নিভৃত দহনে পর্ব-৩০+৩১

0
38
নিভৃত দহনে পর্ব-০১
নিভৃত দহনে

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ৩০)
নুসরাত জাহান লিজা

“কাছে যাওয়া বড্ড বেশি হবে
এই এখানে দাঁড়িয়ে থাকাই ভালো
তোমার ঘরে থমকে আছে দুপুর
বারান্দাতে বিকেল পড়ে এলো”

রাফিদের কথায় তপা ডুবে যেতে যেতে শেষ মুহূর্তে সামলে নিল নিজেকে, একসময় অনেক প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছে তপা, কবীরের কাছ থেকে সৌন্দর্যের জন্য স্তুতিবাক্য শুনেছে। তবে সেসবে আজকের মতো এমন আবেদন কী ছিল!

সে সবসময় চেয়েছে যে ওর জীবনসঙ্গী হবে, সে কেবল স্বামীর অধিকার বোধ নিয়েই পাশে থাকবে না, সে হবে তপার সহযাত্রী, সুখের, বিষাদের, হাসি-কান্নার।

যে তপাকে ওর সমস্তটা নিয়েই ভালোবাসব, ওকে বুঝতে পারবে, সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোরও মূল্য দেবে। যার সাথে থাকতে নিজের অপূর্ণতা নিয়ে কখনো গ্লানিবোধ হবে না। যার কাছে সে কেবল একজন রক্তমাংসের নারী শরীর হবে না, বরং একজন মানুষ হবে, যার মন আছে, ইচ্ছে অনিচ্ছা আছে, জীবন নিয়ে কিছু প্রত্যাশা আর স্বপ্ন আছে। সেসব পূরণ করে দেবার দায় সে দিতে চায়নি কখনো, নিজের স্বপ্ন পূরণ করার যে যোগ্যতা ওর আছে, বা অর্জন করার চেষ্টা করে, সেই স্বপ্নগুলোকে অন্তত শ্রদ্ধা করবে। যেখানে ইগোর লড়াই থাকবে না, বরং পরস্পরের সাফল্য একসাথে উদযাপন করবে। যেখানে সংসারে কেবল আমি এবং আমার নয় বরং আমরা কিংবা আমাদের হবে, যেখানে কেবল আমিত্ব থাকবে না। পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয় বরং পরিপূরক হবে। অপূর্ণতাগুলো দুজনে মিলে পূর্ণ করবে।

ওর ব্যর্থতায় সে-ও সমব্যথী হবে, সহমর্মি হবে।পৈশাচিক আনন্দে জয়ী ভেবে নীরব উল্লাসে মাতবে না। বরং নিজের কাঁধ মেলে দেবে দুফোঁটা চোখের জল ফেলার জন্য। ইচ্ছেমতো কান্না শেষে ভেতরটা হালকা লাগলে চোখের জল মুছে দেবে পরম ভালোবাসায়, অপরিসীম প্রেমে। জীবনের উত্থান পতন সকল মুহূর্তে বলবে,

“চিন্তা কোরো না, পাশে আছি তো।”

তপা এর কিছুই পায়নি কবীরের মধ্যে। বরং যা চায়নি সেসব ওর মধ্যে ছিল বহুলাংশে।

আজ কেন যেন তপার খুব ইচ্ছে করছিল রাফিদের কথাগুলো বিশ্বাস করতে। ঘর পোড়া গরু আকাশে সিঁদুর রঙের মেঘ দেখলেই যেমন আগুন ভেবে ভয় পায়, তপার মনেও তেমন ভয় কিছুটা আছে বৈকি। এই ভালোবাসার স্থায়িত্ব কতটুকু! যদি আবারও যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে হয়!

বুদ্ধদেব বসুর কবিতার কয়েকটা লাইন মাথায় এলো রাফিদের কথার উত্তরে।

রাফিদের চোখে আজ আর হতাশা এসে ভর করল না আজকের এই প্রত্যাখ্যানে। বরং কিছুটা আশান্বিত হলো সে। আজ বরং তপার গলায় দ্বিধা দেখা গেল। ওর কাজ কড়া নেড়ে যাওয়া। একদিন না একদিন তো মনের কপাট খুলবে ওর জন্য। এটুকু বিশ্বাস নিয়ে থাকতে চায় সে।

“যদি কখনো ভালোবেসে ফেলো, আনমনে হলেও একবার আমাকে ডেকো। আমি ঠিক শুনতে পাবো, কারণ আমি তোমার পাশেই আছি, সবসময়।”

***
কবীর আপাতত মা ম লা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না, বলা ভালো সময় পাচ্ছে না। কারণ ওর নিজের নামেই একটা মা ম লা হয়েছে। আবাসন প্রকল্পের ব্যবসায় গড়বড় ধরা পড়ে গেছে। পরবর্তীতে কিছু অবৈধ উপার্জনের হদিস নিয়ে তদন্ত হচ্ছে।

বাদী পক্ষকে সে হুমকি-ধামকি দিয়েছে, সেখানে ব্যর্থ হয়ে টাকা দিয়ে মিটিয়ে নিতে চেয়েছিল। তাতেও লাভ হয়নি। ভদ্রলোক তার সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে জমি কিনেছিলেন, কিন্তু প্রতারিত হয়েছেন।

তার কথা, “সারাজীবন সততা নিয়ে চলেছি। এখন আপোষ করব কেন?”

নিজে দৌড়ের উপরে থাকায় আপাতত তপা আর দর্পণকে নিয়ে চিন্তা করছে না। আগে নিজে এই গাড্ডা থেকে উদ্ধার পাক, পরে ওসব ভাবা যাবে। উপরমহলে লবিং করছে এখন।

***
সেদিন রাফিদের সাথে কথা হবার পরে তপা কয়েক রাত ধরে কেবল ভেবেছে। একবার মনে হচ্ছে ফিরিয়ে দিয়ে ভুল করছে না তো, আরেকবার মনে হচ্ছে ঠিকই আছে।

তবুও সে রাফিদকে মন থেকে সরাতে পারছে না, ছেলেটা ওর মননে, মগজে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আছে।

সোমা এসেছে বিদায় নিতে, ওর ট্রান্সফার হয়ে গেছে। কথায় কথায় সে বলল,

“তপা আপু, তুমি বিচক্ষণ মানুষ। আমার বলাটা ঠিক হবে কিনা জানি না, তবুও বলছি, যে জীবনে আসতে চাইছে তাকে আসতে দাও। হারিয়ে ফেলো না। যখন পৃথিবীপ্লাবী ভালোবাসা দুয়ারে এসে দাঁড়ায়, তখন সেটা গ্রহণ করে আগলে রাখতে হয়, ফিরিয়ে দিতে নেই।”

***
অনেকদিন তপা জোছনা দেখে না, আজ কেন যেন জোৎস্না ওকে টানছে প্রবলভাবে। রাফিদ দর্পণকে নিয়ে ছাদে গেছে। তপারও যেতে ইচ্ছে করল। কিন্তু এই পা নিয়ে সিঁড়ি ভাঙা বড্ড ঝক্কির। নীলাকে ডাকল সে, ওর কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে ক্রাচে ভর করে দাঁড়িয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। মেয়েটাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতে হবে। খোঁজখবর নিতে হবে এখন ভর্তি করা যাবে কি-না!

একদিন জোছনা ভেজা রাতে রাফিদের কোলে দর্পণকে দেখার ছবিগুলো মানসপটে ভেসে উঠল।
এই প্রথমবার মনকে এবার আর সাবধান করল না তপা। হয়তো ভুল হবে, হয়তো ঠিক, তবুও কেন যেন আরেকবার জীবন নিয়ে বাজিটা ধরতে ইচ্ছে করছে।

রাফিদের ভালোবাসায় কী যেন এক চৌম্বকীয় আকর্ষণ আছে, প্রবলভাবে টানছে কেবল। আরেকবার নাহয় জীবনকে আরেকটা সুযোগ দিয়েই দেখল, খুব কী অন্যায় হবে!

যখন রাফিদ দর্পণকে ফিরিয়ে দিতে এলো, তপা বলল,
“শুধু আমার ছেলেকে জোছনা দেখালে হবে? ওই মোহময় চাঁদের আলো তো আমাকেও বড্ড টানে!”

“তুমি জোছনা দেখতে ছাদে যেতে চাও?”

“এখানেই দেখছি। তবে আজ একা একা দেখতে ইচ্ছে করছে না। বসো রাফিদ।”

রাফিদ খানিকটা হতভম্ব হয়েছে, তপা অনেকদিন প্রাণবন্ত হয়ে ওর সাথে কথা বলে না। আজ যেন খানিকটা অন্যরকম মনে হচ্ছে।

রাফিদ তপার পাশের চেয়ারে বসল। বারান্দায় দুটো চেয়ার রেখেছে তপা, এখানে এসে বসে থাকতে ওর ভালো লাগে। সামনেই বাগান, সেখান থেকে চমৎকার ফুলের সৌরভ ভেসে আসছে। কোন ফুলের ঘ্রাণ এটা! মনে করতে পারল না তপা, তবে ভীষণ ভালো লাগছে।

দর্পণ রাফিদের কোল থেকে নেমে বারান্দায় হাঁটতে শুরু করেছে। ইদানিং বেশ দস্যি হয়ে যাচ্ছে।

“কিছু বলবে তপা?”

“তুমি যা শুনতে চাও, সেটাই বলতে চাইছি।”

রাফিদ এবার চমকে উঠল, “মানে… তুমি… তোমাকে ভালোবাসার সুযোগ দেবে আমাকে?”

তপা ছোট্ট দর্পণের দিকে দৃষ্টি রেখে বলল, “আমিও তোমাকে ভালোবাসতে চাই। যদি আশ্বাস পাই, কখনো বিশ্বাস ভাঙবে না, তবে…”

রাফিদের মুখে সহসা কথা যোগাল না, পুরো বিষয়টা ওর মস্তিষ্কে ইনস্টল হতে সময় লাগলে খানিকটা। এরপর মৃদু অথচ দৃঢ় গলায় বলল,

“আমি তোমার জীবনের সেই মানুষটা হয়ে উঠতে চাই, যার প্রতীক্ষায় তুমি এতকাল ছিলে।”

“ভবিষ্যতের কথা আমরা কেউ জানি না, রাফিদ। আমাদের পথচলা কতদূর তাও জানা নেই। শুধু এটুকু বললেই হবে যে কখনো প্রতারণা, প্রতিহিংসা যেন আমাদের মধ্যে না আসে।”

“কথা দিলাম, তপা।”

রাফিদ উঠে দাঁড়িয়ে দর্পণকে কোলে তুলে নিয়ে সদ্য দস্যিপনা শেখা ছেলেটার গালে চুমু খেয়ে বলল,

“চলো তপা, বিয়ে করে ফেলি!”
………
(ক্রমশ)

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ৩১)
নুসরাত জাহান লিজা

রাফিদের কাছে পুরো ব্যাপারটা মনে হচ্ছে বিভ্রম, একটা সুখ-স্বপ্ন। মনে হলো এই রাত, ওই দিগন্তপ্লাবী জোৎস্না, সামনে দাঁড়ানো ওই নারী, ওর কোলে মায়াময় দর্পণ, ফুলের মোহময় সুবাস সমস্তকিছু অলীক, অপার্থিব! কোনো প্রাপ্তির আনন্দ যে এতটা অভাবনীয় সুখের হতে পারে, আজকের আগে রাফিদ তা কোনোদিন জানত না। কী এক প্রগাঢ় অচেনা সুখ ওর সমস্ত চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে!

“এই পা নিয়ে বিয়ে করব?”

রাফিদ অপ্রতিভ হলো, বলল, “না না, তুমি সুস্থ হও আগে।”

দর্পণ কিছু না বুঝেও প্রিয় দুই মানুষের মুখে উদ্ভাসিত হাসি দেখে নিজেও হেসে ফেলল।

“দাফেত, তাদ মামা।”

চাঁদ বলতে পারে না এখনো, তবে দেড় বছরের দর্পণ এখন কিছু ভাঙা ভাঙা শব্দ বলতে পারে। রাফিদের কোলে এতদিন ধরে চাঁদ দেখে ছড়া শুনে শুনে চাঁদ মামাকে চিনে ফেলেছে।

তপা আর রাফিদ সমস্বরে হেসে ফেলল। রাফিদ মোহাবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে রইল সেই হাসিতে। এমন উচ্ছ্বসিত হাসি তপার মুখে আগে কখনো দেখেনি।

“এটা ভীষণ অন্যায়।”

তপা হাসি থামিয়ে প্রশ্ন করল, “কোনটা?”

“এত সুন্দর হাসিটা লুকিয়ে রাখো সবসময়।”

চাঁদের আলোয় তপার মুখে সদ্য জমা হওয়া বিষণ্ণতার ছাপ নজর এড়ালো না রাফিদের।

“এমন করে হাসতে হলে পরিস্থিতি লাগে, সঠিক মানুষ লাগে।”

রাফিদ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, “তোমার এই হাসিমুখে কখনো বিষাদের ছোঁয়া লাগতে দেব না তপা।”

***
তুহিন সেই সকালে বেরিয়ে পড়ে, ফেরে রাতে। মাঝেমধ্যে কল করে মেয়ের খবর নেয়। জহুরাও মেয়ের কাছে গিয়ে উঠেছেন৷ তাই ইলার সাথে ওর মা থাকেন।

মেয়েকে ডাক্তার দেখানোর সময়ও ইলাকে মা’কে নিয়েই যেতে হয়। তুহিনের দায়িত্ব যেন সন্তান জন্ম দেয়া পর্যন্তই ছিল। আর কোন দায়িত্বটা সে পালন করেছে। যাবতীয় জিনিসপত্র কেনা সেটাও লোক পাঠিয়ে ওকে করতে হচ্ছে।

তুহিন বাসায় ফেরার পরে এসব নিয়ে দুটো কথা বললেই শুনতে হয়, “তো কী করব এখন? আমি বাসায় তোমাদের সঙ্গ দিলে ঘরের খাবার আসবে কোত্থেকে? সারাদিন আমাকে বাইরে কতটা খাটতে হয় তুমি জানো? তুমি তো বলেই খালাস।”

ইলার গায়ে লাগে, সে-ও দুটো উত্তর দিলেই লেগে যায় কলহ।

ইদানিং ইলার মনে হয়, তপাই ঠিক। নিজের মতো করে থাকছে। কারোর কথা শোনার দায় নেই। এটা করছে সেটা করছে, সে নিজে কী করছে, এসব শুনতে হয় না। সে কেন পরনির্ভরশীল হলো, এই ভেবে আক্ষেপ হয়। কেউ যদি ভালোবাসে, তবে এভাবে কথা বলতে পারে!

ইলা শ্বাশুড়িকে কল দিয়ে অভিযোগ করল। তিনি বললেন, “একটু ধৈর্য ধরো, সব ঠিক হয়ে যাবে।”

অন্তঃসারশূন্যতা একটা সান্ত্বনা বাক্য শুনতেই কি সে কেবল কল দিয়েছিল!

***
জহুরাকে তপা পরেরদিনই রাফিদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবার কথাটা জানালো,

“তোমার আপত্তি আছে মা?”

তিনি শুনে খুব খুশিই হলেন। তিনি চান মেয়েটা নতুন করে শুরু করুক। তপা যে অন্য ধাতের মেয়ে এটা তিনি জানেন। প্রথমদিকে নানান আশঙ্কা হলেও নীলাকে দেখলে মেয়েকে নিয়ে ইদানিং তার বেশ গর্বই হয়।

তপার জায়গায় তুহিন থাকলে কখনো এই কাজ করত না। পাশ কাটিয়ে চলে আসত। নিজের বাইরে সে ভাবতে শেখেনি। তিনি ছেলেকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারেননি। বরং তার অপরিসীম স্নেহে সে বড্ড আত্মকেন্দ্রীক হয়ে উঠেছে। ছেলেবেলা থেকেই সে এটা ভেবেই বড় হয়েছে যে, সে এই পরিবারে বিশেষ কেউ। তিনি যদি তার দুই সন্তানকেই সমানভাবে বড় করতেন, এই বোধটা তার মধ্যে আসত। নারীকে মানুষ হিসেবে সম্মান করতে পারত, বোনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামত না। সন্তানের জন্য চিন্তা করত, স্ত্রীকে প্রাপ্য সম্মান দিত।

ইলার কাছ থেকে সব শুনে তার মর্মপীড়া হয়, আত্মগ্লানিতে ভোগেন।

তুহিনের প্রতি তিনি স্নেহান্ধ ছিলেন। এখন তার মনে হয় ছেলে বা মেয়ে আসলে কোনো বিষয় নয়, আসল জিনিস হচ্ছে মানুষ হওয়া। মনুষ্যত্বকে লালন করতে পারা। যেটা দুই সন্তানের মধ্যে মেয়ে পেরেছে, ছেলে পারেনি। এর দায় কি তারও নয়!

তপার জন্য রাফিদকে তার মনে ধরেছে৷ এত সহজ, প্রাণবন্ত ছেলে! আপত্তি করার কোনো কারণই নেই।

“তুই সবদিক ভেবেই তো সিদ্ধান্ত নিয়েছিস। তুই ভালো থাক, সুখী হ এটাই কেবল চাওয়া আমার।”

এই প্রথমবার লোকে কী ভাববে, এটা তিনি ভাবলেন না। আত্মীয়স্বজনরা এমনিতেও নানা কথা শোনায়, তারা এখনো বলে, তখনও বলবেই। তিনি তাদের মুখ বন্ধ করতে পারবেন না। তাই কে কী বলবে সেটা ভেবে নিজের সুখ বিসর্জন দেবার চিন্তা তার কাছে এখন বৃথা মনে হয়।

এতে তপা আর দর্পণের ভালো হবে, রাফিদও যদি ভালো থাকে, সমাজের তো কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি হচ্ছে না। তাই এর দায় তিনি কেন মেয়ের উপরে চাপিয়ে দেবেন!

***
সায়েদা ভীষণ খুশি হলেন। তপাকে তিনি বড্ড স্নেহ করেন। স্পষ্টবাদী অথচ কোনো উগ্রতা নেই, বিনয়ী তবে অন্যায়ের কাছে নমনীয় নয়। তাছাড়া ওইটুকু ছেলেকে নিয়ে শুধুমাত্র লড়াকু মনোভাবের জোরে দাঁত কামড়ে বেঁচে আছে এই প্রতিকূল সমাজে।

এদিকে রাফিদ তো তার নিজের মানুষ। ভীষণ স্বচ্ছ একটা ছেলে। জীবনকে এত সহজভাবে ভাবতে পারে।

তার সাথে শিরীনের এই জায়গাটায় মিল ছিল, এখন তা তিনি রাফিদের মধ্যে দেখতে পান।

সোমা তো শুনেই হৈ হৈ করে উঠল, রাফিদকে মুঠোফোনেই অভিনন্দন জানালো।

রাফিদ হেসে বলল, “কিন্তু একটা সমস্যা হলো যে।”

“কী সমস্যা? ঝেড়ে কাশো তো?”

“তোমার বিয়ের ফটোগ্রাফি করে দিলাম। আমার বিয়ের ছবিগুলো কে তুলে দেবে? নিজের বিয়েতে নিজেই ফটোগ্রাফি করব না-কি?”

সোমা হেসে ফোঁড়ন কাটে, “বিরাট সমস্যা। করলে না-হয়। রেকর্ডবুক ঘেঁটে দেখতে হবে এই মহান কাজ কেউ করেছে কি-না। নইলে তোমার নাম গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে জায়গা পাবে। আগেভাগে একটা অটোগ্রাফ দিও তো!”

রাফিদ হেসে ফেলল। ইদানিং ওর কেন যেন সবকিছুই ভালো লাগছে। পুরো পৃথিবীটা ভীষণ রঙিন মনে হচ্ছে।

***
রাফিদ সেদিন রাতে নিজের ঘরে এসেই মাকে সব জানিয়েছে। তাকে বলতে গিয়ে রাফিদ ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল পরম আনন্দে। ছেলের এই উচ্ছ্বাস তাকে ছুঁয়ে গেল।

তিনি তপার সাথে কথা বলেছেন পরেরদিন, “তুমি খুব ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছ মা। জীবনে হোঁচট খেলেই পথেই পড়ে থাকতে নেই। উঠে দাঁড়িয়ে নতুন উদ্যমে আবার সামনে এগিয়ে যেতে হয়। পিছলে পড়ার ভয়ে কেউ হাঁটা থামায় না। সেই পিচ্ছিল পথে যদি সঠিক সহযাত্রী জুটে যায়, তবে একে অপরকে পিছলে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে নেয়া যায়। আমার দোয়া আর ভালোবাসা সবসময় তোমাদের সাথে আছে। দ্রুত আমার ঘরে এসো। এখন বুড়ো হয়ে যাচ্ছি তো, দায়িত্ব হস্তান্তর করতে পারলে ভারমুক্ত হই।”

তপার ভীষণ ভালো লাগল তার কথাগুলো। এভাবে ভাবতে পারার মানুষ এখনো আছে বলেই বোধহয় পৃথিবীটা এখনো সুন্দর!

আরও দুই সপ্তাহ পরে তপার পা ঠিক হলো। প্রায় দুই মাসই লাগল, এখনো হাঁটতে সমস্যা হয়। অল্প অল্প করে হাঁটে। সিঁড়ি বেয়ে উঠা নিষেধ আপাতত, ভারি জিনিস তোলাও নিষেধ। দর্পণকে সে কতদিন পরে নিজের মতো করে কোলে নিল। রাফিদ তপার মতো করেই দর্পণকে আগলেছে এতদিন ধরে। ভালোবাসায় মন আর্দ্র হয়ে আসে ওর।

জয়নুল নিজে না এলেও লোক পাঠিয়েছিলেন কয়েকবার। অসংখ্যবার কল দিয়েছেন। ছেলেকে ফেরাতে পারেননি।

“তোমার পা তো এখন অনেকটা ঠিক। গুরুজনেরা বলেন শুভ কাজে দেরি করতে নেই। কবে কবুল বলবে?”

তপা হেসে বলল, “বলব বলব। আন্টি রাজি। কিন্তু আঙ্কেল?”

“বাবা মত দেবেন না।”

“তবুও, তুমি একবার কথা বলো। তাকে বোঝাও।”

রাফিদ তপাকে বাবার অমতের কথা বলেছে, কিন্তু ওর উপর দিয়ে কী গেছে সেটা বলতে পারেনি। মেয়েটা এখন মনখুলে হাসতে শুরু করেছে। কে জানে, যদি এসব শুনে আবার পিছিয়ে যায়!

“তপা, বাবা রাজি হবেন না। আমরা এখানেই বিয়ে করে ফেলি। বিয়ে হয়ে গেলে ঠিক মেনে নেবে।”

তপা দৃঢ় গলায় বলল, “রাফিদ, ভালোবাসলে কিছু দায়িত্ব নিতে হয়। তুমি তার কাছে একবার যাও। সব বাবা মা’ই সন্তানের সুখ চান। তুমি কীসে সুখী হবে, সেটা তাকে সুস্থির হয়ে বোঝাও। তিনি নিশ্চয়ই বুঝবেন।”

“যদি না বুঝতে পারেন? তারা যে সবসময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেন এটা তো না-ও হতে পারে।”

তপা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসে রইল, এরপর বলল,

“চেষ্টা করতে দোষ কোথায় রাফিদ? আগেই নেগেটিভ চিন্তা কেন করব? নতুন একটা জীবনে পা রাখতে চলেছি আমরা। আমাদের দিক থেকে আমরা ভুলভাবে শুরু না করি। আর যদি একান্তই না মানতে চান, আমি তোমার প্রতীক্ষায় আছি তো।”

রাফিদ এবার সম্মত হলো ফিরতে। সে নিজের সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করবে বাবাকে রাজি করাতে। তিনি রাজি হলে ভালো, আর না হলে তপা তো বলেছেই সে আছে।

রাফিদ একবুক স্বপ্ন নিয়ে ফিরে এলো নিজের বাসায়৷ জানে না সামনে কী অপেক্ষা করছে। শুধু জানে ওকে জয়ী হতে হবে।
(ক্রমশ)