#নিভৃত_দহনে (পর্ব ৪)
নুসরাত জাহান লিজা
“ওহ্, হ্যাঁ, এবার চিনতে পেরেছি। আপনার সাথে আপনার বেবি ছিল, তাই না?”
কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে রাফিদ চিনতে পারল তপাকে। তপাও খানিকটা স্বস্তি পেল এতে।
“হ্যাঁ। যাক, চিনতে পেরেছেন দেখে ভালো লাগল। সেদিন আপনি হেল্প না করলে সমস্যায় পড়ে যেতাম। সেজন্য ধন্যবাদ, আর আজ আপনার ছবি তোলায় বাগড়া দেবার জন্য স্যরি।”
“আরে, না না। তেমন কিছু না। এটুকু কষ্ট না করলে রেজাল্ট আসে না। আপনাকে দেখে এখানকার লোকাল বলে মনে হচ্ছে না।”
“সেটা আপনাকেও মনে হচ্ছে না। আমি এসেছি কাজের সূত্রে। আপনি কি ছবি তুলতে?”
“ওইরকমই। তবে আপনার মতো গালভরা কথায় যদি বলতে চাই, তবে বলতে চাই, আমি এসেছি জীবনের সন্ধানে।”
“ছবি তুলতে ভীষণ ভালোবাসেন বুঝি?”
“সে তো অবশ্যই। তবে প্রকৃতিকেও ভীষণ ভালোবাসি। সে ভালোবাসা আমার অন্য ভালোবাসার জায়গায় ধরে রাখার চেষ্টা করি।”
তপা এবার মৃদু হেসে বলল, “আপনি বেশ কথা বলেন তো।”
“ধন্যবাদ। আপনার ছেলেটা কিন্তু ভীষণ কিউট।”
এবার তপার মুখাবয়বে খানিকটা গর্বিত ভঙ্গি ফুটে উঠল। রাফিদের মনে হলো জগতের সব মায়েরাই কী এমন! ওর নিজের মা-ও যখন কোথাও ওকে নিয়ে কথা বলেন, একটা অদ্ভুত মাতৃগর্ব তার চোখেমুখে খেলা করে।
“আমার ভীষণ কোলে নিতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু আপনি যদি কিছু মনে করেন, সেজন্য বলিনি। আমার ছোট্ট বাচ্চাদের দেখলে কোলে নিতে ইচ্ছে করে। মনে হয় ওদের পবিত্রতার কিছুটা নিজের গায়ে মাখি।”
তপা পূর্ণ দৃষ্টিতে একবার রাফিদকে দেখল। ছেলেটার মধ্যে খানিকটা ছেলেমানুষি আছে, সরলতা আছে।
সে আবারও স্মিত হেসে বলল, “ওর নাম দর্পণ।”
“দর্পণ, আয়না। ভারি সুন্দর নাম তো!”
“আসলে আয়নায় যেমন আমরা নিজের প্রতিবিম্ব দেখি, দর্পণের মধ্যেও আমি নিজের অস্তিত্বকে দেখি। সেজন্যই নামটা রেখেছিলাম৷ অবশ্য ওর নাম লেখা শিখতে বেশ কষ্ট করতে হবে মনে হয়।”
“আপনিও কিন্তু কথা বেশ ভালো বলেন।”
“ধন্যবাদ। আপনার সময় নষ্ট করার জন্য আবারও দুঃখিত। আসি এবার, পরে শহরে ফেরার জন্য গাড়ি পেতে সমস্যা হবে।”
“বারবার ধন্যবাদ দেবেন না, প্লিজ। ওটা তেমন কিছু নয়। আমার জায়গায় অন্য যে-কোনো মানুষ থাকলেই সেটা করত।”
“মানুষের আড়ালে মানুষ চেনাটাই দায় এখন। যাই হোক, ভালো থাকবেন।”
কথাটায় কী যেন এক অদ্ভুত বিষাদের ছোঁয়া মিশে আছে, যা রাফিদ অচেনা মানুষ হয়েও উপলব্ধি করল। সে দাঁড়িয়েই রইল।
তপা তখনও পা বাড়ায়নি। ওর মুঠোফোন বেজে উঠল। কথা বলতে বলতে একরাশ শঙ্কার মেঘ ছড়িয়ে পড়ল ওর চোখেমুখে।
“আন্টি, আপনি একটু দেখুন। আমি আসছি। রওনা দিচ্ছি এখনই।”
মুখে বলল বটে কিন্তু প্রায় দেড় ঘণ্টা লেগে যাবে পৌঁছাতে। বাস সাথে সাথে না পেলে আরও সময় লাগতে পারে। কিছুক্ষণ আগেও তো মলিনার সাথে কথা বলল, ভিডিও কলে দর্পণকে দেখল৷ তখনও তো জ্বর এত বেশি মনে হয়নি। এখন ভীষণ কান্নাকাটি করছে, মা’কে খুঁজছে। তপার মনে হলে যদি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ছেলের কাছে চলে যেতে পারত।
ওর অবস্থা দেখে রাফিদ বলল, “কোনো সমস্যা?”
তপা ঘোরগ্রস্ত গলায় বলল, “হ্যাঁ, আমার ছেলেটার জ্বর। খুব কান্নাকাটি করছে। আমাকে ছাড়া এতক্ষণ…”
যেতে যেতেই উত্তর দিচ্ছিল, রাফিদ ওর পাশে পাশে হেঁটে আসছে।
“কিন্তু এখন তাড়াহুড়ো করে এই অবস্থায় আপনি কীভাবে যাবেন? একটু মাথাটা ঠান্ডা করে দাঁড়ান প্লিজ। আমি দেখছি।”
“আমার ছেলে অসুস্থ, আমি মাথা ঠাণ্ডা করব?” প্রায় চেঁচিয়েই বলল তপা।
রাফিদ সবুজকে কল দিল, “সবুজ ভাই, আপনার গাড়িটা আজকের জন্য ধার দিতে পারবেন?”
“নিয়ে যাও। আমার আজ লাগবে না। লাগলে অফিসেরটা ব্যবহার করব।”
“আমি চৌরাস্তার এদিকে আছি। আপনি যদি…”
“আমি সামাদকে দিয়ে পাঠাচ্ছি।”
“ধন্যবাদ ভাই।”
এরপর তাকিয়ে দেখল তপা এলোমেলো পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেছে খানিকটা। সে প্রায় ছুটে এলো।
“গাড়ির ব্যবস্থা করেছি। আমি আপনাকে পৌঁছে দেব। চিন্তা করবেন না।”
রাফিদকে যারা খুব কাছ থেকে চেনে তারা জানে রাফিদ এমনই। কখনো কাউকে বিপদে পড়তে দেখলে সে পরিচিত না অপরিচিত সেটা খুব একটা দেখে না৷ নিজের সাধ্যমতো সাহায্য করার চেষ্টা করে। যেচেপড়ে সাহায্য করতে চেয়ে কয়েকবার বেশ ঝামেলায় পড়তে পড়তে বেরিয়ে এসেছে। এবারও ওর মাথায় ঘুরছে একজন বিপদগ্রস্ত মা, যে তার সন্তানের টানে দিশেহারা হয়ে ছুটে যাচ্ছে। পথে এক্সিডেন্টও হতে পারে।
আবার সন্ধ্যাও হয়ে আসছে, বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছার জন্য কোনো যানবাহনও চোখে পড়ছে না। তাই স্বপ্রণোদিত হয়ে সাহায্য করতে চাইছে। কিন্তু তপা রাফিদকে চেনে না, তাই সন্দিহান গলায় ঘুরে তাকিয়ে বলল,
“আপনি কেন এতটা করবেন?”
“ধরে নিন একজন মা’য়ের জন্য। প্লিজ না করবেন না। আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন, আমি খুব একটা খারাপ মানুষ নই।”
রাফিদের বলার ভঙ্গিতে সত্যিকারের সহানুভূতি দেখল তপা। তাই আর অমত করল না। এখন ওর কাছে দর্পণের কাছে যাওয়াটাই মূখ্য। বাকি সবকিছু গৌণ।
পুরো রাস্তায় তপা অসংখ্যবার কল করে মলিনা আর সায়েদা আন্টির সাথে কথা বলল। রাফিদ বিরক্ত করতে চাইল না বলে চুপচাপ রইল। সে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করছিল একজন মায়ের আকুতি।
বাসার গেটের সামনে গাড়ি থেকে নামতেই দেখল মলিনা দর্পণকে কোলে নিয়ে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, সাথে সোমাও আছে।
ছুটে গিয়ে ছেলেকে কোলে তুলে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল তপা। এতক্ষণ চোখে জলগুলো সঞ্চিত ছিল, এখন সব ঝরছে। আর দর্পণ, সে যেন কান্নার মাধ্যমে সারাদিনের জমে থাকা অভিমানের প্রকাশ ঘটাচ্ছে।
রাফিদ গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখছিল, এত সুন্দর লাগল মুহূর্তটা। ওর মন জুড়েও একরাশ স্বস্তি খেলা করে গেল।
…….
ক্রমশ