নিভৃত দহনে পর্ব-০৬

0
38
নিভৃত দহনে পর্ব-০১
নিভৃত দহনে

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ৬)
নুসরাত জাহান লিজা

রাফিদ চন্দ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখছিল, সম্বিতে ফিরতেই মনে হলো তপা ওকে এভাবে দেখলে ভুল বুঝতে পারে। তাই এগিয়ে গিয়ে তপার পাশে এসে দাঁড়াল।

তপা রাফিদকে দেখে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই সে বলল, “আপনাদের বিরক্ত করলাম বোধহয়। আসলে রুমে বসে থাকতে ভালো লাগছিল না। ভাবলাম একটু হাঁটাহাঁটি করে আসি।”

এবার তপা বলল, “বিরক্ত হবার কিছু নেই। ছাদটা আমার পার্সোনাল প্রোপার্টি নয়। আপনি আসতেই পারেন।”

“এগারোটা বাজে, দর্পণ ঘুমায় কখন?”

“ও আমি আসার পরে পরে ঘুমিয়েছিল তো। তাই এখন জেগে আছে। এমনিতে দশটার মধ্যে ঘুম পাড়িয়ে দিই।”

“আমি ওকে একবার কোলে নিতে পারি? আসবে আমার কাছে?”

“ও সবার কোলে যায় এমনিতে। তবে মাঝেমধ্যে আমাকে ছাড়তে চায় না।”

রাফিদ হেসে হাত বাড়িয়ে দিল দর্পণকে কোলে নেবার জন্য, “এই দর্পণ বাবু, এসো।”

দর্পণ মায়ের বুকে মুখ গুঁজে দিল, রাফিদ হাল না ছেড়ে পকেট থেকে একটা ছোট্ট টর্চ লাইট বের করল, যাতে নীল আলো দেয়, সে আলো জ্বালিয়ে বলল, “এটা নেবে না দর্পণবাবু?”

এবার দর্পণ লাইটটা ধরার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল, রাফিদ সেই সুযোগে ওকে কোলে তুলে নিল।

দর্পণ লাইটটা হাতে নিয়ে নিল। আলোটা হাত দিয়ে চেপে ধরতে হাতে ভেতরের রঙ বদলে যাওয়াটা ওকে আকর্ষণ করেছে, সে বারবার হাত সরিয়ে দিয়ে আবার রেখে খেলায় মেতে উঠল।

রাফিদ দর্পণের গালে চুমু খেল, দর্পণ ফিক করে হেসে সে-ও রাফিদের গালে চুমু খেল। রাফিদের যে কী ভীষণ ভালো লাগল। এটা ছেলেটা শিখেছে মা’য়ের কাছ থেকে।

“ছোট্ট একটা জীবন্ত পুতুল আপনার দর্পণ। আমি একা থাকেন শুনে ভেবেছিলাম আপনার লাইফটা হয়তো খুব বোরিং। কিন্তু এমন একজন সাথে থাকলে স্বপ্নের মতো সময় কেটে যাবার কথা।”

তপা মৃদু হেসে বলল, “এটা ঠিক বলেছেন। শিশুরা তো অনুকরণ প্রিয় হয়। দর্পণ এখন প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জিনিস শিখছে৷ যখন নতুন কিছু করছে, কিংবা একটু একটু করে বেড়ে উঠছে, আমি এক পৃথিবী তৃপ্তি নিয়ে তা উপভোগ করি। আমার মাতৃত্ব স্বার্থক মনে হয়। আমার শরীরে আমি ওকে ধারণ করেছি, সে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, কথা বলা শিখছে, এক-পা, দু’পা করে হাঁটতে চেষ্টা করছে, ভাবলেই একটা অদ্ভুত আনন্দ, একটা অপার্থিব শিহরণ বয়ে যায় আমার সমস্ত সত্তায়।”

রাফিদের কোলে দর্পণ এবার লাইট ছেড়ে ওর গাল নিয়ে পড়েছে। ওই ছোট্ট দুটো কোমল হাত ওর গালে হাতড়াচ্ছে, ট্রিম করা ছোট ছোট দাড়িতে হাত বুলাচ্ছে। শিশুদের স্পর্শ থেকে কি হ্যাপি হরমোন নিঃসৃত হয়! রাফিদের জানা নেই, কিন্তু এটুকু অনুভব করছে, ওর হৃদয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে একটা অদ্ভুত স্ফুর্তিভাব ছড়িয়ে পড়ছে।

“আপনি একটু আগে গুণগুণ করছিলেন শুনছিলাম, আপনি গান করেন?”

“শিখেছিলাম ছেলেবেলায়। তাছাড়া এককালে আবৃত্তি করতে ভালো লাগত ভীষণ।”

“এখন ভালো লাগে না?”

তপার মৃদু হাসি ম্লান হলো, চাঁদের অস্পষ্ট অথচ উজ্জ্বল আলোয় যা রাফিদের চোখ এড়ালো না। সে কী মেয়েটাকে দুঃখ দিয়ে ফেলল!

তপা ক্ষণকাল নিশ্চুপ থেকে মুখ খুলল, বিস্তৃত আকাশের বুকে ফুটটে থাকা অজস্র তারা আর দূর থেকে ভীষণ ছোট্ট মনে হওয়া ওই চাঁদ্রর পানে চোখ রেখে স্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করল,

“একটি মেয়ে ছিলো
কবিতা লিখতে লিখতে কবিতা লিখতে লিখতে
তার সাঁঝ ফুরিয়ে সকাল হয়ে যায়
সকাল মিলিয়ে যায় রাত্তিরে;
একদিন এলো এক রাজপুত্তুর
মেয়েটাকে বসিয়ে নিলো তার পক্ষীরাজে
বললো, এসো, বললো, চলে এসো,
তোমার কবিতা নিয়ে তোমার দিন নিয়ে
তোমার রাত্রি নিয়ে
আমার কাছে চলে এসো
আমার কাছে দিনও পাবে
আমার কাছে সব কিছুই কবিতা;
মেয়ে খুব খুশি
কলম নামিয়ে রাখলো
সঙ্গে সঙ্গে তার চাঁপার কলি আঙুল
আঙুলগুলি সব ঝরে পড়লো
যেমন ঝরে যায় ফুলের পাপড়িরা
টুপ্ টাপ্ শব্দহীন
ওই কলমটার ওপরেই;

আর সূর্য চন্দ্র একসঙ্গে ঝলসে উঠে
ধাঁধিয়ে দিল তার রাত্রি-দিনের হিসেব
খসিয়ে দিলো তার দুটি নয়নতারা ফুল
এখন সেই মেয়ের
সকালও নেই
রাত্রিও না
এখন সেই মেয়ের
কবিতাও নেই
পক্ষীরাজও না”

রাফিদের মনে হলো উদ্ভাসিত চাঁদের আলোটুকু যেন ম্লান হয়ে গেল মুহূর্তেই। এটা যেন কোনো কবিতা নয়, একটা বিষাদগাঁথা, যার প্রতিটি শব্দে চুয়ে চুয়ে ঝরছে সাত সমুদ্র বিষাদের জল। তবে তা শুধু কণ্ঠেই, তপার চোখমুখ পাথরের মতো নিস্প্রভ।

“কখনো কারো জন্যেই নিজের সত্তাকে বিসর্জন দিতে নেই। তবে নিঃস্ব হয়ে যেতে হয়। নিজেকেই হারিয়ে খুঁজতে হয়।”

কবিতা শেষে তপার কথায় রাফিদ সহসা যেন বোবা বনে গেছে। ওর গলায় কোনো শব্দ আসছে না। এতটুকু বুঝেছে, তপা সান্ত্বনা চায় না। সান্ত্বনা যাদের প্রয়োজন, সে-ই দলে তপা পড়ে না। সে নিজের আত্মবিশ্বাসের ধ্বংসাবশেষ থেকেই নতুন আত্মবিশ্বাস রচনা করতে চাইছে। হারিয়ে ফেলা সত্তার আনাচেকানাচে থেকে যেটুকু এখনো মরে যায়নি, সেই আত্মবিশ্বাসের টুকরোগুলো একত্রিত করে নিজের শিরদাঁড়া ঊর্ধ্বগামী করে রেখেছে।

হঠাৎ করেই রাফিদের ভারি কৌতূহল হলো, এই মেয়েটার গহীন প্রকোষ্ঠকে যদি আবিষ্কার করা যেত! কেন এমন ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে সে জানে না! জানার চেষ্টাও করছে না।

দর্পণ কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে, রাফিদের কাঁধে হেলান দিয়ে।

তপা খেয়াল করে বলল, “দিন ওকে। শুইয়ে দিতে হবে।”

রাফিদ নিজেকে ধাতস্থ করে বলল, “আপনি দারুণ আবৃত্তি করেন।”

“করতাম একসময়।”

“আবারও শুরু করুন না।”

“এখন আর সময় কোথায়। এখন আমার সমস্ত ধ্যানজ্ঞান দর্পণকে নিয়ে। ওর সুন্দর একটা বর্তমানের, নিশ্চিত একটা ভবিষ্যতের।”

তপা আরেকবার ধন্যবাদ জানিয়ে নেমে গেল ছাদ থেকে। কিন্তু রাফিদ নামল না। সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। কতক্ষণ সে জানে না। কেন, তাও জানা নেই! এতটা খেই হারানো কোনোদিন ছিল না রাফিদ। আজ তবে কেন মনে হচ্ছে, বুকের কোথাও একরাশ দীর্ঘশ্বাস ভরা শূন্যতা জমে আছে!

***
শিরীন কিছুক্ষণ আগে রাফিদের সাথে কথা বলেছে। জয়নুল ঘরে ঢুকে বেশ উত্তেজিত গলায় বললেন,

“তোমার ছেলের স্পর্ধা দিনদিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ওকে ফিরতে বলো।”

“আমার ছেলে মানে? ও তোমার ছেলে না?”

“আমার ছেলে, কিন্তু আমার আদর্শের শিক্ষা ও পায়নি তোমার আস্কারায়। দুইদিনের মধ্যে না ফিরলে আমার বাড়িতে ওর জায়গা হবে না।”

“বাহ্! ভালো বললে তো? ছেলে আমার, বাড়িটা তোমার। ছেলে যদি তোমার কথায় তাল মিলিয়ে চলত, ছেলেও শুধু তোমার হয়ে যেত, তাই না?”

“শিরীন, দেখো, এখন তোমার প্যাঁচানো কথা শুনতে আমার একদম ভালো লাগছে না। আমি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তিলে তিলে ব্যবসা দাঁড় করিয়েছি, বাড়ি করেছি। কার জন্য? ওর জন্যই তো। এসব আমি ওর হাতে তুলে দেব একসময়, সেই খেয়াল ওর আছে?”

“আমি যখন তোমার হাত ধরেছিলাম, তখন তোমার কিছুই ছিল না। তোমার এই বাড়ি ব্যবসা এসব দাঁড় করাতে যে আমার কোনো ভূমিকা ছিল না, এতদিন পরে এসে তোমার মুখে এসব জেনে ভালোই হলো।”

“শিরীন, প্লিজ, বুঝতে চেষ্টা করো। আমি রাগের মাথায় বলেছি। আমি ওর ভালো চাই। তুমি আমার পাশে না থাকলে আমি পারতাম না কিছু। তুমি…”

“থাক, আর বোলো না। তোমার ইচ্ছে হলে ছেলেকে ফিরিয়ে আনো। আমি ওর সুখ চাই। যা ওকে সুখী করে তাই করুক। আমার ছেলেটা অন্যরকম। আমি আজকের পর থেকে নিজেও চাইব না, সেও তোমার মতো একদিন ‘আমি’ স্বর্বশ হয়ে উঠুক।”

“তুমি আমাকে স্বার্থপর বলতে চাইছ?”

“আমি কিছুই বলতে চাইছি না। ঘুম পেয়েছে। ঘুমাব।”

বলে তিনি শুয়ে পড়লেন, জয়নুল কথা বলে যাচ্ছেন, কিন্তু তিনি সেসব না শোনার ভাণ করে নিঃসাড় পড়ে রইলেন।

***
রাফিদ বাগানে এসেছিল৷ দেখল সকাল সকাল তৈরি হয়ে বেরুচ্ছে সোমা আর তপা। তপার কোলে দর্পণ, সে মলিনাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে কী করতে হবে।

রাফিদ এসে বলল, “ওকে আমার কাছে দিন। আমি আর ঘণ্টাখানেক আছি। সাড়ে দশটার দিকে বেরোব।”

“না না, আপনি বরং রেডি হন। কষ্ট করতে হবে না।”

“আমার কষ্ট হবে না। ওকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে।”

তপা দর্পণকে একটা হামি দিয়ে পাল্টা পেয়ে হাত নেড়ে বেরিয়ে গেল। যতক্ষণ মাকে দেখা যায়, ছোট্ট শিশুটা ততক্ষণ তাকিয়ে রইল। এরপর রাফিদের বুক পকেট হাতড়াতে শুরু করল, আর মুখে অবোধ্য কিছু শব্দ। রাফিদ বুঝল রাতের খেলাটা আবার খেলতে চাইছে। কিন্তু সেটা তো দিনে ওর জন্য উপভোগ্য হবে না! সে ওকে কোলে নিয়ে বাগানে গেল। বিভিন্ন গাছ আর ফুলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। ছাদে নিয়ে গিয়ে হাত ধরে হাঁটানোর চেষ্টা করল। কয়েক পা হাঁটে হাত ধরে রাখলে।

“দর্পণ সোনা আর কয়দিন পরেই হাঁটতে পারবে।”

রাফিদ নিজের নামটা বলানোর চেষ্টা করল অনেকক্ষণ, তবে সফল হলো না। বহুক্ষণ চেষ্টার পরে বলল ‘’দাফেত”

রাফিদের খুশি তখন দেখে কে! সাড়ে দশমাস বয়সী শিশু, এই অল্প সময়েই কেমন ওর আপন হয়ে গেছে।

ঘড়ি দেখে ওর ভিরমি খাবার দশা হলো। সাড়ে দশটায় বের হবে, অথচ বারোটা আটাশ বেজে গেছে। মাঝে অবশ্য মলিনা কয়েকবার সূজি, ফিডারে করে দুধ আর খিচুড়ি খাইয়ে গেছে। কিন্তু এতটা সময় সব ভুলে কী করে পরে রইল সে!

ফেরার সময় দর্পণ রাফিদের বুকের কাছটা আগলে ধরে রইল। বুঝতে পেরেছে সে চলে যাচ্ছে।

রাফিদ কপালে চুমু দিয়ে বলল, “রাফিদ আবার আসবে সোনা। তোমাকে দেখতে আসবে। ভালো থেকো।”

সেই টর্চলাইটটা দর্পণকে দিয়ে দিল। কী মায়াকাড়া একটা শিশু। কেমন সময় ভুলিয়ে দেয়। এর আশেপাশে যতক্ষণ ছিল, রাফিদের মনে হচ্ছিল পৃথিবীতে কোনো পঙ্কিলতা নেই, আছে কেবল পবিত্রতা।

এই শিশুটার প্রতি এতটা মায়া জন্মেছে তা বাসে উঠে বুঝতে পারল। কিছু ছবিও সে তুলেছে দর্পণের হাসি মুখের। ভুবন ভোলানো হাসি।

পৃথিবীর পরতে পরতে এত মায়া কেন! সেই মায়া আবার কেটে যায় কেন! দর্পণ কী পরে কখনো দেখা হলে ওকে চিনতে পারবে! পারবে না! এটাই পৃথিবীর অমোঘ বিধান।
…….
(ক্রমশ)