#নিভৃত_দহনে (পর্ব ১০)
নুসরাত জাহান লিজা
“আপনার বৃষ্টি ভালো লাগে?” রাফিদের প্রশ্নে আচমকা থমকে দাঁড়াল তপা।
নিজের কী ভালো লাগে, তা তো কতদিন ধরে নিজেরই সেভাবে মনে নেই। এখন কী আলাদাভাবে ওর ভালো লাগা বলে কিছু অবশিষ্ট আছে! সে নির্বিকার ভঙ্গিতে উত্তর দেবার চেষ্টা করল,
“একসময় লাগত!” তবুও গলাটা কি একটু কেঁপে গেল ওর!
একসময় কতকিছুই তো ভালো লাগত! কবীর কখনো ওকে জিজ্ঞেস করেনি ওর প্রিয় রঙ কী, কোন পোশাকে সে বেশি স্বচ্ছন্দ, আইসক্রিম, চকলেট কত প্রিয়। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ফুচকা খেতে ওর কতটা ভালো লাগে! নিজের পছন্দ মতো রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেত সবসময়, নিজের পছন্দের পোশাক নিয়ে আসত। সেগুলো আদৌ ওর পছন্দ কি-না, কোনোদিন জানতে চায়নি। হুড ফেলে কোনোদিন রিকশায় বৃষ্টিতে ভেজা হয়নি ওর সাথে। ভেবেছে এসব লোকটা ভালোবেসে এনেছে, তাই কখনো কিছু নিজেও বলেনি।
রাফিদ তপার মুড বুঝে বলল, “জায়গাটা ভীষণ সুন্দর। দর্পণের সাথে আপনার কিছু ছবি তুলে দেই?”
তপা নিজের ভাবনার ওপার থেকে বেরিয়ে এলো এই নির্জন চা বাগানে। প্রথমে আপত্তি করতেই যাচ্ছিল, ভাবছিল শুধু দর্পণের ছবি তুলে দেবার কথা বলবে। পরক্ষণেই মনে হলো, এমন চমৎকার একটা পরিবেশে ছেলের সাথে ওর স্মৃতি থাকুক৷ দর্পণ বড় হয়ে দেখবে। তাই সম্মতি দিল।
রাফিদ ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখে ক্ষণকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। পেছনে সবুজের সমারোহ, তপার পরনের কচি পাতার সবুজ রঙের শাড়ি যেন আলাদা মাত্রা যোগ করেছে ফ্রেমে।
প্রকৃতির সবুজ যেন তপায় ম্লান হয়ে গেছে সহসা, সাথে মায়ের গালে দুই হাত রেখে দর্পণের পৃথিবী ভোলানো হাসি। এই জঞ্জালে ভরা পৃথিবীর বুকে যেন এক টুকরো সৌন্দর্যের বিচ্ছুরণ। কী ভীষণ সুখী সুখী একটা ছবি। আরও কয়েকবার শাটার চাপল রাফিদ। ভঙ্গি বদল হলো মা ছেলের। কিন্তু সেও অপার সৌন্দর্য অম্লান রইল। রাফিদের ইচ্ছে হচ্ছিল এই ফ্রেমের অংশ হতে। কিন্তু এতটা দুঃসাহস দেখাবার প্রবৃত্তি হলো না। মনকে শাসন করল।
কেন ইচ্ছেরা আজ এমন অবাধ্য হচ্ছে বারবার! সীমানা পেরোতে চাইছে কেন, কে জানে!
তবে অন্য আরেকটা আর্জি ঠিকই তপার কাছে পেশ করল রাফিদ, “দর্পণের সাথে আমার একটা ছবি তুলে দিতে পারবেন?”
তপা এবার এক মুহূর্তও দ্বিধা না করে বলল, “অবশ্যই। নিন ওকে। আমি তুলে দিচ্ছি।”
দর্পণ রাফিদকে কোলে নিতেই সে আগের ছবিগুলোর মতো একইরকম অঙ্গভঙ্গি করতে থাকল। সে মনে করেছে সামনে ওই যন্ত্রটা হাতে কেউ দাঁড়ালে তাকে এরকমই করতে হবে। রাফিদের ভীষণ মজা লাগল বিষয়টা।
তপা ছবি তুলে দিল, দর্পণ এই ছেলেটার সাথে ভীষণভাবে মিশে যাচ্ছে। কয়দিন পরেই রাফিদ চলে যাবে। তখন বাচ্চাটা হয়তো আনমনেই খুঁজবে তাকে। আহারে!
ছবি তোলা শেষে এগিয়ে যাচ্ছিল, আকাশে মেঘ করেছে। বৃষ্টি নামতে পারে। তপা সোমাকে টেক্সট করল, ওদের কথা শেষ হলে যেন কল দেয়।
আরেকটু এগুতেই দুই তিনজন কাপল দেখা গেল। আরেকটু এগুতেই দেখল ফ্যামিলি নিয়ে এসেছে চা বাগানে ঘুরতে। সেখানেই একটা পরিচিত মুখ দেখতে পেল তপা। সে পাশ কাটাতে চাইছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে চোখে পড়ে গেল।
একটা চল্লিশোর্ধ্ব মহিলা এগিয়ে এসে বলল, “আরে, তপা না? কেমন আছ?”
“ভালো।”
ভদ্রমহিলা একবার রাফিদের কোলে দর্পণকে জরিপ করে নিয়ে বলল, “হ্যাঁ, সে তো দেখতেই পাচ্ছি।”
“বেশ ভালো করেছেন। আমি ব্যস্ত। এখন যাই।”
“বড্ড তাড়া তোমার! ডিভোর্সের জন্যও তাড়া ছিল। ওর জন্য বুঝি?” রাফিদকে ইঙ্গিত করে বলল কথাটা।
রাফিদ এবার মুখ খুলল, “দেখুন, আপনি ভুল…”
তপা দৃঢ় গলায় রাফিদকে থামিয়ে দিল, “রাফিদ, প্লিজ। আমি কথা বলছি। ডিভোর্সের পরে আমি কী করছি, সেটা নিয়ে কোনো কৈফিয়ত দেবার দায় আমার নেই। একসময় দিয়েছিলাম। এখন আর দেব না। আমার জীবনে আমি কী করব না করব তার জন্য কোনোরকম কোনো জবাবদিহিতা আমি করব না আর। আরেকটা কথা, কবীরের কথার সাথে তাল মিলিয়ে হ্যাঁ তে হ্যাঁ, আর না তে না বলে কিছু স্বার্থসিদ্ধি আপনার বা আপনাদের অবশ্যই হবে। তবে দিনশেষে বিবেকের আয়নায় একবার চোখ মেলে তাকিয়ে দেখবেন তো, কতটা কদর্যতা আপনার মুখের অবয়বে ফুটে উঠে।”
শীতল গলায় এতগুলো কথা বলে এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে উল্টো পথে হনহনিয়ে হেঁটে গেল তপা, রাফিদ দর্পণকে কোলে নিয়ে একটু ধীর পায়ে হেঁটে পিছু নিল।
কিছুদূর এসে হাঁটার গতি শ্লথ করল তপা।
রাফিদ এসে পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “উনি তো ভুল বুঝল আপনাকে।”
“জগতে বেশিরভাগ মানুষ অন্যদের ভুলই বুঝে রাফিদ। ঠিকঠাক বুঝতে পারলে মানুষের জীবনটা অন্যরকম হতো।”
রাফিদ এই দর্শনের মানে বুঝল না। তবে বলল, “কিন্তু আমরা তো চাইলেই নিজেদের দিকটা ক্লিয়ার করতে পারতাম।”
ম্লান হেসে তপা বলল, “তাহলে বলব আপনি এখনো জীবনটা সেভাবে দেখেননি। আমি দেখেছি। আপনার ধারণা সত্যিটা বললেই সে বিশ্বাস করত? করত না। অপাত্রে সত্য বলতে নেই। তাছাড়া আমি নিজের কাছে পরিষ্কার কি-না সেটাই আসল। বাকি দুনিয়া যা ইচ্ছে ভাবুক। তাতে আমার কিছুই আসবে যাবে না যদি না কেউ একান্তই আমার শুভাকাঙ্খী হয়।”
তপা জানে না, এই একটা জিনিস রাফিদের সাথে ভীষণভাবে মিলে গেছে। সে নিজেও এটা বিশ্বাস করে যে নিজের কাছে সে স্বচ্ছ কিনা, বাকিরা যা ভাবার ভাবুক। তাতে তার কোনো দায় নেই। কেন জানে না তপার প্রতি মুগ্ধতা বেড়ে গেল ওর।
“আপনার শেষের কথাটা আমিও মানি সবসময়। লোকে সেজন্য আমাকে বেপরোয়া বলে।”
“ওই মহিলাটা কবীরের কাজিনের ওয়াইফ৷ ওকে তোয়াজ করে চলে নানা সুবিধা নেয়। ওরকম মানুষের সংস্পর্শে এলেই আমার গা ঘিনঘিন করে।”
এই মুহূর্তে তপার ফোনটা বেজে উঠল, আবারও অপরিচিত নম্বর। মনে হলো কলটা কবীর করেছে, এবং আজকের খবরটা এরইমধ্যে ওর কানে চলে গেছে। কিন্তু এখন অনেক প্রয়োজনীয় কল আসে, তাই রিসিভ করল।
“একটা বাচ্চা পোলাপানের সাথে শেষ পর্যন্ত! তবে একটা জিনিস ভালো হয়েছে। আমার ছেলেকে আমি আমার কাছে নিয়ে আসব।”
কবীরের গলায় তপা দাঁতে দাঁত চাপল, এরপর ঠান্ডা গলায় বলল, “কবীর, পৃথিবীতে প্রত্যেকটা মানুষ অন্যকে ঠিক তার মতোই মনে করে। তুমিও তার বাইরে না। আর ছেলেকে নেবার ভয় দেখাও, তোমার ক্ষমতা বেশি থাকতে পারে, কিন্তু দেশে আইন আদালত বলে একটা ব্যাপার আছে। ডিভোর্স আটকাতে পারো নাই, এটাও পারবে না। তুমি যতই হম্বিতম্বি করো, আদতে তুমি একটা মেরুদণ্ডহীন মানুষ। তোমার সাথে কথা বলতে আমার রুচিতে বাঁধে।”
বলেই কল কেটে দিল তপা। সাথে সাথে টুপটাপ বৃষ্টি পড়তে শুরু করল।
রাফিদ ডাকল, “এদিকে আসুন, ভিজে যাবেন।”
তপা কোনোরকমে বলল, “আপনি দর্পণকে নিয়ে ছাউনিতে দাঁড়ান৷ আমি একটু ভিজি।”
রাফিদ অনিচ্ছা সত্ত্বেও গেল, নইলে দর্পণ ভিজে যাবে, বাচ্চাটার ঠান্ডার ধাত আছে। গায়ে বৃষ্টির পানি লাগানো যাবে না এই সময়।
ওরা যেতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। তপা চোখ বন্ধ করে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর মুখে, চোখের পাতায় বৃষ্টি ছুঁয়ে যাচ্ছে। আঁটসাঁট করে বাঁধা খোঁপা ভিজে যাচ্ছে।
অনতিদূরে দাঁড়িয়ে রাফিদ মোহাবিষ্টের মতো সেদিকে তাকিয়ে আছে। ওর মাথায় একটা কবিতা ঘুরপাক খাচ্ছে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা,
“বৃষ্টি নামলো যখন আমি উঠোন-পানে একা
দৌড়ে গিয়ে ভেবেছিলাম তোমার পাবো দেখা
হয়তো মেঘে-বৃষ্টিতে বা শিউলিগাছের তলে
আজানুকেশ ভিজিয়ে নিচ্ছো আকাশ-ছেঁচা জলে
কিন্তু তুমি নেই বাহিরে- অন্তরে মেঘ করে
ভারি ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে!”
কিন্তু মুখে বলার মতো সাহস সঞ্চয় করতে পারল না। পাছে তপার এই বন্ধুত্বটুকু হারিয়ে যায়! আশ্চর্য রাফিদ কোনোদিন ভয় পায়নি। এখন এই অচেনা ভয় কীসের!
শুধু এটুকু বুঝতে পারে, তপাকে যা খুশি তাই বলা যায় না। মনের কথা হুট করে মুখে বলা যায় না! তপা সে জায়গাটা দেয় না কাউকে। একটা অদৃশ্য অথচ সুদৃঢ় প্রাচীর মেয়েটার চারপাশে অষ্টপ্রহর ঘিরে রাখে। যেই প্রাচীরের প্রবেশপথ রাফিদের অচেনা।
হঠাৎ ওর তৃষ্ণা পেল, প্রাচীর ভেঙে ভেতরের তপাকে আবিষ্কারের প্রবল তৃষ্ণা! যেখানে এক ফালি সুখ হাতছানি দিয়ে ডাকছে রাফিদকে।
ভুল ঠিক জানে না সে, শুধু জানে পতঙ্গও অনিশ্চয়তায় ঝাঁপিয়ে পড়ে, সে নাহয় পুড়ল বিষাদের নীলে। পুড়ে পুড়েই নাকি খাঁটি হওয়া যায়! সে-ও তাই হবে না-হয়।
………..
(ক্রমশ)
#নিভৃত_দহনে (পর্ব ১১)
নুসরাত জাহান লিজা
সোমা বিয়ের জন্য ছুটিতে আছে, তাই তপা একাই অফিসে যাচ্ছে। আজ বেরুচ্ছিল, বাগানে শিরীনের সাথে দেখা হয়ে গেল। দর্পণকে কোলে নিতে নিতে তিনি বললেন,
“এখানে এই খোলামেলা পরিবেশে এসে অনেকটা সুস্থ হয়ে গেছি।”
তপা হেসে বলল, “হ্যাঁ আন্টি। ঢাকায় তো বাড়ির সাথে এমন খোলামেলা বাগান আজকাল দেখাই যায় না।”
“দর্পণের সাথেও খেলাধূলা করে ভালো লাগছে। রাফিদটা যে কবে বিয়ে করবে! বয়স আরও বাড়লে নাতি-নাতনি হলে ওদের সাথে খেলতেই পারব না।”
তপা আবারও হেসে বলল, “আপনি কিন্তু এখনো অনেক ফিট আন্টি।”
আকাশে মেঘ করেছে। সেদিকে তাকিয়ে শিরীন এবার বললেন, “সবই আল্লাহর ইচ্ছা। কিন্তু ছেলেটা বিয়ের কথা শুনতেই পারে না। একটা গার্লফ্রেন্ড জুটিয়েছিল সারাজীবনে। তাও নেই। ক্যামেরার সাথে ওর প্রেম। কিন্তু ক্যামেরাকে তো আর বিয়ে করতে পারবে না, ওর বাচ্চা দেখার সাধও সহসা পূরণ হবে না।”
শিরীনের বলার ভঙ্গিতে তপা সশব্দে হেসে ফেলল। বুঝল রাফিদ এতটা প্রাণবন্ত স্বভাব মা’য়ের কাছ থেকেই পেয়েছে।
“রাফিদ খুব ভালো মানুষ। ওর জন্য মেয়ের অভাব হবে না। সঠিক মেয়েকে চোখে পড়লে আপনা-আপনি প্রেম হয়ে যাবে, বিয়েও করবে।”
তপা বেরিয়ে গেলে রাফিদ এলো এখানে। একটু আগে তপার প্রাণবন্ত হাসিতে ওর চোখ আটকে গিয়েছিল। এভাবে মেয়েটাকে হাসতে আজ প্রথম দেখল সে। এত চমৎকার যার হাসি, সে মেয়ে হাসে না কেন! ভীষণ অন্যায় এটা। তপার এক্স হাজব্যান্ডের উপরে ওর ভীষণ রাগ হলো। কেন এত যন্ত্রণা দিয়েছে মেয়েটাকে! এতটা গ্লানি নিয়ে তপা হাসতেই ভুলে গেছে! হাসির সাথে সে নিজের আর কী কী লুকিয়ে রেখেছে হৃদয়ের গহীন প্রকোষ্ঠে, রাফিদের ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে। কোনোদিন তার থৈ পাবে তো!
“তোকে ঠ্যালাঠেলি করে ঘুম থেকে তোলা যেত না। আজকাল না ডাকতেই সকাল সকাল তোর ঘুম ভাঙছে দেখছি!”
মা’য়ের কথায় রাফিদ সচকিত হলো, সে এতক্ষণ গেটের দিকে তপার যাবার পানে তাকিয়ে ছিল। দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিল। অপ্রতিভ হেসে মা’য়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হুম। অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। দর্পণকে দাও তো। ওকে ধরে ধরে হাঁটাই।”
রাফিদ দর্পণের দিকে হাত বাড়াতেই ঝাপিয়ে চলে এলো ওর কোলে। শিরীনের মনে হলো, রাফিদেরও একদিন এমন একটা সন্তান হবে! কেমন যেন অন্যরকম একটা ছবি ফুটল তার চোখে। ভবিষ্যতের এক বাবার! সেটা তিনি দেখে যেতে পারবে তো!
“তোর বাবার কল নাকি তুই ধরছিস না? তোর জন্য ও একটা মেয়ে দেখেছে বলল। তোর হোয়াটসঅ্যাপে মেয়ের বায়োডাটা আর ফোন নম্বর আর ছবি দিয়েছে। তোকে দেখতে বলেছে।”
রাফিদের মুখ সহসা ম্লান হয়ে গেল। দর্পণকে আরেকটু শক্ত করে আঁকড়ে ধরল, তপার পরশুদিনের বৃষ্টিস্নাত বিষাদী মুখটা মনে পড়ল। চোয়াল শক্ত করে সে বলল,
“মা, প্লিজ, বাবাকে বোঝাও। আমি এখন এসব ভাবছি না।”
“আরে, একবার কথা বলে দেখতে ক্ষতি কী! দেখলেই তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না। তাছাড়া তোর পছন্দও তো হতে পারে।”
“এখানে এসেছি আনন্দ করতে। উনি এখানেও আমার শান্তি নষ্ট করতে উঠেপড়ে লেগেছেন কেন?”
“আচ্ছা, তোর ইচ্ছে না থাকলে থাক, কথা বলিস না। কিন্তু এমন করে রিয়্যাক্ট করিস না তো। দেখ বাচ্চাটা ভয় পাচ্ছে।”
রাফিদ দর্পণের দিকে তাকিয়ে দেখল, একরাশ বিস্ময় নিয়ে ওকে দেখছে সে। যেন সে অচেনা একজন। ওকে কখনো এভাবে রেগে যেতে দেখেনি অবোধ্য শিশুটি। ঠোঁটের কোণে তাই কান্নার আভাস। রাফিদ সহসা নিজেকে সামলে নিল। আকর্ণ হেসে দর্পণের গালে, কপালে চুমু খেয়ে অভিমান ভাঙাতে ভাঙাতে বলল,
“আমি তোমাকে কিছু বলিনি বাবা। আমি ভালোবাসি তো বাবুটাকে।”
এক হাত নিজের কানের ডগায় ছুঁইয়ে দর্পণের হাসি অনুকরণ করে হেসে বলল, “স্যরি দর্পণ সোনা৷ রাফিদ অনেক স্যরি। তোমার সামনে আর কখনো রাগব না। প্রমিস।”
দর্পণ কী বুঝল রাফিদ জানে না, তবে সে মুখে কিছু অবোধ্য শব্দ করে কিছু বলল, এরপর ওর সুন্দর হাসিটা হাসল। এই মেঘলা দিনে যেন এক ফালি সূর্যালোকের দেখা পেল রাফিদ সেই হাসিতে!
শিরীন মুগ্ধ চোখে রাফিদ আর দর্পণের মধ্যে গড়ে উঠা সম্পর্কটা দেখতে লাগলেন।
***
লাঞ্চ আওয়ারে তপা দর্পণের সাথে ভিডিও কলে কথা বলল। এরপর মাকে একবার কল দিলো।
“তপা, তুহিন চাইছে আমাদের বাড়িটা ডেভেলপারদের দিয়ে দিতে। বিল্ডিংয়ের কাজ শেষ হলে আটটা ফ্ল্যাট পাওয়া যাবে নাকি। সাথে বড় অঙ্কের টাকা।”
তপার সেদিন বৃষ্টিতে ভেজার পর থেকে এমনিতেই গা ম্যাজমেজ করছিল। তারমধ্যে এই ধরনের কথায় ওর মাথা ধরাটা বাড়ল।
“কিন্তু মা, তুমি বা বাবা কেউ তো এটা চাওনি। তাছাড়া তোমার এত এত স্মৃতির কথা বলতে সেসব?”
“এখন বয়স হয়েছে। স্মৃতি ধরে রেখে আমার আর কাজ কী!” চেষ্টা করেও তিনি নিজের কষ্ট লুকাতে ব্যর্থ হলেন।
“আমি তোর সাথে কথা বলতে বলেছিলাম। কিন্তু ও বলল, তোকে তো তোর অংশ বুঝিয়ে দেয়া হয়েই গেছে। এখন আবার অনুমতি নিতে হবে কেন!”
আসলেই তো, তপা এখন আর কী করতে পারে! ওর ছেলেবেলার কথা মনে পড়ল, ওদের ছোট্ট ছিমছাম সুখী একটা পরিবার ছিল। ছেলেবেলায় তো তুহিন এমন স্বার্থপর ছিল না! কবে থেকে সে এমন বদলে যেতে শুরু করেছিল! না-কি বীজটা আগে থেকেই ভেতরে ছিল, অঙ্কুরিত হতে সময় নিয়েছে!
“আরেকটা কথা তপা।”
মা’কে ইতস্তত করতে দেখে তপা বুঝল সিরিয়াস কিছু বলবেন তিনি, এমন কিছু, যা ওর পছন্দ নয়।
“বলো মা।”
“তুহিনকে কবীর কীসব যেন বলেছে। তোর সাথে একটা ছেলেকে নাকি দেখা গেছে ঘুরতে। এসব নিয়ে তুহিন খুব রাগারাগি করল।”
এবার আর তপা নিজের মেজাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না, “মা, ওই লোকের সাথে তোমার ছেলের এখনো যোগাযোগ আছে কেন? যার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই, সে যা খুশি রঙচঙ মাখিয়ে বললেই তোমরা সেটাকে ধরে নাচানাচি করবে কেন? আমি তোমাদের আপন না ওই লোকটা?”
“তুই তো জানিস, কবীরের কাছ থেকে একবার পাঁচ লাখ টাকা ধার নিয়েছিল তুহিন। সেটার শোধ করেনি। ডেভেলপারের প্রস্তাবটা কবীরই দিয়েছে।”
যেটুকু মেনে নিতে চাচ্ছিল, এখন মন পুরোপুরি বিদ্রোহ করে বসল তপার।
“তোমার ছেলেকে বলে দিও আমার কোনো বিষয়ে যেন সে নাক না গলায়। আমাকে কলও না করে।”
“আমি জানি তুই বুদ্ধিমতী। ডিভোর্সের পরে এমনিতেই লোকে নানা কথা বলছে। এখন এসব কথা ছড়ালে তোর জন্য, দর্পণের জন্য আরও খারাপ হবে, তুই একটু সাবধানে চলাফেরা করিস। আমার টেনশন হয় তোকে নিয়ে।” তিনি আবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে গেলেন।
“মা, কে কী বলল, এসব নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু তুমি আর ভাইয়া কেন বলবে? তোমরা আমাকে চেন না? এখন রাখছি। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।”
কল কেটে দিয়ে মাথা ডেস্কে ঠেকালো তপা। বিয়ের পরে ওই বাড়ি নিয়ে ওর তুলে রাখা সুখস্মৃতিগুলো শেয়ার করেছিল কবীরের সাথে। ওই সম্পর্ক তো কাগজে শুরু হয়েছিল, কাগজেই চুকেবুকে গেছে। একই মায়ের ঔরসে জন্মানো ভাইয়ের সাথে সম্পর্কটা কী করে শেষ করবে!
কবীর বা তুহিনের অবস্থান মানুষ হিসেবে একই মুদ্রার একটা পিঠেই। দর্পণও একদিন বড় হবে! দর্পণকে সে কোনোভাবেই স্বার্থপরতা, কপটতা শেখাবে না। ভালোবাসতে শেখাবে জগতের সমস্ত সৃষ্টিকে, সমস্ত কুৎসিত আর কদর্যতাকে ঘৃণা করতে শেখাবে সে।
এই ভাবনা থেকে রাফিদের কথা মনে পড়ল। এমন মানুষও তো আছে যে অকাতরে অন্যের বিপদে এগিয়ে আসতে পারে, মন খুলে হাসতে পারে। শিরীন আন্টি পেরেছেন, সে কেন পারবে না।
মনে মনে দোয়া চাইল তপা, “আল্লাহ, আমার ছেলেটাকে একজন সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার শক্তি দাও আমাকে।”
***
আজ থেকেই সোমাদের আত্মীয়স্বজন আসতে শুরু করেছে। পরশু বিয়ে, বাড়িতে আলোকসজ্জা করা হচ্ছে। রাফিদ তদারকি করছে এসবের। ছাদে বিয়ের স্টেজ হবে। তার ডেকোরেশন সে দেখছে, কারণ ছবিতে কোন রঙটা সুন্দর আসবে সেসব বিবেচনায় রাখতে হবে। ওয়েডিং ফটোগ্রাফি সে এবারই প্রথম করবে। এসবের জন্য যদি ছবি ভালো না হয়, তখন ওর ক্রিয়েটিভিটির উপরে প্রশ্ন আসতে পারে। ক্রিয়েটিভিটি’র সাথে ‘নো কম্প্রোমাইজ’।
তপা ধোঁয়া উঠা চা ভর্তি মগ হাতে ছাদে উঠে এসেছে। চোখেমুখে চিরাচরিত বিষণ্ণতা। এত আলোর মধ্যেও কেমন ম্লান মুখটা।
রাফিদ কথা শুরুর জন্য এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল, “দর্পণ কোথায়? ঘুমিয়ে পড়েছে?”
“রুমা আপুর ছেলের সাথে খেলছে। আজ মনে হয় না সহজে ঘুমাবে।”
“আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতাম। কিছু মনে না করলে।”
“করুন।”
“সোমা আপনাকে আপু বলে। আপনি…”
তপা মৃদু হেসে বলল, “এটা জিজ্ঞেস করতে এত সংকোচ? একাডেমিক দিক থেকে আমি সোমার দুই ইয়ার সিনিয়র।”
রাফিদ মনে মনে বলল, “মাত্র দুই বছর! অথচ আমার সাথে এমনভাবে কথা বলে যেন আমি সদ্য জন্মেছি।”
মুখে অবশ্য বলল না কথাটা, বরং বলল, “না, শুনেছিলাম, মেয়েদের বয়স জিজ্ঞেস করাটা নাকি অভদ্রতা। তাই..”
“আপনি হঠাৎ বয়সের মাপজোখ নিয়ে পড়েছেন কেন জানতে পারি?”
এর উত্তরে কী বলা যায় ভাবছে রাফিদ।
“না মানে, সোমা তো আপু বলে, তাই…”
“আপনিও আপু বলতে চান?”
“কীহ্! একদম না!”
ভীষণ উত্তেজিত গলায় বলেই রাফিদ অপ্রতিভ হয়ে গেল। ধূর! মাথায় কেন কোনো কথা আসছে না! ‘আসর জমানোর উস্তাদ’ বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া এই খেতাব দিয়ে সে এখন কী করবে! কেউ জানলে ওর মাথা কা টা যাবে তো!
………….
(ক্রমশ)