#নিভৃত_দহনে (পর্ব ৫)
নুসরাত জাহান লিজা
দ্রুতই ধাতস্থ হলো তপা, মনে পড়ল রাফিদের কথা। সে এগিয়ে এসে মৃদু হেসে বলল,
“শুধু ধন্যবাদ দিয়ে আপনার উপকারকে আমি হালকা করতে চাই না। ভেতরে এসে এক কাপ চা খেয়ে যান প্লিজ। আমার ভালো লাগবে।”
রাফিদ অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল, “না না, আপনি এতদূর জার্নি করে এলেন। তাছাড়া দর্পণ অসুস্থ। অন্য কোনোদিন যদি দেখা হয় সেদিন না-হয়…”
দর্পণও নতুন মানুষের আভাস পেয়ে কান্না থামিয়ে কৌতূহলী চোখে চেয়ে রাফিদকে দেখছে। রাফিদ কোলে নেবার জন্য হাত বাড়াতেই মায়ের বুকে মুখ গুঁজল সে। যেন এখন সে মায়ের কোল থেকে কারোর কাছে যেতে চায় না, সারাদিনের বিচ্ছেদ পুষিয়ে নিতে চায়!
“আপনি এভাবে খালি মুখে ফিরে গেলে আমার ভীষণ খারাপ লাগবে।”
রাফিদ নিজের ইচ্ছে না হলে অকপটে না বলতে পারে, আজ মুখের উপরে না বলতে যেন কোথাও বাঁধল।
এরইমধ্যে একজন পরিচিত মুখ এসে সামনে দাঁড়াল।
সায়েদা রহমান দোতলার বারান্দা থেকে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন, গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে তার চেনা চেনা লাগল। এটুকু দূর থেকেই ইদানিং তিনি খুব ভালো দেখেন না। বয়স তার নিষ্ঠুর আঁচড় বসাচ্ছে দৃষ্টিশক্তিতে। তাই দ্রুত পায়ে নেমে এলেন। এখন খুব বেশি দ্রুত চলাফেরা করতে গেলে হাঁপিয়ে উঠেন। ওবায়েদ রহমান চলে যাবার পর থেকেই তিনি ভেতরে ভেতরে মুষড়ে পড়েছেন। সামনেই সোমার বিয়ে, বিয়েটা হয়ে গেলে তার ডাক এলেও আর কোনো পিছুটান থাকবে না।
গেটের কাছে এসে দেখলেন তার অনুমান ঠিক, শিরীন আপার ছেলেই তো। তিনি এগিয়ে এলেন। রাফিদই প্রথম কথা বলল, “আন্টি, আপনি…”
“রিফাত না তোমার নাম?”
“রাফিদ।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। বয়স হয়েছে তো।”
“সমস্যা নেই আন্টি। আপনি কেমন আছেন?”
“আমি ভালো আছি। শিরীন আপা কেমন আছে?”
“মা ভালো আছে।”
সোমা এসে বলল, “উনাকে তুমি চেনো?”
“আরে, চিনব না কেন? তুই শিরীন আপাকে চিনিস না? তোর সোবহান নানার মেয়ে? তোর বাবাকে ঢাকায় নিয়ে গেলাম চিকিৎসার জন্য, ওদের বাসাতেই উঠেছিলাম আমি আর তোর বাবা।”
শিরীনকে সোমা চেনে। আগে নানুবাড়িতে গেলে মাঝেমধ্যে দেখা হতো। কিন্তু রাফিদকে কখনো দেখেনি।
“তুমি এখানে এসেছ আমার বাসায় আসবে না! সেবার আমাদের সাথে তুমি হাসপাতালে কত ছোটাছুটি করলে!”
“আমি আসলে ঘুরতে এসেছিলাম আন্টি। উনার ছেলে অসুস্থ, ওদিকে গাড়ির অনিশ্চয়তা, বেলাও পড়ে যাচ্ছিল। তাই সাথে এসেছি।”
“ভালো করেছ। এসেছ যখন তখন আজ আর কোনো যাওয়া যাওয়ি নেই। ভেতরে এসো।”
“আন্টি আমি আরেকজনের গাড়ি নিয়ে এসেছি।”
“যে গাড়ি দিয়েছে সে জেনেই দিয়েছে যে তার গাড়ি নিয়ে তুমি পালিয়ে যাবে না এক রাতে। এসো।”
সায়েদা আন্টির বলায় এমন একটা স্নেয়ময় আন্তরিকতা ছিল যে রাফিদ ফেরাতে পারল না।
“তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো তপা। আজ মলিনা দর্পণকে সামলাতেই হিমসিম খাচ্ছিল, তাই বলেছিলাম আমাদের সাথে খেতে। তুমি আবার রান্না করতে বসে যেও না।”
নিমরাজি হয়ে মেনে নিল তপা। মাঝেমধ্যে এমন স্নেহছায়া মাথায় পড়লে ভালোই লাগে।
***
রাফিদকে বসার ঘরে বসিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলেন সায়েদা। কিছুক্ষণ পরে সোমাকে দিয়ে লেবুর শরবত পাঠালেন। ড্রাইভার সামাদ থাকতে রাজি হয়নি, বাড়িতে অসুস্থ মা আছে।
কিছুক্ষণ পরে এক বাটি পায়েস হাতে ফিরলেন। সোমা পছন্দ করে বলে বিকেলে রান্না করেছিলেন।
“শিরীন আপাকে কত বলতাম আসতে, উনি সময়ই বের করতে পারতেন না। তা-ও ভালো তোমার পা পড়ল বাড়িতে।”
“মা আপনার কথা প্রায়ই বলেন। আপনারা একসাথে স্কুলে যেতেন, ভোরবেলা শিউলি কুড়াতে যেতেন একসাথে এসব।”
“হ্যাঁ, আপা আমার দুই বছরের বড়, কিন্তু আমরা বান্ধবীর মতোই ছিলাম৷ একসাথে থাকতাম সবসময়।”
“তোমার বাবা কেমন আছে?”
ছোট্ট করে বুকের কোথাও যেন মৃদু দীর্ঘশ্বাস আন্দোলিত হলো, “ভালো আছেন।”
সোমা একবার বলল, “আপনি ছবি তোলেন বুঝি?”
“আরে, আপনি আপনি কী করছিস? ও আর তুই একই বয়সী৷ তুই ওর তিন মাসের বড়।”
সায়েদা আন্টি মায়ের সাথে কাটানো পুরোনো স্মৃতিচারণ করলেন৷ আলাপে আলাপে ঘড়ির কাঁটা সাড়ে আটটা পার হয়েছে। এরমধ্যে রাফিদ একবার মা’কে কল দিয়ে দু’জনের কথাও বলিয়া দিয়েছে।
সোমাকে পাঠালেন, তপাকে ডাকতে। খাবারের সময় হয়ে যাচ্ছে।
“সোমা, তুমি আগে খেয়ে নাও। তারপর দর্পণের কাছে এসে বসো। আমি পরে খাই।”
সোমা তপাকে জোর করে বসিয়ে দিয়ে বলল, “তপা আপু, তুমি খেতে বসো। আমি পরে খাব। আমি দর্পণের কাছে বসছি।”
তপা বসে সায়েদা আন্টিকে বলল, “আন্টি, দর্পণের জন্য আপনাকে বারবার কষ্ট দিচ্ছি। আসলে…”
“মেয়ে, এভাবে বলছ কেন? সারাদিন আমি বাসায় একাই থাকতাম। সোমাও অফিসে চলে যায়৷ তোমার ছেলে বরং আমার সঙ্গী হয়েছে। বুড়ো বয়সে এমন একটা সময় কাটানোর সঙ্গী পেয়ে আমার খুব ভালো লাগছে। তুমি মনে সংকোচ রেখো না।”
এই ভদ্রমহিলার প্রতি তপার শ্রদ্ধা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এত ঋণের দায় সে শোধ করবে কী করে! সায়েদা আন্টি, সোমা, রাফিদ… তালিকাটা লম্বা হচ্ছে।
“সামনের মাসেই সোমার বিয়ে। রাফিদ বাবা, তুমি কিন্তু অবশ্যই শিরীন আপাকে নিয়ে আসবে বিয়েতে। আমার ভালো লাগবে।”
রাফিদ একবার তপার দিকে তাকাল, চোখে মুখে অবসাদ লেগে আছে৷
“আপনার রান্না ভীষণ মজার আন্টি।” কিছুক্ষণের জন্য মৌনতা নেমে এসেছিল ঘরে। রাফিদের দম বন্ধ লাগছিল বলে কথাটা বলল।
ভেতরের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সোমা বলল, “রাফিদ, আমার বিয়ের ছবি কিন্তু তোমাকে তুলে দিতে হবে।”
রাফিদ বলল, “আরে আমি ওয়েডিং ফটোগ্রাফি করি না তো।”
“করো না, কিন্তু আমার জন্য করবে। তিন মাসের বড় বোন হিসেবে আমার আবদার এটা।”
তপা জিজ্ঞেস করল, “বন পাখি লতাপাতার ছবি তুলতে ভালো লাগে, অথচ মানুষের মধ্যে কত বৈচিত্র্য, সেটা ক্যামারায় ধরতে ইচ্ছে করে না আপনার?”
রাফিদ সোমার কথা শুনে হেসে ফেলেছিল, তবে তপার কথায় ক্ষণকালের জন্য থমকে গেল, সহসা উত্তর দিতে পারল না। তবে দ্রুতই সামলে নিয়ে বলল, “মানুষের বৈচিত্র্যতায় কখনো কখনো কপটতা থাকে, কিন্তু প্রকৃতি কপটতা জানে না। প্রকৃতি সবসময়ই ভীষণ নির্মল, স্নিগ্ধ।”
তপা বলল, “এটা ঠিক, তবে মানুষের স্নিগ্ধতা খুঁজে নিতে হয়। সবাই সেটা আবিষ্কার করতে পারে না, কারণ সেটা মনের ব্যাপার। মনকে ক্যামেরার ফ্রেমে ধারণ করা সম্ভব হয় না। মানুষের সবচাইতে সুন্দর জিনিস তাই অদেখাই থেকে যায় আমাদের। মনের চোখ দিয়ে কখনো কখনো সেই সৌন্দর্য ধরা যায় অবশ্য।”
শুনতে শুনতে খানিকটা তন্ময় হয়ে গিয়েছিল রাফিদ, এরমধ্যে কখন যে একগাদা খাবার ওর প্লেটে তুলে দিয়েছেন তা খেয়াল করেনি। এখন দেখল। সর্বনাশ, এত খাবার সে কীভাবে শেষ করবে!
“কপটতা অবশ্য ধরা যায়, সাথে সাথে যায় না। অনেক দেরি হয়ে যায়! তখন আর ফেরার পথ থাকে না।”
একরাশ বিষাদ যেন ঝরে পড়ল তপার গলা থেকে। রাফিদকে সেই বিষাদ ছুঁয়ে গেল।
সায়েদা আন্টি আর সোমার সাথে আলাপের সময় কথায় কথায় সে জানতে পেরেছে, তপার ডিভোর্স হয়ে গেছে সদ্য।
এটুকু একজন সন্তান নিয়ে এরকম এক অপরিচিত জায়গায় এসে থাকার জন্য ভীষণ সাহস আর মনের জোর লাগে। তপার সেটা আছে বলেই মনে হলো। মেয়েটার এই সাহসের জন্য কিছুটা শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হলো রাফিদের মনে।
সে আবারও পরিবেশ হালকা করার জন্য বলল, “সোমার বিয়েতে ফটোগ্রাফির দায়িত্ব তাহলে আমি নিচ্ছি। দেখি মানুষের বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যকে ক্যামেরায় ধরা যায় কি-না।” একটা সূক্ষ্ম চ্যালেঞ্জও যেন জানালো সে তপাকে।
***
রাফিদ ছাদের দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়াল, যেন পৃথিবীর অপার্থিব সৌন্দর্য থেকে এক ঝলক নেমে এসেছে এই বাড়ির ছাদে।
তপা দর্পণকে কোলে নিয়ে হাঁটছে, আর সুর করে আয় আয় চাঁদ মামা গাইছে চাঁদের দিকে ইশারা করে। ‘চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা’ বলে দর্পণের কপালে আঙুল ঠেকাতেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল নিষ্কলুষ, অপাপবিদ্ধ হাসি।
চাঁদটাও যেন আজ জোছনার চাদর বিছিয়ে দিয়েছে ওই দু’জন মা-সন্তানের উপরে।
এমন অপার্থিব মুহূর্ত ক্যামেরা নয়, হৃদয়ের ফ্রেমে আজীবন বেঁধে রাখা যায়!
………..
ক্রমশ