নিভৃত দহনে পর্ব-২৮+২৯

0
39
নিভৃত দহনে পর্ব-০১
নিভৃত দহনে

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ২৮.১)
নুসরাত জাহান লিজা

সোমা আজ বেশ কিছুদিন পরে শ্বশুরবাড়ি এসেছে। গত সাপ্তাহিক ছুটিতে তপার জন্য আসেনি। খাবার টেবিলে রবীনের মা হঠাৎ প্রশ্ন করলেন,

“তোমার ট্রান্সফারের কতদূর বাকি?”

“হয়ে যাবে, মা।” উত্তরটা দিল রবীন।

“তোদের লাইফ, তোরাই ডিসাইড করবি। তবে বিয়ে তো অনেকদিনই হলো। এখনো তোরা ঠিকমতো সংসারটা শুরু করতে পারলি না। জিনিসটা কেমন না?”

সোমা একবার আড়চোখে তাকালো রবীনের দিকে, ওর বাবা বললেন,

“আচ্ছা, এখন এসব কথা থাক। পরে নাহয় হবে একসময়।”

সোমা ঘরে এসে রবীনকে প্রশ্ন করল, “তুমি কি বিরক্ত?”

“কেন?”

“আমার ট্রান্সফার নিয়ে, বিয়ের পরের লাইফ নিয়ে?”

“রবীন এগিয়ে এসে সোমার হাত দুটো মুঠোয় নিয়ে বলল, “সব ঠিক হয়ে যাবে।”

সোমার মনে হলো যাবতীয় সবকিছুতে শেষ পর্যন্ত স্যাক্রিফাইস মেয়েকেই করতে হয় যেন! ছেলেরা এসব দায় থেকে মুক্ত।

***
“রাফিদ এভাবে কতদিন গিয়ে পড়ে থাকবে? অফিস কি ওর জন্য বসে থাকবে?”

জয়নুলের কথায় শিরীন উঠে বসল, “তুমি এত অস্থির হচ্ছো কেন? ও এখন যথেষ্ট বড় হয়েছে। নিজের ভালো-মন্দ বোঝার মতো পরিপক্কতা ওর আছে। অযথা এটা কর, ওটা কর বলে চাপিয়ে দেবার বয়স কি ওর আছে?”

“তোমার সাথে ওর বিষয়ে কথা বলাই ভুল হয়েছে।”

“যাক বুঝতে পারলে।”

“এভাবে কথা বলছ কেন?”

“একটা কথা বলব?”

“কী কথা?”

শিরীন তার দিকে অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,

“আমার ইদানিং মনে হয়, তুমি বদলে যাচ্ছ। চেনা মানুষের মধ্যে অচেনা কেউ যেন বেড়ে উঠছে। কেন এমন মনে হয়?”

জয়নুল কিছুটা থমকে গেলেন যেন, এরপর বললেন, “বদলটা তো তোমার দৃষ্টিভঙ্গিরও হতে পারে, হয়তো তোমার দেখার চোখ বদলে গেছে।”

শিরীন আরও কিছুক্ষণ তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন, এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “হতেও পারে।”

***
তপার অবস্থা এখন আগের চাইতে ভালো। আগামীকাল রিলিজ দেয়া হবে হাসপাতাল থেকে। কিছুদিন খুব সাবধানে থাকতে হবে। কথা বলার ক্ষেত্রে, মাথায় প্রেসার যেন না পড়ে সেভাবে।

তবে পায়ের অবস্থা ঠিক হতে আরও সপ্তাহ তিনেক লাগতে পারে। প্রতিদিনের মতো আজও রাফিদ এসেছে দর্পণকে নিয়ে।

তপা দর্পণকে আদর করতে করতে হঠাৎ প্রশ্ন করল,

“তুমি অনেক করেছ রাফিদ। ভীষণ ঋণি হয়ে গেলাম।”

“ঋণ? কখনো কখনো গ্রহণ করেও ঋণি হওয়া যায়। শেষের কবিতা পড়োনি? ‘গ্রহণ করেছ যত, ঋণি তত করেছ আমায়?’”

তপার কথা বলতে হয় খুব আস্তে, সে সেভাবেই বলল,

“তুমি বন্ধু হিসেবে ভালো ছিলে। কেন শুধু বন্ধু হিসেবে থাকতে চাইলে না?”

ঘরজুড়ে নেমে এলো অপরিসীম নৈঃশব্দ্য, একসময় সেই নিঃসীম নির্জনতা ভাঙলা রাফিদের কথায়,

“পৃথিবীতে সবকিছু ছকে বাঁধা নিয়ম মেনে হয় না তপা। কিছু জিনিস হয়ে যায়, যার নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে থাকে না।”

হয়তো কথায় কথা বাড়ত, কিন্তু দর্পণবাবু কিছুক্ষণ এটেনশন না পেয়ে ভীষণ অভিমান করেছে, একা একা হাঁটতে শিখেছে, সেভাবেই হাঁটা শুরু করেছিল, পানির বোতল উল্টে ফেলে দিয়েছে হাঁটতে গিয়ে, এবং বুঝতে পেরেছে এটা একটা ভুল কাজ, তাই আগেভাগেই কান্না শুরু করেছে।

রাফিদ উঠে গিয়ে ওকে কোলে নিয়ে কান্না থামানোয় ব্যস্ত হয়ে গেল, তপা সেদিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে দৃশ্যটা দেখছিল।
…….
(ক্রমশ)

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ২৮.২)
নুসরাত জাহান লিজা

কতদিন পরে হাসপাতালের ওই বিচ্ছিরি জিনিসপত্র থেকে মুক্তি মিলেছে, আজ সে ছেলেকে বুকে নিয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে আছে। দর্পণ চুপচাপ মায়ের বুকের মধ্যে মাথা রেখে যে কতদিন পরে স্নেহময় প্রিয় স্পর্শ উপভোগ করছে৷

তপা পা নাড়াতে পারে না, মাথায় ব্যথা এখনো আছে, তবুও আজ দর্পণকে বুকে টেনে যেন সমস্ত জরা, ক্লান্তি এক নিমিষেই শূন্যে মিলিয়ে গেল, কতদিন পরে শান্তি পেল।

বিছানার পাশে চেয়ারে জহুরা বসে আছেন, তপা জিজ্ঞেস করল,

“নীলা কই মা?”

“ও তো উপরে। মলিনার সাথে রান্নাঘরে, বেশিরভাগ সময় ওর সাথেই থাকে।।”

“ও।”

“নানুভাইকে আমার কাছে দে। তোর কষ্ট হবে।”

তপা মৃদু হেসে বলল, “থাকুক না কিছুক্ষণ। শান্তি পাচ্ছি খুব।”

জহুরার মনে পড়ল তুহিন আর তপার ছেলেবেলার কথা, ওরা অসুস্থ হলে তাদের ঘুম উড়ে যেত। সেই ছোট্ট তপা এখন নিজেই মা। মায়েরা বোধহয় এমনই হয়। তপার অবস্থার কথা শুনে তিনি পাগলের মতো ছুটে এসেছিলেন। কী করবেন না করবেন কোনো দিগ্বিদিক খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তুহিন তো একদিন পরেই চলে গেল। রাফিদ না থাকলে তিনি কী করে সব দিক সামলে উঠতেন!

অন্যসময় হলে তিনি মেয়েকে এমন কাজের জন্য দুটো কড়া কথা শোনাতেন, কিন্তু নীলাকে দেখে, ওর অসহায়ত্বের কথা শুনে বরং মেয়ের জন্য তার বেশ গর্বই হয়েছে। তপা হয়েছে ওরবাবার মতো। মানুষটা যে কেমন পাগল ছিল! কখনো অন্যায়কে প্রশ্র‍য় দিতে চাননি। তিনি অনেকবার বলেছেন,

“মেয়েকে একটু শাসন করো।”

কিন্তু উত্তরে মানুষটা স্বভাবসুলভ মৃদু হেসে বলতেন, “শাসন করার কারণ থাকলে অবশ্যই করব। কিন্তু তেমন কিছু তো চোখে পড়ছে না। মেয়েদের একটু এমন হতেই হয় এই সমাজে চলতে গেলে। নইলে হোঁচট খেয়ে মেরুদণ্ড ভেঙে যাবে, আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।”

জহুরা সবসময় মাথা সোজা রাখতে পারেন না, তিনি ভীতু প্রকৃতির মানুষ। একটু কিছুতেই ভয় পান৷ গুটিয়ে রাখেন নিজেকে। তুহিন কি তার এই সত্তা পেয়েছে! কী জানি, হবে হয়তো!

“ওদিকে তোর ওই অবস্থা, দর্পণও আমার কোলে আসতে চায় না। মলিনার তোকে নিয়ে ব্যস্ততা। রাফিদ ছেলেটা না থাকলে ওকে সামলানোই যেত না।”

তপা এক হাতে দর্পণের পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল, সেই হাতটা ক্ষণকালের জন্য থেমে গিয়ে আবারও সচল হলো।

“হুম।”

“এত ভালো ছেলেটা। আজ-কাল কে অন্যের জন্য এতটা করে!”

এটা ঠিক, তপা পরিচয়ের শুরু থেকেই যেকোনো কিছুতে রাফিদকে ঝাপিয়ে পড়তে দেখেছে। এবার তো সকল কিছু ছাপিয়ে গেছে! তবুও তপার ঠিক কোথায় যেন বাঁধছে।

“হ্যাঁ রে তপা, রাফিদকে দেখে মনে হলো ও তোকে পছন্দ করে। তুই একবার ভেবে…”

তিনি এখন এই কথাটা বলতে চাননি, তবুও মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন, বলে ফেলা কথা ফিরিয়ে নেয়া যায় না।

“মা প্লিজ। এসব অসম্ভব কথা কেন বলো?”

“অসম্ভব কেন হতে যাবে? ও যদি তোকে পছন্দ করে, দর্পণকেও তো পছন্দ করে, তাহলে ভাবতে দোষ কী?”

“আমার কথা পরে বলি, আগে একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো মা, ধরো ভাইয়া যদি এমন কাউকে পছন্দ করত, যার অলরেডি একবার বিয়ে হয়েছিল, একটা বাচ্চা আছে, তুমি কী করতে?”

জহুরা উত্তর খুঁজে পেলেন না, তিনি মা হিসেবে এখনো এত উদার হতে পেরেছেন কি! তার সংস্কার, তার পারিপার্শ্বিক সমাজ তাকে বাঁধা দিত। লোকে কী বলব, এটা ভেবেই তিনি সারাজীবন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

“তুমি নিজের ছেলের ক্ষেত্রে এভাবে ভাবতে পারলে না, অথচ ভাবছ, অন্যের বাবা মা এটা করুক। এভাবে হয় না মা। কাউকে নিয়ে কিছু ভেবে ফেলার আগে, নিজেকে ওই পরিস্থিতিতে একটু বসিয়ে দেখো মা। তাছাড়া আমি এখন আবার বিয়ের কথা ভাবছি না। ”

“আচ্ছা৷ বুঝলাম। তুই একটু চুপচাপ বিশ্রাম নে। এত কথা বলা ঠিক না।”

জহুরা তপার বুকের উপর থেকে ঘুমন্ত দর্পণকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। তপাকেও আরেকটু আরামদায়কভাবে শুইয়ে দিলেন।

***
তপার বিষয়টা ভাইরাল হবার পর থেকেই সাংবাদিকদের আনাগোনা শুরু হয়েছিল হাসপাতালে। এদের মধ্যে অনেকগুলো স্থানীয় পোর্টালের রিপোর্টারই বেশি। অন্যরা কম।

রাফিদ তাদের সাথে কথা বলে ফিরিয়ে দিয়েছে আগে। আজ হাসপাতাল থেকে বাড়ির গেট পর্যন্ত চলে এসেছে। রাফিদ ওদের সাথে কথা বলছে।

“দেখুন, এই মুহূর্তে ওকে বিরক্ত করা উচিত নয়। গতকাল তপা পুলিশকে ওর পক্ষের স্টেটমেন্ট দিয়ে দিয়েছে। আপনারা তাদের কাছে যেতে পারেন।”

“নীলা তো এই বাড়িতেই, ওর সাথে কথা..।”

“একজন অসুস্থ মানুষ আর একটা ছোট্ট মেয়েকে আপনারা এসব ভিউ ব্যবসার মধ্যে টানবেন না প্লিজ। ওরাও এসব ক্যামেরায় বলে সিমপ্যাথি চায় না। স্টোরি করতে চাইলে পরে আসুন প্লিজ।”

রাফিদ জানে এদের মধ্যে কোনো কোনো সাংবাদিককে সে আজকে শ ত্রু বানিয়ে ফেলেছে। কী নিউজ করবে কে জানে! কিন্তু সে যথেষ্ট সহজভাবেই কথা বলেছে।

তপা এখনো হাঁটতে পারে না, মাথায় কী ভয়াবহ আঘাত। নীলা এখনো একটা ট্রমাটিক স্টেজে আছে, জাজমেন্টাল জনগনের সামনে ওদের আসার উপযুক্ত সময় এটা একদম নয়।

সোস্যাল মিডিয়ায় কোনো ভিডিওতে যেভাবে লোকে ‘হেট কমেন্ট’ করে, গায়ের রঙ, বডি শেমিংসহনানা রকমের কথাবার্তা লিখে নিজেদের ফ্রাস্ট্রেশন উগড়ে দেয়, সেটা একটা বিশাল বড় ক্রাইম, এটা কি তারা জানে! রাফিদ ভেবে পায় না।

রাফিদ উপর তলায় সায়েদা আন্টির বাসায় ঘাঁটি গেড়েছে আপাতত।

রুমে এসে সবে একটু গা এলিয়ে দিয়েছিল, এরমধ্যে বাবার কল পেল। রিসিভ করবে না করবে না ভেবেও রিসিভ করল।
……
ক্রমশ

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ২৯)
নুসরাত জাহান লিজা

তপা কিছুদিন থেকে ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করছে। দীর্ঘ ছুটির পরে এভাবে একটু একটু করে অফিস যাতায়াত শুরু করেছে, বলাই বাহুল্য রাফিদ দিয়ে যাচ্ছে, আবার দুই-তিন ঘণ্টা পরে গিয়ে নিয়ে আসে।

মনিরুল আলম অনেক চেষ্টা চরিত করে ওর বিষয়টা ম্যানেজ করে নিয়েছেন। তিনি মাঝেমধ্যে কথা শোনালেও তার অধীনস্থ এমপ্লয়িদের প্রতি তার বেশ সহানুভূতি আছে, যা সচরাচর প্রকাশ করেন না।

তপার ওষুধ খাবার সময় হলেই রাফিদ এসে খোঁজ নিয়েছে এই ক’দিন। ইচ্ছা থাকলেও সে সবসময় আসে না। তপা যদি অস্বস্তি অনুভব করে তাই।

জহুরা যখন তপার পাশে বসে থাকেন, সে আন্দাজ করে সেই সময়ই যায়। যদিও দু’জনেই পরিণত মানুষ, তবুও রাফিদ এই জিনিসটা মেইনটেইন করতে চায়। কারণ যদি আবারও নিজের মনের কথাগুলো বলে ফেলে, আন্টি সামনে থাকলে তো সেই ভয়টা নেই।

মাঝে একবার দর্পণের জ্বর হলো, সে কিছুতেই ওষুধ খাবে না। তখন তপার পুরোপুরি বিছানায়। সে উঠে চেষ্টা করতে পারছিল না। মা, মলিনা কেউ পারছিল না। তখন রাফিদই এলো ত্রাতা হিসেবে। সে দর্পণকে কোলে নিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রাজ্যের গল্প শুনিয়ে টুক করে বিটকেলে স্বাদযুক্ত সিরাপটুকু দর্পণের মুখে তুলে দিয়েছে, দর্পণ অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে রাফিদকে দেখেছে, পরবর্তীতে বিশ্বাস করবে কি-না আবার, তাই নিয়ে ছোট্ট মস্তিষ্ক খাটিয়ে ভেবেছে হয়তো। তবে ছেলে ভোলানোর মতো ওইটুকু ছলাকলা রাফিদের জানা আছে ভালোই, সেজন্যই টানা দুইদিন সে ওষুধ খাইয়ে দিতে পেরেছে।

তপা ইদানিং খানিকটা আত্মগ্লানিতে ভোগে রাফিদকে নিয়ে। ছেলেটা ওর জন্য এতকিছু করছে, বিনিময়ে কিছু দিতে পারছে না এই জিনিসটা কেমন কাঁটার মতো খোঁচায়। সাহায্য নিতে ভীষণ বাঁধো বাঁধো লাগে।

আজ তপা হঠাৎ বলল, “তুমি নিজের জগতে ফিরে যাচ্ছো না কেন?”

রাফিদ বিন্দুমাত্র সময় না নিয়ে বলল, “তুমি যখন নিজে নিজে ক্রাচ বা অন্যের সাহায্য ছাড়া নিজের পায়ে দাঁড়াবে, দুই পা চলতে পারবে, তখনই চলে যাব। জানি তোমার ভালো সময়ে কাউকে প্রয়োজন নেই, কিন্তু এই সময় অন্তত পাশে দাঁড়াতে দাও।”

তপা সারাজীবন শুনে এসেছে অসময়ের বন্ধু প্রকৃত বন্ধু। ওর এই ঘোরতর দুঃসময়ে এই ছেলেটা যা করেছে, তা নিঃসন্দেহে একজন প্রকৃত বন্ধুর পরিচয় বহন করে। তবুও তপা জানে বন্ধুত্বের বাইরেও কিছু বিষয় আছে।

রাফিদ আবার বলল, “গান শুনবে?”

উত্তরের অপেক্ষা না করে মৃদু স্বরে গেয়ে উঠল, “যেখানে সীমান্ত তোমার, সেখানে বসন্ত আমার,
ভালোবাসা হৃদয়ে নিয়ে আমি বারে বার আসি ফিরে,
ডাকি তোমায় কাছে…
আমিতো চাইনা তোমার এ দ্বিধা, ভেঙ্গে দাও কাঁচেরই বাধা
সীমার বাঁধন ছিঁড়ে তুমি, ধরা দাও আমারই কাছে।।
ঝড়ের দিনে খুলেছে যে পথ, আমি জানি জানি তার বেদনা
নতুন আলোর জোয়ার এনে, আমি চাই তারে দিতে আশা
তুমি কি চাও না সোনালী দিনে, সোনালী সুখের ইশারা
কাঁটার আঘাত ভুলে তুমি, এসো এই ফুলেরই কাছে,
যেখানে সীমান্ত তোমার, সেখানে বসন্ত আমার…”

গান শেষ হলে রাফিদ তপার দিকে তাকাতেই শুনল,
“আমি এখন অনেকটা সামলে নিয়েছি রাফিদ।”

“তপা, মানুষকে তার পুরো আয়ুকালে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। যার পুরোটা একা চলা সম্ভব নয়। কখনো কখনো প্রয়োজনে কারোর সাহায্য নিতে হয়, এতে নিজের মহিমা খাটো হয় না। এসব নিয়ে চিন্তা করো না।”

তপা কিছুটা থেমে বলল, “তুমি আমাকে ভালোবাসো কেন?”

“ভালোবাসি কেন? ভীষণ জটিল একটা প্রশ্ন। তুমি একবার বলেছিল, এটা নাকি মোহ। মানুষের ইনফ্যাচুয়েশন স্থায়ী হয় না। সেটা কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্য কিংবা কোনো একটা বৈশিষ্ট্যর উপরে সাময়িক মুগ্ধতা। একসময় সেটা কেটে গেলে মোহ কেটে যায়। আমার সেটা নেই। আমি তোমার সবকিছুকে পছন্দ করি। সমস্তটাকে, সেটা এত বিস্তৃত যে একটা একটা করে মোহ কাটলেও সারা জীবন অনায়াসে চলে যাবে। সবচাইতে ভালো লাগে, তোমার হার না মানা মানসিকতা। অন্যায়কে অন্যায় বলতে পারার মতো দৃঢ়তা, সাহস আর সদিচ্ছা অনেকের মধ্যে থাকে না, তোমার মধ্যে আছে। আরও কত শত কারণ, বলে শেষ করা যাবে না।”

তপার হৃদয়ের কোথাও যেন মৃদু আন্দোলিত হলো কথাগুলো, কবীর সারাক্ষণ ওর রূপের প্রশংসা করত, যেন রূপ ছাড়া তপার আর কিছু নেই। প্রথমদিকে তো ভালোই লাগত, কিন্তু একসময় গিয়ে মনে হতো, ওর সত্তার অন্য দিকগুলো কেন কবীরের চোখে পড়ে না! বাহ্যিক রূপ তো চিরস্থায়ী নয়, তখন কি কবীরের ভালোবাসা শেষ হয়ে যাবে! এমন আশঙ্কা হতো তপার। তখন আসলে কবীরকে সে চিনতেই পারেনি।

নিজের ভাবনায় চমকে উঠল তপা, সে কবীরের সাথে রাফিদকে কেন তুলনা করছে! কবীরের সাথে ওর যে সম্পর্ক ছিল, অবচেতন মন কেন রাফিদকে সেই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়ে দিতে চাইছে। অসুস্থতা কি ওকে দুর্বল করে দিচ্ছে! দুর্বল হলে তো চলবে না ওকে।

“মরিচীকার পেছনে কেন ছুটছ রাফিদ?”

“মরিচীকা সরে গিয়ে একদিন সত্যি সত্যি তোমাকে পাব এই আকাঙ্খা থেকে।”

“ভুল করছ রাফিদ। এভাবে হয় না। ধরো কোনোদিন আমাকে পেয়ে গেলে, এরপর কী হবে! এখন আমার প্রতি তুমি যে আকর্ষণ বোধ করছ, সেটা আমাকে এখনো পাওনি বলে। পেলেই রোজকার ডাল ভাতের মতোই বড্ড সাধারণ হয়ে যাব। তখন তোমার মনে হবে জীবন সঙ্গী হিসেবে তো আরও ভালো কাউকে ডিজার্ভ করতে। পুরোপুরি আবিষ্কার হয়ে গেলে, রহস্য শেষ হয়ে যায়। তখন আর আকর্ষণ থাকে না। একসময় তুমি যেমন গিটার ফেলে ক্যামেরা তুলে নিয়েছিলে বিকল্প হিসেবে, গিটারে ধূলো পড়ে গেছে, অবহেলায় এক কোণে পড়ে থেকে। তোমার মন তখন আমার চাইতে বেটার অপশন খুঁজতে থাকবে, এখনকার ভালোবাসা তখন আফসোসের আর অনুশোচনার কারণ হয়ে দাঁড়াবে তোমার কাছে।”

রাফিদ তপার পুরো কথাটা ভীষণ মনোযোগ দিয়ে শুনল, ব্যাঘাত ঘটাল না কথার। এরপর মৃদু হেসে বলল,

“আমাকে নিয়ে তোমার অবজারভেশনে ঠিকই আছে। আমার এক জিনিসে খুব বেশিদিন আগ্রহ থাকে না। কিন্তু সেটা কোনো শখ বা বস্তুর ক্ষেত্রে। গিটারে ধূলো জমে কোণে পড়ে থাকলেও আমি কিন্তু গান ভুলে যাইনি। কখনো ইচ্ছে করলে সে ধূলো ঝেড়ে ফেলে আবার বাজাই, গিটার অভিমান করে না। আমার একটা ব্রেকআপও হয়েছে, সেখানে গভীরতা ছিল না কোনোদিন, কোনো পক্ষ থেকেই। তুমি আমার কিছু ভালোলাগা শখ নও তপা, তোমার বিস্তৃতি আমার সমস্ত হৃদয় জুড়ে। অন্যকিছুর সাথে এর তুলনা চলে না।”

রাফিদ একবার তপাকে দেখল, মেয়েটার দ্বিধার জায়গাটা সে বোঝে, প্রথম দিকে ওর প্রত্যাখ্যানে ভেঙে পড়লেও এখন আর পড়ে না। বরং ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে।

“একবার যা হয়েছিল সেই তিক্ততা নিয়ে সারাজীবন নষ্ট করা অর্থহীন তপা। পৃথিবীর সব পুরুষ কবীর নয়। তাছাড়া দর্পণকেও আমি ভালোবাসি, তোমাকে যতটা ঠিক ততটাই।”

তপা বালিশে মাথা এলিয়ে দিয়ে বলল,

“এসব কথা গল্প উপন্যাসেই মানায়, রাফিদ। বাস্তবতার শক্ত মাটিতে এমন কত সহস্র আবেগ বালুচরে বাঁধা ঘরের মতো পলকা বাতাসেই ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।”

“আমরা নাহয় নিজেরাই একটা গল্প হবো তপা, সত্যিকারের গল্প।”

তপা ঝট করে চোখ তুলে রাফিদের দিকে তাকাল, হৃদয়ের সিংহদুয়ার সে শক্ত তালা এঁটে বন্ধ করে দিয়েছিল। সেখানে কড়া নাড়ার প্রবল শব্দ হচ্ছে।

কঠিন রুদ্ধ প্রাচীরে কি ফাঁটল ধরছে খানিকটা! আবারও সে একই ভুল করতে যাচ্ছে!
………..
(ক্রমশ)