নিভৃত দহনে পর্ব-০৩

0
234
নিভৃত দহনে পর্ব-০১
নিভৃত দহনে

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ৩)
নুসরাত জাহান লিজা

রাফিদ ইন্সটাগ্রামে আসতেই সৌমির এঙ্গেজমেন্টের ছবি দেখল। আটদিন আগে ব্রেকআপ হয়েছে, এরইমধ্যে এঙ্গেজমেন্ট সেরে নিয়েছে মেয়েটা! রাফিদ ফেসবুকে এসে দেখল একই পোস্ট। সে লাভ রিয়্যাক্ট দিয়ে কমেন্ট করল,

“শুভকামনা।”

এরপর আনফ্রেন্ড করে দিল। যে চলে গেছে তাকে ফেসবুকে রাখার কী দরকার! ওই পোস্টের কারণে রাফিদকে ওর বন্ধুবান্ধবরা কল, টেক্সট করতে শুরু করল। কল ধরল না, তবে মেসেজ পড়ল। বেশিরভাগ মেসেজেই ওর জন্য সিমপ্যাথি ঝরছে। কোনো মানে হয়! সে জেনে-বুঝেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসেছে, এই সিমপ্যাথি ওর চাই না। উত্তর না দিলেও সবাই ভাববে সে ছ্যাঁকা খেয়েছে। তাই উত্তর দিল কয়েকজনকে। এরপর ল্যাপটপ খুলে কিছু ছবি এডিট করতে বসল।

কিছুক্ষণ পরে রাফিদের হোয়াটসঅ্যাপে একটা মেসেজের নোটিফিকেশন এলো। সে সিন করল না। নোটিফিকেশনেই দেখল সৌমির মেসেজটা।

এরপর কল এলো, রাফিদ ধরতেই ওই প্রান্ত থেকে তীব্র ভর্ৎসনা ভেসে এলো, “তুমি আমাকে ব্লেম দিয়ে কেটে পড়েছ। তোমার মতো ইরেসপন্সিবল মানুষের সাথে আমি থাকব না এটা যদি আমার দোষ হয়, তুমি রেসপনসেবলিটি নিতে শেখোনি, সেটা তোমার দোষ নয়?”

“এখানে কার দোষ কার নয় সেটা নিয়ে কেন কথা হচ্ছে? আশ্চর্য!”

“হবে না? তুমি আমার এঙ্গেজমেন্টের ছবিতে কমেন্ট করে আনফ্রেন্ড করে দিয়েছ কেন? আমি যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি, সে তোমার মতো না। দায়িত্ব নিতে জানে। তুমি দেখে কিছু শিখতে পারতে।”

“আমার শিখে লাভ কী? দেখেই বা কী লাভ? তুমি বিয়ে করে খুশি থাকো। সেটা আমি দেখে কী করব!”

“দেখে নিজের ভুল স্বীকার করবে।”

“এমন উদ্ভট কথা আমি জন্মে শুনি নাই। আমি কি তোমার সামনে গিয়ে তোমার হবু বরের সাথে নিজের কম্পারিজন করেছি? করার ইচ্ছাও নাই।”

“ইচ্ছা নাই কারণ তোমার মধ্যে রেসপনসেবলিটি নেবার ক্যাপাবিলিটি নাই।”

“আরে আজব! না থাকলে নাই। আমি হ্যাপি সেটা নিয়ে। তোমার সমস্যা হচ্ছিল চলে গেছ। শেষ। খামাখা প্যাঁচানোর কী আছে তাই বুঝলাম না।”

“তোমার বোঝার দরকারও নাই, ফোন রাখো। আমি তোমাকে ব্লক দিচ্ছি। আনফ্রেন্ড ব্লকে শোধবোধ। আর তোমার সাঙ্গপাঙ্গগুলাকে বলবে, আমি তোমাকে ডিচ করছি এসব যেন না বলে।”

“ব্লক করছ জেনে প্রীত হলাম।”

রাফিদের মাথার উপর দিয়ে গেল সবকিছু। এই অদ্ভুত ট্যান্ট্রমের কী হেতু এটা ওর বোধগম্য হলো না! তবে এটুকু বুঝল, কেউ ওকে রাফিদের পক্ষ নিয়ে কিছু বলেছে সাথে আনফ্রেন্ড করায় ওর মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে।

“ওর জামাই রেসপন্সিবল না ইরেস্পন্সিবল সেটা দেখে আমার কাজ কী! আশ্চর্য!”

সবুজ এসে বসতেই সে বলল, “কী ব্যাপার রাফিদ, মুড অফ না-কি?”

রাফিদ খুলে বলতেই সবুজ হেসে ফেলল সশব্দে।

“সবুজ ভাই, আপনি হাসছেন?”

“হাসব না? এটা খুব স্বাভাবিক না? ব্রেকআপ করলে, এতে ওর রাগ আছে তোমার উপরে। তাই বেচারি তোমাকে নিজের বাগদানের ছবি দেখিয়ে বোঝাতে চাইছিল কী জিনিস হারিয়েছ। আরও দেখাত, হলুদের ছবি, বিয়ের ছবি, বিয়ের পরে হানিমুনের ছবি, রেস্টুরেন্টে গিয়ে টাইম স্পেন্ড করার ছবিও দেখাত। দেখিয়ে এটা বোঝাত তুমি ওর কথা মেনে না নিলেও ওর হাজব্যান্ডের কাছে সে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তুমি ওকে আনফ্রেন্ড করে এই সুবর্ণ সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছ।”

হতভম্ব গলায় রাফিদ প্রশ্ন করল, “আপনি কীভাবে জানলেন?”

“এটা কিছু মেয়েদের সাইকোলজি। তুমি কখনো এভাবে ভাবোনি, তাই জানো না। আমি জানি। তোমার ভাবির সাথে ঝগড়া হলে কত অদ্ভুত কর্মকাণ্ড যে করে!”

“তাহলে তো মনে হয় বেঁচে গেছি বড় ধরনের ফেঁসে যাওয়া থেকে।”

“একটা প্রচলিত কথা শোনোনি, রাফিদ? বিয়ে হচ্ছে দিল্লিকা লাড্ডু, খেলেও পস্তাতে হয় না খেলেও। যে ফাঁসে, সে-ও পস্তায়, যে ফাঁসে না সে-ও পস্তায়।”

কিছুক্ষণ হেসে সবুজ আবারও বলল, “তা এক্স গার্লফ্রেন্ডের এঙ্গেজমেন্ট উপলক্ষে দেবদাস হয়ে যাবে বলে ব্রত নিয়েছ নাকি?”

“কী যে বলেন না আপনি!”

“তাহলে খেতে এসো।”

রাফিদ এবার হেসে ফেলল। সবুজের স্ত্রী জাপানে পিএইচডি করছে। এখানে একাই থাকে আপাতত।

সৌমির কথা ভাবল রাফিদ, যা হয় ভালোর জন্য হয়। সৌমি যে ধরনের হাজব্যান্ড চায়, রাফিদ তা কোনোদিন হতে পারত না। একসময় ঠিকই সম্পর্কে তিক্ততা আসত, এখনি এসেছিল। তারচাইতে, মুভ অন করে নিজের সংসারে ভালো থাকুক, রাফিদ ভালো থাকুক তার আপন বলয়ে, নিজস্ব জগতে।

***
তপা গত দশ দিনে ঘরে-অফিসে অনেকটা থিতু হয়ে গেছে নতুন জায়গায়। দর্পণ প্রথম কিছুদিন বের হবার সময় কান্নাকাটি করত। এখন বোধহয় অবোধ্য শিশুটাও বুঝতে পেরেছে, মা’য়ের লড়াইটাকে। গত দুইদিনে বের হবার সময় হাত বেড়ে টা টা দিয়েছে হাসিমুখে। হাসিটা এত মায়াকাড়া, তপার যেতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় সারাক্ষণ ওই ছোট্ট মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে।

মলিনা কথার মতো কাজেও বেশ করিৎকর্মা। অল্পদিনেই দর্পণকে বুঝতে শিখে গেছে৷ ঘরের কাজও অনেকটা সামলে নেয়। নইলে যে কী ঝামেলায় পড়ত।

তপার অফিস কক্ষে চারটা ডেস্ক৷ একটায় বসে রমা’দি। চুপচাপ মানুষ। আরেকটায় মুনীরা নামের একজন মেয়ে, বয়স ওর মতোই হবে। হাজব্যান্ড নামিয়ে দিয়ে যায়, আবার নিয়ে যায়। আরেকটায় শোভন বসে। শোভন খুব হালকা চালের রসিকতা করে বেশিরভাগ সময়। তবে মন্দ নয়, নতুন বিয়ে করেছে। আরেকটায় তপা নিজে বসে।

মনিরুল আলমের কক্ষ থেকে তপা’র ডাক এলো। ওর ওয়ার্ড বুঝিয়ে দিয়েছেন দুইদিন আগে। আগামীকাল একবার ফিল্ড ভিজিটে যেতে হবে। মাসিক মিটিং এরেঞ্জ করতে হবে বেনিফিশিয়ারিদের সাথে। ওই ওয়ার্ডের স্থানীয় এজেন্টের নম্বর দিয়ে দিলেন, নিজেও কথা বলিয়ে দিলেন। কীভাবে যাবে, কোথায় নামতে হবে এসব তার সাথে যোগাযোগ করলেই হয়ে যাবে।

বাসায় এসে দেখল, দর্পণের গায়ে হালকা জ্বর। ছেলেটার ঠান্ডার সমস্যা। বেশ ভুগতে হচ্ছে জন্মের দুইমাস পরে থেকেই। ঢাকায় ডাক্তার দেখাচ্ছিল নিয়মিত। এখানে এসে আর সুযোগ হয়নি। সোমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে এই শুক্রবার ফ্রি আছে কি-না। ভালো একজন চাইল্ড স্পেশালিষ্টের খোঁজ নিতে হবে।

দর্পণ ভাঙা ভাঙা স্বরে যখন মা মা মা ডাকে, হৃদয় শীতল হয়ে আসে প্রশান্তিতে। আরও কিছু ডাক শিখেছে, দা-দা, না-না এরকম। আরও কিছু শব্দ উচ্চারণ করে যেসবের আদতে কোনো অর্থ নেই। তবুও শুনতে ভারি ভালো লাগে। যখন তপা ওকে এটা-সেটা বলে, কখনো কখনো ভীষণ মনোযোগ দিয়ে যেন শোনে। তখন মনে হয়, সে একা নেই এই পৃথিবীতে, ওর সাথে বাঁচার অবলম্বনটা আছে!

“তুই কবে আমার সাথে কথা বলবি খোকা! আমার কথা ভালো করে বুঝবি? তোর সাথে যে আমার অনেক কথা বলার আছে বাবা!”

দর্পণকে ঘুম পাড়াবার সময় ফোন সাইলেন্ট মুডে রাখে তপা। যদি ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে।

সাইলেন্ট করতেই যাচ্ছিল, এরমধ্যে তুহিনের ফোন এলো,

“কেমন আছিস?”

“ভালো। তুমি কেমন আছ? ভাবির শরীর কেমন?”

“ভালোই আছে। শোন যে জন্যে কল দিলাম৷ আমার অফিসের ইমিডিয়েট বসের ওয়াইফ মারা গেছে তিন মাস আগে। বয়স পঁয়তাল্লিশ। উনি পাত্রী খুঁজছেন। আমি…”

তপা থামিয়ে দিয়ে বলল, “ভাইয়া, প্লিজ৷ তুমি আমার জন্য অনেক চিন্তা করেছ, আর কোরো না। আমি বিয়ে নিয়ে ভাবছি না। আমার সন্তান আছে, এখন আমার পুরো জগতটা ওকে ঘিরে।”

“এভাবে একা কয়দিন থাকবি?”

“কেন ভাইয়া? মেয়েদের বাঁচার জন্য সবসময় একজন পুরুষ সাথে থাকতে হয় বুঝি? আমি আমার পথে হেঁটে দেখি কদ্দুর যাওয়া যায়। রাখছি, ভাবির খেয়াল রেখো।”

কথা শেষ করে ফোন রাখল তপা। মনটা আবার বিষিয়ে গেল।

***
আজ সকাল সকাল বাবার কল পেলো রাফিদ। ধরতেই শুনল,

“এখন কোন জঙ্গলে আস্তানা গেঁড়েছো?”

“যেখানেই হোক, তোমার ইট কাঠের খাঁচা থেকে ভালো জায়গায় বাবা।”

“শুনেছ নিশ্চয়ই সৌমির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।”

“হ্যাঁ।”

“তুমি যে একটা অপদার্থ সন্তান এটা কি জানো?”

“না জেনে উপায় আছে, তুমি সারাক্ষণ কানের মধ্যে যেভাবে গুণগুণ করো এটা!”

“একদম বেয়াদবি করবে না। আমি আমার ইনফ্লুয়েন্স খাটিয়ে তোমার জন্য আরেকটা চাকরির ব্যবস্থা করেছি। তিনদিনের মধ্যে তুমি ঢাকায় ব্যাক করবে।”

“রাজা হুকুম করলেন প্রজাকে।” মনে মনে কথাটা আওড়াল রাফিদ, মুখে বলল, “তোমার ইনফ্লুয়েন্স খাটিয়ে যেহেতু যোগাড় করে দিয়েছ, জয়েনিং টাইমটাও পিছিয়ে নাও তোমার সো কলড ইনফ্লুয়েন্স খাটিয়ে। আমি একমাসের আগে ফিরছি না।”

“তিনদিনের মধ্যে না এলে আমার বাসায় তোমার জায়গা হবে না মনে রেখো।”

“মনে থাকবে। রাখছি।”

সকাল সকাল মেজাজটা বিগড়ে গেল রাফিদের। তবে সে বাধ্য সন্তান নয়। মনের উপরে জোর চলে না। ওর এই জায়গাটা ভীষণ ভালো লাগছে। ভালো করে বললে হয়তো ভেবে দেখত, কিন্তু এভাবে কথা বললে তা করতে ওর কোথাও যেন বাঁধে৷

সে মনের প্রশান্তি খুঁজতে বেরিয়ে পড়ল ক্যামেরা নিয়ে।

***
সূর্য লালচে আভা ছড়াতে শুরু করেছে, সার বাঁধা গাছে গাছে কৃষ্ণচূড়া ফুটে আছে। তার নিচে দুটো শিশু হাতে কয়েকটা করে হাওয়াই মিঠাই হাতে ছুটোছুটি করছে, মুহূর্তটা চমৎকার।

রাফিদ সেটাকে ফ্রেমে ধরার চেষ্টা করছিল, হঠাৎ পেছন থেকে শুনতে মেল মেয়েলী অথচ স্পষ্টস্বরে কেউ ডাকছে,

“এক্সকিউজ মি, শুনছেন, হ্যালো, হ্যালো…”

রাফিদ ক্যামেরা থেকে চোখ তুলে ঘুরে তাকাল, চেনা চেনা লাগছে, মনে করার চেষ্টা করছিল কোথায় যেন দেখেছে। সেটা মনে করতে না পারলেও মনে পড়ল ওর ছবি তোলার কথা, সে আবার ঘুরে দেখল বাচ্চা দুটো চলে যাচ্ছে।

ওর সাথে ছবির সাবজেক্টগুলো আড়ি করেছে নাকি!

“উফ্!”

এবার সামনের মেয়েটা যেন ওর বিরক্তি ধরতে পারল, “স্যরি, আপনি ছবি তুলছিলেন, বুঝতে পারিনি।”

অস্ফুটস্বরে স্বগতোক্তি করল রাফিদ, “স্যরি বলে লাভ কী! আমার ছবির দফারফা তো হয়েই গেল!”

“কিছু বললেন? আসলে আপনার একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য ছিল, এভাবে এখানে আপনাকে দেখব ভাবিনি।”

কীসের ধন্যবাদ! কেন ধন্যবাদ! ওর ছবি নষ্ট করার জন্য না-কি!

“আপনি বোধহয় আমাকে চিনতে পারেননি। সেদিন ট্রেন থেকে নামার জন্য আপনি আমাকে হেল্প করেছিলেন।”
………
ক্রমশ

শুরুর আগে বলেছিলাম সপ্তাহে তিনদিন আসবে, এখন আপনাদের উৎসাহ দেখে মনে হচ্ছে একদিন পরপর দেয়া যায় কিনা!

‘জোছনার জল’ পড়ুন বইটই’তে।