#নিভৃত_দহনে (পর্ব ১২)
নুসরাত জাহান লিজা
“আমার নিজের আপু নেই তো। তাই আমি আপু ডাকায় স্বচ্ছন্দ নই। এইজন্য ভড়কে গিয়েছিলাম, এই আরকি।” কোনোরকমে এই একটা খোড়া অজুহাত মুখ দিয়ে বের করতে পারল রাফিদ।
“ঠিক আছে। কোনো সমস্যা নেই। আপনি ‘তপা’ই ডাকুন, এখন যেভাবে ডাকেন, এত ফর্মালিটিজের কোনো দরকার নেই।”
রাফিদ আকর্ণ হেসে বলল, “হ্যাঁ, সেটাই। আমরা তো বন্ধুই এখন, তাই না? আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন প্লিজ।”
তপা উত্তরে কিছু বলতেই যাচ্ছিল, তার আগেই রাফিদ ভীষণ দ্রুততার সাথে বলল, “ও, আপনি হয়তো সংকোচ করছেন। আপনি একাই ‘তুমি’ করে বলবেন, আমি ‘আপনি’ সম্বোধন করলে সংকোচ হবারই কথা। দুই তরফ থেকেই ওটা বাদ। হ্যাপি?”
এতগুলো কথা প্রায় এক নিঃশ্বাসে শেষ করল রাফিদ, মাঝে তপাকে কিছু বলার সুযোগ দেয়নি, তাতে বেঁকে বসতে পারে। রাফিদের আপাতত প্রধান উদ্দেশ্য তপার সাথে আরেকটু সহজ হওয়া। একজন সত্যিকারের বন্ধুর মতো পাশে দাঁড়িয়ে হৃদয়ের গভীর গোপন ক্ষততে কিছুটা যদি প্রলেপ দেয়া যায়! কিছু চমৎকার মুহূর্ত উপহার দেয়া যায় যদি! যেখানে কোনো ক্লেদ থাকবে না, কোনো বিষাদ থাকবে না, কেবল নিখাঁদ বন্ধুত্ব থাকবে!
“বন্ধু?”
“হ্যাঁ। আপনি মানেন না? অন্তত শুভাকাঙ্ক্ষী কিন্তু ভাবতেই পারেন।” মুখে মেঘের ছায়া নামল রাফিদের।
তপা হেসে ফেলল, এমন অকপট বন্ধুত্বের প্রস্তাব সে কখনো পায়নি। প্রস্তাব নয়, বরং বন্ধুত্বের ঘোষণা ছিল এটা।
যারা ওর মঙ্গল কামনা করে, তারাই তো শুভাকাঙ্ক্ষী, তাই না! জগৎ থেকে তপার শুভাকাঙ্ক্ষীর সংখ্যা কমতে কমতে প্রায় তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। তাছাড়া রাফিদ এতটাই বন্ধুসুলভ যে ওকে বন্ধু ভাবতে কোনো সমস্যাই হবার কথা নয়। শুভাকাঙ্খা নিয়ে কিছু মানুষ থাকুক নাহয়, সায়েদা আন্টি, সোমা, রাফিদ, মলিনা…
“আন্টির কাছে শুনেছি, তুমি নাকি একসময় গিটার শিখতে, গানও। এখন গান করো না?”
তপার কথায় রাফিদের ভেতরে আনন্দের ফল্গুধারা বয়ে গেল। সে উচ্ছ্বসিত হেসে বলল,
“স্কুলে পড়ার সময় গিটারের প্রতি একটা ফেসিনেশন তৈরি হয়েছিল। পরে ক্যামেরা হাতে উঠে গিটারকে রিপ্লেস করে দিল।”
তপার মনে হলো, পুরোনো ভালোবাসার বিষয়কে ভুলে যাওয়া কতই না সহজ! নতুন একটা ভালোলাগা এসে কেমন আগেরটাকে আড়াল করে দেয়, কিছুদিন পরে আবার অন্যকিছু! স্মৃতির আয়নায় চোখ মেলে তাকালে পুরোনো নিজেকে দেখলে কখনো শিহরণ জাগে ভেতরে, নস্টালজিয়া পেয়ে বসে, একটু হাতড়ে হাতড়ে ছুঁয়ে দেখা হয় স্মৃতি। এরপর আবার ধূলোয় পড়ে থাকে সেটা। মানুষ ফিরে আসে বর্তমানে। পেছনে পড়ে থাকে ছেলেবেলার পুতুল, বল, গিটার ব্যাট, কবিতার বই, খেলার মাঠ, স্কুল-কলেজের বন্ধুরা, ডিবেট ক্লাব, কখনো রেওয়াজ শেখা হারমোনিয়াম, আরও কত কী! সঙ্গী হয় কেবলই বর্তমানের জরা, ব্যথা, ক্লান্তি, আর কখনো কখনো সেই জঞ্জাল থেকে কুড়িয়ে পাওয়া টুকরো আনন্দ। জীবন এমন কেন! কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যেন চোখের কোণ ভিজে আসছিল তপার।
রাফিদের কথায় সচকিত হয়ে উদগত কান্নাকে রুখে দিল তপা।
“দর্পণের সাথে বন্ধুত্ব কবেই পোক্ত হয়েছে। আজ তোমার সাথে হলো। এখন আমাকে একটু হেল্প করো তো তপা।”
“কী হেল্প?”
“রুমা আপুর হাজব্যান্ড তো অন্য তদারকি নিয়ে ব্যস্ত। আমি একা দেখে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। তুমি একটু দেখবে আমি কিছু মিস করে গেলাম কি-না।”
“আমি ছাদে না এলে কী করতে?”
“কী আর করতাম! কষ্ট করে করে নিতাম কাজ। সুযোগের সদ্ব্যবহার আরকি।”
বলেই হেসে ফেলল রাফিদ, এরপর বলল,
“দাঁড়াও, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড দর্পণকে নিয়ে আসি। সেও দেখুক।”
তপার বিষণ্ণতা যেন আরও প্রগাঢ় হচ্ছিল। রাফিদ কারণ জিজ্ঞেস করতে পারে না। তবে খুব করে চাইত কিছুটা আনন্দক্ষণ তপাকে দিতে। কিছু হাসি, কিছুটা আনন্দ, যা জাগতিক দুঃখবোধ কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলিয়ে দেয়!
***
বাড়ি ভর্তি মানুষ আজ। আগামীকাল বিয়ে। এত মানুষের ভীড়ে দর্পণকে ছেড়ে অফিসে যেতে মন সায় দেয়নি তপার। সোমা এসে বিশেষভাবে বলে গেছে, হলুদ শাড়ি পরতে হবে।
এখন এসব হৈ হট্টগোল ওর ভালো লাগে না, খুব দ্রুতই বোধহয় সে বুড়িয়ে গেছে! কিন্তু সোমা, সায়েদা আন্টি ওকে এত ভালোবাসেন যে তপা না করতে পারে না। একটা হলুদ শাড়ি দিয়ে গেছে সোমা। হলুদের জন্য সব কাজিনদের জন্য একইরকম শাড়ি কেনা হয়েছে।
মিউজিক চলছে গতকাল থেকে। রাতে বন্ধ হয়েছিল, সকাল থেকে আবার শুরু হয়েছে। দর্পণ প্রথমে বেশ মজাই পাচ্ছিল, কিন্তু এত লম্বা সময় ধরে সে এসবে অভ্যস্ত নয় বলে একটু সমস্যা হচ্ছিল। তপা ভাবল, ওকে একটু বাইরে থেকে ঘুরিয়ে আনা যাবে, তাছাড়া ওর ওষুধও শেষ। তাও কেনা যাবে।
ভাবতেই দর্পণকে নিয়ে বেরিয়ে এলো।
রাফিদ তখন গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল, ওকে দেখে বলল,
“কোথাও যাচ্ছ?”
“হ্যাঁ। কিছু ওষুধ কিনব দর্পণের আর…”
“আমাকে প্রেসক্রিপশন দিলে আমি এনে দিতে পারতাম।”
“না না, তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। এমনিতেও একটানা এই শব্দ থেকে একটু ব্রেক দেব, আর একটু ঘোরাও হবে ওর। তাই বেরুচ্ছিলাম।”
“আমি আসতে পারি তোমাদের সাথে?”
তপা ইতস্তত করে বলল, “তোমার কাজ নেই?”
“নেই মানে? হাঁপিয়ে উঠেছি বলে রেস্ট নিচ্ছিলাম। ফটোগ্রাফার হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে এখন ওয়েডিং প্ল্যানারও হয়ে গেছি সোমার বিয়ের। ওর কাছ থেকে পেমেন্ট আদায় করে ছাড়ব।”
রাফিদের বলা ভঙ্গিতে মৃদু হাসল তপা। আজ রোদ ঝলমলে দিন। তবে গরম তেমন নেই, বাতাস আছে।
***
তপা আর রাফিদকে গেট দিয়ে বেরুতে দেখলেন শিরীন। তিনি খেয়াল করে দেখেছেন, তপার প্রতি রাফিদের অন্যরকম একটা মায়া জন্মেছে! ওর ছেলের জন্যও। এটা কী কেবলই সহজাত প্রবৃত্তি, না-কি অন্যকিছু আছে!
রাফিদ তার সন্তান, অন্য সবার চোখ এড়িয়ে গেলেও তার চোখে রাফিদের চোখেমুখের আনন্দ, উপচে পড়া খুশি অগোচরে নেই। তিনি ওকে চেনেন।
এক অজানা আশঙ্কায় তার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল! তার সন্তানের জন্য আশঙ্কা! যদি এটা সত্যি হয়, রাফিদ ভীষণ কষ্ট পাবে! এত অসম্ভবকে কেউ ভালোবাসে!
না, রাফিদের সাথে সরাসরি কথা বলতে হবে তাকে, যত দ্রুত সম্ভব।
………
ক্রমশ
#নিভৃত_দহনে (পর্ব ১৩)
নুসরাত জাহান লিজা
“তোমার ফিউচার প্ল্যান কী রাফিদ? ফটোগ্রাফিটাই কি প্রফেশন হিসেবে নেবে নাকি অন্যকিছু?”
ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে রাফিদকে প্রশ্ন করল তপা। এই সময়টায় স্কুল, অফিস আওয়ার বলে পথচারী তুলনামূলক কম। তাই হাঁটতে ভালো লাগছে। তাছাড়া এখানে ঢাকার মতো সর্বক্ষণ অতিরিক্ত মানুষের চাপ নেই।
রাফিদ সহসা উত্তর দিল না, কয়েক মুহূর্ত ভেবে বলল, “আসলে বাংলাদেশে ফটোগ্রাফার হিসেবে তেমন একটা স্কোপ নেই। যদি প্রফেশন হিসেবে ভাবতে চাই আর কী। আমার ইচ্ছে ছিল বাইরে কোথাও চলে যাবার। কিন্তু আমি চলে গেলে মা খুব কষ্ট পাবে। আমার খুশির জন্য কিছু বলবে না, কিন্তু আমি জানি সেটা৷ তবে ফটোগ্রাফি আমি ছাড়তে পারব না।”
তপা একবার রাফিদের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো, ছেলেটার চোখে আশ্চর্য ভাবালুতা। ছবি তোলার সময় কী ভীষণ অন্যরকম আনন্দ ওর চোখেমুখে ফুটে উঠে তা তপা দেখেছে। উপলব্ধি করেছে ভয়াবহ রকম প্যাশনেট না হলে এতটা সম্ভব নয়। এতটা ভালোবাসার যে ফটোগ্রাফি, তা কেমন নির্দ্বিধায় মায়ের জন্য ছাড়তে চাইছে!
অথচ তুহিন! মাকে একবার আন্তরিকভাবে জিজ্ঞেসও করেনি যে মা বাড়িটা ভাঙতে মন থেকে রাজি কি-না। তার কত স্বপ্ন জুড়ে আছে এটা তো ওর অজানা নয়! মানুষে মানুষে কত বৈপরীত্য!
“আমার মনে হয় কী জানো তপা? সব মানুষকেই কেন একটা চাকরি কিংবা ব্যবসার পেছনে ছুটতে হবে? ওটাই কি একমাত্র ক্যারিয়ার? এর বাইরের পৃথিবীতে কত কী আছে আবিষ্কারের, কত কী দেখার আছে! সেসবের পিছে কেউ ছুটতে চাইলে কেন পেছন থেকে অট্টহাসি হেসে তাকে ছুঁড়ে ফেলা হবে? কিছু মানুষ থাকুক না তার স্বপ্ন নিয়ে।”
তপা মৃদু হেসে বলল, “এরকম স্বপ্ন অনেকেরই থাকে। কিন্তু বাস্তবতা যখন তাদের স্বপ্নে আঁচড় ফেলতে থাকে, তখন বাধ্য হয়ে তারা নিরাপত্তা খুঁজতে চায়। জীবনের মৌলিক চাহিদার নিরাপত্তা। তখন ওই স্বপ্নগুলো কোথায় হারিয়ে যায়, আর খুঁজে দেখবারই অবকাশ হয় না সহসা। হঠাৎ কোনো একদিন হয়তো ভীষণ নিঃসঙ্গ কোনো মুহূর্তে মনে পড়ে, ‘আরে, আমার তো অন্য একটা জগৎ ছিল’! পরের দিনের কর্মব্যস্ততা আবার সেই মুহূর্তের অতৃপ্ত দীর্ঘশ্বাসটুকু শুষে নেয়।”
মুহূর্তের জন্য রাফিদের পা থমকে গেল। তপার সাথে জীবনদর্শনের কতটা ফারাক রাফিদের। তবুও আজ এইসব কথা শুনতে ওর বিরক্ত লাগল না কেন যেন! কথাগুলো অনেকের জন্য ঠিক, কিন্তু রাফিদ তো স্রোতের বিপরীতে চলা মানুষ। জন্মগতভাবে সামাজিক অবস্থানের দিক থেকেও সে আশীর্বাদপুষ্ট, ‘প্রিভিলেজড’। খাওয়া-পরার চিন্তা কখনো ওকে করতে হয়নি। তেমন হলে কি সে জীবন নিয়ে এখন যা ভাবে সেভাবে ভাবতে পারত! কী জানি!
“তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় নিজের ভেতরের তাড়নাতেও সাড়া দেয়া উচিত। আত্মার তৃপ্তি না থাকলে রক্তমাংসের একটা কাঠামো ছাড়া মানুষের আর কী-ই বা থাকে বলো তো? তুমি তাদের যে দীর্ঘশ্বাসের কথা বলে, সেই দীর্ঘশ্বাস কি তাদের আদৌ ভালো থাকতে দেয়? আমি ইঁদুর দৌড়ে বিশ্বাসী নই। আমি মানসিক শান্তিতে বিশ্বাসী। আমার শান্তি আমার প্যাশনের মধ্যে।”
তপা ম্লান হেসে ভাবল, রাফিদ জীবনের অলিগলিতে হয়তো হেঁটেছে, কিন্তু সেসব অলিগলির ঘুপচিতে কখনো পা মাড়ায়নি। জীবন তার কাঠিন্য ওকে দেখায়নি কিংবা সে নিজেই দেখতে চায়নি। বয়সের চাইতে মানুষ পরিণত হয় অভিজ্ঞতায়। তপা জীবনের অনেক কদর্য রূপ দেখেছে, রাফিদ দেখেনি এখনো। তাই বোধহয় সে এতটা সুখী, এত সুন্দর করে হাসতে পারে। সহসা রাফিদকে কিঞ্চিৎ ঈর্ষা হলো তপার। জীবনের সব জটিলতাকে সে কেন এত সহজভাবে ভাবতে পারে না!
হঠাৎ ওদের বিপরীত পাশের ফুটপাতের কিছুটা সামনে ভীষণ হট্টগোল শোনা গেল। ওরা দ্রুত পা চালালো সেদিকে। দর্পণ তপার কোলের মধ্যে এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে কখন যেন। হৈচৈতে জেগে উঠল।
শোনা গেল একটা চো র ধরা পড়েছে পালাতে গিয়ে। শুনেই রাফিদ ছুটে গেল সেদিকে। তপা দর্পণকে নিয়ে খুব দ্রুত হাঁটতে পারছে না, তবুও যতটা দ্রুত সম্ভব পা চালালো।
উত্তেজিত জনতার ভীড় সেখানে। তাদের মধ্যে কয়েকজন লোকটা উত্তম মধ্যম দিতে শুরু করেছে। বাকিরাও উদ্যত হচ্ছে। রাফিদ হাঁচড়েপাঁচড়ে ঢুকে পড়ল ভীড়ের মধ্যে। কিছু মা র ওর উপরেও এসে পড়ল লোকটাকে উদ্ধার করতে গিয়ে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে কথা কেউ শুনতে চায় না। রাফিদ ভেতরে ঢুকে পড়ল একেবারে লোকটার সামনে। এরপর ভীষণ কর্তৃত্বপরায়ণ গলায় বলল,
“ওকে আপনারা পুলিশে ধরিয়ে দিন। এভাবে কাউকে মারার অধিকার আপনার আমার নেই।”
তবুও কিছু অতি উৎসাহী লোক ক্ষান্ত হচ্ছে না, কিন্তু কয়েকজন রাফিদকে সমর্থন করল। রাফিদ আবারও তার গাম্ভীর্য ধরে রেখে বলল,
“কারোর জীবনের মূল্যের কাছে অন্যকিছু মূল্যবান নয়। লোকটার কিছু হয়ে গেলে আপনারা ঘুমাতে পারবেন রাতে? মনে হবে না, যে একটা মানুষের জীবনের ঋণ রয়ে গেছে আপনার? আপনি একজন খু নী? একজন মানুষের র ক্তের দাগ লেগে রয়েছে আপনার হাতে? দেশে আইন আছে, তারা বিচার করবে। আমরা বিচারক নই। শাস্তি দেবার দায়িত্বপ্রাপ্ত যারা আছে, তাদেরকে সহযোগিতা করুন।”
রাফিদের অভিব্যক্তিতে ঠিকরে পড়ছিল ব্যক্তিত্বের প্রাবল্য। ওর অত্যাশ্চর্য দৃঢ়তায় এবার ক্ষান্ত হলো লোকজন। দর্পণ রাফিদকে মা র মু খী জনতার ভিড়ে ঢুকে পড়তে দেখে ভ য়ে কাঁদছে। তপা এখানে একা থাকবে ভেবে অনেকগুলো প্রয়োজনীয় ফোন নম্বর সেভ করে রেখেছিল মোবাইল ফোনে। হেঁটে আসতে আসতেই লোকাল থানায় কল করে ইনফর্ম করেছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ চলে এলো, লোকটাকে থানায় নিয়ে গেল, রাফিদসহ কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে পরিস্থিতি শুনল। এরপর কয়েকজনকে স্বাক্ষী হিসেবে যেতে বলল তাদের সাথে।
তপা আজ অন্য একজন রাফিদকে দেখল। সদা হাস্যোজ্বল ছেলেটার কী দুর্দান্ত সাহস! অন্যায় মেনে না নেবার কী দুর্দমনীয় শক্তি। ওই সময় দেখলে কে বলবে এই ছেলেই কী নির্মল হাসি হাসতে পারে।
তপা এগিয়ে এসে বলল, “ব্রাভো ম্যান।”
রাফিদ মৃদু হাসল, কিছুটা যেন লাজুক আভা ফুটল গালে।
“ওরকম অবস্থায় যেভাবে ঢুকে পড়লে, তোমার ভয় করেনি?”
রাফিদের মধ্যে আবার নিজের আগের সত্তা ফিরে এলো, “ভয় তো কিছুটা ছিলই। কিন্তু শুধু ভয়ের জন্য এতবড় একটা অন্যায় চোখের সামনে দেখেও পিছিয়ে আসব কী করে! ওখানে যারা লোকটাকে মা র ছিল, তাহলে তাদের সাথে আমার পার্থক্য থাকল কই। বিবেকের খোঁচায় আমিও তো রাতে ঘুমাতে পারতাম না।”
তপা বহুদিন পরে মন থেকে হাসল, “তোমার মতো একজন মানুষ আমার বন্ধু, ভাবতেই গর্ব হচ্ছে।”
রাফিদ মনে মনে বলল, “আমি তো আরও বেশি কিছু হতে চাই তোমার। এটা জানলেও কি এই গর্ব থাকবে নাকি ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেবে, তপা?”
মুখে বলতে পারল না। কয়েক মুহূর্ত আগেই যে অসীম সাহস বুকে এসে ভর করেছিল, তা যেন কোথায় মিলিয়ে গেল। বরং আশঙ্কার মেঘ ঘনীভূত হলো হৃদয়ে।
“থ্যাংক ইউ, তপা।”
“কেন?”
“আমাকে তোমার বন্ধু ভাবার জন্য।”
দর্পণ এবার রাফিদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল নিজে থেকে। রাফিদ কোলে নিতেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। এই শিশুটাও ওকে নিজের আপন ভেবেছে, ওর বিপদের আশঙ্কায় কেঁদেছে! ভাবতেই কী যে আনন্দ হলো ওর।
***
শিরীন বিকেলে তপার ঘরে এলেন, এটা সেটা নিয়ে নানান কথার পরে তিনি বললেন, “তোমার সামনে তো গোটা জীবন পড়ে আছে। দর্পণও খুব ছোট। নতুন করে আবার চিন্তা করবে না কখনো?”
তপা মৃয়মান গলায় বলল, “আমার এখন পুরো জগৎটা দর্পণকে কেন্দ্র করে আন্টি। তাছাড়া ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায়।”
শিরীন বুঝলেন তার আশঙ্কাই সত্যি। তিনি এই কথাটা জানতেই এসেছিলেন৷ তার ছেলের জীবনের প্রশ্ন এখানে। তাই ভেবেছিলেন তপার মনোভাব জানবেন। ওরও কী রাফিদের প্রতি মুগ্ধতা আছে!
কিন্তু বুঝলেন পুরোটাই রাফিদের দিক থেকে এক তরফা। তপাকে তিনি যেটুকু চিনেছেন, তাতে এটুকু উপলব্ধি করেছেন, মেয়েটা ভীষণ শক্ত ধাতের। আত্মসম্মানবোধ অত্যন্ত প্রখর। মেয়েটাকে তার ভালোই লাগে। কিন্তু সে-ই তো…
তিনি সিঁড়ি উঠতে উঠতে কিছুটা অসুস্থ বোধ করলেন। রাফিদের ঘরে এসে দেখলেন সে নেই। ছাদে আছে বোধহয়। বিয়ের কত আয়োজন ওকে দেখতে হচ্ছে। আজ রাতেই তিনি ছেলের সাথে কথা বলবেন৷
অঙ্কুরে যেটুকু কষ্ট হবে, বৃক্ষে রূপান্তরিত হবার পরে তার শিকড় সমেত উপড়ে ফেললে যন্ত্রণা হবে বহুগুণ। ছেলেকে তার বোঝাতেই হবে।
………..
ক্রমশ