নিভৃত দহনে পর্ব-১৮+১৯

0
34
নিভৃত দহনে পর্ব-০১
নিভৃত দহনে

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ১৮+১৯)
নুসরাত জাহান লিজা

রাফিদ বরাবরই প্রাণখোলা সদালাপী মানুষ। জীবনের সমস্ত উচ্ছ্বাস ওকে সর্বদা ঘিরে রেখেছে। মনের মর্জিমতো সে চলেছে। হিসেবের খেরোখাতা নিয়ে কখনো হিসেব মেলাতে বসেনি। জীবনের লাভ-ক্ষতি নিয়ে কোনোদিন ভাবেনি। ইচ্ছে মতো ছুটে বেড়িয়েছে যেখানে খুশি, এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।

রাফিদের বন্ধু এবং আশেপাশের অনেকেই ওর জীবন নিয়ে ঈর্ষা করেছে, কেউ বলেছে, “জীবন হোক তোর মতো। কোনো ভাবনা চিন্তা নাই, কোনো ঝুট-ঝামেলা নাই, বিন্দাস লাইফ।”

বন্ধু, পরিজন, শুভাকাঙ্ক্ষী সবার কাছ থেকে সে ভালোবাসা পেয়ে এসেছে, অন্যের যেকোনো ধরনের সমস্যায় সবার আগে যাকে পাওয়া যায়, সে তো রাফিদই। এমন মানুষকে ভালো না বেসে কেউ পারে।

রাফিদ যখন সৌমিকে বেছে নিল, তখন কিছু মেয়ের নিশ্চিতভাবে কপাল চাপড়েছে। ওদিকেও বেশ আগ্রহ ছিল ওর প্রতি। সৌমির সাথে এতবছরের সম্পর্কও ওর প্যাশনকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। বেঁধে রাখতে পারেনি। কারণ আজন্ম সে বাঁধন হারা মানুষ।

সেই রাফিদ তারুণ্যের মধ্যগগনে এসে বাঁধা পড়ল তপা আর দর্পণের কাছে। তপার গভীর চোখের এক পলকের শীতল দৃষ্টি রাফিদের সমস্ত প্রাণোচ্ছ্বাস যেন কেড়ে নিয়েছে এক লহমায়। জীবনটা একেবারে পানসে মনে হচ্ছে৷ ভেতরটা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাচ্ছে প্রতিটা মুহূর্তে।

ছবি তুলতে পর্যন্ত পারছে না।

ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশ পাতাল ভাবছিল রাফিদ। বাবা-মা আজ ফিরে গেছেন। যাবার আগে বাবা রাফিদকে ডেকে একপ্রকার হুমকি দিয়ে গেছেন,

“তোমার বাঁদরামো বহুত সহ্য করেছি। আর সম্ভব নয়। গোঁয়ার্তুমি করলে আমি মানব না। যা বলেছি সেটা করতে আমার খুব একটা কষ্ট হবে না।”

আজই রাফিদ বন্ধুর বাসায় গিয়ে উঠত, কিন্তু সায়েদা আন্টির শরীর খারাপ করেছে কিছুটা। তিনিই এমনভাবে থাকতে বললেন, রাফিদ আর না করল না।

হঠাৎ ওর মুঠোফোন বেজে উঠল, “রাফিদ বলছেন?”

একটা রিনরিনে স্বর ভেসে এলো, “হ্যাঁ। আপনি কে?”

“আমি তরী।”

“আপনাকে কি আমার চেনার কথা?”

কিছুটা যেন আহত শোনাল তরীর গলা, “আসলে জয়নুল আঙ্কেল আপনার নাম্বারটা আমাকে দিয়েছিলেন কয়েকদিন আগে। উনি বলেছিলেন, আপনি যোগাযোগ করবেন। আপনি তো কল করলেন না, তাই আমিই ভাবলাম কথা বলি।”

এবার চিনতে পেরেছে রাফিদ, “দেখুন তরী, আমি যেহেতু যোগাযোগ করিনি, তাহলে তো বোঝার কথা আমি ইচ্ছে করিনি, তাই না?”

আরও কিছু কঠিন কথা মুখে এসেছিল, কিন্তু নিজেকে সংযত করল, এই মেয়ের তো কোনো দোষ নেই৷ বাবার রাগ ওর উপরে ঝাড়ার কোনো অধিকার রাফিদের নেই।

“ও। স্যরি, আমি বোধহয় আপনাকে বিরক্ত করলাম তাহলে। আসলে আপনাকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। ভালোও লাগে। তাই যখন বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল আমি স্বপ্ন দেখে ফেলেছিলাম। যাই হোক, আপনার আপত্তির কারণটা জানতে পারি? সৌমির তো বিয়ে হয়ে গেছে।”

“যখন তখন যাকে তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবেন না। স্বপ্ন ভেঙে গেলে কষ্ট পেতে হয়। ভয়ানক কষ্ট। সৌমির বিষয়ে যেহেতু জানেন, কেন আমাদের বিয়ে হয়নি সেটাও জানেন নিশ্চয়ই। আমার ব্যক্তিগত বিষয় আমি এখন আপনার সাথে শেয়ার করব না, স্যরি। ভালো থাকবেন।”

“তবুও আমি অপেক্ষা করব।”

বলেই কল কেটে দিল তরী। রাফিদের মেজাজ খারাপ হলো। যাকে সে চায়, সে ওর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলেছে, যা চায় না, তা-ই এসে ঘাড়ের উপরে পড়ছে!

রাফিদ তপার কথা তরীকে বলতে চায়নি, কারণ সে বাবার দলের। ওকে সব বললে সে কীভাবে তা বাবাকে বলবে সেটাও একটা ভাবনার বিষয়। তপাকে মানানোটাই ওর জন্য এখন সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ। তপা যদি একবার সাড়া দেয়, সে আর কোনোকিছুরই তোয়াক্কা করবে না। যত প্রতিবন্ধকতাই আসুক না কেন! এই মুহূর্তে সবচাইতে বড় প্রতিবন্ধকতা তপা নিজেই।

আচ্ছা, তপা তো প্রতিদিন ছাদে আসে জোৎস্না দেখতে, আজ আকাশে ঘন মেঘ। ওর মনের মতোই। আজ কি সে আসবে!

***
ফোন রেখে তরী কতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। ওর কান্না পাচ্ছে। রাফিদকে সে প্রথম দেখেছিল ওদের একটা পারিবারিক অনুষ্ঠানে। এরপর ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে অনেকবার দেখেছে।

রাফিদ ওকে চেনে না, কিন্তু তখন থেকেই ওকে ভালো লাগত। কিন্তু সৌমির জন্য সে এগোয়নি। পরে যখন বিয়ের আলোচনা হলো, জানল সৌমির বিয়ে হয়ে গেছে, কোনোকিছু না ভেবেই সম্মতি দিয়েছে।

এই কয়দিনে ওর স্বপ্নের ডালপালা মেলে আকাশ ছুঁয়েছে। প্রতিদিন অপেক্ষা করেছে, এই বুঝি রাফিদ কল করল, কিন্তু কই, অপেক্ষা বৃথা গেছে।

এখন মনে হচ্ছে ওর স্বপ্নটাও বৃথা যাবে। তরী ভীষণ চাপা স্বভাবের মেয়ে। নিজেকে কখনো মেলে ধরতে পারে না। তবুও সাহস করে স্বপ্ন দেখেছিল।

সে তো সেধে যায়নি, তাহলে এখন কেন তাকে কষ্ট পেতে হবে? তার দোষ কোথায়!

***
জহুরা সুপারি কাটছিলেন, এই সময় তুহিন এলো।

“মা এই মাস শেষ হলেই বাড়িটা ছাড়তে হবে। ভাড়া বাড়িতে উঠব আপাতত। এটা কমপ্লিট হলে তখন আবার আসব।”

তার হাত থমকে গেল মুহূর্তের জন্য, ভারাক্রান্ত গলায় চোখ তোলে তিনি ছেলেকে দেখলেন, “তোর মেয়েটার বয়স একদিনও হয়নি। ইলা আজও হাসপাতালে। আর তুই এখন নিজের বাড়ি ছেড়ে ভাড়া বাড়িতে উঠতে চাস? এত তাড়াহুড়ার কী আছে? একটু বড় হোক। তারপর…”

“মা, এগুলো কী বলো? ওরা এতদিন বসে থাকবে? একটা সুযোগ পাওয়া গেছে। এটা হাতছাড়া করব কেন শুধু শুধু।”

“তাও একটু ভাবলে হয় না? তপাটাও…”

“মা, দেখো, ওর কথা আর বলো না প্লিজ। তপা আমার দিক ভেবেছে কোনোদিন? আমি কবীরের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিলাম। শোধ করা হয়নি। সে চায়ওনি। এরমধ্যে তোমার মেয়ে ডিভোর্সের জন্য অস্থির হয়ে গেল। কী সমস্যা ছিল ওদের? বলার মতো কিছুই না। ডিভোর্সের পরে কবীর প্রেসার দিচ্ছিল টাকা ফেরত দেয়ার জন্য। ওইদিকে আমার ওই অবস্থায় তপা কী করল, বাবার সম্পত্তিতে নিজের অধিকার নিয়ে পড়ল। ওর টাকা দিলাম। কবীর মানুষ ভালো বলে এই কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিল। ভাইয়ের কথা ভাবে না, মর্জি মতো চলে, ওর জন্য আমি কেন ভাবব? ওর কথা কেন শুনব? ও কান পড়া দিলেই তোমাকে শুনতে হবে?”

জহুরা হতাশ গলায় বললেন, “তপা কিছু বলেনি। আমিই বললাম। আর কবীরের সাথে তোর এখনো এত দহরম মহরম কীসের?”

“মা, এত কথা বলতে ভাল্লাগে না। আমি একবার হাসপাতালে যাচ্ছি। তুমি যাবে?”

“হ্যাঁ। দাঁড়া একটু। শাড়িটা পাল্টে আসি।”

তুহিন বের হয়ে যেতেই জহুরার হাহাকার হলো। ঘরটা একবার ভালো করে দেখলেন। মানুষটার সাথে এই ঘরে তিনি বহুবছর কাটিয়েছে। তুহিন, তপারা এই ঘরে বেড়ে উঠেছে। একজন স্ত্রী হয়ে এই বাড়িতে পা দিয়েছিলেন, মা হয়েছেন, নানী-দাদী হয়েছেন এখন। এত বড় জীবনে ঘরের আনাচে-কানাচে কত স্মৃতির ধূলো জমে আছে। এক ফুঁৎকারে তা উড়ে যাবে, মুছে যাবে এই বাড়ির দেয়াল, আসবপত্র, ইট, বালু সিমেন্ট থেকে। ক্রেনে গুড়িয়ে নতুন করে দালান উঠবে। তার হাতের ছোঁয়া চিরতরে হারিয়ে যাবে! এটা তার জন্য যে কত ব্যথার, এটা তিনি কাকে বলবেন, কাকে বোঝাবেন! নিজেকে এই বাড়িতে, এই পৃথিবীর বুকে একজন অপাংক্তেয় মানুষ বলে মনে হলো তার।

***
সোমা আর রবিনের সময়টা চমৎকার কাটছে। স্বপ্ন পূর্ণতায় তারা ভাসছে।

আগামীকাল বাড়িতে যাবে। এই বাড়ির মানুষগুলোকে ঠিক বুঝতে পারেনি সোমা। সবাই একটু সিরিয়াস ধরনের মানুষ। বাড়িতে এতগুলো মানুষ, যৌথ পরিবার। তবুও মনে হয় নিষ্প্রাণ। কেমন নির্জন। এত মানুষ থাকে এটা বোঝায় যায় না।

ওরা গল্প করছিল শুয়ে শুয়ে। রবিন বলল,

“হানিমুনে কোথায় যাবে? চলো নেপাল যাই।”

সোমা দ্বিমত করে বলল, “আমার ইচ্ছে ছিল বিয়ের পরে তোমাকে নিয়ে তাজমহল দেখতে যাব।”

“তাজমহল দেখার চাইতে নেপালের সৌন্দর্য দেখা ভালো না?”

“না, গেলে তাজমহল দেখতে যাব। নইলে কোথাও যাব না।”

“আরে অদ্ভুত তো, আমার নেপাল যাবার ইচ্ছে বহুদিনের।”

এই নিয়ে দু’জনের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হলো। কতক্ষণ পরে সোমা বলল,

“আচ্ছা, তাহলে দুটোর কোনোটাই না। অন্য কোথাও যাব। দেশেই। পরে কখনো সময় সুযোগ হলে বাইরে যাওয়া যাবে।”

এবার রবীন সম্মত হলো, “সেটাই। আসল কথা হলো একান্ত সান্নিধ্যে পরস্পরকে পাওয়া। সেটা কোথায় গেলাম, তারচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভালোবাসাবাসিটা আগে।”

***
সামনেই দর্পণের জন্মদিন। তপার মনে পড়ল, সে যেদিন জানল দর্পণের আসার খবর। এক পৃথিবী সুখ ওর সমস্ত মন জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। কবীর তখন চট্টগ্রামে। ফোন করে এই আনন্দের খবরটা দিতে ইচ্ছা করেনি।

কবীর যেদিন এলো, সেদিন সে লাল টুকটুকে শাড়ি পরেছিল, ভীষণ সুন্দর করে সেজে অপেক্ষা করছিল। ঘরের ফুলদানিগুলো ফুলে ফুলে ভরিয়ে তুলেছিল। ফুলের সৌরভে বাড়িটা সুরভিত করে প্রতীক্ষার ছিল তপা। লোকটা বাচ্চার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল, নিশ্চয়ই ভীষণ খুশি হবে এই খবরে।

দরজা খুলে ওকে একবার মুগ্ধ চোখে দেখেছিল।

“আজ এত আয়োজন?”

তপা অকৃত্রিম উচ্ছ্বাসে ফিসফিসিয়ে কবীরের কানের কাছে গিয়ে বলেছিল,

“আমাদের ঘরে নতুন অতিথি আসতে যাচ্ছে কবীর।”

কবীর হেসেছিল, তপা সেই হাসিকে আনন্দের হাসি ভেবে ভুল করেছিল সেদিন। তখন থেকেই কবীরের আচরণ বদলে যাওয়া শুরু করেছিল। শারীরিকভাবে নির্যাতন না করেও মানসিকভাবে কীভাবে একজন মানুষকে ভেঙে ফেলা যায়, তা ওই জঘন্য লোকটার চাইতে কেউ বোধহয় ভালো জানে না।

পুরো প্র‍্যাগনেন্সির সময়টা তপার কেটেছে অসহনীয় মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে। বুঝতে চেষ্টা করছিল, ওর ভুল কোথায়! হঠাৎ কী হলো যার জন্য কবীর ওকে উপেক্ষা করছিল! কিন্তু উত্তর পায়নি তখন। যখন জানল, তখন তপার সমস্ত পৃথিবী চুরে ভেঙে গিয়েছিল!

অথচ ওই সময়ে সে বোকার মতো কত স্বপ্নই না দেখেছিল। প্রতারিত হবার যে কী ভীষণ যন্ত্রণা! তার শত্রুকেও যেন সে-ই যন্ত্রণা সইতে না হয়। জীবনের এই বন্ধুর পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে গড়ে নেবার চেষ্টা করছে দর্পণের মুখের দিকে তাকিয়ে।

ছোটবেলা থেকে সে শুনে এসেছে, আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য করে। কবীরের সাথে যখন ওর সম্পর্ক টলটলায়মান, তখন ওর মনে হতো এই লোকের সাথে বিয়েতে তার ভালো কিছু কী হয়েছে! কিন্তু সেই সম্পর্কের বিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপ থেকেই তো সে দর্পণকে পেয়েছে। এখন কথাটা সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। আঁধার চিরকাল থাকে না। একবার সূর্য হেসে উঠলেই সমস্ত আঁধার কেটে গিয়ে ঝলমলে দিন এসে হাজির হয়। দর্পণ ওর জীবনের সেই সূর্য! দেখতে দেখতে কেমন একটা বছর হয়ে যাচ্ছে।

দর্পণের ঘুম ভেঙে গেল। আজও আগেই ঘুমিয়েছিল। এখন রাত এগারোটা বাজে। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাফিদের সাথে ছিল। তপা জানালা দিয়ে ওদেরকে খেলতে দেখেছে।

রাফিদ ওর প্রতি যে-ই ধারণা পোষণ করুক, সেটা তাদের দুজনের ব্যাপার। সে আর ওকে কোনো প্রশ্রয় দেবে না। তার ছেলেটা রাফিদের সাথে সুন্দর সময় কাটায়। সেটা সে বন্ধ করবে না। মনের দরজায় তালা এঁটে আরও কোনো ফাঁকফোকর থেকে গেল কিনা পরীক্ষা করে সমস্ত রাস্তা সে বন্ধ করল রাফিদের জন্য।

গরম পড়েছে ভীষণ। ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। ভীষণ গরম নিচতলায়। দর্পণ ঘেমে গেছে৷ ওকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ছাদে উঠে এলো।

রাফিদ যে এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে খেয়াল করেনি। যখন চোখে পড়েছে, তখন দেখল ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। এখন নেমে গেলে সেটা ভীষণ হাস্যকর মনে হবে বলে তা করল না।

“কেমন আছো তপা?”

“ভালো।”

“আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করবে না?”

“দেখতেই তো পাচ্ছি ভালো আছো।”

“আমি ভালো নেই তপা। আমি সুস্থ আছি। কিন্তু ভালো নেই। কষ্টে আছি।”

“কেউ যদি নিজে থেকে কষ্ট পেতে চায়, সেটা তার ইচ্ছে।” নির্বিকার মুখে বলল তপা।

“আমার বোধহয় চলে যাওয়াই উচিত ছাদ থেকে।” তপার কথায় রাফিদের মনে হলো, বলে ফেলা কথা ফিরিয়ে নেবার কোনো যন্ত্র থাকলে ভীষণ ভালো হতো। ফিরিয়ে নেবার পরে, সেই কথাটা বক্তা আর শ্রোতা দুই পক্ষের মন থেকেও মুছে দেয়া যেত যদি! এত এত জয়জয়কার নাকি প্রযুক্তির, এমন কিছু কেন আবিষ্কার করা যায়নি! কীসের এত আস্ফালন তবে!

“তপা, আমরা তো বন্ধু হয়েছিলাম, তাই না?”

“তুমি বন্ধুত্ব ধরে রাখতে পারোনি।”

তপা পা বাড়িয়েছিল নেমে যাবার জন্য, রাফিদ পেছন থেকে বলল, “এখন ভেতরে গেলে দর্পণের কষ্ট হবে। তুমি থাকো। আমার জন্য তোমার অস্বস্তি হলে আমিই যাই নাহয়।”

রাফিদ বলল বটে, কিন্তু এখন ওর এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে প্রবলভাবে। এদের দু’জনের সাথে সময় কাটানো ওর জন্য এতটা আরাধ্য, যে মিস করতে চাইছে না।

ওর মনের আশা পূরণ হলো, দর্পণ নিজে থেকেই ওর কোলে আসার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। রাফিদ তপার অনুমতি চাইল,

“আরেকবার ওকে দেবে? আসতে চাইছে।”

তপা দর্পণকে রাফিদের কোলে দিল।

“আমার সেদিন ওইভাবে বলে ফেলাটা ঠিক হয়নি আমি জানি। কিন্তু কথাগুলো মিথ্যে নয় তপা। আমার একান্ত অনুভূতির কথা ছিল।”

কিছুটা থেমে রাফিদ বলল, “আমি সত্যিই তোমাদের ভালোবেসে ফেলেছি।”

“ভুল মানুষকে ভালোবাসলে তার মাশুল দিতে হয় যন্ত্রণা সয়ে। আমিও একসময় সয়ে নিয়েছিলাম, তোমাকেও নিতে হবে।”

“আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।”

“লাভ নেই।”

“অনন্তকাল মানুষ বাঁচে না তপা, তবে আমি যে কদিন বাঁচব, তোমাকে ভালোবেসে বাঁচব।”

“এসব কথা নাটক, সিনেমার স্ক্রিন আর বইয়ের পাতার জন্য। বাস্তবে এসব আবেগের কোনো মূল্য নেই। তুমি এখনো জীবন চেনো না। কিছুই দেখোনি বাস্তবতার। কঠিন বাস্তবতার ছোবলে এসব কাব্যিক ডায়লগ কোথায় ভেসে যায়!”

তপার গলায় ভাবাবেগের ছোঁয়া নেই। বড্ড কাঠখোট্টা গলায় কী কঠিন কঠিন কথা বলে যাচ্ছে।

“একবার আমায় ভালোবেসে দেখো তপা, পৃথিবীটা সুন্দর হয়ে যাবে।” কী অদ্ভুত কাতর শোনায় রাফিদের গলা!

“সেই সুন্দর পৃথিবীটাও নশ্বর। বালুচরে ঘর বেঁধে লাভ হয় না রাফিদ। পলকা হাওয়াতেই ধ্বসে পড়ে যায়। তুমি মিথ্যে আশা রেখো না। আমার পক্ষে নতুন করে শুরু করা কখনোই সম্ভব নয়।”

“ভালোবাসা শাশ্বত, তপা। আগে বিশ্বাস করতাম না। এখন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। আমি জানি তোমার জীবনে আমার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমার জীবনে তোমাকে আর দর্পণকে ভীষণ প্রয়োজন। আমি আমার ভালো থাকার জন্য তোমাদের চাইছি তপা। আজ সারাদিন আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়েছে। দর্পণকে বুকে জড়িয়ে ধরে শান্তি পেয়েছি।” রাফিদের গলার স্বর কম্পিত।

ইলেক্ট্রিসিটি চলে এলো এরমধ্যে, তপা তাড়া দিল, “এবার দর্পণকে দাও। আমার কাল অফিস আছে। ওকে ঘুম পাড়াতে হবে।”

দেখা গেল রাফিদের কোলেই দর্পণ ঘুমিয়ে পড়েছে। রাফিদ ঘুমন্ত দর্পণের কপালে একটা চুমু দিয়ে ফিরিয়ে দিল মায়ের কোলে। তপা ফিরে যাবার আগে বলল,

“ভুলে যাও রাফিদ। কিছুদিনের আবেগকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে নিজের জীবনটা নষ্ট করো না, তোমার সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। বেস্ট অফ লাক, রাফিদ। ভালো থেকো।”

কথাটা বলেই দ্রুত পায়ে চলে গেল তপা, সাথে নিয়ে গেল রাফিদের সমস্ত প্রশান্তি। এমন কাতর অনুনয় সে কবে কাকে করেছিল? কখনোই কাউকে করেনি।

প্রাণশক্তিতে চনমনে রাফিদের কাছে জীবনটাকে বড্ড ফিঁকে, বিবর্ণ বলে মনে হলো। এত ধূসর সময় ওর জীবনে কোনোদিন আসেনি, আসতে পারে বলেও ভাবেনি।

কাউকে এতটা ভালোবাসা যায়! যাকে না পেলে সমস্তকিছু অর্থহীন মনে হয়! জীবন বৃথা মনে হয়! কী করে এটা সম্ভব হয়, কেন এতটা ভালোবাসে কেউ, কেন নিঃস্ব হবার বিপদসংকেত মাথায় নিয়েও মানুষ পাগলের মতো কাউকে ভালোবাসে! উত্তর জানা নেই, শুধু প্রবল আকাঙ্ক্ষা আছে। একদিন তপা আর দর্পণের সাথে ওর ভালোবাসার চাদরে মোড়া একটা সংসার হবে। এই আকাঙ্ক্ষাটুকুই এখন ওর সবচাইতে বড় সঞ্জীবনী।
……….
(ক্রমশ)