নিভৃত দহনে পর্ব-৩৬+৩৭

0
224
নিভৃত দহনে পর্ব-০১
নিভৃত দহনে

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ৩৬)
নুসরাত জাহান লিজা

বিয়ের পরে এক সপ্তাহ ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে কাটল তপা আর রাফিদের। বিয়ে নিয়ে রাফিদের মধ্যে আগে যে ধারণা ছিল, তাও বদলে গেছে অনেকটা। আগে মনে হতো বিয়ের পরে স্বাধীনতা ঠিকঠাক উপভোগ করা যায় না, বাড়তি কিছু দায়িত্ব মাথায় চেপে জীবনটা একঘেয়ে হয়ে যায়। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, বিষয়টা আসলে তেমন নয়। ভালোবেসে সে নিজেই এই জীবনটাকে বেছে নিয়েছে বলেই কি-না, দায়িত্বটুকুও ভীষণ উপভোগ্য বলে মনে হচ্ছে।

দর্পণকে সর্বক্ষণ কাছে পাচ্ছে, পুঁচকেটা ওকে ‘দাফেত বাবা’ বলে সারাক্ষণ ডাকছে, একসাথে সবসময় খেলছে। তপা অফিসে চলে গেলে ওর হাতেই খাচ্ছে, নানা আবদার করছে। ওর আবদার মেটাতে মেটাতে তপার না থাকার সময়টা নিমিষেই কেটে যায়।

তপাকে প্রতিনিয়ত নতুন করে আবিষ্কার করছে। কঠিন খোলসের ভেতরে ভীষণ উচ্ছল অন্য একটা তপার বাস। যে এতদিন সুপ্ত ছিল, এখন মাঝেমধ্যেই তার দেখা মিলছে। খুঁনসুটিতে মেতে উঠছে কখনো।

আজ ঘুরতে বেরিয়েছে ওরা। তপা অসুস্থতার জন্য অনেকদিন ছুটিতে ছিল বলে দূরে কোথাও আপাতত যাওয়া হচ্ছে না৷ তাই সিলেটেই রাফিদের পছন্দের জায়গায় এসেছে। ভোরের আলো সবে ফুটেছে। তপা সেই ভোরে উঠে তৈরি হয়েছে, ওকে ডেকে তুলেছে, দর্পণকেও তৈরি করে দিয়েছে।

এখন শিউলি ফুলের মৌসুম। সোমাদের বাড়ির সামনে একটা শিউলি ফুলের গাছ আছে। ঘাসের উপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা শিউলি কুড়িয়ে নিচ্ছে তপা, দেখাদেখি দর্পণও।

“নানুবাড়িতে শিউলি গাছ ছিল৷ ভোরবেলা কাজিনরা মিলে কাড়াকাড়ি করে কুড়িয়ে নিতম। দর্পণেরও অভিজ্ঞতা হোক।”

হেসে বলল তপা, চোখে নস্টালজিয়া ভর করেছে ওর। আর রাফিদের চোখ নিবন্ধ তপায়। লাল রঙের শাড়ি, হাত ভর্তি শিউলি ফুল আর মুখে উদ্ভাসিত হাসি।

দর্পণ রাফিদের হাত ধরে টেনে ফুল কুড়াতে ইশারা করছে। তপা যখন হাতের ফুলগুলো বাড়িয়ে দিল রাফিদের দিকে, ওর মনে হলো কোনো অপ্সরা পথ ভুলে এই ধূলির পৃথিবীতে নেমে এসেছে।

মোহাবিষ্ট রাফিদের ঘোর কাটল তপার কথায়, “আমার সবচাইতে প্রিয় ফুল, তোমার জন্য। ধরো তো, এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমার হাতে ব্যথা হয়ে যাবে।”

রাফিদ হাত পেতে ফুলগুলো নিল, এবার দর্পণের ডাকে ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ফুল ভরা হাতটা মেলে দিতেই সেও ওর কুড়িয়ে পাওয়া ফুলগুলো তুলে দিল। রাফিদ কোলে তুলে নিল ওকে। তিনজন বেরিয়ে পড়ল গন্তব্যে।

তপাকে দেখে মনে হচ্ছে রঙিন প্রজাপতি। যে বহুদিন পরে ডানা মেলে দিয়েছে প্রকৃতির মাঝে। দর্পণকে মনে হচ্ছিল সদ্য খোলস ছেড়ে বেরুনো সন্ধ্যার জোনাকি।

রাফিদ বহুদিন পরে আজ ইচ্ছেমতো ছবি তুলল তপার। একদিন এক দুষ্টু প্রজাপতিকে ফ্রেমে ধরতে না পারার যে অতৃপ্তি জমে ছিল, আজ ওর হৃদয়ের প্রজাপতি আর জোনাকির ছবি তুলে সেই অতৃপ্তি অনেকটাই ঘুচে গেল৷ বহুদিন পরে একটা দিন কাটল ঠিক স্বপ্নের মতো, সুখ-স্বপ্ন। যে স্বপ্ন বারবার দেখতে ইচ্ছে করে।

“তপা, আজ কবিতা শোনাবে না?”

“না।”

“কেন?”

“এই মুহূর্তটাই তো একটা কবিতা৷ তাই।”

বলেই সশব্দে হেসে ফেলল তপা, সেই হাসি ঝংকার তুলল রাফিদের মননে, মস্তিষ্কে। সত্যিই কি হাসিতে এত ছন্দ থাকে!

ওর মনে হলো, সত্যিই তাই, পৃথিবীর সবচাইতে চমৎকার কবিতাতেও কী এত নিগুঢ় আনন্দ ক্ষণের বর্ণনা করা সম্ভব! নাকি এই অপার্থিব হাসির উপমা দেয়া সম্ভব!

***
সোমার শাশুড়ি আজ বলেই ফেললেন, “গত সপ্তাহে আমার ভাগ্নির এঙ্গেজমেন্ট ছিল। বিশেষভাবে তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছিল। তুমি গেলে না। চলে গেলে তোমাদের ভাড়াটিয়ার বিয়েতে। এটা কেমন হলো না?”

“মা, এঙ্গেজমেন্টে না গেলেও বিয়েতে তো যাবই। তাছাড়া তপা আপু শুধু ভাড়াটিয়া নয়। সেটা না-হয় বাদ দিলাম, রাফিদ আমার ভাই। ওদের বিয়েতে আমার থাকাটা তখন জরুরি ছিল।”

বলে সোমা ভেতরে চলে গেল। রবীনকে তার মা বললেন, “আমি কী এমন বললাম তোর বউকে?”

“মা, তুমি কিছু মনে কোরো না প্লিজ।”

তিনি আর কিছু বললেন না, থমথমে মুখে বসে রইলেন।

রবীন ঘরে এসে দেখল এদিকের আবহাওয়াও বেশ থমথমে।

“সোমা, তুমি…”

“রবীন, তোমার মায়ের চাচাতো বোনের এঙ্গেজমেন্ট যদি গুরুত্বপূর্ণ হয়, আমার মায়ের চাচাতো বোনের ছেলের বিয়েটা কিছুই নয়? তাছাড়া ওদের বিয়েটা স্বাভাবিকভাবে হলে অন্য কথা ছিল।”

“তুমি যতটা কমপ্লিকেটেট ভাবছ বিষয়টা তেমন নয় আসলে। মা তোমাকে আগেই বলে রেখেছিল, তুমিও রাজি হয়েছিলে। হঠাৎ করে রাফিদের বিয়ের ডেট ওইদিনই পড়ে গেল। সেজন্য মা একটু কষ্ট পেয়েছে। তাই বলেছে।”

“এটা তো শুধু এটার ক্ষেত্রে। আমার মা একা থাকে, সেখানে যেতে হলেও ইদানিং আমার কয়েকবার করে বলতে হয়। ছুটির দিনেই কেবল মায়ের কাছে যাই, তোমাদের প্রোগ্রামগুলোও একই সময়ে পড়ে যায়। মাঝে এক দুই সপ্তাহ আমি মায়ের সাথেও দেখা করতে পারি না। চেষ্টা করছি ব্যালেন্স করতে। কিন্তু সেটার দায়িত্ব কি শুধুই আমার?”

রবীন উত্তর দিল না, ওকে জড়িয়ে ধরল। কিন্তু আজ সোমা সাড়া দিল না, চুপচাপ কাঠ হয়ে বসে রইল।

***
তুহিন এসেছে জহুরাকে নিতে। তপা বলল, “তুমি তাহলে চলেই যাচ্ছ মা?”

“হ্যাঁ রে, তোর নতুন সংসার হয়েছে। এখন আমার আর চিন্তা কী। নিজের বাড়িতে ফিরে যাই।”

তপার বলতে ইচ্ছে করল, “ওটা কি তোমার নিজের বাড়ি মা? সেটাও তো ভাড়া বাড়িই! নাকি ছেলে থাকে বলে নিজের বাড়ি বলছ?”

কিন্তু বলল না, জানে তিনি থাকবেন না আর। ছেলে নিজে থেকে নিতে এসেছে, তিনি সেই ডাক উপেক্ষা করতে পারবেন না।

“তুই বিয়ে করেছিস ভালো কথা। তা তোর বর কী করে?”

তুহিন রাফিদ সম্পর্কে জানে, তবুও প্রশ্নটা করেছে তপাকে খোঁচা দিতে।

“ভাইয়া, আমার বাসায় অতিথি হয়ে এসেছ, আমি কিছু বলতে চাই না। তাই প্লিজ খোঁচাবে না।” তপার গলায় আশ্চর্য শীতলতা।

“ওমা, এটা তো সিম্পল একটা প্রশ্ন। তার মানে কিছু করে না, উত্তর পেয়ে গেছি।”

“যখন করার সময় হবে, তখন করবে। সেটা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।”

“চিন্তা হয় তো। এই যে এত কষ্ট করে চাকরি করছিস, সন্তান মানুষ করছিস, আরেকজন বসে বসে তোর ইনকাম খাবে। তোর জামাইয়ের আত্মসম্মানবোধ নিয়ে আমার ডাউট হচ্ছে…”

রাগে তপার শরীর জ্বলছে, সে প্রায় চিৎকার করে বলল, “আমার সংসার আমার একান্ত ব্যক্তিগত। রক্তের সম্পর্কের বাইরে তুমি আমার এমন কিছু নও যে আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে চর্চা করার অধিকার পেয়ে যাবে। আর এই যে স্টেরিওটিপিক্যাল চিন্তাভাবনা, ইনকাম কেবল পুরুষ করবে। নারীরা উপার্জন করলে তাতে পুরুষের আত্মসম্মানে লাগবে। কেন? সংসারটা দুজনের, যখন যার সামর্থ্য থাকবে সেই চালাবে। এখানে উপার্জন কার সেটা মূখ্য বিষয় অন্তত আমার বা রাফিদের কাছে নয়।”

“সেটাই। কারো ভালো করতে নেই। যার জন্য করি চুরি, সেই বলে চোর। আসি, পরে আবার না পস্তালেই হলো।”

“সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।”

তপা ওর রুমে এসে দেখল রাফিদের মুখে কালবৈশাখী ভর করেছে৷ অর্থাৎ ওইপাশের কথোপকথন সবই সে শুনেছে। তপার ভীষণ খারাপ লাগল।

রাফিদের মুখে চিরচেনা হাসিটুকু নেই, অস্ফুটস্বরে বলল, “আমি একেবারেই অকর্মণ্য, তাই না তপা?”

গলা ভীষণ ভারি হয়ে আছে রাফিদের, অদ্ভুত বিষাদ খেলা করছে সেখানে। তপা এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল রাফিদকে।

“আমি তো জানতাম তুমি উটকো কথার পরোয়া করো না। আজ কেন করছ?”

“কথাগুলো তো সত্যি, বাবাও বলে।”

“নিজের প্রতি বিশ্বাস হারাবে না রাফিদ। কখনো বদলে যাবে না, কথা দিয়েছিলে কিন্তু। কথা দিলে তা রাখতে হয়।”

রাফিদের কষ্টটা যে কোথায় তা তপা উপলব্ধি করতে পারে। ওর যন্ত্রণার সমস্তটা শুষে নিচ্ছে তপা, গভীর ভালোবাসায়।
………
ক্রমশ