নিগূঢ় আলিঙ্গন পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
829

#নিগূঢ়_আলিঙ্গন
#পর্বঃ২(,অন্তিম পর্ব)
#Jhorna_Islam

প্রতিদিন ভোরে ঘুম ভাঙে আজানের ধ্বনি আর পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ শুনে। পাখিদের মতো নিশাতও যে ভোরের পাখি।ফজরের নামাজ পরে প্রতিদিনের নিয়মে সাংসারিক কাজ কর্ম শুরু করে নিশাত তবে আজকের সকালটা ভিন্ন। টিনের ঘরের কাঠের জানালার ফাঁক ফোকড়া দিয়ে সকালের মিষ্টি রোদ চোখে পড়তেই চোখ মুখ কোচকে ফেলে নিশাত। বহুদিন পরে এরকম অনুভূতি। নিশাত ঘুমের ঘোরেই বিয়ের আগে বাবার বাড়ির জীবনে যেনো ফিরে যায়। সেই নয়টা দশটায় রোদের আলো চোখে মুখে পরলে ঘুম থেকে উঠা। ভোর রাত থেকে মা কতো ডাকতো উঠার জন্য কিন্তু কে শুনতো? আর যেদিন স্কুল থাকতো সেদিন মা সেই না পারে চারটা থেকেই ডাকা শুরু করে। আটটা বাজলেই বলতো এগারোটা বেজে গেছে ঘুমা তুই। ঘুমিয়ে থাক পড়াশোনা আর করা লাগবে না তোর। আহা কি সুমধুর শৈশব।

নিশাত আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে উঠে বসে। চোখ ডলতে ডলতে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে পুরো রুম আলো আধারির খেলা খেলছে। পাশে তাকিয়ে দেখে মাহমুদ নেই। মাহমুদ কে না দেখে বেশ চমকায় নিশাত। আজ মাহমুদ তার আগে উঠে গেছে ভেবে বেশ অবাক হয়ে যায়। মাহমুদ কোনোদিন নিশাতের আগে ঘুম থেকে উঠতে পারে না। নিশাত ভোর রাতে রান্না শেষ করে মাহমুদকে ডাকে তারপর সে ঘুম থেকে উঠে।
নিশাত ভাবলো হয়তো মাহমুদ বাথরুমে গেছে। নিশাত উঠে আধখোলা দরজা পুরো খুলে বাইরের দিকে তাকিয়ে হা হয়ে যায়। বেলা হয়ে গেছে অনেক। নিশাত বেশ অবাক হয় এটা ভেবে যে শ্বাশুড়ি এখনও তাকে ডাক দিলো না আর না চেঁচামেচি করলো।

হয়তো এখনও সজাগ পায়নি এটা ভেবে নিশাত স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে তারাতাড়ি গোসলে ঢুকে। গোসল করে রান্না চড়িয়ে দেয়।

এরমধ্যে মাহমুদ বাড়ির বাইরে থেকে চিল্লিয়ে নিশাতকে ডাকতে থাকে।

“নিশাত এই নিশাত? নিশাত কই তুমি? ”

নিশাত তখন তরকারি নাড়াচাড়া করছিল, মাহমুদের এরকম ডাকাতে নিশাত ভয় পেয়ে যায় ভাবে কি না কি হয়েছে। নিশাত রান্না ঘর থেকে হাতে খু’নতি নিয়েই হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে আসে।

“এই নাও ধরো বলেই বাজারের ব্যাগটা নিশাত কিছু বুঝে উঠার আগেই তার হাতে দিয়ে দেয়।”

এরমধ্যে এমন চিল্লাচিল্লিতে ঘুম ভেঙে যায় মাহমুদের মায়ের।
তারাতাড়ি এসে জিজ্ঞেস করে,,, “কিরে মাহমুদ কি হয়েছে? বাড়িতে কি ডাকাত পরছে নাকি? ”

“কি কও মা ডাকাত পরতে যাবে কেনো?”

“তাহলে এমন চিল্লাক করলি কেনো?”

“বাজার করে নিয়ে এসেছি। ”

“ওহ আচ্ছা। আজকে তোর অফিস নাই? ”

“কিসের অফিস মা আজ কি বার ভুলে গেছো?”

নিশাত ও বেশ অবাক হয়েছিল মাহমুদকে আজকে বাড়িতে দেখে। খুব ভোরে উঠে চলে যেতে হয় মাহমুদকে কাজে আজ যে শুক্রবার সেটা মাথাতেই ছিলো না।

“তা বাজার থেইক্কা কি আনলি বাপ?”

বাজারে আজ অনেক বড় বড় মাছ উঠেছে। আমি সবচেয়ে বড় মাছটা এনেছি মা। হাসি হাসি মুখে বলে মাহমুদ।

বড় মাছ বউরে খাওয়াইয়া কি হইবো বাপ? কোনো কাজে লাগেনি এইসব? এহনও একটা সু সংবাদ দিতে পারলো না। আমার বাড়ির একটা প্রদীপ দিতে পারলো না। কোন অসময়ে যে এই মাইয়ারে আমি ঘরে তুলছি কে জানে। যেই বয়সে নাতি নাতনি নিয়ে খেলার কথা সেই বয়সে আমি ঘরের কোণে একলা পরে থাকি। মাঝে মাঝে মনে হয় সব ছেড়ে কোথাও গিয়ে পরে থাকি।

নিশাতের আর এসব একদমই সহ্য হচ্ছে না। সে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ক্লান্ত। প্রতিদিন এসব কথা শুনতে আর ভালো লাগে না। নিশাত নিজের হাতে থাকা বাজারের ব্যাগটা উঠোনে ছুঁড়ে মারে।তারপর কাউকে কিছু না বলে দৌড়ে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়।

মাহমুদ নিশাতের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তারপর মায়ের দিকে এক পলক তাকায়। মাহমুদের মা ও তখন মাহমুদের দিকে তাকিয়ে আছে।
উনি ছেলের চোখের চাহনিতে কিছু একটা দেখেছেন। মাহমুদ হয়তো নীরব চোখের ভাষায় কিছু একটা বলতে চেয়েছে।
তিনি মাহমুদকে বার কয়েক ডাক দেয় কিন্তু মাহমুদ মায়ের ডাকে এই প্রথম শুনেও সারা দেয় না। মাহমুদ চুপচাপ বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।

মাহমুদের মায়ের মনটা কেমন কু ডাকছে।

সকাল গড়িয়ে দুপুর হয় আর দুপুর গড়িয়ে রাত কিন্তু মাহমুদের কোনো খুঁজ নেই। এদিকে নিশাত সেই যে ঘরের দরজা লাগিয়েছে এখনও খুলেনি।প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিল নিশাত দরজা খুলছেনা দেখে কিন্তু পরে জানালা দিয়ে দেখতে পায় ঠিকই আছে।

রাত দশটায় মাহমুদ বাড়িতে এসে আবারও নিশাতকে চিল্লিয়ে ডাকতে থাকে। নিশাত এবার আর বের হয় না।
এরমধ্যে একটা বাচ্চা মা বলে ডেকে উঠে।
নিশাত ভাবে হয়তো মনের ভুল কিন্তু না বাচ্চাটা আরও বার কয়েক ছোট্ট হাত দিয়ে দরজা ধাক্কিয়ে মা বলে ডাকতে থাকে। নিশাত দৌড়ে এসে দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলে দেখতে পায় একটা বাচ্চা ড্যাপ ড্যাপ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

নিশাত কিছু বলার আগে তার শ্বাশুড়িই বলে উঠে,,, “এই বাচ্চাটা কে মাহমুদ?”

আমার ছেলে মা দায় সারা ভাবে বলে মাহমুদ।

মানে?

ও আজ থেকে আমার আর নিশাতের সন্তান। এই বাড়ির ছেলে তোমার কথায় বংশের প্রদীপ।

মাহমুদ?

অনেক হয়েছে মা আর সহ্য করতে পারছি না। এবার অন্তত শান্তিতে থাকতে দাও।এই বাচ্চাটার পৃথিবীতে কেউ নাই আর আমাদের ও সন্তান নেই।
আজ থেকে ও আমার সন্তান। তুমি যদি আর কিছু বলো তাহলে আমি নিশাত আর ওকে নিয়ে এই বাড়ি থেকে এই মুহূর্তে বের হয়ে যাবো।
মাহমুদের মা আর একটা টু শব্দ ও করে না চুপচাপ চলে যায়।

নিশাত ছলছল চোখে মাহমুদের দিকে তাকায়। মাহমুদ হাসি মুখে বলে,, আজ থেকে তোমাকে আর কেউ বাচ্চার জন্য কিছু বলবে না। আজ থেকে তুমি ও মা তোমার ও একটা সন্তান আছে। নিশাত কাঁদতে কাঁদতে বাচ্চাটা কোলে নিয়ে মাহমুদকে এসে নিগূঢ় আলিঙ্গন করে। আজ নিজেকে তার সুখী মনে হচ্ছে। আজ থেকে সেও মা।
#সমাপ্ত।