নিভৃত দহনে পর্ব-১৪+১৫

0
45
নিভৃত দহনে পর্ব-০১
নিভৃত দহনে

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ১৪)
নুসরাত জাহান লিজা

রাতে খাবার পরে রুমে এসে রাফিদ দেখল মা বসে আছেন। তিনি হেসে বললেন,

“খাওয়া হলো?”

“হ্যাঁ মা। উফ্, সারাদিন যা ধকল গেল। কাল তো আরও যাবে।”

“হুম। এদিকে এসে বোস। কথা বলি তোর সাথে।”

রাফিদ মায়ের কোলে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল। মাথাটা ব্যথা করছে মা, একটু চুলে বিলি কেটে দাও তো।”

ছেলের মুখে অনাবিল হাসি দেখে তার মন ভালো হয়ে গেল। ছেলেবেলা থেকেই সবসময় এমন করে কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ত রাফিদ। তিনি আগের মতো বিলি কেটে দিতে লাগলেন পরম মমতায়।

“সিলেটে এসে দিব্যি ভীষণ ভালো আছিস মনে হচ্ছে।”

রাফিদের হাসি বিস্তৃত হলো, “হুম। অনেক ভালো লাগছে এবার এসে।”

“বিশেষ কোনো কারণ আছে?”

রাফিদ আয়েসে চোখ বন্ধ করে ছিল, এবার ঝট করে চোখ খুলে মা’র দিকে তাকিয়ে দেখল, তিনি অন্তর্ভেদী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন। সে বুঝল, ওর অনুভূতি মা’র অগোচরে নেই। সবার কাছ থেকে লুকাতে পারলেও এই একজনের কাছ থেকে সে কিছুই আড়াল করতে পারবে না।

রাফিদ উঠে বসে মায়ের হাত ধরে বলল, “বিশেষ কারণ আছে মা।”

“কারণটা নিজের মুখে আমাকে বলা যায়?”

“আমি কোন বিষয় তোমার কাছ থেকে লুকিয়েছি?”

“এবার কিন্তু নিজে থেকে জানাসনি।”

“আমি নিজেই সদ্য জেনেছি মা। তাই। আমি বলতাম তোমাকে।”

“ভালোবাসিস তপাকে?”

রাফিদ মাথা নেড়ে বলল, “হুম।”

“কেন?”

“এত ব্যাকরণ খুঁজিনি তো মা। শুধু জানি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি, সাথে দর্পণকেও। ওদের সাথে আমার সময় কাটাতে ভালো লাগে। মনে হয় ইশ্, সময়টা যদি থেমে থাকত! দর্পণ যখন হাসে আমার মনে হয় সেই হাসিটা আমি সারাদিন ধরে দেখি। তপার বিষণ্ণ মুখটা দেখলে নিজেকে ভীষণ তুচ্ছ মনে হয়। মনে হয় ওর এক টুকরো হাসি ফোঁটার কারণ কেন সবসময় হতে পারি না।”

ছেলের স্বপ্নাতুর চোখ দেখতে দেখতে শিরীনের মন আবারও আশঙ্কাগ্রস্ত হয়। তিনি রাফিদের গালে হাত রেখে বললেন, “কিন্তু বাবা, তপা তো এটার জন্য প্রস্তুত নয়।”

“আমি অপেক্ষা করব মা৷ যতদিন লাগে আমি অপেক্ষা করতে রাজি আছি।”

“যদি কখনো ও রাজি না হয়? তুই ভীষণ কষ্ট পাবি।”

“এখনই এসব ভাবতে চাই না আমি।” রাফিদের গলায় আর্তস্বর।

“যদি তপা রাজিও হয়, তোর বাবা, ও তো মানতে চাইবে না। সমাজ…”

“তপা যদি সবকিছুর সাথে এত লড়াই করে জীবনে এগিয়ে যেতে পারে, আমি কেন ভালোবেসে ওর পাশে দাঁড়াতে পারব না মা? তাছাড়া সমাজের ভয় আমি কবেই বা করেছি!”

“তবুও আমার মনে হয়, তুই ওকে ভুলে যা বাবা। এখনও সময় আছে। একটা অসম্ভব জিনিসের পেছনে ছুটে নিজেকে কষ্ট দিস না।”

“ভালোবাসার উপরে যে মানুষের নিয়ন্ত্রণ থাকে না, সেটা আমি এই কয়েকদিনে উপলব্ধি করেছি মা। আগে কখনো এমন মনে হয়নি। এখন বুঝতে পারি, কেন মানুষ তার ভালোবাসার মানুষের একটুখানি মন ভালো রাখার জন্য এত স্যাক্রিফাইস করে। জীবনের পথে চলতে চলতে আচমকা কোথাও বাঁধা পড়ে যায় মানুষ। সেই অদৃশ্য সুতোর বাঁধনে এতটা শক্তি যে সমস্ত জাগতিক সুখকেও তুচ্ছ মনে হয়। যন্ত্রণাও সয়ে নেয়া যায়। আমি সব সহ্য করতে পারব মা, শুধু তুমি কোনো আপত্তি করো না প্লিজ। তুমি আমার জীবনীশক্তি। তুমি যদি আমাকে নিরাশ করো, আমার জন্য পথটা আরও কঠিন হবে মা। আমি তো ভালোবেসেছি। অন্যের জন্য ক্ষতিকর কিছু করিনি। তুমি আমার পাশে থাকবে না মা?”

শিরীনের ভেতরটা হু হু করে উঠল এক পৃথিবী হাহাকারে। তার ছেলেটা ভীষণ অন্যরকম। একইসাথে ড্যাম কেয়ার আবার ভীষণ সংবেদনশীল। এই দুটো বৈপরীত্য ওর মধ্যে বিচিত্রভাবে সহাবস্থানে আছে। তবে এমন কাতর আর্তি এর আগে কোনোদিন ছেলের মুখে শোনেননি। এতটা করুণ আবদারও আগে শোনেননি।

রাফিদ তার একমাত্র সন্তান। সমাজের ভয় তিনি পান না। পেলে বহুবছর আগে তিনি জয়নুলের হাত ধরতে পারতেন না। তাছাড়া তপাকে তিনি যেটুকু চিনেছেন তাতে এটুকু উপলব্ধি করেছেন মেয়েটা খুব ভালো। মেয়েরা দৃঢ়চেতা হলে অনেকের অপ্রিয় হয়ে উঠে। ডিভোর্সের পরে একটা মেয়ে ভেঙেচুরে না গিয়ে মাথা উঁচিয়ে লড়াই করতে গেলেও লোকে সেটা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করতে, নোংরা ইঙ্গিত করতে পিছপা হয় না। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোটাও তো প্রত্যেকের অধিকার। তিনি একজন নারী বলেই হয়তো অন্য নারীকে এতটা ভালোমতো পড়তে পারেন! তার আশঙ্কার জায়গাটা ভিন্ন।

আট বছর বয়সে ছেলের একবার ভীষণ অসুখ করেছিল, মাসখানেক বিছানায় পড়েছিল। তখন তিনি যেভাবে ভয় পেয়েছিলেন, হঠাৎ করে তেমন একটা বুকে কাঁপন তোলা ভয় তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। তিনি রাফিদের মাথায় হাত রেখে মৃদু গলায় বললেন,

“আমি এটুকু জানি তুই কোনো ভুল করবি না। সবসময় তোর সাথে ছিলাম, সামনেও আছি। কিন্তু বাবু, যা করবি ভেবেচিন্তে করিস। ও যদি রাজি হয়েও যায়, তারপর? মোহ আর ভালোবাসা, দুটোর মধ্যে বিস্তর ফারাক। একদিন গিয়ে যদি তোর এখনকার ভালোলাগা কেটে যায়? যদি মনে হয় দর্পণ তোর নিজের সন্তান নয়? তখন ওই মেয়েটা আরেকবার ভেঙে পড়বে। ওকে ভালো রাখতে গিয়ে আগের চাইতেও বড় আঘাত দিয়ে ফেলবি তখন। মানুষের মন সবসময় পরিবর্তনশীল। আজ যেটা ছাড়া মনে হবে জীবন বৃথা, কাল তা বোঝা মনে হতে পারে। পাবার আগে একটা জিনিস যত সুন্দর মনে হয়, পেয়ে গেলে বেশিরভাগ সময়ই সেটা কেটে যায়। তখন আর ওই জিনিসটা আমাদের টানে না।”

রাফিদ এবার মায়ের কাঁধে মাথা রেখে বলল, “আমি অনেক ভেবেছি মা। বিশ্বাস করো। এই এক সপ্তাহে আমি শুধু ভেবেছি। তুমি হয়তো মনে করতে পারো, যে সৌমির সাথে এত সহজভাবে ব্রেকআপ হয়ে গেল, সেটা তপার সাথেও হতে পারে! কিন্তু মা, দুটো অনুভূতি পুরোপুরি আলাদা। সৌমির সাথে আমার সম্পর্ক ভেঙেছে কিছুদিন আগে, কিন্তু তিক্ততা জমছিল আরও অনেক আগে থেকে। আর এখন বুঝতে পারি সেই সম্পর্কে ভালোবাসা অবশ্যই ছিল, কিন্তু গভীরতা ততটা ছিল না। গভীরতা থাকলে ও সাথে সাথে বিয়ে করে ফেলতে পারত না, আমিও এতটা নির্বিকার থাকতে পারতাম না। তুমি চিন্তা করো না মা, আমি এমনকিছু করব না যা তোমার আদর্শকে, তোমার শিক্ষাকে ছোট করে।”

“একটা কবিতা পড়েছিলাম, তোমার রবীন্দ্রনাথের, পুরোপুরি মনে নেই, শুধু একটা লাইন মনে আছে, ‘কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’! তোমার নিজের ভালোবাসার পথটাও মসৃণ ছিল না, তুমি কিন্তু বাবার সাথে সংসার করছ।”

তিনি ছেলের মাথায় হাত রেখে বললেন, “আল্লাহ তোর সকল ইচ্ছে পূরণ করুন। তুই সুখী হ, বাবা।”

বাইরে থেকে আচমকা দরজা নক করা হচ্ছে।

“আসতে পারি?”

অপ্রত্যাশিত পরিচিত গলা শুনে দু’জনেই উঠে দাঁড়ালো।

“এসো।”

ভেতরে এসে দাঁড়ালো জয়নুল। কোনো খবর ছাড়া এখানে তাকে দেখার প্রত্যাশা অন্তত মা-ছেলে কেউই করেনি।

“তুমি? তুমি আসবে আমাকে আগে বলোনি তো?”

শিরীনের গলায় বিস্ময়, তা উপভোগ করে জয়নুল বললেন, “আগে বললে, তোমার এই বিস্মিত মুখটা দেখতে পারতাম না। তাছাড়া সায়েদা এত করে বলল, ভাবলাম চলে আসি। ও আমাদের এত সাহায্য করেছিল, এভাবে ফেরাই কী করে?”

রাফিদ ততক্ষণে সামলে নিয়েছে নিজেকে।

“তুমি কেমন আছো রাফিদ?”

“ভালো। তুমি কেমন আছো?”

‘’ভালো। তুমি আমাকে দেখে খুশি হওনি মনে হচ্ছে।”

রাফিদ এই কথার উত্তর দিল না। বাবার সাথে ওর দূরত্ব বিস্তর। কেউই কারোর সাথে তেমন সহজ হতে পারে না।

রাফিদ ভাবছিল বাবার এভাবে হঠাৎ আগমনের কারণ কী! উদ্দেশ্য ছাড়া তিনি এক পাও নড়েন না।

জয়নাল সাহেব এসেছেন এক ঢিলে দুই পাখি মারতে। প্রথমটা সায়েদার কথা রাখতে। আরেকটা কারণ রাফিদ।

সে যতই গাইগুই করুক এবার তিনি ওকে ঘরমুখো করতে বদ্ধপরিকর। সব ব্যবস্থা তিনি করে ফেলেছেন৷ প্রয়োজনে বাধ্য করবেন। ছেলের খামখেয়ালী তিনি আর বরদাস্ত করবেন না। ফেরার সময় ছেলেকে সাথে নিয়েই ফিরবেন।

***
সোমার সাথে পার্লারে এসেছে তপা। বিয়ের আগেরদিন রাতে রবিনের সাথে একচোট ঝগড়া হয়েছে সোমার।

ঝগড়ার বিষয়টা খুবই শিশুসুলভ। কিন্তু তপার মজাই লেগেছে। তবে দর্পণকে আনলেই বোধহয় ভালো হতো। এত লম্বা সময় লেগে যাবে, সে বুঝতে পারেনি।

সোমার সাজ পছন্দ হয়নি, এত বিশেষ একটা দিন ওর জন্য। এত আয়োজন, অথচ আজই কিনা এমন লাগবে! এমন তো না যে আজ যা হয়েছে হয়েছে, পরে আবার ঠিকমতো সাজগোজ করা যাবে!

তাই মুখ ভালো করে ধুয়ে মেকআপ তুলে আবার নতুন করে সাজানো হচ্ছে। সে বায়না করেছে তপাকেও এখান থেকে একেবারে সেজে বেরুতে হবে।

গতকাল হলুদের কথা মনে পড়ল ওর। হলুদ শাড়িটা পরেছিল। রাফিদ দর্পণের জন্য একটা হলুদ জামা এনে দিয়েছিল। কী সুন্দর লাগছিল দর্পণকে। রাফিদ অনেকগুলো ছবি তুলেছে। ওর কাছ থেকে ছবিগুলো নিতে হবে।

তপা ভাবল অনেকদিন সাজের অভ্যাস নেই। ইচ্ছেও নেই। কিন্তু সোমার জন্য আজ এত আনন্দের একটা দিন। ওকে এভাবে দেখলে বেচারি মন খারাপ করবে। তাই ভাবল একেবারে হালকা করে এখান থেকে সাজবে। যে সময় লাগছে, বাসায় গিয়ে আর সময় হবে না। সায়েদা আন্টি গতকাল ওকে একটা শাড়ি উপহার দিয়েছেন আজ পরার জন্য। তাদের অনুভূতিকে সে খাটো করতে পারে না।

সাজ প্রায় শেষের দিকে, তখন ওর ফোনটা বাজল।

“রাফিদ, বলো।”

“আমি পার্লারের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি, দর্পণকে নিয়ে এসেছি।”

“ওকে নিয়ে এসছো কেন? আজ বাইরে ওয়েদার দেখেছ?”

“কী করব বলো, তোমাকে খুঁজছিল। কাঁদছিল। ওর কান্না সহ্য হচ্ছিল না, তাই নিয়ে এলাম।”

তপার চুল ঠিক করা হয়নি তখনো, কিন্তু আর এক মুহূর্ত বসল না। দর্পণ কাঁদছিল, এটা শোনার পরে সে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো, সোমাকে বলল,

“আমি দর্পণকে নিয়ে আসছি।”

বাইরে আসতেই দেখল দর্পণকে একেবারে তৈরি করে নিয়ে এসেছে রাফিদ। রাফিদের গায়ে খয়েরী রঙের একটা পাঞ্জাবী, দর্পণের গায়েও। ওকে তাকাতে দেখে রাফিদ বলল,

“সায়েদা আন্টি দিয়েছেন পাঞ্জাবি। ওরটা আমারটার যেদিন মাপ দেয়া হয় সেদিন অর্ডায় দেয়া হয়েছিল।”

তপা হেসে দর্পণকে কোলে নিল। রাফিদ তপার দিকে এবার ভালো করে তাকাল। চুলগুলো এলোমেলো, তবে এই শাড়িতে ভীষণ মানিয়েছে। এত রঙিন শাড়ি পরতে সে কখনো তপাকে দেখেনি। অন্যরকম লাগছে মেয়েটাকে। যেন একটা রঙিন প্রজাপতি!

দর্পণের জন্য চিন্তিত হয়ে ছুটে এসে সন্তানকে দেখে যে হাসিটা হাসল তপা একেবারে ভেতর থেকে উৎসারিত হাসি। সেই হাসিটা এত সুন্দর! রাফিদ একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে।
………
(ক্রমশ)

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ১৫)
নুসরাত জাহান লিজা

তপাকে প্রথম দেখেই মনে ধরেছিল কবীরের। তখন বিয়ে করার কথা ভাবছিল, ওকে দেখে মনে হলো ওর বউ হিসেবে এই মেয়েটাই পারফেক্ট হবে। এমন সুন্দরী একটা মেয়েই সে মনে মনে চাইছিল, প্রেজেন্টেবল, ওর পাশে দাঁড়ালে নিজের গ্ল্যামার আরও বাড়বে। সাথে খোঁজখবর নিয়ে জানল মেয়ে মধ্যবিত্ত ঘরের, তখন ওর আগ্রহ বেড়ে গেল।

কবীরের প্রচুর টাকা, এমন বিলাসবহুল জীবন পেলে যেকোনো মেয়েই ওকে তোয়াজ করে চলবে সারাজীবন। শাড়ি, গহনার স্তুপের মধ্যে বসে বসে ওর ঘরের শোভাবর্ধন করবে, লোকের চোখ কপালে উঠবে, “আহা, ভাগ্য বটে কবীরের! টাকা, সাথে সুন্দরী বউ!”

আরেকটা কারণ হলো, বাইরের দুনিয়ায় কবীর কী করল না করল তা নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাবে না। তপা বিয়েতে রাজি হলে বন্ধুমহলে কবীর হেসে বলেছিল,

“বলেছিলাম না রাজি হবে, এরা আদতেই গোল্ড ডিগার হয়। এত টাকাওয়ালা পাত্র হাতছাড়া করার মতো বোকামী কেউ করে না-কি!”

বিয়ের পরেই কবীর উপলব্ধি করল, তপাকে যেমন ভেবেছিল তেমন নয়। তবে ‘ইমোশনাল ফুল’। গদগদ হয়ে একটু প্রশংসা করলেই গলে যায়।

স্ত্রীর মন রক্ষার জন্য কিছুদিন সে পুতুপুতু ধরনের প্রেমও করেছে ওর সাথে। ব্যাস, আর কী লাগে। ওর প্রেমে তখন নতুন বউ হাবুডুবু।

টাকার সাথে সাথে সে সুপুরুষও বটে। কত মেয়ে ওর আগে-পিছে ঘুরেছে, কবীর অবশ্য কাউকে না করেনি কখনো। আবার হ্যাঁ-ও বলেনি। নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছে অনেক মেয়েকে। সে আগুন, পতঙ্গ তো ছুটে আসবেই। ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ এই নীতিতে চলেছে সবসময়। সে বিয়ে করে ফেলায়, সেসব মেয়েদের মন ভেঙেছে। তা ভাঙুক, সে তো কাউকে সেধে গিয়ে বলেনি, ওর পিছে পড়ে থাকতে!

বিয়ের ছয়মাস পর কবীরের মনে হতে থাকে, তপা আসলেই একটু অন্যরকম। দামী গিফট পেয়েও অনেকসময় এটা-সেটা প্রশ্ন করে বসে। শান্তিতে যে বাসায় বসে একটু পানীয়ের তৃষ্ণা মেটাবে তাও সম্ভব হচ্ছিল না। মাঝেমধ্যে ঝগড়াও লেগে যায়। হিসেবে যেন কোথাও ভুল মনে হয় কবীরের।

কবীর চেষ্টা করে তপাকে কী করে দমানো যায়, সে তপার চারিত্রিক ত্রুটি খুঁজতে থাকে। ওর মনে হয় একটা মেয়ে যখন এত ভালো এমন দেখাচ্ছে, নিশ্চয়ই ওর অগোচরে কিছু আছে। অনেক চেষ্টা করেও সে কিছু পায় না।

এরপর নতুন করে ফাঁ দ পাতে, অন্য একটা নম্বর থেকে তপাকে উস্কাতে থাকে। কিন্তু পাত্তা পাওয়া যায় না। কবীরের সন্দেহবাতিকগ্রস্ত মন অন্য উপায় খুঁজতে থাকে। একটা বড় ধরনের ত্রুটি। যা দিয়ে মেয়েটাকে দমানো যাবে।

যে বন্ধুমহলে সে দম্ভভরে তপাকে বলেছিল, ‘’গোল্ড ডিগার” তারা তাকে নিয়ে উপহাস করতে শুরু করে। কবীর কারোর উপহাস বসে বসে শুনবে এমন মানুষই নয়। তাদেরই একজন বলল,

“বাচ্চা নিয়ে নে। একটা বাচ্চা হয়ে গেলে দেখবি, আর তোর উপরে চোখ রাঙাবার সাহস পাবে না। নিজে তো কিছু করে না, বাচ্চাসহ বাপের বাড়িতে কয়দিন থাকবে! তখন তোর নাম জপবে সারাদিন।”

এই আইডিয়াটা ওর পছন্দ হয়। যদিও এখনই সে সন্তান চায় না, তবে তপাকে হাতে রাখতে হলে এর বিকল্প নেই। একটা সাধারণ মেয়ে ওকে ছেড়ে যাবে, এটা ওর জন্য চূড়ান্ত অপমানের। তাই এত নাটুকে আচরণ।

উত্তরাধিকার সূত্রেই ওর এত সম্পদ। তবে ওর প্রবল আরাধ্য হলো ক্ষ ম তা। যত বেশি টাকা, তত বেশি মানুষের আনুগত্য। এই সম্পদ সে বহুগুণে বাড়িয়েছে, সব যে সঠিক পথে তাও নয়। অনেক আঁকাবাঁকা পথে ওর পা পড়েছে। এসব নিয়েই তপার কৌতূহল, প্রায়ই প্রশ্ন করে,

“এত টাকা কোত্থেকে আসে তোমার?”

কবীর মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হয়, না চাইতেই সব পাচ্ছে যেখানে, সেখানে এত প্রশ্ন কেন! তবে সে হাসিমুখে জবাব দিত, “সব তো তোমার জন্য। আমাকে এরজন্য কত পরিশ্রম করতে হয়।”

“এত টাকার তো দরকার নেই। যা আছে, যথেষ্ট। এত পরিশ্রম করতে হবে না।”

বিয়ের এক বছরের মাথায় তপা একদিন এসে বলে ওর কিছু বন্ধুরা মিলে একটা চ্যারিটি ফাউন্ডেশন খুলবে, পথশিশুদের নিয়ে। সে-ও ওদের সাথে কাজ করতে চায়। বাচ্চাদের পড়াবে ফ্রি তে। সাথে ওদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে।

কবীরের ভালো লাগেনি কথাটা, সে বলল, “ওদের ডোনেশন দিয়ে দিও। তোমাকে কেন ওদের সাথে কাজ করতে হবে!”

“এত ভালো একটা উদ্যোগ, আমি সাথে থাকব না?”

“সেটা তো নিষেধ করিনি। কিন্তু রাস্তার বাচ্চাদের কেন তোমার গিয়ে পড়াতে হবে!”

“রাস্তার বাচ্চা মানে কী? ওরা ছোট্ট শিশু। মানুষ। তোমার কাছ থেকে এই ধরনের কথা আমি আশা করিনি।” সেদিন প্রথম তপার তেজ দেখেছিল কবীর।

অনেক পাত্তা দিয়েছে সে, সেদিন ওর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে, “তুমি দরকার হলে ওদের যা লাগে সব টাকা দাও। কিন্তু তুমি আমার স্ত্রী, রাস্তায় নামার আগে কথাটা ভুলে যেও না।”

“তোমার স্ত্রী সেটা আমার একটা পরিচয়, কিন্তু আমি নিজেও একটা আলাদা সত্তা, কথাটা মনে হয় তুমি ভুলে গেছ। তাছাড়া আমার বন্ধুরা যারা এত চমৎকার একটা উদ্যোগ নিয়েছে, তারা ভিখারি নয়। তোমার টাকা দিয়ে তুমি অংশ নিতে পারবে। আমার তৃপ্তি কোথায়?”

সেদিন কবীরের ইচ্ছে হয়েছিল চড় মেরে সোজা করতে। কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল, কারণ ওর মাথায় তখন সন্তানের পরিকল্পনা। তবে এইসব চ্যারিটি ফ্যারেটি করার সম্মতি দেয়নি। অনেক মাথায় তোলা হয়েছে আর নয়। যেসব জনসেবায় স্পন্সর টন্সর পাওয়া যায়, সেসব করা যায়। এসব অতি মোরালিটি’র কী দরকার ওর টাকা দিয়ে!

কবীর তুহিনকে টাকা দেয় ব্যবসার জন্য। এটাও ওর একটা পরিকল্পনা। তপার পরিবার ওর পক্ষে থাকলে তপাকে কোনঠাসা করে রাখা যাবে। কিন্তু একদিন…

এতকিছু করেও কবীর নিজের হার ঠেকাতে পারল না। চরম অপমানিত হয়েছে সে নিজের পরিচিত গণ্ডিতে। ওর দয়া আর করুণায় লালিত পালিত শ্রেণির অনেকেও আড়ালে আবডালে ওকে নিয়ে হেসেছে ডিভোর্সের পরে। হাতের গ্লাসটা ছুঁড়ে ফেলে দিল কবীর। তপার কথা মনে হলেই ভেতরটা ফুঁসে উঠে ওর।

ওর বাড়িটা নাকি ওর স্মৃতির জায়গা, শান্তির জায়গা। তপা অসম্ভব ঘাড়ত্যাড়া, বেয়াদব মেয়ে হলেও ওর ভাইটা ওর মতো খারাপ নয়। বুদ্ধি আছে। নিজের অঙ্কের একটা ভুল সমাধানের হিসেব মেলাতে মেলাতে ভাবল কবীর।

***
সোমা একের পর এক্সপ্রেশন দিয়ে যাচ্ছে। একটা মেয়ে ছবি তুলতে কত ভালোবাসে রে! ক্লান্তি নেই এতটুকু। অথচ রাফিদ ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যেই সে বারকয়েক তপা আর দর্পণের খোঁজ নিয়েছে।

ওকে দেখলেই দর্পণ ওর কোলে আসতে চাইছে। ছবি তোলার ফাঁকে কয়েকবার নিয়েছেও। কিন্তু সবসময় পারছে না বলে বাবু মন খারাপ করছে। ইশ! যদি ছবি তোলার দায়িত্ব না থাকত, কত্ত ভালো হতো।

ওদের দুজনেরও ছবি তুলেছে। রাফিদ আর দর্পণের একইরকম পাঞ্জাবি, তাই তপা ওদের ছবিও তুলে দিয়েছে।

এরমধ্যে একটা ছবি সে শুধু তপার তুলেছে। সেটার জন্য অনুমতি নেয়া উচিত ছিল। কিন্তু মেয়েটা রাজি হবে না। পরক্ষণেই মনে হয়েছে অনুমতি একবার তো নেয়াই হয়েছে৷ বারবার নেবার প্রয়োজন আছে! এই নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্ব চলছে ভেতরে। যাই হোক, শূন্যে দৃষ্টি মেলা উদাস এক তরুণী ক্যামেরা বন্দী হয়েছে। অন্যায় কিছু তো নয়!

তপা দর্পণকে খাইয়ে দিতেই একবার রাফিদ এসে দর্পণকে কোলে নিয়ে বলল, “তুমি খেয়ে নাও। আমি ওকে রাখছি।”

মলিনা নিচে সায়েদা আন্টির সাথে আছে। তার যদি সাহায্য হয়, সেজন্য তপাই থাকতে বলেছে।

রাফিদ আরেকবার এসে দেখল তপা ভীষণ ঘামছে, সে কোত্থেকে একটা ছোট্ট রিচার্জেবল হ্যান্ডফ্যান এনে দিয়ে গেল। প্রচন্ড গরম পড়েছে আজ, মনে হয় বৃষ্টি হবে।

রবিনের সাথে ছবি তোলার সময় সোমা ওর ফোন থেকে কিছু ছবি দেখিয়ে সেরকম ভঙ্গিতে এক্সপ্রেশন দিতে বলল। কিন্তু রবিন বেচারার ক্যামেরা শাইনেস আছে বলে মনে হলো। সে পারছে না। সোমার অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছিল সে কেঁদে ফেলবে। এতদিন ধরে সে স্বপ্ন দেখেছিল বিয়ের দিন এভাবে-ওভাবে, কত ছবি তুলবে। কিন্তু এমন নিরামিষ ছেলে সব ভণ্ডুল করে দিল।

সে দুঃখ পেয়ে বলল, “এমন নিরামিষ একটা মানুষ কেন তুমি?”

রবিন বলল, “নিরামিষ মানুষকেই তো ভালোবেসেছো।”

এরপর ফিসফিসিয়ে বলল, “তোমার ভালোবাসায় আমিষ হয়েও যেতে পারি। সেজন্যই তো দ্রুত বিয়েটা করে ফেললাম।”

সোমা কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল, আশেপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ শুনেছে কি-না কথাগুলো। সে লাজুক মুখেই কপট রাগ দেখিয়ে রবিনের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

“নির্লজ্জ।”

রবিন হেসে ফেলল, সাথে সাথে শাটার চাপল রাফিদ। এই ছবিটা চমৎকার হয়েছে। এত মিষ্টি লাগছে দুজনকে।

দূরে তাকিয়ে একবার তপাকে দেখল রাফিদ, এমন একটা দিন কী ওদের জীবনে আসবে!

ভালোবাসা মানুষকে কতটা বদলে দেয়। বিয়ে নিয়ে ওর একটা অনীহা তৈরি হচ্ছিল, কিন্তু এখন চাতকের মতো অপেক্ষা করছে কবে আসবে সেই ক্ষণ, আদৌ আসবে তো!

***
জয়নুলের চোখ সারাক্ষণ রাফিদের উপরেই ছিল। ওই মেয়েটার প্রতি ছেলের যে একটা দুর্বলতা তৈরি হয়েছে, তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। তিনি কথায় কথায় দুই একজনের কাছ থেকে জেনেছেন, মেয়েটা ডিভোর্সি, তার উপর একটা বাচ্চাও আছে।

তার একটা মান সম্মান আছে, তিনি জীবনে বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজকের এই অবস্থানে এসেছেন। ছেলের খেয়ালীপনার জন্য তিনি হেয় প্রতিপন্ন হতে রাজি নন। তাছাড়া তার ছেলেটা বড্ড অস্থির স্বভাবের, আজ এটা নিয়ে মেতে থাকে তো কাল অন্যটা।

তিনি তার ব্যবসায়ী বন্ধুকে কথা দিয়েছেন, তার মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দেবেন। মেয়েটা বেশ ভালো। এই ডিভোর্সি মেয়ের মোহ কাটতেও সময় লাগবে না বলেই তার বিশ্বাস।

রাফিদের এই মুহূর্তের দুর্বলতা তিনি জেনে গেছেন। ছেলেকে ঘরে ফেরাতে সেই দুর্বলতাকে অ স্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে তিনি পিছপা হবেন না। সন্তানের ভালোর জন্য এটুকু তিনি করতেই পারেন। রাফিদকে তার সাথে ফিরতেই হবে।
………….
(ক্রমশ)
কেমন লাগছে?