নিভৃত দহনে পর্ব-২০+২১

0
39
নিভৃত দহনে পর্ব-০১
নিভৃত দহনে

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ২০)
নুসরাত জাহান লিজা

সোমা খাবার টেবিলে বসে শ্বশুরবাড়ির সকলকে পর্যবেক্ষণ করল। এরা কথাও বলে মেপে মেপে, একই কথা খাওয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এতগুলো মানুষ একসাথে খেতে বসেছে, অথচ কথা হলো গুণে গুণে কয়েকটা। দুই দিনেই বেশ হাঁসফাঁস লাগছে ওর। রবীনের ভাবিরাও অতি শান্ত। সে ভেবে পেল না যে বাছাই করে এমন স্বভাবের মানুষগুলোকেই আনা হয়েছে এখানে, নাকি এই বাড়ির সংক্রমণে এমন অবস্থা!

সোমার শাশুড়ি জেসমিন শুধু একবার বললেন, “সোমা, তুমি খেয়ে রেডি হয়ে নাও। আর রবীন, পাঁচ তারিখ কিন্তু তোর বড় খালার বাসায় তোদের দুজনের দাওয়াত আছে। সেটা মিস করিস না।”

রবীনের মুখও বিরস, “মনে আছে, মা। আমরা পরশুই চলে আসব।”

এরপর আর কোনো কথা নেই।

খাওয়া শেষ করে ঘরে এসে সোমা রবীনকে বলল, “আমার কিন্তু সাত তারিখ থেকে অফিসে যেতে হবে। পাঁচ তারিখ এসে পরেরদিন আমি চলে যাব আবার।”

“কোনো সমস্যা হবে না। সবাই জানে। তোমার ট্রান্সফারটা যত দ্রুত হয় তত ভালো।”

সোমাকে চুপচাপ দেখে রবীন বলল, “তোমার হয়তো এখানে মানিয়ে নিতে প্রথম দিকে একটু প্রবলেম হতে পারে, তবে আস্তে-ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। আমার পরিবারের মানুষকে দূর থেকে দেখলে একরকম লাগে, কিন্তু মিশলে বাকিটা নিজেই বুঝতে পারবে। তারা মানুষ হিসেবে চমৎকার।”

সোমা তবুও নির্বিকার, রবীন বলল, “তুমি রেডি হও, নইলে যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।”

“হুম যাচ্ছি।”

“আচ্ছা, তোমার লাগেজে দেখো, একটা খয়েরি রঙের শাড়ি আছে। ওটা আমি নিজে পছন্দ করেছিলাম। তোমাকে খুব মানাবে। ওটা কি পরবে?”

সোমা শাড়ি বের করে পরে এসে দেখল রবীন মোটামুটি গোছগাছ করে ফেলেছে। ভালো লাগল সোমার।

সে খোঁপা করছিল, রবীন ওর খোপায় বেলীফুল গুঁজে দিয়ে বলল,

“ভীষণ সুন্দর লাগছে তোমাকে।”

সোমা হেসে ফেলল এবার। ওর একটু মন খারাপ হয়েছিল, মন ভালো করার এই যে আপ্রাণ প্রচেষ্টা, এটা ওর ভীষণ ভালো লাগল। নতুন জায়গায় মানিয়ে নিতে গেলে এই সাপোর্ট ভীষণ জরুরি।

“তুমি সবসময় এমন থাকবে তো?”

“কেমন?”

“এই যে, কেয়ারিং, রেসপন্সিবল!’’

রবীন হাসল এবার, সোমার হাতদুটো মুঠোবন্দি করে বলল,

“আমি সবসময় তোমার পাশে, তোমার সাথে থাকব বলেই এই হাত দুটো ধরেছি। পাশে থাকার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছি। তুমিও একইরকম থেকো।”

***
রাতে জয়নুল রাফিদকে কল দিলেন।

“কবে আসছ ঢাকায়?”

“আসব।”

“সেটা যতো তাড়াতাড়ি হয় ততই মঙ্গল। তুমি তরীকে কী বলেছ?”

“যা বলার কথা তাই বলেছি। আমি তোমার কথায় ফিরব, এইটাই বেশি নয়? আমি এখন বিয়ে নিয়ে ভাবছি না।”

“আগে এসো, পরে সেটা দেখা যাবে।”

বলেই ফোন রাখলেন, শিরীন কখন এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে তিনি বুঝতে পারেননি।

“ছেলেটাকে এভাবে ফোর্স না করলে তোমার হচ্ছে না?”

“রাফিদ ফিরছে। এবার ওকে বোঝানোর দায়িত্ব তোমার।”

“আমি পারব না।” সাফ জানিয়ে দিলেন শিরীন।

“কেন?”

“কারণ আমি হিপোক্রেট নই।”

“এখানে হিপোক্রেসির কি দেখলে? ছেলে ভুল পথে যাচ্ছে, তাকে সঠিক পথ দেখাবার দায়িত্ব আমাদের।”

লাইব্রেরী ঘরের জানালার পর্দা সরিয়ে দিতে দিতে শিরীন বললেন, “তোমার মনে আছে, তুমি সারাজীবন আমার বাবাকে পছন্দ করতে পারোনি। বাবা মেনে নিলেও মন থেকে তোমাকে কখনো পছন্দ করেননি। তুমি কেন পছন্দ করোনি বাবাকে?”

“এসব কথা বহুল চর্চিত, এখন অপ্রাসঙ্গিকভাবে এসব তোলার মানে কী?”

“উত্তরটা আগে দাও।”

“কারণ তিনি তোমার জন্য আমাকে কখনো পছন্দ করেননি।”

এবার শিরীন ভীষণ ঠান্ডা গলায় বললেন, “তোমার এখনকার কাজ আর তার তখনকার সিদ্ধান্ত, পার্থক্য আছে কোথাও?”

“শিরীন, আমি আমাদের সন্তানের ভালোর জন্য করছি এসব।’’

“তিনিও তার সন্তানের ভালোর জন্য করেছিলেন।”

“শিরীন, আমরা কি অসুখী ছিলাম? তুমি কি বলতে পারবে এটা?”

“কথা সেটা নয়। তোমার এই সিদ্ধান্ত পরের ব্যপার। আগে বলো তো, যেই কারণে তুমি সারজীবন একটা মানুষকে অপছন্দ করে এসেছ, আজ তারই পথে হাঁটছ। এটা হিপোক্রেসি নয়? আমি সব বাঁধা ভেঙে তোমার হাত ধরেছিলাম, একই কাজ আমার ছেলে করতে চাইলে আমি বাঁধা দেব! এটা হিপোক্রেসি নয়? আমি আমার ছেলেকে তখনই বাঁধা দেব, যখন দেখব সে পথ হারাচ্ছে, যদি দেখি সে কোনো অন্যায় করছে। এখানে আমি এমন কোনো অন্যায় দেখছি না যাতে মানবতা বা নৈতিকতার লঙ্ঘন হয়।”

ঘুরে বেরিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে শিরীন বললেন, “বাবা আর তোমার অন্তর্দ্বন্দে আমি কতটা পীড়ন অনুভব করেছি, কখনো জানতে চেয়েছ তোমরা? এখন ছেলের সাথে। তোমরা তিনজনই আমার সবচাইতে কাছের মানুষ। এই তিনজনের একজনকে ছাড়াও আমি অসম্পূর্ণ। আমার পূর্ণতা কোথায় বলতে পারো?”

বলেই শিরীন ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলেন। জয়নুল হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। শিরীনকে ইদানিং তিনি ঠিকঠাক বুঝতে পারেন না। তারা এত কাছের, তাকে এত চমৎকার পড়তে পারতেন, এখন মনে হচ্ছে সহজবোধ্য বইটা যেন হুট করে শেষ খন্ডে এসে মারাত্মক জটিল, দুর্বোধ্য কোনো ভাষায় লেখা!

তবুও বাবা হিসেবে তার একটা দায়িত্ব আছে ছেলের জীবনকে মসৃণ করে দেবার। তিনি দায়িত্ব থেকে পিছপা হবেন না।

***
তপা অফিস থেকে এসে দেখল, মলিনা দর্পণকে খাওয়াচ্ছে।

“এই সময় খাওয়াচ্ছ যে!”

“ওরে রাফিদ ভাইজান নিয়ে গেছিল। একটু ঘুরাইতে বাইর হইছিল। একটু আগে দিয়া গেছে।”

তপা কিছু বলল না। পরশু রাতের পর থেকে আর রাফিদকে সে দেখেনি। তবে দর্পণের সাথে যোগাযোগ আছে। গতকালও এসেছে শুনেছিল।

ফ্রেশ হয়ে দর্পণকে কোলে নিল তপা। সারাদিনের ক্লান্তি আর বিপর্যস্ততা যেন নিমিষেই কেটে গেল।

“মা, মা, মা…..”

এই ডাকটা যেন ওর কানে মধুবর্ষণ করে। এক পৃথিবী প্রশান্তি ওর মন জুড়ে ঢেউ তোলে যায়।

***
রাতে সোমা এলো, “আপু, চলো ছাদে বসি কিছুক্ষণ। গল্প করি।”

“তোমরা একসাথে সময় কাটাও। আমি কেন?”

“এসো না। ভালো লাগবে। আড্ডা হবে।”

সোমার জোরাজুরিতে তপা উঠল, দর্পণকে কোলে নিয়ে।

ছাদে এসে দেখল রবীনের সাথে রাফিদ বসে আছে। ওকে দেখে রাফিদ কিঞ্চিৎ যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেল। সেদিন রাতে নিজের সর্বস্ব দিয়ে তপাকে আহ্বান জানিয়েছিল সে। কী হয়েছিল, কী হচ্ছে সে ঠিকঠাক বুঝেও উঠতে পারছে না। তপা এখানে আসবে জানলে সে আজ রাতে আসত না।

ওকে সোমা কল দিয়েছিল, রাফিদ যেহেতু কাল চলে যাবে, তাই এসেছিল ওদের বিয়ের ছবিগুলো দিতে। সব এডিট করা হয়নি। কিছু স্পেশাল ছবি আছে দু’জনের সেগুলো সোমা আগে চেয়েছিল। মেইল করে দিলেই হয়তো ভালো হতো। কিন্তু সবার সাথে এত ভালো সময় কেটেছে, আবার কবে আসতে পারবে সে জানে না! বাবা কোন পরিস্থিতি তৈরি করবেন, তা জানা নেই। চেয়েছিল ওদের সাথে দেখা করে সামনা-সামনি বিদায় নিয়ে নেবে।

ওর অস্বস্তির প্রধান কারণ হচ্ছে, তপা হয়তো ওকে এখানে দেখতে চায়নি। আবার কী ভাববে কে জানে!

“আমি আগামীকাল ঢাকায় ফিরে যাচ্ছি।”

তপা একবার চোখ তুলে তাকালো রাফিদের দিকে, ওর মনে হলো, কথাটা ওকে উদ্দেশ্য করেই বলা।

“সবাইকে ভীষণ মিস করব। বিশেষ করে আমার ছোট্ট বন্ধুকে।”

দর্পণকে ইঙ্গিত করে বলল রাফিদ।

সোমা বলল, “আবার আসবে কিন্তু। না আসলে মানবো না, ঢাকায় তোমাদের বাড়িতে গিয়ে হানা দেব।”

“অবশ্যই যেও। তবে আমি আবার আসব এখানে। এবার সিলেটে এসে আমি নিজেকে অন্যভাবে আবিষ্কার করেছি।”

রবীন বলল, “তা আজ তোমার ক্যামেরা কোথায়? গিটার যে?”

রাফিদ বিষণ্ণ হেসে বলল, “এটা আমি যেই ফ্রেন্ডের বাসায় উঠেছি ওর। একসময় টুকটাক বাজাতাম দু’জনে ক্যাম্পাসে থাকতে। আমিও ভাবলাম একটু স্মৃতি রোমন্থন করা যাক।”

“ভালোই হলো। একটা গান শোনাও।” হৈ হৈ করে বলল সোমা।

রাফিদ ক্ষণকাল নীরব থেকে মুখ খুলল, “ঠিক আছে। তাছাড়া কেউ একজন বলেছিল পুরনো ভালোবাসার জিনিস একেবারে ফেলে দেয়া উচিত নয়। তাকে ডেডিকেট করেই গাইছি।”

অন্যরা না বুঝলেও তপা বুঝল, এবারও রাফিদ ওকে উদ্দেশ্য করেই বলল।

রাফিদ টুংটাং বাজাতে শুরু করল গিটার। এরপর তপাকে একবার পূর্ণ দৃষ্টিতে অবলোকন করেই দৃষ্টি সরিয়ে নিল, এরপর গাইতে শুরু করল…….

“বন্ধু ভেঙে ফেল এই কারাগার, খুলে দাও সে হৃদয়ে প্রণয়েরই দ্বার…
হতেও পারে এই দেখা শেষ দেখা, হতেও পারে এই গানই শেষ গান,
হতেও পারে এই দেখা শেষ দেখা, হতেও পারে এই গানই শেষ গান।

হতেও পারে আমাদের এই মিলনমেলাই এক ইতিহাস
হতেও পারে তোমার শীতল চোখটাই যেন এক উচ্ছ্বাস
হতেও পারে বিষাদের এই জনপদ প্রণয়ের তীর্থ
হতেও পারে তোমার একটু নীরবতায় সে ব্যর্থ
হতেও পারে… এই দেখা শেষ দেখা… এই গানই শেষ গান…..
নীরবে, অভিমানে নিভৃতে, করছো তিলে তিলে নিজেকে শেষ
কেন বলো পৃথিবীতে কেউ কারো নয়, হয়ে গেছে ভালোবাসা নিঃশেষ।
বন্ধু ভেঙে ফেল এই কারাগার
খুলে দাও, খুলে দাও সে হৃদয়ে প্রণয়েরই দ্বার
হতেও পারে এই দেখা শেষ দেখা
হতেও পারে এই গানই শেষ গান….”

এক ফোঁটা অশ্রুজল সন্তর্পণে আড়াল করে নিল রাফিদ। ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেল সহস্রবার। হাত তিনেক দূরত্বে বসা তপার সাথে ওর দূরত্ব যেন আলোকবর্ষ সম।
……….
(ক্রমশ)

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ২১)
নুসরাত জাহান লিজা

ফেরার আগে রাফিদ একবার সায়েদা আন্টির বাসায় গেল। জানে এখন তপা নেই। দর্পণকে দেখতে আসার লোভ সংবরণ করতে পারল না। তাছাড়া রাফিদ সবসময় নিজের মনের কথা শুনে চলতে অভ্যস্ত।

রাতে তপার সাথে শেষ কথা ছিল, “ভালো থেকো।”

‘ভালো থেকো’ কথাটা পৃথিবীর অন্যতম সান্ত্বনা বাক্য বলে মনে হয় রাফিদের। একধরণের ভদ্রোচিত প্রত্যাখ্যান। যখন কেউ জীবনের সাথে জুড়ে যায়, তাকে গ্রহণ না করে ভালো থেকো, বলাটার মধ্যে একটা কৌতুক মিশ্রিত বিষাদ মিশে থাকে। যে বলে তার হয়তো কিছু যায় আসে না, কিন্তু যাকে বলা হয়, তার হৃদয়ের কোথায় গিয়ে যে বিদ্ধ করে! সে কথা পৃথিবীর অন্য কেউ কীভাবে জানবে! রাফিদও কাল রাতের আগে জানত না।

দর্পণ বাগানে খেলছিল, একটা পাটি বিছিয়ে দেয়া হয়েছে বাগানে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খেলনা এলোমেলো করছিল, মলিনা সেসব আবার গুছিয়ে ওকে দিচ্ছিল।

রাফিদ গিয়ে সেখানে বসল।

“দর্পণ বাবা কী করে?”

ওর দিকে তাকিয়ে উদ্ভাসিত হাসল দর্পণ, এরপর হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এলো, রাফিদের হাত ধরে উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক পা হাঁটল।

রাফিদ জড়িয়ে ধরল কোলে নিল ওকে। হাত নেড়ে যেন কিছু বলছে, ভাষাটা অবোধ্য। তবুও মন ভরে যায়।

রাফিদ ওর সাথে কিছুক্ষণ খেলল, মলিনার কাছ থেকে ওর নম্বরটা নিল, ওরটা সেভ করে দিল। তপাকে তো কল দেয়া যাবে না, ওর কাছ থেকেই দর্পণের আর তপার খোঁজখবর নিতে হবে।

একটা শাড়ি মলিনাকে দিল, সাথে কিছু টাকা। সোমার বিয়েতে তারও ছবি তুলেছিল রাফিদ, সেই ছবিগুলোও দিল৷ ভীষণ খুশি হলো মলিনা। দোয়া করে দিল।

দর্পণের জন্য একটা ছোট্ট সাইকেল এনেছে। তপা রাগ করতে পারে, কিন্তু ওর তো অনেককিছু দিতে ইচ্ছে করে।

সায়েদা আন্টি, সোমা আর রুমার জন্যও উপহার এনেছে সে। তপার জন্যও একটা শাড়ি কিনেছে। সেটাও সাহস করে মলিনার হাতে দিল। জানে এটা অবহেলায় হয়তো তপার অন্য শাড়ির ভিড়ে কোথাও পড়ে থাকবে।

সায়েদা আন্টি কিছুতেই না খেয়ে আসতে দিতে রাজি হলেন না। পুরোপুরি সুস্থ না থেকেও নিজের হাতে রান্না করলেন রাফিদের জন্য। এই স্নেহগুলো ওর কাছে অমূল্য। তাই নিষেধ করলেও তাতে জোর ছিল না।

পুরোটা সময় সে দর্পণকে সাথে রাখল। মাঝে একবার ঘুমিয়ে পড়েছিল সায়েদা আন্টির ঘরে। রাফিদ তখনও ঘুমন্ত দর্পণকে কাছ ছাড়া করেনি।

তপা হয়তো রাফিদের ভালোবাসাটা অনুধাবন করতে পারেনি। কীভাবে করবে! কতদিনেরই বা চেনা সে। হৃদয় খুলে বের করে দেখানো গেলে মন্দ হতো না। ওর হৃদয় কতটা দগ্ধ হচ্ছে প্রতিনিয়ত, সেখানকার ভস্মীভূত অবস্থা দেখলে হয়তো তপা প্রলেপ দিতে চেষ্টা করত, প্রতিষেধক দিয়ে সারিয়ে দেবার চেষ্টা করত। ওর ভালোবাসা এই দহন যন্ত্রণার একমাত্র প্রতিষেধক, সেটাই মেয়েটা জানল না।

একটা তীব্র অভিলাষ, ছোট্ট অভিমান আর এক পৃথিবী আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সে ফিরে যাচ্ছে দূরে। এই ক’দিন কাছে থেকেও বহুদূরে ছিল, আজ সত্যি সত্যি ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। তবুও মনটা সাথে নিয়ে যেতে পারছে কই। সেটাকে এখানে রেখেই যেতে হচ্ছে অনিশ্চয়তার পথে।

যাবার বেলায় দর্পণকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে রাফিদ নিজের হৃদয়ের সমস্ত আবেগ মিশিয়ে বলল,

“আমাকে ভুলে যাবি তুই? মনে রাখিস প্লিজ। আবার যখন দেখা হবে, এভাবেই আমার কোলে ঝাপিয়ে পড়বি তো?”

রাফিদ জানে এই কথাগুলো দর্পণকে বলা অর্থহীন, সে কিছুই বুঝবে না। তবুও বললে যদি বুকে জমা জগদ্দল পাথরের বোঝা কিছুটা হালকা হয়!

দর্পণ হেসে সাড়া দিল, “আসি রে। আবার কবে তোকে এভাবে কোলে নিতে পারব জানি না। ভুলে গেলে কিন্তু আমি খুব কষ্ট পাব ছোট্ট বন্ধু। মনে থাকবে?”

দর্পণ এখন মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়, না করতে পারে। কথা না বুঝলেও কিছু প্রশ্ন করা হয়েছে বুঝতে পারলে, কথা না বুঝেও নিজের মতো মাথা নাড়ায়।

এবার হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। রাফিদ হেসে ফেলল, সাথে দর্পণও।

দর্পণ ওকে কিছুতেই ছাড়তে চাইছে না, বুকের কাছের শার্ট খামচে ধরে আছে। বাসের সময়ও হয়ে আসছে। রাফিদের মনে হচ্ছিল একে সাথে করে যদি নিয়ে যাওয়া যেত! কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়।

কোনোমতে দর্পণের হাত ছাড়িয়ে মলিনার কাছে দিয়ে দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে এলো, অবোধ্য, আদুরে শিশুটা কাঁদছিল, ওর সাথে ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিল গতকাল। আজও সম্ভবত যেতে চাইছিল সাথে।

গেট পেরুবার সময় একবার পেছনে তাকিয়ে হাত নেড়ে বিদায় নিল, দর্পণ হাত ইশারায় ওকে ডাকছিল কী ভীষণ মায়া নিয়ে। দ্রুত পায়ে রিকশায় উঠে ভিজে আসা চোখ মুছে নিল রাফিদ। ওর সমস্তটা জুড়ে আজ কেবলই ভাঙনের সুর, সে সুর কী ভীষণ মর্মভেদী! চাপা কান্নায় ভেতরটা ভেঙে আসতে চাইছে।

***
সামনের মাসেই দর্পণের প্রথম জন্মদিন। আর অল্প কয়েকদিন পরেই এক বছর হয়ে যাবে, ওর মাতৃত্বের এক বছর, একলা চলার এই দুঃসহ সময়টাকে সে কোনোদিন মন থেকে মুছতে পারবে না।

সামনের সপ্তাহে আবারও ওকে ফিল্ড ভিজিটে যেতে হবে। কাজের চাপও বেড়েছে এখন। রমা’দি অসুস্থ, ছুটি নিয়েছেন, সোমাও ছুটিতে। তাই কাজের চাপটা বেশি।

বাসায় এসে রাফিদের দেয়া সাইকেলটা দেখল তপা, মলিনা ওর জন্য দেয়া শাড়িটাও দিল।

তপা কিছু বলল না। রাফিদকে এরা সবাই পছন্দ করে। তাছাড়া এটা নিয়ে সিনক্রিয়েট করার কোনো মানে হয় না। যাকে বলা যেত সে তো চলে গেছে।

এটা বেশ ভালো হয়েছে। একটা মরীচিকার পেছনে ছুটে সময় নষ্ট করা উচিত নয়। এখন নতুন করে জীবনটা শুরু করুক। ইনফ্যাচুয়েশন ক’দিনেই কেটে যাবে ছেলেটার।

***
রাফিদ বাসায় ফেরার আগে জয়নুলের অফিসে এসেছে। এখানে আসলে ওর দম বন্ধ লাগে। তবুও ওর উপরে নির্দেশ ছিল, আগে যেন তার সাথে দেখা করে তারপর বাসায় যায় রাফিদ। গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা আছে, যা বাসায় বলতে চান না তিনি।

রাফিদের গা জ্বলে যাচ্ছিল, কিন্তু আপাতত সে নিরুপায়। নিজের জন্য কোনো ভয় নেই, ওর সমস্ত ভয় তপাকে নিয়ে। ওর এই দুর্বলতার জায়গাটা তিনি ধরে ফেলেছেন। সেটা দিয়েই রাফিদের গলায় লাগাম পড়াতে চাইছেন।

রাফিদও বুনো ঘোড়া, লাগামে ক’দিন বাঁধতে পারবেন তিনি।

একরাশ তিক্ততা নিয়ে বাবার কেবিনে প্রবেশ করল রাফিদ৷ এত কীসের গুরুত্বপূর্ণ কথা যা বাসায় বলা যায় না, সেটাই শুনতে চায়৷ নিশ্চয়ই প্রিয় কোনো কথা তিনি বলবেন না। অপ্রিয় কথায় নিজেকে কতক্ষণ ধরে রাখতে পারবে তাও সে জানে না।
……….
(ক্রমশ)