নিভৃত দহনে পর্ব-০৭

0
39
নিভৃত দহনে পর্ব-০১
নিভৃত দহনে

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ৭)
নুসরাত জাহান লিজা

তপা সোমাকে সাথে নিয়ে দর্পণকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে এসেছে। ঠান্ডা, জ্বরে বেশ কাহিল হয়ে পড়েছে ছেলেটা। রাতে ঘুম ভেঙে প্রচুর কান্নাকাটি করে, শ্বাসকষ্টও হয়। তাছাড়া এখন যে ভ্যাপসা গরম, তাতে পরিণত বয়সের মানুষদের জন্যও টেকা দায়।

আর দুজনের পরেই সিরিয়াল। একটা অচেনা নম্বর থেকে কল এলো। রিসিভ করতেই ওই প্রান্তে কবীরের গলা শুনল,

“দর্পণ কেমন আছে?”

“তুমি কেন কল করেছ?”

“আমি আমার ছেলের খোঁজ নেব না?”

তপার চোয়াল শক্ত হলো। এসব মেকি আদিখ্যেতা সে ভালো করেই চেনে, “তুমি আসলে ছেলের খোঁজ জানতে কল দাওনি, কবীর। তুমি কল করেছ এটা শুনতে যে আমি ছেলেকে নিয়ে অথৈ সাগরে পড়েছি। কিন্তু তোমার পৈশাচিক আনন্দ পাওয়ার সুযোগ নেই। আমি আর আমার ছেলে দুজনেই খুব ভালো আছি।”

“দুই লাইন বেশি বোঝা মেয়েদের নিয়ে আসলেই সমস্যা।”

“দুই লাইন বেশি বুঝিনি, অক্ষরে অক্ষরে এমনকি দাড়ি, কমা, সেমিকোলন পর্যন্ত যথাযথ পড়েছি। এটাই তোমার সমস্যা। তুমি নিতে পারো না। তোমার করুণায় বাঁচবে, আবার তোমার অন্যায় মাথা পেতে মেনে নেবে না, এর চাইতে বাজে মানুষ তোমার কাছে আর হয় না।”

“চ্যাটাং চ্যাটাং খই ফোটানো বুলি কয়দিন থাকে, আমিও দেখব। নতুন নতুন ডানা গজালে মানুষ এইভাবেই উড়ে। কয় টাকার চাকরি করছ, আবার বড় বড় কথা। চাকরির বাজার আবার অন্য বাজারে যেন ট্রান্সফর্ম না হয়!”

তপা দাঁতে দাঁত চাপল, মগজ ফেটে যাচ্ছে নোংরা ইঙ্গিত শুনে। তবে গলায় সেই উত্তেজনা প্রকাশ করল না, শীতল ঠান্ডা গলায় বলল, “নর্দমার কীটের সাথে তোমার তুলনা করে কীটদের অপমান করতে চাই না। কারণ তুমি তাদেরও অধম।”

বলেই কল কেটে দিল, এরপর কবীরের আগের কিছু নম্বরের সাথে এই ফোন নম্বরটাও চলে গেল ব্লক লিস্টে। ভয়ানক রাগে গা গোলাচ্ছে ওর। ঘৃণা শব্দটাও যথেষ্ট নয় ওই জঘন্য শয়”তা”নটা’র জন্য। এত বিশ্রী ভাষায় যে সে কথা বলতে পারে, সেটাও আগে জানত না তপা। হিউম্যান মাস্ক ডিটেক্টর জাতীয় কিছু যন্ত্র থাকলে ভালো হতো। মুখোশের আড়ালের মানুষটাকে সময় থাকতে চেনা যেত। তপার মতো আরও অনেকেই হয়তো বেঁচে যেত!

সোমার কোলে ছিল দর্পণ, সে একরাশ কৌতূহল নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তপা ওকে কোলে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। দর্পণ মুখ গুঁজল মায়ের কোলে।

ঠিকঠাক ধাতস্থ হয়ে উঠার আগেই চেম্বারে ডাক পড়ল ওদের।

***
“তোমার মায়ের শরীর খারাপ করেছে, বাসায় এসো, রাফিদ।”

রাফিদের ভেতরটা কেমন করে উঠল, সে বলল, “কী হয়েছে মা’র? আমি তো রাতেও কথা বললাম।” বাবাকে প্রশ্ন করল রাফিদ।

সকালে রিংটোনের শব্দে ঘুম ভেঙেছে ওর, বাবার কল দেখে দু’বার কেটে দিয়েছে। ঘুম থেকে উঠেই তার সাথে তর্কযু*দ্ধে লিপ্ত হতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু তারপরও যখন আবার কল এলো, সে বাধ্য হয়ে ধরল। বাবা কল কেটে দিলে আর কল করেন না। ভীষণ ইগো তার৷ তাই রাফিদ বুঝল কলটা আর্জেন্ট। ধরতেই দুঃসংবাদটা শুনল।

“হঠাৎ করে ব্লাড প্রেসার খুব হাই হয়ে গেছে, ডায়েবিটিসও বেড়েছে। সকালে প্রায় কিছুক্ষণের মতো সেন্সলেস ছিল।”

এটুকু বলে জয়নুল খানিকটা থেমে আবারও বললেন, “আমার কথায় না আসো, মায়ের প্রতি তো তোমার টান আছে, সেই টানেই এসো নাহয়।”

“মা ঠিক আছে তো? আমি মা’র সাথে কথা বলতে চাই।”

“এখন ঘুমিয়ে আছে।”

রাফিদ অস্থির হয়ে পড়ল, ঝড়ের বেগে তৈরি হয়ে বেরিয়ে এলো। সবুজ অফিসে চলে গেছে, তাকেও বলা হলো না তাড়াহুড়ায়। ট্রেনের টিকিট পাবে না বলে বাস ধরল।

এরমধ্যে মায়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা চালিয়ে গেল, কিন্তু কেউ ধরল না। রাফিদের চোখে মায়ের সদা হাস্যোজ্বল চেহারাটা বারবার ভেসে উঠছিল।

একুশ দিনের মাথায় ওর এবারের সিলেট ভ্রমণ সমাপ্ত হলো।

***
তপা বেশ গুছিয়ে উঠেছে এখানে। একটা স্টিলের আলমারি কিনেছে গত সপ্তাহে, একটা ড্রেসিং টেবিল। একটা ছোট ফ্রিজও কেনা হয়েছে। এখনো স্যালারি পায়নি। তবে তুহিনের কাছ থেকে ওর অংশের পাওয়া টাকা থেকে কিছু টাকার সদ্ব্যবহার করেছে।

একসময় প্রচুর বই পড়া হতো। বাবা এনে দিতেন ওদের দুই ভাইবোনকে, তুহিন খুব একটা পড়ত না, তবে তপার নেশা হয়ে উঠেছিল। বিয়ের পরে কবীর একবার ওকে একসাথে একশো বই উপহার দিয়েছিল। তখন কী ভীষণ খুশি যে হয়েছিল তপা! কিন্তু সবটাই নিজের মুখোশকে পোক্ত করতে করেছিল লোকটা তা যদি একবার জানত!

তপার আগের বইগুলোও সে ওই বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। আসার সময় অনেককিছুর সাথে প্রিয় বইগুলোও ফেলে এসেছে তপা। যাকে সে সংসার বলে ভেবেছিল, তা আসলে ওর জন্য একটা সোনায় মোড়া খাঁচা ছিল। নিজের সত্তাকে বিসর্জন দিতে পারল হয়তো সেই বৈভবের মধ্যে ভালোই থাকত সে! কিন্তু সেটা ওর পক্ষে সম্ভব নয়।

নতুন করে ঘরের জিনিসপত্র সাজাতে সাজাতে তপার মনে পড়ল আগেও একবার সব সাজাতে চেয়েছিল নিজের মতো করে।

কবীরের আলাদা ফ্ল্যাট ছিল। বাবা-মায়ের সাথে থাকত না। তপা একবার খুব শখ করে কিছু পেইন্টিং কিনেছিল। খুব বেশি দামী না, কিন্তু দেখতে ভীষণ স্নিগ্ধ ছিল। সেগুলো ওদের বেডরুমে টাঙিয়েছিল।

কবীর এসব দেখে বলেছিল, “এখন পছন্দও আপগ্রেড করো একটু। মিডল ক্লাস মেন্টালিটি বদলাও। এগুলো এই রুমের সাথে ভীষণ বেমানান।”

সেদিন তপা খানিকটা আহত হলেও খুব সিরিয়াসলি নেয়নি কথাটাকে, বরং বলেছিল, “মিডল ক্লাস মেয়েকে বিয়ে করা যায় অথচ তার পছন্দে ভরসা নেই?”

কবীর হেসে বলেছিল, “বউটা টপ ক্লাস যে।”

তপার গা গুলিয়ে উঠল ঘৃণায়, রক্ত টগবগিয়ে উঠল।

দর্পণকে মলিনার কোলে দিয়ে দোতলায় পাঠিয়েছে। এখানে ঝাড়পোঁছ করছে, এই ময়লা টয়লা নাকে চোখে ঢুকে ঠান্ডা বেড়ে যেতে পারে বলে।

সায়েদা আন্টির বয়স হয়ে গেছে৷ সোমার বিয়ে সামনেই, তাই বড় মেয়ে আর জামাইকে এনেছেন শলাপরামর্শ করতে। কীভাবে কী আয়োজন হবে সব কিছুর একটা লিস্ট করে খরচ কেমন হবে এসব ঠিক করতে। রুমা আপুর একটা মেয়ে দুই বছর বয়সী, তার সাথে দর্পণের খুব ভাব হয়েছে। ওর সাথেই খেলছে।

তপা আবারও কাজে মন দিল, ফেলে আসা কথা সে আর ভাববে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিল, তবুও কেন এসব মনে পড়ে! অপমান আর কষ্টগুলো এমন চিরস্থায়ী আঁচড় ফেলে যায় কেন, জীবনে, মনে!

***
রাফিদ হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে এলো। দৌড়ে মায়ের ঘরে চলে এলো।

মা তখন বিছানায় আধোশোয়া হয়ে বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছেন, পাশে বাবা।

“ফিরলে তাহলে!”

রাফিদ জয়নুলের শ্লেষাত্মক কথার কোনো উত্তর দিল না, এগিয়ে গিয়ে মায়ের পাশে বসে কপালে গালে হাত রেখে অস্থির গলায় বলল,

“মা, তুমি ঠিক আছ?”

“পাগল ছেলে, আমি এখন একদম ঠিক আছি। শরীরটা একটু খারাপ করেছিল, এই যা। আমি তোর বাবাকে বলেছিলাম, তোকে না জানাতে। কিন্তু তবুও…”

বাবা বেরিয়ে গেলেন, হয়তো রেগে গেছেন, ছেলে কেবল মায়ের জন্য এত উতলা, অথচ তার সাথে এত দূরত্ব বলে! স্বাভাবিক সৌজন্য বিনিময় তো দূরের কথা, প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পর্যন্ত ভদ্রতা দেখালো না।

রাফিদ মায়ের মেলে রাখা পায়ের উপরে মাথা রাখল, “আমাকে জানাতে নিষেধ করেছিলে কেন মা?”

শিরীন ছেলের চুলে আঙুল বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “বা রে, এই যে টেনশন করে এভাবে ছুটে এলি। তোর ছবি তোলা অসমাপ্ত থাকল।”

“তোমার চাইতে বেশি আমার জীবনে আর কিচ্ছু নেই মা।”

এবার দুই হাতে ছেলে মুখ দুটো তুলে ধরলেন শিরীন, মৃদু হেসে বললেন, “মাকে খুব ভালোবাসিস, খোকা?”

রাফিদ মাথা পুরোপুরি তুলে মা’য়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা আবার কেমন প্রশ্ন? তুমি আমাকে ভালোবাসো না?”

শিরীন অন্তর্দৃষ্টি মেলে রাফিদের ভেতরটা যেন দেখে ফেললেন। কতদিন পরে কাছ থেকে দেখলেন ছেলেকে। কী পাগল ছেলে তার! তার ছেলেটা এত ভালো কেন! কী সুন্দর দেখতে! চোখে এত মায়া, হাসিটা এত মনকাড়া! চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না তার। সমস্ত স্নেহ ঢেলে তিনি অন্তর থেকে দোয়া করলেন, তার ছেলের ভেতরে বাইরের এই সৌন্দর্য, এই হাসি যেন অম্লান হয়।

“কী করলি এতদিন ওখানে? তোর তোলা ছবি আমাকে দেখাবি না?”

সহসা দর্পণের নিষ্কলুষ হাসিমুখ রাফিদের মানসপটে ভেসে উঠল। সাথে ভীষণ বিষাদী অথচ দৃঢ় একজন মেয়ের মুখ।

“অবশ্যই দেখাব, মা।”
……….
ক্রমশ