নিগূঢ় আলিঙ্গন পর্ব-০১

0
779

#নিগূঢ়_আলিঙ্গন
#Jhorna_Islam
#সূচনা_পর্ব

কনকনে শীতের মাঝে রাত তিনটায় উঠিয়ে যখন পুকুরের ঠান্ডা পানিতে গোসল করিয়ে বাচ্চা হওয়ার ঔষধ খাইয়েছে শ্বাশুড়ি মা, তখন বুঝে গেছি বাচ্চা ছাড়া আমার অবস্থান টা কোথায়।

সকলের খাওয়া দাওয়া শেষ হওয়ার পর নিজে খেয়ে আবার সবকিছু গুছিয়ে একেবারে থালা বাসন ধুয়ে তারপরই ঘুমোতে গিয়েছে নিশাত। ঘুমোতে গিয়ে দেখে স্বামী নামক রোবট লোকটা না ঘুমিয়ে একবার এপাশ ফিরছে তো ওপাশ ফিরছে।
নিশাত কিছু সময় মাহমুদের কর্মকান্ড নীরব চোখে পর্যবেক্ষণ করে। সারাদিন এটা ওটা করে শরীরে একদম শক্তি পাচ্ছে না নিশাত।ঘুমে আপনা আপনি চোখ বন্ধ হয়ে আসছে তার। কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ গিয়ে মাহমুদের পাশে শুয়ে পরে নিশাত। এরমধ্যে ও মাহমুদের নড়াচড়া এখনও বন্ধ হয় না। পাশে কেউ শুয়ে থেকে এরকম নড়াচড়া করলে কি ঘুমানো যায় নাকি? নিশাত মাহমুদের পিঠে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে,, “কিগো? কি হয়েছে আপনার শরীর খারাপ? প্রশ্ন করে উত্তরের আশায় না থেকে নিশাত নিজেই মাহমুদের কপালে হাত রেখে দেখে জ্বর আসছে কি না।
কপালে হাত দিয়ে নিশাত বুঝতে পারে মাহমুদের শরীরের তাপমাত্রা একদম স্বাভাবিক। নিশাতের ব্রু আপনা আপনি কোচকে আসে,, বুঝতে পারে না লোকটা কেনো এমন করছে।
মাহমুদ যে নিজে থেকে কোনো দিন বলবে না জিজ্ঞেস না করলে নিশাত খুব ভালো ভাবে জানে।
নিশাত করুন স্বরে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে আপনার? আমাকে বলা যায় না?

মাহমুদ কিছু সময় গাঁইগুঁই করে বলে,,খুব পা ব্যাথা করছে নিশাত। পা ব্যাথার জন্য কিছুতেই ঘুমোতে পারছি না।

মাহমুদের কথা শুনে নিশাত চুপচাপ শোয়া থেকে উঠে মাহমুদের পায়ের কাছে বসে। মাহমুদ এতে হকচকায়। আমতা আমতা করে বলে,, তুমি ঘুমিয়ে পরো তোমার পা টিপতে হবে না। আমি একটু পর এমনিতেই ঘুমিয়ে যাবো।

নিশাত কোনো কথা না বলে চুপচাপ পা টিপতে থাকে। মাহমুদ আরাম পেয়ে ঘুমিয়ে পরে কিছু সময়ের মধ্যেই। নিশাতের শরীর যেনো আর কুলোয় না ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে দুইটা প্রায় বাজতে চলল। ঘুমে আর চোখ খুলে রাখা সম্ভব না। ঘুমের কারণে যে বালিশে গিয়ে শুবে সেটাও পারছে না, মাহমুদের পায়ের কাছেই ঘুমিয়ে পরে সে।

এরমধ্যে দরজাতে জোরে কড়াঘাতের শব্দে ঘুম ভাঙে নিশাতের।এতো তারাতাড়ি সকাল হয়ে গেলো? এই না মাত্র শুইলাম ভাবতে ভাবতে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে মাত্র তিনটা বাজে।

দরজার ওপাশ থেকে অনবরত শ্বাশুড়ি মা ডেকে চলেছে।

বউমা ও বউমা ডাকছি শুনতে পারছো না তুমি?
মরার ঘুম দিছো?
ও বউমা।

নিশাত প্রথমে ভেবেছিলো মনের ভুল, আবার মনে মনে ভাবতে থাকে নিশির ডাক নয়তো? এতো রাতে শ্বাশুড়ি কেনো ডাকবে? নিশাত ভয়ে শুকনো ঢুক গিলে। পাশে তাকিয়ে দেখে মাহমুদ আরামসে ঘুমিয়ে আছে। নিশাত একবার ভাবে মাহমুদকে ডাকবে আবার ভাবে লোকটা ব্যাথায় ছটফট করতে করতে ঘুমিয়েছে এখন ডাকলে যদি সজাগ হলে আরো ব্যাথা বেড়ে যায়। নিশাত শুকনো ঢুক গিলে লেপের ভিতর নিজেকে আরো গুটিয়ে নেয় চুপটি করে মাহমুদের আরো পাশ ঘেঁষে বসে থাকে।

কিন্তু না একের পর এক ডেকেই চলেছে আর দরজায় শব্দ করে চলেছে। মাহমুদ ও বারবার শব্দ শুনে চোখ মুখ কোচকে ফেলছে আর এপাশ ওপাশ করছে। নিশির ডাক হলে এতোবার তো ডাকার কথা না। নিশাত শুনেছে তিনবারের বেশি ডাকে না। আর এখন তো কম করে হলেও দশবার ডেকে ফেলেছে তারমানে তার শ্বাশুড়িই।মনে সাহস সঞ্চার করে নিশাত কাঁপা কাঁপা পায়ে উঠে দাঁড়ায়। একেইতো প্রচন্ড শীত তারপর আবার ভয় দুটো মিলিয়ে নিশাতের শরীর অনবরত কেঁপে চলেছে। বালিশের পাশ থেকে চাদরটা গায়ে মুড়িয়ে আস্তে আস্তে দরজার কাছে এগিয়ে যায় নিশাত। কাঁপা কাঁপা হাতে দরজার ছিটকিনি তুলে দরজা খুলে।
দরজা খুলতেই দেখতে পায় শ্বাশুড়ি মা রণমুর্তি ধারন করে দাঁড়িয়ে আছে। পারলে হয়তো উনি এক্ষনি কাঁচা চিবিয়ে খেতো।

“আ-আআম্মা কিছু হয়েছে? ”

“এহনও কিছু হয় নাই তবে যদি আর কয়েকটা ডাক দেওয়া লাগতো তবে অনেক কিছু হইতো।
ইশশশ নবাবের বেটির ঘুম দেখো বাড়িঘর সব তুফানে উইড়া গেলে আর ডাকাত নিয়া গেলেও উনার ঘুম ভাঙবো না।”

আম্মা আমি আরো আগেই উঠছিলাম।

হইছে হইছে কতো আগে উঠছো বুঝতে পারছি।মাইয়া মানুষের এতো ভারি ঘুম হইবো কেন? মাইয়া মানুষের ঘুম হইতে হয় পাতলা। ঘুমের মধ্যে চোখের সামনে দিয়া একটা মশা উইড়া গেলে ও বুঝতে হইবো।

নিশাতের খুব বলতে ইচ্ছে হলো আপনার ঘুম বুঝি খুব পাতলা আম্মা। সকালে খাবার খাওয়ার জন্যতো কম করে হলেও দশটা ডাক দেওয়া লাগে। কথায় কথা বাড়ে আর সবচেয়ে বড় কথা নিশাত এই কথাটুকু বললে এখন তান্ডব শুরু হবে।

“ভাবনা করতে করতে বিজ্ঞানী হইবা নাকি? আহো আমার সাথে। ”

“এই শীতের মধ্যে কোথায় যাবো আম্মা? ”

“তোমারে আমার ছেলের গলায় ঝুলাইয়া যেই পাপ করছি হেই পাপ মোছন করতে। ”

নিশাত কথা বাড়ায় না চুপচাপ শ্বাশুড়ির পিছু পিছু যেতে থাকে আর কথা বাড়ায় না। এসব শুনতে শুনতে শরীরে সয়ে গেছে আর গায়ে লাগে না এখন আর।

নিশাতদের বাড়ির পিছন দিকে বড় একটা ঘাট বাঁধানো পুকুর আছে শ্বাশুড়ি তাকে সেখানেই নিয়ে যাচ্ছে। নিশাত বেশ অবাক হয় শ্বাশুড়ি এই দিকটায় যেখানে দিনের বেলা ও আসতে দেয় না সেখানে কিনা এই গভীর রাতে তাকে নিয়ে আসছে?

নিশাত চারপাশটা অন্ধকারে একবার চোখ বোলায় কুয়াশায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। প্রথম প্রথম যখন বিয়ে হয়ে আসছিল এই বাড়িতে নিশাত অবসর সময়টা এখানেই কাটাতো তারপর আস্তে আস্তে সময়ের পরিক্রমায় সব বদলে গেলো কতোদিন এদিকটায় আর আসা হয় না।

শ্বাশুড়ি ঘাটের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে নিশাতকে নির্দেশ দিলো একদম সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার।
নিশাত দাঁড়িয়ে থাকে কথা মতো। শ্বাশুড়ি কি কি করে নিশাতের কোমরে একটা তাবিজ বাঁধতে থাকে।

তাবিজ দেখে নিশাত বলে,,আম্মা তাবিজ কেনো? আমিনা বলেছি তাবিজ দেওয়া,,,,,

” চুপ করো তুমি। আমারে আমার কাজ করবার দাও।”
তিনি তার কাজ শেষ করে নিশাতকে বলে,,,এখন গিয়ে চোখ বন্ধ করে পুকুরের পানিতে এক নিশ্বাসে তিনটা ডুব দিয়া আহো।

আম্মা কি বলছেন? এই শীতে এই ঠান্ডা পানিতে ডুব দিলে আমিকি বাচঁমু?

কিছুই হইবো না যাও যাও বলে তিনি নিজেই নিশাতকে ধাক্কা দিয়ে হাঁটু পানিতে নামিয়ে দেয়।
নিশাতের খুব ইচ্ছে হলো এই পানিতে ডুবেই নিজেকে শেষ করে দিতে। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে শ্বাশুড়ির কথা মতো পানিতে ডুব দেয় আর ভাবে শ্বাশুড়ি ঠিকই বলে আসলেই তার কই মাছের জান।
নিশাত এক নিশ্বাসে ডুব দিয়ে উঠে। তবে ডুব দিয়ে একটা কাজ করে সে কোমরে কালো সুতো দিয়ে বাঁধা তাবিজটা পানির নিচেই ছিঁড়ে ফেলে উঠে আসে।
এই শীতে কাঁপতে কাঁপতে কোনোমতে উপরে উঠে আসতেই শ্বাশুড়ি নির্দেশ দেয়, বড় বড় হাঁটা দিয়ে ডানে বামে পিছনে না তাকিয়ে সোজা ঘরে চলে যেতে। নিশাত শ্বাশুড়ির কথা মতো তাই করে।

পিছন থেকে শুনতে পায় শ্বাশুড়ির কথা,, আল্লাহগো এইবার আমার পুতের দিকে মুখ তুইলা চাইও। আমার পুতের ঘর আলো কইরা একখান বংশের প্রদীপ দিয়ো।

নিশাতের পুরো শরীর হীম হয়ে গেছে। শরীর যেনো বরফের আস্তরণে ঢেকে আছে। রক্ত মনে হচ্ছে জমে গেছে। নিশাত কাঁদতে কাঁদতে অনেক কষ্টে ভিজা জামা কাপড় বদলে নেয়। তার জানা নেই একটা সন্তানের জন্য তাকে আর কতো কষ্ট লাগে হয়।আল্লাহ কেন তার ডাক শুনছে না সে নিজেও চায় একটা সন্তান। তবে শ্বাশুড়ির এসব কর্মকান্ড দুইবছর ধরে সহ্য করছে মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সব ছেড়ে চলে যেতে। কিন্তু মাহমুদ নামক লোকটার মুখের দিকে তাকালে সব কষ্ট বেদনা অভিযোগ সব যেনো কোথায় হাওয়া হয়ে উড়ে যায়।

নিশাত কাঁপতে কাঁপতে কোনোমতে লেপের ভিতর ঢুকে। লেপের ভিতর ঢুকার পর যেনো কাঁপুনি আরো বেড়ে গেছে তার। কাঁপতে কাঁপতে হাত পা মুড়িয়ে চুপটি করে শুয়ে থাকে খুব সাবধানে মাহমুদের গায়ে যেনো ঠান্ডা হাত পা না লেগে যায়।

তবে নিশাত লক্ষ করলো মাহমুদ একটু একটু করে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। নিশাত পিছাতে পিছাতে অনেকটাই পিছিয়ে যায়। মাহমুদ তবুও এগিয়ে এসে নিশাতের হাতটা নিজের বুকে নিয়ে নেয় তারপর ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বলে,,, এতো ঠান্ডা কেনো তোমার হাত নিশু?

তারপর নিশাতের কোমরে হাত রেখে নিশাতকে নিজের কাছে নিয়ে এসে বলে,, তোমার পুরো শরীরইতো ঠান্ডা। আসো গরম করে দেই।
নিশাতকে আর কিছু বলার সুযোগ দেয় না। নিশাতও আর কিছু বলে না কারণ তার যে এই মুহূর্তে খুব উষ্ণতা প্রয়োজন।মাহমুদের ভালোবাসার উষ্ণতা না পেলে এই ঠান্ডা কিছুতেই কমবে না তার।
কাল সকালে কি হবে তার জানা নেই তবে এখন মুহূর্তটার সুখ নিশাত কিছুতেই হারাবে না। সারাদিনের কষ্ট এই লোকটার ছোঁয়ায়ই ভুলে সে। শ্বাশুড় ক্ষত হলে মাহমুদ সেই ক্ষত সারানোর মলম।

বুকের ভেতর এক তীব্র অশান্তি নিয়ে কে-টে যায় রাতের পর রাত। মনে হয়, বুকের ভেতর চলতে থাকা আর্তনাদগুলোকে শুনবার জন্য কোথাও কেউ নেই। তবু, খুঁজে নেই তাকে, যাকে সবচেয়ে আপন বলে মনে হয়।

#চলবে,,,,,?