নিভৃত দহনে পর্ব-০১

0
39
নিভৃত দহনে পর্ব-০১
নিভৃত দহনে

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ১)
নুসরাত জাহান লিজা

ডিভোর্স পেপারে সিগনেচার করে বড় করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল তপা। একটা জগদ্দল পাথর পাঁজর থেকে সহসা সরে গিয়ে ওকে নির্ভার করে দিয়ে গেল। মায়ের কোলে তপার আট মাস বয়সী পুত্র সন্তান । তাকে সে কোনোভাবেই ওই লোকের ছত্রছায়ায় থেকে আরেকটা জানোয়ার তৈরি হতে দেবে না৷ নিজের ভেতরের সমস্ত আলো দিয়ে ঘিরে রাখবে যেন সেখানে কবিরের অন্ধকারের বিন্দুমাত্র ছাপও থাকতে না পারে।

কবিরের চোখ-মুখ তাচ্ছিল্যের হাসিতে চিকচিক করছিল, ওর সে-ই ভাষা বুঝতে একটুও বেগ পেতে হলো না তপাকে। যেন তাতে লেখা, “দেখব, কী করো। নিজেকেই এখনো সামলাতে শেখোনি, আবার সাথে আরেকটা। সামলে দেখাও।”

মনে মনে চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্ট করল তপা। জীবনে কখনো কোনোকিছু থেকে পিছিয়ে আসেনি সে, আর এখানে তো ওর সন্তানের জীবনের প্রশ্ন। এখানে কীভাবে পিছিয়ে আসবে! সে-ও নির্ভার একটা হাসি উপহার দিয়েছিল।

জীবনের পথটা কতটা বন্ধুর, সেটা গত কয়েক মাসে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে তপা। ওর মা পর্যন্ত ওকে বারবার বলেছেন, “সিদ্ধান্তটা আরেকটু ভেবেচিন্তে নে। তোর ছেলেটা দুধের শিশু। ওর ভবিষ্যৎ কী হবে?”

তপা দৃঢ় গলায় বলেছিল, “মা, নিজের অস্তিত্ব যেখানে বিলীন হয়ে যায়, সেখানে থেকে সন্তান মানুষ করতে পারব? আমার ছেলে একদিন বড় হবে। সে যদি দেখে তার মা’য়ের শিরদাঁড়া নেই, তখন সে আমাকে সম্মান দিতে পারবে? অন্য নারীকে সম্মান দিতে পারবে?”

মা তবুও তপাকে বলার চেষ্টা করেছেন সে ভুল করছে। কিন্তু তপা জানত সে বহুদিন পরে একটা ঠিকঠাক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে।

সবচাইতে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছিল ওর নিজের পরিবার থেকেই৷ বড় ভাই তুহিন আর তার স্ত্রী ইলা ধরেই নিয়েছে তপা এখন তাদের ঘাড়ে এসে পড়বে সন্তানসহ। সরাসরি না বললেও ইনিয়েবিনিয়ে বলেছে, “কবির তো তোকে ভালোই রেখেছে৷ বিলাসবহুল জীবনও। শুধু শুধু কোন ভরসায় সংসার ভাঙছিস? তাছাড়া কবিরও তো ডিভোর্স চাইছিল না।”

তপা সব ঘটনা বাড়িতে খুলে বলেছে, তবুও যদি তার নিজের ভাই এসব বলে তখন আর এক্সপ্লেনেশন দিতে ইচ্ছে করে না। সে দেবার চেষ্টাও অবশ্য করল না। স্পষ্ট গলায় নিজের অধিকার চাইল,

“বাবার সন্তান হিসেবে আমারও অংশ আছে এই বাড়িতে, তার সম্পত্তিতে। আমার অংশ আমাকে দিয়ে দাও।”

তুহিন হতভম্ব গলায় বলেছিল, “তুই প্রচণ্ড স্বার্থপর একটা মেয়ে।”

“স্বার্থপর শব্দটা আপেক্ষিক ভাইয়া। সেটা আমিও তোমাকে বলতে পারি। স্বার্থে যখন যার জন্য টান লাগবে, সেটা যদি ন্যায্যও হয়, তবুও বিপরীত পক্ষের কাছে সে স্বার্থপরের তকমাই পায়। এটা পৃথিবীর অনাদিকাল থেকেই চলে এসেছে। আমাকে আমার পাওনা বুঝিয়ে দাও, আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে তোমাকে আর চিন্তা করতে হবে না।”

তুহিন গাইগুই করে কিছুদিন পরে তিন লাখ টাকার একটা চেক ধরিয়ে দিয়েছে তপার হাতে৷ যদিও পাওনা এর তিনগুণ হবার কথা। তবে সে আর কিছু বলল না।

কৈশোর থেকেই তপা খানিকটা একরোখা, নিজের মর্জির বাইরে চলতে অনভ্যস্ত ছিল। চোখের সামনে নয়-ছয় দেখলে মুখ বন্ধ রাখতে পারত না। সে-ই তপাও তো আপোষ করতে শিখে গিয়েছিল! কবিরের সাথে এরেঞ্জ ম্যারেজ ছিল। ছবি দেখেই ভালো লেগে গিয়েছিল, কথা বলেও মুখোশের পেছনটা দেখতে পায়নি। মত দিয়ে দিয়েছিল বিয়েতে। বিয়ের পরে প্রথম কয়েকমাস ভালোই ছিল, তবে কখনো কখনো মনে হতো ভীষণ দাম্ভিক, অনেক পজেসিভ। তবুও খারাপ তো লাগেনি। বরং ভালোবেসেছিল। তপার বাবা মারা যান ওদের বিয়ের দেড় বছরের মাথায়। তখন সমস্ত খরচও লোকটা দিয়েছিল। এখন তপা বুঝতে পারে লোকটা টাকার জোরে সব কিনে ফেলতে ভালোবাসে। আর তারপর তো…

তপা ভীষণ চেষ্টা করেছিল দাঁত-মুখ চেপে মানিয়ে নিতে। স্কুল থেকেই সে ডিবেট করত, ভীষণ ভালো আবৃত্তি করত। ছটফটে স্বভাবের মেয়ে ছিল। সবকিছু কবেই জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। প্রায় চার বছর সে কেবলই কারোর ঘরণী হতে শেষ করে ফেলেছে। তাতে আরও পেয়ে বসেছিল কবির।

কিন্তু মানুষের ধৈর্যের সীমা আছে৷ ওর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। মনে হলো অনেক হয়েছে নিজেকে নিজে অসম্মান করা, আর নয়! এক কাপড়ে বেড়িয়ে এসেছিল চার মাস আগে।

থাক, আজ আর ওসব ভাববে না। পাশেই দর্পণ কেঁদে উঠল। ঘুম ভেঙে গেছে ওর রাজপুত্রের। পরম মমতায় কোলে আগলে নিল। ছোট্ট একটা হাত ওর গাল স্পর্শ করল। নতুন করে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলো তপা। যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বেরিয়ে আসবে তখন থেকেই নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিল।

ডিভোর্সের দুই মাসের মাথায় একটা এনজিও থেকে ডাক এলো। ভালো পোস্ট। কিন্তু যেতে হবে ঢাকার বাইরে। এত ছোট বাচ্চা নিয়ে সেখানে থাকাটাও খুব কঠিন। মা আনোয়ারার কাছে দর্পণকে রেখে জায়গাটা একদিন গিয়ে দেখে এসেছে। অফিসের হবু কলিগদের সাথে আলাপ করেছে। সোমা নামের একজন আছে, স্থানীয়। তার বাড়ির একটা ঘর খালি আছে। ভাড়ায় উঠা যাবে৷ তার বাড়িতে গিয়ে ঘরও দেখে এসেছে। সোমার মা সায়েদা আন্টি বেশ মিশুক। তিনি বলেছেন তিনি তার বিশ্বস্ত কাউকে জোগাড় করে দেবেন দর্পণকে কাজের সময়ে দেখভাল করার জন্য।

আগামী পরশু জয়েনিং। তাই আজই রওনা দিয়েছে তপা। মা এসে ওর মাথায় হাত রেখে বললেন, “সাবধানে থাকিস। জানি আমার উপরে রেগে আছিস। কিন্তু জীবনটা খুব কঠিন রে। তোর ভালো চাই বলেই ভয় পাই তোকে নিয়ে।”

“তুমি আমার সাথে যেতে রাজি হলে না।”

“ইলাটার এই অবস্থা, প্রেগন্যান্ট একটা মানুষকে রেখে কীভাবে যাই? এটাও তো আমার দায়িত্ব।”

তপা ওর পাওয়া তিন লাখ টাকার মধ্যে এক লাখ টাকা আনোয়ারার একাউন্টে দিয়েছে, যদিও তিনি আপত্তি করছিলেন৷ তুহিন আর যাই হোক মা’কে অসম্মান করে না কখনো। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব না চাইতেই এনে দেয়। তবে তপার সাথে ওর সম্পর্কটা ঠিক অন্যরকম। সে মায়ের হাতে দশ হাজার টাকা দিয়ে বেরিয়ে এলো। তিনি চোখ মুছলেন।

তুহিন ওকে ট্রেনে তুলে দিতে এসেছিল৷ ভাগ্নেকে কোলে করে তুলে দিয়ে ট্রেন ছাড়ার আগে আগে বলল, “ভালো থাকিস তোরা।”

“তুমিও ভালো থেকো।”

ট্রেনের হুইসেল কানে এলো, একটু একটু করে তপা পেরিয়ে যাচ্ছে নিজের চেনা গণ্ডিটাকে। পথে নেমে নতুন করে মাটি খুঁড়ে এবড়োথেবড়ো অবস্থা থেকে একটা নতুন পথ ওকে করে নিতে হচ্ছে৷ অনিশ্চয়তা ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মনে আশঙ্কার দোলাচল, তবুও ভুলেও সে রিগ্রেট করল না।

ট্রেনের জানালার বাইরে গ্রামের পরে গ্রাম পেরিয়ে যাচ্ছে, ধানী জমি, সবুজ অরণ্যানী, মাঠ-ঘাট, প্রান্তর পেরোচ্ছে। সে এগিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে নতুন জীবনের পথে। পেছনের সমস্ত অন্ধকার সে এই পেরিয়ে আসা প্রকৃতির সাথেই ছুঁড়ে ফেলে যাচ্ছে। পেছনে আর ফিরে তাকাবে না।

***
রাফিদ ব্যাগ গুছাচ্ছে, মাস খানেকের জন্য সে সিলেটে যাচ্ছে। মাঝেমাঝেই ওর ডুব দিতে ইচ্ছে করে। এই ইট-পাথরের খাঁচায় প্রায়ই সে হাঁপিয়ে ওঠে। তখন প্রকৃতি ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকে৷ খেয়ালখুশি মতো ঘুরে বেড়ায়, প্রাণভরে ছবি তোলে, এরপর যখন নিজেকে খুঁজে পাওয়া হয়ে যায়, একরাশ সতেজতা যখন ওকে জীবনীশক্তি দেয়, তখন সে আবার ফিরে আসে চেনা মানুষের ভীড়ে।

বাবার সাথে এটা নিয়ে খাবার টেবিলে একচোট খণ্ডপ্রলয় হয়ে গেছে। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। মুঠোফোন বাজতেই সে দেখল সৌমি কল দিয়েছে৷ ওর গার্লফ্রেন্ড।

“তুমি আমার কথা শুনলে না রাফিদ? এখন কেন যাচ্ছ?”

“সৌমি, তুমি জানো, আমি এরকমই।”

“এটা কোনো এক্সপ্লেনেশন নয় রাফিদ। এটা জীবন নয়। এখন লোকে একটা জবের জন্য হাপিত্যেশ করে, আর তুমি দুই বছরে তিনটা চাকরি ছাড়লে, দুটোয় তোমাকে বের করে দিয়েছে।”

“এসব চাকরি আমার জন্য নয়। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারি না। আমি চাকরি করতেও চাই না।”

“কী করবে তাহলে? তোমার এই খামখেয়ালিপনার জন্য আমাদের বিয়েটা আটকে আছে।”

“তোমার কাছে যা খামখেয়ালি, আমার কাছে তা লাইফ এনার্জি, ফুয়েল। তুমি সব জেনে আমাকে ভালোবেসেছিলে। তাহলে এখন?”

“এখনো ভালোবাসি। কিন্তু এসব প্রশ্রয় দেয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে। তুমি জানো আমি কতগুলো বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছি? এখনো প্রস্তাব আসছে।”

“তুমি কি তার জন্য রিগ্রেট করছ?”

“হ্যাঁ করছি।”

“তাহলে বিয়ে করে ফেলতে পারো। এটাই তো বলতে চাইছো, তাই না? সরাসরি বলছ না কেন?”

“রাফিদ আমি..”

“আমি বুঝতে পেরেছি সৌমি। তুমি ভালো থেকো।”

সৌমির সাথে ওর সম্পর্ক থার্ড ইয়ার থেকে। আজ তার ইতি ঘটল। অবশ্য অনেকদিন ধরেই সুতো নড়বড় করছিল, আজ পুরোপুরি তা কেটে গেল। ভালো হলো নাকি মন্দ তা সময়ের হাতেই তোলা থাকুক।

মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলে তিনি হাসিমুখে বললেন, “কী রে? মুখ ওমন করে রেখেছিস কেন? এখন কি প্রকৃতিও তোকে আর টানছে না? নাকি সৌমির সাথে ঝগড়া করেছিস?”

“ব্রেকআপ৷ ও আর কতদিন ঝুলে থাকবে! বিয়ে করে ফেলুক। আমি কি ভুল করলাম মা?”

মা রাফিদের মাথায় হাত রাখলেন, তার ছেলেটা বড্ড ছেলেমানুষ। বেপরোয়াও খানিকটা, অস্থির স্বভাব। তবে ভীষণ উচ্ছল।

“যখন সুস্থির হবি, তখন একান্তে ভেবে দেখবি। ঠান্ডা মস্তিষ্ক মানুষকে সঠিক পথ দেখায় বাবা। তোর ট্রেনের সময় তো হয়ে এলো।”

যেটুকু অস্থিরতা মনে জমছিল, মায়ের সাথে কথা বলে তা কেটে গেল। নিশ্চিন্তে বেরিয়ে এলো স্টেশনের উদ্দেশ্যে। যা হবে পরে ভাবা যাবে।

***
নামার সময় ভারি ঝামেলায় পড়ল তপা। ছেলেকে কোলে নিয়ে এতবড় ব্যাগ নামানো এই ভীড়ের মধ্যে, ভীষণ ঝক্কির ব্যাপার।

হঠাৎ একটা ভরাট গলা কানে এলো, “এক্সকিউজ মি। আমি হেল্প করছি। আমি নেমে যান, আমি জানালা দিয়ে আপনার ব্যাগ নামিয়ে দিচ্ছি।”

ভিড়ের মধ্যে সময় নেই, তবুও সে একবার কণ্ঠস্বর লক্ষ করে তাকাল, সোম্য চেহারার একটা ছেলে, ট্রেনে উঠার কিছুক্ষণ পরে ওকে দেখেছে৷ দর্পণ কাঁদলে ওকে কোলে নিয়ে হেঁটেছে, তখন চোখে পড়েছে।

সে দ্রুত পা চালিয়ে নেমে গেল৷ জানালা থেকে ব্যাগ নেবার সময় খেয়াল করল ছেলেটার চোখ দুটো ভীষণ বুদ্ধিদীপ্ত।

ট্রেন ছাড়বে ছাড়বে করছে। ছেলেটা কোনদিকে নামল আর খেয়াল করতে পারল না তপা। একটা ধন্যবাদ পাওনা ছিল, সেটা বাকি রয়ে গেল।

কিছু কিছু মানুষের চেহারা এমন হয় যে একবার দেখলে অনেকদিন পরে আবার দেখলেও মনে হয় কোথায় যেন দেখেছি! এই ছেলেটার চেহারাটাও তেমন। পরে কোনোদিন দেখা হলে নাহয় ধন্যবাদের ঋণ শোধ করা যাবে।
……..
(ক্রমশ)