নিভৃত দহনে পর্ব-১৬+১৭

0
34
নিভৃত দহনে পর্ব-০১
নিভৃত দহনে

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ১৬)
নুসরাত জাহান লিজা

ইলার ডেলিভারির সময় যত ঘনিয়ে আসছে, মেয়েটা কেমন মনমরা হয়ে যাচ্ছে। তুহিনের বাইরে ব্যস্ততা বেড়েছে। স্ত্রীকে তেমন একটা সময় দিতে পারে না। বাড়িতে জহুরা চেষ্টা করেন পুত্রবধূকে সময় দিতে। সাথে সাথে থাকার চেষ্টা করেন। এটা-সেটা গল্প করেন।

বাবার বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, প্রথম সন্তান জন্মের সময় তারা চেয়েছিলেন মেয়ে তাদের সাথে থাকুক। ইলার মা মারা গেছে ওর বিয়ের কিছুদিন পরেই৷ তারপর থেকে বাবার বাড়িতে যায় না সে। এবারও না করে দিয়েছে। তুহিনও বলল, এখানেই থাকতে। ওর এখন শ্বশুর বাড়ি গিয়ে থাকার সময় নেই।

তুহিন ফেরে আটটার পরে, এরপর যেটুকু সময় দিতে পারে সেটুকুই ইলার স্বস্তি। এত ব্যস্ততার কী আদৌ প্রয়োজন ছিল!

জহুরার নানারকম চিন্তার শেষ নেই। সবচাইতে বড় চিন্তা তপাকে নিয়ে। মেয়েটা বড্ড একগুঁয়ে। চলার পথে কখনো কখনো সমঝোতা করতে হয়, সে এসবের ধার ধারে না। ভীষণ আশঙ্কা হয় তার, ওইটুকু একটা সন্তান নিয়ে কত দূরের একটা অচেনা জায়গায় গিয়ে একা একা থাকছে।

এখন আবার বাড়ির চিন্তা। সাথে ঘরেও শান্তি নেই খুব একটা। তুহিনের সাথে ইলার প্রায়ই কথা কাটাকাটি লেগে যাচ্ছে ইদানিং। তিনি তুহিনকে বলেছেন,

“মেয়েটার এই অবস্থায় তোর আরেকটু সংযত হওয়া উচিত।”

“মা, আমার ব্যবসাটা এখনো ঠিকঠাক দাঁড়ায়নি। আমার এত সময় কই। বউয়ের পেছনে পড়ে থাকলে কয়দিন পরে পথে বসতে হবে।”

জহুরা তার বাড়ির দিকে তাকান, এই বাড়িটা তার শ্বশুর সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে করেছিলেন। এর বাইরে আসলেও তাদের তেমন স্বচ্ছলতা নেই। সারাজীবন কেটেছে হিসেব করে, এটা নিয়ে তার কখনো আক্ষেপ হয়নি। এসবের মধ্যেই তিনি ভালো থাকতেন। তার স্বামী একটা চাকরি করতেন, হিসেব করা টাকায় মাস যেতেই টানাটানি পড়ত। দোতলা বাড়িটা ভাড়া থেকে যা আসত তা জমা হতো। ভবিষ্যতে কোন কাজে লাগে!

তুহিন প্রথমবার ব্যবসা করতে গিয়ে সেই সমস্ত টাকা খুইয়ে ফেলেছে। অল্পকিছু মূলধন ছিল, এরপর আবার কবীরের কাছ থেকে ধার নিয়ে নতুন করে শুরু করেছে কয়েক বছর ধরে। লোকসান হয় না এখন, কিন্তু লাভও খুব একটা হয় কি-না, তা তার ছেলেই ভালো বলতে পারবে।

জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে তার মনে হয়, এত দীর্ঘ জীবন না পেলেই হয়তো তার ভালো হতো। একটা ছোট্ট সুখী সুখী সংসারের ছবি নিয়েই তিনি ওপারে চলে যেতে পারতেন, জানেন এসব ভাবনা ঠিক নয়। তবুও প্রচণ্ড হতাশা তাকে ভাবতে বাধ্য করে।

জহুর তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ছিলেন, তখন দরজায় শব্দ হলো। তিনি সালাম ফিরিয়ে দরজা খুললেন। তুহিন হন্তদন্ত হয়ে বলল,

“মা, ইলাকে মনে হয় হাসপাতালে নিতে হবে। অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে না।”

তিনি ছুটে এলেন। রাতে সাড়ে তিনটায় হাসপাতালে ছুটতে হলো তাদের। যখন খবর এলো যে কন্যা সন্তান হয়েছে, মা মেয়ে সুস্থ আছে, তখনই দূরের মসজিদ থেকে ফজরের আজান ভেসে এলো। তিনি বহুদিন পরে বাইরে তাকিয়ে ভোরের নতুন সূর্যোদয় দেখলেন৷ অনেক অস্বস্তির খবরের মধ্যে এই খবরটা ভীষণ প্রশান্তিদায়ক।

***
একটু আগের কোলাহল থিতিয়ে পড়েছে। সোমাদের বাড়িটা এখন একেবারে শান্ত। সায়েদা মাঝেমধ্যেই কেঁদে ফেলছেন। যতই আশেপাশে স্বস্তি খুঁজতে যান, আসলে যে আজকের পরে তিনি একা হয়ে গেলেন এই উপলব্ধিই একটা শূন্যতা তৈরি করেছে ভেতরে। অপরদিকে মেয়ের খুশি দেখেও খুশি হয়েছেন ভীষণ।

বদলী হবার আগ পর্যন্ত যদিও সোমা আরও কিছুদিন থাকবে এখানে। তারপরও মন প্রবোধ মানছে না তার। শিরীন তার সাথেই ঘুমান। আজ বেশিরভাগ আত্মীয়স্বজন চলে গেছেন, তবুও তিনি তাকে একা ছাড়লেন না।

***
রাফিদ ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল, গত কয়েকদিন ভীষণ ঝক্কি গেছে ওর উপর দিয়ে। ক্লান্তিতে দু চোখ ভেঙে আসছে। এরমধ্যে জয়নুল এসে বললেন,

“যাক ঘুমাওনি তাহলে। তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।”

“বলো।”

“কালই চলে যেতে চাইছিলাম। কিন্তু সায়েদা মানছে না, তাই পরশু ফিরিছি আমরা। সব গোছগাছ করে নিও।”

“আমি সিলেটে আরও কিছুদিন থাকব। তোমরা যাও।”

“আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। এটাই ফাইনাল। আমাদের সাথেই ফিরবে তুমি।”

“আমি বললাম তো..”

রাফিদকে থামিয়ে দিলেন জয়নুল, “তোমার বিয়ের পাকা কথা হয়ে গেছে। আমি ইকবাল ভাইকে কথা দিয়েছি। তার মেয়ে তরীর সাথে তোমার বিয়ে হবে। তুমি ফিরে গিয়ে তরীর সাথে দেখা করবে।”

“আমার বিয়ে?” তড়িতাহত রাফিদ অস্ফুটস্বরে বলল কথাটা। এরপর সম্বিত ফিরে পেয়ে ক্ষুব্ধ গলায় বলল,

“জীবনটা আমার। কাকে বিয়ে করব সেটা তুমি ঠিক করে দিতে পারো না।”

“তো তুমি নিজে ঠিক করবে? কাকে?”

রাফিদ উত্তর দিল না, জয়নুল বললেন, “ওই বাচ্চাওয়ালা ডিভোর্সি মেয়েকে?”

এবার রাফিদ চমকে উঠল, সে ঝট করে মুখ তুলে বাবার দিকে তাকাল, “সেদিন তোমার মায়ের সাথে যখন কথা বলছিলে কারোর জন্য অপেক্ষা করতে চাও, তখন আমার কানে এসেছিল কথাগুলো। কিন্তু মেয়েটা কে, আজকে তোমার অবস্থা দেখে নিশ্চিত হলাম।”

রাফিদ জীবনে প্রথমবার ভয় পাচ্ছে, নিজের জন্য নয়। তপার জন্য। বাবা যদি তপাকে অপমান করে বসেন।

“তুমি আমার সাথে ফিরে বিয়েতে রাজি হলে ভালো। আর না ফিরতে চাইলেও সমস্যা নেই। ওই মেয়েকে অপমানিত হতে দিতে চাও নাকি সুবোধ বালকের মতো আমার কথা মেনে নিতে চাও, সেই ডিসিশন তোমার।”

রাফিদের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো, তীব্র রাগ দমাতে হাতের মুঠি শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল, তপাকে সে কখনো অপমানিত হতে দিতে পারবে না ওর জন্য। আবার ওকে ভুলে বিয়েও করবে না সে কখনো।

বেশ খানিকটা সময় লাগল নিজেকে ধাতস্থ করতে, বাবার ঠোঁটের কোনে বিদ্রুপের হাসি।

“তুমি যদি ভেবে থাকো, তপাকে অপমান করে তুমি শান্তি পাবে সেটা তোমার ভুল ধারণা বাবা। তোমার আসলে সন্তানের প্রয়োজন নেই। একটা পাপেট প্রয়োজন, যাকে তুমি তোমার ইচ্ছায় নাচাতে পারবে। তপাকে খারাপ কিছু বললে, আমার চোখে কতটা নিচে নেমে যাবে ভেবেছ? সন্তানের শ্রদ্ধা চির জীবনের জন্য তুমি হারিয়ে ফেলবে। এবার তুমিও ঠিক কোরো, তুমি কোনটা চাও। একটা নির্দোষ মেয়েকে অপমান করে নিচে নেমে যেতে নাকি সম্মানটুকু ধরে রাখতে!”

জয়নুলের চোখে চোখ রেখে কথাগুলো বলল রাফিদ। জয়নুল ক্ষণকাল নীরব রইলেন, ছেলের চোখের ওই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে পর্যবেক্ষণ করলেন। এরপর বললেন,

“ঠিক আছে। এবার আমি কিছু বলব না। কিন্তু তুমিও মনে রেখো, তুমি যা চাইছ তা কখনো হবে না। আমার একটা সম্মান আছে সোসাইটিতে। সেই সম্মান আমি খোয়াব না কিছুতেই। তোমাকে এক সপ্তাহের সময় দিলাম। এরমধ্যে বিয়েতে সম্মতি না দিলে ওই মেয়ের কোনো ক্ষতি করতে আমার খুব বেশি কাঠখড় পোড়াতে হবে না৷ ধরো যদি ওর চাকরিটা চলে যায়, ওইটুকু সন্তানকে নিয়ে তোমার জন্য ওর পথে বসতে হবে। ও তোমাকে তখন ভালোবাসবে তো?”

বলেই বেরিয়ে গেলেন, রাফিদকে আর উত্তর দিতে না দিয়ে। রাফিদের ঘুম বহু আগে উড়ে গেছে। মনটা ভীষণ বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে।

ওই চাকরিটুকুই তো মেয়েটার সম্বল। অনেক এনজিওর সাথেই বাবার উঠা বসা আছে। এটা করা তার জন্য অসম্ভব নয়। সাত দিন অনেক সময়, ওকে ভাবতে হবে। কীভাবে এটা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়, তার একটা পথ নিশ্চয়ই বের করবে সে। নইলে ভালোবেসেছে কেন!

মনের বিক্ষিপ্ত বিক্ষুব্ধ অবস্থা কাটাতে সে ছাদে এলো। ঘুম আগেই বিদায় নিয়েছে চোখ থেকে। ক্লান্তিতে, ক্ষোভে মাথা ফেঁটে যাবার যোগাড়।

এখনো আলোকসজ্জা আছে। ছাদে উৎসবের ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সুদূর আকাশের ওই স্নিগ্ধ চাঁদ আর অজস্র তারারা যেন ওকে সঙ্গ দেবার অভিপ্রায়ে জ্বলজ্বল করছে। মনকে কিছুতেই সে প্রবোধ দিতে পারছে না।

“এখনো ঘুমাওনি? তুমি না বললে সোমার বিয়ে শেষ হলেই এমন ঘুম দেবে যে চব্বিশ ঘণ্টা ঘুমাবে!”

পরিচিত গলায় সে পেছনে তাকিয়ে তপাকে দেখল। উত্তর দিল না।

“কী হয়েছে? শরীর খারাপ করেছে?”

রাফিদের মধ্যে সদা প্রাণোচ্ছল ব্যপারটি নেই। যারা সবসময় হাসিখুশি থাকে, তাদের হঠাৎ মন খারাপ হলে তা সকলের চোখে পড়ে।

“না, ঠিক আছি।”

“কিছু তো একটা হয়েছেই। নইলে এমন গোমড়ামুখো রাফিদকে তো কখনো দেখিনি আগে।”

তপার মুখে মৃদু হাসি, রাফিদ বলল, “তুমি আমাকে বোঝো তপা?”

তপা হেসে বলল, “এটুকু বুঝি যে আজ তোমার মন ভালো নেই। মন খারাপ থাকলে নিজের সবচাইতে ভালো লাগার কাজগুলো করতে হয়৷ তাহলে দেখবে মেঘ কেটে যাবে।”

রাফিদের কাছে তখন পুরো পৃথিবীটাই যেন বিস্মৃতির অতলে। মন পুরোপুরি কালো মেঘের দখলে, হারিয়ে ফেলার দুশ্চিন্তায় সে অস্থির হয়ে উঠেছে ভেতরে। পাওয়ার আগেই যদি হারিয়ে ফেলে! তাছাড়া রাফিদ কখনো কপটতা শেখেনি। মনে এক মুখে আরেক এভাবে সে থাকতে পারে না। কিছুই সে ভাবতে পারল না, কী বলছে না বলছে নিজেও জানে না, তবুও গলায় স্বর ফুটল।

অস্ফুটস্বরে সে ঘোরগ্রস্ত হয়ে নিজের হাতটা সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

“তুমি কি আমার হাতটা একবার ধরবে তপা?”

নিমিষেই তপার মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে গেল, এক পৃথিবী কাঠিন্য এসে ভর করল তপার মুখাবয়বে।

সে ইস্পাত দৃঢ় গলায় বলল,

“না।”

এরপর হনহনিয়ে প্রায় ছুটে দুদ্দাড় নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে।

তপার চলার শব্দে সে সচকিত হলো, কত বিশাল বড় ব্লান্ডার সে করে ফেলেছে বুঝতে পারল। রাগে, ক্ষোভে সে নিজের হাত দিয়ে কার্নিশে আঘাত করল।

মনে হলো ওর হৃদপিণ্ডটা কেউ যেন খামচে ধরেছে। পুরো পৃথিবীর উপরে, বাবার উপরে, নিজের উপরে ওর অসম্ভব রাগ হলো। সে কার্নিশে হেলান দিয়ে বসে পড়ল।
………
(ক্রমশ)

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ১৭)
নুসরাত জাহান লিজা

একটা অসীম স্বপ্নের ভেলায় ভাসছিল রাফিদ, সেই ভেলা যেন নিমিষের ঝড়েই ডুবে গেল অতল বিষাদী সমুদ্রে। যে সমুদ্রের থৈ নেই। সে হাবুডুবু খাচ্ছে। ওর দম আটকে আসছে। বুকের ভেতরের নিঃসীম হাহাকার ওর টুঁটি চেপে ধরে আছে যেন সর্বশক্তিতে।

সে তো তপাকে ভালো রাখতে চেয়েছিল, নিজেই কি-না ওর কষ্টের কারণ হয়ে গেল! রাফিদের মনে হচ্ছে সে যেন মুহূর্তেই নিঃস্ব হয়ে গেল। যে চোখ বন্ধুত্ব দেখতে শুরু করেছিল, সে চোখেই কী করে নিজের জন্য ঘৃণা দেখবে! সে পারবে না, ওর দুঃসাহসও হার মানছে আজ।

তপা যদি ওকে সবার সাথে গুলিয়ে ফেলে! ভাবে আট-দশজন অন্য ছেলেদের মতো সে-ও মেয়েদের সম্মান দিতে জানে না! এটা সে কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না।

তপাকে আরও ভালো করে আবিষ্কার করতে চেয়েছিল সে, নিজেকে আরও মেলে ধরতে চেয়েছিল ওর কাছে। ওই প্রান্তের মানুষটা ওকে ‘এক্সেপ্ট’ করতে পারবে কি-না, বা আরও কতটা পথ হাঁটতে হবে, তা বুঝে মনের দুয়ার খুলতে চেয়েছিল। আজ কেন তবে ওর সংযম বাঁধ মানল না।

দুই হাতে নিজের চুলগুলো খামচে ধরে আকাশের দিকে তাকাল রাফিদ। দূর দিগন্তে ভেসে থাকা ওই রাতের সারথিরাও আজ রাফিদকে এক ফোঁটা স্বস্তি দিতে ব্যর্থ হলো।

চির বহমান সময় বয়ে গেলে, কিন্তু সে কতক্ষণ ধরে ছাদে একইভাবে বসে রইল তার হিসেব ওর কাছে রইল না। যখন নেমে বিছানায় গা এলিয়ে দিল, তখনও তীব্র অস্বস্তি একটা ছোট্ট বিষকাঁটা হয়ে যেন ওর হৃদপিণ্ডে খোঁচাতে থাকল। চোখে পাতায় ঘুম নামল না একফোঁটা। এই রাত তার সমস্ত আঁধার জেঁকে বসে রইল ওর হৃদয়ে।

***
সকাল হতেই তপার ঘুম ভাঙল, দর্পণ এখনো উঠেনি। গতকাল আগে আগে ঘুমিয়ে পড়েছিল বলে মাঝরাত থেকে জেগে বসেছিল, ভোরের দিকে ঘুমিয়েছে।

রাতে রাফিদের কাণ্ডের কথা মনে পড়ল। তপার মনে হচ্ছিল, সে কী রাফিদকে বেশি প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেছিল, যার জন্য ওর মনে এরকম একটা আশা জন্মেছে! ছেলের নিখাঁদ বন্ধুত্বের প্রস্তাব ফেরায়নি সে। তখন সত্যিই মনে হয়েছিল রাফিদের মধ্যে পুরোপুরি বন্ধু হবার মতো একটা ব্যপার আছে। রাফিদও যে আর দশটা ছেলের মতো বন্ধুত্বের পরে এভাবে এগুতে চাইবে এটা তপা ভাবতে পারেনি। ছেলেটাকে ওর অন্যরকম মনে হয়েছিল। মানুষ চিনতে কী সে আবারও ভুল করল! না, এভাবে হবে না। ওকে আরও শক্ত হতে হবে!

আজ মলিনা আসবে না। তপাও ছুটি নিয়েছে। হাতমুখ ধুয়ে দর্পণের খাবার বানাচ্ছিল, তখনই ঘুম ভেঙে গেল দর্পণের৷ দর্পণকে ফ্রেশ করে দিয়ে নিয়ে টেবিলে বসল। ছেলেকে খাইয়ে নিজেও খেয়ে নিল। এরপর মাকে কল দিল।

তুহিনের মেয়ে হয়েছে রাতে, ওকে ছবি পাঠিয়েছে। এত মন খারাপের মধ্যে এই খবরটা স্বস্তির। ভাইয়ের সাথে যতই বনিবনা না হোক, ওর সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানের সেসবের দায় নেই। তপা সেভাবে ভাবেও না।

ভিডিও কলে আরেকবার শিশুটাকে দেখল, ইলার সাথে কথা বলল। কিন্তু ভাই-বোন একে অপরকে যেন খানিকটা এড়িয়েই গেল।

এরমধ্যে দর্পণ উশখুশ করতে শুরু করল বাইরে যাবার জন্য। কিন্তু তপা পণ করেছে আজ সে কোনোভাবেই রাফিদের মুখোমুখি হবে না৷ দর্পণ একটু পরপর হামাগুড়ি দিয়ে দরজার কাছে গিয়ে দরজা ধরে ধরে উঠে দাঁড়াচ্ছে, এরপর ধাক্কা দিচ্ছে। মুখে অবোধ্য শব্দ করে বোঝাতে চেষ্টা করছে, ঘরের এই দম বন্ধ পরিস্থিতিতে সে থাকতে চায় না।

তপা ওকে কোলে করে বিছানায় তুলে দিল। এরপর ওর যত খেলনা আছে সব বের করে দিল। কিছুক্ষণের জন্য এসবে মেতে উঠে আবারও হাঁপিয়ে গেল। এবার জেদ শুরু করেছে। কিন্তু তপা অনড় রইল। একসময় দর্পণ চিৎকার করে কান্না শুরু করল।

***
রাফিদের ঘুম এসেছিল সকালের দিকে। তবে তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। সে বাগানে বসে অপেক্ষা করছিল কখন দর্পণ বাইরে আসবে। ওর সাথে কিছুক্ষণ খেললে হয়তো ভেতরটা শান্ত হতো। কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও তার দেখা মিলল না।

কিছুক্ষণ পরে দর্পণের অনবরত কান্নার সুর ভেসে আসছিল, তবুও ওই ঘরের কপাট খুলল না, তখন যা বোঝার সে বুঝে নিল। ছোট্ট শিশুটা ওর কাজের জন্য কষ্ট পাচ্ছে। এটা ভাবলেই মনটা বিষিয়ে যাচ্ছে ওর।

শেষমেশ মায়ের কাছে গেল। শিরীন রাফিদকে দেখে কাছে ডাকলেন।

“কী রে? খাবি না?”

“খেতে ইচ্ছে করছে না মা। আমি তোমার কোলে একটু মাথা রাখি মা?”

ছেলের কাতর স্বর শুনে তার মুখাবয়বে দুঃশ্চিতার ছাপ পড়ল। তিনি বসে কোল পেতে দিলেন ছেলের জন্য। রাফিদ গুটিশুটি মেরে মায়ের কোলে মাথা রাখল।

“তোর কী হয়েছে বাবা?”

“কিছু না তো মা।”

তিনি রাফিদের মুখটা দুই হাতে আলতো করে ধরে পরিমাপ করলেন যেন কিছু একটার। এরপর বললেন,

“মাকে মিথ্যে বলবি?”

“আচ্ছা মা, ভালোবাসলে কি সবসময় কষ্ট পেতে হয়?”

“কষ্ট করে পাওয়া যায় বলেই তো ভালোবাসা অমূল্য বাবা। তুই তো কষ্ট মানতে রাজি। তাহলে সেটা সইতে এত কষ্ট হচ্ছে কেন?”

রাফিদ বাবার বলা কথাগুলো মাকে বলল। এরপর বলল,

“আমি এখন যাব না মা। এখানে আমার এক পুরোনো বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছিল৷ ও এখানেই থাকে। এখানে থেকে মিনিট পাঁচেকের দূরত্ব। ওর ওখানে কিছুদিন থাকব।”

“তোর বাবার কথার জন্যই শুধু তোর মন খারাপ? নাকি আরও কিছু আছে?”

“তোমাকে তো সব বলিই মা। এটা এখন বলব না৷ পরে বলব। তুমি শুধু আমাকে এটুকু বলো তো মা, তুমি আমাকে এত বোঝো কীভাবে?”

“আমি তোকে পেটে ধরেছিল, তোর জীবনের সব ধাপে তুই আমার এই দুই হাতে বেড়ে উঠেছিস ধীরে ধীরে। আমি তোকে বুঝব না? আমি তোকে পড়তে পারি।”

রাফিদ এবার চুপচাপ শুয়ে রইল। শিরীন ছেলের মাথায় স্নেহার্দ্র স্পর্শ দিতে লাগলেন।

***
রাফিদ একসময় ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল৷ তখনও দর্পণের কান্না ভেসে আসছিল বন্ধ দরজার ওপার থেকে। ওর সহ্য হচ্ছিল না। কিন্তু নক করার মতো সাহস সঞ্চয় করতে পারল না।

ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। ভোরের দিকে বৃষ্টি হয়েছে। পথঘাট ভেজা। সেই ভেজা পথ ধরে সে হাঁটল উদ্দেশ্যহীন।

কয়েকবার ছবি তোলার চেষ্টা করল। কিন্তু হলো না। প্রিয় ক্যামেরাটাও আজ বড্ড অসহ্য লাগছে। দর্পণের ওই কান্না ওর ভেতরে তড়পাচ্ছে। কিছুতেই কোথাও মন বসল না।

শেষমেশ ফিরে এলো। গেটের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে দেখল তপা ভেতরে ঢুকে আবারও দরজা বন্ধ করে দিল। তারমানে মেয়েটা সে না থাকায় বেরিয়েছিল দর্পণকে নিয়ে। ওর আসার আভাস পেয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল৷

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক বেয়ে। কিন্তু ওই শিশুর কান্না থামছেই না আজ। অবশেষে রাফিদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। সে তপার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নক করতেই যাচ্ছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে থেমে গেল।

এভাবে তপার বাসায় নক করা ঠিক হবে না। মেয়েটা ওকে দেখলেই আর দরজা খুলবে না। অধৈর্য হয়ে যদি সে জোরে ধাক্কাধাক্কি শুরু করে! পাছে লোকে ভুল বোঝে, সাথে তপা! এসবের পরোয়া সে করে না, কিন্তু তপা যদি কিছু মনে করে!

রাফিদ আবারও বাগানে নেমে এলো। এরপর মুঠোফোন বের করে তপাকে কল করল। কিন্তু মেয়েটা ধরল না। রাফিদ কয়েকবার চেষ্টা করে বুঝল, ওটা বেজেই যাবে, লাভ হবে না।

সে টেক্সট করল একটা,
“তপা, প্লিজ, দর্পণকে একবার আমার কাছে আসতে দাও। ও এসব কিচ্ছু বোঝে না। আমি প্রমিজ করছি, তোমাকে একটুও বিরক্ত করব না। শুধু দর্পণকে একবার দেবে আমার কাছে? প্লিজ?”

এটা পাঠিয়ে আবার লিখল, “আমি মন্দ ছেলে নই। প্রমিজ রাখতে জানি।”

কিছুক্ষণ পরে তপার দরজা খুলল, রাফিদ এগিয়ে গেল। দর্পণের দিকে হাত বাড়াতেই সে ঝাপিয়ে চলে এলো ওর কোলে। ভীষণ কাঁদছে সে। রাফিদের গালে, কপালে আঁচড়ে দিচ্ছে নখ দিয়ে। চাপড়ও দিচ্ছে। যেন সারাদিন কেন সে ওর কাছে আসেনি, ওকে ওই দম বন্ধ করা ঘর থেকে উদ্ধার করেনি, এর শাস্তি দিচ্ছে ছোট্ট অভিমানী দর্পণ।

রাফিদ আদর করতেই ওকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। রাফিদের ভেতরে কী যেন হয়ে গেল মুহূর্তেই। মনে হলো এই নিষ্পাপ, পবিত্র শিশুটিকে ছাড়া সে বাঁচবে কী করে! এত অল্প সময়ে ও যে ওর জীবনের একটা অংশ হয়ে উঠেছে।

তাকিয়ে দেখল, তপা কোনো কথা না বলেই ভেতরে চলে গেছে।

দর্পণের অভিমান ভাঙিয়ে ওর সাথে খেলছে রাফিদ। সারাদিন পরে খোলা জায়গা পেয়ে হঠাৎ হঠাৎ খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে।

রাফিদ সেই হাসি দেখে দর্পণকে কোলে নিয়ে গালে চুমু খেয়ে বলল,

“আমার ফিরে যাবার সময় হয়ে আসছে। তোকে ছাড়া আমি বাঁচব কীভাবে বাবা?”

দর্পণ কী বুঝল রাফিদ জানে না, তবে সে ওর চোখে হাত দিয়ে পানি মুছে দিতেই উপলব্ধি করছিল, রাফিদের অবচেতনেই কখন যেন ওর চোখ দুটো ভিজে উঠেছিল। বুঝতেই পারেনি।

এক পৃথিবী মায়ায় এই শিশুটি কী করে ওর কষ্টটা বুঝল, তা লাঘব করারও চেষ্টা করছে।

এক পাথুরে রমনীর একজোড়া শীতল চোখ, আর এর এক জোড়া মায়াময় ছোট্ট হাত! এত মায়া সে কাটাবে কী করে! ও তো পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে যাবে!
…………..…
(ক্রমশ)