনি সে। কীভাবে মাফ করবে নিজেকে সে?
রুমি আজ ক্লাসে যায়নি। কী জানি সকালে ঘুম থেকে উঠে ক্লাসে যেতে একদমই ইচ্ছে হয়নি। এমনিতে কখনো সে বিনা কারণে ক্লাস মিস করে না। তবে, মাঝেমধ্যে একটু ফাঁকিবাজি করে আরকি। আর এসব বাজে অভ্যাস হয়েছে তাঁর রঙ্গনের সঙ্গে থেকে থেকে। নিজেও একটা ব’দ। রুমির মাথায়ও কী সব বদবুদ্ধি ঢোকাচ্ছে আজকাল। রঙ্গন কালরাতে ছোট্টমাছ এনেছে। রাতে কা’টা হয়নি বিধায় রুমি দুপুরে সেগুলো নিয়ে বসলো। আজকের রান্না শেষ তাঁর। মাছগুলো কালকে আলু কুচি করে তাঁর সঙ্গে ঝোলের মতো করে রাঁধবে রুমি। রঙ্গন স্কুল থেকে ফিরেই দেখলো রুমি রান্নাঘরে মাছ কা’টছে। বারবার রান্নাঘরের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে লাগলো সে। রুমিটা কী যে বোকা! বর কাজ থেকে বাড়ি ফিরলে ঘরের দিকটায় একটু এলে কী হয়? সারাদিন শুধু সংসারের কাজ নিয়ে পরে থাকে। এদিকে রঙ্গন যে বউয়ের ভালোবাসার অভাবে শুকিয়ে ম”‘রছে সেদিকে একটুও খেয়াল নেই। রঙ্গন এবার রান্নাঘরে রুমির সামনে গিয়ে বসে বললো,
” তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে ঘরে এসো। আমার দরকারি একটা কাজ আছে তোমাকে দিয়ে। ”
রুনি বেশ ভালো করেই জানে এই কথার মানে। মাছ কুটতে কুটতে সে বললো,
” পারবো না। অনেক মাছ কুটতে সময় লাগবে। ”
রঙ্গন আর অপেক্ষা করলো না। আরেকটা ব’টি নিয়ে এসে রুমির সঙ্গে মাছ কুটতে বসে গেল। যত দ্রুত মাছ কুটা শেষ হবে। তত তাড়াতাড়ি বউটাকে ঘরে নিয়ে আদর সোহাগ করতে পারবে সে। এভাবে সত্যিই মাছ খুব তাড়াতাড়ি কা’টা শেষ হয়ে গেল। রুমি ব’টিগুলো ধুয়ে রাখার সময়ই হঠাৎ নাহার বেগম দৌড়ে এসে বললেন,
” বউ তাড়াতাড়ি বাইর হও। তোমার আম্মায় ফোন দিসিলো। তোমার ভাবীর একটা পোলা হইসে।”
রুমি চমকিত হয়ে কথা বলতে ভুলেই গেল। সে ফুপি হয়েছে? বাবু এসেছে বাবু?
★
তরীর জ্ঞান ফিরলো ভর দুপুরে। তরী কোনো রকমে চোখ মেলে তাকাতেই দেখলো; আহসান চিন্তিত মুখে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। তরী তৎক্ষনাৎ বললো,
” বাবু কোথায় আমাদের বাবু?”
আহসান নিজের কোলে থাকা বাবুটাকে তরীর কাছে দিয়ে বললো,
” এই দেখো আমাদের তুতুন তরী!”
তরী কোনো রকমে বাবুকে কোলে নিয়ে কেঁদে ফেললো। আহসানেরও সন্তানের মুখ দেখে চোখ ভিজে গেল। তাঁদের তুতুন! তরী আর সে মিলে ঠিক করেছিল। বাবু মেয়ে হলে নাম রাখবে তুবা। আর ছেলে হলে নাম হবে তুতুন। তুতুন খিদের তাড়নায় আঙ্গুল মুখে ঢুকিয়ে সমান তালে আঙ্গুল খেয়েই যাচ্ছে। শোভা এসে তরীকে বাবুকে খাওয়াতে সাহায্য করলেন। প্রথমে খুব কষ্ট হচ্ছিলো খাওয়াতে। এরপর ব্যাথায় আস্তে আস্তে কমে এলো। খাওয়া শেষে তুতুন চোখ বুজে ঘুমিয়ে পরলো। একেবারে যেন ছোট্ট একটা পুতুল। গালগুলো কী লাল টুকটুকে। নাকটা আবার হয়েছে তরীর মতো। মধুবিবি এসে আহসানকে বললেন,
” পোলা হইসে আজান দিবি না আহসান? উঠ দাঁড়া! আজান দে বাবুর কানে।”
আহসান আলতো হাতে বাবুকে কোলে তুলে বাবুর কানে আজান দিলো। এরমতো সুন্দর অনুভূতি আর নেই! রোজ একবার করে সন্তানের কানে আজান দেওয়ার প্র্যাকটিস করতো আহসান। আজ বোধহয় স্বপ্নটা সত্যি হলো! আজান শুনে তুতুন কেমন নড়েচড়ে উঠলো। সে শুনেছে বাবার দেওয়া আজান!
★
রঙ্গন রুমিকে সঙ্গে করে তাড়াহুড়ো করে এই বাড়িতে এলো। খুশিতে যেন কেমন পাগল পাগল লাগছে বাড়িতে ঢুকে হাতটা ধুয়েই বাবুকে কোলে নিলো সে। বাবুর টুকটুকে লাল গালে অসংখ্য চুমু খেয়ে লাল করে দিলো। রঙ্গন পাশ থেকে বাবুর আঙ্গুলগুলো নিয়ে খেলা করতে করতে বললো,
” নাম কী বাবুর?”
রুমিকে বাবুর চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বললো,
” ডাকনাম তুতুন। ভালো নাম এখনও ভাইয়া ভাবী ঠিক করেনি।”
রঙ্গন বাবুটার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো। কী সুন্দর! কবে সে বাবা হবে? এরকম একটা পুতুলের মতো বাবু রুমির কোলেও আসবে? রঙ্গন আদুরে গলায় রুমিকে বললো,
” চলো না রুমি আমরাও একটা বাবু নিয়ে আসি? এরকম ছোট্ট একটা বাবু। তোমার কিছু করতে হবে না। আমি সব করে দেবো। তুমি এনে দাও না বাবু রুমি!”
রুমি মশকরা করে বললো,
” আছে তো আমাদের বাবু। আপনি না আমার টুকটুকির বাবা?”
রঙ্গন মেয়ের কথা শুনেই রুমিকে ভেংচি কাটলো। ঘটনাটার সূত্রপাত হয়েছে দেড়মাস আগে। ক্লাস শেষে রুমিকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে রাস্তায় এক বিড়ালছানা পেয়ে সেটাকে ঘরে তুলে এনেছে রুমি। সেটা নিয়েই আধিখ্যেতার শেষ নেই! সারাদিন ওটাকে কোলে নিয়ে বসে থাকে। নাম দিয়েছে আবার টুকটুকি। সারাদিন টুকটুকির বাবা টুকটুকির বাবা বলে রঙ্গনের মাথা খায়! রঙ্গনের ইচ্ছে হয় টুকটুকিকে বাইরে ফেলে দিয়ে আসতে। নেহাতই রুমির এত মায়া দেখে সে আর তা পারে না। বজ্জাত মায়ের বজ্জাত মেয়ে! সুযোগ পেলেই রঙ্গনকে টার্গেট করে রাখে টুকটুকি। ধুমধাম কামড় দিয়ে দৌড়ে পালায়। রুমির মতো সে-ও রঙ্গনকে দু’পয়সার দাম অবধি দেয় না।
রঙ্গন মুখ ভোঁতা করে বললো,
” আমার নিজের একটা বাবু লাগবে। তোমার বিড়ালের বাচ্চা নিয়ে তুমি বসে থাকো যাও! আমার বাবুর সবকিছু আমিই দেখাশোনা করবো!”
রুমি তুতুনের হাতে চুমু খেতে খেতে বললো,
” আচ্ছা তাহলে আমাদের বাবু হলে আমরা তুতুনের সঙ্গে নাম মিলিয়ে রাখবো হ্যাঁ?”
রঙ্গন ভ্রু কুঁচকে বললো,
” আমার বাবুর নাম আমি রাখবো। আমার বাবুর নাম হবে ❝সৈয়দ কামাল উদ্দিন জামাল চৌধুরী বিন সুলতান ইবনে আব্দুল মোজাহেদ দেওয়ান ব্যাপারী!❞
রুমি নামের বহর শুনে ঝটকা খেলো। এত বড় নাম ডাকতে গিয়ে মানুষ অক্কা পাবে! এই আধা পাগলটারও বলিহারি! নাম রাখার কী ছিঁড়ি! ছ্যাহ!
★
সন্ধ্যাবেলা বাবুকে খাওয়ানো মাত্রই সে ঘুমিয়ে গেল। রুমি আর রঙ্গন একটু আগে চলে গেছে। আহসান তখন ঘরে এলো। তাঁর দু’হাতে তুতুনের জন্য কেনা নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। আগের বারের দূর্ঘটনায় এবার আগে থেকে বাবুর জন্য কিছুই কেনা হয়নি। তাড়াহুড়ো করে এখন সব কেনা হলো। আহসান বিছানায় এসে তুতুন আর তুতুনের আম্মুর মাথা চুমু খেলো। ঘুমন্ত তুতুনকে তরীর কোল থেকে সরিয়ে নিজে কোলে তুলে নিলো। তরীর দিকে তাকিয়ে আহতসূরে বললো,
” আজকের দিনটার জন্য কখনো নিজেকে মাফ করতে পারবো না তরী! তোমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টাতেই তোমার পাশে থাকতে পারলাম না। আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম। কিছুতেই পারলাম না! আমাকে ক্ষমা করে দিও পারলে তরী!”
তরী আহসানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
” আপনি চেষ্টা করেছেন পারেননি। রিজিকে যা ছিল তাই হয়েছে। আপনাকে কেন অকারণে দোষ দেবো? আপনারও তো কাজ আছে। আপনি কাজ করেন আমার আর তুতুনের জন্যই তো। আমি আপনার ওপরে রাগ করিনি তুতুনের বাবা। আর তুতুনও বলেছে বাবাকে সে খুব ভালোবাসে। বাবার ওপরে তুতুন রাগ করতেই পারে না!”
আহসান তুতুনের দিকে তাকিয়ে চোখ মুছলো। কী ছোট্ট ছোট্ট হাত তাঁর। নরম গোলগাল মুখ! চেহারায় আবছা তরীর মতো একটা আদল। গায়ের রঙটা তরী কিংবা তাঁর কারোর মতোই হয়নি। হয়েছে দাদার মতো ধবধবে ফর্সা। আহসান তুতুনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
” তুমি আমার জীবনে ফুল হয়ে এসেছিলে তরী। ফুলের বিপরীতে কখন যে তুমি আমার জীবনটাকে মস্ত ফুল; বাগানে পরিণত করলে কে জানে! কখন করলে এই কাজ তরী?”
তরী নতমুখে লজ্জায় মাথা নামিয়ে ফেললো। তবে কী সে ফুল? হতে পারে। সে যদি ফুল হয় তবে আহসান মালী। হিহি! আম্মু বাবার প্রেমালাপের মাঝেই তুতুন জেগে উঠলো। কিন্তু একটুও কাঁদলো না। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে হাতখানা মুখে পুরে আম্মু আর বাবার কথা শুনতে লাগলো। ভাবখানা এমন যেন সে সব বোঝে। দুষ্টু একটা!
সমাপ্ত…