নিভৃত দহনে পর্ব-০২

0
45
নিভৃত দহনে পর্ব-০১
নিভৃত দহনে

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ২)
নুসরাত জাহান লিজা

তপার রিকশা সোমাদের বাড়ির সামনে এসে থামল। দর্পণ রিকশায় উঠে কৌতূহলী চোখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখছিল, অবোধ্য বুলিতে কথা বলছিল। এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। দশ মাস বয়সী শিশু, তার উপর এত লম্বা জার্নির ধকল! সায়েদা আন্টি সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। নিজের নতুন আবাসে ঢুকে মনটা স্বস্তিতে ভরে উঠল। বিছানা পেতে রাখা, একটা টেবিল, একটা চেয়ার, দেয়ালের সাথে কাঠের ফ্রেমের মাঝারি সাইজের একটা আয়না, একটা পুরোনো কাঠের ওয়ার্ডরোব। সায়েদা আন্টিকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন,

“এসব নিয়ে ভেবো না। এগুলো পড়েই আছে। তাছাড়া তুমি এতদূর থেকে এসে একলা সামলে উঠতে পারবে না। তাই আমি আর সোমা যতটুকু সম্ভব গোছগাছ করে রেখেছি।”

একরাশ অস্বস্তি নিয়ে তপা বলল, “আন্টি, আমি আসলে কী করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব…”

“একদম এসব বলবে না। আমি তোমার মায়ের মতোই। কোনো প্রয়োজন হলে আমাকে বা সোমাকে কিন্তু অবশ্যই জানাবে।”

ভদ্রমহিলার হাসি আর কথাবার্তায় একটা মার্জিত ভঙ্গি আছে। শ্রদ্ধা আসে মন থেকে। তপা নিজের কিছু জামাকাপড় আর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া কিছুই নিয়ে আসেনি। দর্পণের জিনিসপত্রেই ব্যাগ ভারি হয়ে গেছে। ভেবেছিল এখানে এসে তোশক, বালিশ, হাড়ি পাতিল সব কিনে নেবে। কিন্তু আসলেও আসার পরে পরেই কেনাকাটা করতে চলে যাওয়াটা ওর জন্য ভীষণ কঠিন হয়ে যেত।

“আজ আমাদের সাথে খাবে। কাল যদি কিছু কেনাকাটা করার থাকে, দিনে তোমার ছেলেকে আমার কাছে দিয়ে এরপর যেতে পারবে। মার্কেট একটু দূরে। তপারও অফিস আছে। আমি ব্যবস্থা করে দেব।”

মলিনা নামের একজন মেয়ে এসেছিল, সে সকাল থেকে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত থাকবে, দর্পণের দেখাশোনা করবে। মেয়েটা ভালো, তবে বাচাল প্রকৃতির। নিঃসন্তান মেয়েটার স্বামী ওকে রেখে নিরুদ্দেশ। নিজের জীবন চালানোর জন্য কাজ করছে। বন্ধ্যাত্বের অপূর্ণতা ঘোচাতেই কি-না দর্পণের প্রতি আন্তরিকতা চোখে পড়ল।

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল তপা, পড়াশোনা না জানা মলিনা, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ থেকে পড়াশোনা করা তপা, কোথায় গিয়ে ভাগ্যটা যেন একইরকম।

তপা ঘুমন্ত দর্পণকে নিয়ে শুয়ে ছিল। ঘুম আসছিল না। নতুন জায়গায় সহসা ঘুম হয় না ওর। মানিয়ে নিতে সময় লাগে। সায়েদা আন্টিকে ওর ভীষণ ভালো লেগে গেছে। ভালো লাগার আরেকটা কারণ হলো, তিনি একবারও তপাকে ওর ডিভোর্স, বাচ্চার বাবা বিষয়ক কোনো প্রশ্ন করেননি। বরং ওর কোনো সমস্যা হচ্ছে কি-না, বাড়ির কোথায় কী আছে, সব বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। এমন মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আর সম্ভ্রম না জেগে পারে!

অফিসে যাবার আগে ব্যাগ থেকে একটা হালকা রঙের তাঁতের শাড়ি বের করল। আজ প্রথম দিন, নিজেকে যতটা সম্ভব পরিপাটি করতে হবে। ব্যাগে দেখল ওর সাজগোজের জিনিসপত্র। এটা কোথা থেকে এলো! নির্ঘাৎ মা তুলে দিয়েছেন। বিতৃষ্ণ হাসল তপা। শাড়ি পরে দেয়ালে সাঁটানো আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। বহুদিন পরে যেন নিজেকে দেখল সে। ওর ফর্সা গায়ের রঙে মালিন্য, কতদিন যত্ন নেয়া হয়নি।

একসময় ভীষণ সাজতে ভালোবাসত তপা। টকটকে গায়ের রঙের সুশ্রী মুখাবয়ব মিলিয়ে ভীষণ সুন্দরী ছিল সে। নইলে কী আর কবির এহসানের মতো লোকের স্ত্রী হতে পারত! ওর কাছে একটা সুন্দরী রমনী ভিন্ন তপার বাকিসব গুণ, একটা নিজস্ব সত্তা সব ফিঁকে ছিল। তাই তো পরিচিত মহলে বেশ দম্ভভরে নিজের স্ত্রীকে পরিচয় করিয়ে দিত! টাকা, সাথে সুন্দরী স্ত্রী, লোকের চোখে নিজেকে ঈর্ষণীয় হতে দেখবার লোভ ছিল লোকটার মধ্যে। তপা বুঝতে বড্ড দেরি ফেলেছিল!

এক ঝটকায় নিজের ভাবনার জগৎ থেকে বের করে আনল নিজেকে। ফেস পাউডার সরিয়ে সাধারণ পাউডার মুখে বুলিয়ে নিল আলতো করে। লিপস্টিক সরিয়ে রেখে লিপজেলের প্রলেপ লাগাল ঠোঁটে। ঘড়িটা হাতে পরে ব্যাগে মোবাইল আর টাকা তুলে নিয়ে দর্পণের খাবার বুঝিয়ে দিল মলিনাকে। পইপই করে বলল,

“দুধ গরম করে ফিডারে তুলে দিয়েছি। সুজি করে রেখেছি। তুমি ভুলে যেওনা কিন্তু। মোবাইলটা সবসময় কাছে রাখবে।”

এতটুকু ছেলেকে একটা অপরিচিত জায়গায় রেখে যেতে মন সায় দিচ্ছিল না একেবারেই, কিন্তু সে নিরুপায়। সায়েদা আন্টি ওর মনের অবস্থা বুঝে বললেন,

“আমি দর্পণকে সাথে নিয়ে যাচ্ছি। মলিনা দুই একদিন আমার সাথে থেকে জিনিসগুলো শিখুক নাহয়।”

বেরুবার আগে হঠাৎ মনে হলো মাকে কল দেয়া হয়নি, সে মায়ের কাছ থেকে দোয়া নিল। কর্মময় এক জীবনের শুরু হতে যাচ্ছে আজ।

***
রাফিদের বেলা করে ঘুম ভাঙে সবসময়। আজ সকাল সকাল পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। এবার সে এসেছে হাওড়ের দিকে। ওর ইউনিভার্সিটির সিনিয়র সবুজ ভাই। তিনি এখানকার ইউএনও। তার কোয়ার্টারে উঠেছে এসে। ওর বড় ভাইয়ের মতো, বয়স ছাপিয়ে বন্ধুত্ব হয়েছিল দুজনের।

রাফিদ উঠে হাতমুখ ধুয়ে রেডি হয়ে ক্যামেরা ঝুলিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। সবুজ ভাইকে বলতে হবে ভোরের দিকে ডাকতে। এদিকে ভোরের সৌন্দর্যটা কেমন হয় সে উপভোগ করতে চায়। এলার্ম দিয়ে উঠতে পারে না। বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ে আবার।

মা সবসময় জোর করে ডেকে তুলতেন ওকে ক্লাসে পাঠানোর জন্য। কখনো দেরিতে উঠলে সে উল্টো মা’কেই বলত, “আরও আগে ডাকলে না কেন মা?”

মা কপট রাগ করে ধমক দিতেন।

রাস্তায় এখনো যান চলাচল সেভাবে শুরু হয়নি, নাকি এই রাস্তাটা এমনই প্রায় নির্জন রাফিদ জানে না। তবে রাস্তার পাশের বেনামী একটা ফুল ওর নজর কাড়ল। কী ভীষণ সুন্দর! ফুলের উপরে একটা রঙিন প্রজাপতি এসে বসল, প্রজাপতির পাখায় অনেকগুলো রঙ, ফটোগ্রাফার হয়েও সব রঙের নাম সে জানে না। সৌমির সাথে এটা নিয়ে ঝগড়াও হয়েছে কত্তবার!

এখন ওকে নেশা পেয়ে বসল, ঠিকঠাক ফ্রেমিংয়ের সুতীব্র নেশা। সৌমি এক ঝলক উঁকি দিয়েই হারিয়ে গেল মন থেকে।

ক্যামেরা রেডি করে ক্লিক করেছে কী করেনি ওমনি প্রজাপতিটা ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল।

“উফ্!” একরাশ বিরক্তি এসে ঘিরে ধরল ওকে।

কোনোকিছুর আকাঙ্ক্ষা যখন তীব্র হয়ে উঠে তখন না পেলে যেমন লাগে তেমন লাগছে। অনেকটা ছেলেবেলায় প্রিয় খেলনা হাতছাড়া হয়ে গেলে যেমন লাগত, তেমন অনুভূতি হচ্ছে। ওকে কেন ধরা দিল না প্রজাপতিটা!

এরপর দেখল প্রজাপতিটা খানিকটা দূরের উঁচু একটা ডালের উপরে আসন গেঁড়েছে। তবে এত সুন্দর একটা জিনিস দেখার তৃপ্তি নিয়ে ছবি তুলতে না পারার অতৃপ্তি ঘুচিয়ে নিল এখনকার মতো।

মুচকি হেসে অস্ফুটস্বরে বলল, “দুষ্টু প্রজাপতি!”

***
তপা এখন বসে আছে এই ব্রাঞ্চের এরিয়া ম্যানেজার মনিরুল আলমের কক্ষে। জয়েনিং লেটারের সাথে ঢাকার বাংলাদেশের মেইন ব্রাঞ্চ থেকে ইস্যু করা কাগজপত্র জমা দিয়েছে। তিনি সেসব দেখতে দেখতে বললেন, “আপনি বললেন আপনার সন্তানকে নিয়ে থাকেন। কাগজের স্পাউসের নাম নেই। আপনারা…”

“ডিভোর্সড।” এই ধরনের প্রশ্ন তপার শুনতে তেতো লাগে। তবুও শুনতে হয়। ভাইভা বোর্ডেও এটা নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। অবশ্য তাদের দোষ দেয়া যায় না, তাদের দরকার কাজ। কাজটা ঠিকঠাক না করতে পারলে স্যালারি দিয়ে রাখবে কেন!

“ও, স্যরি।” বলে একবার ওর দিকে তাকালেন, ভদ্রলোকের বয়স পঁয়তাল্লিশের উপরে হবে। এরপর বললেন,

“আমাদের বেনিফিশিয়ারি হলো রুরাল উইমেন। তাই আপনাকে প্রায়ই প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে যেতে হবে। অনেক সময় দিতে হবে, হার্ডওয়ার্ক করতে হবে। পারবেন তো?”

“স্যার, আমি পার্সোনাল লাইফ আর প্রফেশনাল লাইফ দুটোর ব্যালেন্স করতে পারব আশা করি। আমার বাচ্চাটা যেহেতু এখনো খুব ছোট, তাই কখনো সখনো হয়তো আমি পাওনা ছুটি নেব। তবে তার জন্য কাজের হ্যাম্পার যেন না হয় সেটা এনশিওর করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।”

কথাগুলো খুব সাধারণ, তবুও তপার বলার মধ্যে বলিষ্ঠ একটা ভঙ্গি ছিল। মনিরুল আলম কনভিন্স হলেন।

“আপনার স্পার্কটা ভালো লেগেছে। নতুন নতুন সবার মধ্যেই এটা থাকে। পরে হারিয়ে যায়। এই এনথোজিয়াজম আপনার মধ্যে সবসময় থাকবে এই আশা করি। বেস্ট অব লাক।”

“আই হোপ সো। থ্যাংক ইউ স্যার।”
………
ক্রমশ