#নিভৃত_দহনে (পর্ব ২২)
নুসরাত জাহান লিজা
রাফিদ বাবার জন্য অপেক্ষা করছে, দশ মিনিট পরে ডাক এলো। এত জরুরি তলব, এখন অপেক্ষা করতে হচ্ছে বলে সে বিরক্ত। বাবার কাছে তার কাজ ছিল ফার্স্ট প্রায়োরিটি। রাফিদ বরাবরই পিছিয়ে ছিল। ছেলেবেলায় জন্মদিনের কেক নিয়ে সে কতবার বাবার জন্য অপেক্ষা করেছে! তিনি ফিরেছেন একেবারে শেষ বেলায়। ফাইভে বৃত্তি পেয়েছিল, তখন তিনি দেশের বাইরে। সবসময় ওর যত আবদার সব ছিল মা’য়ের কাছে। ওর জীবনের বেশিরভাগ বিশেষ মুহূর্তগুলোতে সে বাবাকে পাশে পায়নি। তিনি কেবল ওর কৃতিত্ব কিংবা সাফল্যের গর্বটুকুই নিয়েছেন, সঙ্গ দেননি কখনো। বরং সেই গর্ব কী করে আরও চওড়া হয় সেজন্য নানা কিছু ওর উপরে চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন। ছোট্ট রাফিদ যত বড় হয়েছে, ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে বেড়েছে দূরত্ব।
আজ হঠাৎ করেই যে সবকিছু পরিবর্তন হয়ে যাবে এটা আশা করা বৃথা। ভেতরে গিয়েই রাফিদ তাড়া দিল,
“কী বলার আছে বলো।”
জয়নুল রাফিদকে নিরীক্ষণ শেষে বললেন, “আরে, এত তাড়া কীসের? জার্নি করে এসেছ, আগে বসো। মুখটা ধুয়ে আসো৷ আমি খাবার দিতে বলি। খেয়ে সুস্থির হয়ে নাও। তারপর বলি।”
রাফিদ অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসল, কিন্তু খেতে ওর বড্ড অনীহা, “আমি খাব না। যা বলার তাড়াতাড়ি বলো। বাসায় গিয়ে রেস্ট নেব। তাছাড়া যা বলার বাসায়ই বলতে পারতে, এখানে কেন?”
জয়নুল যেন আজ রাফিদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন। কিছু কাগজপত্র চোখ বোলালেন, সিগনেচার করলেন, এরপর মুখ তুলে হেসে বললেন,
“আজ যা বলব তা বাসায় বলতে চাই না। আমি চাই আজ আমাদের মধ্যে যেই কথা হবে তা তোমার মায়ের কানে না যাক।”
“কেন?”
“গল্পটা বোধহয় তুমি জানো, তাও আমার দিকটা বলি। তোমার মা’কে আমি অসম্ভব ভালোবাসি। তখন আমার কিছুই ছিল না। আমার জন্মের সময় মা চলে যান৷ বাবা আরেকটা বিয়ে করলেন। আমি বড় হলাম ভীষণ অনাদরে আর অবহেলায়। কোনোমতে পড়াশোনা শেষ করলাম। টিউশনির টাকায় চলে যায় কোনোমতে। কিন্তু আমার মধ্যে তখন অন্য একটা স্পৃহা। আমার বাবার ধন সম্পদ অনেক ছিল। ধনাঢ্য পরিবারে জন্মেও আমাকে যে স্ট্রাগলের মধ্যে যেতে হয়েছে, শুনতে হয়েছে আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। আমি ভেঙে পড়তাম ভেতরে ভেতরে, তবুও একটা অদম্য জেদ চাপত, দেখিয়ে দেবার জেদ। আমাকে দিয়ে কেন হবে না! আমি চেষ্টা করব, হাল ছাড়ব না। একটা ছোট্ট চাকরি হলো, শিরীনদের এলাকায়। ভাবলাম শুরু করি, প্রমোশন আছে, পরে অন্যকিছুতেও যাওয়া যাবে। তখন শিরীনকে দেখি। কথা হতো রাস্তায় মাঝেমধ্যে। ওকে ওর বাবা এরজন্য শাসিয়েছেন। তখনকার দিনে এখনকার মতো ছিল না, একটা অপরিচিত ছেলের সাথে তার মেয়ে কথা বলছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সেটা তিনি নিতে পারেননি। তখনও আমাদের সম্পর্ক শুরু হয়নি। ওই যে একটা নিষেধের দেয়াল তুলে দিলেন, সেটাই হয়তো অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। আমার কথাবার্তায়, সততায় সে মুগ্ধ হয়েছিল। ওর মুগ্ধতা আমি টের পেতাম। আমি নিজেও তখন মুগ্ধ হতাম। কী সহজভাবে ও জীবনকে দেখত। ওর জীবনবোধ আমাকে আকর্ষণ করত। সায়েদার মাধ্যমে আমাদের চিঠির আদানপ্রদান হতো। সায়েদার বিয়ে হয়ে গেলে আমরা সমস্যায় পড়লাম। নানারকম অজুহাতে শিরীন বাইরে বের হতো। সময়গুলো খুব সুন্দর ছিল, উৎকণ্ঠার ছিল। একদিন ওর মতের বিরুদ্ধেই বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। পরেরদিনই বিয়ে। আমি পাগলের মতো হয়ে গেলাম, এরমধ্যে একটা চিঠি পেলাম সায়েদার মাধ্যমে, সে তখন বাড়িতেই ছিল। এই বিয়ে সে কোনোমতেই করতে রাজী নয়, আমি সায়েদার হাতে এক লাইনের একটা চিরকুট দিলাম।
‘আমার প্রতি বিশ্বাস থাকলে আজ রাতে যে করেই হোক, বেরিয়ে এসো। আমরা পালিয়ে যাব।’
সেদিন শিরীন পরম ভরসায় আমার হাত ধরে নিজের সমস্ত কিছু বিসর্জন দিয়ে পালিয়ে এসেছিল। এরপর আমার সাথে কতভাবেই না স্ট্রাগল করেছে, একটা স্কুলে পড়ানোর পাশাপাশি টিউশনি চলেছে। আমি তখন উদভ্রান্তের মতো ঘুরছি, আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছে। কত হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরে যে সুদিন ফিরেছে, সে আর নাই বা বললাম। ওই ভদ্রমহিলার কাছে আমার ঋণের শেষ নেই। অসম্ভব ভালোবাসার ক্ষমতা নিয়ে সে পৃথিবীতে এসেছে। তোমার প্রতি ওর ভালোবাসা পুরোপুরি অন্ধ। তুমি যা করবে, তা ঠিক হোক, ভুল হোক, সে অন্ধভাবে তোমাকে সাপোর্ট দিয়ে যাবে। তাই আমি চাই না, এসব সে জানুক।”
কিছুক্ষণ থেমে তিনি আবারও বললেন, “তোমাকে এত কথা বলার কারণটা এবার বলি। বাস্তবতা ভীষণ রূঢ়, তোমার মাথার উপরে আমার নাম জুড়ে আছে বলে তুমি বাস্তবতা সম্পর্কে অজ্ঞ। মানুষ টাকা ছাড়া তোয়াজ করে না, টিস্যু যেমন ব্যবহারের পরে মূল্যহীন হয়ে যায়, পায়ের নিচে শক্ত মাটি যাদের থাকে না, তাদেরকেও মানুষ ওই ব্যবহৃত টিস্যু মনে করে। এত পরিশ্রম করে আমি যা অর্জন করেছে, এতে আমার শ্রম, ঘাম, মেধা, মনন, মগজ সমস্ত কিছু ক্ষয় করতে হয়েছে। এর সবই আমার অবর্তমানে তোমার। আমি চাই না আমার আর তোমার মা’য়ের এত স্ট্রাগল বৃথা যাক৷ তোমার এবার দায়িত্ব নেবার সময় এসেছে।”
রাফিদ এতক্ষণ ধরে একটা কথাও বলেনি, মায়ের কাছ থেকে সে তাদের গল্পটা শুনেছে, আজ অপর প্রান্তের মানুষের কথাটাও শুনল। তবে অন্যভাবে।
রাফিদ বলল, “সেটা নাহয় বুঝলাম। কিন্তু এটা বাসায় বলা যেত। তুমি আরও কিছু বলবে আমি জানি। বলে ফেলো।”
“রাফিদ, আমি ওই ডিভোর্সি মেয়েটা, কী যেন নাম? যাই হোক, ও তোমার জন্য উপযুক্ত পছন্দ নয়। আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। তরীর সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছি। তুমি আমার ব্যবসায় বসতে চাওনি কখনো, তাই অন্য চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম কয়েকবার। তুমি সেখানেও থিতু হওনি। তাই এবার একটাই অপশন বাকি। কাল থেকেই আমার সাথে অফিসে আসবে। দুই মাস পরে বিয়ে করে সংসার শুরু করবে।”
রাফিদ এবার ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলল, “অসম্ভব। আমি বিয়ে করব না কিছুতেই। তুমি বিয়েটা ভেঙে দাও।”
“আমার শর্তের কথা ভুলে গেছ বোধহয়? মেয়েটাকে তার সন্তানসহ পথে বসাতে চাও?”
রাফিদের হাতের মুঠো শক্ত হলো, “আমি বিয়ে করব না বাবা। তোমার পছন্দের মেয়েকে ঠকানো হবে। আমি কাউকে ঠকাতে চাই না।”
জয়নুল কিছুক্ষণ ভাবলেন, এরপর কফির মগে চুমুক দিয়ে বললেন, “ঠিক আছে, বিয়ে তো এখনই হচ্ছে না। ওটা থাক। অন্য শর্ত যেহেতু তুমি নিজেই চাইলে, তাই বলি, আগামী এক বছর আমার অনুমতি ছাড়া তুমি ঢাকার বাইরে যাবে না।”
“এটা কী ধরনের কথা? তুমি… “
রাফিদকে থামিয়ে দিয়ে জয়নুল বললেন, “মন দিয়ে কাজ করবে। ব্যবসা সহজ বিষয় নয়, শিখে পড়ে নিতে অনেক সময় লাগবে। তবে তরীকে বিয়ে করতে রাজি হলে এই নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে। আর না হলে তোমার মন মর্জিমতো ভবঘুরেপনা বন্ধ। আমার কথার নড়চড় হলে মনে রেখো, তার ফল ভোগ করতে হবে ওই মেয়েকে।”
রাফিদ চোখেমুখে অন্ধকার দেখছে, চোখের সামনে বাবার মুখটা যেন পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে, তার সৌম্য মুখে কেমন ক্রুরতার ছাপ। রাফির মুক্ত পাখির মতো উড়ে বেড়াতে ভালোবাসে। চিরকালই সে বহমান নদী। আজ তাকে শৃঙ্খলিত করা হচ্ছে। বুনো পাখিকে খাঁচায় পুরে দিলে যেমন দমবন্ধ হয়ে আসে, তেমন অনুভূতি হচ্ছে।
“বলো, বিয়ে না বন্দীত্ব কোনটা চাও?” তাগাদা দেন জয়নুল।
সে তপাকে ভালোবাসে, দর্পণকে ভালোবাসে। তরীকে বিয়ে করে সে ভালোবাসার অপমান করতে পারবে না, তরীকেও অসম্মান করা সম্ভব নয়। আবার বন্দীত্ব ওর জন্য অসহনীয় যন্ত্রণার। সে হাঁপিয়ে যায় এই ইট কাঠের জঞ্জালের মধ্যে। প্রকৃতি ওকে দূর্বার হাতছানিতে কাছে ডাকে। সেই ডাক সে উপেক্ষা করতে পারে না।
আগে গল্প শুনত ভালোবাসলে নাকি গরলও সুধা মনে হয়। আজ তার প্রমাণ সে নিজেই পেল। নিজের সহজাত ভালোবাসা সে আজ বিসর্জন দিল। প্রকৃতির ডাক তাকে এবার উপেক্ষা করতেই হবে। রাফিদের মতো একজন বাঁধনহারা মানুষের জন্য হাতে পায়ের শেকল যে কত অসহনীয়, এটা বাবা জানেন। তাই এই মোক্ষম চাল তিনি দিয়েছেন। বিয়ে করে ফেললেই সে তপাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে। কোনো আশা অবশিষ্ট থাকবে না। ভালোবেসে কত মানুষ কত কী ত্যাগ করে, সে নাহয় প্রকৃতিকেই ত্যাগ করল!
ওর গলায় কথারা যেন বাষ্পীভূত হয়ে গেছে, স্বর বেরুচ্ছে না, তবুও অস্ফুটস্বরে বলল,
“ঠিক আছে, এক বছর নাহয় তোমার পাপেট হয়েই থাকলাম।”
জয়নুল এতটা আশা করেননি, তার ছেলে বরাবরই বড্ড বেয়ারা, বেপরোয়া। সে এত অবলীলায় তার কাছে নতি স্বীকার করবে। তবে তিনি খুশি, টাকা একটা নেশার মতো। এই নেশা ততদিনে রাফিদের রক্তে মিশে যাবে এটুকু তার বিশ্বাস।
“তবে তুমিও মনে রেখো, তপার যদি কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করো, আমাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে।” বহুকাল পরে যেন কথা ফুটল রাফিদের মুখে।
“আমি কথা দিলে কথা রাখি। আর যাই হোক, আমি সততার মূল্য দেই। তাছাড়া আমার একমাত্র কনসার্ন তুমি। কোথাকার কোন মেয়ে, ভালো থাকলে থাকুক তার মতো। আমার তাতে কী এসে যায়। তুমি ঠিক থাকলে সেও বহাল তবিয়তে ঠিক থাকবে।”
রাফিদ উঠল, এরপর বলল, “মা যদি কখনো তোমার এই চেহারাটা দেখে, কী হবে ভেবে দেখেছ?”
“সে জানবে না। এটাও শর্তের অংশ। কাউকে না কাউকে কঠোর হতে হয় সন্তানকে পথে ফেরাতে। তোমার মা তো সেটা করবে না। তাই অপ্রিয় কাজের ভার আমাকেই মাথায় তুলে নিতে হলো। একদিন এই কাজের জন্য তুমি আমাকে ধন্যবাদ দেবে।”
“ধন্যবাদ দেব, নাকি তিরস্কার সেটা সময়ই বলে দেবে। তুমি একটু আগে বললে মাকে ভালোবাসো। ভালোবাসা হারাবার যন্ত্রণা জানো না?”
বলেই বেরিয়ে গেল রাফিদ। ওর বুকে উথাল-পাতাল হচ্ছে। বিরামহীন ভাঙণের শব্দ সে শুনতে পাচ্ছে, পুরো পৃথিবী কি শুনতে পাচ্ছে?
প্রেমের সমস্ত গরলটুকু রাফিদই নাহয় হজম করে নিল, অমৃতসুধাটুকু তপা আর দর্পণের জন্য বরাদ্দ থাকুক।
………
(ক্রমশ)
#নিভৃত_দহনে (পর্ব ২৩)
নুসরাত জাহান লিজা
তপা অফিসে যেতে যেতে মাকে কল দিল, “মা, তোমার জন্য একটা শাড়ি আর ভাইয়ার বাবুর জন্য কিছু জামা পাঠিয়েছি কুরিয়ারে।”
“সে কী! আমার জন্য শাড়ি কেনার কী দরকার ছিল, এই তো মাসের শুরুতেই টাকা পাঠালি।”
“মা, আগে তো কখনো নিজে কিছু দিতে পারিনি, তাছাড়া শাড়িটা তোমাকে মানাবে। দর্পণের জন্য কিছু কেনাকাটা করছিলাম, ওর তো জন্মদিন পরশু। মাশাল্লাহ্, বড় হচ্ছে দ্রুত। আগেরগুলো ছোট হয়ে যাবে। তখন শাড়িটা পছন্দ হয়ে গেল। তাই কিনে ফেললাম তোমার জন্য।”
কবীরের সংসারটা কি কখনো ওর নিজের সংসার ছিল! তপার বাবা যখন চলে গেলেন, তপার ইচ্ছে হতো মার জন্য কিছু করতে। বাবা তার খরচের টাকা রেখে বাকি টাকা তুলে দিতেন মায়ের হাতে। নিজের মতো করে তিনি সংসার চালাতেন। খরচ বাঁচিয়ে ঘরের এটা-সেটা কিনতেন। কখনো হাত পেতে চাননি। স্বামীর পেনশনের টাকা তিনি এখনো পান, তবুও তখন সদ্য স্বামী হারিয়ে শোকের সাগরে সাগরে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি।
সরকারি অফিসগুলোতে অনেক ছোটাছুটি করতে হয়। টাকাপয়সা লাগে। খুব ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল মা আর তুহিনকে সেই সময়। তপার খুব ইচ্ছে হতো পরিবারের জন্য কিছু করতে। কবীর নিজেই টাকা দিত। তবে এই দেয়াকে সে খুব জোর গলায় জাহির করত, যে তপার পরিবারের জন্য যে কী কী করছে, নইলে ওরা ভেসে যেত।
তপার তখন নিজেকে খুব ছোট মনে হতো। সে চাকরি করতে চাইত, কিন্তু কবীরের পছন্দ ছিল না। বলত,
“আমার কি কম আছে? তোমাকে ভরনপোষণ দিতে পারছি না?”
তপা তখনও আপোষ করেছিল। চেয়েছিল সংসারটা টিকুক। হয়তো টুকটাক প্রতিবাদ করেছে কথার, কিন্তু তখনও তো কবীরকে চেনার অনেক বাকি ছিল!
“তোর জন্য কিনিসনি?”
তপা ক্ষণকালের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল, ধাতস্থ হয়ে বলল, “আমার শাড়ি আপাতত লাগবে না। লাগলে কিনে নেব।’’
এই যে নিজের মতো করে মাকে মন খুলে দিতে পারছে, এটাও তো এক ধরনের মুক্তি!
আজ ভীষণ গরম পড়েছে, কেমন প্যাচপ্যাচে ভ্যাপসা ধরনের গরম। সকাল সকাল সূর্য উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে। গোসল করেই বেরিয়েছে তপা, অথচ এরইমধ্যে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। রিকশা চলছে হেলে-দুলে। মৃদু ঝাঁকুনিতে নড়েচড়ে বসল তপা, এরপর প্রশ্ন করল,
“ভাইয়ার বাবুর নাম রেখেছো তোমরা?”
জহুরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “না, এখনো খোঁজ চলছে, যুগের সাথে মানানসই নাম খুঁজছে ইলা।”
“ও, তুমি কি কোনো নাম সাজেস্ট করেছিলে মা?”
জহুরা একটু ইতস্তত করে বললেন, “সেভাবে না, তবে তোর বাবার ইচ্ছা ছিল আমাদের আরেকটা মেয়ে হলে নাম রাখবে তরু। তপা’র বোন তরু। আমার তো তোর পরে আর সন্তান হয়নি। নামটাও আমার পছন্দেরই ছিল। তাই ওইটা বলেছিলাম যে এই নাম রাখতে পারো। ইলা হেসে উড়িয়ে দিল। বললো, তরু নাকি সেকেলে নাম। থাক, ওর মেয়ে, যা পছন্দ রাখুক।”
বললেন বটে, তবে তপা বুঝল, মা মনে মনে কিছুটা হলেও কষ্ট পেয়েছেন। বাবা যেমন তুহিনের চাইতে তপাকে বেশি স্নেহ করেছেন রাখঢাক না করে, মা তেমন তুহিনকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন সবসময়। ছেলের প্রতি তার অগাধ স্নেহ। সেটা কি কেবলই ছেলে বলে! না-কি প্রথম সন্তান বলে সেটা অবশ্য তপা জানে না।
তুহিনের প্রতি তার টান ইদানিং কখনো কখনো হোঁচট খাচ্ছে বলেই কি তিনি কষ্টটা বেশি পাচ্ছেন, ছোট বড় যেকোনো কারণে! হবে হয়তো!
“হ্যাঁ রে, তুই বাসায় কবে আসবি? সেই যে গেলি, আর একবারও এলি না।”
তপা ইচ্ছে করেই যেতে চায় না। তুহিন আর ইলার সাথে ওর সম্পর্ক ভালো নয়। তাছাড়া গেলেই আত্মীয়স্বজন আসবে, সহানুভূতির ছলে ওকে কিছু বিদ্রুপাত্মক কথাবার্তা শোনাবে। এসব যদিও গায়ে লাগে না আর, তবুও ভালো লাগে না। কুৎসিত মনে হয়। মানুষের কুৎসিত রূপ দেখতে ইচ্ছে করে না।
“বাড়িটা ভাঙার আগে একবার অন্তত আসিস।”
“দেখি মা, এখন রাখছি, অফিসে চলে এসেছি।’’
রিকশার ভাড়া মিটিয়ে নামল তপা। আরও একটা কর্মব্যস্ত দিন শুরু হলো।
***
রাফিদের সময় কাটছে ব্যস্ততায়। অফিসের কাজকর্ম ওকে কোনোদিন টানেনি। বাধ্য হয়ে কাজ করতে হচ্ছে বলে একটা বিতৃষ্ণা তৈরি হলো কয়েকদিনের মধ্যেই।
জয়নুল চোখে চোখে রাখেন ছেলেকে। তার দৃঢ় বিশ্বাস, তার ছেলে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলবে, এরপর তরীকে বিয়ে করে স্বাধীনতা ফেরত পেতে চাইবে। সেজন্যই এমন শর্ত দিয়েছেন তিনি।
তার ছেলে ভীষণ ব্রাইট, দ্রুত কাজ শিখে নিচ্ছে। লেগে থাকলে তিনি নির্ভার হবেন।
এখন সারাদিনে দুটো ভালো মুহূর্ত আসে রাফিদের, যার জন্য সে অপেক্ষা করে। প্রথমটা তো বাসায় ফিরে মায়ের সাথে কিছুটা একান্ত সময়, তার নিবিড় স্নেহমাখা হাত যখন মাথায় বিলি কাটে তখন ক্লান্তি উবে যায়। আরেকটা মুহূর্ত হলো দর্পণের সাথে ভিডিওকলে কথা বলার মুহূর্ত।
প্রতিদিন সকাল এগারোটার দিকে সে একবার করে মলিনাকে কল দেয়। দর্পণকে দেখে দু-চোখ ভরে। কথা বলে, দর্পণ সাড়া দিলে ভেতর খুশির ফল্গুধারা বয়ে যায়।
হাত ইশারা করে যখন ওকে কাছে ডাকে, তখন ইচ্ছে করে ছুটে যেতে, কিন্তু এখন ওর হাত-পা বাঁধা। প্রবল ইচ্ছে কখনো কখনো পরাজিত হয় চরম বাস্তবতার কাছে, জীবনের জটিলতার কাছে। সে-ও আপাতত পরাজিত সৈনিক।
তপা যদি ওকে ভালোবাসত, এসব শর্ত টর্ত সে থোড়াই কেয়ার করত, চলে যেত ওর কাছে। একসাথে পথে নামলে একটা না একটা উপায় বেরিয়ে আসত। এত বড় পৃথিবীতে কিছু একটা ব্যবস্থা হয়েই যেত ওদের।
কিন্তু তপা তো ওকে ভালোবাসে না। এখন ওর জন্য কোনো ক্ষতি হলে মেয়েটার মন ওর প্রতি বিষিয়ে যাবে, সে সাহায্য করতে চাইলেও নেবে না। বরং অসম্মানিত হবে।
এটা সে করতে পারে না। ওকে এই বন্দীত্বে অভ্যস্ত হতেই হবে, যত কষ্টই হোক। এটা এক ধরনের এসিড টেস্ট ওর জন্য, অগ্নিপরীক্ষা। এই পরীক্ষায় জয়ী হতেই হবে।
আজ কল দিতেই মলিনা বলল, “আইজকা আপা বাসাত।”
“বাসায়? কেন? অসুস্থ?”
“না না, আইজকে তো বাবুর জন্মদিন। তাই ছুটি নিসে।”
দর্পণের জন্মদিন আজ! ইশ, রাফিদ যদি যেতে পারত!
“দর্পণ কই এখন?”
“আপার কাছে। দিমু?”
“না, থাক। যখন তোমার কাছে থাকবে, তখন কল দিও।”
কল কেটে রাফিদের মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। দর্পণের প্রথম জন্মদিন, আর সে যেতে পারছে না! তপার কাছে আছে এখন, কথা বলতেও পারবে না।
ভেতরে রক্ত ছলকে উঠছে সেখানে যাবার জন্য। একবার মনে হচ্ছে সব চুলোয় যাক, সে অবশ্যই সেখানে যাবে, যেখানে ওর সুখ। কিন্তু সে পারছে না। ওখানে তপা ওকে অভিবাদন জানানোর জন্য নিশ্চয়ই বসে নেই, এখানেও নানারকম জবাবদিহিতায় সে নাকাল।
কী অমোঘ অলঙ্ঘনীয় টানে যে ওকে টানছে সিলেট! কিন্তু..
সব মিলিয়ে ভীষণ অসহায় লাগছে ওর। আচ্ছা, দর্পণ যদি আরেকটু বুঝতে শিখত তবে ওকে আমন্ত্রণ জানাতো না? অবশ্যই জানাত। এত ভালো বন্ধুকে রেখেই সে নিজের জন্মদিন উদযাপন করত না নিশ্চয়ই!
নিজেকে ভোলাতে ছেলেমানুষী চিন্তা পেয়ে বসেছে রাফিদকে।
***
তপা ভেবেছিল সেভাবে উদযাপন করবে না। কারণ দর্পণ এখনো সেভাবে বুঝতে শেখেনি। ছেলের সাথে দিনটা কাটাবে বলেই ছুটিটা নেয়া। পরে মনে হলো, সায়েদা আন্টিকে বলা যেতে পারে। সোমাও অফিসে যাচ্ছে এখান থেকেই। ওদের জন্য খাবার আয়োজন করলে কেমন হয়!
আবার ছেলের জন্মদিন বলে ছুটি নিয়েছে, কলিগদের না বললেও কেমন দেখায়! ওরা এমনিতেই নানা সময় ওর রান্না খেতে চায়। টিফিন ভাগাভাগি করে খেতে খেতে এসব বলে। এই উপলক্ষে তাদেরও বলা যায়।
করবে না করবে না করেও বেশ ভালো আয়োজন হয়ে যাচ্ছে। অফিসের পরে আসলে আটটার মধ্যে খাবার আয়োজন শেষ করতে হবে।
তপা আর মলিনার আজ ফুরসৎ নেই। সোমা লাঞ্চ আওয়ারে চলে এসে দর্পণকে নিয়ে গেল উপরে।
এরপর রাফিদকে কল দিল।
“এখন বলো, কাহিনী কী? দর্পণের সাথে কথা বলার জন্য উদগ্রীব, আবার তাতে লুকোছাপা কেন?”
রাফিদ ভাবছে বলবে কিনা, এরপর বলেই দিল। সোমাকে যতটা চিনেছে তাতে এটুকু জানে, অন্যের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সে কখনো টিপ্পনী কাটবে না।
“আমি ওকে প্রপোজ করেছিলাম। সে রিজেক্ট করে দিয়েছে।”
“বুঝলাম। জটিল প্রেমের গল্প।”
“তাছাড়া দর্পণ আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।”
“তোমার ঘ্যানঘ্যানানিতে আমি আজ বসের ঝাড়ি খেয়েছি ছুটি চেয়ে। দর্পণের পাশাপাশি আমাকেও গিফট দিতে হবে কিন্তু। এই বলে দিলাম।”
সোমা যে সহজভাবে নিয়েছে, এতে রাফিদ স্বস্তি পেল।
“গিফট পাবে। আরেকটা কথা, কথাটা কিন্তু টপ সিক্রেট। কাউকে বলো না যেন, রবীনকেও নয়।”
“আমি ভরসাযোগ্য মানুষ। কত বান্ধবীর গোপন প্রেমের খবর হজম করে ফেলেছি।”
রাফিদ দর্পণকে ডেকে বলল, “শুভ জন্মদিন বন্ধু। তাড়াতাড়ি বড় হ, যাতে মা’কে একটু বোঝাতে পারিস। শুদ্ধ মানুষ হ জীবনে এই দোয়া থাকল।”
………
(ক্রমশ)